যুদ্ধের মেঘ
যুদ্ধের প্রাক্কালে আমার সৈন্যরা তাদের অবস্থান গ্রহণ করে। এ ব্যাপারে মেজর জেনারেল ফজল মুকিম তার পাকিস্তান’স ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ নামক বইয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তিনি অনেক ক্ষেত্রে ইস্টার্ন কমান্ড সম্পর্কে সঠিক বর্ণনা দিয়েছেন এবং সত্য গােপন রাখতে পারেননি। সে সময় সৈন্য সমাবেশ তিনি নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন “পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যদের অবস্থা সম্পর্কে কিছুটা আলােচনা করা দরকার। ১৪ পদাতিক ডিভিশন স্থায়ীভাবে পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন ছিল। এ ডিভিশনকে সামরিক অভিযান শুরু হবার আগে প্রায় দু’বছর অব্যাহত সামরিক আইনের দায়িত্ব পালনের চাপ সহ্য করতে হয়েছে। পরবর্তীতে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান এবং আওয়ামী লীগের বিরুপ প্রচারণায় এ ডিভিশনকে চড়া মাশুল দিতে হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ দিক থেকে ৯ম ও ১৬তম পদাতিক ডিভিশনের সঙ্গে এ ডিভিশনকে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। এ লড়াইয়ের জন্য সৈন্যদের না ছিল প্রশিক্ষণ না ছিল প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র। এটা ছিল এমন এক অদ্ভুত লড়াই যেজন্য সৈন্যরা মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। শত্রুকে চিহ্নিত করারও সম্ভব ছিল না। তাদের সহযােগিতায় কারা কারা আছে তাও বােঝা যাচ্ছিল না। শত্রুরাও মানছিল না যুদ্ধের প্রচলিত নিয়ম-কানুন। বস্তুতপক্ষে, এটা ছিল সাধারণ যুদ্ধের চেয়েও বাজে। সৈন্যদেরকে ভারতীয় সৈন্য ও বিদ্রোহীদের সঙ্গে অবিরাম আটমাস লড়াই করতে হয়েছে। মাঝে মধ্যে শান্ত অবস্থা বিরাজ করত তবে তা বেশি দিন স্থায়ী হতাে না। সেপ্টেম্বর থেকে ভারতীয় আর্টিলারি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ বৃদ্ধি পায় এবং সীমান্তে তাদের হামলা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। স্থানে স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে প্লাটুন ও সেকশন আকারে মােতায়েন করা হয়। স্বস্তির কোনাে আশা ছিল না। সৈন্যরা বিশ্রাম নিতে পারে নি। এক মুহূর্তের জন্য। যে সৈন্যটি এপ্রিলে ট্রেঞ্চে প্রবেশ করেছিল, মরে গিয়ে না থাকলে সে সৈন্যটি নভেম্বর পর্যন্ত সেখানেই ছিল। সরবরাহ ছিল খুবই নগণ্য। কোনাে নিরাপত্তা ছিল না। কারণ বেসামরিক সরকারের প্রতিটি স্তরে ও স্থানীয় জনগণের মধ্যে সর্বত্র শত্রুর অনুচর ছিল। সর্বোচ্চ গােপনীয়তার মধ্য দিয়ে কোনাে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও তার গােপন রাখা যেত না।
এসব কারণে সৈন্যদের ওপর সার্বক্ষণিক প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতায় যুদ্ধ ছাড়াই সৈন্যরা হতাহত হতে থাকে। এতে তাদের মনােবলে চিড় ধরে। পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন সশস্ত্র বাহিনীর ওপর ন্যস্ত জটিল দায়িত্ব সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ উপলব্ধি করতে পারে নি। তাদেরকে অবহিত করার জন্য কোনাে পদক্ষেপও নেয়া হয় নি। সৈন্যরা কী ধরনের দায়িত্ব পালন করেছে এবং কি পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়েছে, তা বােঝানাের জন্য সাম্প্রতিক কালের দু’একটি গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা যুদ্ধের একটি তুলনামূলক আলােচনা করা প্রয়ােজন। প্রথমে, ১৯৬০ সালে আলজেরিয়ায় গেরিলা যুদ্ধের কথা আলােচনা করা যাক। আলজেরিয়া হচ্ছে একটি সাবেক ফরাসি। উপনিবেশ, ফ্রান্স থেকে এর দূরত্ব প্রায় ৪শ’ মাইল। সে সময় আলজেরিয়ার জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি এবং ফ্রান্সের ৫ কোটি। আলজেরিয়ার ১ কোটি লােকের মধ্যে ১০ লাখ ছিল ফরাসি যারা তাদের মাতৃভূমির প্রতি ছিল অনুগত। ফরাসি সামরিক বাহিনী আলজেরিয়াকে পুরােপুরি ঘেরাও করে রেখেছিল। সে অঞ্চলে ফ্রান্সের প্রায় ১০ লাখ সৈন্য ছিল। মিসর, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন আলজেরীয় গেরিলাদের সমর্থন দিত। কিন্তু এসব দেশ ছিল আলজেরিয়া থেকে অনেক দূরে। তারা আলজেরিয়ার ভেতর থেকে নৈতিক পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তা দিতে পারে নি। দ্বিতীয় উদাহরণ হচ্ছে উত্তর ভিয়েতনাম। বিশ্বের শীর্ষ সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২০ কোটি। অন্যদিকে, উত্তর ভিয়েতনামের জনসংখ্যা ছিল দেড় কোটি। উত্তর ভিয়েতনামের ২০ লাখ গেরিলা ১০ লাখ মার্কিন সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করেছে। উত্তর ভিয়েতনামের সঙ্গে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সীমান্ত হচ্ছে মাত্র ১শ’ মাইল। মার্কিন ও দক্ষিণ ভিয়েতনামী বাহিনীর উত্তর ভিয়েতনামকে ঘেরাও করে রেখেছিল। তাদের রণসম্ভার ও গােলাগুলির কোনাে অভাব ছিল না।
অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি যাদের অধিকাংশই পর্যায়ক্রমে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের ২ হাজার মাইলব্যাপী সীমান্ত রয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমুদ্র পথে দূরত্ব হচ্ছে ৩ হাজার মাইল। পূর্ব পাকিস্তানে তিন ডিভিশন পদাতিক সৈন্য মােতায়েন ছিল। তাও আবার ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া। তাদের শক্তি বৃদ্ধির অথবা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কোনাে সুযােগ ছিল না। কয়েকজন বিদেশি বিশেষজ্ঞ সে সময় বলেছিলেন যে, বিদ্রোহ দমন অভিযানের পাকিস্তানের আড়াই থেকে তিন লাখ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যের প্রয়ােজন। এছাড়া, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আর্থরাজনৈতিক প্রচারণা চালানােরও প্রয়ােজন ছিল। পাকিস্তানের চেয়ে কমপক্ষে ৫ গুণ বড় ভারত পূর্ব পাকিস্তানি গেরিলাদের বস্তুগত, প্রশিক্ষণ, কারিগরি সহায়তা ও জনবল দিয়ে সাহায্য করছে। আলজেরিয়া ও ভিয়েতনামে যে ধরনের রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রচারণা চালানাে হয়েছে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় অথবা প্রাদেশিক সরকার সে ধরনের প্রচারনা চালিয়ে সৈন্যদের উৎসাহ যােগায় নি। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানও পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পেছনে ঐক্যবদ্ধ ছিল না। পর্বত প্রমাণ এসব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সৈন্যরা তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য অর্জন এবং পুরােপুরিভাবে ভারত-সমর্থিত মুক্তিবাহিনীর সব অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু তাদের সফলতার কোনাে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা হয় নি। সৈন্যদের ওপর অর্পিত দায়িত্বের জটিলতা বিবেচনায় তাদের সাফল্য একটি অলৌকিক ঘটনা।
