You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুদ্ধপরিকল্পনা

যুদ্ধের শিল্পকর্মের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে বর্তমান কালে যুদ্ধ আরাে জটিল ও ধ্বংসাত্মক। আধুনিক যুদ্ধ হচ্ছে বিলম্বিত সময়ের জন্য পরপর সংযুক্ত সংগ্রাম। যুদ্ধ করাই সশস্ত্র বাহিনীর একমাত্র কাজ নয়। সেনাবাহিনী হচ্ছে বৃহত্তর লক্ষ্য অর্জনের একটি মাধ্যম। যুদ্ধ শুরু ও বন্ধের চাবিকাঠি থাকে সরকারের হাতে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলাে সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে তাদের ক্ষমতার পরিধি বিস্তৃততর করেছে। রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে বন্দুকের নল হচ্ছে সরকারের একটি অন্যতম হাতিয়ার। আমার ওপর দায়িত্ব ছিল, ‘গেরিলাদের উচ্ছেদ কর। শত্রুদেরকে প্রদেশের কোনাে ভূখণ্ড দখল করে নিতে দিও না যাতে সেটাকে তারা বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা দিতে পারে। পূর্ব পাকিস্তানকে বহিঃশত্রুর আগ্রাসন থেকে রক্ষা কর। আমাকে এ নির্দেশ দেয়া হয় মৌখিকভাবে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাকে লিখিতভাবে অভিযান পরিচালনার দিক-নির্দেশনা দেয় নি। | লে. জেনারেল টিক্কা খান ছিলেন সামরিক আইন প্রশাসক এবং আমি ছিলাম ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার। আমরা প্রত্যেকেই ছিলাম নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বাধীন। যদিও কিছু ওভার ল্যাপিং ছিল। আমার দায়িত্ব সম্পর্কে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না। তাই আমি মৌখিক নির্দেশনা সত্ত্বেও কাজে নেমে পড়ি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে গেরিলাদের উচ্ছেদ ও দ্রুত সময়ের মধ্যে সীমান্ত পুনরুদ্ধার এবং প্রাদেশিক সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করি। টিক্কা খান আমার মিটিং-এ আসতে থাকেন। আমি তাকে বিনয় ও কৌশলের সঙ্গে মিটিংয়ে যােগদান থেকে বিরত থাকতে বলি। কারণ আমাদের কাজ দেখার এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা সদর দপ্তর ছিল। তখন সরকার প্রেসিডেন্ট হাউসে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সঙ্গে ছিলেন জেনারেল ইয়াহিয়া, হামিদ, পীরজাদা, ওমর ও জেনারেল মিঠা। তারা রাষ্ট্র ও পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করছিলেন।

জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে চিফ অভ জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান ছিলেন পকিল্পনা প্রণয়নের দায়িত্বে। কিন্তু তিনি তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে জেনারেল ওসমানীর অধীনে ভারতীয় সৈন্যরা ব্যাপকভাবে মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং এতে রুশ গেরিলাবিশেষজ্ঞরা সহায়তা দিচ্ছে- একথা পুরােপুরি জানার পরও জেনারেল গুল হাসান পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা অথবা বিদ্রোহ দমনে কখনাে কোনাে অপারেশনাল নির্দেশনা দেন নি ।  আমার কাছে যে সীমিত সম্পদ ছিল তাই দিয়েই আমাকে পরিকল্পনা করতে হয়েছে। বারবার অনুরােধ সত্ত্বেও ডিভিশন ও কোরের কোনাে কামান ও ট্যাংক পাঠানাে হয় নি। আমাকে গােলাগুলি ছাড়া আর কোনাে বস্তুর সহায়তা দেয়া হয়নি। আমার সৈন্যদের পায়ে পচন ও ছত্রাক দেখা দেয়। অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ বলতে গেলে। ছিল না। এ পরিস্থিতিতে আমি আমার চিফ অভ স্টাফ ব্রিগেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীকে এমজিও লে. জেনারেল ওয়াসিউদ্দিনের কাছে পাঠাই। যিনি একজন বাঙালি ছিলেন। জেনারেল ওয়াসিউদ্দিন তাকে গালিগালাজ করেন এবং সহায়তা দিতে সরাসরি অস্বীকৃতি জানান। এরপর ব্রিগেডিয়ার বাকির সিজিএস জেনারেল গুল হাসানের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু তিনি তার অনুরােধ রক্ষা করেন নি। সুতরাং আমাদেরকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র এমনকি শার্ট, ট্রাউজার ও বুট ছাড়াই চলতে হয়। সৈন্যদেরকে খালি পায়ে ও বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ছাড়াই যুদ্ধ করতে হয়েছে।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আমার চিফ অভ স্টাফ বাকির সিদ্দিকী জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে জেনারেল হামিদের সঙ্গে দেখা করতে যান। সে সময় জেনারেল হামিদ আবারাে নির্দেশ দেন যে, বিদ্রোহীদের কোনাে ভূখণ্ড দখল করতে দেয়া যাবে না। আমি পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকে ভারতীয় সমরসজ্জার খবর পাচ্ছিলাম। আরাে শােনা। যাচ্ছিল যে, ৪টি বিগ্রেডের সমন্বয়ে মুক্তিবাহিনীকে একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী হিসেবে পুনর্গঠিত করা হয়েছে এবং জেনারেল ওসমানীর অধীনে রণাঙ্গনকে ৮টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে বৈঠককালে শত্রুর হুমকি। নিয়ে আলােচনা করা হয়। চীন সীমান্ত থেকে নতুন করে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার এবং জেনারেল রায়নার অধীনে দ্বিতীয় কোরের কলকাতার কাছে কৃষ্ণনগরে অবস্থান গ্রহণের নিশ্চিত খবর পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছিল যে, ১৯৭১ সালের অক্টোবর নাগাদ ভারত তার সমরসজ্জা সম্পন্ন করে ফেলবে। শক্রর হুমকি সম্পর্কে নিম্নোক্ত ধারণা করা হয়:

-চতুর্থ কোরের অধীনে লে. জেনারেল সগত তিনটি ডিভিশন ও মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড সিলেট, ভৈরব বাজার ও চাঁদপুরের দিকে এগিয়ে আসবে (লে. জেনারেল সগত সিং)।

-৩৩ তম কোরের নেতৃত্বাধীন (লে. জেনারেল থাপন) দু’টি ডিভিশন

এবং আরাে সৈন্য পঞ্চগড়, রংপুর ও হিলি সেক্টরে প্রবেশ করবে।

– নবগঠিত দ্বিতীয় কোরের (লে. জেনারেল রায়না) দুটি ডিভিশন কৃষ্ণনগর

থেকে যশাের-খুলনা সেক্টরে প্রবেশ করবে এবং ঢাকা দখলে এগিয়ে। আসবে।

– তুরা থেকে ময়মনসিংহের দিকে একটি ভারতীয় পদাতিক ব্রিগেড ও মুক্তিবাহিনীর আরেকটি ব্রিগেড এগিয়ে আসবে।

আমরা আরাে জানতে পারলাম যে, বিরাট গােলন্দাজ বহর এবং সেতু নির্মাণ। সামগ্রীসহ প্রায় ১৯টি ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নও মােতায়েন করা হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কারিয়ানগঞ্জ (সিলেটের বিপরীত দিকে) থেকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি আইজল পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত বরাবর সড়ক নির্মাণ করছে। ধারণা করা হচ্ছিল যে, এসব সড়ক নির্মাণ শেষ হবে অক্টোবরের মধ্যে। এসব হুমকির প্রেক্ষিতে আমাকে নতুন করে পরিকল্পনা সাজাতে হয়। মেজর জেনারেল জামশেদ ও রহিম, এয়ার কমােডর হক (যিনি ঢাকায় ছিলেন) ও আমার চিফ অভ স্টাফ বিগ্রেডিয়ার বাকির সিদ্দিকীর সঙ্গে আলােচনা করার পর কয়েকটি এডহক ফরমেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। স্থির করা হয় যে, মুজাহিদ, রাজাকার, স্কাউট ও রেঞ্জারদের সীমান্ত চৌকি (বিওপি) রক্ষায় মােতায়েন করা হবে। এছাড়া তারা যােগাযােগ ব্যবস্থাও রক্ষা করবে। নিয়মিত সৈন্যদের অধিকাংশকে আত্মরক্ষামূলক লড়াইয়ের জন্য ঘাটি ও দুর্গে মােতায়েন করা হবে। বিওপির আশপাশের প্রধান সংযােগ সড়কগুলাে নিয়মিত। সৈন্য অথবা সিএএফ রক্ষা করবে এবং নিয়মিত বাহিনীর অফিসার ও জেসিওদের নেতৃত্বে সিএএফ সীমান্তের বাদবাকি অঞ্চল রক্ষা করবে। কমান্ডাররা যুদ্ধকালে এমন কিছু পরিস্থিতির মুখােমুখি হন যা তাদের কাম্য নয়। কখনাে কখনাে তারা কঠিন পরিস্থিতির মুখােমুখি হন এবং প্রতিকূল ও চরম বৈরি পরিস্থিতিতেও তাদের পড়তে হয়। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অপ্রত্যাশিত ঘটনায়। তাদের চমৎকার পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যেতে পারে। আমার অবস্থা তখনাে ততটা খারাপ ছিল না। কিছু বিষয় আমাদের অনুকূলে ছিল এবং এগুলাে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারলে আমরা যথেষ্ট উপকৃত হতে পারতাম। ফিল্ড মার্শাল রােমেল বলেছেন, “শক্রর কোনাে পরিকল্পনাই টেকে না। কোনাে কমান্ডারের পরিকল্পনা অনুযায়ী যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে এমন এক সময় আসবে যখন তাকে দ্বন্দ্ব যােদ্ধার মতাে।

