প্রাথমিক জীবন
আমার নাম আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, তবে আমি ‘টাইগার নিয়াজি’ হিসেবে বেশি পরিচিত। এ খেতাবটা আমাকে দিয়েছিলেন ১৬১ ভারতীয় পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্মায় আমার বীরত্বপূর্ণ কাজের জন্য। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাকে খেতাব দেয়া হয় ‘তারিক-বিন-জিয়াদ’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমাকে কোহিমাতে মিলিটারি তারকা দেয়া হয় এবং ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে আমি দু’বার ‘হিলাল-ই-জুরাত’ খেতাবে ভূষিত হই, একবার ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে অন্যবার ১৯৭১-এর যুদ্ধে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে সিতারা-ই-খিদমত এবং ‘সিতারা-ই-পাকিস্তান”। আমি চব্বিশটা পদক পেয়েছি। আমাকে প্রশংসাপত্র দেয়া হয়েছে। মেজর থেকে আরাে ওপরে আমার সব পদোন্নতি হয়েছে দ্রুত। আমাকে যখন ইন্টার্ন গ্যারিসনের কর্তৃত্ব দেয়া হয়, যেটা ছিল সামরিক বাহিনীর। তৃতীয় সিনিয়র পদ, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের তালিকায় আমি ছিলাম বারতম। বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শনে গেলে আমার সেনা দলকে দেখে সবাই চিৎকার দিত ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ, নিয়াজি তদবির, আল্লাহ-আকবর। আমাকে ইপকাফ (ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস)-এর সদস্যদের কমিশন এবং পূর্ব পাকিস্তান গ্যারিসনের সদস্যদের এসজে (সিতারা-ই-জুরাত) বীরত্বপদক প্রদানের অনুমতি দেয়া হয়। ভারতীয়রা আমাকে সৈনিকদের সেনাপতি বলে সম্বােধন করত। আমার বীরত্বের জন্য পুরস্কার প্রাপ্তির কথা উল্লেখ করেছি নিজেকে জাহির করার জন্য নয়, বরং আমার কর্তব্য পালনে কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য। কর্তব্য পালনে সর্বদা আমি দেশকে নিজের চেয়ে ওপরে স্থান দিয়েছি। আমি ১৯১৫ সালে বালাে-খেল নামে একটা ছােট্ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করি। গ্রামটা মিয়ানওয়ালি শহর থেকে দু মাইল দূরে সিন্ধু নদের পূর্ব তীরে অবস্থিত। বর্তমান মিয়ানওয়ালি এবং মিয়ানওয়ালি জেলার ইসা-খেল তহসিল একসময় বান্ন জেলার অংশ ছিল।
ব্রিটিশরা এক অজ্ঞাত কারণে বান্ন জেলা থেকে এ অংশটা কেটে নেয়। এবং নতুন মিয়ানওয়ালি জেলা গঠন করে। ফয়সালাবাদ জেলার লুন্দিয়ানওয়ালায় চৌদ্দটি চক (গ্রাম) রয়েছে নিয়াজিদের, যারা বসতি স্থাপন করে ব্রিটিশদের মাধ্যমে। স্থানীয় লােকজন এ এলাকাকে এখনাে বান্ন টুকরি (খণ্ড) হিসেবে ডাকে। আমি জন্মগ্রহণ করি এক নিয়াজি পরিবারে। নিয়াজিরা হলাে আফগানদের বংশধর যারা গজনি ও কান্দাহার থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসে এবং ছড়িয়ে পড়ে ভারত ও পাকিস্তানে। নিয়াজিদের বেশির ভাগ লােক বাস করে মিয়ানওয়ালি জেলাতে, এ জেলার সিন্ধু নদের উভয় তীরে তাদের বসবাস, এটা পাