You dont have javascript enabled! Please enable it!

সেক্টর ভিত্তিক যুদ্ধ

রাজশাহী, রংপুর, হিলি, বগুড়া এ সেক্টরের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল ১৬ ডিভিশন যার সদর দপ্তর ছিল নাটোরে । ২৩, ১০৭ ও ২০৫ ব্রিগেড নিয়ে গঠিত এ ডিভিশনের কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্। ব্রিগেডিয়ার সাঈদ আখতার আনসারীর নেতৃত্বাধীন ২৩ ব্রিগেড দিনাজপুর-রংপুরের প্রতিরক্ষার জন্য দায়ী ছিল। পরে অদক্ষতার জন্য আনসারীকে ২৩ ব্রিগেডের কমান্ড থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ডিভিশনাল কমান্ডার তার সামরিক অপারেশন পরিচালনায় পুরােপুরি অসন্তুষ্ট ছিলেন। তার স্থলাভিষিক্ত করা হয় ঢাকার লজিস্টিক এরিয়া কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার শফিকে। ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হুসেইন ২০৫ ব্রিগেড কমান্ড করতেন, যিনি হিলির প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। শত্রুর ক্ষতিসাধন করার পর তাকে পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী বগুড়ায় প্রত্যাহার করা হয়। থার্ড ব্রিগেড ১০৭-এর নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার নাঈম। এ ব্রিগেড অভ্যন্তরে মােতায়েন ছিল এবং পানিটোলা, নবাবগঞ্জ ও ঈশ্বরদীতে এ ব্রিগেডের এক ব্যাটালিয়ন করে সৈন্য মােতায়েন ছিল।  মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহর বিপরীতে ছিলেন ভারতের ৩৩ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল থাপন। তার কমান্ডের অধীনে ছিল ২০ মাউন্টেন ডিভিশন, ৬ মাউন্টেন ডিভিশন, ৩৪০(১) ব্রিগেড গ্রুপ, ৪৭১ ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেড, ৩৩ আর্টিলারি ব্রিগেড, ৬৪ ক্যাভালরি (পিটি-৭৬) ও ৭২ সাজোয়া রেজিমেন্ট (টি৫৫)। এছাড়া, তার অধীনে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড এবং কয়েক ব্যাটালিয়ন বিএসএফ ছিল। ৬ মাউন্টেন ডিভিশন আমাদের ২৩ ব্রিগেডের এলাকায় অগ্রসর হয় ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর। ভারতীয়রা রংপুরের উত্তরে লালমনিরহাট দখলের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। তবে তাদের প্রতিটি প্রয়াস অত্যন্ত সফলভাবে প্রতিহত করা হয়। ২৫ নভেম্বর তাদের হামলা নস্যাৎ করে দেয়া হয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী উত্তর-পশ্চিমে তিস্তা সেতু ধ্বংস করে দেয়। এ সেতুটি ছিল রংপুর অভিমুখী প্রধান। সড়কের ওপর। আমাদের সৈন্যরা ধীর-স্থিরভাবে লড়াই করে। এতে অগ্রগামী শত্রু বাহিনীর উল্লেখযােগ্য ক্ষতি হয়। আমাদের সৈন্যরা পরিকল্পনা অনুযায়ী পেছনে হটে আসে এবং রংপুর দুর্গ দখল করে। শক্রর অগ্রযাত্রা থেমে যায় এবং তাদের প্রথম পদক্ষেপ চূর্ণ হয়ে যায়। প্রাণান্ত চেষ্টা করেও শক্ররা অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। এবং শেষ দিন পর্যন্ত তারা আমাদের অবস্থান ঘেরাও করতে পারেনি। ভারতের ৭১ ব্রিগেড দিনাজপুরের দিকে এগোয়। বীরগঞ্জে তাদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেয়া হয়। কোনাে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি সাধনে ব্যর্থ হয়ে শক্র দিনাজপুর ও অন্যান্য অবস্থানের মাঝে সড়ক অবরােধের প্রচেষ্টা চালায়। আমাদের সরবরাহ লাইন উন্মুক্ত থাকায় এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

এরপর ভারতীয়রা আমাদের অবস্থান ঘেরাও করার লক্ষ্যে দিনাজপুরের দক্ষিণে ৯ মাউন্টেন ব্রিগেডকে নিয়ােজিত করে। এ উদ্যোগ কোনাে স্থায়ী প্রভাব সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয় এবং আমাদের অবস্থানগুলাে অক্ষত থেকে যায়। প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত সৈন্যদের মনােবল তখনাে উচু ছিল। ব্রিগেডিয়ার শফি স্থানীয় সম্পদের উপযুক্ত ব্যবহার এবং রণক্ষেত্রের সুবিধা কাজে লাগিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তার ব্রিগেডকে পরিচালনা করেন। তিনি ভারতীয় সৈন্যদেরকে তার প্রতিরক্ষা ব্যুহের সামনে যুদ্ধে লিপ্ত রাখেন এবং লড়াই শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে সেখানেই আটকে রাখেন। ব্রিগেডিয়ার শফিকে আমিই ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করেছিলাম। এ ব্রিগেডের দায়িত্ব ছিল দিনাজপুর-রংপুর ধরে রাখা এবং ভারতীয় সৈন্যদেরকে সামনে অগ্রসর হতে না দেয়া। ব্রিগেডিয়ার আনসারী যেসময় ২৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন সেসময় প্রাথমিক সাফল্যে ভারতীয়রা দুঃসাহসী হয়ে ওঠে। ভারতীয় নেতৃত্ব ভেবেছিল যে, এ সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর সহযােগিতায় বিএসএফ পাকিস্তানি সৈন্যদের মােকাবেলা করতে পারবে। তাই তারা ৬ ডিভিশনকে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মােতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিগেডিয়ার শফি কমান্ড গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের মােড় ঘুরে যায়। তাদের আক্রমণাত্মক অবস্থান আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে রূপ নেয়। ব্রিগেডিয়ার শফি শক্রর যােগাযােগ ব্যবস্থা, অস্ত্র মজুদ ও তাদের সদরদপ্তরে দুঃসাহসী হামলা চালান। এবং শক্রর অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেন। অগ্রগতি না হওয়ায় ভারতীয়রা ৬ ডিভিশন স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বাতিল করে। পাকিস্তানি সৈন্যদের অদম্য স্পৃহার সামনে মাথানত করতে বাধ্য হয় ভারতীয় সৈন্যরা। ভারতীয় সৈন্যরাই যেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের মােকাবেলা করতে পারেনি সেখানে বিএসএফ ও মুক্তিবাহিনীর মােকাবেলা করার প্রশ্নই আসে না। ২৩ ব্রিগেডকে অনেক কঠিন কাজ করতে হয়েছে। একদিকে, তাদেরকে যুদ্ধ করতে হয়েছে এবং অন্যদিকে অনুগত পাকিস্তানিদেরও রক্ষা করতে হয়েছে।

বিদ্রোহিরা সংখ্যালঘু বিহারিদের হত্যা করতে শুরু করে। তাই এসব নিরীহ। লােকজনকে রক্ষার দায়িত্ব এ ব্রিগেডের ওপর ন্যস্ত হয়। এ ব্রিগেডকে হিলির দক্ষিণে ২০৫ বিগ্রেডের উভয় পার্শ্ব রক্ষার এবং বগুড়া ও ঢাকা অভিমুখী সড়ক অবরােধে ব্যবহার করা হচ্ছিল। হিলিতে তখন চলছিল প্রচণ্ড লড়াই। তাই আমি ২৩ ব্রিগেডকে দিনাজপুর-রংপুর সেক্টর থেকে প্রত্যাহার করে হিলির দক্ষিণে মােতায়েন করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের সরাসরি নির্দেশে (৫ ডিসেম্বর প্রেরিত সংকেত) আমাকে এ সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হয়। ভারতের ৬ মাউন্টেইন। ডিভিশনকে এখানে ব্যস্ত রাখার জন্যই এ নির্দেশ দেয়া হয়। নয়তাে এ ডিভিশনকে। পশ্চিম রণাঙ্গনে স্থানান্তর করা হতাে। পশ্চিম রণাঙ্গনের অনুকূল পরিস্থিতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি না করার জন্য আমরা এ নির্দেশ মেনে নিই। পশ্চিমে পাকিস্তানি অভিযানের সাফল্যের স্বার্থে আমি আমার কৌশলগত পরিকল্পনা উৎসর্গ করি। ২০৫ ব্রিগেড গ্রুপের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হুসেইন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে হিলির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। তিনি নােয়াপাড়া রেললাইন, বাসুদপুরা। চেকপােস্ট ও রেলওয়ে স্টেশনে পর্যবেক্ষণ চৌকি প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব পাকিস্তান অভিমুখী সকল পথ রক্ষায় অভ্যন্তরেও কয়েকটি সুরক্ষিত অবস্থান গড়ে তােলা হয়। ৪ এফ এফ ও ১৩ এফএফ ব্যাটালিয়নের জওয়ানরা এসব অবস্থান অত্যন্ত। কার্যকরভাবে রক্ষা করছিল। একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট, একটি মর্টার ব্যাটারি, এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক এবং পর্যবেক্ষণ গ্রুপের সদস্য ও একটি সাপাের্ট ব্যাটালিয়নও সহায়তা দিচ্ছিল। এ আত্মরক্ষামূলক অবস্থানের গভীরতা ছিল দু’ হাজার পাঁচশ গজ।  হিলির যুদ্ধ ছিল ১৯৭১ এর সর্বোত্তম যুদ্ধ। সাহসী পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতের ৩৩ কোরের অধিকাংশ সৈন্যকে এখানে আটকে রাখে, ভারতের এ কোরকে ট্যাংক ও জঙ্গি বিমান সহায়তা দিচ্ছিল। হিলি এলাকাটি হচ্ছে সমতল, অনেকটা পাঞ্জাবের মতাে মাটি শক্ত।

এতে সৈন্য ও ভারি সামরিক যানবাহন চলাচল সহজতর। ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হুসাইনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভারতের অনবরত ও উপর্যুপরি হামলার বিরুদ্ধে অজেয় বলে প্রমাণিত হয়। তার অবস্থান পাশ কাটিয়ে যাবার ভারতীয় প্রচেষ্টা নিস্ফল হয়। ভারতীয়রা আমাদের অবস্থান দখল করার জন্য একেকবার একেকটি কৌশল অবলম্বন করতে থাকে, কিন্তু তাদের প্রতিটি কৌশলই ব্যর্থ হয়। ভারতের ২০ মাউন্টেন ডিভিশনকে মােতায়েন করা হয় বালুরঘাটে। এটি আমাদের অবস্থানে হামলার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। মুক্তিবাহিনী আমাদের প্রতিটি অবস্থানের বিস্তারিত বিবরণ ভারতীয়দের সরবরাহ করে। অন্ত্রের অবস্থানগুলােও  চিহ্নিত করা হয়। হিলি হচ্ছে হিলি-গাইবান্ধা মেরুর প্রবেশদ্বার- এখান থেকেই বগুড়া ও ঢাকা অভিমুখী সড়ক এগিয়ে গেছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনী হিলিতে উপর্যুপরি হামলা চালাতে থাকে। তবে তাদের প্রতিটি হামলাই ব্যর্থ হয়েছে। হিলি একটি দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যুহে পরিণত হয়। আশপাশের গ্রামগুলােকেও এ ব্যুহের আওতায় নিয়ে আসা হয়। খাল, পুকুর ও জলাভূমিগুলাের পূর্ণ ব্যবহার করা হয়। শত্রু পক্ষের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ ও তাদের গােলাবর্ষণ প্রতিহত করার জন্য সুরক্ষিত ট্রেঞ্চ খনন করা হয়। একটির সঙ্গে আরেকটি ট্রেনের আন্তঃ যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ট্রেঞ্চগুলােয় মাঝারি মেশিনগান ও রিকয়েললেস রাইফেল বসানাে হয়। এলাকা থেকে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২৪ নভেম্বর ভারতীয়রা এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে দক্ষিণ দিক থেকে মােরাপাড়া এ হামলা করে। শত্রুরা আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসা মাত্র আমাদের সুরক্ষিত অবস্থানগুলাে থেকে একযােগে সবগুলাে মেশিনগান গর্জে ওঠে । আমাদের মেশিনগান, আর্টিলারি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ এবং জলাভূমি ও কাঁটাতারের বাধার মুখে তাদের এগিয়ে আসার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।  ভারতীয়রা বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং তাদের ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে। শক্রদের মাত্র কয়েক প্লাটুন সৈন্য গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তে পৌছতে সক্ষম হয়। সে গ্রামে হাতাহাতি লড়াই হয়। আরাে কয়েক ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য এ গ্রামের উত্তর-পূর্ব দিক থেকে এগিয়ে আসে। সৈন্যদের দৃঢ়তা ও সাহসিকতার মুখে শক্ররা এ গ্রাম থেকে সরে যেতে বাধ্য হয় এবং এভাবে এখানে ভারতীয় হামলা ব্যর্থ হয়। ভারতীয়রা এক ব্রিগেড সৈন্য নিয়ে হিলিতে হামলা করেছে বলে যে দাবি করেছে তা অযৌক্তিক। এটা হচ্ছে তাদের অভিযানের ব্যর্থতা আড়াল করার একটি ঘৃণ্য প্রচেষ্টা। তারা যদি শুধুমাত্র এক ব্রিগেড সৈন্য ব্যবহার করে থাকে, তাহলে তাদের ২০ ডিভিশনের অন্যান্য ব্রিগেডগুলাে হিলির আশপাশে দশ দিন কি করে কাটিয়েছে? একটি পাকিস্তানি ব্রিগেড ভারতের একটি ডিভিশনকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছে। ভারতের এ ডিভিশন গােলন্দাজ বাহিনী ও জঙ্গিবিমানের ছত্রছায়া নিয়েও মার খেয়েছে।