নিজের চোখ, কান ও অনুভূতির সাহায্যে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।” সীমিত সম্পদ এবং ক্ষুদ্র, ক্লান্ত ও অসজ্জিত একটি বাহিনী থাকা সত্ত্বেও আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে পালন করার বেশ কয়েকটি সুযােগ তখনাে  আমাদের সামনে খােলা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কাছে আমি ছিলাম। জিম্মি । আমার হাত-পা ছিল বাধা। আমার এ অসহায়ত্ব শত্রুর অগােচরে ছিল না। সুতরাং আমাকে আমার ঘাটতি, দুর্বলতা ও কর্মপন্থা আড়াল করার জন্য ছল-চাতুরি, কৌশল ও প্রতারণার আশ্রয় নিতে হয়। আমি কৌশলগত চাতুর্যের মাধ্যমে শক্রকে আমাদের শক্তি ও সৈন্যমােতায়েন সম্পর্কে ধাঁধায় ফেলে দেই। আমার জন্য সবচেয়ে ভালাে হতাে যদি আমি বিধ্বস্ত মুক্তিবাহিনীকে তাড়া করতে করতে ভারতে ঢুকে যেতে পারতাম এবং তাদের পুনর্গঠিত হওয়ার সুযােগ না দিতাম। কিন্তু আমি । অসহায় ছিলাম এমন একটি রাজনৈতিক মিশনের কাছে যেখানে আমার দায়িত্ব ছিল। শুধু বাংলাদেশ সরকার গঠনে মুক্তিবাহিনীকে বাধা দেয়া। ভারতে ঢুকে মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা না করার সিদ্ধান্ত ছিল একটি মারাত্মক কৌশলগত ভুল। এ ভুলের জন্য পরবর্তীতে আমাদেরকে চড়া মাশুল দিতে হয়েছে।  যুদ্ধ এগিয়ে চললে নতুন নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে। এজন্য যে সরকার যুদ্ধ। পরিচালনা করে তাকে এ পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। হাই কমান্ডের কাজ হচ্ছে লক্ষ্যের প্রকৃতি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা প্রদান করা এবং এ লক্ষ্য অর্জনে কমান্ডারের কাজে কোনােক্রমেই হস্তক্ষেপ না করা। কিন্তু হাই কমান্ড অবিচার করেছে আমার প্রতি। তারা আমাকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর করুণার ওপর ছেড়ে দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করার সুযােগ দিতে আমাকে জবাব। দেয়ার জন্য বসে থাকতে হয়। আমি ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হামলার জন্য প্রহর গুণতে থাকি। সতর্ক থাকা এবং সম্ভাব্য পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকা ছাড়া আমার করণীয় কিছু ছিল না। যুদ্ধকালে এর চেয়ে বিরক্তিকর ও পীড়াদায়ক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না।

প্রতিরক্ষার ধারণা

বিভিন্ন স্তরবিশিষ্ট একটি প্রতিরক্ষা ধারণা গ্রহণ করা হয়। এমনভাবে স্তরগুলাে বিন্যাস করা হয় যাতে একটি আরেকটিকে সহায়তা দিতে পারে। প্রতিরক্ষা ধারণায় উল্লেখ করা হয় যে, মূল বাহিনীর ওপর আক্রমণ এবং এলাকার গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশের আগে শত্রুকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে হবে এবং তাদের সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন করতে হবে। ঘাটি ও সুরক্ষিত অবস্থানের ভিত্তিতে একটি অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পরিবিশষ্ট ৭-এ এই ধারণার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হলাে।

প্রতিরক্ষার ধরন

পর্যবেক্ষণ ফাড়ি কৌশলগত ও অন্যান্যবিবেচনায় যতটুকু সম্ভব ততটুকু অগ্রবর্তী এলাকায় পর্যবেক্ষণ ফাড়ি প্রতিষ্ঠা করা হবে। চোখ-কান খােলা রেখে কাজ করা এবং প্রতিরক্ষায় শক্রর প্রথম ধাক্কা সামলানাের দায়িত্ব পালন এবং শত্রুর অগ্রাভিযানে বাধা দেয় এবং তাদেরকে সতর্ক করে দেয়াই ছিল পর্যবেক্ষণ ফাঁড়ি প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। প্রধান সংযােগ সড়কগুলােতে অবস্থিত পর্যবেক্ষণ ফাড়িগুলাে সুরক্ষিত করা হবে এবং এগুলােতে নিয়মিত সৈন্য অথবা সিএএফ মােতায়েন করতে হবে। ভূখণ্ডের অভ্যন্তরেও প্রধান প্রধান রুটে বিকল্প অবস্থান তৈরি করতে হবে।

শক্ত অবস্থান

পরবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে হবে ছােট ছােট শহর, যােগাযােগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কেন্দ্র অথবা অন্যান্য স্থান-যেমন কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে এমন সব জায়গা, যে কোনাে রাস্তা প্রভৃতিতে। এগুলাে হবে প্রতিরক্ষার মূল স্তম্ভ এবং এখানে শত্রুর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে এবং তাদের সর্বোচ্চ শক্তি ক্ষয় করতে হবে। এ প্রতিরক্ষা লাইন হতে হবে সুরক্ষিত এবং গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রের মজুদ থাকতে হবে।

দুর্গ

এ পরিকল্পনার পরবর্তী ধাপে ছিল ধারাবাহিক দুর্গ গঠন। দুর্গগুলাে হতে হবে বড় বড় শহর ও প্রধান প্রধান যােগাযােগ কেন্দ্রে। এ প্রতিরক্ষা ব্যুহ হতে হবে দুর্ভেদ্য এবং অবস্থানগুলাে হতে সুরক্ষিত এবং এগুলােতে অস্ত্রশস্ত্রের প্রচুর মজুদ থাকতে হবে। সৈন্যদেরকে সেখানে জীবিত অথবা মৃত অবস্থান করতে হবে।

প্রতিরক্ষা পরিচালনা

প্রতিরক্ষা পরিকল্পনায় একটি অগ্রবর্তী ব্যুহ গঠনের বিষয় বিবেচনা করা হয়। পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয় যে, সৈন্যদেরকে পর্যায়ক্রমে সীমান্ত থেকে দুর্গগুলােতে প্রত্যাহার করা হবে এবং দুর্গগুলােতেই হবে চূড়ান্ত লড়াই। এখানে শত্রুকে থামিয়ে রাখতে হবে যাতে ওয়েস্টার্ন গ্যারিসন তাদের মিশন অর্জনে পর্যাপ্ত সময় পায়। ‘পূর্ব। রণাঙ্গনের যুদ্ধ করা হবে পশ্চিম রণাঙ্গনে এটাই ছিল প্রতিরক্ষার মূল নীতি। পশ্চিম রণাঙ্গনে যুদ্ধের ফলাফলের ওপর শুধু ইস্টার্ন গ্যারিসন ও পূর্ব পাকিস্তান নয়; গােটা পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ভরশীল ছিল। এ যুদ্ধ করার কথা ছিল জেনারেল টিক্কা খানের নেতৃত্বাধীন রিজার্ভ বাহিনীর। | আমার শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য মুজাহিদ ও সিএএফ-এর সমন্বয়ে ইউনিটগুলােকে পুনর্গঠন করা হয়। অগ্রবর্তী পদাতিক বাহিনীর উভয় পার্শ্ব ও পেছন দিক রক্ষায় ইঞ্জিনিয়ারিং বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। একইভাবে, পদাতিক বাহিনীকে সহায়তা দানে গােলন্দাজ বাহিনী মােতায়েন করা হয়।

মাইন ও তাদের ঘাটতি থাকায় পুঞ্জি (বাশের তীক্ষ্ণ শলা) পোঁতা হয়। বিশাল এলাকায় পুজি পোঁতা হয়। শক্রর ট্যাংক ও যানবাহন চলাচল ব্যাহত করার জন্য কৃত্রিম বন্যা ঘটানাে হয় ব্যাপক এলাকায়।

পরিকল্পনা সংশােধন

নিম্নলিখিত উপায়ে পরিকল্পনা পুনর্গঠন করা হয় এবং ১৯৭১ সালের অক্টোবর নাগাদ তা সম্পন্ন হয়। | ইতােপূর্বে ঢাকায় অবস্থানরত ১৪ ডিভিশনকে ময়মনসিংহ-সিলেট-চট্টগ্রাম সেক্টরের দায়িত্বে দেয়া হয়। ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা গঙ্গা নদীর পূর্ব দিকের অঞ্চল নিয়ে এ সেক্টর গঠন করা হয়। এ সেক্টরকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা হয়।

(১) ১৪ ডিভিশন (১০ ব্যাটালিয়ন) কে মেঘনা নদীর গােটা পূর্বাঞ্চলের

দায়িত্ব দেয়া হয়।

(২)  বিগ্রেডিয়ার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে সিলেট এলাকায় মােতায়েনকৃত একটি ব্যাটালিয়ন ও সিএএফ-এর সমন্বয়ে একটি নয়া এডহক ২০২তম ব্রিগেড গঠন করা হয়। ব্রিগেডিয়ার রানার নেতৃত্বে ৩১৩ তম ব্রিগেডকে মৌলভীবাজার অঞ্চলের দায়িত্ব দেয়া হয়।

(৩)  ইতােপূর্বে ময়মনসিংহে মােতায়েনকৃত ২৭তম ব্রিগেড (ব্রিগেডিয়ার সাদুল্লাহ) এক্স-ময়মনসিংহ (দুটি ব্যাটালিয়ন) কে আখাউড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া রক্ষায় মােতায়েন করা হয়।

(৪) ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর হােসেন আরিফের নেতৃত্বে ১৭তম ব্রিগেডকে কুমিল্লা ময়মনামতি এলাকায় মােতায়েন করা হয়। ১৬ ডিভিশন এ ডিভিশনের ১০টি ব্যাটালিয়নে কোনাে পরিবর্তন আনা হয়। নি। ১৬ ডিভিশনের এলাকা ছিল রংপুর-বগুড়া-রাজশাহী সেক্টর।

৯ ডিভিশন এক ব্রিগেড কম (৭ ব্যাটালিয়ন) : যশোের-কুষ্টিয়া-ফরিদপুর সেক্টর। খুলনা সেক্টরের জন্য উপকাফ-এর সমন্বয়ে কর্নেল ফজল হামিদের নেতৃত্বে একটি নয়া এডহক ৩১৪ তম ব্রিগেড গঠন করা হয়।  একটি ব্যাটালিয়ন, দুটি কোম্পানি, স্থানীয় গ্যারিসনের সৈন্য ও নৌ সেনাদের সম্বনয়ে চট্টগ্রামে বিগ্রেডিয়ার আতা মালিকের নেতৃত্বে একটি নয়া এডহক ৯১তম স্বতন্ত্র ব্রিগেড় সৃষ্টি করা হয়। | ব্রিগেডিয়ার আসলাম নিয়াজীর নেতৃত্বে ৫৩ তম ব্রিগেডকে ঢাকা রক্ষায় মােতায়েন করা হয়। ইপকাফ-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জামশেদের নেতৃত্বে একটি নতুন এডহক ৩৬ তম ব্রিগেডকেও ঢাকা রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। বিগ্রেডিয়ার কাদির নিয়াজির নেতৃত্বে ৯৩ তম ব্রিগেডকে ময়মনসিংহ রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। দুটি ব্যাটালিয়ন ও সিএএফ-এর সমন্বয়ে এই নতুন এডহক ব্রিগেড গঠন করা হয়।  মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বে ৩৯তম এডহক ডিভিশনকে চাঁদপুর রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ ডিভিশন মাত্র ৫৩তম ব্রিগেড নিয়ে গঠিত হয়।

জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এ ডিভিশনকে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন হিসেবে গঠনে প্রয়ােজনীয় সৈন্য পাঠানাের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তারা এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। প্রতিটি ব্রিগেডের সঙ্গে একটি ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট থাকার কথা ছিল। কিন্তু আমরা ঘাটতির কারণে কোনাে ব্রিগেডে ফিল্ড আর্টিলারি পাঠাতে পারি নি। নির্দিষ্ট এলাকার পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আনুপাতিক হারে আর্টিলারি বণ্টন করা হয়।

এডহক ফরমেশন প্রকৃত ফরমেশনের মতাে ছিল না। এডহক ফরমেশনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্টাফ, অফিসার ও যানবাহনের অভাব ছিল। কমান্ড হেড কোয়ার্টার্স এবং বিভাগীয় হেডকোয়ার্টার্স ও কমিউনিকেশন লাইনে বিদ্যমান সম্পদ অনুযায়ী যােগাযােগ সরঞ্জাম বিতরণ করা হয়। কমান্ড ও কন্ট্রোলের জন্য এগুলাে যথেষ্ট ভালাে ছিল। সৈন্যরা তাদের এলাকায় অফিসারদের পরিদর্শনে যেতে দেখতে পেত। যুদ্ধকালে সৈন্যদের মনােবল বৃদ্ধিতে অফিসারদের এ ধরনের পরিদর্শন খুবই সহায়ক বলে বিবেচিত হয়। সৈন্যদের গতিবিধিতে আমাদের শক্তি ও সামর্থ্য সম্পর্কে শত্রুদের মনে ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়।  ১৯৭১ সালের মার্চে প্রণীত আমাদের অপারেশন পরিকল্পনায় যেসব বিষয়ের উপর জোর দেয়া হয় সেগুলাে হলাে: অগ্রবর্তী আত্মরক্ষামূলক অবস্থান এবং শত্রুদের সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধন; একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত শত্রুকে আটকে রেখে নির্দিষ্ট দুর্গ ও সুরক্ষিত অবস্থানে পিছু হটে আসা; দুর্গগুলাের অবস্থা খারাপ হয়ে পড়লে সৈন্যদেরকে ঢাকা অভিমুখী সকল রাস্তা বন্ধ করার জন্য চূড়ান্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহে পিছু হটে আসতে হবে। ময়মনসিংহ থেকে চতুর্দশ ডিভিশন ও ৯৩ তম এডহক ব্রিগেড এবং খুলনা থেকে ৩১৪ (ক) ব্রিগেডকে ঢাকা এলাকায় পিছু হটতে হবে। | গােয়েন্দা তথ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন সত্ত্বেও জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স আমাকে কোনাে লিখিত দিকনির্দেশনা দেয় নি। বৈরি পরিস্থিতি এবং ভারতীয় আগ্রসন ও বিদ্রোহ মােকাবেলায় সম্পদের ঘাটতি থাকায় আমাকে আমার পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হয়। দেশের ভেতরে দুর্গ ও সুরক্ষিত অবস্থানের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। দুর্গ ও সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলাে শক্রর অবাধ চলাচলে বাধা দেবে, তাদেরকে আত্মরক্ষামূলক লড়াইয়ে ব্যস্ত রাখবে এবং এভাবে তাদের ক্ষতিসাধন করবে।  পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী (ইফকাফ) বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ায় স্থানীয় রাজাকারদের (সাবেক বিহারি ও অনুগত পূর্ব পাকিস্তানি) সীমান্ত চৌকি প্রহরায় নিয়ােজিত করা হয় এবং তারা নিয়মিত সেনাবাহিনীর প্রহরাধীন দুর্গ ও সুরক্ষিত ঘাঁটিতে পিছু হটে আসে। রাজাকারদের অফিসার ছিল নিয়মিত সেনাবাহিনীর। তারা খুব প্রশংশনীয় ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গেও প্রচণ্ড লড়াই। করেছে তারা।

