জয় বাংলা ১৩ আগস্ট ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপাত্র
মুজিবনগরঃ প্রথম বর্ষ, ১৪শ সংখ্যা শুক্রবার ২৭শে শ্রাবণ, ১৩৭৮, ১৩ই আগস্ট ‘৭১
বন্ধ কর এই বিচার প্রহসন
বাংলাদেশের মুক্ত এলাকার সংগ্রামী মানুষ, অবরুদ্ধ এলাকার মৃত্যুঞ্জয়ী জনতা এবং তার সঙ্গে বিশ্ব বিবেকের সোচ্চার কণ্ঠ মিলিত ধ্বনি তুলছেঃ
১. বন্ধ কর এই বিচার প্রহসন
২.বঙ্গবন্ধুকে যুক্ত করো
৩. বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ
মাঠে, ময়দানে, কলে-কারখানায়, দেয়ালে দেয়ালে সেই কন্ঠের সুর ধ্বনি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে -দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অভিযান। এক মুজিব এর কন্ঠ থেকে কোটি কণ্ঠে বজ্রের মতো ধ্বনিত হচ্ছেঃ জয় বাংলা- বাংলার জয়।
শিশুঘাতী, নারীঘাতী, গণহত্যাকারী ইয়াহিয়া চক্রের শাস্তি আড়ালে নয় -বিশ্ব বিবেকের উন্মুক্ত গণআদালতে।
ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনী অবশ্যই বিচারের রায় দিয়ে দিয়েছে আগেই- ২৫শে মার্চের মধ্যরাতে কাপুরুষের মত বাঙালি নিধন যজ্ঞে অবতীর্ণ হয়ে। আর সেই কলঙ্কিত অধ্যায় কে চাপা দেয়ার জন্য তারা বসিয়েছে বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন। তারা বন্দুকের নল উদ্যত রেখে বিচারকের আসনে বসিয়েছে তাদের নিজেদের মনগড়া অভিযোগের বিচার করতে। তাই শুধু বাংলাদেশের নয় সমগ্র এশিয়ার শান্তি ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কে সুরক্ষিত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব সারাবিশ্বের।
স্বৈরতন্ত্র ও সামরিক একনায়কত্ব-না গণতন্ত্র ও সামরিক জান্তার পশুশক্তি -না জনগণ? মানুষ কোনটি বেছে নেবে, বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রশাসন আজ বিশ্ব বিবেকের কাছে এই মৌলিক প্রশ্ন তুলে ধরেছে।
বাংলা নব অগ্নিযুগের স্রষ্টা শোষিত মানুষের মুক্তির মূর্ত প্রতীক স্বাধীনতার তূর্যবাদক লক্ষ-কোটি মানুষের ভালোবাসার সিক্ত অগ্নিপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তথাকথিত বিচারের নামে প্রহসন শুরু করেছে তার বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশের কোটি কন্ঠে আজ সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
সভ্যতার ইতিহাসে বৃহত্তম ট্রাজেডি
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে বলেন ইসলামাবাদের জঙ্গীচক্র কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে যে বিচারের প্রহসন অনুষ্ঠিত হচ্ছে সভ্যতার ইতিহাসে তা বৃহত্তম ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিবৃতিতে তিনি সভ্যতা গণতন্ত্র ও মানবতার নামে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারবর্গের বিনাশর্তে মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ করার দাবি করা হয়েছে।
উথান্টের গভীর উদ্বেগ
জাতিসংঘের জনৈক মুখপাত্র উ থান্ট বলেন যে, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট এই মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, শেখ মুজিবের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যে কোন পরিণতি পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন
শেখ মুজিবের বিচারের নামে খুনি ইয়াহিয়া সরকার যে অপচেষ্টায় মেতে উঠেছে তাতে মানবিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
প্রেস অফিসার জন কিং বলেছেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আদান-প্রদানের সম্ভাবনার উপর যে প্রতিক্রিয়াশীল প্রবেশের সেজন্য ও মার্কিনরা উদ্বিগ্ন।
ভারত উৎকন্ঠিত
ভারত সরকার গত ৯ই আগস্ট সোমবার নয়াদিল্লিতে এই বলে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে শেখ মুজিবুর রহমানের কোর্টমার্শাল’ হলে পাক জঙ্গীকে তার সমুচিত ফল ভোগ করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার স্মরণ সিং লোকসভায় একথা ঘোষণা করেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের সময় শেখ মুজিব জীবিত নাও থাকতে পারেন বলে ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধেও ভারতের তীব্র ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করেন।
আন্তর্জাতিক জ্যুরিস্ট কমিশনের প্রতিবাদ
জেনেভা থেকে গত দশ ই আগস্ট আন্তর্জাতিক জ্যুরিষ্ট কমিশনে আন্তর্জাতিকভাবে ইয়াহিয়ার কাছে শেখ মুজিবের বিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে।
কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়াল ম্যাকডেরমট স্বাক্ষরিত ওই বার্তায় বলা হয়েছে যে, আন্তর্জাতিক জ্যুরিস্ট কমিশন সামরিক আদালতে গোপনে শেখ মুজিবের বিচারের প্রতিবাদ করেছেন। বিচারের ক্ষেত্রে গোপন করার কিছু নেই।
আবার সাধারণতন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ
সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্র পাকিস্তানে জঙ্গি কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আধা-সরকারি সংবাদপত্র পত্র আল-আহরাম এক সম্পাদকীয়তে বলেছেন, সামরিক বা গোপনে আদালতে বিচারের দ্বারা জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব নয়; অস্ত্র বলের সাহায্যে ও কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে দাবিয়ে রাখা যায় না। বিচারের প্রহসন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সভ্যতার ইতিহাসে তা বৃহত্তম ট্রাজেডি ছাড়া আর কিছুই নয়।
বিবৃতিতে তিনি ন্যায়, সভ্যতা, গণতন্ত্র ও মানবতার নামে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্টের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারবর্গের বিনাশর্তে মুক্তির জন্য হস্তক্ষেপ করার দাবি করা হয়েছে।
উ থান্টের গভীর উদ্বেগ
জাতিসংঘের জনৈক মুখপাত্র বলেন যে সংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মিস্টার উথান্ট উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, শেখ মুজিবের ভবিষ্যতের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যেকোনো পরিণতির পাকিস্তানের সীমানা ছাড়িয়ে সর্বত্র প্রভাব বিস্তার করবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন
শেখ মুজিবের বিচারের নামে খুনি ইয়াহিয়া সরকারি অপচেষ্টা মেতে উঠেছে তাতে মানবিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
প্রেস অফিসার জন কিং বলেছেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে সংক্ষিপ্ত বিচারের মাধ্যমে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে তা বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আদান-প্রদানের সম্ভাবনা উপর যে খারাপ প্রতিক্রিয়া পড়বে সেজন্য ও মার্কিনিরা উদ্বিগ্ন।
ভারত উৎকণ্ঠিত
ভারত সরকার গত ৯ই আগস্ট (সোমবার) নয়াদিল্লিতে এই বলে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন যে, শেখ মুজিবুর রহমানের কোর্টমার্শাল’ হলে জঙ্গী শাহী কে তার সমুচিত ফল ভোগ করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার স্মরণ সিং লোকসভায় একথা ঘোষণা করেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে পাক জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের সময় শেখ মুজিব জীবিত নাও থাকতে পারেন বলে ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দিয়েছিলেন তার বিরুদ্ধেও ভারতের তীব্র ক্ষোভের কথা ব্যক্ত করেন।
আন্তর্জাতিক যুরিস্ট কমিশনের প্রতিবাদ
জেনেভা থেকে গত ১০ই আগস্ট আন্তর্জাতিক যুরিস্ট কমিশনের আনুষ্ঠানিকভাবে ইয়াহিয়ার কাছে শেখ মুজিবের বিচারের প্রতিবাদ জানিয়ে বার্তা পাঠিয়েছে।
কমিশনের সেক্রেটারি জেনারেল নিয়াল ম্যাকডেরমট স্বাক্ষরিত ওই বার্তায় বলা হয়েছে যে আন্তর্জাতিক যুরিস্ট কমিশন সামরিক আদালতে গোপনে শেখ মুজিবের প্রতিবাদ করেছে। বিচারের ক্ষেত্রে গোপন করার কিছু নেই।
আবার সাধারণতন্ত্রেরর তীব্র প্রতিবাদ
সংযুক্ত আরব সাধারণতন্ত্র পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের তীব্র ভাষায় প্রতিবাদ জানিয়েছে।
আধা-সরকারি সংবাদপত্র আল আহরাম এক সম্পাদকীয়তে বলেছেন সামরিক বা গোপন আদালতে বিচারের দ্বারা জাতীয় ঐক্য বজায় রাখা সম্ভব নয়, অস্র বলের সাহায্যেও কখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতকে দাবিয়ে রাখা যায় না।
জল্লাদের শ্বেত পত্র
ইসলামাবাদের ঘাতকরা বাংলাদেশে তাদের ঘৃণ্যতম গণহত্যার জন্য একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছে। কিন্তু জল্লাদদের প্রতীকী রং কালো; শত শ্বেতপত্রেও তাদের সেই জঘন্য কলঙ্কের কালিমা ঢাকা পরবেনা। একটি জাতিকে সুপরিকল্পিতভাবে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানী জল্লাদ -সামরিক বাহিনীর সাহায্যে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত যেভাবে প্রতিবাদ মুখর ও সঙ্গবদ্ধ হয়ে উঠেছে এই শ্বেত পত্র তাদের নিরস্ত্র করার একটা অন্তিম প্রয়াস মাত্র।
আমরা জানি ইসলামাবাদের জল্লাদ বাহিনীর সে উদ্দেশ্য সফল হবে না। একদিকে ঘাতকবাহিনী শ্বেত পত্র অপরদিকে রয়েছে বিশ্বের পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশনের খবর ও সংবাদ চিত্র এবং বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত প্রহরী- সাংবাদিকরা। শিশুঘাতী, নারীঘাতী, গণহত্যাকারী ইয়াহিয়া চক্রের মিথ্যার বুনিয়াদের উপরে রচিত শ্বেত পত্র কোনদিনই তাকে লুকাতে পারবেনা; পারবে না এ গণহত্যার কালিমা ঢাকতে। কিন্তু অপরাধী যেমন নিজের অজান্তে নরকে যায় তার অপরাধের স্বাক্ষর, ইয়াহিয়ার শ্বেত পত্রেও তেমনি ভাবে রয়ে গেছে তাদের জঘন্য অপরাধের স্বীকৃতি।
