You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তান বিমান বাহিনী

পূর্ব পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে এফ-৮৬ মডেলের এক স্কোয়াড্রন বিমান ছিল। এসব বিমান ঢাকায় মােতায়েন ছিল। এয়ার কমােডর ইনামুল হক যেভাবে তাঁর সাহসী ও অকুতােভয় বাহিনীকে পরিচালনা করেছেন তা সত্যি প্রশংসনীয়। প্রতিদিনই এসব জঙ্গিবিমান উড্ডয়ন করতাে এবং সংখ্যায় বিশাল শত্রু বিমানের প্রচুর ক্ষতি করতাে। ভারতীয় বিমানকে বরাবরই দৌড়ের ওপর রাখতাে। বিমান ভূপাতিত হলে স্থানীয় লােকজনের হাতে নিহত হতে হবে-এ কথা জেনেও আমাদের পাইলটরা শৌর্য-বীর্যের সঙ্গে আকাশে উড্ডয়ন করেছেন এবং কেউ কেউ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমাদের যেসব পাইলট প্যারাশুটের সাহায্যে অবতরণ করেছেন বাঙালিরা তাদেরকে কেটে টুকরাে টুকরাে করেছে। তাদের কেউ ফিরে আসেননি। অন্যদিকে, ভারতীয় পাইলটরা প্যারাশুটের সাহায্যে অবতরণ করলে তাদেরকে পাহারা দিয়ে নিরাপদে ভারত-অধিকৃত এলাকায় পৌঁছে দেয়া হতাে। কখনাে কখনাে আমাদের পাইলটদেরকে বিধ্বস্ত বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করতে হয়েছে। অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে তারা এ কাজ করতেন।  এয়ার কমােডর ইনাম তার স্বল্পপাল্লার রাডারে ভারতীয় সৈন্যদেরকে হেলিকপ্টারে করে মেঘনা নদী অতিক্রম করতে দেখেন এবং এ ঘটনা আমাকে অবহিত করেন। সময়মতাে এ সংবাদ পেয়ে সাদউল্লাহর ব্রিগেডকে আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজারে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেই। এভাবে ভারতের হেলিকপ্টারবাহিত সৈন্যরা ঢাকা ও আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের মাঝে আটকা পড়ে। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক যে, ঢাকা বিমানক্ষেত্র এত ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, ৬ ডিসেম্বরের পর এখান থেকে আমাদের কোনাে জঙ্গিবিমান উড্ডয়ন করতে পারেনি। এ কারণে গােটা পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে ভারতীয় জঙ্গিবিমান একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করে। আত্মসমর্পণের আগে আমরা আমাদের কিছুসংখ্যক পাইলটকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেই এবং বিমান বাহিনীর অবশিষ্ট সদস্যদের ঢাকার প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত করি।

সাজোয়া

কর্নেল বখতিয়ারের নেতৃত্বে সাজোয়া সৈন্যরা শত্ৰু ট্যাংকের বিরুদ্ধে তাদের ভ্রাম্যমাণ অভিযানের মাধ্যমে এবং আমাদের নিজস্ব পদাতিক বাহিনীর সহায়তায় তাদের যােগ্যতা প্রদর্শন করেছে। অস্ত্রশস্ত্র ও সংখ্যায় নগণ্য হয়েও তারা বরাবর সাহসিকতার সঙ্গে শত্রুর অত্যাধুনিক ট্যাংকের মােকাবেলা করেছে এবং উন্নত কৌশলের মাধ্যমে তারা শত্রুর সাঁজোয়া বাহিনীকে কোণঠাসা করে রেখেছে।

আর্টিলারি

আর্টিলারি ব্রিগেডিয়ার এস,এস,এ, কাসিম ছিলেন আমার আর্টিলারি কমান্ডার। তিনি ছিলেন একজন দক্ষ গানার এবং অগ্রবর্তী সৈন্যদের পরিদর্শনের সময় তিনি সবসময় আমার সঙ্গী হতেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানযােগে আসার কারণে আমাদের আর্টিলারি ফরমেশন ও ইউনিটগুলাে তাদের ভারী অস্ত্রগুলাে নিয়ে আসতে পারেনি। এ বাস্তব অসুবিধার মুখে ব্রিগেডিয়ার কাসিম প্রাপ্ত গানগুলাের সম্ভব সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করেন। ডিভিশন ও ব্রিগেডগুলাে ছিল তাদের কাজ-কর্মে প্রায় স্বাধীন। তবু তিনি তাদের গােলাবর্ষণ পরিকল্পনায় সমন্বয় সাধন করতেন এবং পরিকল্পনা চূড়ান্ত  করতেন। এসব পরিকল্পনা যুদ্ধকালে কার্যকর ও সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।

৬ হালকা এএ রেজিমেন্ট

লে, কর্নেল মােহাম্মদ আফজাল এ রেজিমেন্টের নেতৃত্বে ছিলেন। ঢাকায় ভারতীয় বিমান হামলার সময় কাসিম বরাবরই আশপাশে থাকতেন। যুদ্ধের পুরাে সময় জুড়ে শত্রুবিমান এ রেজিমেন্টের ওপর উপর্যুপরি হামলা চালিয়েছে। কিন্তু আমাদের সাহসী গানাররা নির্ভীকচিত্তে শত্রু বিমানের ওপর গােলাবর্ষণ করেছে। বিমান হামলার সময় আমি কোনাে একটি গান পিটে (বাংকারের যেখানে বিমান বিধ্বংসী কামান রাখা হয়) ছিলাম । ৬টি শত্রু বিমান আমাদের তিনটি গানপােস্টে হামলা চালায়। কামান চালকরা অত্যন্ত সাহস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে লড়াই করেন। এ লড়াই প্রায় ১০ মিনিট স্থায়ী হয়। দুটি শত্রু বিমান ধ্বংস হয় এবং বাদবাকিগুলাে পালিয়ে যায়। ১৬ ডিসেম্বর এ রেজিমেন্ট শেষবারের মতাে একটি ভারতীয় বিমান ভূপাপিত করে। এ বিমানটি ছিল একটি বােমারু বিমান। এ রেজিমেন্ট চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেছে। তারা ৩০টির বেশি শত্রু বিমান ভূপাতিত করেছে। সকল কৃতিত্বের দাবিদার হচ্ছেন আফজাল ও কাসিম। তারা ব্যক্তিগতভাবে রণনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন এবং শক্রকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন।

ইঞ্জিনিয়ার্স

আমাদের ইঞ্জিনিয়ারগণ পূর্ব পাকিস্তানের সংকটকালে মহৎ কাজ করেছেন। তাদের বিশ্রাম নেয়ার কোনাে সুযােগ ছিল না। অনেক সময় আমরা ইঞ্জিনিয়ারদের পদাতিক সৈন্য হিসেবে ব্যবহার করেছি। তাদেরকে ঘাটি রক্ষার দায়িত্ব অথবা গেরিলাদের গােপন আস্তানায় পদাতিক বাহিনীর অভিযানকালে অথবা অন্যান্য হামলায় পদাতিক বাহিনী এগিয়ে গেলে পদাতিক বাহিনীর পার্শ্বভাগ রক্ষার দায়িত্বও তাদের পালন করতে হতাে। সেতু নির্মাণ ও মেরামতের মাধ্যমে তারা পদাতিক বাহিনীর অগ্রযাত্রায় সহায়তা দিত। এছাড়া, তারা রাস্তাঘাট ও রেলসড়ক চলাচল উপযােগী রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করতাে। সুরক্ষিত ঘাঁটি ও দুর্গ প্রস্তুত ও নির্মাণে তাঁরা। গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতেন। ইঞ্জিনিয়ার বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শরীফ। তিনি খুবই সাহসী ও পরিশ্রমী ছিলেন। বিপদসংকুল জায়গা এবং শক্রর হামলাকালে তিনি তার সৈন্যদের অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করতেন। নিজের জীবনের ঝুঁকির চিন্তা না করে তিনি সম্ভব সংক্ষিপ্ততম সময়ে বিমানক্ষেত্র মেরামত করতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ-কর্ম দেখাশােনা করতেন। যােগাযােগ, সেতু ও রাস্তাঘাট পুনঃপ্রতিষ্ঠার মতাে দুরূহ কাজে তার দক্ষতার কোনাে তুলনা হয় না। ঢাকায় তাকে একটি সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা। হয় এবং তিনি অত্যন্ত সন্তোষজনকভাবে তার সেক্টরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠিত করেন।