আমি জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স থেকে একটি গােয়েন্দা রিপাের্ট পাই। রিপাের্টে বলা হয় যে, আগ্রাসী মনােভাব সত্ত্বেও ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। তবে সে বিদ্রোহীদের সমর্থন দান এবং কিছু ভূখণ্ড দখলে নেয়ার লক্ষে সীমিত পর্যায়ে হামলা চালাতে পারে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার জন্য সুপারিশ করা হয়। আমরা স্থানীয়ভাবে গঠিত বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী মােতায়েনের মাধ্যমে সীমান্ত বন্ধ করে দিতে সক্ষম হই।  ঢাকা ছিল মেরুদণ্ড। নদী ও খাল-বিল এবং প্রধান-প্রধান যােগাযােগ কেন্দ্রের ভিত্তিতে ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়। যােগাযােগ কেন্দ্রগুলােতে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তােলা হয় যাতে ঢাকা অভিমুখী শত্রুর যে কোনাে অগ্রাভিযান ব্যাহত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রু নদী পারাপারে হেলিকপ্টারে সৈন্য পরিবহন অথবা ছত্রী সেনা নামানাের চেষ্টা করতে পারে। দুর্ভাগ্যক্রমে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স ও আইএসআই ভারতের হেলিকপ্টারে সৈন্য পরিবহনের সম্ভাবনা অথবা সামার্থ্য সম্পর্কে আমাদেরকে কখনাে অবহিত করে নি।

ফরমেশন কমান্ডারদের বৈঠকে ঢাকা প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে আলােচনা করা হয় এবং তা চূড়ান্ত করা হয় । আমি এ বৈঠকে আমার সেকেন্ড ম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী মেজর জেনারেল জামশেদ এবং সহায়ক বাহিনীর কমান্ডারদের নিয়ে যােগদান করি। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে চিফ অভ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ আমাদেরকে দেখতে আসেন। পরিকল্পনায় এসব পরিবর্তন সম্পর্কে তাকে অবহিত করা হয়। একই মাসে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স অর্ডার অব ব্যাটল’ ইস্যু করে। এতে পরিবর্তনগুলাে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিরাজিত পরিস্থিতির আলােকে আমার পরিকল্পনা কার্যকর ও অত্যন্ত বাস্তবসম্মত বলে প্রমাণিত হয়। এ পরিকল্পনা বিভিন্ন মিশন বিশেষ করে রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রণয়ন করা হয়। রাজনৈতিক দিক নির্দেশনা ছিল সকল বিবেচনার উর্ধ্বে এবং আমার পক্ষে তা অগ্রাহ্য করা সম্ভব ছিল । আমি ছিলাম পাকিস্তানের সার্বিক পরিকল্পনার কেবলমাত্র একটি অংশ বাস্তবায়নের দায়িত্বে। পক্ষান্তরে পুরাে বিষয় কৌশলগত পর্যায় থেকে দেখার দায়িত্ব ছিল হাই কমান্ডের। তাদের উচিত ছিল গােটা পরিস্থিতির জটিলতা অনুধাবন করা এবং ইন্সিত লক্ষ্য অর্জনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। সার্বিক পরিকল্পনা থেকে যে কোনাে বিচ্যুতি যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন অসংখ্য ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে এবং গােটা পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে মােতায়েন একজন কমান্ডারের তার ওপর অর্পিত মিশন সফল করে তুলতে নিজস্ব উদ্যোগ গ্রহণের স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু আমার ওপর অর্পিত মিশন বাস্তবায়নে এমন স্বাধীনতা আমাকে দেয়া হয় নি। 

প্রতারণা

প্রতারণা হচ্ছে এমন এক জিনিস যা শত্রু প্রত্যাশা করে না এবং যার জন্য সে প্রস্তুত নয়। এটা শত্রুকে চমকে দেবে এবং নৈতিকভাবে তাকে দুর্বল করে তুলবে। প্রতারণা থেকে সৃষ্টি হয় চমকের। চমক হচ্ছে এমন এক লবণ যা যুদ্ধের স্বাদ বাড়িয়ে দেয়। এটা হচ্ছে যুদ্ধের নীতি। একজন কমান্ডার সর্বদাই তার অভিপ্রায় সম্পর্কে শত্রুকে বিভ্রান্ত করেন। বিশেষ করে যেখানে সৈন্যবল কম এবং শক্রর অস্ত্র, সাজ-সরঞ্জাম ও সম্পদের ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা বিদ্যমান সেখানে একজন কমান্ডারকে তার ঘাটতি আড়াল করার জন্য ফাঁদ পাততে ও ধাপ্পা দিতে হয় এবং কৃত্রিম তৎপরতা ও ছলাকলার আশ্রয় নিতে হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, প্ররােচণামূলক তৎপরতায় প্রতিপক্ষের কমান্ডার বিভ্রান্ত হবেন।তার মতামত প্রভাবিত হবে এবং তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে আমরা শত্রুকে ধােকা দিতে হিমশিম খেয়েছি। কারণ আমাদের গােয়েন্দা ব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছিল। ক্ষুদ্র একটি সৈন্যদল হিসেবে আমাদের সৈন্য ও সমরাস্ত্রের ঘাটতি পূরণে আমাদেরকে উন্নত প্রশিক্ষণ, দক্ষ নেতৃত্ব, কঠোর শৃঙ্খলা, সাহস ও বিভিন্ন অপ্রচলিত ধারণার ওপর ভরসা করতে হয়েছে। তহবিল ও সাজ-সরঞ্জামের অভাব কাটিয়ে উঠতে আমাদেরকে ব্যাপকভাবে কৃচ্ছতা সাধন করতে হয়েছে এবং একইসময়ে আমাদের শক্তি সম্পর্কে শত্রুকে ধােকা দিতে হয়েছে। শত্রুকে ধােকা দেয়ার জন্য স্থানীয় বাঙালিদের সহযােগিতা অপরিহার্য ছিল। সৌভাগ্যবশত আমি কয়েকজন গণ্যমান্য। ব্যক্তি এবং আমার কয়েকজন পুরনাে সহকর্মী পেয়ে যাই। তারা পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে চেয়েছিলেন এবং আমাকে এ কঠিন দায়িত্ব পালনে সহযােগিতা করতে সম্মত হন। শত্রুকে ধােকা দেয়ার জন্য আমি কোথাও সৈন্যদের পরিদর্শন করতে গেলে ঢাকায় অবস্থানরত পূর্ব পাকিস্তান বেসামরিক বাহিনী (ইপকাফ)-এর কমান্ডার মেজর জেনারেল জামশেদকে সঙ্গে নিয়ে যেতাম। প্রত্যেকেই জেনারেল জামশেদকে চতুর্থ ডিভিশনের ডিভিশনাল কমান্ডার হিসেবে ধারণা করত। 

আমার অফিসে টেবিলের ওপর পুরু কাপড়ে মােড়া চারটি পতাকা ছিল। এসব ছােট পতাকার বাঁশের দণ্ড বেরিয়ে থাকত এবং গণনা করা যেত। একইভাবে আমার অফিসে মােটা কাপড়ে আবৃত মানচিত্র ছিল।এসব মানচিত্রে সেনাবাহিনীর চারটি ডিভিশনের সীমারেখাও দেখা যেত। যেসব বাঙালি অফিসার ও বেসামরিক লােজন আমাদের সহায়তা করত তাদেরকে দেখানাের জন্যই এমন করা হতাে। এতে তারা নিশ্চিত হতাে যে, পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের চারটি ডিভিশন রয়েছে। এভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪টি ডিভিশনের শক্তি হিসাবের মধ্যে রেখে আসান চালায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকজন সিনিয়র কমান্ডারের স্বীকারােক্তি থেকে আমাদের প্রতারণাপূর্ণ পরিকল্পনার কার্যকারিতা প্রমাণ। পাওয়া গেছে। যুদ্ধ বিরতির পর তাদের সঙ্গে আলাপ হয় আমার। তখন তারা আমাদের পরিকল্পনার সাফল্য স্বীকার করেন। মেজর জেনারেল সুখবন্ত সিং তার  