শ্বেত পত্র ইয়াহিয়া চক্র অন্তত একটা সত্য স্বীকার করেছে। বাংলাদেশের যে ব্যাপক গণহত্যা ঘটেছে, ঘটেছে নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ-শ্বেত পত্রে তার স্বীকৃতি রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশে এই নারকীয় ঘটনা ঘটেছিল কখন? ২৫ শে মার্চের রাত থেকে, না তার পূর্বে। ‘গিভ দি ডগ এ নেম এন্ড কিল ইউ’ প্রবচনটি সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশে গণহত্যা চালাবার ক্ষেত্রে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীর পুরোহিত ইয়াহিয়া খান এবং তার ঘাতক সহচরেরা এই প্রবচনটি কে একটু ঘুরিয়ে কাজে লাগাতে চেয়েছে। দে ফিল্ড দ্যা পিপল ফার্স্ট, অ্যান্ড দেন গিভ এ নেম । প্রথমে তারা নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-যুব-শিশু, নির্বিশেষে বাঙালির নরমুণ্ড নিয়ে গেন্ডুয়া খেলেছে। তারপর সামরিক অসামরিক, সরকারি-বেসরকারি উপদেষ্টা ও অনুচরদের নিয়ে তাদের ঘৃণ্যতম অপকর্মের সাফাই গাওয়ার জন্য দুর্নামের ফিরিস্তি তৈরি করেছে শ্বেত পত্র নামক কালো পত্রে। কারণ তারা জানত প্রথমে ব্যাড নেম অর্থাৎ দুর্নাম দেবার সমস্ত পথ তাদের জন্য রুদ্ধ। মার্চ মাসের পয়লা তারিখ থেকে সারা বিশ্বের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছিল বাংলাদেশের প্রতি। তখন থেকেই সারা পৃথিবীর প্রখ্যাত সংবাদপত্র, সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ও রেডিও-টেলিভিশন প্রভৃতির প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। কাদের প্রেরিত সংবাদে সংবাদ চিত্রের এই নারকীয় অধ্যায়ের কোন উল্লেখেই নেই-বরং অবাক বিস্ময়ে তারা ইতিহাসের একটি অনন্য অধ্যায় প্রত্যক্ষ করেছে। প্রত্যক্ষ করেছে ইয়াহিয়া চক্রের জঙ্গিশাহীদের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের প্রচন্ডতা অথচ অবিশ্বাস্য সংযম।
উস্কানি দিয়ে ইয়াহিয়া চক্র এই সব ভেঙে দিতে চেয়েছিল দোসরা মার্চে আকস্মিকভাবে কার্ফু জারি করে। কিন্তু পারেনি বাংলাদেশের মালয়েশিয়ার অসহযোগ আন্দোলনের সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে হিংসার পথে পা বাড়াতে প্ররোচিত করেছিল ইয়াহিয়া চক্র মার্চের মাঝামাঝি জয়দেবপুর এবং টঙ্গীর উস্কানিমূলক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নীতিতে অবিচল সচেতন জনতা উস্কানির পথে পা বাড়ায়নি। বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ প্রতিনিধিরা তাও সহ বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছেন। তাই ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষে প্রথমে ব্যাড নেম বা দুর্নাম দেবার পথ খোলা ছিলো না; আর ছিল না বলেই রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ক্ষ্যাপা কুকুরের মত।
অসহযোগ আন্দোলনের পর্যায়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সংবাদ সংগ্রহে কিংবা গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের কোনো প্রয়োজন হয়নি গণ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের। কাপুরুষের মত ঘৃণ্যতম গণহত্যায় প্রকৃত হবার পর সে প্রয়োজন হয়েছিল ইয়াহিয়া টিক্কা চক্রেরই। তারা বিদেশী সাংবাদিকদেরকে ছাগল, ভেড়ার মতো অবরুদ্ধ করে তাদের তোলা ছবি ও ক্যামেরা বাজেয়াপ্ত করে অভুক্ত ও প্রায় অর্ধনগ্ন অবস্থায় বাংলাদেশের মাটির ছাড়তে বাধ্য করেছিল।
আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের মানুষেরা ইয়াহিয়া চক্র গঠিত সময়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকত তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে কেমন করে নির্ভেজাল ভালো মানুষের মতো শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের ‘সাধু উদ্দেশ্যে’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল? বাংলাদেশে গণহত্যা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কে হত্যার স্বপক্ষে সাফাই গাইবেন উদ্দেশ্যে ছাব্বিশে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান যে বেতার ভাষণ দিয়েছিল তাতে ও শ্বেত পত্র কথিত অভিযোগ আনা হয়নি। কারণ শ্বেত পত্রের সমগ্র ব্যাপারটা পরবর্তীকালে পরিকল্পিত এবং নিজেদের কুকীর্তি গুলোকে বাঙালি দেশপ্রেমিকদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেবার অপপ্রয়াসে রচা কাহিনী।
এই শ্বেতপত্রে বলা হয়নি, কেন ভিটেমাটি জীবিকার সহায়-সম্বল ছেড়ে প্রায় এক কোটি মানুষ পার্শবর্তী দেশসমুহ অনিশ্চিত জীবনের পথে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়েছে। একজন দুজন নয় -লক্ষ লক্ষ মানুষ সাধ করে কোন দিন সাত পুরুষের ভিটা আর সহায়-সম্বল ছেড়ে অনির্দেশের পথে পা বাড়ায় না। ইসলামাবাদের ঘাতকচক্রের অবিশ্রাম প্রচারণা সত্বেও কেন আজও বাস্তভিটা ও দেশ ত্যাগের অবিরাম স্রোত অব্যাহত রয়েছে। শ্বেতপত্রে পাকিস্তানের জল্লাদরা এ প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারেনি। পারেনি কারণ তাদের কোনো জবাব নেই।
মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মার খেয়ে ইসলামাবাদের অসুর-পুরে মরা কান্না পড়েছে। তাই তারা জাতিসংঘের দোরে ধর্না দিচ্ছে পর্যবেক্ষক মোতায়েন করানোর জন্য, যদিও ত্রাণকার্য এর ব্যাপারে ইসলামাবাদ সরকারেই জাতিসংঘের তদারকি ব্যবস্থার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল। কারণ তখন তারা ছিল জয়ের আনন্দে ডগোমগো এবং নিজেদের কুকীর্তি ঢাকবার পন্থাও বের করতে পারেনি। অপরদিকে বিশ্বজনমত ক্রমে ইসলামাবাদের জল্লাদ শাসকের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে এবং জোরদার হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের সফল গেরিলা তৎপরতা। এরই মুখে বিপর্যস্ত ইয়াহিয়া চক্রকে ২৫শে বস এবং তার পরের অব্যাহত গণহত্যার জবাব না দিয়ে উপায় নেই। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি মন্ত্রের দীক্ষা গুরু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্পর্ধিত বিচার প্রহসন ও এরই অঙ্গ। আর তারই প্রেক্ষিতে রচিত হয়েছে এই শ্বেত পত্র। তাই প্রকৃতপক্ষে জল্লাদ পুরোহিতদের হত্যাযজ্ঞ ও বিচার প্রহসনের মুখবন্ধ এই শ্বেত পত্র। কিন্তু বিবেকের কাছে এর কানাকড়িও মূল্য নেই। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ দুর্বার হয়ে উঠেছে, ঘাতক হানাদার বাহিনীর মৃত্যুর ঘন্টা বাজছে। ঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের শত শ্বেতপত্র সত্বেও বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্তিম শয্যা রচিত হবেই, ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি কেউ রোধ করতে পারবে না।
আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশারদ ঢাকায়
আর এক আইকম্যান রবার্ট জ্যাকসন
কে এই ব্যক্তিটি? জ্যাকসন নামে যিনি কুখ্যাত? নাজী বাহিনীর হত্যা বিশেষজ্ঞ আইকন এর উত্তরসূরী রবার্টসন?
আধুনিক উপনিবেশবাদের প্রধান পান্ডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও সরকারী কর্মচারী জ্যাকসন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গণহত্যায় সহায়তা করেছেন। আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিষয়টি ‘কিলার জ্যাক’ নামে তার উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশের হত্যা, ধ্বংস ও গণহত্যায় তার ভয়াবহ ভূমিকা ছিল। ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞ পূর্ব থেকেই জ্যাকসন ঢাকায় ছিলেন এবং ইসলামাবাদ ও জেনারেলদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল প্রাত্যহিক। এই সমস্ত তথ্য আজ মার্কিন মুল্লুক থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে।
সিনেটর কেনেডি সম্প্রতি নিউইয়র্ক এর জ্যাকসন সম্পর্কিত তথ্য বিশ্বের নিকট প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, জ্যাকসনকে পুলিশ বিশেষজ্ঞ রূপে পুনরায় ঢাকায় প্রেরণ করা হচ্ছে। আবার একটি খবর থেকে প্রকাশ ‘জল্লাদ জ্যাক’ বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে পূনরায় ঢাকা পৌঁছেছেন।
বাংলাদেশি গণহত্যার সাথে বিশেষভাবে জড়িত এবং বাছাই করা ব্যক্তিদের হত্যার পরিকল্পনাকারী রবার্ট জ্যাকসনের মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পুলিশ নীতির বিশেষজ্ঞ দীর্ঘদিন পূর্বে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছিল। সে সময় তিনি প্রকাশ্যে সামরিক জান্তার পুলিশের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে জ্যাকসন ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটে একটি গোপন দফতর খুলে চক্রান্তমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন। তিনি কালক্রমে কনস্যুলেটে এতটা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে কনসাল জেনারেল ব্লাড এর সাথে তার ক্ষমতার লড়াই পর্যন্ত হয়। জ্যাকসনের এ ক্ষমতা পেন্টাগন যুগিয়েছিল বলে আজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের নানা সাহায্য সংস্থা ও সেবা প্রতিষ্ঠান মাধ্যমে এভাবে বিশেষজ্ঞদের আচ্ছাদনে গুপ্তচর ও হত্যার পরিকল্পনাকারীরা প্রবেশ করে। রবার্ট জ্যাকসন সে ধরনের একজন ক্রীড়ানক।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত সেই জ্যাকসনেই বাংলাদেশে নির্বাচিত হত্যার তালিকা প্রস্তুত করে সেনাপতিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই জল্লাদ জ্যাকই দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও ব্রাজিল সরকারকে হত্যা ও ধ্বংসের পরিকল্পনা করে দেন। উক্ত দু’টি দেশের জ্যাকসন পরিকল্পিত সংস্থা নরহত্যা ও ধ্বংস দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখে।