ভারতের অব্যাহত ও ক্রমাগত চাপে সৈন্যদের মনােকল ভেঙে যালি সীমান্তে। সে সময় এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হলিল যে, যুদ্ধ শুরু হলে তারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে এবং তাদের কাছে কোনাে সাহায্য আসবে না। তাদেরকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বৈরি জনগণের করুণার ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। অফিসারও সৈন্যদের মধ্যে গৃহকাতরতা দেখা দেয় এবং তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার একটি আতংক জোরদার হয়ে ওঠে। দুঃস্বপ্নময় মাসগুলােতে প্রেসিডেন্ট ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান একবারের জন্যও পূর্ব পাকিস্তান সফরে যান নি। সেনাবাহিনী প্রধান ও অন্যান্য উর্ধ্বতন অফিসারগণও খুব একটা সফরে যেতেন না। এতে দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়। প্রেসিডেন্ট ও অন্যান্যরা পূর্ব পাকিস্তান সফরে না যাওয়ায় ভারতীয় প্রচারণার মাত্রা আরাে বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম পাকিস্তানি লােকজনসহ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ প্রত্যাশা করতেন যে, প্রেসিডেন্ট এসে স্বচক্ষে পরিস্থিতি দেখে যাবেন। প্রেসিডেন্ট সফরে না যাওয়ায় কানাঘুষা, গুজব ও ফিসফাস শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ বলতে লাগল যে, তিনি সফরে আসতে খুবই ভয় পাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করত যে তিনি আমােদ-ফুর্তিতে এত ব্যস্ত যে, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে ভাববার তার ফুরসত নেই। তবে সৈন্যরা তাদের কমান্ডার-ইন-চিফকে তাদের মধ্যে দেখতে চেয়েছিল। সৈন্যরা বলল যে তিনি লাহাের ও শিয়ালকোট সীমান্তে সফরে যেতে পারলে পূর্ব পাকিস্তানেও আসতে পারেন। ভারতীয়রা প্রচারণা চালাচ্ছিল যে, সৈন্যরা ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর দয়ার কাছে জিম্মি। প্রেসিডেন্টের কাঙিক্ষত সফর ভারতের এ প্রচারণা নস্যাৎ করে দিতে পারত। ১৯৭১ সালে মার্চে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট তার সৈন্যদের দেখার জন্য একবারও পূর্ব পাকিস্তানে যান নি। সামরিক ইতিহাসে এমন নজির খুব কমই আছে যেখানে একটি চরম বৈরি পরিবেশ যুদ্ধরত একটি বাহিনীকে তাদের সেনাপতি নয়। মাস দেখতে যান নি। সৈন্যরা সেকেন্ড-ইন-কমান্ড সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদকে দেখতে পেয়েছে মাত্র দু’বার। একবার আগস্টে এবং আরেকবার অক্টোবরে। একটি পরিকল্পিত বিদ্রোহ দমনে সফল হওয়ার পরও তারা হয়ে ওঠে একটি বিস্মৃত সেনাবাহিনী। তারা তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব দক্ষতা ও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে এবং পরে তারা আট মাস ধরে এমন সব ব্যর্থ তৎপরতায় জড়িত রয়েছে যার কোনাে সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছিল না। তারপরও তারা মাটি কামড়ে লড়াই করেছে এবং এতে তারা ক্লান্তির চরম মাত্রায় পৌছে যায়।
এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবার আত্মবিশ্বাষ প্রদর্শন করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন তিন ডিভিশন সৈন্যের মনােবল ছিল দৃশ্যত উঁচু। কিন্তু তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক ভারী অস্ত্র ও লজিস্টিক সমর্থন ছিল না। বিমান বাহিনীর অবস্থা ছিল আরাে শােচনীয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে ছিল মাত্র এক স্কোয়াড্রন বিমান। আট মাসে বিভিন্ন অপারেশনে এক স্কোয়াড্রন বিমান থেকেও কিছু বিমান খােয়া যায়। এ বিমান বাহিনী কোনােমতেই বিদ্রোহ দমনে যথেষ্ট ছিল না। নৌবাহিনীতে গানবােট ছিল ৪টি। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তান পর্যন্ত সমুদ্র সীমা পাহারা দেয়া তাে দূরের কথা, পূর্ব পাকিস্তানের নদ-নদীগুলাে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতাও এদের ছিল না। অরতের ব্যাপক সামরিক অভিযানের আলামত স্পষ্ট। হয়ে উঠে। সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে কৌশলগত ও লজিস্টিকভাবে এক অসাধ্য কাজের মুখােমুখি দাঁড়াতে হবে। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সহায়তা না এলে অথবা পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী কার্যকর ও ত্বরিত ভূমিকা পালন করলে পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর মনােবল বজায় রাখা হবে এক দুরূহ সমস্যা। পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন সশস্ত্র বাহিনী এক সর্বাত্মক আগ্রাসন মােকাবেলা করছে।’
(পাকিস্তান’স ক্রাইসিস অভ লিডারশিপ, মেজর জেনারেল ফজল মুকিম)
সামরিক বিশেষজ্ঞ ডেভিড লােশাকের মতে, বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আড়াই লাখ সৈন্যের প্রয়ােজন ছিল। অন্যান্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের হিসাব অনুযায়ী ও পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ দমন অভিযানে পাকিস্তানের আড়াই থেকে তিন লাখ সৈন্যের প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু আমার অধীনে ছিল মাত্র ৪৫ হাজার নিয়মিত ও আধাসামরিক সৈন্য। এ সামান্য সংখ্যক সৈন্য নিয়েও আমি দু’মাসের কম সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে গেরিলাদের উচ্ছেদ করতে সফল হই। আমার সৈন্যদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ ছিল না এবং কাজ করতে পারছিল না। প্রাদেশিক সরকারও।