সিগনাল

বরাবরই আমাদের সিগনালের তৎপরতা ছিল অত্যন্ত ভালাে। তারা শেষদিন পর্যন্ত জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এবং অগ্রবর্তী ইউনিটের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ বজায় রেখেছিল। এ কৃতিত্বের দাবিদার হচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার আরিফ রেজা। ব্রিগেডিয়ার রেজার দায়িত্ব ছিল খুবই কঠিন এবং তার সম্পদ ছিল অপর্যাপ্ত। কিন্তু তিনি যােগাযােগ সমস্যার জট খুলতে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। নবগঠিত এড়হক ফরমেশনগুলাের জন্য যন্ত্রপাতি, সুযােগ-সুবিধা ও জনশক্তি সরবরাহে তাঁর অবদান অতুলনীয়। ভারতীয়দের এগিয়ে আসার পূর্ব মুহূর্তে যােগাযােগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়া নাগাদ তিনি সকল ইউনিট, ফরমেশন ও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের মধ্যে যােগাযোেগ অক্ষুন্ন রেখেছিলেন।

হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন

লে. কর্নেল নিয়ামত বুখারীর কমান্ডে আমাদের হেলিকপ্টার স্কোয়াড্রন ন্যস্ত করা হয়। তিনি ছিলেন দক্ষ, বুদ্ধিমান ও একজন সাহসী কমান্ডার। টহলদার, রসদ সরবরাহ ও হতাহতদের স্থানান্তর করার কাজে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হতাে। আমাদের হেলিকপ্টারে কোনাে নাইট ভিশন অথবা নৈশকালে চলাচলের জন্য কোনাে যন্ত্রপাতি ছিল না। ২৩ নভেম্বর আমি খুলনা সেক্টর, ২৬ নভেম্বর বগুড়া সেক্টর এবং ৩ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ সেক্টর পরিদর্শন করি। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা দিনের বেলায় খুব একটা বের হতাম না। তখন রাতের অন্ধকারে আমরা কাজ করতে শুরু করি। রাতের বেলা কাজ করা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবু আমরা অত্যন্ত নৈপুণ্য ও সাহসের সঙ্গে নৈশ অভিযান চালাই। জেনারেল নজর হােসেন শাহ আহত হলে তার স্থলে মেজর জেনারেল জামশেদকে নিয়ােগ দেয়া হয়। জেনারেল জামশেদকে রাতে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। ঐ রাত ছিল খুবই অন্ধকার এবং হেলিকপ্টারগুলােকে মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় অবতরণ করতে হয়। এটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। কিন্তু আমি  একটি ডিভিশনে কমান্ডার নিয়ােগ না করে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। সকল পাইলটই এ বিপজ্জনক মিশনে যেতে চেয়েছিল। অন্ধকার রাতে মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হেলিকপ্টার অবতরণ করলে মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য তা দেখে ফেলে। পাইলট তাকে চিনে ফেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে উড্ডয়ন করে ফিরে আসেন। নৈশকালে উড্ডয়ন করতে গিয়ে একটি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়। তবে কেউ হতাহত হয়নি। ১৫/১৬ ডিসেম্বর রাতে সকল হেলিকপ্টার বার্মা গমন করে।

মেডিকেল সার্ভিসেস

মেডিকেল সার্ভিসের ব্রিগেডিয়ার ফাহিম আহমেদ খান অগ্রবর্তী অবস্থান অবধি চিকিৎসা সুবিধা পৌঁছে দেয়া এবং ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত হতাহতদের ঢাকা ও পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরের কাজে জড়িত ছিলেন। তার কাজ ছিল খুবই দুরূহ এবং ডিভিশনগুলােকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজেদের সম্পদের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। বহু অসুবিধা সত্ত্বেও তাকে শেষদিন পর্যন্ত এডহক ফরমেশনগুলােতে চিকিৎসা সহায়তা পাঠাতে হয়েছে।