একটি বিশেষ পত্রিকা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ জ্যাকসনের ঢাকায় অবস্থানকালে যে বিভীষিকাময় কার্যক্রমের সাথে যুক্ত ছিলেন, তা উদঘাটন করেছে। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছেঃ পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে যাদের যাদের হত্যা করা হবে, তার একটা দীর্ঘ তালিকা তিনি প্রস্তুত করেন। জ্যাকসন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ইসলামাবাদকে উপদেশ দিতেন। এই ব্যক্তির পরিকল্পনা উত্তমরূপে কার্যকরী হয়। ২৫শে মার্চ গণহত্যা আরম্ভ করার সময় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর তার তালিকা অনুযায়ী বেছে বেছে বিশেষ বিশেষ শ্রেনীর ব্যক্তিদের হত্যায় লিপ্ত হয়।’
উল্লেখ্য যে, ১৯৬৭ সাল থেকেই ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের সম্প্রসারিত অফিসের নাম শাহবাগ হোটেলের ‘স্যুটে’ একটি একটি গোপন অফিস ছিল। উক্ত গুপ্ত অফিসের উচ্চ পদস্থ অফিসার জনাব ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ১৯৬৪ সালের দিকে আকস্মিকভাবে চাকরি ছেড়ে দেন। তিনি প্রথম প্রকাশ করেন যে, কতিপয় মার্কিন অফিসার সমস্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নেতা, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আলোকচিত্র, জীবনী ও কর্ম তৎপরতা সম্পর্কে রিপোর্ট সংগ্রহ করে গোপন কক্ষে রাখা হয়। জনাব ফরিদ স্থানীয় একটি দৈনিকে সহকারী সম্পাদক রূপে কাজ পান। কিন্তু এই সমস্ত তথ্য সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশ করতে তিনি ব্যর্থ হন-কোন প্রকাশক ছাপাতে চাননি।
শাহবাগ হোটেলে গুপ্তচরবৃত্তির কাহিনী বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ার পর মতিঝিলস্ত আদমজী কোর্টে অবস্থিত কনস্যুলেট অফিসে গুপ্ত অফিসটি সরিয়ে নেয়া হয়। জ্যাকসন শেষ অবধি এই অফিসের সাথেই সম্পর্কিত ছিলেন। জ্যাকসন একাই নন তার সঙ্গে আরো তিনজন সহকারি জড়িত।
আত্মসহায়ক ও গণহত্যায় পরিকল্পনাকারী এ কুখ্যাত ব্যক্তি দক্ষিণ ভিয়েতনামে ব্যাপক হত্যাকান্ড অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে “অপারেশন ফিনিক্স”নামক একটি মানবতাবিরোধী প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন। জনৈক মার্কিন সিনেটরের ধিক্কৃত ‘ফিনিক্স’-কে দক্ষিণ ভিয়েতনামে রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে উচ্ছেদ সাধনের কার্যক্রম বলে উল্লেখ করেছেন। সমস্ত বিপ্লবী ঘাঁটি ধ্বংস এবং মুক্তি ফ্রন্টের সাথে সম্পর্কিত সকল ব্যক্তিকে হত্যা হয়েছিল জ্যাকসনের ফিনিক্স অপারেশন এর মূল লক্ষ্য। একসময় মার্কিন সিনেট সাব কমিটির সদস্য ভিয়েতনাম সফরে এসে বলেছিলেন যে, উক্ত অপারেশন ফিনিক্স কার্যকরী করে পনের হাজার সায়গন সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেককে নিক্ষেপ করা হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে।
জ্যাকসন যাকে বলা হয় জল্লাদ জ্যাক-ব্রাজিলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোক নিয়ে একটি আধাসামরিক সংস্থা গঠন করেন। উক্ত দেশে পরিকল্পিত হত্যার অনুষ্ঠানের জন্য দায়ী এই সংস্থাটির নাম ‘ডোপস’। জ্যাকসন প্রতিষ্ঠিত ‘ডোপস’ রাতের অন্ধকারে রাজনৈতিক বিরোধীদের নৃশংসভাবে হত্যার অভিযান চালাত। ভাড়াটিয়া হত্যাকারী জ্যাক ব্রাজিলের কর্তৃপক্ষকেও হত্যার জন্য একটি দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। তদুপরি সত্য উদঘাটনের নামে এক নির্দেশিত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালানো হতো। এই সমস্ত হত্যায় শিহরণমূলক কাহিনী শুনে বিশ্ব স্তম্বিত হয়ে পড়ে-শেষ পর্যন্ত পোপের হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়।
সেই ঘৃণ্য জল্লাদটি পুনরায় ঢাকায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন।
তার নামও কার্যক্রম আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ পাওয়ায় তিনি হয়তো এবার বিশেষ সতর্কতাঃ সঙ্গে হত্যার পরিকল্পনা ফ্যাক্টরি করবেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রায় সাত লক্ষ বৈদেশিক সৈন্য ও ঘাঁটি এবং তাবেদার সরকার ছিল। আর ব্রাজিলে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পদলেহী সরকার। কিন্তু সেই ক্ষেত্রে ঢাকা তথা বাংলাদেশের বিদ্রোহী মাটি যে জ্যাকসনের জন্য আর নিরাপদ নয়, সেকথা উচ্চারণের অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তিবাহিনীর সেনারা আর খুঁজে বেড়াচ্ছে সেইসব রক্তপিপাসু কুকুর ও হায়না-যারা হত্যা করেছে, আর যারা হত্যার সহায়ক।
ইসলামাবাদের দালালরা ইতিহাসের চাকা নিয়ন্ত্রিত করতে পারবে না
দৃষ্টিপাত
বাংলাদেশের মানুষ ভাবপ্রবণ- আমরা যা করি, তা না কি করি ঝোঁকের বশে। কথাটা প্রায় দুর্নামের মতো শোনায়। অথচ বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির এই দুর্নাম ঘুচিয়ে দিলেন। আইয়ুবের কালো দশকে মুজিব দেখা দিলেন যথার্থ বিপ্লবীর বেশে। বাংলা হিন্দু মুসলিম জনগণের মুখপাত্র তিনি। মুজিবের শত্রু, বাংলাদেশের জনগণের শত্রু, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও জমিদারদের পোষ্যপুত্র জুলফিকার আলী ভুট্টো মুজিবকে ‘বাঙালি জনগণের কণ্ঠস্বর’ বলে অভিহিত করেছিলেন। কারণটা কি? কারণ মুজিব বাঙালি হৃদয়ের প্রকৃত কথাটি জ্ঞাত ছিলেন। তাই আইয়ুবের আমলে যখন রবীন্দ্রনাথের গান নিষিদ্ধ করা হলো শেখ সাহেব তখন গর্জে উঠলেন সিংহ শাবকের মত। বললেন রবীন্দ্র সংগীত বাঙালি জাত শুনতে চায়। হ্যাঁ বাঙালিরা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিলেন। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি শেখ সাহেবের মন-প্রাণ কে উদ্বেলিত করত, দুখিনি, বন্দিনী এবং অত্যাচারিতা বঙ্গজননীর কথা ভাবতে ভাবতে তার চোখ অশ্রু ছলছল করত। এই গানটিতে বিপ্লবের বাণী নেই কিন্তু সুদের মহাসম্রাট রবীন্দ্রনাথ সেই গানের ভেতর বেদনার মহা পারাবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর সেই গানের বাণী ও সুর ছড়িয়ে গেল সবখানে। বাঙালিকে তারা একত্রিত করেছে, দেশকে তা নির্ধারিত মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছে, বাঙালি সে গানের পথ ধরে চলেছে আলোকোজ্জ্বল মহা-বিজয়ের জন্য।
কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা করবার লোকের অভাব হয় না। আজ ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে অনবরত সাম্প্রদায়িকতার প্রচার চলছে। যে ঢাকা বেতার কেন্দ্র বাংলাদেশের মহান নেতা শেখ মুজিবের বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করেছে, যে ঢাকা বেতার কেন্দ্র রবীন্দ্রনাথের গান প্রচার করেছে সেই ঢাকা বেতার কেন্দ্রে আজ সাম্প্রদায়িকতার মচ্ছব শুরু হয়েছে। ইতিহাসের চাকার গতি রোধ করার কি গভীর এবং ঘৃণিত ষড়যন্ত্র। তোমরা কারা এগুলো করছো, তোমরা কোন বাঙালি মায়ের সন্তান? ইতিহাসে চাকা ঘোরানো যায় না। বিপ্লবকে প্রতিবিপ্লব দিয়ে কবে স্তব্ধ করা সম্ভব হয়েছে? ইতিহাস তোমাদের দেখবে ঘৃণিত পথ কুকুরের মত। মীরজাফরের মত তোমাদের প্রাপ্য হল পথচারী জনতার থুথু। এবং জেনে রাখ, তার খুব বেশি দেরি নেই। ইতিহাস বাজিয়ে দিয়েছে তোমাদের মৃত্যু ঘন্টা। মহাকাল স্বাক্ষর করেছে তোমাদের মৃত্যু পরোয়ানা। ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা।
মনিরুল শেখ সাহেবের বজ্রকন্ঠের ঘোষণা? যদি বেতার ও টেলিভিশনে আমাদের কথা বলতে না দেওয়া হয়, বাঙালিরা কেউ সেখানে যাবে না কাজ করবে না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণা সত্ত্বেও তোমরা ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দালাল হয়ে কাজ করছো। নির্লজ্জ ভাড়াটের দল তোমরা। কিন্তু মনে রেখ শেখ সাহেবের কথা যখন তোমাদের কানে ঢুকেনি তখন আমাদের কথা ও ঢুকবে না। কিন্তু জবাবদিহি তোমাদের করতে হবে। বাঙালির হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তাকে পশ্চাৎদেশ থেকে ছুরিকাঘাত করবার কোন অধিকার তোমাদের নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদীরা ভাড়াটে সেনা দিয়ে যা করতে চেয়েছে, তাহলে বাংলার হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ফাটল ধরানো। এবং সেই ভাড়াটে সেনাদের পক্ষ থেকে একই কাজে লিপ্ত রয়েছে।