আমি জেনারেল হামিদকে জানাই যে, আমাদের প্রতি বাঙালিরা বৈরি হওয়ায় পরিস্থিতি পুরােপুরি বদলে গেছে। সুতরাং আমার মিশনও পরিবর্তন করা উচিত এবং আমাকে প্রয়ােজনবােধে আমার পরিকল্পনা পরিবর্তনের অনুমতি দেয়া উচিত। শক্রর হাতে কোনাে ভূখণ্ডের পতন হতে দেয়া যাবে না। এবং সীমান্ত বন্ধ করে দিতে হবে বলে যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল তাতে কোনাে কৌশলগত বিবেচনা স্থান পায় নি। সম্পূর্ণ রাজনেতিক বিবেচনা থেকে এ রকম একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। মিশন পরিবর্তন করা হলে আমি আরাে স্বাধীন ও নমনীয়ভাবে আমার দায়িত্ব পালন করতে পারতাম। কিন্তু জেনারেল হামিদ রাজি হন নি। তিনি ভারতে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি ও রসদ ধ্বংসে আমাকে অতিরিক্ত সৈন্য ও সম্পদ দিতে অস্বীকার করেন।
ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের সার্বিক ধারণা
পাকিস্তান সৃষ্টির সময় থেকেই ঐতিহাসিক ও ভৌগােলিক কারণে সশস্ত্র বাহিনীর বৃহদাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে মােতায়েন রাখা হতাে। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে রাখা হতাে ডিভিশন আকৃতির একটি বাহিনী। “পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর”- এটাই ছিল প্রতিরক্ষা নীতি। এটা আরাে সহজবােধ্য ভাষায় বলতে গেলে তার অর্থ দাঁড়ায় যে, ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের মীমাংসা হবে পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে। অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানের গ্যারিসনকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক ভারতীয় সৈন্যকে ব্যস্ত এবং তাদেরকে এ ফ্রন্টে আটকে রাখতে হবে। আমি আবার বলছি- একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। অর্থাৎ পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধের ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত। ঢাকায় আমাদেরকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দানের দিন পর্যন্ত এটাই ছিল আমাদের সামরিক কৌশলের ভিত্তি। পরিশিষ্ট ১৪-তে এ ব্যাপারে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া আছে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে উপস্থাপন শত্রুর অতীতও সম্ভাব্য তৎপরতা, মুজাহিদ, ইপকাফ ও অন্যান্য বাহিনীসহ সৈন্য মােতায়েন এবং বৈদিশক হুমকি মােকাবেলা ও বিদ্রোহ দমনে আমার গৃহীত। ব্যবস্থাদি সম্পর্কে ব্রিফিং দানের জন্য আমি আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী ও আমার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর জেনারেল জামশেদকে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে পাঠাই। আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে জানাই যে “বিদ্রোহ দমনে সফল হওয়ায় আমি আশংকা করছি যে, পূর্ব পাকিস্তানে শুষ্ক মওসুম শুরু এবং চীনা গিরিপথগুলাে অবরুদ্ধ হয়ে এলে ভারত আমাদের বিরুদ্ধে হামলা করবে। সম্প্রতি মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের অস্বাভাবিক তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের সীমান্ত বরাবর ভারতীয় সৈন্য সমাবেশের খবর পাওয়া গেছে। যুদ্ধ আসন্ন বলে মনে হচ্ছে। নভেম্বর অথবা ডিসেম্বরের মধ্যে শক্রর সমরসজা সম্পন্ন হওয়া মাত্রই যুদ্ধ শুরু হতে পারে। বর্তমানে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে লড়াই করার মতাে অনুকূল অবস্থা আমাদের নেই। গেরিলা উৎপরতা চলছে আমাদের বিরুদ্ধে এবং গেরিলারা সেতু, কালভার্ট, সড়ক ও রেললাইন ধ্বংস বরছে এবং স্থানীয় লােকজনের অধিকাংশ আমাদের প্রতি বৈরি। বেসামরিক প্রশাসন একটি প্রতীকী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় রাজাকার ও মুজাহিদরা যেখানে যেখানে সক্রিয় কেবলমাত্র সেখানে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। মিল-কারখানায় বর্মরত শ্রমিকরা ৮০ ভাগ উৎপাদন পুনরুদ্ধার করেছে। কিন্তু হুমকি দেয়া হচ্ছে তাদেরকে। বড় বড় শহরগুলােতে স্বাভাবিক কাজ-কর্ম শুরু হয়েছে। কিন্তু গেরিলা হামলায় জনগণের মধ্য আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি হয়েছে।”
সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা এবং আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের অভিষেকের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির জন্য আমি সুপারিশ করেছিলাম। আমার এ সুপারিশ গ্রহণ করা হলে আগ্রাসী শক্তিকে মােকাবেলায় আমার কাজ সহজ হতাে। কিন্তু এবার আমাকে পশ্চাদ্ভাগ ও সম্মুখভাগ থেকে লড়াই করতে হবে। শত্রুর সামর্থ্য আমি আশা করেছিলাম যে, এগার অথবা বার ডিভিশন ভারতীয় সৈন্য এবং চারটি স্বতন্ত্র বিগ্রেড, একটি সাজোয়া ব্রিগেড ও ৩৯ ব্যাটালিয়ন বিএসএফ হামলায় অংশ নেবে আমি আরাে হিসাব করেছিলাম, চীনা হুমকি মােকাবিলায় ভারত চীন সীমান্তে ৪-৫ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করে বাকি সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। চীন সীমান্তে মােতায়েন সৈন্যরা মূলত রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত হবে। সকল গিরিপথ বরফাচ্ছাদিত হয়ে পড়ায় চীনা সৈন্যরা সীমান্ত অতিক্রমে সক্ষম হবে না। তাই ভারত ১২ ডিভিশনের বেশি সৈন্য পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধে নামাতে পারে। নিম্নোক্ত ঘটনাবলী শত্রুর আগ্রাসী অভিপ্রায়ের স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছিল। সেগুলাে
ক. ১৯৭১ সালে রুশ-ভারত সামরিক চুক্তির ফলে ভারতের অনুকূলে
কৌশলগত সামরিক ভারসাম্যের সূচনা হয়। রাশিয়া সামরিক উপদেষ্টা ও সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহে সহযােগিতার মাধ্যমে চীনা হুমকি মােকাবেলা করার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
খ.পূর্ব পাকিস্তানের স্থল সীমান্তকে পুরােপুরি ঘেরাও করার জন্য ২০ তম মাউন্টেন ডিভিশনকে নামানাে হয় এবং চতুর্থ ও ৬ষ্ঠ মাউন্টন ডিভিশনকে অগ্রবর্তী অবস্থানে মােতায়েন করা হয়।
গ.কোরের মধ্যে সেনা ও কমান্ড ইঞ্জিনিয়ার সম্পদ বন্টন।
ঘ, রেল লাইনের সংস্কার এবং রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণ। ত্রিপুরা অঞ্চলে এসব কাজ চলছিল।
ঙ. সীমান্ত বরাবর আগ্রাসী তৎপরতা বৃদ্ধি।
চ, জনমত গঠনে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর।
অনুমান মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা এবং ভারতীয়দের পরােক্ষ সংশ্লিষ্টতার ভিত্তিতে নিম্নোক্ত অনুমানগুলাে পেশ করা হয় :
ক. এইচ-১
(১) অভ্যন্তরে বিদ্রোহী তৎপরতা জোরদার।
(ক) যােগাযােগ ব্যবস্থা ব্যাহত। | (খ) অসহযােগ আন্দোলন ও আইন অমান্য। (গ) নির্বাচন এবং বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বাধা। |
(২) ভূখণ্ড দখল এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
ইস্টার্ন সেক্টরে অগ্রাধিকার : (ক) সব সেক্টরে ভারতীয় পদাতিক ও গােলন্দাজ বাহিনীর সহায়তা নিয়ে
বিদ্রোহীদের সর্বাত্মক হামলা। (খ) ভারতীয় সৈন্যদের পূর্ণ সমর্থনে সীমান্তে হামলা এবং আমাদের একটির
পর একটি বিওপি দখল। (গ) চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-সিলেট সীমান্ত বরাবর যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে
দেয়ার লক্ষ্যে দুর্বল স্পটে হামলা এবং যতটুকু সম্ভব ততটুকু জেরে
প্রবেশ। (ঘ) বাংলাদেশ ভূখণ্ড প্রতিষ্ঠা।
(৩) বাংলাদেশকে স্বীকৃতি।
খ. এইচ-২ (সবচেয়ে বিপজ্জনক)
(১) পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় হামলা। (২) এইচ-১, ইতােমধ্যে এগিয়ে চলছে।
গ. এইচ-৩ (১) এইচ-১ এক মাসের জন্য অথবা অনুরূপ। (২) স্পষ্ট ফলাফল পাওয়া না গেলে এইচ-২ এর দিকে এগিয়ে যাবে।
আমরা এ সুপারিশে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে সুস্পষ্টরূপে জানাই যে, পাকিস্তানের পক্ষে যে কোনাে হামলা চালানাের জন্য সর্বোত্তম সময় ছিল অক্টোবর অথবা মে-এর আগে এবং তা হতে হবে অবশ্যই মার্চের পর।
সার্বিক অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক পরিস্থিতির আলােকে আমরা সুপারিশ করি যে, ভারতের বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য আমাদের সামনে তিনটি উপায় খােলা রয়েছে :
ক, সৈন্যদেরকে লড়াইয়ের অবস্থানে প্রত্যাহার করা এতে প্রকৃত সীমান্ত পরিত্যাগ করতে হবে এবং আশপাশের কতিপয় এলাকা অরক্ষিত অথবা কোনাে রকমে ধরে রাখতে হবে। ভারতের নিয়মিত বাহিনীর সরাসরি সমর্থন নিয়ে বিদ্রোহীরা এ ধরনের এলাকায় ও ক্ষুদ্র পােস্টগুলােতে হামলা চালাবে। এ ধরনের কয়েকটি এলাকা দখল করে বিদ্রোহী ও ভারতীয়রা বাংলাদেশ হিসেবে দাবি করতে পারে। শত্রুরা বড় ধরনের লড়াই ও রক্তপাত ছাড়াই তাদের মিশন সফল করবে। আমাদের সকল শ্রম, কঠিন। লড়াই, আত্মত্যাগ ও বিস্ময়কর সাফল্য বিফলে যাবে এবং পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত হয়ে উঠবে।
সীমান্ত শক্তভাবে ধরে রাখা। এটা আমাদেরকে শক্তি যােগাবে এবং সফল হলে আমাদেরকে কোনাে ভূমি হারাতে হবে না। কিন্তু এলাকার বিশালত্ব এবং সৈন্য, গােলাবারুদ ও গতিশীলতার অভাবে এটা কৌশলগতভাবে উপযুক্ত নয়। আমার হাতে খুব। সামান্য ভূখণ্ড থাকবে। কোনাে রিজার্ভ, কোনাে গতিশীলতা অথবা সচলতা থাকবে না এবং তৎপরতার সুযােগ থাকবে সীমিত। পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা ও ঝুঁকি রয়েছে। এতে অহেতুক প্রাণহানি ঘটবে বিদ্রোহী ও ভারতীয়রা আমাদের ক্ষতি করার সুযােগ পাবে। অন্যদিকে, আমরা ভারতীয় ভূখণ্ডে গোলাগুলি ও হামলা করার অবস্থানে থাকব। ফলে ভারতীয়রা তাদের ট্যাংক। ও কামানের মজুদ রক্ষায় সৈন্য পাঠাতে বাধ্য হবে। এতে আমি আমার অবস্থান ধরে রাখার সুযােগ পাব এবং নিজেদের শরণার্থীদের নিয়ে ভারতীয়রা হাবুডুবু খাবে।
গ. পর্যাপ্ত অতিরিক্ত সৈন্য রাখা
অগ্রবর্তী অবস্থান ও অভ্যন্তরে শক্তিশালী হওয়ার জন্য ঘাটতিগুলাে পূরণ করতে হবে। নিয়মিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অঘােষিত যুদ্ধে দক্ষতার সঙ্গে লড়াই এবং দেশের অভ্যন্তরে লড়াইয়ে বিদ্রোহীদের নির্মূল করতে হবে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স তৃতীয় প্রস্তাবে সম্মত হয়। কারণ তাদের অভিমত ছিল যে, প্রথম দুই উপায় বা প্রস্তাবের ক্ষেত্রে শত্রু তার মিশন হাসিলে চমৎকার অবস্থানে পৌছে যাবে এবং পুরাে পরিস্থিতি আমাদের বিপক্ষে চলে যাবে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আরাে অভিমত প্রকাশ করে যে, পশ্চিম রণাঙ্গনে উভয়পক্ষের সৈন্য সংখ্যার একটি অনুকূল অনুপাত সৃষ্টি। করার লক্ষ্যে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ভূখণ্ড না হারিয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে সর্বোচ্চ সংখ্যক ভারতীয় সৈন্যকে ব্যস্ত রাখতে হবে এবং পশ্চিমাঞ্চলীয় ফ্রন্ট থেকেই চূড়ান্ত হামলা করা হবে। আমরা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের এ অভিমত মেনে নিই। এবং সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিই যে, ভারতীয় হামলা মােকাবিলা এবং ভারতীয়দের জন্য কষ্টকর অবস্থা সৃষ্টির লক্ষ্যে অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানাে এবং আমাদের ঘাটতিগুলাে পূরণ করা খুবই জরুরি। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স। এতে সম্মত হয়। আমাদের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ ছিল।
(১) মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করা প্রদেশের অধিকাংশ লােক “বাংলাদেশকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে সমর্থন করত । এজন্য আমরা বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা চালানাের জন্য ঢাকাভিত্তিক একটি কেন্দ্রীয় মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বাের্ড গঠনের প্রস্তাব দেই । এ ধরনের একটি মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ চালানাের জন্য সার্বক্ষণিক ব্যাপক প্রচেষ্টা এবং উৎসর্গীকৃত একদল লােকের প্রয়ােজন ছিল।
