You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও সৈন্য মােতায়েন

সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের তিন দিক ভারত দ্বারা বেষ্টিত। দক্ষিণ-পূর্বে একটি ক্ষুদ্র অংশের সঙ্গে রয়েছে বার্মা সীমান্ত দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এটা হচ্ছে একটি ভাটি এলাকা এখানে অসংখ্য নদ-নদী ও খাল রয়েছে। তিনটি বড় নদী-মেঘনা, পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্র বর্ষাকালে পানিতে ভরে গিয়ে সমুদ্রের রূপ ধারণ করে। এসব নদী পূর্ব পাকিস্তানে চলাচলের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাড়ায়। ভৈরব ও পাকশি—এ দুটি হচ্ছে গােটা অঞ্চলের দুটি বড় সেতু। সড়ক ও সেতুর স্বল্পতার কারণে চলাচলের জন্য নৌকা ও ফেরি ব্যবহার করতে হয়। নৌকা ও ফেরিতে চলাচলের জন্য সময় লাগে বেশি এবং এগুলােতে হামলা করাও সহজ নদী পথের এ বাধা অতিক্রম করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বিমানে পাড়ি দেয়া অথবা ছত্রী সেনা নামানাে। ১৯৭১ সালে ভারতীয়রা তাই করেছিল।  এ অঞ্চলের আবহাওয়া হচ্ছে আর্দ্র ও উষ্ণ বর্ষাকাল হচ্ছে দীর্ঘ এবং সে সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বর্ষাকালে আর্দ্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এ অঞ্চলের আবহাওয়ায় যারা অভ্যস্ত নয় তাদের কাছে তা অসহ্য। এটা তাদের শক্তি ক্ষয় করে। শুষ্ক অঞ্চলের লােকের কাছে আর্দ্র জলবায়ু বিপজ্জনক। অনেক রােগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হলাে ম্যালেরিয়া। এছাড়া, আর্দ্র আবহাওয়ায় রয়েছে। জোক ও অন্যান্য নােংরা পােকামাকড়ের উপদ্রব। এগুলাে ঠিকমতাে রােধ করতে না পারলে যুদ্ধের চেয়েও বেশি সৈন্য মারা যেতে পারে।  প্রধান নদীগুলাে সমগ্র দেশকে চারটি পৃথক ভূখণ্ডে বিভক্ত করে রেখেছে। রংপুর-রাজশাহী সেক্টর পাকশির কাছে একটিমাত্র রেল সেতু রয়েছে যা কুষ্টিয়া-খুলনা অঞ্চলকে দক্ষিণের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে মাত্র একটি বড় রাস্তা। ঢাকা সেক্টরের সঙ্গে সংযােগ সাধনে যমুনা নদীতে কোনাে সেতু নেই। ঠাকুরগাঁয়ে হালকা বিমান অবতরণ উপযােগী একটি ছােট্ট বিমান ক্ষেত্র রয়েছে।

কুষ্টিয়া-খুলনা সেক্টর এ অঞ্চলে দুটি বড় রাস্তা রয়েছে। একটি রাস্তা কুষ্টিয়া থেকে চলে গেছে খুলনা এবং আরেকটি গেছে বেনাপােল থেকে ভারত সীমান্তবর্তী যশাের-ঝিনাইদহ-ফরিদপুর পর্যন্ত এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে প্রচুর নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। এ জন্য এখানে সােজাসুজি চলাচল করা কঠিন। যশােরে একটি ভালাে বিমান ক্ষেত্র ও চালনায় একটি সমুদ্র বন্দরও রয়েছে। সিলেট-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সেক্টর চট্টগ্রাম হচ্ছে একটি সামুদ্রিক বন্দর। মেঘনা নদী এ অঞ্চলকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তবে ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রামের সরাসরি সড়ক যোেগাযােগ রয়েছে। ভৈরব বাজারে রেলওয়ের একমাত্র সেতু ঢাকার সঙ্গে প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের সংযােগ রক্ষা করছে। কোথাও কোথাও এ রেল লাইন আগরতলা সীমান্ত স্পর্শ করেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেটের মধ্যেও সরাসরি সড়ক যােগাযােগ রয়েছে। পথে প্রচুর নদী থাকায় চলাচল মন্থর ও দুষ্কর। চট্টগ্রামে একটি বিমান ক্ষেত্র রয়েছে। তবে শুধুমাত্র হালকা বিমান ওঠানামা করতে পারে।  ঢাকা সেক্টর : এটা হচ্ছে রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু। এ অঞ্চলের পশ্চিমে রয়েছে যমুনা নদী এবং পূর্বদিকে মেঘনা। ময়মনসিংহ থেকে একটি রাস্তা সােজা ঢাকা এসেছে। এটা হচ্ছে ভারত সীমান্ত থেকে ঢাকা পর্যন্ত সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ বিপজ্জনক রুট। ব্রহ্মপুত্র নদ হচ্ছে এ অঞ্চলের প্রধান প্রতিবন্ধকতা। মাঝে মধ্যে ছােট-ছােট নদীও রয়েছে। ঢাকায় একটি বৃহত্তম বিমান ক্ষেত্র রয়েছে। এফ৮৬ জঙ্গীবিমান ওড়ার জন্য এ বিমান ক্ষেত্র উপযােগী।  গােটা প্রদেশের অভ্যন্তরে সড়ক যােগাযােগ মােটামুটি ভালাে। কিন্তু নদ-নদীর প্রতিবন্ধকতার জন্য এক সেক্টর থেকে আরেক সেক্টরে সৈন্য চলাচল দুঃসাধ্য। যােগাযোেগ সামরিক অভিযানে যােগাযােগ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগে যােগাযােগ ব্যবস্থা খুব খারাপ রেল যােগাযােগ সীমিত। পাকা রাস্তা কম ও উঁচু। এখানে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিশ্বের অদ্বিতীয়; নদীপথ, রেলপথ ও সড়ক পথ  বিশ্বের আর কোথাও এমন যােগাযােগ ব্যবস্থা নেই।