আমাদের বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, এমনকি তারও আগে মীর মোশারফ হোসেন অসাম্প্রদায়িক পথে সাহিত্য সাধনা করেছেন। মধ্যযুগের কুশলী কবি আলাওল, দৌলত কাজী, দৌলত উজির বাহরাম খান এবং মোহাম্মদ কবীরের কাব্যে কিংবা জীবনে সাম্প্রদায়িকতার চিহ্নমাত্র ছিলনা। ইসলাম ধর্মেও সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। কুরআনে বলা হয়েছে: লা ইকরাহা ফীদ-দীন অর্থাৎ ধর্মে কোন জবরদস্তি নেই। কাজেই যারা ধর্মের নামে চাকুতে শান দিচ্ছে তারা সামগ্রিকভাবে আমাদের ধর্ম ও সাহিত্যের মহান ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে কাজ করছে। ভাবতে অবাক লাগে যে, ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর মূলতঃ ইসলাম ধর্মের নামেই সাম্প্রদায়িকতার বীজ বোনার চেষ্টা করছে। ইসলাম ধর্মে যে সমস্ত মহান সুফি, চিন্তানায়ক ও কবি এসেছিলেন তারা কেউ সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। মৌলানা ফরিদ উদ্দিন আত্তার, মাওলানা রুমি, হাফি, শাদী কিংবা মনসুর আল হাল্লাজ ছিলেন শুভ্র মানবিকতার এবং বিশ্ব বিবেকের প্রতিক। সুতরাং আজ যেভাবে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়া হচ্ছে, তাকে সর্বতোভাবে বাধা দিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে শপথ নিয়েছিল বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমান। শপথ নিয়েছিল তারা একতাবদ্ধ থাকবেন -একতাবদ্ধ থাকবেন সংগ্রামের শেষ দিনটি পর্যন্ত। বাংলাদেশের হিন্দু মুসলিম জনগণ শেখ সাহেবের কথা স্মরণ রেখেছেন। সংখ্যালঘু জনগণের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে তাদেরকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাদের সহায় সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। যারা এগুলো করছে তাদের জন্য আমাদের কোনো ক্ষমা নেই। ধর্মের নামে জনগণকে বিভক্ত করা চলবে না। আমরা তা হতে দেব না।
বাংলাদেশের মানুষ জানে কিভাবে ২৩ বছর ধরে তাদেরকে ধর্মের নামে শোষণ করা হয়েছে। আর তারা পুরনো বুলিতে ভুলছে না। সংহতি এবং ইসলামের নাম যখন ইয়াহিয়ার কণ্ঠে শোনা যায়, তখন তার অর্থ আমরা জানি। তার অর্থ শোষণ, অত্যাচার, জেল, মৃত্যু, সামরিক আইন এবং সর্বশেষে দুনিয়ার বৃহত্তম নরহত্যা। বাংলাদেশের জনগণ এসব জানে। কাজের হত্যাকারী সেনাবাহিনী এবং তাদের বাঙালি-অবাঙালি দালালরা যা করেছে, তা করেছে আমাদের দুর্বলতার সুযোগে। সংখ্যালঘু ভাইদের কে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আপনারা যেমন জানেন, তেমনি আমরাও জানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক ভূমিকা বাংলাদেশ থেকে সাম্প্রদায়িকতার শেষ চিহ্নটুকুও উঠে গিয়েছিলো। কিন্তু তারপর ঝাপিয়ে পরল রক্তলোলুপ সেনাবাহিনী, প্রগতিশীল হিন্দু-মুসলিম কর্মীগণকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো, বাংলাদেশের দশ লক্ষাধিক ভাইবোন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেন। বাংলা নয়ন মনি শেখ সাহেব হলেন বন্দি। এবং এসব সত্ত্বেও আমরা বসে নেই। জনগণের ঐক্য রাখার জন্য আমরা সবকিছু করবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। স্বীকার করছি, আমাদের দুর্বলতম মুহূর্তে বেরিয়ে এসেছে গর্তের কাটেরা, ধর্মঘট ভাঙ্গা দালালেরা। মুজিব ডাক দিয়েছিলেন অহিংস ও অসহযোগ ধর্মঘটের। তার বজ্রকন্ঠ আজও অনুরনিত হচ্ছে আকাশে বাতাসে। সে ডাকের বিরোধিতা করে যারা ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করছে তারা শেখ সাহেবের বিরোধিতা করছে। কাজেই তাদের জন্য আমাদের কোনো ক্ষমা নেই। আর ধর্মঘট ভাঙ্গা দালালদের উদ্দেশ্যে বলতে চাইঃ
এখন এই তো সময়-
কই? কোথায়? বেরিয়ে এসো ধর্মঘট -ভাঙ্গা দালালেরা;
সেইসব দালালেরা-
ছেলেদের চোখের মতো যাদের ভোল বদলায়,
বেরিয়ে এসো!
জাহান্নামে যাওয়া মূর্খের দল
বিচ্ছিন্ন, তিক্ত, দুর্বোধ্য
পরাজয় আর মৃত্যুর দূত-
বেরিয়ে এসো!
বেড়িয়ে শক্তিমান অর্থলোভী দল
সংকীর্ণ গলির বিষাক্ত নিঃশ্বাস নিয়ে।
গর্তের পোকারা!
এইতো তোমাদের শুভক্ষণ,
গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়ো।
আর বেরিয়ে পড়ো ছোট ছোট সাপেরা
বড় আর মোটা সাপদের যারা ঘিরে থাকো।
সময় হয়েছে আসরফি আর পুরনো অপমানের বদলে
সাদা যাদের পেট-
বংশগত সরীসৃপ দাঁত তারা বের করুক,
এইতো তাদের সুযোগ।
মানুষ ভালো করেই জানে,
অনেক মানুষের বিরুদ্ধে একজনের লাগানোর সেই পুরনো কায়দা।
সামান্য কয়েকজন লোভী
অনেক অভাবীর বিরুদ্ধে-
আর স্বাস্থ্যবানদের বিরুদ্ধে
ক্ষয়ে যাওয়ার দল।
সূর্যালোকের পথে যাদের যাত্রা
তাদের বিরুদ্ধে তাই সাপেরা ।
অতীতে অবশ্য এই মাপেরা জিতেছে বহুবার।
কিন্তু এখন সেই সময়,
সচেতন মানুষ! এখন আর ভুল করো না-
বিশ্বাস করো না সেই সব সাপেদের
জমকালো চামড়ায় যারা নিজেদের ঢেকে রাখে।
ভারত সোভিয়েত এর মধ্যে নয়া চুক্তি স্বাক্ষরিত
গত ৯ই আগষ্ট (সোমবার) নয়াদিল্লিতে ভারত ও সোভিয়েত এর মধ্যে মৈত্রী, শান্তি ও সহযোগিতা সম্পর্কে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই যুক্তিতে দুটি দেশের যেকোনো একটি তৃতীয় কোন দেশের দ্বারা আক্রান্ত হলে , সেই আক্রমণের মোকাবিলার জন্য কি ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে, তা ভারত সোভিয়েত পারস্পরিক আলোচনার দ্বারা স্থির করবে।
এই যুক্তিতে আরো বলা হয়েছে দুটির মধ্যে যেকোনো একটি দেশ আক্রান্ত হলে, আক্রমণকারী দেশকে কেউ অস্ত্র দেবে না। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিটার স্বরণ সিং এবং সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ আঁদ্রে গ্ৰোমিকো স্ব স্ব দেশের পক্ষ থেকে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
ভারতের বিরুদ্ধে পাক জঙ্গী সরকারের সাম্প্রতিককালের এক আনা রণহুঙ্কার এর মুখে নয়া যুক্তি গভীর তাৎপর্যপূর্ণ বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন।
পাক জঙ্গী সরকার কর্তৃক কেনেডির বাংলাদেশ সফর নিষিদ্ধ ঘোষণা
বাংলাদেশ থেকে পাক জঙ্গিশাহী কর্তৃক বিতাড়িত শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে দেখার জন্য মার্কিন সিনেটের শরণার্থী সংক্রান্ত সাব কমিটির চেয়ারম্যান মিঃ এডওয়ার্ড কেনেডি গত মঙ্গলবার কলকাতায় এসে পৌঁছেছেন। সিনেটর কেনেডি গত মঙ্গলবার ও বুধবার ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে পশ্চিমবঙ্গের বহু শরণার্থী শিবিরে ছিন্নমূল অসংখ্য শরণার্থীদের সঙ্গে খোলাখুলি ভাবে কথাবার্তা বলেন, দুচোখে দেখেন বাস্তুচ্যুত নর-নারীর কি অসহনীয় দুরবস্থা।
সিনেটর কেনেডি নয়াদিল্লি কলকাতা ঢাকা ও ইসলামাবাদ সফরের উদ্দেশ্যে কলকাতায় পৌঁছানোর দিনেই পাক জঙ্গী সরকার দখলীকৃত বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সফর বাতিল করে দিয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে সিনেটর কেনেডির বাংলাদেশ সফরকালে ভারত থেকে প্রত্যাগত শরণার্থীদের জন্য নির্মিত শিবিরগুলো পরিদর্শনের কথা ছিল। সিনেটর এই সফরকালে জল্লাদ সরকারের বাংলাদেশের তথাকথিত স্বাভাবিক অবস্থা গণহত্যা ধ্বংসযজ্ঞ ও অত্যাচারের আসল তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে মনে করে, জঙ্গী সরকার এই সফর বাতিল করে দিয়েছেন বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করছেন। শরণার্থীদের ভারতে প্রবেশকালে মিঃ কেনেডি বলেন, আমি জীবনে এমন দৃশ্য দেখি নি।’
আরো দু’জন
জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকারের সাথে সফল সম্পর্ক ছিন্ন করে আরও দু’জন পাকিস্তানি কূটনীতিক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
গত ৯ই আগস্ট লন্ডনে এক বিরাট জনসভায় লন্ডনস্থ দূতাবাসের ফিল্ম ও প্রকাশনা দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর জনাব এ কে এম আব্দুর রউফ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে বলেন, যে জঙ্গিশাহ বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ভাইবোনদের রক্তে হাত রঞ্জিত করেছে তার সঙ্গে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখাও পাপ।
এদিকে দিল্লিস্থ পাকিস্তানি দূতাবাস এর চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী জনাব করিম বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাঁর আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সাথে বেশি কিছু নিতে পারিনি। আমি নিয়েছি দুটো প্যান্ট, দুটো শার্ট আর এক জোড়া জুতা। আসার আগের দিন এক বন্ধুর সাথে দেখা করে লন্ড্রীর স্লিপ গুলো ওকে দিয়ে এসেছিলাম। ওহে সাথে একটা চাদর ও নিয়েছিলাম, ভাবলাম যদি গাছ তলায় শুতে হয় তাহলে কাজে লাগবে। পরবর্তীকালে আমার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়েছিল। বেশ কাজ দিয়েছে এই চাদর। কুমিল্লার অভয়াশ্রমে তৈরি এই চাদর এখনো আমার সেবায় নিয়োজিত। সাথে টাকা কড়ি যা অল্প ছিল সেগুলো দুজনে রেখেছিলাম মোজার নিচে। বাসে অসংখ্য যাত্রী। সবার মুখে একই আলোচনা। কি হবে। মুক্তিফৌজ (তখনও নাম মুক্তিবাহিনী হয়নি) শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে পারবে তো; এই ব্যাটা টিক্কা খান কবে শেষ হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যে ব্যাপারটা সবচেয়ে লক্ষণীয় তা হল সরাসরি সবাই মিলিটারীর বিরুদ্ধে কথা বলছে। কোনো লুকোচুরি নেই, নেই ফিসফাস বা হুশহাশ শব্দ। কে একজন একটু মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আর যাবে কোথায়। বাকি সব যাত্রী হইহই করে উঠলেন, যান মশাই ভয় করিনা আর এখন, বাঙ্গালীদের তো ওরা মারছে; কথা বললে আর কি হবে, মারবে। মেরে ফেলবে, এর বেশি তো আর কিছু করতে পারবে না।