ইপকাফ

পুরনাে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস বিদ্রোহ করার পর ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস গঠন করা হয়। এটা ছিল খুবই কঠিন কাজ এবং মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদের কাঁধে এ কাজ সমাধা করার দায়িত্ব চাপানাে হয়। জেনারেল জামশেদকে এ ব্যাপারে সহায়তা করেন তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ব্রিগেডিয়ার বশির আহমেদ। তারা নতুন করে তােক নিয়ােগ করেন। অনুগত লােকজন খুঁজে পাওয়া এবং তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া ছিল দুষ্কর। আমাদের নিয়মিত বাহিনী থেকে অফিসার ও নন-কমিশন্ড অফিসার নিয়ােগ করতে হতাে। উভয় ক্যাটাগরির অফিসারগণ ব্যতিক্রমধর্মী সাহস ও বিক্রমের পরিচয় দিতেন। মেজর জেনারেল জামশেদ ছিলেন আমার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড এবং ফরমেশন পরিদর্শনকালে আমি তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। তিনি সুপরামর্শ দিতেন। কারণ তিনি ছিলেন একজন সত্যিকার সৈনিক। তিনি ঢাকার প্রতিরক্ষার জন্য দায়ী ছিলেন এবং তিনি এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে কয়েক স্তরে ভাগ করেন। ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তর আমি ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর ব্রিগেডিয়ার এল-ইস চিফ অভ স্টাফ হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জিলানী খানের (পরে পাঞ্জাবের গভর্নর) কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। ব্রিগেডিয়ার জিলানী শুরুতে আমার ওপর অর্পিত মিশনের কাজ সম্পাদনে আমার নির্দেশ বাস্তবায়নের জন্য দায়ী ছিলেন। তিনি ভারতের সঙ্গে যুদ্ধকালে বিদ্রোহী ও মুক্তিবাহিনীর কর্মকাণ্ড দমনে প্রণীত অপারেশনাল পরিকল্পনাগুলাে পুনঃপরীক্ষার কাজও করেছিলেন। তার পদোন্নতি ঘটলে ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী তার স্থলাভিষিক্ত হন। সেনাবাহিনীতে একজন চৌকস ও মেধাবী অফিসার হিসেবে ব্রিগেডিয়ার বাকিরের বেশ সুনাম ছিল। তিনি ছিলেন সৎ, যােগ্য ও একজন সাহসী অফিসার। তিনি একসময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডারও ছিলেন। তিনি প্রায় সকল সেক্টরের ভূ-প্রকৃতির সঙ্গে পুরােপুরিভাবে পরিচিত ছিলেন। এজন্য তিনি আমাদের কাছে একটি বিরাট সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হন। তিনি এত দ্রুত আমার নির্দেশ বাস্তবায়ন করতেন যে, তা ছিল সত্যি বিস্ময়কর। একজন সৎ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন অফিসার হিসেবে তিনি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় সংকটপূর্ণ পরিস্থিতি মােকাবেলা করতেন। তিনি আমাকে হামুদ-উর-রহমান কমিশনের জন্য। রিপাের্ট তৈরিতে সহায়তা করেন। টিক্কা ও ভুট্টোর ভয়ে যেখানে অন্যান্য সবাই। আমাকে ত্যাগ করেছিল অথবা আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, সেখানে ব্রিগেডিয়ার বাকির পাহাড়ের মতাে অটল হয়ে আমার পাশে দাড়ান। তিনি কোনাে প্ররােচনা ও প্রলােভনের কাছে মাথা নত করেননি। তার নিজের কোনাে দোষ না। থাকা সত্ত্বেও তিনি দুর্ভোগ পােহান। তিনি ছিলেন পরিস্থিতির শিকার। আমাদের সামরিক ব্যবস্থায় কমান্ডারের কার্যকলাপের জন্য তার স্টাফ অফিসার দায়ী নয়। কিন্তু আমার প্রতি অবিচল আনুগত্য থাকায় তাকে বলি পাঠা বানানাে হয়।