ভূ-পৃষ্ঠ থেকে পাকা রাস্তাগুলাে কমপক্ষে পনের থেকে কুড়ি ফুট উচু। এসব রাস্তার নিচে কৃষি জমি। জমিতে কোথাও শাক-সবজি, কোথাও ধান-পাট, কোথাও বা জলাবদ্ধতা। কোথাও কোথাও জমিতে চার থেকে পাঁচ ফুট পর্যন্ত পানি। এ জন্য পানি নিষ্কাশন করে কাদা মাটিতে পরিখা খনন করতে হতাে। কোনাে রকমে পরিখা খনন করা হলে দেখা যেত বৃষ্টির পানিতে এগুলাে তলিয়ে গেছে। ভৈরব সেতু ঢাকা। বিভাগকে চট্টগ্রাম বিভাগের সঙ্গে এবং পাকশি সেতু খুলনা বিভাগকে রাজশাহী। বিভাগের সঙ্গে যুক্ত করেছে। কিন্তু রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সঙ্গে ঢাকা বিভাগের কোনাে সংযােগ সেতু নেই। সুতরাং রাজশাহী, খুলনা ও ঢাকা বিভাগের মধ্যে সব ধরনের চলাচলের মাধ্যম হচ্ছে নৌযান অথবা আকাশপথ। ফেরি দিয়ে নদী পারাপার হতে হয়। একটি ছােট্ট উদাহরণ থেকে বােঝা যাবে প্রদেশে চলাচল কত কঠিন। ঢাকা থেকে যশাের যেতে হলে প্রথমে যেতে হয় নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত ট্রেনে অথবা সড়ক পথে। পরে নারায়ণগঞ্জ থেকে খুলনা অথবা গােয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত স্টিমারে এবং সেখান থেকে যশাের পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথে। ঢাকা থেকে যশােরের দূরত্ব ৭৫ মাইল। এটুকু পথ যেতে সময় লাগে দুদিন। তিনবার যানবাহন পরিবর্তন করতে। হয়। একইভাবে সিলেট থেকে যশাের যেতেও তিন থেকে চারবার যানবাহন পাল্টাতে হয়, কখনাে সড়কপথে, কখনাে দুধরনের রেলপথে আবার স্টিমারে। বিদ্রোহ দমন অভিযানে সৈন্য মােতায়েন যখন আমি ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্বভার গ্রহণ করি, তখন বিরাজমান পরিস্থিতি আমাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেনানায়ক ফিল্ড মার্শাল ফচের একটি উক্তি মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কেন্দ্রভাগ ভেঙে পড়ছে। আমার দক্ষিণ পাশেরও পতন ঘটেছে তবু পরিস্থিতি চমৎকার। আমি অবশ্যই হামলা করব।’ আমি নিজে যে বলি, আমার কেন্দ্রভাগ বিধ্বস্ত। আমার উভয় পাশের পতন ঘটেছে। পরিস্থিতি ভালাে হওয়ার লক্ষণ নেই। আমাকে এ অবস্থায়ও হামলা চালাতে হবে।’ তাই করেছিলাম আমি। ত্বরিৎগতিতে আমি হামলা চালাই এবং আল্লাহর রহমতে যুদ্ধের প্রথম রাউন্ডে পূর্ণ সফলতা অর্জন করি। প্রশিক্ষণ ও শৃংখলা বজায় রাখার জন্য সব ফরমেশনে দুটি চিঠি পাঠাই। চিঠি দুটি ৩ ও ৪ পরিশিষ্টে দেয়া হলাে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছিল তিন দিক থেকে ভারত পরিবেষ্টিত। সীমান্তের মােট দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩ হাজার মাইল (২৫০০ মাইল স্থল ও ৫শ’ মাইল সমুদ্র)। এ সীমান্ত অভিন্ন রেখায় অথবা অর্ধবৃত্তাকার অবস্থায় নেই। তবে সীমান্ত প্রদেশটিকে কম-বেশি একটি পূর্ণ বৃত্তে রূপ দিয়েছে।

বড় বড় নদীগুলাে মাঝ বরাবর প্রবাহিত হওয়ায় দেশটি ৪টি অংশে বিভক্ত হয়ে রয়েছে। এ জন্য অব্যাহত প্রতিরক্ষা লাইন রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।  টিক্কার সৈন্য মােতায়েন আমি অক্ষুন্ন রাখি। আমি গেরিলাদের উচ্ছেদ করার সংকল্প গ্রহণ করি। এ জন্য আমার সামনে দুটি পথ খােলা ছিল : ক. সীমান্তের দিকে গেরিলাদের ঠেলে দেয়া এবং চূড়ান্তভাবে তাদের ধ্বংস করা অথবা ভারতের অভ্যন্তরে ঠেলে দেয়া। এতে সময় লাগতে পারে এবং জানমালের প্রচুর ক্ষতিও হতে পারে। আমাকে লড়াই করতে হবে গেরিলাদের সুবিধাজনক অবস্থানে যেখানে তারা পুনরায় শক্তি বৃদ্ধি এবং সুযােগ মতাে প্রত্যাহারের সুবিধা ভােগ করছে এবং তাদের এ সুবিধা শেষ পর্যন্ত বহাল থাকবে। 