২০ মাউন্টেন ডিভিশনে ছিল পাঁচটি পদাতিক ব্রিগেড, একটি ট্যাংক ব্রিগেড, প্রায় অর্ধ ডজন বিএসএফ ব্যাটালিয়ন ও মুক্তিবাহিনী। এছাড়া, এ ডিভিশনকে ডিভিশনাল ও কোর আর্টিলারিও সমর্থন দিয়েছে। আকাশে ছিল ভারতীয়দের পূর্ণ কর্তৃত্ব। কোনাে পাকিস্তানি বিমান ভারতীয়দের চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি। অন্যদিকে, প্রতিদিন অন্তত কয়েকবার আমাদের অবস্থানে ভারতের বিমান। হামলা হয়েছে। ভারতীয় জেনারেল সুখবন্ত সিং স্বীকার করেছেন যে, লে. জেনারেল থাপনের নেতৃত্বাধীন পাঁচটি ব্রিগেড হিলি দুর্গ অবরােধে অংশগ্রহণ করেছিল। 

ভারতীয়রা তাদের প্রথম হামলায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয় চার জন। অফিসার মারা যায় ও তিন জন আহত হয়। এছাড়া, দুজন নন-কমিশন্ড অফিসার ও ৬১ জন অন্য ব্যাংকের সৈন্য মারা যায় এবং ৮৫ জন আহত হয়। বালুরঘাটের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও ভারতীয়রা কোনাে অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় জনগণ শক্র কমান্ডারকে হিলিতে পাকিস্তানি সৈন্য, তাদের অস্ত্রশস্ত্র, অবস্থান ও চলাচল সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করেছিল।  ‘সমগ্র বাংলাদেশে হিলিই হচ্ছে একমাত্র দুর্গ যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান চূর্ণ করে দেয়ার জন্য মরণপণ লড়াই করেছে। এখানে পাকিস্তানি দুর্গে ভারতীয় হামলা নিষ্ফল বলে প্রমাণিত হয়। ভারতীয়দের পূর্বেকার কৌশল ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে মুখােমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া। কিন্তু হিলি। অপারেশনে ব্যর্থতার পর তারা তাদের এ কৌশল পরিবর্তন করেন। এরপর ভারতীয়রা পাকিস্তানি অবস্থানে হামলা করার পরিবর্তে পাকিস্তানি অবস্থান এড়িয়ে যেতে থাকে। আল-আমিনীয় ধারণা যা এতদিন পুরনাে প্রজন্মের জেনারেলদের। মগজে বদ্ধমূল ছিল, তার পরিসমাপ্তি ঘটে।

মেজর জেনারেল লক্ষণ সিং, ভারতের ২০ ডিভিশনের কমান্ডার, করতােয়া থেকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি ৬৬ ও ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেড নিয়ে হামলা করেন উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে। তিনি সংযােগ সাধন অথবা চরকাই-হিলি। দখল কোনােটাই করতে পারেননি। আমাদের সৈন্যরা তার নেতৃত্বাধীন ৩৪০ ও ১৬৫ মাউন্টেন ব্রিগেডকে এত ব্যতিব্যস্ত করে তােলে যে, এ দুটি ব্রিগেড না পারছিল পুনরায় সংগঠিত হতে অথবা না পারছিল পিছু হটতে। এ ভারতীয় ভ্রাম্যমাণ বহর আমাদের পার্শ্বদেশ অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে। কিন্তু তারা বগুড়া থেকে বের হতে পারেনি। ২০২ মাউন্টেন ব্রিগেডকে পাঠানাে হয় হামলা জোরদার করার জন্য। কিন্তু আমাদের সৈন্যরা এ ব্রিগেডের ওপর এত তীব্র হামলা চালায় যে, এতে শুধু তাদের অগ্রযাত্রাই ব্যাহত হয়নি, বরং তাদের পিছু হটার পথও বন্ধ হয়ে যায়। ২০ মাউন্টেন ডিভিশনের সকল ব্রিগেড় তাদের অপারেশনকে আরাে এগিয়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে পায়ের নিচে এক টুকরাে নিরাপদ জায়গা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালায়। আমাদের মাত্র একটি কোম্পানি ভাদুরিতে ভারতীয় এ ডিভিশনের হামলা প্রতিহত করে। এ কোম্পানির হামলায় শক্রদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং তাদের অগ্রযাত্রা ব্যর্থ হয়ে যায়। ভাদুরিতে ভয়াবহতম যুদ্ধ হয়। পাকিস্তানিদের দৃঢ়তা ও কঠিন সংকল্পের জন্যই এ প্রতিরােধ গড়ে তােলা সম্ভব হয়। জনশক্তি ও অস্ত্রশস্ত্রে শ্রেষ্ঠত্ব এবং স্থানীয় জনগণের নিরংকুশ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সৈন্য ও অফিসাররা পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসারদের সমকক্ষ ছিল না। কিন্তু তা সত্ত্বেও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশে ১১ ডিসেম্বর আমাদের সৈন্যদের প্রত্যাহার এবং আমাদের অবস্থান ছেড়ে দিতে হয়।  জেনারেল সুখবন্ত সিং তার লিবারেশন অভ বাংলাদেশ” বইয়ে মজার বিশ্লেষণ দিয়েছেন : ‘থাপন (ভারতীয় কোর কমান্ডার) কি কোনাে ভূখণ্ড দখল করতে পেরেছেন? যুদ্ধ বিরতিকালে তিনি আত্রাই নদীর পূর্ব দিকের সকল ভূখণ্ড, বালুঘাটের উত্তরাংশ এবং কটিদেশের এক উল্লেখযােগ্য ভূমি দখল করেছেন। কিন্তু দিনাজপুর, সৈয়দপুর, রংপুর, রাজশাহী ও নাটোরের মতাে সকল গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল তার নাগালের বাইরে এবং এসব শহরে তখনাে পাকিস্তানিদের অব্যাহত প্রতিরােধ গড়ে তােলার সামর্থ্য ছিল।

এ অভিযান কি প্রতিপক্ষ বাহিনীর মনােবল ও সামর্থ্য বিকল করে দেয়ার মতাে সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে? দৃশ্যত না। কুড়ি হাজার সৈন্যের মধ্যে মাত্র পাঁচ শতাধিক সৈন্য যুদ্ধবিরতির পর থাপনের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। লড়াইয়ে যেসব অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস অথবা দখল করা হয়েছে তার পরিমাণও ছিল নগন্য। এতে পাকিস্তানি সৈন্যের কমান্ডারের সামরিক সামর্থ্য কোনােক্রমেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, উত্তর-পশ্চিম সেক্টরে লড়াই নিয়াজির পতনে উল্লেখযােগ্য। অবদান রাখতে পারেনি। কেন এমন হলাে? জেনারেল থাপনের কমান্ডার (লে. জেনারেল অরােরা) তার ওপর যে অনির্ধারিত দায়িত্ব অর্পণ করেছিলেন, সেখানেই এ ব্যর্থতার কারণ নিহিত রয়েছে। এসব দায়িত্বের মধ্যে ছিল ৮ দিনের মধ্যে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও হিলি দখল এবং হিলি-গাইবান্ধা কটিদেশ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া এবং এরপর পরিস্থিতি অনুযায়ী রংপুর অথবা বগুড়ায় মিলিত হওয়া। পাকিস্তানের ১৬ ডিভিশনের পুরােটা অথবা এর বড় অংশকে ঢাকা প্রত্যাহারে বাধা দেয়া কি সেনা কমান্ডারের ইচ্ছে ছিল? তখন প্রথমেই ফুলছড়ি, সিরাজগঞ্জ ও বেড়াঘাটের ফেরি দখল করার পরিকল্পনা করা হয় শুধুমাত্র যে অংশটা ওয়েস্ট লাইনের উত্তরে পড়েছে সেটুকু বাদ দিয়ে। সেনা কমান্ডার কি চেয়েছিলেন যে, থাপন যমুনা অতিক্রম করে ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে যাক? অবশ্যই প্রাথমিক পরিকল্পনা প্রণয়নকালে এসব চিন্তা করা হয়নি কিন্তু মনে হচ্ছে এ ক্ষেত্রে তার অন্য কোনাে চিন্তা ছিল।  ১২ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত তখন ঢাকার অবস্থা খুব নাজুক ছিল, তখন সেনা কমান্ডার কয়েকটি ভারী ট্যাংক ও মাঝারি ট্যাংকসহ একটি ব্রিগেডকে নদীর অপর পাড়ে পাঠানাের জন্য প্রাণান্ত অথচ ব্যর্থ চেষ্টা করেন। জেনারেল থাপনের সৈন্যরা। ফুলছড়ি ফেরিঘাট দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু স্থল ও বিমান হামলায় এ ফেরিঘাট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা ব্যবহারের অযােগ্য হয়ে পড়ে। সিরাজগঞ্জ ও বেড়াঘাট ব্যবহার নিরাপদ ছিল না। এ দুটি ঘাট ছিল বগুড়া থেকে অনেক দূরে। এগুলাে দখল করা কোরের দায়িত্বের মধ্যে ছিল না।

এটা দেখা যাচ্ছে যে, সার্বিক পরিকল্পনা প্রণয়নকালে ধারণা সঠিক খাতে পরিচালিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, থাপনের সেক্টর থেকে ঢাকার প্রতি একটি সমন্বিত হুমকি সৃষ্টির লক্ষ্যে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ২য় কোরের সঙ্গে প্রাথমিক যােগাযােগ নিশ্চিত করার কোনাে প্রচেষ্টা এ পরিকল্পনায় নেই। সে সময় থাপনের সেক্টর থেকে ঢাকার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করার প্রচুর সুযােগ ছিল। বাইরের সামরিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আগে যুদ্ধ শেষ এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের শিগগির আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য একটি আঁটসাট সময় নির্ধারণের গুরুত্বের ওপরও সেনা কমান্ডার কখনাে জোর দেননি। মনে হচ্ছে, তিনি দুটি বিষয়ে দোদুল্যমানতায় ভুগছিলেন একটি  হচ্ছে, তার সৈনদের সাফল্য সম্পর্কে তিনি কী প্রত্যাশা করছিলেন এবং আরেকটি হচ্ছে, সাফল্য অর্জনে তাদের সামর্থ্য সম্পর্কে তার মূল্যায়ন। ফলে তিনি তার যুদ্ধের লক্ষমাত্রা নির্ধারণে ব্যর্থ হন। তাঁর অধঃস্তন কমান্ডার ও তাদের অধীনস্থ সৈন্যরা সার্বিক লক্ষমাত্রায় উল্লেখযােগ্য অবদান রাখা ছাড়াই এক লক্ষ্য থেকে আরেক লক্ষ্যে ছুটোছুটি করেছেন। ৭ ডিসেম্বরের পরে থাপন তার সেক্টরে মােতায়েনকৃত প্রায় ৬ ব্রিগেড সৈন্যের পুরাে ক্ষমতাকে লড়াইয়ে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন। এর মধ্যে মাত্র একটি ব্রিগেড আক্রমণাত্মক অবস্থানে ছিল এবং বাদবাকি ৫টি ব্রিগেড পাকিস্তানি দুর্গ অবরােধে সময় কাটিয়েছে।’  হিলি দুর্গ দখলে ভারতীয় সৈন্যদের অক্ষমতা হচ্ছে এ প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের মৌলিক শক্তির একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। জনবল, অস্ত্রশস্ত্র, সাজসরঞ্জামে একচেটিয়া শ্রেষ্ঠত্ব এবং বিমান বাহিনীর কার্যকর সহায়তা সত্ত্বেও এ দুর্গের শক্তি এবং দুর্গ রক্ষায় নিয়ােজিত সৈন্যদের কাছে ভারতীয়রা হেরে গেছে । ১৬ ডিভিশনের কমান্ডারের নির্দেশে ১১ ডিসেম্বর অগ্রগামী শত্রুদের হামলা থেকে বগুড়া রক্ষার প্রয়ােজনে হিলি দুর্গে মােতায়েন সৈন্যরা শত্রুর অবরােধ ভেঙে বগুড়া পৌঁছে। ৩৩ ভারতীয় কোর দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়ায় আমাদের দুর্গ দখলে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধবিরতি নাগাদ সবগুলাে দুর্গ তখনাে শত্রুর হামলা মােকাবিলা করছিল। যারাই আমাদের সীমানায় প্রবেশ করেছে তাদেরকেই বেয়নেট দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পাল্টা হামলা চালিয়ে হারানাে অবস্থানগুলাে পুনর্দখল করা হয়। মেজর জেনারেল (অব:) ফজল মুকিম বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন : ‘৯ ডিসেম্বর দিনের চতুর্থ দফা হামলায় হিলির পতন ঘটে। অফিসার ও সৈন্যরা এত ক্লান্ত ছিল।

যে তারা হাঁটতেও পারছিল না। হিলির পতন ৯ ডিসেম্বর ঘটেনি। ১৬ ডিভিশনের জিওসির স্পষ্ট নির্দেশে ১১ ডিসেম্বর সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়। শক্রর হাতে কোনাে এলাকার পতন ঘটা এবং একটি সার্বিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কোনাে একটি অংশের প্রতিরক্ষায় অন্য কোনাে অংশ থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের মাঝে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। আমরা সৈন্য প্রত্যাহার করার পর ১১ ডিসেম্বর ভারতীয়রা হিলি দুর্গ দখল করে, ৯ ডিসেম্বর নয়।  ‘৩২ বালুচ রেজিমেন্টের সঙ্গে সংযুক্ত মেজর শহীদের নেতৃত্বাধীন ২৩ পাঞ্জাবের একটি কোম্পানি এসব অপারেশনকালে বস্তুতপক্ষে নির্মূল হয়ে যায়। যে ক’জন জীবিত ছিল তারাও বন্দি হয়। এ সময় হাবিলদার হুকাম দাদ এক বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন ২৩ পাঞ্জাবের কোম্পানি কমান্ডার মেজর সাজিদ ছিলেন। মূল সড়কের পূর্বাংশে। দক্ষিণ দিক থেকে এগিয়ে আসা শত্রুদের হাতে বন্দি হন তিনি। সাজিদের নেতৃত্বাধীন কোম্পানির হাবিলদার হুকাম দাদ উত্তর ও দক্ষিণে সংযােগ সাধনে শত্রুর তিনটি হামলা ব্যর্থ করে দেন। ভারতীয় মেজর তার হাতে লপি মেজর সাজিদকে হাবিলদার হুকামকে হামলা বন্ধের নির্দেশ দিতে বলেন। সাজিদ এ নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জানালে একটি ভারতীয় সৈন্যদল হুকাম দাদের অবস্থানে হামলা চালায়। তার অবস্থানে নিঃসঙ্গ অবস্থায় হুকাম হামলাকারী সৈন্যদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। এতে তিনজন শত্রু সেনা নিহত হয়। অন্যান্যরা পিছু হটে যায় হামাগুড়ি দিয়ে। আরাে উত্তেজিত হয়ে ভারতীয় সেই মেজর পাকিস্তানি মেজর সাজিদের বুকে রিভলভার ঠেকিয়ে হুকাম দাদকে হামলা বন্ধের নির্দেশ দিতে চাপ দিতে থাকে। মেজর সাজিদ চিৎকার করে হুকাম দাদকে নির্দেশ দেন হামলা বন্ধ করতে। জবাবে সে বলল, সাহেব, মনে হচ্ছে আপনার গুলি ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনাে আমার কাছে দুটি ম্যাগাজিন আছে। চিন্তা করবেন না, আমার যথেষ্ট বুলেট আছে ৪  এটা হলাে সেই সেক্টর সেখানে মাপারা এলাকায় সাহসিকতার জন্য ৪ এফএফএর কোম্পানি কমান্ডার মেজর আকরামকে মরণােত্তর নিশান-ই-হায়দার উপাধি দেয়া হয়। ২০৫ ব্রিগেড অত্যন্ত চমৎকারভাবে লড়াই করেছে। ৪ এফএফ-এর লে, কর্নেল আব্বাসী আহত হন এবং তাকে সরিয়ে নেয়া হয়।