‘দ্য লিবারেশন অভ বাংলাদেশ’ নামক পুস্তকে পাকিস্তান ইন্টার্ন গ্যারিসনের শক্তি ৪ ডিভিশন বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, ভারতীয় গােয়েন্দারা আমাদের শক্তি সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়েছিল। তারা ধারণা করেছিল যে, ঢাকাতেই পুরাে এক ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ঢাকায় ছিল মাত্র একটি ব্রিগেড। মেজর জেনারেল জামশেদের নেতৃত্বে এ ব্রিগেড গঠন করা হয়। ৩৬ তম এ এডহক ব্রিগেডে ছিল দুটি ব্যাটালিয়ন। ভারতীয়রা ভেবেছিল যে, ঢাকায় একটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন রয়েছে। তাই তারা ঢাকা অভিমুখী উত্তরাঞ্চলে সকল রুট বিপদমুক্ত দেখেও দ্রুত রাজধানীতে পৌছানাের চেষ্টা অথবা আগ্রহ দেখায় নি।

ব্রিগেডিয়ার শাহ বেগ (পরে মেজর জেনারেল) যুদ্ধকালে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পর তিনি একদিন আমার কাছে আসেন এবং নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি তার সন্দেহ নিরসনের জন্য জানতে চান, পূর্ব পাকিস্তানে আমার সৈন্য সংখ্যা কত ছিল। আপনাদের সেখানে কত ডিভিশন সৈন্য ছিল, স্যার,’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। আমি জবাব দিলাম, “তিন ডিভিশন।’ ‘আপনাদের কি ৪ডিভিশন সৈন্য ছিল না? জেনারেল জামশেদের কি দায়িত্ব ছিল?’- বিস্ময়ে তিনি জানতে চাইলেন। আমি তাকে জানালাম যে, জেনারেল জামশেদ ছিলেন ইপকাফের কমান্ডার এবং তিনি আমার সেকেন্ড-ইনকমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করতেন। ইপকাফ কি কোনাে ব্রিগেডিয়ারের কমান্ডে ছিল না?’ তিনি জানতে চাইলেন। আমি বললাম, আপনি ঠিক বলেছেন, ইপকাফের নেতৃত্বে একজন ব্রিগেডিয়ারই ছিলেন। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার নিসার ইপকাফ থেকে বদলি হলে আমি জেনারেল জামশেদকে তার স্থলাভিষিক্ত করি। জেনারেল জামশেদ আমাদের চতুর্থ ডিভিশন কমান্ড করতেন। এটি ছিল একটি এডহক ডিভিশন এবং সৈন্য ছিল মাত্র দুই দুই ব্যাটালিয়ন।’ আমার কথা শুনে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে যান। তাই আমি অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই এবং বলি, আমি ভেবেছিলাম আপনি একজন শিখ।’ হ্যাঁ, আপনি ঠিকই ধরেছেন আমি একজন শিখ। কিন্তু আপনাদের শক্তি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য ঢাকা আসার আগে আমাকে চুল ও দাড়ি কেটে ফেলতে হয়। বাঙালিরা আমাকে ঢাকা নিয়ে আসে। তখন আমার পরনে ছিল। বাঙালিদের মতাে পােশাক। আমি দুদিন অবস্থান করি এবং রিক্সায় ঘুরে বেড়াই। তবে আমি ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় প্রবেশ করি নি। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কী দেখতে পেলেন?’ তিনি বললেন, ব্যাপক সামরিক তৎপরতা দেখে আমার মনে হচ্ছিল যে, ঢাকা সৈন্যে বােঝাই। বাঙালিরা আমার সঙ্গে বেরুতে চাইত । তারা ক্যান্টনমেন্ট অথবা সামরিক অবস্থানে ঢুকতে ভয় পেত।

এজন্য আমি ঢাকায় সৈন্যদের সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা করতে পারি নি।’ আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কবে ঢাকা গিয়েছিলেন? তিনি বললেন, ‘১৯৭১ সালের নভেম্বরের ব্রিগেডিয়ার ক্লার (পরে মেজর জেনারেল) ময়মনসিংহ সেক্টরে একটি ভারতীয় বিগ্রেডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের কয়েকদিন পর তিনি আমার কাছে এসেছিলেন এবং ব্রিগেডিয়ার শাহ বেগ যে ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন তিনিও একই ধরনের প্রশ্ন করেন। আমি বললাম, আমি জানতে চাই, আপনাদের পর্যাপ্ত সৈন্য ও সম্পদ, বিমান বাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব, প্রচুর ট্যাংক ও সাজোয়া যান ছিল এবং আপনারা মুক্তিবাহিনী ও স্থানীয় জনগণের সমর্থনও পেয়েছিলেন। এক কথায় আপনাদের কোনাে ঘাটতি ছিল না বরং সবকিছুতেই ছিল প্রাচুর্য। আপনারা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কমপক্ষে অর্ধেক সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে মােতায়েন করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনারা কোনাে দিক থেকে ঢাকা এগিয়ে গেলেন না কেন? ঢাকা। অভিমুখী সকল রুট বিশেষ করে উত্তরর দিক থেকে আগত রাস্তা শুরু থেকেই ছিল বিপদমুক্ত। আপনারা সিলেট ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে আমার সৈন্যদের পেছনে সৈন্য নামিয়েছিলেন। এরপর টাঙ্গাইলে আপনাদের প্যারা ব্রিগেড অবতরণ করে। ঢাকা সেক্টরে দুটি জায়গায় হেলিকপ্টারে করে আপনারা মেঘনা নদীর এপারে সৈন্য নামিয়েছিলেন। কিন্তু আপনারা তাৎপর্যপূর্ণ কোনাে সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। আপনারা ব্রিগেডিয়ার কাদিরের ব্রিগেডকে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা এবং সাদউল্লাহর ব্রিগেডকে আশুগঞ্জ থেকে ভৈরব প্রত্যাহারে বাধা দিতে পারেন নি। আপনারা কাউকে বন্দি অথবা কোনাে এলাকায় কোনাে সিদ্ধান্ত আঁকড়ে ধরতে পারেন নি। আপনাদের সম্পদের তুলনায় আপনাদের সাফল্য খুবই নগণ্য। সবকিছু আপনাদের অনুকূলে থাকা সত্ত্বেও সীমান্তের কাছে সমগ্র ফ্রন্টে আপনারা বিপাকে পড়ে যান এবং আপনারা সেখানে তিন সপ্তাহ অবস্থান করেন। ঢাকা সেক্টরে পরিস্থিতি এমন গুলিয়ে যায় যে, আপনাদের সেনা কমান্ডারকে একটি দীর্ঘস্থায়ী বিভ্রান্তিকর অবস্থায় পড়তে হয়। আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়া না হলে মার্কিনীরা ভিয়েতনামে এবং ফ্রান্স আলেজরিয়ায় যে পরিণতি ভােগ করেছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীকেও পূর্ব পাকিস্তানে অনুরূপ পরিণতি ভােগ করতে হতাে।

ক্লার বললেন, ‘আপনাকে সত্য বলতে কি, আমাদের সিনিয়র অফিসাররা ছিলেন খুবই সতর্ক কারণ আমরা ১৯৭১ সালের জুলাই থেকেই আপনার সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করছিলাম। পাকিস্তানি সৈন্যরা যে যুদ্ধ করেছে তাতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা শুধু সাহসী নয় বরং শক্তিশালী এবং তারা তাদের পেশায় সুনিপুণ এবং লড়াই করার যােগ্যতা তাদের ছিল। তারা বরবারই তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অগ্রাভিযানে আমাদেরকে চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতিই হচ্ছে আমাদের সতর্ক অগ্রাভিযানের মূল কারণ। ঢাকা সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল যে, এখানে লড়াই হবে কঠিন। ঢাকাকে বলা হতাে বাঘের গর্ত। কামালপুর ও জামালপুর আক্রমণে আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল। এ দুটি স্থানে আপনার সৈন্যরা তাদের অবস্থান ধরে রাখার তীব্র লড়াই করেছে এবং আমাদেরকে ঢাকা অভিযানে বাধা দিয়েছে। ঢাকা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের স্নায়ুকেন্দ্র। এছাড়া ঢাকায় ছিল আপনার সদর দপ্তর। তাহলে আমরা কিভাবে ভাবতে পারি যে, সেখানে লড়াই করা সহজ হবে? একই সময়ে আমাদের মনে এই ধারণাও ছিল যে, ঢাকা সেক্টরে একটি পূর্ণাঙ্গ ডিভিশন রয়েছে এবং ঢাকার প্রতিরক্ষায় এ ডিভিশনের সৈন্যদের মােতায়েন করা হয়েছে। আপনার সম্পর্কে আমাদের সকল অফিসারদের একটি উঁচু ধারণা ছিল। তারা আপনাকে একজন ফাইটিং জেনারেল হিসেবে মনে করতেন। ঢাকার প্রতিরক্ষা। আপনার ব্যক্তিগত কমান্ডের আওতায় থাকায় তারা যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়া আপনার প্রতিরক্ষা লাইনে হামলা করতে চান নি।