(২) দেশ ও জনগণের নৈতিক মনােবলের স্বার্থে দীর্ঘস্থায়ী একটি অনিশ্চিত অবস্থা কাম্য নয়। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে। (৩) ভারতীয় গােলাবর্ষণের প্রতিশােধ গ্রহণে আগরতলা বিমান ঘাঁটিতে বােমাবর্ষণ করতে হবে। (৪) বেসামরিক প্রশাসনকে জোরদার এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলাকে
শক্তিশালী করার মাধ্যমে বেসামরিক প্রশাসনকে আরাে সমর্থন যােগাতে হবে। (৫) পূর্ব পাকিস্তানে আরাে নতুন সৈন্য নিয়ােগের মাধ্যমে আমাদের সামরিক সামর্থ্য বৃদ্ধি করতে হবে। (৬) পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে যুদ্ধ শুরু করা যাবে না। | জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে ফিরে এসে মেজর জেনারেল জামশেদ ও ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী আমাকে নিম্নোক্ত ব্রিফিং করেন : (ক) জেনারেল হামিদ খান নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমাদেরকে অগ্রবর্তী
প্রতিরক্ষা অবস্থান এবং প্রদেশের অভ্যন্তরে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। (খ) অতিরিক্ত সৈন্য ও আর্টিলারি প্রেরণে আমাদের অনুরােধ আংশিকভাবে রক্ষা করা হয়েছে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স অবিলম্বে ৮ ব্যাটালিয়ন পদাতিক ও এক ব্যাটালিয়ন ইঞ্জিনিয়ার পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। (গ) ভারত ঈদের দিনে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করতে পারে । (ঘ) আমাদের রাজনৈতিক মিশন অপরিবর্তিত থাকবে।
ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে অ্যুত্থান
চিফ অভ জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লে. জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকী যেসব বিষয় নিয়ে আলােচনা করেছেন তিনি আমাকে তা অবহিত করেন। আমি ব্রিগেডিয়ার মমতাজ আলীর নেতৃত্বাধীন ১১১তম ব্রিগেড ও আরাে ১০টি ব্যাটালিয়ন পাঠানাের এবং কামান ও ট্যাংকে আমার ঘাটতি পূরণের অনুরােধ করি। এ অনুরােধ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার বাকির জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। জেনারেল হাসান ১১১তম ব্রিগেড, ১০টি ব্যাটালিয়ন ও আরাে কয়েকটি সহায়ক। ইউনিট পাঠাতে সম্মত হন। আলােচনাকালে দুপুরে খাবারের সময় হয়ে যায়। তাই দুপুরের পর আবার আলােচনা শুরু হওয়ার কথা ছিল। ব্রিগেডিয়ার বাকির লাঞ্চে যান এবং তখন তার এক বন্ধু আলােচনার ফলাফল সম্পর্কে জানতে চান। ব্রিগেডিয়ার বাকিরের ওই বন্ধু জানান যে, তাকে ১১১তম ব্রিগেড দেয়া হবে না।
কারণ এ ব্রিগেডটি অভ্যুত্থান ঘটানাের জন্য রাওয়ালপিন্ডিতে রেখে দেয়া হয়েছে। এবং ব্রিগেড কমান্ডার সিজিএস জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গেই অবস্থান করছেন। বিকেলে যখন আলােচনা শুরু হয়। তখন তাঁকে জানানাে হয় যে, ১১১তম। ব্রিগেড পাঠানাে হবে না। মাত্র আট ব্যাটালিয়ন সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে পাঠান হবে। তাকে ঢাকা ফিরে আসার জন্য নির্দেশ দেয়া হয় এবং জানানাে হয় যে, এই মাত্র। পাওয়া এক খবরে জানা গেছে, ১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর ঈদের দিনে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে হামলা করবে। মাত্র দুটি ব্যাটালিয়ন আমাদের কাছে পৌছে। ইউনিটের বাকিরা আর কোনােদিনই এসে পৌছায় নি। দৃশ্যত জেনারেল গুল হাসান একটি অভ্যুত্থান ঘাটানাের জন্য আমাদের প্রতারিত করেছিলেন। তিনি অ্যুত্থান ঘটিয়ে ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়াকে বাধ্য করতে চেয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার বাকির যে বৈঠকে জেনারেল হাসানের সঙ্গে আমার সুপারিশ নিয়ে। আলােচনা করছিলেন সে বৈঠকে নৌবাহিনী প্রধান উপস্থিত ছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু করা যাবে না বলে আমি যে সুপারিশ করেছিলাম ব্রিগেডিয়ার বাকিরের মুখ থেকে তা শােনা মাত্রই নৌবাহিনী প্রধান মন্তব্য করেন যে, সেক্ষেত্রে তিনি তার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেবেন। জেনারেল হামিদ তখন তড়িঘড়ি। করে তাকে সঙ্গে নিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন। ব্রিফিঙের পর জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ মন দিলাম । প্রথমেই ভাবতে শুরু করলাম চাঁদপুরের কথা। ১৪তম ডিভিশনকে চাঁদপুর রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছিলাম। সে সামর্থ্য তাদের ছিল। কিন্তু তারা চাদপুর রক্ষায় ব্যর্থ হয়। তাই আমি মেজর জেনারেল এম, রহিম খানের নেতৃত্বে ৩৯ এডহক ডিভিশন গঠন করি। মার্শাল ল’ সদর দপ্তর ও ৫৩ ব্রিগেডের কিছু সৈন্য নিয়ে এ ডিভিশন গঠন করা হয়। ৫৩ ব্রিগেড ছিল একটি কমান্ড রিজার্ভ এবং ঢাকার প্রতিরক্ষাই ছিল এর মূল কাজ। কিন্তু জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আরাে ৮টি ব্যাটালিয়ন পাঠানাের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেই প্রতিশ্রুতির ওপর ভরসা করে এ ব্রিগেডকে চৌদ্দগ্রামলাকসাম পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কিন্তু প্রতিশ্রুত ব্যাটালিয়ন এসে না পৌছানােতে অন্যান্য ডিভিশন কাটছাট করে কিছু সৈন্য ঢাকায় এনে মােতায়েন করি। যে দু’টি অতিরিক্ত ব্যাটালিয়ন এসে পৌছেছিল সে দুটি ব্যাটালিয়নকে যশাের সেক্টরে ৯ ডিভিশনের ঘাটতি পূরণে পাঠানাে হয়। আরাে ৬টি ব্যাটালিয়ন এসে পৌছানাের কথা ছিল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এ ৬টি ব্যাটালিয়নকে ঢাকায় মােতায়েন করা হবে। চাঁদপুরের কাছে একটি দ্বীপে ৩৯ ডিভিশনের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। ৩৯ তম ডিভিশন গঠন করায় ১৪ তম ডিভিশনের ওপর চাপ কমে যায়। ফলে এ দুটি ডিভিশনের দায়িত্ব পুনরায় বন্টন করা হয়। ১৪ তম ডিভিশন (৭ ব্যাটালিয়ন) কে মেঘনা নদীসহ সিলেট থেকে কসবা পর্যন্ত এবং ৩৯ তম ডিভিশন (৪টি ব্যাটালিয়ন)কে কসবা থেকে ফেনী পর্যন্ত এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। | জিওসি ইস্টার্ন কমান্ড লে. জেনারেল অরােরা পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকে ৩ কোর। সৈন্য ও একটি কমিউনিকেশন জোন মােতায়েন করেন। লে. জেনারেল সগত সিংয়ের নেতৃত্বে একটি কোর চট্টগ্রাম সেক্টরে সিলেটের বিপরীত দিকে, মেজরজেনারেল জি,এস, গিলের নেতৃত্বে ১০১ তম কমিউনিকেশন জোনকে ময়মনিসংহ সেক্টরের বিপরীতে। ৩৩ তম কোরকে লে. জেনারেল থাপনের কমান্ডে রাজশাহী। সেক্টরের বিপরীতে ও লে. জেনারেল রায়নার নেতৃত্বে দ্বিতীয় কোরকে যশাের। সেক্টরের বিরুদ্ধে মােতায়েন করা হয়।