যাত্রীদের কারো মুখে কোন শঙ্কা বা ভীতির কোনো চিহ্ন নেই। বাস চলছে। মাঝে মাঝে পশলা বৃষ্টি হচ্ছে। আবার খানিক বাদে রোদ। হঠাৎ ছেলেবেলার একটা কথা মনে পড়ে গেল। পাড়ার এক বন্ধু শাহাদাত, ডাকনাম ছিল সাধু। ও আর আমি গেছি পাহাড়ে। দুজনের হাতে গুলতি আর পকেট ভর্তি পোড়ামাটির ছোট ছোট গুলি। পাখি শিকার করতে করতে ঢুকে গেছি বিরাট একটা ঝোপের মধ্যে। প্রকাণ্ড একটা গাছের আশেপাশের বিভিন্ন রকম লতা গাছ, বেত গাছের বন আস্তানা আরো নাম না জানা কত গাছ গাছড়া। মাকাল লতার চেহারাও খুঁজে পেলাম সেখানে। সেই ঘন ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়েছে দোয়েলটা। সাধুর হাত খুব সই। একটা গুলি খেয়ে পাখিটা ঝোপে ঢুকে পড়েছে। ঝোপঝাড় আমরা দুজনে উল্টেপাল্টে তোলপাড় করছি। এমন সময় কানে আসলো একটা খসখস শব্দ। ঝোপে ডান দিকে মনে হয়। পা টিপে টিপে গিয়ে দেখি গর্তের মধ্যে বসে পিটপিট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছে একটা শিয়াল। সত্যি ওর চেহারা এমন একটা ভাব মনে হয় দেখাও ছেলেপেলের কান্ড দেখো এই বলে সে আল্টা প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়বে। ভাবছি কি করি। এমন সময় শুরু হল ঝুপ ঝুপ ধরে প্রচন্ড বৃষ্টি। শিয়ালটা গেঁবিয়ে গেল গর্তের গভীরে। পায়ের কাছেই কি যেন একটা নড়ছে। নিচু হয়ে দেখে আমাদের আহত বন্ধু দোয়েল। বিচারের একটা পা ভেঙ্গে গেছে। আলতোভাবে তুলে নিলাম। খুব একটা আপত্তি আর জোরজবরদস্তি করলো না দোয়েল। মিনিট তিন চারেক ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি হবার পর আকাশের এক কোন ভেঙে সূর্যের সোনালী আলো চারিদিক ঝলমল করে তুলল। বৃষ্টি এখনো থামেনি। সাধু বললে, ওই যে শিয়াল টা দেখলাম কিছুক্ষণ পর ওর বিয়ে হবে। জানিস মা বলেছিলেন যে রোদ আর বৃষ্টি একসাথে হলে শিয়ালের বিয়ে হয়।
এই ঘটনার পর প্রায় বাইশ তেইশ বছর কেটে গেছে। আসলো ১৯৭১ সালের পঁচিশে শে মার্চ। কেটে গেল আরো এক মাস এর পর। আমি চলেছি আমার স্বদেশ ছেড়ে। জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখি বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত ছড়িয়ে আছে দিগন্তব্যাপী। টেলিগ্রাফের তারে ফিঙ্গে। আকাশের ছেঁড়া মেঘের আনাগোনা। বাংলাদেশ আমার, সোনার বাংলা। এ ফিঙের দিকে তাকিয়ে কি বোঝা যায় বাঙালির রক্তে এখন বাংলার মাঠ ঘাট লাল হয়ে গেছে। বন্ধু সাধু! তুমি কি বেঁচে আছো এখনো, সেই শিয়ালদার বিয়ে কি হয়েছিল। সব জানতে ইচ্ছে করে বন্ধু।
বেলা দুইটার দিকে বাংলাদেশের কোন এক স্থানে এসে বাস থামল। যে গ্রামে আমাদের থাকার কথা সে গ্রামটা এখান থেকে কত মাইল দূরে তার ঠিক আমাদের জানা ছিল না। যাইহোক বাস থেকে নেমে বেবিট্যাক্সি করে গেলাম খানিক দূর। তারপর বাকি পথ রিক্সায়। প্রায় মাস ছয়েক রিক্সা করে যাবার পর বেলা তিনটার দিকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমাদের নির্ধারিত জায়গায় এসে পৌছালাম। ভদ্রলোক সত্যি খুব ভালো। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য একেবারে উঠে পড়ে লাগলেন তিনি। যেন কতকাল এর পরিচয়। সামনেই পুকুর, পুকুর পাড়ে মসজিদ। অনেক দিনের পুরনো মসজিদ। পুকুরের কাল টলটলে জল। কাপড়চোপড় খুলে ঝাঁপিয়ে পড়লাম দুজনে। আহ কি আরাম! বেশ কতক্ষন ঝাপাঝাপির পর উঠেই দেখি খাবার তৈরি। মাছ, বেগুনের ভর্তা আর ডাল। সাধাসাধি করতে হলো না মোটেই। রাক্ষসের মত শুরু হলো আক্রমণ। (চলবে)
অসুর-পুরে মরা কান্না
মুক্তিবাহিনীর দুর্জয় অভিযান অব্যাহত
মুক্তিবাহিনীর বীর্যধারা গত সপ্তাহ ব্যাপী বিভিন্ন রণাঙ্গনে হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর প্রবল আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে।
গত ৫ই আগস্ট বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী সিলেটের আলিনগর অঞ্চলে এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে দশজন শত্রুসৈন্য খতম করেছেন। এই আক্রমণে আরও পনের জন সৈন্য আহত হয়। গজল চৌঠা আগস্ট মুক্তি বাহিনীর এক প্রচণ্ড আক্রমণে কসবা এলাকায় আটজন রাজাকার নিহত হয়। একটি শত্রুসৈন্য গাড়ি তিনটি বাঙ্কার ও দুটি সড়ক সেতু ও ধ্বংস করা হয়।
পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা মংলা ফেরিঘাটে আক্রমণ চালিয়ে ফেরি ইঞ্জিন ও নৌকার ক্ষতি সাধন করেন। কানাইঘাটের ফেরিঘাটে এক আক্রমণে একজন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও তিনজন আহত হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধারা দশরথের রেজিস্ট্রি অফিস আক্রমণ করে সম্প্রতি দুই জন রাজাকার ও মুসলিম লীগের তিনজন গুন্ডাকে খতম করেন। সাকমা গ্রাম ও পাগলায় মুক্তিবাহিনী একটি সড়ক সেতু ও দুটি কালভার্ট উড়িয়ে দিয়েছেন।
দক্ষিণ মূল অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে এক সংঘর্ষে পাঁচজন হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায়। ইসলামপুর ও কোমর জানি এলাকায় তাদের হাতে আটটন হানাদার সেনা খতম হয়েছে।
আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন যে গত ৩রা আগস্ট কুমিল্লার সিঙ্গারবিল এলাকায় মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে হানাদার সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিন ঘণ্টার এই আক্রমণের সার্জন অফিসার ৩৫ জন দস্যু সৈন্য নিহত হয় এবং দুই জনকে আটক করা হয়। এছাড়া একটি মেশিন গান সহ বিশ হাজার রাউন্ড গুলি মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়।
পশ্চিম পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর কাছে প্রবল বাধা পাওয়ায় চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে কয়েকদিন আগে পাক বিমান থেকে বোমা এবং নৌবহর থেকে গোলাগুলি বর্ষণ করা হয়। তেহরানের দৈনিক পত্রিকা ‘কয়হান ইন্টারন্যাশনাল’-এ আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় সদস্যের বক্তব্য এই খবর প্রকাশিত হয়। বাঙালি হত্যাকারী ও বেলুচিস্তানের নরঘাতক দখলীকৃত বাংলাদেশের সামরিক গভর্নর টিক্কা খান ওই পত্রিকার সংবাদ দাতার কাছে স্বীকার করেছেন যে, পূর্ববাংলার আইন-শৃংখলার অবস্থা মোটেই স্বাভাবিক নয়। বাধা আসছে চারি দিক থেকেই এবং আন্তর্জাতিক কাজও চলছে।’
এদিকে পূর্ব রণাঙ্গন থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, এই সপ্তাহের গোড়ার দিকে মুক্তি বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে জল্লাদ বাহিনীকে দিশেহারা করে তোলে। গেরিলাদের আক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
গেরিলা বাহিনী ময়মনসিংহ জেলায় ৩১শে জুলাই থেকে দোসরা আগস্ট পর্যন্ত মুখোমুখি আক্রমণ চালিয়ে বহু খানসেনাদের হতাহত করেন। ময়মনসিংহ কিশোরগঞ্জ এর মধ্যকার ট্রেন যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছে। গেরিলারা বৈদ্যুতিক লাইন ও নষ্ট করে দিয়েছে। ফলে সিলেট শহরের অর্ধেক এলাকায় গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেছে।
গেরিলা যোদ্ধারা বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাক ফৌজ বোঝাই একটি ট্রেনের বগিতে আক্রমণ করেন। ফলে বহু সৈন্য হতাহত হয়। তাদের আক্রমণের দুটি রেল ইঞ্জিন, বেশ কয়েকটি ওয়াগণ এবং যাত্রীবাহী কোচ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২রা আগস্ট দেওয়ানগঞ্জ শহর আক্রমণ করেন। হারাদা সৈন্যরা স্টেশনে আশ্রয় নিলে মুক্তিবাহিনী প্রচন্ড আক্রমণ চালান। দস্যু সৈন্যরা পালিয়ে কোন রকমের প্রাণ বাঁচায়। রাজাকারদের দুইটি ট্রেনিং ক্যাম্প ও ধ্বংস করে দেয়া হয়।
গত ২রা আগস্ট কাইয়ুমপুর মুজিব বাহিনীর এক অতর্কিত আক্রমণে দশ জন সেনা নিহত এবং চারজন মারাত্মকভাবে আহত হয়। এই অঞ্চলে হানাদার বাহিনীর টহল দল রত সেনাদের উপর অপর এক রুমে দুইজন সৈন্য খতম হয়।
বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ দখলীকৃত বাংলাদেশ এস এস সি পরীক্ষা অনুষ্ঠানের জন্য পাক সামরিক সরকার যে প্রচেষ্টা চালায় তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। ঢাকার মতিঝিল সরকারি বিদ্যালয় কিছু কিছু বাঙালি ছাত্র পরীক্ষা দিতে গেলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে প্রশ্নপত্র ও ভস্মীভূত এবং ভবনের ক্ষতিসাধন করে। ফলে ওই কেন্দ্রে আর কোন পরীক্ষা হতে পারে নাই।
মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা গত ৩ রা আগস্ট তারিখে সিলেটের দক্ষিণাঞ্চলে ২ প্লাটুন খান সেনার উপর আক্রমণ চালিয়ে ৫০ জন দস্যু সৈন্যকে হত্যা করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা একটি মেশিনগান, একটি হালকা মেশিনগান, ছয়টি বন্দুকসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখল করে নিয়েছেন। এছাড়া একজন দুশমন সৈন্যকে জীবন্ত অবস্থায় আটক করা হয়েছে বলে স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর প্রকাশ।
গত ২রা আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা শালদা নদীতে দখলদার সৈন্যবাহিনী নৌকার উপর এক অতর্কিত হামলা চালায়। ফলে পাঁচটি নৌকা ডুবে যায় এবং ৯০ জন শত্রু সেনা নিহত হয়।