হিলির মতাে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে লড়াইয়ে লিপ্ত থাকায় আমি ৪ এফএফ-এ একজন ভালাে কমান্ডিং অফিসার নিয়ােগ না করে স্বস্তি পাচ্ছিলাম না। তাই আমি ১৯৭১-এর ২৬ নভেম্বর এ এলাকা সফরকালে আমার জেনারেল স্টাফ অফিসার লে. কর্নেল মমতাজকে সঙ্গে নিয়ে যাই। সেখানে তিনি চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। তাজাম্মালের অনুপস্থিতিতে ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্বও পালন করেন। তার অসাধারণ বীরত্বের জন্য তাকে সিতারা-ই-জুরাত পদকে ভূষিত করা হয়। কর্নেল মমতাজ শক্রর ৪টি ব্রিগেড, মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড এবং শক্রর আরাে একটি সাজোয়া ব্রিগেডের বিরুদ্ধে হিলিতে লড়াই করেছেন এবং উনিশ দিন একটানা বিমান হামলার মাঝেও তিনি তার অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন। জেনারেল লক্ষ্মণ সিংয়ের পর্যাপ্তের চেয়ে বেশি সংখ্যক সৈন্য, গােলাবারুদ ও অনুকূল পরিস্থিতি ছিল এবং এতে তার ভালাে করার কথা ছিল, কিন্তু যুদ্ধে তিনি হাল ছেড়ে দেন এবং একজন নীরব দর্শকে পরিণত হন। তিনি যুদ্ধের নাড়ি না বুঝে একের পর এক হামলা চালিয়ে গেছেন। তিনি ছিলেন গতানুগতিক ধাচের এক জেনারেল যারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে সশরীরে না গিয়ে, যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি না বুঝে শােনা কথার ওপর হেড কোয়ার্টার্সে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও যুদ্ধ পরিচালনা করেন। হিলি থেকে ৪০ মাইল দূরে বগুড়ায় আমাদের সৈন্য প্রত্যাহার এবং বিমানের ছত্রছায়া ও দূরপাল্লার কামানের সহায়তা ছাড়া ভারতীয় বেষ্টনি ভেঙে ফেলা ছিল জেনারেল লক্ষ্মণ সিংয়ের নেতৃত্বের ওপর একটি কলঙ্ক চিহ্ন পদোন্নতি দিই । তিনি ৯ ডিভিশনের কমান্ড গ্রহণ করেন মেজর জেনারেল শওকত রিজার কাছ থেকে। আনসারীর ডিভিশনে দুটি ব্রিগেড ছিল এবং তিনি যশােরে ৯ ডিভিশনের সদরদপ্তর স্থাপন করেন। লড়াই শুরু হলে তিনি ফরিদপুর এগিয়ে যান এবং নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী লড়াই করেন। অধীনস্থ ফরমেশনের সঙ্গে কখনাে কখনাে তার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। এ সময়ে আমি তাদের দিকনির্দেশনা দিতাম। 

এগিয়ে আসতে হয়। ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর আহমেদের নেতৃত্বাধীন ৫৭ ব্রিগেড | ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া রক্ষার জন্য দায়ী ছিল। ব্রিগেডিয়ার হায়াত এসজে’র নেতৃত্বাধীন ১০৭ ব্রিগেডকে বায়রা-যশাের রক্ষায় মােতায়েন করা হয়। শক্রর ক্ষতিসাধন ও তাদের অগ্রযাত্রায় বিলম্ব ঘটিয়ে এ ব্রিগেডকে মাগুরা-ফরিদপুরে পিছু হটে আসতে হয়। এক ব্যাটালিয়নকে সাতক্ষীরা-খুলনা এলাকা রক্ষায় রেখে আসা হয়। খুলনায় আমার সিএএফ’র একটি এডহক ব্রিগেড ছিল যেটাকে পরে আমি ঢাকায় স্থানান্তর করি।  ৯ ডিভিশনের বিপরীতে ছিল ভারতের ২য় কোর, ঢাকা দখল করার জন্য এটা গঠন করা হয়। লে. জেনারেল রায়নার নেতৃত্বাধীন এ কোরে ছিল ৪ মাউন্টেন | ডিভিশন, ৯ পদাতিক ডিভিশন, ৫০(১) প্যারা ব্রিগেড গ্রুপ, দুটি ট্যাংক রেজিমেন্ট ও পাঁচ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ। ঢাকা অভিযানের জন্য এ কোরকে বিশেষভাবে সজ্জিত করা হয় । ৪ মাউন্টেন ডিভিশনকে করিমপুর-হার্ডিঞ্জ ব্রিজ মেরুতে দ্বিমুখী | এবং ঝিনাইদহ দখলের জন্য মেহেরপুর-কুষ্টিয়া মেরুতে দ্বিতীয় হামলা চালানাের দায়িত্ব দেয়া হয়। ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর যখন যুদ্ধ শুরু হলাে, বায়রা আক্রমণ করল ভারতীয়রা, কিন্তু এজন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয় তাদেরকে। নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী বায়রা পরিত্যাগ করা হলাে। সৈন্যদেরকে আফ্রা-চৌগাছায় পরবর্তী প্রতিরক্ষা লাইনে প্রত্যাহার করা হয়। ২ ডিসেম্বর দর্শনার পতন ঘটে। ৩৫০ ইন্ডিয়ান ব্রিগেডের একটি অগ্রবর্তী হামলা প্রতিহত করা হয়। ভারতীয়দের ক্ষয়ক্ষতি হয় অনেক । তারা বেশকিছু ট্যাংকও হারায়। এ এলাকায় গৌরিপুর গ্রামে প্রথম আকাশ যুদ্ধ সংঘটিত ১০৭ পাকিস্তানি ব্রিগেডকে মােতায়েন করা হয় যশাের এলাকায়। ব্রিগেডিয়ার হায়াত, এস জে, সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য আমার অনুমতি প্রার্থনা করেন। আমি তাকে পরিস্থিতি যাচাই করতে বললাম এবং আরাে বললাম যে, সৈন্য প্রত্যাহার সর্বোত্তম বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হলে তিনি তাও করতে পারেন। কারণ তিনি। শত্রুদের বাধা দেয়ার অবস্থানেই দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং এ অবস্থান এক পর্যায়ে ছেড়েই দিতে হতাে। তিনি খুলনার দিকে সৈন্য প্রত্যাহারের পরামর্শ দেন। কিছু বিবেচনার পর আমি তাঁকে সৈন্য প্রত্যাহারের অনুমতি দিই। আমি ভেবে দেখি যে, এ উদ্যোগ জেনারেল রায়নাকে যশাের এলাকায় সৈন্য পাঠাতে উৎসাহিত করবে এবং এভাবে শক্রর বিরাট সংখ্যক সৈন্যকে এখানে ব্যস্ত রাখা যাবে যাতে তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে ছুটে যেতে না পারে। ৫ ডিসেম্বর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে  প্রেরিত সংকেত অনুসারেই পরিকল্পনায় এ পরিবর্তন আনা হয়।

আমি আরাে দেখতে পেলাম যে, হায়াত ভারতীয়দের পশ্চাৎভাগ এবং এলওসি’র প্রতি একটি গুরুতর হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারেন। আমাদের এ প্ররােচিত উদ্যোগে ভারতীয় কোরের সংযােগ বিচ্ছিন্ন হবে এবং এর ডিভিশনগুলাে বিচ্ছিন্ন লড়াইয়ে লিপ্ত হবে। এতে ফরিদপুর ও ঢাকার প্রতি রায়নার হুমকি কমবে। হায়াতকে বলা হলাে একসঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহার না করে পর্যায়ক্রমে সৈন্য প্রত্যাহার করতে, শত্রুকে ব্যস্ত রাখতে, তাদের ক্ষতি করতে এবং অধিকাংশ সৈন্যকে প্ররােচিত করতে। তিনি এ কাজ অত্যন্ত চমৎকারভাবে সম্পন্ন করেন। প্রত্যাশা অনুযায়ী রায়নার নেতৃত্বাধীন ২য় কোরের অধিকাংশ সেন্য হায়াতকে খুলনার পথে অনুসরণ করে। হিলি থেকে ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুলের বগুড়া পশ্চাদপসরণ, ময়মনসিংহ থেকে ব্রিগেডিয়ার কাদিরের ঢাকা, সলিমুল্লাহর সিলেট, সাদউল্লাহর ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ভৈরব বাজারে প্রত্যাহারের মতাে হায়াতের খুলনায় প্রত্যাহারের ঘটনা সামরিক ইতিহাসে একটি শিক্ষার বিষয় হয়ে থাকবে। তিনি। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ১০৭ ব্রিগেডকে প্রত্যাহার করেন। শত্রুদের বিমান হামলা, সশস্ত্র প্রতিরােধ এবং প্রতি পদে মুক্তিবাহিনীর বাধা সত্ত্বেও তিনি এ প্রত্যাহার কার্য সম্পন্ন করেন। তিনি শত্রুদের অগ্ৰাযাত্রায় বাধা দেয়ার অবস্থানগুলাে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ব্যবহার করেন। তিনি প্রত্যাহারকালে তার ওপর শত্রুকে হামলা। চালানাের সুযােগ দেননি। তিনি তার কৌশলগত বুদ্ধি ও সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে রায়নার কোরকে প্রলােভন দেখান এবং হ্যামিলনের বংশী বাদকের পেছনে যেভাবে শিশুরা দৌড়াচ্ছিল সেভাবে ভারতীয় সেন্যরা তার পিছনে ছুটে। হায়াত চূড়ান্তভাবে প্রকৃত হন খুলনা থেকে কয়েক কিলােমিটার দূরে দৌলতপুরে। শক্রক মােকাবেলা করার জন্য। এখানকার একদিকে ছিল বিশাল জলাভূমি এবং আরেকদিকে ছিল ভৈরব নদী। তিনি এলাকার ভৌগােলিক সুবিধা গ্রহণ করেন।

বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাগুলােকে সর্বোত্তম সুবিধা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ পর্যায়ে মেজর জেনারেল দলবীর সিং ২ কোরের আর্টিলারি ও বিমান বাহিনীর সহায়তা নিয়ে দৌলতপুর দখলের জন্য তার ডিভিশন নিয়ে অগ্রসর হন। ১৫ ডিসেম্বর এ হামলা চালানাে হয়, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়। গােটা ডিভিশনকে থামিয়ে দেয়া হয়। শত্রুর সাঁজোয়া বাহিনী হায়াতের সুসমন্বিত ও নির্ভুল গােলাবর্ষনের মুখে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হয়। হায়াতের তৎপরতা ছিল অসাধারণ। একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে তিনি এক শক্তিশালী শত্রু বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেন। তিনি টি-৫৫ ও পিটি-৭৫ ট্যাংক নিয়ে। গঠিত শত্রুর সাঁজোয়া বহরকে স্তব্ধ করে দেন এবং পাল্টা হামলা চালিয়ে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। হায়াত ছিলেন একজন সাহসী কমান্ডার। ১৯৬৫-এর যুদ্ধে তিনি আমার কমান্ডে কাজ করেছেন শিয়ালকোট সেক্টরে এবং একটি এফ এফ ব্যাটালিয়নের কমান্ডে চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। এ জন্য তাকে এসজে পুরস্কার দেয়া হয়। ভয়াবহ গােলাবর্ষণে ভারতীয় সৈন্যদের আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ভারতীয়রা আক্ষরিকভাবে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। পেছনে ও রিজার্ভে যেসব সৈন্য ছিল তারাও একইভাবে পালিয়ে যায়। ভারতীয় কোর কমান্ডার ঝিনাইদহ থেকে কুষ্টিয়ায় আরেকটি ব্রিগেড নিয়ে আসেন। ৪১ ব্রিগেডও এগিয়ে আসে। মধুমতিতে থেকে যায় কেবল একটি ব্যাটালিয়ন। এভাবে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে গােটা । ডিভিশনকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে আসা হয়।  ৫৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুরকে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম এবং অধিকাংশ সাজ-সরঞ্জাম নিয়ে ১৬ ডিভিশনের এলাকায় চলে যাবার অনুমতি দেয়া। হয়। এ সেতু তখন ১৬ ডিভিশনের আওতায় ছিল। মঞ্জুর তার অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে প্রাথমিকভাবে সৈন্য প্রত্যাহার করলে একটি রাইফেল কোম্পানিসহ তার সদরদপ্তর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এটি ঝিনাইদহ পৌছে। অন্যদিকে, মঞ্জুর তার ব্রিগেডের বাদবাকি সৈন্য ও টেকনিক্যাল সদরদপ্তর নিয়ে কুষ্টিয়ায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি তার সৈন্য নিয়ে ১৬ ডিভিশনের এলাকায় পৌঁছলে মেজর জেনারেল আনসারী ব্রিগেডিয়ার মঞ্জরের অবশিষ্ট সৈন্য (ব্রিগেড সদরদপ্তর ও একটি রাইফেল কোম্পানি) এবং ঢাকা থেকে আসা দুটি নয়া ব্যাটালিয়ন নিয়ে একটি এডহক ব্রিগেড গঠন করেন। তিনি তার কর্নেল স্টাফ কর্নেল কে, কে, আফ্রিদীর কাছে এ ব্রিগেডের কমান্ড ন্যস্ত করেন। আফ্রিদীকে ফরিদপুর থেকে গােয়ালন্দ পর্যন্ত যােগাযােগ পথগুলাে রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। আনসারী নিজে ফরিদপুর দুর্গ রক্ষায় নিয়ােজিত সৈন্য গােয়ালন্দ ঘাটির কমান্ড গ্রহণ করেন। কর্নেল আফ্রিদী চমৎকারভাবে লড়াই করেন। শত্ৰু কখনাে ফরিদপুর পৌঁছতে পারেনি। ফলে তাদের ঢাকা অভিমুখী অগ্রযাত্রা বার বার ব্যর্থ হয়েছে।