তুলনামূলক শক্তি যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় উভয়পক্ষের তুলনামূলক শক্তি ছিল নিম্নরূপ :
সিলেট-চট্টগ্রাম সেক্টর
পাকিস্তান ১১টি ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে ১৪ ও ৩৯ ডিভিশন। ৯১ ও ৫৩ ব্রিগেড (একটি ডিভিশন সাধারণত ৯ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে গঠিত হয়)।
ভারত ৮, ২৩ ও ৫৭ ডিভিশন, তিনটি সাঁজোয়া স্কোয়াড্রন, মুক্তিবাহিনী ব্রিগেড, মুক্তিবাহিনীর ৮টি সেক্টর ও একটি ডিশিনের শক্তিসম্পন্ন কিলােফোর্স সমন্বয়ে ৪র্থ। কোর। ভারতের ৮ম ডিভিশনে ৬টি ব্রিগেড ছিল। আবার প্রতিটি ব্রিগেডে সৈন্য ছিল। ৮ ব্যাটালিয়ন (তিনটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে সাধারণত একটি ব্রিগেড গঠিত হয়।)
ঢাকা-ময়মনসিংহ সেক্টর পাকিস্তান ৯৩ ও ৩১৪ ব্রিগেডের সমন্বয়ে ৩৬ ডিভিশন।
ভারত ১০১ কমিউনিকেশন জোন, ৯৫ স্বতন্ত্র ব্রিগেড, ৬৩ পদাতিক ব্রিগেড, একটি মুক্তিবাহিনী ব্রিগেড ও একটি প্যারাে ব্রিগেড। ১১ ডিসেম্বর এ প্যারা ব্রিগেডকে টাঙ্গাইল নামানাে হয়।
যশাের সেক্টর
পাকিস্তান দুটি ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত ৯ ডিভিশন এবং একটি স্বতন্ত্র সাজোয়া স্কোয়াড্রন (৮টি ট্যাংক)। ২৫ নভেম্বরে এ সেক্টরে আরাে ২টি ব্যাটালিয়ন পাঠানাে হয়।
ভারত ৪ ও ৯ ডিভিশনের সমন্বয়ে ২য় কোর, একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড ও দুটি সাজোয়া রেজিমেন্ট।
রাজশাহী সেক্টর
পাকিস্তান। ১৬ ডিভিশন ও ২৯ ক্যাভালরি । আইএসএফ ও ভিপি ফোর্সসহ ইপকাফ-১৮ হাজার। রাজাকার (প্রশিক্ষণবিহীন, সামান্য অস্ত্রে সজ্জিত, ৩০৩ ও ১২ বােরের রাইফেল ও বন্দুক সজ্জিত) ৬০ থেকে ৭০ হাজার।
ভারত ২০ ও ৬ মাউন্টের ডিভিশনের সমন্বয়ে ৩৩ কোর, একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড, একটি মুক্তিবাহিনী ব্রিগেড, দুটি সাজোয়া রেজিমেন্ট। (২০তম ডিভিশনে ৪টি নিয়মিত ব্রিগেড ছিল।) | পদাতিক হিসেবে মােতায়েন ৩৯টি বিএসফ এফ ব্যাটালিয়ন, কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ-২৫,০০০ হাজার। মুক্তিবাহিনী-সুপ্রশিক্ষিত ও আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ৩,৫০,০০০-এর বেশি, আরাে ৪টি ব্রিগেড ।
অন্যান্য
পাকিস্তান পাকিস্তান এয়ার ফোর্স এফ-৮৬-এর এক স্কোয়াড্রন,—৬ ডিসেম্বর অকেজো, একটি বিমানঘাঁটি, ৪টি গানবােট।
ভারত
ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স-১৭ স্কোয়াড্রন, এসইউ-৭ ও মিগ-২১; ৫টি বিমানঘাঁটি ও বিমানবাহী রণতরী বিক্রম। ভারতীয় নৌবাহী স্কোয়াড্রন এবং বিক্রম।
শক্রর কয়েকটি ডিভিশন গঠিত হয়েছিল তিন ব্রিগেডের চেয়ে বেশি সৈন্য নিয়ে এবং কয়েকটি ব্রিগেডে ছিল তিন ব্যাটালিয়নের বেশি সৈন্য। তাদের ৮ মাউন্টেন ডিভিশনে ছিল ৬টি ব্রিগেড এবং ২০ মাউন্টেন ডিভিশনে ছিল ৪টি ব্রিগেড ও মুক্তিবাহিনীর আরাে একটি ব্রিগেড। সিলেট এলাকায় একটি ব্রিগেডে ৭ ব্যাটালিয়ন। সৈন্য ছিল। শত্রুরা ১২ ডিভিশন শক্তি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা চালায়।
মেজর জেনারেল ডি. কে, পালিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে নিম্নোক্ত মন্তব্য করেছেন।
“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীসহ নিয়ােজিত সৈন্য সংখ্যা এক মিলিয়নের এক তৃতীয়াংশ ছাড়িয়ে যায় । উত্তরাঞ্চলে তিব্বত সীমান্ত মােতায়েন আরাে ১ লাখ সৈন্যও এ হিসাবের মধ্যে ছিল। সুতরাং সব মিলিয়ে ইস্টার্ন কমান্ডের আওতায় ভারতের সৈন্য ছিল প্রায় অর্ধ মিলিয়ন এ হিসাবের মধ্যে নৌ ও বিমান বাহিনীকে ধরা হয় নি।
সামরিক ইতিহাসে একজন লে. জেনারেল এত বড় বিশাল বাহিনীকে কখনাে নেতৃত্ব দেন নি অথবা এমন একটি কৌশলগত দায়িত্বের বােঝা বহন করেন নি।”
– দ্য লাইটনিং ক্যাম্পেইন, পৃষ্ঠা-১০৫
ভারতীয় ও আমাদের মধ্যে সৈন্য মােতায়েনের অনুপাত দাড়ায় দশ এক। এছাড়া, ভারতীয়রা স্থানীয় বৈরী জনগণের সমর্থনও পেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানিরা ছিল আমাদের বিরুদ্ধে এবং যুদ্ধের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কোনাে আগ্রহ ছিল না। জেনারেল মানেকশ’র মতে, পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য মােতায়েনের অনুপাত ছিল ৪ ১ (তার হিসেবের মধ্যে নৌ ও বিমান বাহিনী এবং বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি)। মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থার হিসেবে উভয়পক্ষের সৈন্য সংখ্যার অনুপাত ৬১ বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয়রা ছিল আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে। পাকিস্তান ইস্টার্ন কমান্ড পূর্ব পাকিস্তানে যে ধরনের প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মুখােমুখি হয়েছিল আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে আর কোনাে সেনাবাহিনী তেমন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয় নি। বিজয়ী হতে হলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে শক্তির অনুপাত হতে হবে ৩ : ১। কৌশলগত বিজয়ের জন্য এ ধরনের অনুপাত অপরিহার্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয়দের অপ্রতিহত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও তারা রণাঙ্গনে ক্ষুদ্র, ক্লান্ত অথচ সাহসী পাকিস্তান ইস্টার্ন গ্যারিসনকে পরাজিত করতে পারে নি। এটা শুধু অবিশ্বাস্য নয়, সামরিকভাবেও অসম্ভব।