খ. উভয় পাশের ও পেছনের অবস্থানের চিন্তা বাদ দিয়ে সীমান্তের দিকে বিরাট বহর নিয়ে অগ্রসর হওয়া এবং গেরিলাদের পুনরায় শক্তি বৃদ্ধি ও প্রত্যাহারের রুট বন্ধ করে দেয়া। আমাদের ক্ষিপ্র অভিযান ও উপর্যুপরি হামলায় আমরা বিস্ময় উৎপাদন করব এবং এভাবে গেরিলাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করব। এ প্রক্রিয়ায় গেরিলারা তাদের অবস্থান ত্যাগে বাধ্য হবে এবং নিরাপত্তার জন্য ভারতের দিকে পালাবে। আমি দ্বিতীয় পথ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

জেনারেল টিক্কার সৈন্য মােতায়েন পদ্ধতি ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আত্মরক্ষামূলক। আক্রমণ অভিযানে নামার আগে গ্রুপিং এবং সৈন্য মােতায়েনে কিছুটা পরিবর্তন ঘটানাের প্রয়ােজন ছিল। আমি বিস্ময় সৃষ্টি এবং শত্রুর আক্রমণ করার ক্ষমতা ধ্বংস করতে চেয়েছিলাম। সুতরাং দ্রুত সীমান্তে পৌছানাের জন্য গতি ছিল অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়। তাই আমি সামান্য পরিবর্তন ঘটাই। ফরমেশনগুলােকে নতুন দায়িত্ব দিই এবং ক্ষিপ্র অভিযানের জন্য তাদের প্রস্তুত হতে বলি। আমি স্রেফ তাদেরকে বললাম, ‘সর্বোচ্চ গতিতে সংক্ষিপ্ততম সময়ে সীমান্তে পৌছে যাও।’ | আমি নিচের চারটি পর্যায়ে পালনীয় নির্দেশ জারি করি।

পর্যায় ১ সীমান্তবর্তী সকল বড় শহর মুক্ত করা এবং অনুপ্রবেশ ও চোরাচালানের

রুটগুলাে বন্ধ করে দেয়া। চট্টগ্রাম ঘাঁটি মুক্ত করা এবং এটাকে

আর্টিলারি ও মর্টারের গােলাবর্ষণ থেকে নিরাপদ রাখা।

পর্যায় ২: প্রয়ােজনীয় নদী, সড়ক ও রেল যােগাযােগ ব্যবস্থা খুলে দেয়া।

পর্যায় ৩ : মুক্তিবাহিনীর কজা থেকে অভ্যন্তরীণ সকল শহর ও উপকূলীয় এলাকা।

উদ্ধার করা।

পর্যায় ৪ সারা প্রদেশে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা এবং বিদ্রোহী/

অনুপ্রবেশকারীদের নির্মূল করা। অন্তত ১৯৭১ সালের ১৫ মে’র মধ্যে এসব কাজ সম্পন্ন করতে হবে। গতি ও উপর্যুপরি হামলার জন্য পুরস্কার প্রদানের ওপর জোর দেয়া হয়। সৈন্যদল এবং দায়িত্ব মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ্র আওতাধীন ১৬ ডিভিশনকে রাজশাহী সিভিল ডিভিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এছাড়া এ ডিভিশনের ওপর দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া ও রাজশাহী ধরে রাখার দায়িত্বও অর্পণ করা হয়। ভারতীয় ক্যান্টনমেন্ট কাছে থাকায় এবং এলাকাটি ট্যাংক চলাচলের জন্য উপযােগী হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র ট্যাংক রেজিমেন্টটি দেয়া হয় এই ডিভিশনকে। | মেজর জেনারেল শওকত রিজার নেতৃত্বাধীন ৯ম ডিভিশনকে ঢাকা ও খুলনা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রাদেশিক রাজধানী হওয়ায় এবং একটি বিমান বন্দর থাকায় ঢাকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকার উত্তরাংশে কোনাে প্রতিবন্ধকতা ছিল না। তবে মধুপুর জঙ্গল ও টাঙ্গাইল শহরের আশপাশে আত্মগােপন করার মতাে ভালাে অবস্থান ছিল। শক্তি দিয়ে ময়মনসিংহকে রক্ষা করতে হবে। রাজশাহী বিভাগের পর পরবর্তী অগ্রাধিকার দেয়া হয় খুলনা বিভাগের ওপর। যশােরকেও শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে হবে। ফরিদপুরের ওপর ঢাকা ও যশােরের নিরাপত্তা নির্ভর করছে বলে এটাকে ধরে রাখতে হবে।