সম্প্রতি মুকুন্দপুরে এক আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর হাতে ৪৩ জন পাকফৌজ নিহত হয়। গেরিলা যোদ্ধারা কাইয়ুমপুরে শত্রু সৈন্যবাহী একটি নৌকা ডুবিয়ে দিয়েছেন। এখানে পনের জন পাকিস্তানী সৈন্য প্রাণ হারায়।
নোয়াখালীতে মুক্তিযোদ্ধারা আটজন রাজাকার কে হত্যা করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেন। সম্প্রতি গেরিলা যোদ্ধারা রায়পুরার কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা সাবেক পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি মোতালিব ভুইয়া কে গুলি করে হত্যা করেছেন।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। গেরিলা স্কোয়াড নিউমুরিং এলাকায় একটি কয়লা ডিপো ভষ্মিভূত করেন। ১৯ নম্বর জেটির কাছে একই পাকিস্তানি জাহাজ গেরিলা যোদ্ধারা ডুবিয়ে দিয়েছেন।
বঙ্গোপসাগরে বহির্নোঙ্গর অবস্থায় একটি পাকিস্তানি ট্যাংকের উপর আক্রমণ চালিয়ে গেরিলা যোদ্ধারা ট্যাংকারটির মারাত্মক ক্ষতি করে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে
ইয়াহিয়া ও টিক্কা চক্রের অন্তর্দ্বন্দ্বে সংকট ঘনায়মান
পাকিস্তানের সমর নায়কদের মধ্যে তীব্র ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে বলে নানা সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এই ক্ষমতা দ্বন্দ্বের একদিকে হচ্ছে ইয়াহিয়া, হামিদ খান চক্র অন্যদিকে আছে টিক্কা খান ও তার ভক্তবৃন্দ। খবরে প্রকাশ, টিক্কা খাঁর অথবা সমর্থক জেনারেল ওমরকে ষড়যন্ত্র করে পশ্চিম পাকিস্তানের মেরে ফেলা হয়েছে। ওমর একটি হেলিকপ্টারে করে যাচ্ছিল। তখন এই হেলিকপ্টারটি পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলে হঠাৎ ভেঙে পড়ে। মনে করা হচ্ছে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনাটি কোনো আকস্মিক যান্ত্রিক গোলযোগে হয়নি। পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে হয়েছে। অর্থাৎ জেনারেল ওমর নিহত হয়েছে ষড়যন্ত্র ফলে। টিক্কা খানের আর একজন সমর্থক, মেজর জেনারেল আকবরকে বর্তমানে পাক অধিকৃত কাশ্মীর অঞ্চলের বদলি করা হয়েছে। তার জায়গা নিযুক্ত করা হয়েছে মেজর জেনারেল জিলানীকে। মেজর জেনারেল আকবরের উপর ছিল সামরিক গুপ্তচর বিভাগের ভার। তাকে এ পথ থেকে অপসারণ করাকে মনে করে হচ্ছে ক্ষমতা দ্বন্দ্বে ইয়াহিয়া গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফল বলে।
বিদ্রোহী ঘাতক সুবাদার টিক্কা
টিক্কা খান বর্তমানে বাংলাদেশে ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন মিটিংয়ে যাচ্ছে না। এটাকে মনে হয় টিক্কা খান এখন পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে সাহস করছে না। বাংলাদেশ থেকে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়তে যাচ্ছে।
ঘাতকদের দোসর দেশে উদ্বেগ
পাকিস্তানের মিত্রদেশগুলো পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে সৃষ্ট এই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তারা বুঝতে পারছে না কোন গোষ্ঠীর পিছনে তাদের সমর্থন দান করা উচিত হবে।
ব্রিটিশ পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা, সাধারণভাবে সামরিক বাহিনীর মধ্যেও বিক্ষোভ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ তাদের বোঝানো হয়েছিল বাংলাদেশের জন্য কোন যুদ্ধ করতে হবে না। মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যে গুলি ছুড়ে, কামান দাগিয়ে, বোমা ফেলে বাঙ্গালীদের সমস্ত প্রতিরোধ চূর্ণ করে দেওয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধের অবস্থা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করছে। ক্ষমতাচ্যুত হতে পারে এই ভয়ে ইয়াহিয়া বাংলাদেশ সফরে আসছে না।
বীমার দাবি নিয়ে বিভ্রাট
পাকিস্তানের সবচাইতে বড় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি হলো, ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এরা সামরিক বাহিনীর জন্য গ্রুপ ইন্সুরেন্স চালু করে। এখন অনেক পাক ফৌজ প্রতিদিন মারা যাচ্ছে। আহত হচ্ছে। যারা মারা গেছে তাদের জন্য অর্থ দাবি করে পাচ্ছেনা মৃতের আত্মীয়-স্বজন। কারণ পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে যা করছে তাকে যুদ্ধ বলে ঘোষণা করতে রাজি হচ্ছে না। ফলে সেনাবাহিনীতে সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে। ইন্সুরেন্স এর শোনা যায় এ পর্যন্ত প্রায় ২০০০০ দাবি পড়েছে টাকার জন্য। এ থেকে অনুমান করা চলে প্রায় ২০০০০ পাক ফৌজ এযাবত খতম হয়েছে বাংলাদেশের মাটিতে।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে পাঞ্জাবি ফৌজ এর সাথে বালুচ ও পাঠান ফৌজদের সাথে প্রায়ই গন্ডগোল হচ্ছে। পাঞ্জাবি ফৌজেরা বিপদের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। তারা বালুচ ও পাঠান সৈন্যকে সব বিপদের মুখে এগিয়ে দিতে চাচ্ছে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে পাঞ্জাবি ফৌজেরা ভালো খাচ্ছে। বালুচ ও পাঠানদের বঞ্চিত করছে। এ কারণেও পাক সেনাবাহিনীতে গোলযোগ দেখা যাচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে পাঞ্জাবি ফৌজের সাথে বালুচ ও পাঠানদের গুলিবিনিময়ের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।
গোটা পাক বাহিনীর মধ্যে নিয়ম-শৃঙ্খলা দারুণ অভাব দেখা দিয়েছে।
যুদ্ধ জয়েই একমাত্র সমাধান
বাংলাদেশের সমস্যার কোনো রাজনৈতিক সমাধান হবে না। কারণ সামরিক চক্র রাজনীতি বোঝে না। তাদের ধারনা বন্দুকের সাহায্যে তারা বাংলাদেশের শাসন বজায় রাখতে পারবে। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা কার্যকরী হবে না। বিভিন্ন বিদেশী পত্র-পত্রিকায় বিশ্লেষণ করে দেখানো হয়েছে যে, পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশকে আর দীর্ঘদিন দখলে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ মুক্তিফৌজ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। অন্যদিকে পাকবাহিনীর দেখা দিয়েছে সামরিক শৃঙ্খলা বোধের অভাব ও হতাশা। একদিকে মুক্তিফৌজ হয়ে উঠছে অনেক বেশি অভিজ্ঞ ও দৃঢ় মনোবল সম্পন্ন, অন্যদিকে পাকবাহিনী হয়ে উঠছে ভগ্নোদ্যম। সারা বাংলাদেশ পাকিস্তান সরকার চার ডিভিশন সৈন্য নিয়োগ করেছিল। এই সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ অকেজো হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান সরকার এই ঘাটতি পূরণ করবার জন্য আরো দুইডিভিসন সৈন্য বাংলাদেশের পাঠানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য লোক জোগাড় করা সম্ভব হচ্ছে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের যুদ্ধ করতে আসতে চাচ্ছে না কেউ। তাই জঙ্গিশাহীর আশা পূরণ হচ্ছে না।
মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজ উইক বলেছেনঃ মুক্তিফৌজ একসময় ছিল খুবই অগোছালো। তাদের মধ্যে সুষ্ঠু সংযোগ ছিল না। কিন্তু বর্তমানে এই পৌজ খুবই সংগঠিত হয়ে উঠেছে। এবং গেরিলা যুদ্ধে খুবই কৃতিত্ব দেখাচ্ছে। মুক্তিফৌজ বহু সেতু, রাস্তা ও রেল যোগাযোগ নষ্ট করে দিয়ে পাকবাহিনীর যাতায়াতের বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পেরেছে। তাদের হাতে বহু পাক সৈন্য ও দালাল প্রতিদিন মারা পড়ছে। ফলে ইয়াহিয়ার ফৌজরা ক্রমশঃ ভীত হয়ে পড়ছে। ঢাকার কোন বিদেশী কূটনৈতিকের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে ঃ এইভাবে ভিয়েতনামে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল। এরকম যুদ্ধের মূল্য পাকিস্তান সরকার যতক্ষণ দিতে পারবে, যুদ্ধ ততক্ষণেই চলবে। কিন্তু পাক সরকারের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের ফলাফল পাক সরকারের বিপক্ষে যাবে।
পাক বাহিনীকে যুদ্ধ চালাতে যাচ্ছে এমন এক দেশে, যেখানকার সমস্ত মানুষ তাদের বিপক্ষে। এরকম প্রতিকূল পরিবেশে কেবল অস্ত্রের জোরে যুদ্ধ করে, যুদ্ধে জয় লাভ করা যায় না। আলজেরিয়া, ভিয়েতনামই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করতে যেয়ে ঢাকায় আর একজন বিদেশী কূটনীতিক বলেছেন ঃ পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। যেদিন থেকে সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলের মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, সেদিন থেকে মৃত্যু ঘটেছে পাকিস্তানের। আর কোন আপোষ রফা সম্ভব নয় কোনভাবেই।
মিউজিক কাগজ মন্তব্য করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো পাকিস্তানকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। ভাবছো এভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখা যাবে এবং পাকিস্তানের শাসক বর্গের উপর প্রভাব বিস্তার করে সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব হবে। তিনি মার্কিন নীতির সাথে বাস্তব ঘটনা প্রবাহের যোগাযোগ আছে বলে মনে হয় না। ইয়াহিয়া কোন রাজনৈতিক সমাধান চাচ্ছে না, ইয়াহিয়ার কোন বক্তৃতার মধ্যে আপোষের কোনো পথ খোলা নেই। ইয়াহিয়ার বক্তৃতা একটি সামরিক হুকুম নামা বিশেষ। কোনো পক্ষই আর আপস-রফার পক্ষে যেতে পারে না। কেবলমাত্র যুদ্ধের পথেই এখন খোলা।
কলকাতায় বাংলাদেশ একাদশের প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত
(নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত)