ভারতের চতুর্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিংও এ সত্য স্বীকার করেছেন, তবে ভিন্নভাবে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘ঢাকা দুর্গে আপনাদের কি পরিমাণ শক্তি ছিল। আমি তাকে বললাম যে, আমার ৩০ হাজার সৈন্যমােতায়েন ছিল এবং আরাে কিছু মােতায়েন করার প্রক্রিয়া চলছিল। এছাড়া, আমার আরাে ২ হাজার যােদ্ধা ছিল। এরা ছিল অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও পুলিশ বাহিনীর লােক। এদেরকে আমরা নিয়মিত সৈন্যদের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলি। বহু পশ্চিম পাকিস্তানি ও বেসামরিক বিহারিও আমাদের সঙ্গে যােগদান করেছিল। আমরা শেষ পর্যন্ত লড়াই। করার জন্য শপথ নিয়েছিলাম। ভৈরব বাজারে মােতায়েন ব্রিগেড এবং নারায়ণগঞ্জে মােতায়েন ৩৬ এডহক ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার্সে অবস্থানরত সৈন্যদেরকে এ হিসাবের মধ্যে ধরা হয় নি। প্রতিটি অফিসারের একজন করে ব্যাটম্যান ছিল এবং এই এলাকায় বহু অফিসার ছিলেন। ( মােটের ওপর, ঢাকা ছিল সৈন্যে পরিপূর্ণ। অফিসারদের মধ্যে ছিলেন তিনজন। মেজর জেনারেল, একজন এয়ার কমােডর, দু’জন পুলিশের আইজি, আট জন ব্রিগেডিয়ার, কয়েকজন কর্নেল ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল। বস্তুতপক্ষে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে একই সময়ে তিনটি দুর্গ যথা- ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ভৈরব বাজারের মােকাবিলা করতে হতাে। এতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর গােটা চতুর্থ কোরের প্রয়ােজন হতাে। নারায়ণগঞ্জের অবস্থান এবং আমাদের পার্শ্বভূমির প্রতিবন্ধকতার কারণে ঢাকা পৌঁছান অথবা অবরােধ করা যেত না। ভারতীয়রা একমাত্র উত্তর দিক থেকে ঢাকায় হামলা করতে পারত। সেক্ষেত্রেও ভৈরব সেতু ছিল তাদের পেছনে। এখানে ভারতীয় সেনাবাহিনী ফাঁদে পড়ে যেত। তারা উভয় সংকটে পড়তাে। হাজার হাজার লােককে অন্ত্রসজ্জিত করার জন্য আমার কাছে তখনাে প্রচুর অস্ত্র। ছিল। 

জেনারেল সগত সিং বললেন, ‘আমি জানতাম যে, ঢাকা ছিল ভালােভাবে সুরক্ষিত এবং ময়মনসিংহ ব্রিগেডের ঢাকা, আশুগঞ্জ ব্রিগেডের ভৈরব বাজার ও ৩৯তম ডিভিশনের সদরদপ্তর ও এ ডিভিশনের কিছু সৈন্য নারায়ণগঞ্জে স্থানান্তরিত হওয়ায় ঢাকা দুর্গের শক্তি বৃদ্ধি পায়। এতে আপনার সৈন্য চলাচলও বৃদ্ধি পায়। পরিস্থিতির প্রকৃতি না জানায় মেঘনা নদীর এপারে হেলিকপ্টার থেকে সৈন্য নামানাে সত্ত্বেও আমাদের তৎপরতা ছিল মূলত উত্তরাঞ্চলীয় অংশে সীমাবদ্ধ। জেনারেল অরােরা ঢাকা দখলে অত্যন্ত আগ্রহী ছিলেন। আমি তাকে বললাম যে ঢাকা দখলের আগে আমাদের যথাযথভাবে রেকি চালাতে হবে। এজন্য আমাদের আকাশ পথে ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ছবি তােলার প্রয়ােজন। ঢাকা আক্রমণে যথাযথ পরিকল্পনা ও বিশাল বাহিনীর প্রয়ােজন হবে। শত্রুর মুখােমুখি হওয়ার আগে প্রচও গােলাবর্ষণের মাধ্যমে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুই দুর্বল করে দিতে হবে। গােলাবর্ষণের জন্য আমাদের মাঝারি ও ভারি কামান এবং বিমান থেকে বােমাবর্ষণের প্রয়ােজন হবে। মাঝারি ও ভারি কামান ও ট্যাংক ছাড়া তড়িঘড়ি করে এগিয়ে যাওয়া হবে আমাদের জন্য আত্মঘাতী। সুতরাং আমি প্রস্তুতি ও আমার সৈন্য সমাবেশের জন্য সাত দিন সময় চাই। আগরতলায় আমার হেলিকপ্টার ছিল। কিন্তু ভৈরব বাজারের অবস্থানের কারণে আমাদেরকে সেখান থেকে দূরে সৈন্য নামাতে হয়। ভৈরব বাজার আপনার নিয়ন্ত্রণে থাকায় আমরা ট্যাংক ও কামান আনতে পারি নি। সাত দিনের মধ্যে ঢাকায় আঘাত হানার জন্য প্রয়ােজনীয় রসদ এসে পৌছবে কিনা সে ব্যাপারেও আমার সন্দেহ ছিল। ভৈরব বাজার ও নারায়ণগঞ্জের অবস্থান আমাদের অভিযানকে অধিক কঠিন করে তােলে।  উর্ধ্বতন ভারতীয় অফিসারদের আলাপ-আলােচনা থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে | যে, আমাদের শক্তি সম্পর্কে ধোকা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য আমাদের পাতা ফাঁদ ছিল যথার্থ।

তারা ভেবেছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে আমার তিনটি নয়; চার ডিভিশন সৈন্য রয়েছে। তারা বিশ্বাস করত যে, প্রতিটি বিভাগে অন্তত একটি করে ডিভিশন মােতায়েন রয়েছে। সুতরাং তারা আমার চার ডিভিশন সৈন্যের ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করে। এ পরিমাণ সৈন্য আছে ভেবেই তারা শুরুতে ঢাকা দখলের উদ্যোগ নেয় নি। তবে তারা আমার প্রকৃত ক্ষমতা জানতে পারলে তাই করতাে। একই কারণ কুষ্টিয়ায় প্রচুর সৈন্য হতাহত হওয়ায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ফরিদপুরে এগিয়ে আসে নি। আমাদের এসব প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা কয়েকজন ভারতীয় জেনারেল বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় সৈন্যের কমান্ডার জেনারেল অরােরার জন্য মারাত্মক বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ সকল সুবিধা, অনুকূল পরিস্থিতি ও পর্যাপ্ত স্থানীয় সহায়তা সত্ত্বেও তিন হাজার মাইলব্যাপী সীমান্তে ন’ মাসে তিনি কিছুই অর্জন করতে পারেননি। | যুদ্ধের ইতিহাসে জেনারেল অরােরা যতটুকু সুবিধা ও অনুকূল পরিবেশে যুদ্ধ।

করেছেন তা সত্যি এক বিরল ঘটনা। প্রতিপক্ষের তুলনায় প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সুবিধা ছিল অন্তত দশ গুণ বেশি। আমাদের জঙ্গীবিমান, বিমান বিধ্বংসী কামান, দূরপাল্লার আর্টিলারি ও ট্যাংকের ঘাটতি ছিল বিরাট। পক্ষান্তরে, জেনারেল অরােরার কোথাও কোনাে ঘাটতি ছিল না। বিমান শক্তিতে শ্রেষ্ঠত্বের কারণে তিনি বিমানের ছত্রছায়া, বিমানে করে সৈন্য পরিবহন, নদী পারাপারে বিমান সুবিধা ও আকাশ পথে অব্যাহত সরবরাহ সুবিধা ভােগ করেন। সমুদ্র ও নদীতে ছিল তার অবাধ কর্তৃত্ব। আমাদের পেছনে ও উভয় দিকে বিনা বাধায় তাঁর সেন্যরা উপকূল বরবার,ও নদীর তীরে অবতরণ করেছে। প্রতিটি সেক্টরে তার কয়েক ব্রিগেড ট্যাংকগুলাে ছিল উভচর। পক্ষান্তরে, আমাদের ট্যাংকের গােলা ভারতীয় ট্যাংকের বিরুদ্ধে অকার্যকর প্রমাণিত হয়। তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে দূরপাল্লার কামান ছিল। এসব দূরপাল্লার কামানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বল্পপাল্লার কামানগুলােকে অনবরত গােলাবর্ষণ করতে হতাে। এতে আমাদের পদাতিক বাহিনীকে সমর্থনদানের সামর্থ্য উল্লেখযােগ্যভাবে কমে যায়। ভারতীয়রা মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণদান এবং তাদের সংগঠনে রুশ বিশেষজ্ঞদের সহায়তাও পেয়েছিল। রুশরা যুদ্ধক্ষেত্রে ভারতীয়দের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র চালনায় সহায়তা দিত। এছাড়া হাজার হাজার বাঙালি ও ভিন্নমতাবলম্বী। ব্যক্তি মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করতাে। এসব সুবিধা সত্ত্বেও জেনারেল অরােরা সামরিকভাবে বিজয়ী হতে পারেননি। আমাদেরকে রাজনৈতিক পরাজয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিল এবং এটা করেছিলেন ভুট্টো। যুদ্ধ থেমে যাবার মাত্র কয়েক মাস পর অন্য কোনাে কাজে নিয়ােজিত না করে জেনারেল আরােরাকে অবসরে পাঠানাে হয়।