জলাবদ্ধ এলাকা চালনা, বরিশাল ও সুন্দরবনের দায়িত্ব দেয়া হয় সিএএফ’র ওপর। মেজর জেনারেল আবদুর রহিম খানের নেতৃত্বাধীন ১৪ ডিভিশনকে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামকে ধরে রাখতে হবে। চট্টগ্রাম ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পার্বত্য চট্টগ্রামে কমান্ডাে মােতায়েন করা ডিভিশনের এলাকা এবং দায়িত্ব বণ্টনের পর এগুলাে পরিদর্শনে যাই আমি। এরপর আমি আমার বিস্তারিত পরিকল্পনা, পরবর্তী গ্রুপিং এবং ফরমেশনের নতুন সীমানা বণ্টনের কাজ শুরু করি।  এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, যেখানে জনগণ আপনার বিপক্ষে এবং আপনার শক্রর প্রতি সহানুভূতিশীল এমন একটি বৈরি ভূখণ্ডে কোনাে শক্তি টিকতে পারে না। বিশ্বাসঘাতকরা শক্রর সঙ্গে সহযােগিতা করায় সশস্ত্র বাহিনীর বীরত্ব ও সাহসিকতা। সত্ত্বেও জাতির মর্যাদা ভূলুষ্ঠিত হয়। আমাদেরকে ভেতর ও বাইরের উভয় শক্তিকে মােকাবেলা করতে হয়েছে। টিক্কা খানের নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের পর স্থানীয় জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে চলে যায় এবং একটি বৈরি ভূখণ্ডে আমরা বিদেশিদের মতাে হয়ে যাই। বাঙালিরা আমাদেরকে দখলদার বাহিনী বলতাে। মুক্তিবাহিনী শুধু স্থানীয় জনগণ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযােগিতা নয়, ভারতের গােটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক কাঠামাে এবং রুশ উপদেষ্টাদের সহযােগিতাও যদিও প্রতিপক্ষ সংখ্যায় ছিল বেশি এবং তারা ছিল স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে অভ্যস্ত ও রণাঙ্গনের সঙ্গে পরিচিত এবং আক্রমণ করার সামর্থ্যের অধিকারী তবু আমরা রেকর্ড সময়ে সাফল্যের সঙ্গে প্রথম পর্যায় ও দ্বিতীয় পর্যায় সম্পন্ন করি। ১৯৭১ সালে এপ্রিলের শেষ নাগাদ আমরা সব সীমান্ত শহর ও বিওপি দখল, অনুপ্রবেশের রুট বন্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত পুনরুদ্ধার করি। মে মাসের শুরুতে চট্টগ্রাম, খুলনা ও চালনার সমুদ্র রুট ও নদীগুলাে মুক্ত করি এবং এসব বন্দরে নৌযান ও জাহাজ চলাচল পুনরায় শুরু হয়। প্রদেশে রেলযােগাযােগও পুনরুদ্ধার করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৩ মে আমি রাওয়ালপিন্ডিতে একটি বার্তা পাঠাই যেখানে আমি সর্বশেষ পরিস্থিতি, বিদ্রোহী তৎপরতার ধরন, ভারতীয় হস্তক্ষেপের বিস্তৃতি, সীমান্তের পরিবর্তন এবং বিভিন্ন ফরমেশনের ওপর ন্যস্ত এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিই।

শহর এলাকায় পরাজিত হয়ে বিদ্রোহীরা প্রত্যন্ত এলাকায় পিছু হটে অথবা সীমান্তের ওপারে চলে যায়। প্রায় ৩০ হাজার বিদ্রোহী নিহত অথবা নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। নতুন বিন্যাসে সৈন্য মােতায়েন করা হয় যা নিম্নরূপ। মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ-এর নেতৃত্বাধীন তিনটি ব্রিগেড ও একটি সাজোয়া রেজিমেন্টের সমন্বয়ে গঠিত ১৬ ডিভিশনকে দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর জেনারেল এম. এইচ, আনসারীর নেতৃত্বাধীন দুটি ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত ৯ম ডিভিশনকে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, বরিশাল, ভােলা দ্বীপ, পটুয়াখালী, খুলনা, যশাের, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। পাকশি সেতুও ঐ ডিভিশনের ওপর অর্পন করা হয়। পানিবদ্ধ এলাকা চালনা, বরিশাল ও সুন্দরবনের দায়িত্ব সিএএফ’র ওপরই ন্যস্ত রাখা হয়। মেজর জেনারেল রহিম খানের নেতৃত্বাধীন তিনটি ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত ১৪ ডিভিশনের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় ময়মনসিংহ, সিলেট এবং কুমিল্লা পর্যন্ত এবং আরাে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ফেনী নদী, নােয়াখালি ও ঢাকাকে। এছাড়া, ১৪ ডিভিশনের ওপর ভৈরব সেতুর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। একটি স্বতন্ত্র ব্রিগেড ও ইস্টার্ন কমান্ডের অধীনস্থ কমান্ডােদের ওপর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। নতুন করে সৈন্য বিন্যাসে নিচের পরিবর্তন ঘটানাে হয় : যুদ্ধের চাপে নিস্তেজ ও অকর্মণ্য হয়ে পড়ায় মেজর জেনারেল শওকত রিজাকে ৯ ডিভিশনের কমান্ড থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। পদোন্নতি দেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার এম, এইচ, আনসারীকে এবং তাকে ৯ ডিভিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই ডিভিশনের মূল কাজ ছিল ঢাকা ও খুলনার সিভিল ডিভিশনের প্রতিরক্ষা। এক ব্রিগেড বাদে এ ডিভিশনকে শুধুমাত্র খুলনা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। চট্টগ্রাম সিভিল ডিভিশনের দায়িত্ব দেয়া হয় ১৪ ডিভিশনকে। এ এলাকা এত বড় ছিল যে, একটি ডিভিশনের পক্ষে সামলানাে কঠিন হয়ে ওঠে। তাই এ এলাকাকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়। ফেনী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে এ ডিভিশনের আওতা থেকে বাদ দেয়া হয় এবং তাদের ওপর ফেনীর উত্তরে একটি সংযুক্ত এলাকার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।  ১৬ ডিভিশনের এলাকায় কোনাে পরিবর্তন আনা হয়নি।