গত রোববার কলকাতায় ভারত সফররত বাংলাদেশ একাদশ বনাম মিঃ গোষ্ঠ পাল একাদশের মধ্যে এক প্রাতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকারের অত্যাচারে যেসব বাঙালি ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের সাহায্যার্থে উক্ত খেলার আয়োজন করা হয়। বিখ্যাত মোহনবাগানের কয়জন সেরা খেলোয়াড়ের সমন্বয়ে গঠিত মিঃ গোষ্ঠ পাল একাদশ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ৪-২ গোলে জয়লাভ করেন। খেলা শুরু হওয়ার ১৩ মিনিটের সময় বাংলাদেশের তূর্য হাজরা প্রথম গোল করেন। বাংলাদেশের পক্ষে অপর গোলটি করেন নওশের। ভারতের পক্ষে সবচেয়ে ক্রীড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন গোষ্ঠ পাল একাদশের প্রবীণ খ্যাতনামা খেলোয়াড় চুনী গোস্বামী। অপর তিনটি গোল করেন প্রণব গাঙ্গুলী দুইটি এবং সুকল্যাণ ঘোষ দস্তিদার একটি।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘোষণা
এটা জনযুদ্ধঃ ভাড়াটিয়া সৈন্যের যুদ্ধ নয়
এই সরকারের আয়ের কোনরকম সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই। শুধুমাত্র দান, শুধুমাত্র খয়রাত, শুধুমাত্র ঋণ, আর শুধুমাত্র কিছু কিছু বান্ধব মারফত টাকা সংগ্রহ করে কোনমতে সরকার চলছে। তাই আমাদের বীর যুবকেরা যারা প্রতিনিয়ত আজকে মুক্তিযোদ্ধার নাম লেখাবার জন্য ট্রেনিং গ্রহণ করতে বিভিন্ন অঞ্চলে এগিয়ে আসছেন, তাদের সবাইকে ট্রেনিংয়ের সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর হয় নাই। কি করে এই সীমিত সামর্থ্য মধ্যে ভালো ট্রেনিংয়ের বন্দোবস্ত করা যায় কি করে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীকে আরও জোরদার করা যায়, আপনাদের মন্ত্রিসভার সদস্যরা সেই কথা আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনার গঠনমূলক সমালোচনা করা ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন। আর মনে রাখবেন বর্তমান মুহূর্তে আমরা একটা যুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ঐক্যের’। ঐক্যকে আজকে অটুট রাখতে হবে। সারা পৃথিবীর মানুষ যেন দেখতে পায় আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা, বঙ্গবন্ধুর শিষ্যরা, বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা এক প্রাণ এক মন হয়ে বাংলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঐক্যের কোন রকম ফাটল ধরলে তার ফল হবে মারাত্মক। কেউ কেউ বাইরে থেকেও নানাপ্রকার প্রচারণায় আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করতে পারে। সেই সমস্ত প্রচেষ্টাকে আমাদের বানচাল করে দিতে হবে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি আমার মন্ত্রিসভার সদস্যরা মনেপ্রাণে এক। তাদের প্রতিনিয়ত চিন্তা মাতৃভূমির স্বাধীনতা কে কি করে ত্বরান্বিত করা যায়।
তাই বন্ধুরা যে অটুট ঐক্য আজকে সরকারের মধ্যে বজায় আছে আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। বন্ধুরা আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের প্রধান সেনাপতির বর্তমান রণকৌশলে আমাদেরকে গেরিলাযুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জিনিস হল জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। আপনারা যারা প্রতিনিধি আপনাদের কাছে আমার আকুল আবেদন আমাদের গেরিলা যোদ্ধারা যে রণনীতি আর কৌশলে যুদ্ধ করে চলেছে, এই রণনীতি আর কৌশলে আপনারাই তাদের সর্বাধিক সাহায্য করতে পারেন জনগণের মনোবল অটুট রেখে আর সমর্থন বজায় রেখে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যারা বন্দুক নিয়ে লড়াই করছে তারাও যেমন-মুক্তিযোদ্ধা, আমরা আপনারাও তেমনি মুক্তিযোদ্ধা। এটা জনযুদ্ধ, ভাড়াটিয়া সৈন্যদের যুদ্ধ নয়। এটা হচ্ছে Peoples War এই people’s War এর People হচ্ছে সবচেয়ে Important factor .
আর সেই People কে সঙ্ঘবদ্ধ করার দায়িত্ব জনসাধারণের প্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে। প্রতিটি সৈনিককে জনতার বন্ধু ভাবতে হবে। নির্যাতিত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত বাংলার মানুষ যেন ভাবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠানে আওয়ামীলীগের কর্মীরা, সৈনিকেরা তাদের বন্ধু। যেই বন্ধুত্ব আমরা পেয়েছি, সেই বন্ধুটিকে অটুট রাখার জন্য আমাদেরকে দিনরাত নিরলস সংগ্রাম করে যেতে হবে। যদি আমরা জনগণের এই সমর্থনকে বজায় রাখতে পারি তাহলে আমি আপনাদের আশা দিতে পারি যে, আপনাদের বীর সৈনিকেরা, পৃথিবী যা ভাবছে, তার চেয়ে বহু আগে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করবে।
বন্ধুরা আমার মনে রাখবেন, এই জনগণের সমর্থন আদায় করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের চরিত্রে, প্রত্যেকের কার্যকলাপে, জনগণের বন্ধু জনতার বন্ধু নির্যাতিত চাষীর বন্ধু বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। অত্যাচারী জোরদারদের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতিত চাষীর বন্ধু, অত্যাচারী মিল মালিকের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতিত শ্রমিকের বন্ধু। এই বন্ধুত্ব প্রকাশের প্রধান উপায় হলো, আওয়ামী লীগের প্রণীত ম্যানিফেস্টো কে বারবার জনগণের সামনে তুলে ধরা। আওয়ামী লীগ ভোট পেলে পরে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই সমস্ত প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব। এই প্রতিশ্রুতি আমি জনগণকে নেতাদের মাধ্যমে দিয়েছি। আপনাদের প্রতি গ্রামে, গঞ্জে, বন্দরে এই প্রতিশ্রুতি বারবার দিতে হবে। এই মুহূর্তে যে মুক্তি সেনানীরা যে অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করবে তত মুহূর্তে সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা, আপনারা অর্থনৈতিক-সামাজিক সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি তাকে বাহ্যরূপ দেওয়ার সক্রিয়ভাবে কাজে নামবেন। মনে রাখতে হবে সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করবে স্বাধীনতা তারা অর্জন করে দিবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পটভূমিকায় রূপ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।
সেই দায়িত্ব আপনারা আমরা যদি পালন করতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে আমাদেরকে অনেকে আবার অনেক কথা বলার সুযোগ পাবেন। অনেক স্মৃতি মন্থন করে বহু ভুলের জন্য বহু প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।
তাই বন্ধুরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের নীতি, আদর্শে আপনারা অটল থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়িকতা বা সেক্যুলারিজমের মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আমরা বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি। এই একটি বিষয়ে আমাদের অস্পষ্ট থাকতে হবে। কোন প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার মালিন্য যেন আওয়ামী লীগের সদস্য বৃন্দের নাম ফলানিবাত না হয় সে বিষয়ে আপনাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে। গণতন্ত্র অর্থই হলো সাম্প্রদায়িকতা যেখানে সাম্প্রদায়িক বিভেদ বুদ্ধি সেখানে গণতন্ত্র কোন দিন কার্যকর হতে পারে না।
আজ আমরা ঘরে তাহলে বিশ্বাস করি বলে অসাম্প্রদায়িকতা বা সেকুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতিটি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যারা আছেন তাদের মধ্যে প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবাই বন্ধু। আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখের সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।
বন্ধুরা আমার, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পদ্ধতি আমরা বহু পূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত যে দেশ আপনারা ভবিষ্যতে পাবেন সে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিগত মালিকানার ওয়াস করতেই হবে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে যদি গড়ে তুলতে হয় তাহলে পরে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আদর্শের উপর ফাটল যেন না হয় কিন্তু মনে রাখতে হবে বাংলার বাঙালির জন্য আমাদের নিবেদিতপ্রাণ। বাংলার বাঙালির স্বার্থে পৃথিবীর যে দেশের সঙ্গে যেকোনো জায়গায় বন্ধুত্ব করা দরকার তা আমরা করব। বিশ্বের কোন রাষ্ট্রের কাছে যত বড়ই হোক আমরা আভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক কোন দাসত্ব লিখে দেই নাই। ভবিষ্যতেও দেব না। জাতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সবার সঙ্গে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে বন্ধুত্বের নীতি গড়ে তুলব। এর নামই হচ্ছে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি সেই নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের প্রতিটি জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্জন করার জন্য আমরা সেই সমস্ত জাতির পাশে দাঁড়াবো। বহু রক্তের বদলে বহু দুঃখের রজনী পার করে আমরা মেনেছি স্বাধীনতার লড়াই কি? আমরা মিলেছি সাম্রাজ্যবাদীরা যারা এখনো পৃথিবীর দিকে দিকে বিভিন্ন জাতি কে পদানত করে রেখেছে সেই সমস্ত পদলিত জাতির বুকের মর্মজ্বালা কি তা আমরা উপলব্ধি করেছি।