ঈদের দিনের প্রাক্কালে পরিস্থিতি (২১ নভেম্বর) আমাদের সৈন্যরা তখন রণাঙ্গনে অবস্থান গ্রহণ করছিল এবং স্থানীয় রাজাকাররা মুক্তিবানিীকে উৎখাত করার চেষ্টা করছিল। নিয়মিত সৈন্যরা রাজাকারদের শক্তি বৃদ্ধি করছিল এবং উভয়ে ভারতীয় সৈন্যদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল। ভারতীয়। সেনাবাহিনী ভূরুঙ্গামারি, কামালপুর, আটগ্রাম, চাদপুর, বিলােনিয়া, বেনাপােল ও হিলিতে হামলা চালায়। | বিদ্রোহ দমনে নিয়ােজিত অধিকাংশ সৈন্য প্রত্যাহার করা হয় এবং রাজাকার ও মুজাহিদরা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয় । রিজার্ভ সৈন্য পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী রিজার্ভ বাহিনী পাঠানাে হয় নি। তাই আমরা নতুন করে রিজার্ভ বাহিনী গঠন করি। একটি বৈরি পরিবেশে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে আমাদের সৈন্য ও অফিসাররা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। ডিভিশনগুলােতে ট্যাংক রেজিমেন্ট ও দূরপাল্লার কামান ছিল না। এছাড়া ইউনিটের অস্ত্রশস্ত্র ও সাজসরঞ্জামের ঘাটতি ও ভারসাম্যহীনতা ছিল মারাত্মক। হেড কোয়ার্টার্স একটি ভারী ও দু’টি মাঝারি আর্টিলারি রেজিমেন্ট ও একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয় নি। দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী মােটেও সুসজ্জিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল না। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স মুক্তিবাহিনীর দখল থেকে কয়েকটি এলাকা উদ্ধার অভিযানের অগ্রগতি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিচ্ছিল। আমাদের তখনাে রাজনৈতিক মিশন ছিল যে, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সৈন্যদের বাংলাদেশের কোনাে ভূখণ্ড দখল করতে দেয়া যাবে না। তাই আমাদেরকে সীমান্তে ও অভ্যন্তরে উভয় ফ্রন্টে লড়াই করতে হয়েছে। | যে কটি ব্যাটালিয়ন পাঠানাের কথা ছিল সেগুলোর মধ্যে প্রথম ব্যাটালিয়নও ২৪ নভেম্বর পর্যন্ত পৌছতে পারে নি। ৮টি ব্যাটালিয়নের স্থলে মাত্র ২টি ব্যাটালিয়ন পাঠানাে হয়। আমাকে একথা বলা হয় নি যে, অন্যান্য ব্যাটালিয়নগুলাে পাঠানাে হবে না। এটা ছিল জেনারেল গুল হাসানের আকেরটি নিষ্ঠুর কৌতুক। শত্রু হামলা করার জন্য উদ্যত হয়। আমরা চাঁদপুরে আরেকটি এডহক ডিভিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেই এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
যুদ্ধের প্রস্তুতি
সৈন্যদের লড়াই, শত্রুদের অগ্রাভিযান বিলম্বিতকরণ, শক্রদের সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন এবং পূর্ব নির্ধারিত ঘাঁটি ও দুর্গে পিছু হটে আসার লক্ষ্য নিয়ে যুদ্ধ পরিকল্পনা কার্যকর করার নির্দেশ দেয়া হয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাংকারগুলাে না ছিল কংক্রিটের তৈরি, না ছিল এদের চারদিকে মাইন পোঁতা। শুধু তাই নয়, এগুলাে রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আর্টিলারি ফায়ারের ব্যবস্থাও ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এ ধরনের সমস্যা ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানে এ নাজুক পরিস্থিতির জন্য যেসব কারণ। দায়ী সেগুলাে হচ্ছে :
– গভর্নরের কার্য নির্বাহ ছাড়া প্রতিরক্ষা খাতে কোনাে টাকা বরাদ্দ করা হয় নি।
গভর্নরের জন্য যে ফান্ড দেয়া হতাে তাও ছিল খুব সামান্য। এ তহবিল সরবরাহও পরবর্তীতে মার্কিন আপত্তিতে বন্ধ করে দেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর অনুপ্রবেশ রােধে ইতােমধ্যেই জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের নির্দেশে অধিকাংশ মাইন ফুরিয়ে যায়। যা অবশিষ্ট ছিল তার পরিমাণও ছিল খুবই সামান্য। এসব মাইন শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে খুব একটা কাজে আসে নি। পশ্চিম পাকিস্তানের শত্রুর অগ্রাভিযান রােধে কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা রয়েছে । কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সেরকম প্রতিবন্ধকতা থাকায় শত্রু ধেয়ে আসতে থাকে। শক্রর হামলা ধ্বংস করতে আর্টিলারি অপরিহার্য। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিটি প্রতিরক্ষা অবস্থানে যেখানে কয়েক ডজন আর্টিলারি ছিল সেখানে আমাদের ছিল গড়ে মাত্র কয়েকটি। অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থাও ছিল একইরকম। আমাদেরকে পুরান এম-২৪ মডেলের হালকা ট্যাংক দেয়া হয়। এগুলাে চালানাে ছিল খুবই কঠিন। ফ্যান বেল্টের পরিবর্তে দড়ি ব্যবহার করতে হতাে। একটি ট্যাংক দিয়ে টেনে আরেকটি ট্যাংক স্টার্ট করতে হতাে। আমরা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে এ সমস্যার কথা অবহিত করেছিলাম। হাত দিয়ে কেউ শত্রুর আক্রমণ ঠেকাতে পারে না। আমাদের ট্যাংক-বিধ্বংসী কামানের ঘাটতি ছিল ৫০ শতাংশ। শত্ৰু বহরকে ঠেকিয়ে রাখার অথবা ধ্বংস করার জন্য আমাদের মাঝারি অথবা ভারি কামান ছিল না। আবার কয়েকটি মর্টার ও ট্যাংক-বিধ্বংসী কামানে নিশানা ঠিক করার যন্ত্রও ছিল না। কোনাে পর্যাপ্ত বিমান সহায়তা ছিল না। সর্বোপরি, জনগণ ছিল বিরােধী। একটি যুদ্ধ পরিচালনা ও যুদ্ধের ফলাফল নির্ভর করে পর্যাপ্ত গােয়েন্দাগিরির। ওপর। ভারতীয় সেনাবাহিনী স্থানীয় লােকজনের মাধ্যমে আমাদের সব অবস্থান এমনটি শেষ ব্যাংকারটি পর্যন্ত চিনে ফেলতাে। তাদের জুনিয়র অফিসারদেরকে আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান চিনিয়ে দেয়া হতাে। গােয়েন্দা তথ্যের জন্য ভারতীয়দের বেগ পেতে হয় নি। স্থানীয়রা সহায়তা না দিলে গােয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে ভারতীয়দের প্রচুর সময় ও রক্ত দিতে হতাে। কিন্তু তাদের কোনাে মূল্য দিতে হয় নি। তাদেরকে আমাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌছে দেয়া হতাে। সৈন্যদেরকে স্বস্তি ও বিশ্রাম ছাড়া অবিরাম আট মাস লড়াই করতে হয়েছে। সবকিছুতেই তাদের ঘাটতি ছিল। এজন্য তাদেরকে কৃচ্ছ সাধন করতে হয়েছে।
১৯৭১-এর আগস্টে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একদল সিনিয়র আর্মি চিকিৎসক আসেন। তারা সবকিছু ঘুরে দেখেন এবং অফিসার ও জওয়ানদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। সফর শেষে তারা একটি রিপাের্ট পেশ করেন। এ রিপাের্টে বলা হয় যে, সৈন্যরা যুদ্ধের চূড়ান্ত ক্লান্তিকর অবস্থায় পৌছেছে এবং তারা যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নয়। এসব সৈন্য প্রত্যাহার এবং তাদেরকে ছুটিতে পাঠানাের সুপারিশ করা হয়। সৈন্যদেরকে প্রত্যাহার অথবা ছুটিতে যেতে না দেয়ায় তাদেরকে রণাঙ্গনে থেকে। যেতে হয় এবং যুদ্ধ করতে হয়। আমি তাদের মনােবল ও দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য তাদেরকে জেহাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে একটি অভিযান শুরু করি। ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের মিশনে সফল হই এবং ১৯৭১-এর নভেম্বর নাগাদ সৈন্যরা জেহাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং আমরণ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হয়। তখন একমাত্র মন্ত্র ছিল- হয় বাচ না হয় মর।’