৭ ডিসেম্বরের মধ্যে যশাের ও ঝিনাইদহের পতন ঘটায় জেনারেল রায়না ঢাকা অভিমুখে দ্রুত অভিযানের অবস্থায় পৌঁছে যান। তিনি তার দুটি ব্রিগেড নিয়ে কুষ্টিয়া ও খুলনায় আনসারীর দুটি ব্রিগেডের অবশিষ্টাংশকে মােকাবেলা করার এবং তার কোরের অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে ফরিদপুর ও গােয়ালন্দ ঘাটে এগিয়ে যাবার অবস্থায় উন্নীত হন। কিন্তু আমরা দেখতে পেলাম যে, তিনি তার একটি ডিভিশনকে কুষ্টিয়ায় যুদ্ধে জড়িত করে ফেলেন এবং তার দ্বিতীয় ডিভিশনও খুলনার পথে রাস্তায় আটকা পড়ে। এভাবে ঢাকা পৌঁছার সুযােগ হাতছাড়া হয়ে যায়।’৫ ভারতীয় লেখকের এ অভিমত থেকে সকল ক্ষেত্রে বিপুল শ্রেষ্ঠত্ব থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্যর্থতা স্পষ্ট ধরা পড়ে। তাদের প্রতি স্থানীয় জনগণের বিশাল সমর্থন ছিল। স্থানীয় জনগণ নাশকতামূলক তৎপরতা চালিয়েছে, ভারতীয়দের সর্বতােভাবে সহায়তা এবং তাদের বিস্তারিত তথ্য দিয়েছে। ঢাকা দখল তাে দূরের কথা; সকল ভারতীয় কোর তাদের প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তু দখলেও ব্যর্থ হয়। ভারতীয় কমান্ডারদের প্রতিটি উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়া হয়। কৃতসংকল্প পাকিস্তানি কমান্ডাররা প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয় জেনারেলদের হার মানিয়েছে।  নদ-নদীর প্রতিবন্ধকতার সাহায্যে আমি ঢাকা রক্ষা করছিলাম। আমরা সফল। হয়েছিলাম শত্রুকে কোণঠাসা করে রাখতে। ভারতীয় সেনা ফরমেশনগুলােকে ঢাকা থেকে দূরে এবং একটি থেকে আরেকটিকে বিচ্ছিন্ন রাখা হয়। তারা তাদের নিজ নিজ সেক্টরে আবদ্ধ ছিল। আমরা তাদেরকে পুরােপুরি নিশ্চল করে রেখেছিলাম। যাতে তারা পশ্চিম রণাঙ্গনে সৈন্য প্রত্যাহার করতে না পারে। শুধু তাই নয়, আমরা তাদেরকে এক সেক্টর থেকে অন্য সেক্টরে সৈন্য স্থানান্তর করতেও দেইনি। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষায় আমাদেরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া না হলে আমরা এক উল্লেখযােগ্য সময় লড়াই করতে পারতাম। আমরা শত্রুকে প্ররােচিত করে আমাদের দুর্গের কাছে নিয়ে আসি এবং আমাদের পছন্দসই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে লড়াই করি। আমরা ছিলাম সুরক্ষিত বাংকারে।

অন্যদিকে, শত্রু ছিল উন্মুক্ত জায়গায়। ভারতীয়দেরকে বিস্তৃত এলওসি বজায় রাখতে হয়েছে। অন্যদিকে আমাদের এরূপ করতে হয়নি অথবা করলেও তা ছিল খুবই সীমিত। ভারতীয়দেরকে সরবরাহ লাইন পাহারা দিতে হয়েছে। পক্ষান্তরে, আমাদের অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও খাদ্য ছিল বহুদুরে আমাদের দুর্গে। ভারতীয় দ্বিতীয় কোর কমান্ডার জেনারেল রায়নাকে ‘ইন্ডিয়ান আর্মি আফটার ইন্ডিপেন্ডেন্স’ বইয়ের লেখক যে পরামর্শ দিয়েছেন তা খুবই মজার। তিনি বলেছেন যে, রায়নার উচিত ছিল তার দুটি ব্রিগেড নিয়ে দৌলতপুর (খুলনা) ও কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি দুটি ব্রিগেডকে মােকাবেলা করা এবং তার বাদবাকি সৈন্য নিয়ে স্বয়ং ঢাকার দিকে যাত্রা করা।’ লেখকের এ মতামতে খানিক ভুল রয়েছে। তিনি যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিত ও বাস্তবতার আলােকে এ কথা বলেননি। তিনি আমাদের সৈন্যদের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যদের নিম্নমানের তৎপরতাকে এড়িয়ে গেছেন। দুটি পাকিস্তানি ব্রিগেডকে কোনাে অবস্থাতেই দুটি ভারতীয় ব্রিগেড মােকাবেলা করতে পারতাে না। দুটি ভারতীয় ব্রিগেড এগিয়ে এলে রায়নার (এলওসি) অবরুদ্ধ হয়ে যেত। ফলে তাকে এলওসি রক্ষার জন্য সৈন্য পাঠাতে হতাে। এতে তার আক্রমণাত্মক ক্ষমতা হ্রাস পেত। জেনারেল আনসারীর ব্যক্তিগত কমান্ডের আওতায় ফরিদপুর ও গােয়ালন্দ অত্যন্ত চমৎকারে ধরে রাখা হয়েছিল। এসব দুর্গ অভিমুখী সড়কগুলাে রক্ষা করছিল কর্নেল কে, কে, আফ্রিদীর নেতৃত্বাধীন এডহক ব্রিগেড। আফ্রিদীর ব্রিগেডই মধুমতি নদী রক্ষা করছিল। কিন্তু ভারতীয়রা তখনাে এ নদী অতিক্রম করতে পারেনি। তার সৈন্যদেরকে ফরিদপুর ও গােয়ালন্দে পিছু হটে আসতে হয়। এতে এসব দুর্গের শক্তি ও প্রতিরক্ষা সামর্থ্য উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এ পরিস্থিতিতে জেনারেল রায়নার পক্ষে ফরিদপুরে এগিয়ে আসা সম্ভব ছিল না।

চট্টগ্রাম

ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে তাদের এয়ার ক্র্যাফট মােতায়েন করেছিল। আমাদের সাবমেরিন গাজী’ চুপি চুপি এ বিমানবাহী জাহাজ ‘বিক্রম’-এর তলদেশে পৌছে যায়। খবরে জানা গেছে যে, গাজী এত নিচে ডুব দেয় যে, এটি ভেসে উঠতে ব্যর্থ হয়। কিছু কাগজপত্র ও যন্ত্রপাতি ভেসে উঠা নাগাদ এর অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়নি। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে গাজী অত্যন্ত চমৎকার লড়াই করেছিল। তখন এর কমান্ডার ছিলেন কারামত নিয়াজী, যাকে সিতারা-ই-জুরাত পুরস্কার দেয়া হয় এবং পরে তিনি নৌবাহিনী প্রধান হন।  চট্টগ্রাম রক্ষা করছিল আমাদের নৌ সেনা এবং ব্রিগেডিয়ার আতা মােহাম্মদ মালিকের নেতৃত্বাধীন একটি এড়হক ব্রিগেড। মালিক চট্টগ্রাম বন্দর দখলে শত্রুর প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন এবং তাদের সৈন্যদের আটকে রাখেন। শেষ দিন পর্যন্ত তিনি। আত্মসমর্পণ করেননি। ব্রিগেডিয়ার তাসকীন আরেকটি এড়হক ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এ এডহক ব্রিগেডে কমান্ডাে, স্থানীয় চাকমা উপজাতি ও আসামের মিজোরাও ছিল। তারা ভারতীয়দের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের শহরগুলাে দখল করতে দেয়নি এবং তারা ভারতীয় কিলাে ফোর্সের উল্লেখযােগ্য ক্ষতিসাধন করেছিলেন। কক্সবাজারে ভারতীয়রা একটি উভচর হামলা চালানাের চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের এ হামলা ব্যর্থ হয়। ভারতীয়রা যে ব্যাটালিয়ন নিয়ে এ হামলা চালিয়েছিল সেই ব্যাটালিয়নের মাত্র ১২ জন অবতরণে সক্ষম হয়েছিলেন। দু’জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এভাবে এ অভিযান নিস্ফল হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে তৎপর ভারতীয় কিলাে ফোর্স কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।

৩৯ এড হক ডিভিশন

৪ ডিসেম্বর আমাকে ফেনী পুনর্দখলের নির্দেশ দেয়া হয়। কৌশলগত গুরুত্ব না। থাকায় বিরাজমান পরিস্থিতিতে আমি সেখান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করেছিলাম। কিন্তু জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাকে আবার ফেনী দখলের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। বস্তুতপক্ষে, জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের হস্তক্ষেপ ছিল। বাস্তবতাবর্জিত। তারা মাঝে মাঝে পরিস্থিতি না বুঝে অথবা এলাকা সম্পর্কে কোনাে খোঁজ-খবর ছাড়াই নির্দেশ দিত।  লাকসাম ফেনীর প্রতিরক্ষায় ৩৯ এহক ডিভিশন গঠনের বিষয় মূল পরিকল্পনার অংশ ছিল না। আমি চাঁদপুরকে একটি কভারিং পজিশন হিসেবে রেখে ঢাকা ও চট্টগ্রাম দুর্গকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। লাকসাম অথবা ফেনীর চিন্তা আমার মাথায় ছিল না। কিন্তু জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে আরাম কেদারায় উপবিষ্ট জেনারেল গুল হাসান আমাকে ফেনী ও লাকসাম ধরে রাখার নির্দেশ দেন। 

জেনারেল গুল হাসান কখনাে কোনাে লড়াইয়ে সৈন্য পরিচালনা করেননি। তিনি নানা অজুহাতে পূর্ব পাকিস্তান সফর এড়িয়ে গেছেন। এ জন্য তাঁর পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের জটিল পরিস্থিতি বুঝার কথা ছিল না। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে পদাতিক যুদ্ধের কৌশলগত চাহিদা এবং মৌলিক কৌশল বুঝতে ব্যর্থ হন। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমার মতামত উপেক্ষা করে সৈন্য পরিচালনার নির্দেশ দেয়। ফেনী সীমান্ত চৌকি দখলের নির্দেশ দিয়ে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স মূলত এ এলাকায় আমাকে আমার নাক বাড়িয়ে দিতে বাধ্য করে। তারা বুঝতে পারেনি যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল এবং অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা লাইন (এফডিএল) গুলােই সীমান্তে পরিণত হয়। মেজর জেনারেল আবদুর রহিম খানের নেতৃত্বে ৩৯ এডহক ডিভিশন গঠন করা হয় ১৯৭১-এর ২১ নবেম্বর। বিদ্রোহ দমন অভিযানে ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি হিসেবে জেনারেল রহিম অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দেন। তার সাহসিকতা, বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার জন্য তাকে চাঁদপুর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। ৩৯ এডহক ডিভিশনে ছিল দুটি ব্রিগেড। এর একটি ছিল ৫৩ এবং আরেকটি ১৭৭। ১১৭ ব্রিগেড কুমিল্লা থেকে চৌদ্দগ্রাম পর্যন্ত এবং ৫৩ ব্রিগেড কুমিল্লা ও চৌদ্দগ্রামের আরাে দক্ষিণে ফেনী পর্যন্ত এলাকা রক্ষার দায়িত্ব ছিল। ৫৩ ব্রিগেডের নেতৃত্বে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজী। তিনি ঢাকার জন্য। গঠিত রিজার্ভের কমান্ডার ছিলেন। ৫৩ ব্রিগেড চাঁদপুর রক্ষার দায়িত্বে ছিল এবং পরে এটি ঢাকায় পিছু হটে আসে। এ ব্রিগেডকে ৩৯ এহক ডিভিশনের কমান্ডে। ন্যস্ত করা হয় এবং লাকসামে মােতায়েন করা হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে ভারতের ৩০১ মাউন্টেন ব্রিগেড লালমাই পাহাড় ও লাকসামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে আসে। ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে তারা মুজাফফরগঞ্জ দখল করে এবং ২৫ এফএফ-এর একটি বড় অংশ দখল করতে সক্ষম হয়।