এ সৈন্য বিন্যাস এবং এলাকা পুনর্গঠন রণকৌশলের দিক থেকে আরাে কার্যকর বলে বিবেচিত হয়। ফরমেশন কমান্ডারদেরকে তাদের ভবিষ্যৎ কাজের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে বলা হয়। ভবিষ্যৎ কাজের মধ্যে ছিল যােগাযােগের উন্নয়ন এবং প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি। শক্ত ঘাঁটির ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ এবং অবস্থানে গােলাবারুদ  ও রেশনের মজুদ গড়ে তুলতেও নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষদিকে বিদ্রোহীদের প্রতিরােধ ভেঙে পড়ে, বিরাট। ক্ষতি হয় তাদের জানমালের। বিদ্রোহীদের মনােবল ভেঙে যায়। তারা দুর্গম এলাকায় অথবা ভারতের মাটিতে নিরাপদ ঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। এ পরিস্থিতিতে ভারত আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও সাজ-সরঞ্জাম সরবরাহ করে বিদ্রোহীদের মনােবল চাঙ্গা করার পদক্ষেপ নেয়। ভারতীয়রা সীমান্তের কাছে আমাদের অবস্থানে সরাসরি হামলা করে এবং সীমান্তের ওপার থেকে গােলাবর্ষণ করে বিদ্রোহীদের তৎপরতায় সমর্থন যােগাতে থাকে। কিন্তু হতােদ্যম বিদ্রোহীরা আমাদের সৈন্যদের সামনে দাঁড়াতেই পারছিল না। তারা ভয়ে পালিয়ে যেত নয়তাে ভারতে আশ্রয় নিত। এসব অভিযানকালে প্রায় ৪০ হাজার রাইফেল, ১০টি ভারি মেশিনগানসহ ৬৫টি মেশিনগান, ১৪০টি হালকা মেশিনগান, ৩১টি মর্টার, ১২টি রিকয়েললেস রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ গােলাবারুদ আমাদের হাতে আটক হয়। আমাদের ঝড়ােগতিতে সামরিক অভিযান চালানাের ফলে শত্রুদের এত বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র খােয়া যায় এবং তাদের এত প্রাণহানি ঘটে। যে গতিতে এসব সামরিক অভিযান পরিচালনা করা হয় গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাসে সে ধরনের নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রচণ্ড গতিতে হামলা চালানাের ফলেই শত্রুরা ভেঙে পড়ে। তারা যুদ্ধ করার মনােবল হারিয়ে ফেলে এবং আত্মরক্ষার জন্য এদিক-সেদিক ছুটে যায়। এ সময় তারা প্রচুর গােলাবারুদ, অস্ত্রশস্ত্র ও পরিবহন ফেলে রেখে যায়। তারা সংগঠিত উপায়ে নয় বরং চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে পিছু হটে। স্থানীয় জনগণের সক্রিয় সমর্থন এবং ভারতীয়দের সহযােগিতা দান সত্ত্বেও দু’মাসেরও কম সময়ে বিদ্রোহীরা তাদের নিজেদের এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অভিযানকে সঠিকভাবে বলা যেতে পারে বন্দ্র অভিযান’। আমি এসব অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে রিপাের্ট পাঠাই এবং ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেয়া মুক্তিবাহিনীর ওপর হামলা চালাতে ভারতে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করি।

জেনারেল হামিদ আমাকে টেলিফোনে বললেন, প্রেসিডেন্ট ও আমি উভয়ে আপনার বিস্ময়কর সাফল্যে অত্যন্ত আনন্দিত। তবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করবেন না। আমি শিগগির আপনার সঙ্গে আপনার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলােচনা করব।’ ব্যস এটুকুই। সীমান্ত বন্ধ এবং যােগাযােগ প্রতিষ্ঠায় আমাদের দ্রুত অভিযান পাল্টে দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিসাব। ভারতীয়রা ধারণা করেছিল যে, মুক্তিবাহিনী। প্রদেশের ভেতরে বড় বড় শহর ও ক্যান্টনমেন্টের আশপাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ব্যস্ত রাখবে এবং আমাদের সরবরাহে ঘাটতি ও অনিয়মের দরুন কয়েক মাসেই তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলবে। জেনারেল টিক্কা কমান্ডে থাকলে অথবা তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কাজ করলে ভারতীয় কৌশলবিদদের এ সহজ সমীকরণ সফল হতাে। ভারতীয়রা হিসাব করেছিল যে, একজন গেরিলা একজন করে পাকিস্তানি সৈন্য হত্যা করতে পারলে কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তান গ্যারিসন ফাঁকা হয়ে যাবে।  মেজর জেনারেল ফজল মুকিম খান (অব.) তার পাকিস্তান’স ক্রাইসিস ইন লিভার শিপ বইয়ে লিখেছেন যে, “বিদ্রোহী বাহিনী ভারতে পিছু হটে এবং মনােবল হারিয়ে ফেলে। তাদের মধ্যে বিশৃংখলাও চরমে পৌছে। পিছু হটে যাবার পথে তারা রাস্তাঘাট, নৌযান ও পরিবহন ধ্বংস করেছে। যেগুলাে তারা ভারতে নিয়ে যেতে পারেনি সেগুলাে হয় তারা ধ্বংস করেছে নয়তাে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।’ | ‘সশস্ত্র বাহিনী দ্রুতগতিতে অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছে। অভিযানে তারা যে ক্ষিপ্রগতির পরিচয় দিয়েছে তাতে শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবাই বিস্মিত হয়েছে। তাদের এ্যাকশন সেসময় ভারতকে পূর্ব পাকিস্তানে দুঃসাহসিক অভিযান চালাতে বিরত রেখেছে। তাদের জন্য নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা তারা অর্জন করেছিল। তবে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছিল সরকারের।’