গণসংযােগ

জাতীয় পর্যায়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিল আমাদের সমস্যাকে আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরা। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় সে কাজে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। টিক্কা সকল বিদেশি সাংবাদিককে বের করে দেয়ায় তারা অতিরঞ্জিত রিপাের্ট প্রকাশ করতে থাকে। আমি এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করি। আমার পিআরও সিদ্দিক সালিক। ছিল তরুণ ও অনভিজ্ঞ। সুতরাং আমি আন্তঃবাহিনী গণসংযােগ (আইএসপিআর) অধিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার আবদুল রহমান সিদ্দিকীর সহায়তা কামনা করি। তিনিই ছিলেন জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের একমাত্র কর্মকর্তা যিনি নিয়মিত ঢাকা সফর করতেন। তিনি বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার সাংবাদিকদের সঙ্গে যােগাযােগ করতেন, তাদের সঙ্গে বৈঠকের আয়ােজন করতেন এবং এভাবে। আমাদের ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টা করেন। আমি বুঝতে পারছিলাম যে, জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে তথ্য না পাওয়ায় তিনি অসুবিধার মুখােমুখি হচ্ছেন। সুতরাং আমরাই হয়ে উঠি তার একমাত্র ভরসা। আমাদের সঙ্গে তার যােগাযােগ, সংবাদপত্রের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে আমার স্টাফকে দিকনির্দেশনা দান, তার সাংবাদিক সম্মেলন এবং স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার যােগাযােগে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে। কখনাে কখনাে সাংবাদিকরা অগ্রবর্তী অবস্থান পরিদর্শনকালে আমার সঙ্গী হতেন এবং গােলাগুলির মধ্যে পড়ে যেতেন। পাকিস্তানেও সাহসী সাংবাদিকদের অভাব ছিল না। হিলিতে আমার সফরকালে শক্রর অবিরাম গােলাবর্ষণে জনাব সুবহানী প্রায় মরেই গিয়েছিলেন।

পিআইএ মনে পড়ে শুরুতে পিআই’এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাকির উল্লাহ্ দুররানী আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং তিনটি হালকা ডিভিশন ঢাকায় পরিবহনের বিষয় নিয়ে আলােচনা করেন। একটি রেকর্ড সময়ে এসব সৈন্য পরিবহন হচ্ছে পিআইএ’র একটি অনন্য কৃতিত্ব এবং এজন্য দুররানী গর্ব করতে পারেন। বার্লিনে সৈন্য পরিবহনের সঙ্গে এর তুলনা করা যেতে পারে। সীমিত সম্পদ নিয়ে পিআইএ একটি বিস্ময়কর দায়িত্ব পালন করেছে এবং ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্রীলংকা হয়ে ঘােরালাে রুটে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা দান অব্যাহত রেখেছেন। সিএসপি ও পুলিশ অফিসার। চিফ সেক্রেটারি মি. মুজাফফর হুসাইন, তার মেধাবী বেসামরিক অফিসাররা এবং পুলিশের আইজি এমএকে চৌধুরী ও তার যােগ্য পুলিশ কর্মকর্তারা এক অসম্ভব কাজ করেছেন। সামরিক অভিযানের পর স্থানীয় প্রশাসন ভেঙে পড়ে। এসব। অফিসারগণ বেসামরিক প্রশাসন পুনর্গঠিত ও পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তারা ছিলেন পাকিস্তান ব্যুরােক্রেসির অত্যন্ত মেধাবী অংশ। কিন্তু তাদেরকে প্রতি মাসে নামমাত্র ৫ টাকা স্টাইপেন্ডে বেরিলিতে যুদ্ধবন্দি শিবিরে ইন্টার্নি হিসেবে লাঞ্ছিত জীবন বেছে নিতে হয়। আমার জানা মতে, তারা বেসামরিক-সামরিক সহযােগিতায় এক অসাধারণ উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করায় আমরা তাদের জন্য গর্বিত।

নােটস

১. সুখবন্ত সিং, দ্য লিবারেশন অভ বাংলাদেশ, বিকাশ, নিউদিল্লী, ১৯৭৯

২. ইবিদ।

৩. ফজল মুকিম, ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ, অপ, সিট, পৃষ্ঠা-১৭৯।

৪. তাজাম্মল হুসাইন মালিক, দ্য স্টোরি অত মাই স্ট্রাগল ।

৫. ইন্ডিয়ান আর্মি আফটার ইনডিপেনডেন্স।

৬. সুখবন্ত সিং দ্য লিবারেশন অভ বাংলাদেশ, অপ সিট।

৭. মেজর জেনারেল ডি.কে পালিত, দ্য লাইটানিং ক্যাম্পেইন, কটন, সালিসবারি, ইংল্যান্ড, ১৯৭২।

৮, সিডনি এইচ শামবার্গ, নিউইয়র্ক টাইমস।

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!