বন্ধুরা আমার, এই উপলব্ধি কার না হয়। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায়। একদিন আমেরিকাকে ব্রিটিশের রাজ্যের অধীনে থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। বোস্টনের বন্দরে যেদিন জাহাজ ডুবিয়ে দিলো। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং জর্জ ওয়াশিংটনের ওসি ঝলসে উঠল বোস্টনের তীরে তীরে। আর জেফারসনের বলিষ্ঠ কণ্ঠে যেদিন মানবতার জয়গান গাইল, সেদিনের আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। তাহলে কেন আজ সাম্রাজ্যবাদ ইয়াহিয়ার জন্য অস্ত্র আসছে। এই ব্যথা বেদনার সাথে স্মরণ করি বলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আপনাদের তরফ থেকে মনের বেদনা প্রকাশ করেছি আর প্রতিবাদ জানাচ্ছি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে।
বন্ধুরা আমার, বহু সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার জাতীয় স্বাধীনতা কাকে পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল। জারের অত্যাচার সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত ও পরবর্তীকালে হিটলারের আক্রমণ তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বীর রুশ জাতির লোকেরা জাতীয় স্বাধীনতার স্বর্ণশিখরে উপস্থিত হয়েছিল। সেই জন্য আপনাদের মাধ্যমে আর একবার আমি মহান রুশ জাতির কাছে আবেদন জানাই। তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। চিরকাল বাংলার মুক্তিকামী মানুষ সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষকে স্মরণ করবে।
১৪ই আগস্ট এর মৃত্যু
১৪ই আগস্ট এর মৃত্যু হয়েছে ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবর তারিখে। এতদিন পর্যন্ত এই মৃতদেহটি শবাধারে সংরক্ষিত ছিল। গত ২৫শে মার্চ রাত্রে ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্ট জঙ্গি চক্র এই শবাধারটিও চিরতরে মাটিচাপা দিয়েছেন। আমরা মৃতের পুনর্জীবনের বিশ্বাসী নই। তবু চলতি সালের ২৫শে মার্চ তারিখের সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা আশা করেছি মাত্র ২৪ বছর আগে পাকিস্তানের “স্বাধীনতা দিবস” নাম ধারণ করে যে ১৪ই আগস্ট এর জন্ম, এত শীঘ্র সত্য সত্যই তার অকাল মৃত্যু ঘটেনি। আইয়ুবের অস্ত্রাঘাতে অতিরিক্ত রক্তমোক্ষণনে তার মুমূর্ষ দশা প্রাপ্তি ঘটেছে। ইয়াহিয়া প্রতিশ্রুতিবদ্ধ গণতন্ত্রের সঞ্জীবনী সুধা দেশে ফিরিয়ে আনবেন। এই সঞ্জীবনী সুধার স্পর্শে ১৪ ই আগস্ট আবার নব জীবন লাভ করতে পারে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। তিনি চোদ্দই আগস্টের শবদেহে আরো অস্ত্রাঘাত করেছেন। অতঃপর পূতিগন্ধময় শবদেহটি টিক্কার কাঁধে চড়িয়ে বাংলাদেশের মাটিতে সমাধিস্থ করেছেন। এই সমাজের উপর পানির শিঞ্জনের কাজ করেছেন দশ লক্ষ নিহত বাঙালি নর-নারীর রক্ত শিঞ্জন দাঁড়া। ১৪ই আগস্ট মৃত। তার দেহ ও সমাহিত। এখন তারই সমাধীর উপর ১৪ই আগস্ট এর পতাকা উড়িয়ে ‘স্বাধীনতা দিবস’ উদযাপন করছে ইয়াহিয়া টিক্কার দল। এই ‘স্বাধীনতা দিবস’ কার বা কাদের স্বাধীনতা ? ইয়াহিয়া ও টিক্কা রুপি ধরে রাক্ষস দের স্বাধীনতা। তাদের অবাধ হত্যালীলার স্বাধীনতা। লক্ষ লক্ষ বাঙালি নারী, শিশু, যুবক, বৃদ্ধ হত্যার স্বাধীনতা। হাজার হাজার বাঙালি নারীর সম্ভ্রম ও সতীত্ব অপহরণের স্বাধীনতা। তাই বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় আজ ১৪ই আগস্ট এর পতাকা বলপ্রয়োগে তোলা হয়েছে, তার দন্ড বন্দুকের বাঁট আর বেওনেট দ্বারা তৈরি। পতাকার সবুজ রং রক্তরঞ্জিত। বক্র চাঁদের খন্ডতায় আলো ও রোশনাই নেই। রয়েছে মৃত চাঁদের নিরুত্তাপ কলঙ্কচিহ্ন। তাই ১৯৭১সালের ১৪ই আগস্ট তারিখ আজ আর কোন জাতির স্বাধীনতা দিবস নয়; বরং একটি স্বাধীনতা দিবস এর মৃত্যুর শোক দিবস। পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় আজ স্বাধীনতা দিবস পালনের নামে আসলে চলছে এই শোক দিবস পালনের এই সারম্বর ঘটা।
বস্তুতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির বিলুপ্তি ঘটেছে। পশ্চিম পাকিস্তান নামক যে অংশটুকু এখনো বেয়োনেট আর সঙ্গীনের গুতার মুখে এক রাখা হয়েছে, সেখানে বালুচি প্রাক্তন ও জাতিসত্তা পাঞ্জাবের নির্যাতন ও শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও বিপ্লবের জন্য উন্মুখ। তাহলে এই স্বাধীনতা দিবস কার বা কোন রাষ্ট্রের? পাকিস্তান অধুনালুপ্ত দেশ। ইয়াহিয়া কোন দেশের নির্বাচিত সরকারের নেতা নন, আইনানুগ বৈধ প্রেসিডেন্ট নন। পাকিস্তানে দু-দুবার শাসনতন্ত্র বাতিল করা হয়েছে। তাহলে কোন শাসনতান্ত্রিক বিধানবলে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট? সামরিক আইন বলে? এই সামরিক আইন কার? যে সামরিক আইনের পেছনে দেশের একজন মানুষের সমর্থন নেই তার প্রয়োগ মূল্য ও বৈধতা কতটুকু? সুতরাং আজ অস্তিত্ব বিলুপ্ত একটি রাষ্ট্রের অবৈধ প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা দখলকারী হানাদার বাহিনীর সহায়তায় ইয়াহিয়া চক্র তথাকথিত স্বাধীনতা দিবসের নামে আসলে ১৪ই আগস্ট এর মৃত্যু দিবস পালন করছেন। তাদের এই তথাকথিত স্বাধীনতা দিবস জনগণের স্বাধীনতার স্মারক নয়, জনগণের যোগ দিবস এর সঙ্গে নেই। এই দিবসের ও জনগণের সঙ্গে যোগ নেই। এখন এই দিবসটি ইয়াহিয়া চক্রের বর্বরতা পাশবিকতা ও যথেচ্ছ দস্যুবৃত্তির স্বাধীনতা দিবস।
নরহত্যা ইয়াহিয়া তার স্বরূপ বিশ্ববাসীর কাছে উদঘাটিত হওয়ার আগে দেশের শাসনতন্ত্র সম্পর্কে এক বক্তৃতায় বলেছিলেন,’শাসনতন্ত্র হচ্ছে জনগণের একত্রে বসবাসের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সম্মতির দলিল মাত্র।’শাসনতন্ত্রের এই সংঘা অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জন্য ছিল আরো বেশি প্রযোজ্য। কারণ, পাকিস্তান এক জাতি, এক ভাষা, এক ধর্ম, এক সংস্কৃতির দেশ নয়। আমাকে ভৌগলিক দিক থেকে এক দেশ ও এক রাষ্ট্র ও নয়। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে জনপথের ব্যবধান দুই হাজার মাইলেরও বেশি এবং স্থলপথ এর যোগাযোগ অপর একটি দেশের গণ্ডিত ও বিভক্ত। এ অবস্থায় এই দুই অঞ্চলের একত্রে বসবাসের স্বেচ্ছা সম্মতিই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভিত্তি। এই স্বেচ্ছা সম্মতির আমাদের স্মারক হিসেবেই ১৪ই আগস্ট এর জন্ম। কিন্তু এই তারিখে জন্ম লাভের পর থেকেই বাঙালির স্বেচ্ছা সম্মতি উপর জবরদস্তি খাটানো শুরু হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের একটি সংখ্যালঘু চক্র রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা অপহরণ করে বাংলাদেশকে একটি পদানত কলোনিতে পরিণত করে। ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তবু রাষ্ট্রপরিচালনায় গণতন্ত্রের খোলসটুকু রাখা হয়েছে। কিন্তু ১৯৫৮ সালে দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে পাঞ্জাবের এককালে ইংরেজ গভর্ণরের দেহরক্ষী কুচক্রী পুত্র আইয়ুব বর্তমান ইয়াহিয়া খাদের সহায়তায় একত্রে বসবাসের স্বেচ্ছা সম্মতির তখনকার দলিল ৫৬ সালের শাসনতন্ত্র উড়িয়ে দেন এবং দেশে বন্দুকের শাসন কায়েম করেন। বস্তুতঃ ১৯৫৮ সালের সেই অশুভ ও অপবিত্র রাত্রে চোদ্দই আগস্টের অপমৃত্যু ঘটে।
আমাদের এ মন্তব্য যে অসৎ নয় তার প্রমান পাওয়া যাবে আইয়ুবের ক্ষমতা লাভের পরবর্তী দশ বছরের ইতিহাসে। এই সময় পাকিস্তানের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস হিসেবে চোদ্দই আগস্টের মর্যাদার আসনে মহাসমারোহে ২৭শে অক্টোবর তারিখে তথাকথিত বিপ্লব দিবস অনুষ্ঠান শুরু হয়। তথাকথিত বিপ্লব দিবসের অতিথি সমারোহ এবং চোদ্দই আগস্টের অমর্যাদা দৃষ্টে আইয়ুবের পা চাটা লাহোরী দৈনিক’পাকিস্তান টাইমস’ পর্যন্ত একবার দুঃখ করে লিখেছিলেন, “১৪ই আগস্ট উদযাপন এখন একটা প্রহসনে পরিণত হয়েছে। লাহোরের বাৎসরিক পশু প্রদর্শন উৎসব ও এর চাইতেও মর্যাদার সাথে উদযাপিত হয়।”পাকিস্তান টাইমস পত্রিকা দুঃখ করেছিলেন। কারণ আইয়ুব স্বহস্তে দিবসটিকে হত্যা করেছেন, তাকে মর্যাদা দিবেন বা দেখাবেন এমন আশা করা বাতুলতা।
তথাপি, ১৯৭০ সালে ইয়াহিয়া চক্র কর্তৃক দেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ঘোষিত হওয়ায় অনেকেই আশা করেছিলেন, ১৪ই আগস্ট তারিখে গণতন্ত্রের সঞ্জীবনী প্রাণের স্পর্শ হয়তো পুনরুজ্জ্বীবিত হবে। আমাদের এবং ইয়াহিয়াদের ও দুর্ভাগ্য তা হয়নি। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে উন্মাদ ইয়াহিয়া ১৪ই আগস্ট তারিখের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানকেও দশ লাখ বাঙালির লাশের স্তূপের নিচে সমাধিস্থ করেছে। এখন শকুনি গৃহিণীর মত এই পচনশীল শবের পাহারায় ১৪ই আগস্ট এর পতাকা ব্যবহার ইয়াহিয়া চক্রের জন্য পৈশাচিক বর্বরতার ছিন্ন আবরণী মাত্র!
পলাশীর আম্রকাননে একদা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছে। ইতিহাসের কী বিস্ময়কর অভ্যুত্থান! ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের কুষ্টিয়া জেলার এক আম্রকুঞ্জে স্বাধীনতার সূর্য উদিত হয়েছে। বাঙালি কবি তাই যথার্থই বলেছিলেন,
“ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়
আমাদের দিবাকর
উদিবে সে রবি আমাদেরই খুনে
রাঙিয়া পুনর্বার।”
এই খুন রাঙ্গা রক্ত রবিই বাঙালির স্বাধীনতার পতাকা। আর এই রক্ত রবির উদয় দিবসেই তার স্বাধীনতা দিবস। ১৪ই আগস্ট আর বাঙালির স্বাধীনতা দিবস নয়।