ফজল মুকিম তার বইয়ের ১২৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন। সেপ্টেম্বরে গােটা পূর্ব পাকিস্তানে মােটামুটি শান্তি ছিল এবং মনে হচ্ছিল প্রদেশে নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসছে। এর কারণ হচ্ছে বর্ষকালে মুক্তিবাহিনীর বহুল প্রচারিত অভিযান ব্যর্থ হয়। ভারতে বিদ্রোহীদের ক্যাম্পে বিদ্রোহের খবর পাওয়া যাচ্ছিল। মুক্তিবাহিনী নিঃশেষ হয়ে যাবার মতাে এবং আত্মসমর্পণ করার মতাে অবস্থায় এসে দাড়িয়েছিল বলেও জানা গেছে। কিন্তু এ পরিস্থিতির কোনাে রাজনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করা হয়নি।’ মেজর জেনারেল শওকত রিজা (অব.) তার ‘দ্য পাকিস্তান আর্মি ১৯৬৬-৭১’ বইয়ে লিখেছেন : ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী বহু প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ৮ সপ্তাহে প্রায় সব শহরে। সরকারি কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। বিদ্রোহ দৃশ্যত নির্মূল হয়ে যায়। বিদ্রোহীরা নাজুক অবস্থায় পৌঁছে। কতিপয় বাঙালি নেতা রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা করছিলেন। এ ধরনের একটি সমাধানের জন্য সেটাই ছিল সঠিক সময়। কিন্তু। আমরা এ সুযােগ হাতছাড়া করি। এরপর পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে।’ ‘প্রায় সব শহরে সরকারি কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করা হয়। বিদ্রোহীরা নিহত কিংবা গ্রেফতার হয় অথবা পালিয়ে যায়। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্ব আত্মগােপন করে অথবা ভারতে পালিয়ে যায়। বাঙালি পুলিশ ও আমলারা ধীরে ধীরে তাদের কাজে ফিরে আসেন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষকে সহযােগিতা করতে থাকেন। মেজর জেনারেল খুশবন্ত সিং তার দ্য ইনডিয়ান আর্মি আফটার ইনডিপেনডেন্স বইয়ের ৪৩৭ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : ‘সীমান্তের ভেতর ও বাইরে থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ে প্রবল চাপের মুখে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৪২ হাজার নিয়মিত সৈন্যের পাকিস্তান বাহিনীকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী একটি বিদ্রোহ মােকাবেলা করতে হয়েছে। তারা প্রদেশের অধিকাংশ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হলেও তাদেরকে দীর্ঘস্থায়ী বিদ্রোহ দমন অভিযানে বহু মূল্য দিতে হয়েছে। প্রাণহানির সংখ্যা অনেক। ২৩৭ জন অফিসার, ১৩৬ জন জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার ও ৩,৫৫৯ জন সৈন্য নিহত হয়েছে।’ 