কমান্ডিং অফিসার তার মনােবল হারিয়ে ফেলেন। লড়াই করার মতাে অবস্থা তার ছিল, কিন্তু বিনা লড়াইয়ে তিনি আত্মসমর্পণ করেন। আমি তাকে কোর্ট মার্শাল করার জন্য সুপারিশ করেছিলাম। ভারত থেকে ফিরে আসার পর তাকে ক্ষমা করে দেয়া হয়। কারণ সরকারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল ভালাে। মেজর জেনারেল রহিম মােজাফফরগঞ্জে আক্রান্ত হন। সে সময় তিনি অগ্রবর্তী অবস্থানে তার সৈন্যদের দেখার জন্য লাকসামের পথে ছিলেন।  ৫৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আসলাম অক্লান্ত প্রচেষ্টা চালান চাঁদপুরে পৌঁছানাের জন্য। হাজীগঞ্জে ভয়াবহ লড়াই হয়। উভয়পক্ষে প্রাণহানী ঘটে। ১৩ দিন পর ১৯৭১-এর ৮ ডিসেম্বর হাজীগঞ্জের পতন ঘটে। ব্রিগেডিয়ার আসলাম ব্রিগেডিয়ার আতিফের নেতৃত্বাধীন ১১৭ ব্রিগেডে যােগদান করার জন্য লালমাই অবস্থানে পিছু হটে আসেন। আমি জেনারেল রহিমকে চাঁদপুর ছেড়ে দিয়ে তার চাদপুরস্থ গােটা গ্যারিসনসহ ঢাকায় পিছু হটে আসার নির্দেশ দিই। তাকে ঢাকা নিয়ে আসার জন্য ফেরিগুলাে রাতের প্রথমভাগে নােঙ্গর ফেলে। ফেরিগুলাে রওনা হওয়ার পর চরায় আটকা পড়ে। ফলে তাকে দিনের বেলা রওনা দিতে হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদেরকে ধাওয়া করে। এতে আমাদের কেউ কেউ হতাহত হয়। জেনারেল রহিমও আহত হন। আহতদের ঢাকার পিলখানায় বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী সদরদপ্তরে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়। এদেরকে পরে ঢাকা সিএমএইচ-এ স্থানান্তর করা হয়। আমি গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রসহ মেজর জেনারেল রহিমকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাই।  

ব্রিগেডিয়ার মিয়া মনসুর মােহাম্মদ মেজর জেনারেল রহিমের সৈন্যদের কমান্ড গ্রহণ করেন। জেনারেল রহিমের নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা নারায়ণগঞ্জ এলাকায় মােতায়েন ছিল। ব্রিগেডিয়ার সােধির নেতৃত্বে ভারতের একদল ছত্রী সৈন্য এ এলাকায় এগিয়ে আসার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তাদের এ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এখানে এবং অন্যান্য জায়গায়। তীব্র প্রতিরােধের মুখে ভারতীয়রা তাদের প্রচেষ্টায় বিরতি দেয়। এ সময় আমরা নারায়ণগঞ্জ ও মিরপুরে প্রচুর সৈন্য মােতায়েন করি। ঢাকায় হামলা চালানাের আগে ভারতীয়দের ব্যাপকভাবে সমরসজ্জা গড়ে তুলতে হতাে। কিন্তু তারা সে অবস্থায় পৌঁছার আগেই আমাদেরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। ১১ ডিসেম্বর লেঃ জেনারেল সগৎ সিংকে ঢাকা দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেদিন তিনি ঢাকা দখলের প্রস্তুতি সম্পন্ন করার জন্য ৭ দিন সময় চেয়েছিলেন। আমার হিসাব অনুযায়ী তার আরাে বেশি সময়ের প্রয়ােজন ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভারতীয়রা সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে এমনভাবে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল যে, তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারছিল না। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে আমি ট্যাংক অথবা ভারী অথবা মাঝারি কামান ছাড়াই ঢাকা অঞ্চলে মােতায়েন ভারতীয় সৈন্যদের তাড়িয়ে দিতে পারতাম।

কুমিল্লা-ময়নামতি

কুমিল্লাকে স্থায়ীভাবে ধরে রাখা হয়নি। প্রাথমিক যুদ্ধের পর ১১৭ ব্রিগেড ময়নামতি দূর্গে পিছু হটে আসে। যে কোনাে দিক থেকে শত্রুর হামলা মােকাবেলায় ময়নামতিকে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। এসব কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার পেছনে আরাে তিনটি প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা হয়। সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও শক্র ময়নামতির প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করতে সক্ষম হয়নি। ১১৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আতিফ আত্মসমর্পণে ভারতীয়দের আহ্বান উপেক্ষা করেন। ১৯৬৪ সালে হকি ক্যাপ্টেন হিসেবে অলিম্পিকে তিনি যেভাবে লড়াই করেছিলেন ঠিক সেভাবে তিনি ১৬ ডিসেম্বর শেষদিন পর্যন্ত লড়াই করেছেন। তিনি ময়নামতিকে দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলেছিলেন। লাকসাম থেকে ৫৩ ব্রিগেড আতিফের ব্রিগেডে এসে যােগ দেয়। তখন তার সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজারে। এছাড়া, তার অধীনে ছিল ৪টি ট্যাংক ও এক ব্যাটারি আর্টিলারি। ভারতীয়রা আমাদের সুরক্ষিত অবস্থান দখল অথবা ভেদ করতে পারেনি। হামলায় ভারতীয়দের চড়া মাশুল দিতে হয়। অতঃপর তারা ময়নামতি দুর্গ অবরােধের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু যুদ্ধবিরতি নাগাদ এ দুর্গ ধরে রাখা হয়। আতিফ শক্রর দুটি ব্রিগেডকে আটকিয়ে রাখেন। এতে ঢাকা দখলের জন্য জেনারেল সগৎ সিংয়ের কাছে এক ডিভিশনের সামান্য বেশি সৈন্য ছাড়া আর কিছু ছিল।  তবে জেনারেল সগৎকে ঢাকা দখল করতে হলে ভৈরব বাজার ও নারায়ণগঞ্জকে মােকাবেলা করতে হতাে। চট্টগ্রামের দায়িত্বও তার ওপর ন্যস্ত করা হয়। 

সিলেট-আখাউড়া

৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ সিলেট, আখাউড়া ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলেন। পরিকল্পনা করা হয় যে, তিনি অগ্রবর্তী অবস্থান, সুরক্ষিত ঘাঁটি ও দুর্গে ভারতীয়দের সঙ্গে লড়াই করার পর ঢাকা পিছু হটে আসবেন। ব্রিগেডিয়ার রানার নেতৃত্বে ৩১৩ পাকিস্তানি ব্রিগেড সিলেট রক্ষা করছিল। ৮ ভারতীয় মাউন্টেন ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল কৃষ্ণ। রাও শমশেরনগর ও কুলাউড়ায় হামলা চালান। এ দুটি জায়গায় একটি করে ভারতীয় ব্রিগেড হামলায় অংশ নেয়। ৮১ মাউন্টেন ব্রিগেড কৈলাশবাহার, শমশেরনগর ও মৌলভীবাজার মেরু বরাবর অগ্রসর হয়। শমশেরনগর ও কুলাউড়ায় ২২ বালুচ ও টচি স্কাউটের একটি করে কোম্পানি নিয়ে গঠিত আমাদের সৈন্যরা বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে এবং দীর্ঘদিন শত্রুর ব্রিগেডকে ঠেকিয়ে রাখে। ৩১ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত এবং ৮৭ জন আহত হয়। বিপরীত মেরুতে ৬৯ ভারতীয় ব্রিগেড কুলাউড়ায় হামলা চালায়। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর নাগাদ তারা তা দখল করতে পারেনি। তবে ব্যাপকভাবে নাপাম বােমা ব্যবহারের পর এর পতন ঘটে।  ১৯৭১-এর ৫ ডিসেম্বর ৮১ ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেড মুন্সীবাজারে হামলা করে। এ শহর রক্ষায় ৩০ এফএফ-এর একটি রাইফেল কোম্পানি বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। এতে কোম্পানি কমান্ডারসহ ২২ জন নিহত হয়। ইতোমধ্যে হেলিকপ্টারযােগে দুই ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য সিলেট শহরের দক্ষিণ পূর্বদিকে অবতরণ করে। ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে আমাদের ২০২ এডহক ব্রিগেড এ শহর দখল করে নিয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ্ অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে পিছু হটে আসা কয়েকটি ইউনিটের সৈন্য নিয়ে এটাকে একটি দুর্গে পরিণত করেন। ব্রিগেডিয়ার আসগর হােসেনের নেতৃত্বাধীন আমাদের ৩১৩ ব্রিগেড মৌলভীবাজার থেকে সিলেটে পিছু হটে আসে। শত্রু এ ব্রিগেডের গতিরােধ করতে পারেনি। মেজর জেনারেল কৃষ্ণ রাও তার ডিভিশনের ৬টি ব্রিগেড নিয়ে এ শহর অবরােধ করেন। বিমান সহায়তা এবং নাপাম বােমাবর্ষণ সত্ত্বেও তিনি সামনে এগিয়ে আসতে পারেননি অথবা সিলেটের প্রতিরক্ষা ব্যুই ভাঙতে সাহস পাননি।

‘এটা উল্লেখযােগ্য যে, যুদ্ধে ক্লান্তি এবং একটি অসম যুদ্ধের সম্ভাবনা সত্ত্বেও শমশেরনগর ও কুলাউড়া থেকে পিছু হটে আসা দুটি কোম্পানি এবং আরাে কিছু আধা সামরিক সৈন্য বিমান সহায়তা ছাড়া সামান্য কয়েকটি কামানের সাহায্যে কৃষ্ণ রাওয়ের ডিভিশনকে বেশ কয়েকদিন আটকে রাখে এবং নিজেদের প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা সিলেট থেকে বের হয়ে আসতে সক্ষম হয়। ‘৬।  এমন শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তােলার কৃতিত্ব ছিল ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ ও ব্রিগেডিয়ার আসগরের। তাদের সাহসিকতায় শক্রর একটি গােটা ডিভিশনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। শত্রুর এ ডিভিশনকে ঢাকা পাঠানাের কথা ছিল।  

ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ্ ২৭ ব্রিগেডের কমান্ডার তার ব্রিগেড নিয়ে ভৈরব বাজার সেক্টর রক্ষা করছিলেন। সাদউল্লাহ ছিলেন একজন সাহসী অফিসার, প্রতিটি লড়াইয়ে তিনি থাকতেন সম্মুখভাগে। তিনি বেয়নেটের সাহায্যে পাল্টা হামলায় ব্যক্তিগতভাবে যােগদান করে কয়েকটি জায়গা থেকে শত্রুকে হটিয়ে দেন। তাঁকে। নিশান-ই-হায়দার পদক প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল, কিন্তু তার পরিবর্তে তাকে দেয়া হয় হিলাল-ই-জুরাত। এটা খুবই দুঃখজনক যে, তাঁর মত একজন যােগ্য অফিসারের পদোন্নতি হয়নি। তাকে মৌলবাদী হিসেবে বিচেনা করা হয়েছিল।  সাদউল্লাহর ব্রিগেড মােতায়েন ছিল। আগরতলার কাছে আখাউড়াব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রধানত ছিল তিস্তা নদী ভিত্তিক এর চারপাশে ছিল প্রচুর ঝিল। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। আখাউড়া থেকে ৫ কিলােমিটার উত্তরে নাম গঙ্গাসাগর। প্রতিটি শহরে আমাদের একটি করে। ব্যাটালিয়ন মােতায়েন ছিল। লড়াই শুরু হওয়ার পর আগরতলায় ভারতীয় বিমানঘাঁটিতে আমাদের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক গোলাবর্ষণ করা হতাে ২৭ ব্রিগেড তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তােলে এবং ২১ নবেম্বর থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতীয়রা আমাদের একটি অবস্থানও দখল করতে পারেনি। আমরা আমাদের পরবর্তী প্রতিরক্ষা অবস্থান আশুগঞ্জ এবং পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়ার আগ পর্যন্ত ২৭ ব্রিগেড ১৫ দিন তাদের হামলা প্রতিহত করেছে।  ৫ ডিসেম্বর, ৩১১ ভারতীয় ব্রিগেডের অগ্রবর্তী সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করে। ৭৩ ব্রিগেডও পরদিন এগিয়ে আসতে থাকে। মেজর জেনারেল গনজালভেজের নেতৃত্বে একটি মুক্তি ফৌজ ২১ নবেম্বর থেকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তৎপরতা চালাচ্ছিল। ভারতীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রায় মুক্তিবাহিনী সর্বোতভাবে সাহায্য করেছে। মুক্তিবাহিনী ভারতীয় বাহিনীকে আমাদের অবস্থান, অস্ত্রশস্ত্র ও শক্তি সম্পর্কে গােয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করে। ‘অন্যান্য স্থানের মতাে এখানেও যখনি প্রয়ােজন হতাে, একদল স্থানীয় লোেক শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতাে। ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে (ভারতীয় বাহিনীর কাছে তথ্য সরবরাহের জন্য কোনাে স্থানীয় লােককে সন্দেহ হলে পাকিস্তানিরা তাকে নির্যাতন করে হত্যা করতাে) তারা রাতে উধাও হয়ে যেত এবং সকাল হওয়ার আগে শক্রর সুরক্ষিত অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে ফিরে। আসতাে এ উপায়ে আমাদের সৈন্যরা অগ্রযাত্রা বজায় রাখতে, শক্রর অবস্থানের আশপাশে তৎপরতা চালাতে এবং বরাবর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়। দেশের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ বহন করার প্রয়ােজন হলে। বাঙালি গ্রামবাসী, প্রতিরােধ যােদ্ধা, স্কুলের ছাত্র প্রভৃতি লােকজনকে তৎক্ষণাৎ পাওয়া যেত- সবাই সাহায্য করার জন্য ছিল প্রস্তুত।’

নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি শাম্বার্গ সে সময় একটি অগ্রবর্তী ব্রিগেডের সঙ্গে ছিলেন। তিনি একটি ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। ২২ জন স্থানীয় লােককে একটি ৫ দশমিক ৫ ইঞ্চি মাঝারি কামানকে পানিতে ভর্তি একটি মাঠের মধ্য দিয়ে ঠেলে নিয়ে যেতে এবং অন্যান্যদের গােলাবারুদ বহন করতে দেখেছেন। ‘৮  ভারতীয়রা ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত পাকিস্তানি সৈন্যদের মােকাবেলা করার লক্ষ্যে আগরতলার দক্ষিণ দিক থেকে কুমিল্লা অভিমুখে একটি বহর পাঠায়। শত্রুরা দ্রুত আশুগঞ্জ সেতু দখলের চেষ্টা চালায়। কিন্তু আমরা তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিই। আমরা তাদের ডিভিশনকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘাঁটি গেড়ে বসতে দেইনি। আমরা আশুগঞ্জ সেতু ধ্বংস এবং আখাউড়ার পশ্চিম দিকের সেতুটি শক্রর ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য অকেজো করে দিই। ৯ ডিসেম্বর  ভারতের ৩১১ ব্রিগেডের অগ্রবর্তী সৈন্যরা এগিয়ে আসার আগে আমাদের ২৭ ব্রিগেড আশুগঞ্জে বাংকারে অবস্থান গ্রহণ করে। ভারতীয়দেরকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আশুগঞ্জ আসতে দেয়া হয়। আশুগঞ্জে তাদের জন্য ফাঁদ পাতা হয়েছিল। ফরমেশনগুলাের গােলাবর্ষণে শৃঙ্খলা বজায় রাখা হয়। আমরা ভারতীয়দেরকে আমাদের সুরক্ষিত এলাকায় এগিয়ে আসার সুযােগ দিই। এরপর শুরু হয় তাদের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ আমাদের কার্যকর গােলাবর্ষণে ১২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত এবং তাদের ৪টি ট্যাংক ধ্বংস হয়। আরেকটি ব্যাটালিয়ন শক্রর শক্তি বৃদ্ধি করে। ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহর নেতৃত্বে একটি পাল্টা হামলায় তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল কাজী মজিদ আশুগঞ্জ সেতু উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। এ সময় আমাদের ২৭তম ব্রিগেড ছিল মেঘনা নদীর পূর্ব তীরে। তবে তখনাে আশুগঞ্জ সেতুর প্রতি তাৎক্ষণিক কোনাে ঝুঁকি ছিল না। ব্রিগেড নদী পার হয়ে ভৈরব বাজারে পৌঁছতে সক্ষম হয়।  ভারতীয়রা হেলিকপ্টারের সাহায্যে মেঘনা অতিক্রম করে ভৈরব বাজারের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবতরণ করতে থাকে। নরসিংদীতে ভারতীয়দের সমরসজ্জা ছিল ধীর-স্থির। এখানে আমাদের পক্ষ থেকে ভারতীয়দের বাধা দেয়া হয়নি। মেঘনা নদী দিয়ে ট্যাংক ও কামান বয়ে নিয়ে আসা ছিল একটি দুরূহ কাজ। আমাদের মাঝারি ও ভারী কামান না থাকায় আমরা শত্রুর অবতরণে বাধা দিতে পারিনি। আমার কাছে ট্যাংক রেজিমেন্ট ও দূরপাল্লার কামান থাকলে শত্রুরা হেলিকপ্টার যােগে সৈন্য অবতরণ অথবা টাঙ্গাইলে ছত্রসৈনা নামাতে পারতাে না।

আমার কাছে অন্তত কয়েক স্কোয়াড্রন জঙ্গী বিমান থাকলে আমি শক্রর ট্যাংক চলাচলে বাধা দিতে সক্ষম হতাম, ছত্রীসেনা ও হেলিকপ্টার সৈন্য অবতরণ অথবা টাঙ্গাইলে ছত্রীসেনা নামাতে পারতাে। আমার কাছে অন্তত কয়েক স্কোয়াড্রন জঙ্গী বিমান থাকলে আমি শক্রর ট্যাংক চরাচলে বাধা দান, ছত্রীসেনা ও হেলিকপ্টারে সৈন্য অবতরণ এবং তাদের নদী অতিক্রম রুখে দাঁড়াতে পারতাম।  সার্বিক প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার আওতায় ১৪ পদাতিক ডিভিশনের ওপর নরসিংদী-নারায়ণগঞ্জ সেক্টর রক্ষার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। সিলেট ও আশুগঞ্জ থেকে তাদেরকে সেখানে পিছু হটার নির্দেশ দেয়া হয়। সিলেট ব্রিগেড মৌলভীবাজারে এসে পড়ে। মজিদকে এসব সৈন্য ঢাকা পাঠানাের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি তাদেরকে পুনরায় সিলেটে পাঠিয়ে দেন। ভৈরব সেতু ধ্বংস করে দেয়ার পর মজিদকে ঢাকায় পিছু হটার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমি প্রথমে তাকে নরসিংদীতে পিছু হটতে বলি। কিন্তু তিনি আমার নির্দেশ পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করেন। রেলওয়ে লাইন তখনাে উন্মুক্ত ছিল। ঢাকা আসার জন্য তাকে ৬পি ফেরি দেয়া হয়। ভারতীয়রা রেলপথ দখল করে নেয়। মজিদের সৈন্যরা নীরব দর্শকের মতাে চেয়ে চেয়ে এ ঘটনা দেখেছে। মজিদ খুব সহজেই ঢাকা পৌঁছতে পারতেন। কিন্তু তিনি কখনাে ঢাকা আসার চেষ্টা করেননি। তার এ অবাধ্যতা হচ্ছে ইন্টার্ন গ্যারিসনের পতন ঘটানোের ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। তিনি জানতেন যে, ঢাকার প্রতিরক্ষা হচ্ছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা জেনেও তিনি আমার নির্দেশ পালনে ব্যর্থ হন। এরপর আমি তাকে ডিভিশনের কমান্ড থেকে অপসারণ করি এবং তার সৈন্যদেরকে ৩৬ (এডহক) ডিভিশনের আওতায় ন্যস্ত করি। সিলেট চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা অঞ্চলকে এ ডিভিশনের আওতায় ন্যস্ত করা হয়। ১৪ ডিভিশনের ঢাকায় নির্ধারিত অবস্থানে পৌছতে ব্যর্থ হওয়ার পর আমাকে এসব পুনর্বিন্যাস করতে হয়। যুদ্ধ তুঙ্গে থাকার কারণে মজিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মতাে সময় তখন আমার হাতে ছিল না। যুদ্ধের পুরােটা সময় সাদউল্লাহ অত্যন্ত চমৎকারভাবে যুদ্ধ করেন। তাকে ঢাকায় ফিরে আসার অনুমতি দেয়া উচিত ছিল। তার সৈন্যরা ঢাকা মেরুতে নির্ধারিত এলাকায় পৌছতে পারলে শত্রুরা সাফল্যের সঙ্গে নরসিংদীতে হেলিকপ্টারে সৈন্য নামাতে পারতাে না।

ঢাকার প্রতিরক্ষা জোরদারে মৌলভীবাজারে মােতায়েন ব্রিগেড ও সাদউল্লাহ্র ব্রিগেডকে না পাঠানােয় জেনারেল গুল হাসানের নেতৃত্বাধীন জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের একটি গােষ্ঠীর সঙ্গে মজিদের যােগসাজশ সম্পর্কে আমার মনে একটি দৃঢ় সন্দেহ দেখা দেয়। জেনারেল গুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ওই গােষ্ঠীটি ইস্টার্ন গ্যারিসন ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। আমি মজিদের অসৈনিকসুলভ আচরণ এবং নির্দেশ পালনে অক্ষমতা তুলে ধরে তার সম্পর্কে একটি কঠোর রিপাের্ট পেশ করি। তার অবাধ্যতার জন্য। তাঁর এলাকায় শেষ মুহূর্তে লড়াইয়ে চরম বিপর্যয় দেখা দেয়। তিনি ভৈরববাজারের কাছে হেলিকপ্টার থেকে অবতরণকারী ভারতীয় সৈন্যদের ওপর খুব সহজে হামলা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তাদের ওপর কোনাে ধরনের হামলা চালাননি। হেলিকপ্টার থেকে অবতরণের সময় ভারতীয় সৈন্যরা বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। সে সময় খুব সহজেই তাদেরকে ফাঁদে ফেলে ধ্বংস করা যেত। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স মজিদকে শাস্তি দানের পরিবর্তে পুরস্কৃত করে। অবসর গ্রহণের পর তাকে লােভনীয় চাকরিও দেয়া হয়। ‘ইতিপূর্বে ভৈরব বাজারের পেছনে ভারতীয় ছত্রীসেনা অবতরণ করলে ১৪ ডিভিশন ও ২৭ ব্রিগেড তাদের ওপর হামলা চালাতে এবং ঢাকার প্রতিরক্ষায় অংশগ্রহণ করতে ঢাকায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু তাদেরকে হামলা চালানাের অনুমতি দেয়া হয়নি।’ | জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ফজল মুকিমকে নিযুক্ত করে ঘটনাবলী সম্পর্কে তাদের নিজেদের ভাষ্য লেখার জন্য। কাজী মজিদ ছিলেন লেঃ জেনারেল হামিদের (ভূপালী) ভাই। লাহােরে অবস্থানরত অফিসারদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে ইস্টার্ন কমান্ড ও আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দানের জন্য জেনারেল টিক্কা জেনারেল হামিদকে নিযুক্ত করেছিলেন। মজিদকে নির্দোষ প্রমাণ এবং ইস্টার্ন কমান্ডের ওপর দোষ চাপানাের এটা ছিল একটি সুচিন্তিত প্রচেষ্টা।  মজিদ ভৈরব সেতু উড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর এ নির্দেশ দান খুবই রহস্যময়। কারণ এ সেতুর প্রতি তখন কোনাে হুমকি ছিল না। তদুপরি সাদউল্লাহর ব্রিগেড ছিল মেঘনা নদীর অপর পাড়ে।

নিজের এলাকায় শত্রুর ওপর হামলার জন্য একজন জেনারেলের অনুমতি চাওয়ার প্রয়ােজন নেই। মজিদকে ঢাকায় পিছু হটে আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। সুতরাং পূর্বনির্ধারিত এলাকায় আসার জন্য তাকে অনুমতি চাইতে হবে কেন? মুকিম কার কাছ থেকে এ তথ্য জানতে পেরেছেন, তা আমি বুঝতে পারছি না। তিনি যখন এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে বই লেখা শেষ করেছেন তখন কাজী মজিদসহ আমরা ছিলাম ভারতে যুদ্ধবন্দি। আরেকটি কথা হলাে, ভারতের হেলিকপ্টারবাহিত সৈন্যদের মােকাবেলায় মজিদের গুরুতর অক্ষমতার অভিপ্রায় সম্পর্কে মুকিমের বইয়ে কিছুই বলা হয়নি। মুকিম হচ্ছেন একজন ভাড়াটিয়া লেখক। তিনি তার কলম ও বিবেক বিক্রি করেছেন। তাকে যা বলা হয়েছে তিনি তাই লিখেছেন। ভৈরবে মজিদের পেছনে ছত্রীসেনা নয়; হেলিকপ্টারবাহিত সৈন্য অবতরণ করেছিল। এর একদিন আগে টঙ্গীর কাছেও ছত্রীসেনা অবতরণ করেছিল। জায়গাটি ছিল মজিদের অবস্থান থেকে বহুদূরে। তিনি সেখানে যাননি এবং তাই তাঁর এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করার প্রশ্নই ওঠে।  হিলির পতন সম্পর্কে মুকিম যে ধরনের মিথ্যাচার করেছেন মজিদের অবস্থানের। কাছে ভারতীয় সৈন্য অবতরণ সম্পর্কেও তিনি একই ধরনের মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। ভুট্টো, গুল হাসান, টিক্কার মতাে লােক যারা পাকিস্তান ভাঙার চক্রান্ত। করেছিলেন, তাদের অপরাধ ও স্থলন চাপা দেয়ার জন্যই মুকিম কলম ধরেছিলেন। ‘সেতু এলাকা থেকে প্রায় দু’মাইল দক্ষিণে ভারতীয় সৈন্যর! মেঘনা নদী অতিক্রম করে। ভৈরব বাজারে শক্র গ্যারিসন নদী পারাপার বন্ধে কোনাে উদ্যোগ নেয়নি। এমনকি তারা হেলিকপ্টারে সৈন্য নামানাের ঘটনাও প্রত্যক্ষ করতে পারেনি। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে এবং নিজেদের মনােবল ভেঙে যাওয়ায় তার বাংকারে নিজেদেরকে আবদ্ধ রাখে।১০

এই একটিমাত্র ঘটনায় একজন ভারতীয় লেখক আমাদের সৈন্যদের সাহসিকতা। ও মনােবল সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। কাজী মজিদের বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ। ভূমিকার জন্যই ভারতীয় লেখক এমন মন্তব্য করতে পেরেছেন। অথচ তার এসব সৈন্যই ১৫ দিন শক্রর একটি ডিভিশনকে কোণঠাসা করে রেখেছিল এবং আশুগঞ্জে ট্যাংকের সমর্থনপুষ্ট শত্রু বাহিনীকে বেয়নেটের সাহায্যে বিতাড়িত করেছিল। সৈন্যদের মধ্যে পূর্ণমাত্রায় উদ্দীপনা ছিল এবং কমান্ডারদের আরােপিত যে কোনাে দায়িত্ব পালনের আগ্রহও তাদের ছিল। মজিদের কাপুরুষােচিত মন-মানসিকতার জন্যই ভারতের হেলিকপ্টারবাহিত সৈন্যরা আমাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।