গােলাগুলির মাঝে যারা সময় ব্যয় করেছেন অন্তত কয়েকমাস কাটিয়েছেন। কেবল তারাই বুঝতে পারবেন যুদ্ধে অবসন্নতা বলতে কী বুঝায়। এতে মনােবল ভেঙে যায়। জন কেয়ি তার ‘দ্য ফেস অব ব্যাটল নামক বইয়ে উল্লেখ করেছেন যে, ইতিহাসে বহু খ্যাতনামা জেনারেল যুদ্ধের দখল ও চাপ সইতে না পেরে রণাঙ্গন ত্যাগ করেছেন। ওয়াটারলুতে যুদ্ধের পর ওয়েলিংটন প্রচুর কান্নাকাটি করেছিলেন। ফ্রেডারিক দ্য গ্রেট যুদ্ধকালে উদ্বেগ থেকে মুক্তি পেতে শৈল্য চিকিৎসককে তার শরীর কেটে রক্ত বের করতে দিতেন; রােমেল পেটের পীড়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন এজন্য সংকটকাল দু’বার তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে ফেরত আসতে হয়েছিল। গুদেরিয়ান রাশিয়ার বাইরে হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বিদায় নেন। মারাত্মকভাবে স্মরণশক্তি লােপ পাওয়ায় ১৯৪৫ সালে রিজওয়েকে পদত্যাগ করার পরামর্শ দেয়া হয়। | আমার ঘাটতি, প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও হাই কমান্ড আমার প্রতি বিমাতাসূলভ আচরণ করে। এতে তখন এটাই মনে হচ্ছিল যে, আমাকে কোরবানির খাসি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং আমার সৈন্যদেরকে দেখা হচ্ছে ব্যয়যােগ্য পণ্য হিসেব। একটি বিরাট শক্তিশালী শত্রুর প্রচণ্ড চাপ সত্ত্বেও আমি শেষদিন পর্যন্ত লড়াইয়ের জন্য উপযুক্ত ছিলাম এবং যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে সক্ষম ছিলাম। একইভাবে আমার কোনাে অফিসার ও জওয়ানও যুদ্ধের প্রচণ্ড চাপ ও ধাক্কায় ভেঙে পড়ে নি। উপরন্তু, তারা বাঘের মতাে লড়াই করেছে যা খুবই প্রশংসাযােগ্য। পূর্ব রণাঙ্গনে আমরা যেসব সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার মুখােমুখি হয়েছি পশ্চিম রণাঙ্গনে অনুরূপ সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতা ছিল না। আমাদের মতাে পরিস্থিতিতে কখনাে কোনাে বাহিনীকে পড়তে হয় নি। এটা মাথায় রেখে পূর্ব পাকিস্তানে আমার সৈন্যদের দক্ষতার সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের সৈন্যদের দক্ষতা তুলনা করতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একটি বৈরি জনগণের মধ্যেও পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন সৈন্যরা অত্যন্ত সাহস ও দক্ষতার সঙ্গে লড়াই করেছে। সর্বাত্মক যুদ্ধে মাত্র ১৪ দিনের লড়াইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে যে পরিমাণ ভূখণ্ড খােয়া গেছে, সেই তুলনায় ৯ মাসের একটানা বিদ্রোহ এবং ভারতের সঙ্গে ২৬ দিনের লড়াইয়ের পূর্ব রণাঙ্গনে আমাদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড খুবই সামান্য। লড়াইয়ে আমাদের এ সাফল্য সত্ত্বেও আমাদরেকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া হয়। আমরা ভারতে দু’বছর যুদ্ধবন্দি হিসেবে ছিলাম। এজন্য আমাদেরকে হাজারাে প্রশ্ন। করা হয়। অন্যদিকে, পশ্চিম রণাঙ্গনে অনূকূল পরিবেশে যুদ্ধ করে যারা সাড়ে ৫ হাজার বর্গমাইলের বেশি ভূখণ্ড হারিয়েছে তাদেরকে পদোন্নতি ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধা দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
“ভৌগােলিক কারণে ডিভিশনাল অপারেশনের ওপর জেনারেল নিয়াজির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বাধাগ্রস্ত হয়। একই কারণে ডিভিশনগুলাের মধ্যে পারস্পরিক সহায়তাদানও বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি ব্যাটালিয়নগুলাে তাদের কোম্পানিগুলাের কর্মকাণ্ডে সমন্বয় সাধন করতে পারে নি। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও বিদ্রোহের ফলে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানও ধরে রাখা দৃশ্যত অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রতিটি জায়গায় শক্রর সঙ্গে যুদ্ধরত সৈন্যরা নিজেদেরকে অরক্ষিত দেখতে পায়। তাদের পশ্চাৎডাপ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। সৈন্যরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরের সময় বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। ১৯৭১-এর নভেম্বর নাগাদ আমাদের অধিকাংশ সৈন্য জীবিত ছিল। এবং চরম বৈরি পরিবেশে তারা ৯ মাস যুদ্ধ করেছে। এ ৯ মাস তারা দিন ও রাতে রাস্তা দিয়ে চলাচল করেছে। এসময় তারা মাইন বিস্ফোরণে মুখােমুখি হয়েছে এবং যখন-তখন আক্রান্ত হয়েছে। তাদের একমাত্র রক্ষাকবচ ছিল তাদের দৃরিত পাল্টা হামলা। নভেম্বর পর্যন্ত অধিকাংশ সৈন্য পানিবদ্ধ বাংকারে কাটিয়েছে, তাদের পায়ে পচন ধরছে, তাদের গায়ের চামড়ায় ফোসকা পড়েছে, অজানা আশঙ্কায় তাদের মন ছিল ভারাক্রান্ত।
(জেনারেল শওকত রিজা, দ্য পাকিস্তান আর্মি ১৯৬৬-৭১)
আমাকে ভারতীয় আগ্রাসন মােকাবেলা করতে হয়েছে এমন একদল সৈন্য নিয়ে যারা শুধু ক্লান্ত ও অবসন্নই ছিল না, তাদের পা ফুলে গিয়েছিল, পায়ে বুট ছিল না, বুকে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও ছিল না। আমার সৈন্যদেরকে প্রয়ােজনীয় বুট ও কাপড় সরবরাহ করা হয়নি। আমরা ছিলাম প্রতিপক্ষের তুলনায় সংখ্যায় খুবই নগণ্য। ট্যাংক ও কামান ছিল আমাদের সামান্য। অন্যদিকে, ভারতীয় সৈন্যরা ছিল তরতাজা, তারা তাদের সুবিধাজনক ঘাঁটি থেকে হামলা চালাত। কখন এবং কোথায় হামলা চালানাে হবে সে সিদ্ধান্ত ছিল তাদের হাতে। আমাদের করণীয় ছিল শুধু শত্রুর আক্রমণের জন্য অপেক্ষা করা। ভারতীয়দের শক্তি বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায় বাঙালিদের সহায়তায় যারা যুদ্ধ করছিল তাদের স্বাধীনতার যুদ্ধ’।
সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)