যখন জেনারেল আবদুল হামিদ খান ১৯৭১ সালের জুনে আমাদের দেখতে এলেন আমি তাকে জানাই যে, আমরা অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং অতি সংক্ষিপ্ত সময়ে বিরাট নৈতিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিজয় অর্জন করেছি। আমাদের মনােবল উঁচু। পক্ষান্তরে, বাঙালিদের নিচু। বাঙালিরা রয়েছে দৌড়ের ওপর। এতে ভারতীয়রা হাত গুটিয়ে নিচ্ছে এবং রুশরা বিস্মিত হয়ে গেছে। আমার সৈন্যরা যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, ভারতীয়রা মর্ম জ্বালায় ভুগছে। আমি আরাে বললাম যে, সময় থাকতে আমাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। ভারতীয়। ভূখণ্ডে বিদ্রোহীদের ঘাঁটিতে হামলা করে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে দিতে হবে এবং এভাবে বিদ্রোহীদের ভবিষ্যতে সহায়তা দানে ভারতকে বিরত থাকতে বাধ্য করতে হবে। আমার কথা মতাে কাজ করা হলে লাখ লাখ ভারতীয়কে নিরাপদ স্থানে পৌঁছানাের জন্য দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে হতাে। সে ক্ষেত্রে তাদের। যােগাযােগ ব্যবস্থা তছনছ হয়ে যেত এবং সরকারি অফিস ও অন্যান্য জায়গায়। লােকজন আশ্রয় নিত। এভাবে ভারতের বেসামরিক প্রশাসনের জন্য অসংখ্য সমস্যা। সৃষ্টি হতাে এবং ভারতীয় সৈন্যদের যে কোনাে অভিযান বাধাগ্রস্ত হতাে। তখন পর্যন্ত আমরা আমাদের ভূখণ্ডে দাড়িয়ে লড়াই করছিলাম এবং বৈষয়িকভাবে দুর্ভোগ পােহাচ্ছিলাম। কিন্তু ভারত সরকার যদি নিজেদের জনগণকে দুর্ভোগের মধ্যে দেখতে পেত এবং তাদের সম্পদের হানি ঘটতাে তাহলে তারা তাদের আগ্রাসী মনােভাবে বিরতি দিতে বাধ্য হতাে। উপরন্তু, মুক্তিবাহিনীর সংগঠিত প্রতিরােধ গুঁড়িয়ে যেত। ফলে তাদের মনােবলে চিড় ধরতাে এবং বিশৃংখল হয়ে পড়তাে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী সে মুহূর্তে আমাদের অপ্রত্যাশিত হামলা মােকাবিলায় মমাটেও প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু ইতােমধ্যে ভারতীয়রা সংঘটিত হয়ে যায় এবং আমার অগ্রাভিযান মােকাবিলার মতাে অবস্থায় পৌছে যায়। আমাকে অনুমতি দেয়া হলে আমি গেরিলা ক্যাম্প ধ্বংসের মাধ্যমে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন, গেরিলাদেরকে ভারতের গভীর অভ্যন্তরে বিতাড়িত এবং সীমান্তে মােতায়েন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী। বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দিতে পারতাম। সামনেই ছিল বর্ষাকাল। তাই আমরা এ উদ্যোগ নিলে সে সময় ভারতীয়রা তাদের ভারী অস্ত্র ও বিমান বাহিনী ব্যবহার করে আমাদেরকে আমাদের অবস্থান থেকে হটাতে পারতাে না। এ সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী পশ্চিমাঞ্চলীয় গ্যারিসন এগিয়ে এলে আমরা সফল হতাম। আমার দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল যে, আমার ডিভিশনগুলােতে ট্যাংক ও কামানের ঘাটতি পূরণ এবং আমাকে এক স্কোয়াড্রন আধুনিক জঙ্গীবিমান ও বিমান-বিধ্বংসী সরঞ্জাম এবং একটি পদাতিক ব্রিগেড দেয়া হলে আমি আগরতলা ও আসামের এক বিরাট অংশ দখল করে নেব এবং পশ্চিমবঙ্গে উপর্যুপরি চাপ সৃষ্টি করব। আমরা হুগলি নদীর ওপর সেতু এবং জাহাজ ও নৌযান ধ্বংস করে কলকাতার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেব এবং বেসামরিক লােকজনের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানি জিরাে ফাইটার যেভাবে কলকাতায় বােমা ফেলেছিল সেভাবে এ শহরে একবার বিমান হামলা হলে কলকাতা জনশূন্য হয়ে পড়বে। আমার তৃতীয় প্রস্তাব ছিল আমার ঘাটতি পূরণ করতে হবে, আমাকে আরাে দুটি ডিভিশন, কয়েকটি জঙ্গীবিমান ও কয়েকটি বিমান-বিধ্বংসী কামান দিতে হবে (পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ক্ষুন্ন না করে আমার এ দাবি সহজে পূরণ করা যেত) এবং আমাকে এগুলাে সরবরাহ করা হলে আমি ভারতের মাটিতে শুধু পূর্ব পাকিস্তানের নয়; গােটা পাকিস্তানের লড়াই চালাতে পারব। আমাদের পাঁচ ডিভিশনের বিপরীতে ভারতকে অন্তত ১৫ ডিভিশন সৈন্য এবং তাদের নৌ ও বিমান বাহিনীর এক বিরাট অংশ মােতায়েন করতে হবে।