পরিদর্শন

আমি অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করি এবং এ পরিকল্পনা সার্বক্ষণিকভাবে পর্যালােচনা করা হতাে। এ সময়ে পাকিস্তানের বহু প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সফরে গিয়েছিলেন। তাদের মূল্যবান পরামর্শ আমার জন্য সহায়ক হয়েছে। লাহােরে সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালেও আমাকে রাজনীতিবিদদের সংশ্রবে আসতে হয়েছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তানে রাজনীতিকদের সফর ছিল সত্যি উৎসাহব্যঞ্জক। গােটা পরিস্থিতি সম্পর্কে মাওলানা মুফতী মাহমুদের গভীর অন্তঃদৃষ্টিতে আমি অত্যন্ত মুগ্ধ হই। তিনি অভিমত প্রকাশ করেন যে, শক্তিপ্রয়ােগ নিষ্ফল হবে এবং গণ আন্দোলন বেশিদিন দমন করে রাখা যাবে না। তিনি আরাে বলেছিলেন যে, স্বাভাবিক অবস্থা অনেকখানি ফিরে এসেছে। তাই সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করার এবং একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তি খুঁজে বের করার এটাই মােক্ষম সময়। এ সমস্যা হচ্ছে মূলত রাজনৈতিক। মুজিব একতরফাভাবে স্বাধীনতা অথবা যুদ্ধ ঘােষণা করেন নি। ভারত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার হচ্ছে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার যার সাহায্যে একটি রাজনৈতিক মীমাংসায় পৌছানাে সম্ভব। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকার গঠনের সুযােগ দেয়ার পক্ষে অভিমত প্রকাশ করেন। কারণ তারাও পাকিস্তানি এবং লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার অনুযায়ী তাদেরকে তাদের ন্যায্য অধিকার দিতে হবে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বঞ্চনার ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাবে। কারণ পূর্ব পাকিস্তানিরা ভাবছে যে, তাদেরকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। তাই তারা স্বাধীনতা চাইবে। তিনি আরাে বলেছিলেন, সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং ইয়াহিয়া ও ভুট্টো পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী নন। কত সত্য কথাই না তিনি বলেছিলেন। | অন্যান্য নিয়মিত দর্শনার্থীদের মধ্যে রয়েছেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরী, জনাব আবদুস সবুর খান, জনাব সিরাজুল হক এবং মৌলভি ফরিদ আহমদ। তারা ছিলেন খুবই অনুগত পাকিস্তানি। তারা দেশকে ভালােবাসতেন এবং দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। তারা নির্বাচিত। প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং অবিলম্বে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে, মুক্তিবাহিনী মৌলভি ফরিদ আহমেদকে হত্যা করে। এছাড়া আরাে বহু পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ নিহত হন। চট্টগ্রাম থেকে পালানাের চেষ্টাকালে ফজলুল কাদের চৌধুরী ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি হন। সিরাজুল হক ছিলেন ডা. মালিকের মন্ত্রিসভার একজন সদস্য। তিনি কপাল গুণে। বেঁচে যান। বিহারিরা ছিল শেষদিন পর্যন্ত অনুগত।

এজন্য তাদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। | ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ফিরে এসে ব্রিগেডিয়ার বাকির আমাকে জানান যে, তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে জানাতে পেরেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের মােতায়েন সেনাবাহিনীকে বলির পাঁঠা বানানাের জন্য সর্বোচ্চ পর্যায়ে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এবং জান্তা পূর্ব পাকিস্তান পরিত্যাগেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। রাজনৈতিক মহলে গুজব ছিল যে, লারকানায় ইয়াহিয়া ও ভুট্টো একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে এসব কথা বিস্তারিত জানা সম্ভব হয় নি। আরাে বলা হয় যে, তারা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করতে এম, এম, আহমেদকে নির্দেশ দিয়েছেন।  চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদ অক্টোবরে সফরে গেলে ব্রিগেডিয়ার বাকিরের কাছ থেকে আমি যা শুনেছি তা তাঁকে জানাই, কিন্তু তিনি তা অস্বীকার করেন। মনে হচ্ছিল যে, তিনি সত্য কথা বলছিলেন না। পরে প্রমাণিত হয়েছে যে, গুজব কত সত্য ছিল।

গভর্নর পদে পরিবর্তন

যখন ডা, মালিক জেনারেল টিক্কা খানের কাছ থেকে গর্ভনরের দায়িত্বভার গ্রহণ। করেন প্রেসিডেন্ট ডাকলেন আমাকে এবং বললেন যে গভর্নরের কথা আমাকে মানতে হবে। | ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে আমি ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার হিসেবে আমার দায়িত্বে অতিরিক্ত সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করি। সরকার ও প্রশাসনের মধ্যে সম্পর্ক ক্রমেই পরিবর্তিত হতে থাকে। একজন বেসামরিক গভর্নর। ও মন্ত্রিসভার নিয়ােগকে রাজনৈতিক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জনসমর্থন না থাকায় মন্ত্রিগণ অক্ষম হিসেবে প্রমাণিত হন এবং তাদের নিয়ােগে পরিস্থিতির কোনাে উন্নতি হয় নি। তারা সেনা প্রহরা ও হেলিকপ্টার ছাড়া চলাফেরা করতে পারতেন না। কোনাে উর্দুভাষীকে মন্ত্রিসভায় না। নেয়ায় উর্দুভাষীরাও সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। জনগণের তখন বেসামরিক প্রশাসনের প্রতি কোনাে আস্থা ছিল না। প্রশাসনের নিম্নস্তর সরকারের প্রতি সহায়ক হওয়ার। পরিবর্তে একটি বাধা হয়ে দেখা দেয়।

উপ-নির্বাচন

উপনির্বাচনের তারিখ ঘােষণায় সামান্য রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। তবে এ রাজনৈতিক তৎপরতা ডানপন্থী ও কিছু অনুগত বাঙালিদের মধ্যেই কেবল সীমাবদ্ধ। ছিল। রাজনৈতিক তৎপরতা কয়েকটি নির্দিষ্ট গ্রুপের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এর কারণ হচ্ছে, যেসব দল তখন মাঠ দখলের চেষ্টা করছিল তারা আগে সাধারণ নির্বাচনে গুরুতর বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। তাছাড়া, বিদ্রোহ শুরু হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক তৎপরতা বন্ধ ছিল। উপ-নির্বাচনের তফসিল ঘােষণা করায় পিপিপি, জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টো। সারা পাকিস্তানের নেতা হওয়ার জন্য ৬৫টি আসন চান। কিন্তু স্থানীয় সমস্যার জন্য তাকে দেয়া হয় মাত্র ২২টি আসন। আমরা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে সতর্ক করে দেই যে, উপ-নির্বাচনকালে । ব্যাপক গােলযােগ দেখা দিতে পারে। বিক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের ওপর হামলা ও তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরােধ গড়ে। তােলার চেষ্টা করে। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সকে জানানাে হয়, যে, পূর্ব পাকিস্তানে। ১০ হাজার সৈন্য পাঠানাে না হলে নির্বাচনে নিরাপত্তা রক্ষা করা সম্ভব হবে না কারণ। সৈন্যদেরকে বিদ্রোহ দমন অভিযানে পুরােপুরি নিয়ােগ করা হয়েছিল।