ময়মনসিংহ-জামালপুর

এ সেক্টর ছিল ৩৬ এডহক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল জামশেদের কমান্ডে। ব্রিগেডিয়ার কাদির নিয়াজীর নেতৃত্বাধীন ৯৩ এডহক ব্রিগেড ছিল এ সেক্টর রক্ষার দায়িত্বে। ৯৩ এডহক ব্রিগেডে দুটি ব্যাটালিয়ন ছিল। ব্রিগেডিয়ার কাদির নিয়াজী ছিলেন একজন সাহসী কমান্ডার। তাঁর অনুপম নেতৃত্বের ফলে তার অন্যতম কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হন। এভাবে ভারতের ৯৫ ও ১৬৭ মাউন্টেন ব্রিগেডের অগ্রযাত্রা ২২ দিন বিলম্বিত হয়। ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা অভিমুখী রুটে নদ-নদীর প্রতিবন্ধকতা ছিল খুবই কম এবং এটাই ছিল ঢাকা পৌঁছার সংক্ষিপ্ততম পথ । ব্রিগেডিয়ার কাদির নিয়াজী ব্যর্থতার পরিচয় দিলে শত্রুরা অনেক আগেই ঢাকার প্রতিরক্ষা লাইনে পৌঁছে যেত। এ ব্রিগেড মুক্তিবাহিনীর এলাকায় প্রচণ্ড লড়াই করেছে। সেই এলাকায় জনগণ ছিল চরমভাবে বৈরি । প্রতিটি সৈনিকই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ লড়াই চালায়। দুটি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন নিয়ে ৯৩ এডহক ব্রিগেড গঠন করা হয়। এর একটি ছিল ৩১ বালুচ এবং অন্যটি ৩৩ পাঞ্জাব । ৩৩ পাঞ্জাব ছিল একটি আধা সামরিক রেজিমেন্ট। এ ব্রিগেডে একটি মর্টার ব্যাটারিও ছিল। ব্রিগেডিয়ার কাদির প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে জামালপুরে ব্রহ্মপুত্রের পেছনে এবং ময়মনসিংহে প্রধান প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তােলেন। তিনি নদীর অপর পাড়ে হাতিবান্দা, শেরপুর ও জামালপুর মেরুতে শক্রর অগ্রযাত্রা বিলম্বিত এবং তাদের ওপর নজরদারি করার জন্য চৌকি প্রতিষ্ঠা করেন। মুক্তিবাহিনী এ এলাকায়। অত্যন্ত তৎপর ছিল। তারা প্রায়ই জামালপুর ও হাতিবান্দায় আমাদের চৌকির ওপর হামলা চালাত। লেঃ কর্নেল সুলতানের নেতৃত্বাধীন ৩১ বালুচ ছিল এ মেরুর নিরাপত্তার দায়িত্বে। অন্যদিকে, কর্নেল রাজ্জাকের নেতৃত্বাধীন ৩৩ পাঞ্জাব ময়মনসিংহ মেরুর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত হয়। | হালুয়াঘাট, ফুলপুর, গােবড়াকুড়া, সরিষাপুর, দুর্গাপুর, বিসিসিড়ি ও পূর্বধলায় শক্রকে বাধা দানের জন্য অবস্থান তৈরি করা হয়। তবে মূল শক্তি নিয়ােগ করা হালুঘাটে। এই এড়হক ব্রিগেডে কোনাে ট্যাংক, ফিল্ড গান অথবা মাঝারি আর্টিলারিও ছিল না। আগ্নেয়াস্ত্রের অভাবে প্রতিরক্ষা সম্ভাবনা উল্লেখযােগ্যভাবে হ্রাস পায়। উপরােক্ত অবস্থানগুলাের দায়িত্ব ছিল যতক্ষণ সম্ভব ততক্ষণ শত্রুকে ঠেকিয়ে রাখা এবং এরপর ঢাকা দুর্গে প্রধান প্রতিরক্ষা লাইনে পিছু হটে আসা। ভারতীয় সেনাবাহিনী তাদের লজিস্টিক এরিয়া ১০১ কমিউনিকেশন জোন নিয়ে হামলা চালায়।

এ কমিউনিকেশন জোনে ছিল দুটি মাউন্টেন ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত একটি ডিভিশন এবং মুক্তিবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড। এ জোনকে ঢাকা  দখলে সহায়তা করার লক্ষ্যে টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ সেক্টরে মােতায়েন আমাদের সৈন্যদের ওপর হামলা করার দায়িত্বও দেয়া হয়। মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং ছিলেন এ কমিউনিকেশন জোনের কমান্ডার। ২১ নবেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে মেজর। জেনারেল শুরুবক্স সিং ব্যক্তিগতভাবে কামালপুর চৌকি অবরােধে অংশ নেন। কামালপুর চৌকিতে আমাদের এক প্লাটুন নিয়মিত সৈন্য এবং আরাে কিছু মুজাহিদ ছিল। এ চৌকির কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের বিপরীতে ছিল মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড। মুক্তিবাহিনীর এ ব্রিগেড আমাদের অবস্থানের ওপর বিরামহীন হামলা চালিয়েছে। একজন ভারতীয় জেনারেলের বিরুদ্ধে আমাদের তরুণ ক্যাপ্টেন। আহসান মালিক লড়াই করেছেন। ৪ ডিসেম্বর প্রত্যুষে কামালপুর পােস্টে পাকিস্তানি কমান্ডার ও তার ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের মধ্যে ওয়ারলেস বার্তা বিনিময় হয় এবং এ বার্তা ভারতীয়দের গােচরীভূত হয়। পােস্ট কমান্ডার সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য অনুমতি চাইছিলেন। কিন্তু ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তার এ অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করেন। গুরুবক্স সিং এ পােস্টে মনস্তাত্ত্বিক রণকৌশল প্রয়ােগ করেন। পাকিস্তানি পােস্টের কাছাকাছি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের পর সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মিগ-২১ সাত বার এ চৌকিতে রকেট নিক্ষেপ করে। একই দিন আরাে দু’বার বিমান হামলা হয়।

প্রথম হামলার পর শুরুবক্স সিং মুক্তিবাহিনীর একজন বাহকের মাধ্যমে পােস্ট কমান্ডারের কাছে একটি চিরকুট পাঠান। এতে তিনি বলেন, ‘আপনি বিগত কয়েকদিন ধরে সরবরাহ ও গােলাবারুদ আনতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এবং আপনি তাতে সফল হননি। এসব সরবরাহ আমাদের হাতে পড়েছে। আপনার পােস্টের সময় ফুরিয়ে গেছে এবং আপনি যে সিদ্ধান্তই নিন, আমরা কামালপুর চৌকি দখলে বদ্ধপরিকর। অপ্রয়ােজনীয় প্রাণহানি এড়ানাের জন্য আপনার কাছে এ বার্তা পাঠানাে হচ্ছে। গতকাল থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমরা আশা করি আপনি অবগত আছেন যে, এ মুহূর্তে আমাদের সৈন্যরা আপনার দক্ষিণে কয়েক মাইল দূরে তৎপরতা চালাচ্ছে। পােষ্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান কোনাে জবাব দেননি। মেশিনগান চালিয়ে তিনি যুদ্ধ অব্যাহত রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। জেনারেল গুরুবক্স সিং দ্বিতীয়বার বিমান হামলার নির্দেশ দেন। আবার দ্বিপ্রহরে এ পােস্টে বিমান হামলা হয়। গুরুবক্স সিং এবার দ্বিতীয় একটি বার্তা পাঠান। এ বার্তায় তিনি বলেন, ‘আপনি প্রথম বার্তার কোনাে জবাব দেননি। একটু আগে আপনি আমাদের ওষুধের স্বাদ গ্রহণ করেছেন। (পােস্টের ওপর বিমান হামলার প্রতি লক্ষ্য করে এ কথা বলা হয়)। আপনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিলে আমি আপনাকে এ নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, একজন সাহসী শত্রুর প্রাপ্য সম্মান আপনাকে দেয়া হবে।

দ্বিতীয় বার্তারও কোনাে জবাব দেয়া হয়নি। শক্রর কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সংকেত হিসেবে বাংকার থেকে মেশিনগান গর্জে ওঠে। এরপর পােস্ট কমান্ডার ও তার কমান্ডিং অফিসারের মধ্যে ওয়ারলেসে আবার কথা হয় । কমান্ডিং অফিসার অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানাের এবং প্রতিশােধমূলক বিমান হামলা চালানাের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু কোনােটাই বাস্তবায়িত হয়নি। জেনারেল গুরুবক্স সিং অধৈর্য হয়ে ওঠেন। তিনি বিকেলে আবার এ পােস্টের ওপর বিমান হামলার নির্দেশ দেন। অবশেষে তিনি চূড়ান্ত বার্তা পাঠান । বার্তায় তিনি বলেন, ‘আপনি আত্মসমর্পণ করবেন কিনা তা অবশ্যই বিকেল ৪টার মধ্যে জানাতে হবে। আমি আপনাকে আর সময় দিতে পারছি না। আপনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য একজন বার্তাবাহক নিয়ে এলে খুবই ভালাে হয়। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যে, আপনার কোনাে ক্ষতি হবে না।’ পােস্ট কমান্ডার এ বার্তারও কোনাে জবাব দেননি। তিনি পােস্টে মােতায়েন সকল অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। এতে গুরুবক্স সিং আরাে হতাশ হন। তিনি নৈশকালীন হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। এমন সময় পােষ্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন আহসান রাত ৭টায় একটি সাদা পতাকা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসেন এবং তার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন। তবে তিনি বলেন যে, তার (গুরুবক্স সিং) চরমপত্রে সাড়া দিয়ে নয়, বরং তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে তিনি আত্মসমর্পণ করছেন। ক্যাপ্টেন আহসান অবরুদ্ধ অবস্থায় অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছেন এবং ৭৫ জন নিয়মিত সৈন্য ও মুজাহিদ নিয়ে ২১ দিন পােল্ট অবরােধকারী একটি ব্রিগেডকে মােকাবেলা করার পর আত্মসমর্পণ করেন। ভারতের অব্যাহত গােলাবর্ষণ ও বিমান হামলা সত্ত্বেও এ পােস্টে প্রাণহানির সংখ্যা খুবই নগণ্য। প্রতিপক্ষরাও এ বালুচ ক্যাপ্টেনের বীরত্বের প্রশংসা করেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ তার অনমনীয় ভূমিকার প্রশংসা করে ক্যাপ্টেন আহসানের কাছে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন বার্তা পাঠিয়েছিলেন।

কামালপুর যুদ্ধবন্দিদের সাহসী সৈনিক হিসেবে প্রাপ্য যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য তিনি ফরমেশন কমান্ডারকে নির্দেশ দেন।’ (বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ : সুখবন্ত সিং)  ভারতীয় ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ক্লার জামালপুরে ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ওপর হামলা করতে এসে হতাশ হন। ব্রিগেডিয়ার ক্লারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড এবং বিএসএফ-এর কয়েকটি ব্যাটালিয়নও ছিল। তিনি বহু হামলা চালিয়েও আমাদের কোনাে একটি অবস্থানের পতন ঘটাতে পারেননি। ব্রিগেডিয়ার ক্লার ঢাকার দিকে এক ইঞ্চিও অগ্রসর হতে পারেননি। জামালপুরে ৩১ বালুচের কমান্ডিং অফিসার কর্নেল সুলতান আহমদ ও তার মধ্যেও বার্তা বিনিময়ের চমৎকার ঘটনা ঘটে। সুখবন্ত সিংয়ের বই থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দেয়া হলাে : ৯ ডিসেম্বর বিকেল ৫টায় ক্লার জামালপুরে ৩১ বালুচের কমান্ডিং অফিসারের কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দিয়ে মুক্তিবাহিনীর একজন কুরিয়ারের মাধ্যমে তার কাছে একটি চিরকুট পাঠান। এ কমান্ডিং অফিসারের সরবরাহ পথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছিল এবং তিনি প্রতিরােধ অব্যাহত রাখলে তার ওপর আরাে প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করা হতাে। সন্ধ্যায় লেঃ কর্নেল সুলতান মাহমুদ (আহমদ) এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জবাব দেন। তিনি একটি খামে একটি চীনা বুলেট ভরে পাঠিয়ে দেন। এতে তিনি বলেন, ‘আশা করি আপনি সুস্থ আছেন। চিঠির জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা জামালপুরে লড়াই শুরু হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছি। তবে এখনাে লড়াই শুরু হয়নি। সুতরাং আলােচনা না করে চলুন আমরা লড়াই শুরু করি। ৪০ বার বিমান হামলা যথেষ্ট নয়। আরাে বিমান হামলা চালাতে বলুন। আপনার কলমে ধার আছে। আশা করি পরবর্তী সময়ে কলমের পরিবর্তে আপনার হাতে একটি স্টেনগান দেখবাে। কমান্ডার, জামালপুর দুর্গ।’  ৯ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল আনসারী আমাকে জানালেন যে, শত্রুর প্যারা ব্রিগেডকে স্থল অভিযান থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। ছত্রীসেনা কোথায় অবতরণ করতে পারে, আমি এ নিয়ে দ্রুত চিন্তা করতে লাগলাম। টাঙ্গাইল ও টঙ্গীকে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বলে মনে হলাে। এ দুটি জায়গা থেকে শত্রু ময়মনসিংহ থেকে ৯৩ ব্রিগেড প্রত্যাহারের পথ অবরােধ করতে পারে। টঙ্গী ঢাকার খুব সন্নিকটে হওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানে ছত্রীসেনা অবতরণে বাধা দিতে পারবে। তাই টাঙ্গাইলকে ছত্রীসেনা অবতরণের জন্য সবচেয়ে সম্ভাব্য স্থান বলে মনে হতে লাগলাে।

তাই আমি মেজর জেনারেল জামশেদকে ময়মনসিংহ থেকে ৯৩ ব্রিগেড প্রত্যাহারের নির্দেশ দেই। আমি অন্যান্য ডিভিশনের কমান্ডারদেরও তাদের মূল অবস্থানে পিছু হটার নির্দেশ দেই। ১০ ডিসেম্বর বিকেলে টাঙ্গাইলে শক্রর ছত্রী সৈন্য। অবতরণ করেন। ৯/১০ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে ব্রিগেডিয়ার কাদিরকে ঢাকায় পিছু হটার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। ৩১ বালুচ জামালপুর ও কামালপুরে ২১ দিন শক্রর অগ্রযাত্রা সাফল্যের সঙ্গে প্রতিহত করে। তারা ছিল অবরুদ্ধ। কিন্তু তারা বেয়নেট চার্জ করে শত্রুর অবরােধ ভেঙে তাদের পথ বের করে নেয়। লে. কর্নেল রাজ্জাকের নেতৃত্বে ৩৩ পাঞ্জাব বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে এবং এ সেক্টরে শত্রুকে কোণঠাসা করে রাখে। তারা ভয়াবহ লড়াইয়ের মুখােমুখি হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস। ব্যবহার করা হয়। তা থেকেও তারা রক্ষা পেয়েছে। তারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে। পিছু হটে আসে। মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং আহত হন এবং ১০১ কমিউনিকেশন জোনের। কমান্ডার হিসেবে মেজর জেনারেল নাগরা তার স্থলাভিষিক্ত হন। গুরবক্স সিং ছিলেন একজন অভিজ্ঞ ও বাস্তববাদী জেনারেল। অন্যদিকে, নাগরা ছিলেন দাম্ভিক ও একজন ড্রয়িংরুম কৌশলবিদ । আমাদের পিছু হটার সময় নাগরার প্রতিটি হামলা। ব্যর্থ করে দেয়া হয়। ব্রিগেডিয়ার কাদির প্রতিটি বিলম্বিতকরণ অবস্থানে ভারতীয়দের। ২৪ ঘণ্টার বেশি আটকে রাখেন। কোনাে অবস্থায় এবং কখনাে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী আমাদের ফাঁদে ফেলতে পারেনি। আমাদের সৈন্যরা প্রতিটি ঘটনায়। নিজেদেরকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে এবং শত্রুকে সাবধানে পা ফেলতে বাধ্য করেছে। শত্রুদেরকে ঢাকা এগিয়ে আসার সময় বিশৃঙ্খল ও নির্জীব হয়ে পড়তে । দেখা গেছে। ৯৩ ব্রিগেড ভালােভাবে ঢাকা পৌছে। কিন্তু এর ব্রিগেড সদর দপ্তর ও রক্ষীদল। কালুয়ারকারে শক্রর ছত্রী সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে যায় । ব্রিগেডিয়ার কাদিরের নেতৃত্বাধীন এই ক্ষুদ্র বাহিনী শক্রর অগ্রযাত্রা ৪ দিন বিলম্বিত করে। এরপর তারা ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে। তাদের কোনাে বিশ্রাম ছিল না। গােলাগুলিও ফুরিয়ে। যায়। এ অবস্থায় ব্রিগেডিয়ার কাদির যুদ্ধবন্দি হন।