একইসঙ্গে ভারতকে চীন সীমান্তে কয়েক ডিভিশন এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য আরাে কয়েক ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন রাখতে হবে। এভাবে ভারত পশ্চিম রণাঙ্গনে দুর্বল হয়ে পড়বে। এবং আমাদের জন্য কাশ্মীর ও গুরুদাসপুর মুক্ত করা কোনাে সমস্যা হবে না। পশ্চিম রণাঙ্গণে ভারত শক্তিশালী হলে পূর্ব রণাঙ্গনে সে দুর্বল হয়ে পড়বে। দুটি ফ্রন্টে তার শক্তিতে ভারসাম্য থাকবে না। মিজো মুক্তিবাহিনীর নেতা লাল ডেঙ্গা, আসামে নাগা মুক্তিবাহিনীর নেতা এ. জেড, ফিজা ও পশ্চিমবঙ্গের নক্সাল আন্দোলনের নেতা চারু মজুমদারের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ রয়েছে। তারা আমাদের সঙ্গে যােগ দেবে এবং ভারতের মাটিতে লড়াই শুরু করে দিতে পারলে আমাদের নিজেদের বাঙালিরাও আমাদের সঙ্গে যােগ দিতে পারে। এটা হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি সুযােগ। আমাদেরকে এ সুযােগ কাজে লাগতে হবে। নৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে ভারতে প্রবেশ করা যৌক্তিক। কারণ তারা আমাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে এবং আমাদের ভূখণ্ডে লড়াই চালাচ্ছে। | জেনারেল হামিদ বলেন যে, আমার প্রস্তাবের অর্থ হচ্ছে ভারতের সঙ্গে প্রকাশ্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। আমি তার সঙ্গে একমত হলাম এবং বললাম যে, আমরা তাদের ভূখণ্ডে প্রবেশ করলেই তারা শান্তির পথে আসতে বাধ্য হবে। ভারত পাকিস্তান সৃষ্টি মেনে নেয়নি। পাকিস্তান ও মুসলমান বাঙালি অথবা অবাঙালি কারাে প্রতিই তার সহানুভূতি নেই। ভারত তার সুবিধামতাে যে কোনাে সময় কোনাে কারণ ও হুঁশিয়ারি ছাড়াই আমাদের আক্রমণ করবে। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারত কখনাে শাস্তি চায়নি। ইতােমধ্যে সে ৭ বার আমাদের সঙ্গে লড়াই করেছে এবং বর্তমানে সে পূর্ব পাকিস্তানে পরােক্ষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, আমাদেরকে এখনি হামলা। করতে হবে। তাহলে মুখে তারা অহিংসতার যে বাণী প্রচার করে বাস্তবে তাই। করতে বাধ্য হবে। 

ধৈর্যের সঙ্গে আমার যুক্তি শুনে জেনারেল হামিদ উত্তরে বলেন, নিয়াজি আপনার প্রস্তাব সুন্দর, যুক্তি সঠিক এবং এগুলাে বিবেচনার দাবি রাখে। আমি আপনার সহায়তায় সৈন্য ও সমরাস্ত্র পাঠাতে পারি এবং আমরা পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানের লড়াই করতে পারি। ভারতের মাটিতে এ যুদ্ধ নিয়ে যেতে অথবা কোনাে রকম ঝামেলা ছাড়া আপনার শেষ প্রস্তাব রক্ষা করতে পারলে আমি খুশি। হতাম। কিন্তু আমাদের সরকার ভারতের সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত নয় । আমরা যেভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছি সেভাবেই সরকার যুদ্ধ করার পক্ষে। আপনি এ যুদ্ধে চমৎকার সাফল্য অর্জন করেছেন। এখন মনােযােগ দিয়ে শুনুন। আপনার কাজ। হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতে বাংলাদেশ সরকার গঠন করার সুযােগ না দেয়া। আপনি এটুকু করতে পারলেই আমরা আপনার ও আপনার অধীনস্থ সৈন্যদের প্রতি সন্তুষ্ট থাকব। আপনি ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশ অথবা ভারতে হামলার জন্য কোনাে সৈন্য পাঠাবেন না। শুধু তাই নয়, আপনি ভারতীয় ভূখণ্ডে গােলাবর্ষণও করবেন না। আপনি কেবল বৈরি শক্তিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে বাধা দেবেন এবং তাদের উৎখাত করবেন।’ তখন আমি বললাম, বাঙালিরা কি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য প্রস্তুত? তিনি। বললেন, ‘টাইগার, আপনি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মাথা ঘামাবেন না। বিষয়গুলাে খুবই জটিল।

“ঠিক আছে স্যার’। ভারতে প্রবেশ করে বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াই এবং ভারতের ভূখণ্ডে যুদ্ধকে বিস্তৃত করার আমার স্বপ্ন ও চিন্তাধারা এভাবেই সেখানে শেষ হয়ে যায়।  মেজর জেনারেল খুশবন্ত সিং তার ‘দ্য লিবারেশন অব বাংলাদেশ’ বইয়ের ৬৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন : | ১৯৭১ সালের মে মাসের শেষদিকে গেরিলাদের হটিয়ে দিতে এবং ভারতে তাদের ঘাঁটি ধ্বংসে পূর্বাঞ্চলে আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করার যৌক্তিক সুযোেগ ইয়াহিয়া খানের ছিল এবং তিনি পশ্চিম রণাঙ্গনে ভারতের ওপর হামলা করে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করতে পারতেন। ভারতের জন্য সময়টা ছিল তখন খুবই নাজুক। কারণ ভারতের রিজার্ভ ফরমেশনগুলাে ছিল পশ্চাৎভূমিতে। এছাড়া সামরিক সরঞ্জামের মারাত্মক ঘাটতি ছিল এবং সৈন্য ও জনগণ তাৎক্ষণিক একটি যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। ইয়াহিয়া তখন যুদ্ধ শুরু করলে বর্ষা আসার আগেই তিনি পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে উল্লেখযােগ্য সাফল্য লাভ করতে পারতেন।’ ভারতীয় ফরমেশনগুলাে যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল তাই নয়; ভারত তখনাে রাশিয়ার সঙ্গে কোনাে প্রতিরক্ষা চুক্তি সই করেনি। সে সময় ইয়াহিয়া আঘাত হানলে পাকিস্তান অখণ্ড থাকতাে এবং ভারতের চরম শিক্ষা হতাে। অজেয় হয়ে। থাকতে পারতাে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।  

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!