সাধারণ ক্ষমা

মে থেকেই আমি সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করার পরামর্শ দিচ্ছিলাম। পরিস্থিতির । ক্রমাগত উন্নতি ঘটনায় শােনা যাচ্ছিল, যে এ মুহূর্তে একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে পৌছানাে প্রয়ােজন। তাই আমি জেনারেল হামিদের মে মাসে সফরকালে তাকে এ ব্যাপারে অবহিত করি। আমার ক্ষমা ঘােষণার সুপারিশ বাস্তবায়নে যথেষ্ট দেরি হয়ে যায়। সাধারণ ক্ষমার যে ঘােষণা দেয়া হয় তা ছিল আংশিক। এজন্য এতে ইলিত। ফলাফল অর্জিত হয় নি। ভারত শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে বাধা দেয়। ১৯৯১ সালের। সেপ্টেম্বরে মাত্র ২৪০ জন বিদ্রোহী আত্মসমর্পণ করে।

গােয়েন্দা সংস্থা

১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত মূলত বাঙালিদের নিয়েই গােয়েন্দা সংস্থা গঠিত হয়েছিল। সামরিক অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে সব গােয়েন্দা সংস্থা ভেঙে পড়ে এবং তারা। আওয়ামী লীগের অনুকূলের স্বপক্ষত্যাগ করে। আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে। এমন কোনাে গােয়েন্দা সংস্থা গঠনে আমরা সফল হতে পারি নি। কিছু চেষ্টা। চলছিল। ভাষাগত অসুবিধা ও স্থানীয় জনগণের বৈরিতার কারণে এ চেষ্টা সফল হয় নি। ডিআইবি ও এসআইবি’র মতাে স্থানীয় বেসামরিক গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে আমাদের কোনাে কাজে আসে নি। পত্র-পত্রিকায় যা প্রকাশিত হতাে অথবা আমাদের প্রচারণায় অংশ হিসেবে যা প্রকাশ করা হতাে তারা সেগুলােই আওড়াত। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের বিরুদ্ধে ভারতের অতিরিক্ত ৩ থেকে ৪ ডিভিশন সৈন্যের সম্ভাব্য হুমকি সম্পর্কে কোনাে তথ্য দিতে পারে নি। ১৯৭১ সালের অক্টোবরে মিলিটারি ডাইরেক্টরেটে সংরক্ষিত নথিপত্রে এ সংক্রান্ত প্রমাণ পাওয়া যাবে। যুদ্ধকালে আমাদেরকে ভারতীয় হেলিকপ্টার গানশিপের হুমকির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু আইএসআই কিংবা সামরিক গােয়েন্দা অধিদপ্তর আমাদেরকে এ ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে নি। তাই আমরা ৮ ডিভিশন ভারতীয় সৈন্যের হামলা হবে বলে যে ধারণা করেছিলাম সে ধারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। ভারতীয় বাহিনী আমাদের সব খবরই পেয়ে যেত। কারণ মুক্তিবাহিনী ও বৈরি জনগণ আমাদের সম্পর্কে সর্বশেষ গােয়েন্দা তথ্য তাদের সরবরাহ করত।  আমাদের গােয়েন্দা নেটওয়ার্ক ও কাঠামাের অভাবে আমরা শত্রুদের নাগালের। বাইরে আমাদের কোনাে তথ্য গােপন রাখতে অথবা শক্রদের সম্পর্কে কোনাে তথ্য সগ্রহ করতে পারতাম না। সুতরাং আমাদের পরিকল্পনা, দুর্বলতা ও শক্তি সম্পর্কে। তথ্য গােপন রাখতে আমাদেরকে পরিকল্পিত উপায়ে ধােকা, প্রতারণা ও ধাপ্পার। আশ্রয় নিতে হতাে। আমরা শেষদিন পর্যন্ত আমাদের শক্তি, দুর্বলতা ও ঘাটতি সম্পর্কে শত্রুকে ধােকা দিতে সক্ষম হই এবং শত্রু আমাদের অতিরঞ্জিত শক্তির ভিত্তিতে তাদের আগ্রাসী পরিকল্পনা তৈরি করে।

চীনা প্রভাব

ভুট্টো চীন সফর করেন ১৯৭১-এর নভেম্বরের প্রথম দিকে একটি সামরিক রাজনৈতিক প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসেবে এবং ৭ নভেম্বর চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। চীনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য ভারতকে অভিযুক্ত করেন। তিনি বলেন যে, চীন সরকার পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় পাকিস্তান সরকারের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেবে। চীনের এ ঘােষণা ভারতীয় পরিকল্পনাবিদদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে একটি আঁতাতের সম্ভাবনা মাথায় রেখেই ভারতীয়রা। তাদের পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এভাবে সময় ও সংখ্যা উভয় নিরিখে চীনের বিরুদ্ধে মােতায়েন অতিরিক্ত ফরমেশনগুলাে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়’ (ইন্ডিয়ান ওয়্যারস সিন্স ইনডেপেনডেন্স মেজর জেনারেল খুসবন্ত সিং, ডেপুটি ডিরেক্টর, মিলিটারি অপারেশন, ভারত)।

ভূট্টোর চীন সফরকালে ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানাের ষড়যন্ত্র করা হয়। চিফ অব জেনারেল স্টাফ লে. জেনারেল গুল হাসান, এয়ার মার্শাল রহিম খান ও আরাে কয়েকজন ছিলেন এ ষড়যন্ত্রের মূল হােতা। জেনারেল হামিদের সঙ্গে আমার আলােচনাকালে আমি জোর দিয়ে বলি যে, পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করা উচিত হবে না। কারণ আমরা ভারতের সঙ্গে সীমিত লড়াই করতে চাই। ভারতও বিশ্বের কাছে আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত হতে চায় না বলে সীমিত যুদ্ধই চায়। যুদ্ধে চীনের সম্ভাব্য হুমকির ব্যাপারে ভারত উদ্বিগ্ন। ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূখণ্ড হারাই নি। আমাদেরকে অবহিত করা ছাড়াই পাকিস্তান ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমাদের চলাচল ও বিমানসহায়তা বিধ্বস্ত করে দেয়। ভারতীয় নৌবাহিনী নৌ অবরােধ আরােপ করে। ফলে আমরা কেন্দ্র (পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। রুশরা প্রকাশ্যে যুদ্ধে ভারতের পক্ষে যােগদান করে।

আমি জেনারেল হামিদকে জানাই যে, আমরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। সমুদ্র ও আকাশ পথ অবরােধ করা হলে আমরা পুরােপুরি বিচ্ছিন্ন ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ব। তখন তিনি আমাকে জানান যে, আমাকে বিচ্ছিন্ন অথবা পরিত্যক্ত হতে হবে না। কেন্দ্র আমাকে পরিচালনা করবে এবং ‘ঘােরা পথ’ (চীন ও তিব্বতের ওপর দিয়ে)-এর মাধ্যমে আমার সঙ্গে যােগাযােগ বজায় রাখবে। ভারতীয়রা অবরােধ আরােপ করার পর আমি জেনারেল হামিদের সঙ্গে ‘গােরা পথ’ ব্যবহারের প্রসঙ্গে উত্থাপন করি। তিনি বললেন, ‘দুঃখিত নিয়াজি। আমরা ঐ রুট ব্যবহার করতে পারছি না। আপনাকে এখন নিজের ওপর নির্ভর করতে হবে। আপনার যা আছে তাই নিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে হবে—আপনার মঙ্গল হােক।’ এভাবে আমি যুদ্ধের মাঝপথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। আমাকে পরাজিত করার পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিম রণাঙ্গনে অপ্রয়ােজনীয়, অনাহুত ও নির্বোধ যুদ্ধ শুরু করা হয় এবং আমাকে পরিত্যাগ করা হয়। তাদের অশুভ উদ্দেশ্য জেনেও আমি বাইরের সাহায্য ছাড়াই ভারতীয় সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য আমার সৈন্যদের প্রস্তুত করি। অঘােষিত যুদ্ধ ঘােষিত যুদ্ধে রূপ নেয়। তবে এতে ইচ্ছাকৃতভাবে তের দিন দেরি করা হয়। পূর্বাঞ্চলীয় গ্যারিসনকে পরিত্যাগ করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এ বিলম্ব করা হয়। এতে রুশদের সাহায্য নিয়ে ভারতীয়রা সর্বাত্মক হামলা চালানাের জন্য সময় পায় অনেক।

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!