১১ ডিসেম্বর লে. জেনারেল সগৎ সিং তার সৈন্যদের হেলিকপ্টারে করে মেঘনা নদী পার করান। ময়মনসিংহ থেকে পিছু হটা সৈন্যদের পথ রােধ করে দাড়ানােই ছিল সেখানে হেলিকপ্টারে সৈন্য নামানাের লক্ষ্য। এছাড়া, ভৈরব সেতুর পশ্চিমাংশ দখল করাও ছিল আরেকটি উদ্দেশ্য। ভারতীয় সৈন্যরা এসে পৌঁছানাের আগেই ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহর ব্রিগেড আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজারে এসে পৌঁছে এবং অবস্থান গ্রহণ করে। হেলিকপ্টারে করে সৈন্য পরিবহনের সামর্থ্য ছিল অরােরার। তুরুপের তাস। ময়মনসিংহ থেকে ৯৩ ব্রিগেডের ঢাকা এবং আশুগঞ্জ থেকে। সাদউল্লাহর ব্রিগেড ভৈরব বাজারে পৌঁছার ঘটনায় শত্রুর কৌশল ব্যর্থ হয়ে যায় । শত্রু এ দুটি ব্রিগেডের পথ রােধ করতে ব্যর্থ হয়।  ঢাকার আশপাশে মােতায়েন অরােরার অধিকাংশ সৈন্যই ছিল পদাতিক। তাদের ভারী ট্যাংক ও দূরপাল্লার কামানের ঘাটতি ছিল। তবে ঢাকা দখলে ব্যর্থতার জন্য এটাই একমাত্র কারণ ছিল না। ১২ ডিসেম্বর অরােরা ঢাকার আশপাশে মােতায়েন সকল সৈন্যকে লে. জেনারেল সগৎ সিংহের কমান্ডে ন্যস্ত করেন। তাকে ঢাকা দখলের দায়িত্ব দেয়া হয়। ৯ ডিসেম্বর অরােরার এ কাজ করা উচিত ছিল। ছত্রী সেনাদের তিনি তার ব্যক্তিগত কমান্ডে রেখে দেন। নাগরা ছিলেন একটি ডিভিশনের কমান্ডে। তবে হেলিকপ্টারবাহিত সৈন্য ছিল সগৎ সিংয়ের নেতৃত্বে। একই উদ্দেশ্যে একাধিক কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এভাবে সার্বিক কমান্ডে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। এ জন্য এ অভিযান ইপ্সিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। জেনারেল সগৎ প্রস্তুতি গ্রহণ, রেকি এবং সৈন্য ও সম্পদ সংগ্রহে ৭ দিন সময় চান। মেজর জেনারেল খুশবন্ত সিংয়ের ভাষায় : এ সময় যুদ্ধে ভারতীয়রা আর্টিলারি ও সাজোয়া বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট ৪টির বেশি  দুর্বল ব্রিগেড প্রস্তুতে সক্ষম ছিল না। ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যুহে আঘাত হানার লক্ষ্যে। প্রয়ােজনীয় সমরসজ্জা গড়ে তােলার জন্য আরাে কয়েকদিন লাগতাে।’  ঢাকার ভেতরে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়। অভিজ্ঞ অফিসারদের কমান্ডে পােড়-খাওয়া সৈন্যদের এসব প্রতিরক্ষা ব্যুহে মােতায়েন করা হয়। অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়ে আসা হয় এবং তাদেরকে ঢাকার প্রতিরক্ষা আরাে সংহত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ভৈরব বাজার, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ- এ তিনটি দুর্গ নিয়ে ঢাকা প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্স গঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জ দুর্গ ঢাকার পশ্চাৎভাগ রক্ষা করছিল।

ঢাকা থেকে দূরে হলেও ভৈরব বাজার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সড়ক রক্ষা করতাে। ভারতের চতুর্থ কোরের ঢাকা এগিয়ে আসার সেটাই ছিল মূল পথ। ফরিদপুরের জন্য কুষ্টিয়ার অবস্থানের যে গুরুত্ব ছিল। ঢাকার জন্য ভৈরব বাজারের অবস্থান ছিল একই রকম। বিচ্ছিন্নভাবে এ তিনটি অবস্থানে হামলা করা যেত না। একযােগে হামলা চালাতে হতাে। একটি দুর্গে হামলা করা হলে অপর দুটি দুর্গও মােকাবেলা করতে হতাে। ঢাকা বিচ্ছিন্ন ছিল না। ঢাকা কমপ্লেক্সকে মােকাবেলা করার জন্য পর্যাপ্ত সৈন্য সংগ্রহ করা অরােরার পক্ষে দুরূহ হয়ে উঠত। কামালপুরে একটি মিশ্র কোম্পানি ২১ দিন শক্রর দুই ব্রিগেড সৈন্যকে আটকে রেখেছিল। হিলিতে আমাদের। মাত্র একটি ব্যাটালিয়ন ভারতের ৫টি পদাতিক ও একটি ট্যাংক ব্রিগেড নিয়ে গঠিত একটি পুরাে ডিভিশনকে ঠেকিয়ে রেখেছিল। বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদ সত্ত্বেও ভারতীয়রা হিলি দখল করতে পারেনি। আমাদের সৈন্যরা ১৯ দিন হিলি দখলে রেখেছিল এবং ভারতীয় অবরােধ ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল। জামালপুর, আশুগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও দৌলতপুরেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ঢাকা দুর্গে আমাদের সৈন্য ছিল ৩১ হাজারের বেশি। বিরাজিত পরিস্থিতিতে ঢাকা প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্স ছিল দুর্ভেদ্য। ভারতীয়দের নিজেদের ভাষ্য অনুযায়ী, ১২টি ডিভিশনের মধ্যে মাত্র তাদের ৪টি দুর্বল ব্রিগেড ঢাকা আক্রমণের জন্য তখন প্রস্তুত ছিল। ঢাকার মতাে একটি সুরক্ষিত এলাকা যেখানে আমার ৩১ হাজার সৈন্য ছিল এবং ব্যক্তিগতভাবে যেখানে আমি সৈন্য পরিচালনা করছিলাম, সেখানে ঐ পরিমাণ শক্তি নিয়ে তারা কি ঢাকা দখল করতে পারতাে? না, কখনাে না। সামরিক বিবেচনায় আমরা ভারতের ১২টি ডিভিশনকে মােকাবেলা এবং এসব ডিভিশনকে বিচ্ছিন্ন করে রাখতে সক্ষম হই। যশাের ও ময়মনসিংহ (যেখান থেকে আমরা সৈন্য প্রত্যাহার করেছিলাম) এছাড়া। সকল বড় শহর এবং চট্টগ্রাম ও চালনাসহ সকল সমুদ্র বন্দর ও বিমানক্ষেত্র ছিল তখনাে আমাদের নিয়ন্ত্রণে।

কিন্তু একটি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে পাকিস্তান ভেঙে দেয়া হয় এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গৌরব ধূলিস্যাৎ ও ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ও সৈন্যদের পরিত্যাগ করা হয়। আমাদেরকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে অসম্মানিত করা হয়। আমরা পরাজিত হইনি। আমাদেরকে পরিত্যাগ এবং আমাদের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় যারা শহীদ হয়েছেন তাঁদের রক্তের জন্য দায়ী কে? আমরা আমানত হিসেবে শহীদদের দাফন করেছি। তাদের দেহাবশেষ পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা উচিত। স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে সম্মান প্রদর্শন করা উচিত ঐসব শহীদদের প্রতি; যারা পাকিস্তান ভেঙেছে তাদের প্রতি নয়। আমেরিকানরা যদি ভিয়েতনামে তাদের সৈন্যদের লাশ খুঁজে দেশে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে আমাদের সরকারের পক্ষেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে আমাদের সৈন্যদের লাশ নিয়ে আসা সম্ভব। কারণ পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের ভালাে সম্পর্ক রয়েছে। কোনাে সৈন্যের বীরত্বে মুগ্ধ হলে শত্রুর যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ সৈন্য অংশগ্রহণ করেছিল এবং এবং এ যুদ্ধ ৬ বছর স্থায়ী হয়। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে শত্রুপক্ষের সৈন্যকে সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করার ঘটনা ঘটেছে মাত্র একটি। এ ভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছেন। একজন ব্রিটিশ সার্জেন্ট। এ সার্জেন্টকে ওয়েস্টার্ন ডেজার্টে জার্মান সৈন্যাধ্যক্ষ ফিল্ড মার্শাল রােমেলকে হত্যা করার জন্য পাঠানাে হয়েছিল। তিনি এত চমৎকারভাবে এবং এত সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন যে, রােমেল স্বয়ং তাকে সামরিক মর্যাদায় সমাহিত করার নির্দেশ দেন। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার অধীনে ছিল মাত্র ৪৫ হাজার নিয়মিত ও আধাসামরিক সৈন্য। পূর্ব পাকিস্তানে ২৬ দিনের প্রকাশ্য যুদ্ধকালে ভারতীয়রা ৪ জন পাকিস্তানি সৈন্যকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করেছিল। আমার মতে, আর কোনাে সেনাবাহিনী এ ধরনের সম্মান পায়নি। নিম্নোক্ত সৈন্যদের সামরিক মর্যাদায় দাফন করা হয় :

(১) ১৬তম ডিভিশনে বগুড়া সেক্টরে ২৪ ক্যাভালরির নায়েক সারােয়ার ।

একজন ভারতীয় লে. কর্নেল ব্রিগেডিয়ার তাজাম্মুল হােসেনের সামনে। মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্র কাছে নায়েক সারােয়ারের বীরত্বের কাহিনী ব্যক্ত করেন। ওই ভারতীয় লে. কর্নেল বগুড়া সেক্টরে একটি গার্ড ব্যাটালিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এবং

(৩) ৩১ বালুচের মেজর আইউব ও। পশ্চিম পাকিস্তানি রেঞ্জার্সের নায়েক আবদুল সাত্তারকে ময়মনসিংহ সেক্টরে ভারতীয়রা সামরিক মর্যাদায় দাফন করে। ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ক্লার (পরে মেজর জেনারেল) ব্রিগেডিয়ার কাদির নিয়াজীর কাছে কর্তব্যের প্রতি তাদের নিষ্ঠা ও সাহসিকতার বর্ণনা দেন। ১০১ কমিউনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল নাগরাও এ ঘটনা স্বীকার করেছেন।

(৪) মাসলিয়ায় এক হামলায় ৩৮ এফএফ (১০৭ ব্রিগেড, ৯ ডিভিশন) এর মেজর আনিস নিহত হন। ভারতীয় ৯ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল দলবীর সিং মেজর আনিসকে সামরিক মর্যাদায় দাফন করেন এবং তিনি। নিজে ফাতেহা পাঠ করেন।১২ হুকাম দাদের বীরত্বের উপাখ্যান এর আগে বর্ণনা করা হয়েছে। তাদের প্রত্যেকে নিশান-ই-হায়দার পদক পাওয়ার যােগ্য। কিন্তু তাদেরকে এ সম্মান দেয়া হয়নি। কারণ যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্ব ও আত্মত্যাগ বলতে কি বুঝায় তা অনেকেই জানে। আমাদের ভাগ্য ঐসব সুবিধাবাদীদের কাছে জিম্মি ছিল যারা ক্ষমতা দখল অথবা ক্ষমতায় টিকে থাকার তীব্র লড়াইয়ে জড়িত ছিল। আন্তঃবাহিনী, আন্তঃসেনাবাহিনী ও বেসামরিক-সামরিক সহযােগিতা পূর্ব পাকিস্তান সরকারে কর্মরত সকল সার্ভিস, শাখা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে টিম ওয়ার্ক ও সহযােগিতা ছিল চমৎকার। আমি সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা এবং স্থানীয় ও ভারতীয়দের সঙ্গে মােকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের বিস্তর অভিজ্ঞতা থেকে লাভবান হয়েছি। এটা আমার জন্য খুবই গর্বের বিষয় যে, আমি আমার সৈন্যদের সবসময় উৎফুল্ল এবং পাকিস্তানের সংহতি রক্ষায় জীবন দানে প্রস্তুত দেখেছি। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ অফিসারদের পুর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়েছিল এবং এসব অফিসার বিদ্রোহ চলাকালে এবং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে। কখনাে সম্মুখভাগে আবার কখনাে বা পশ্চাদভাগে থেকে তাদের ইউনিট ও ফরমেশনগুলােকে দক্ষতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে তারা। অদ্বিতীয় সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। পাকিস্তান নৌবাহিনী ভাইস অ্যাডমিরাল মােহাম্মদ শরীফের কমান্ডে মাত্র ৪টি গানবােট নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নৌবাহিনী গঠিত হয়েছিল। সমুদ্র ও নদীতে শত্রুর শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আমাদের নৌসেনারা তেজস্বিতা, সাহসিকতা ও দক্ষতা দেখিয়েছে। তারা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সহায়তা দিয়েছে। বিলােনিয়া অপারেশনে তাদের অবদান প্রশংসনীয়। ক্যাপ্টেন জমিরের নেতৃত্বে নৌসেনারা সেখানে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। ক্যাপ্টেন জমির সবসময়ই তার কর্তব্য পালনে প্রস্তুত ছিলেন এবং ঝুঁকি গ্রহণে কখনাে ভয় পেতেন না। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!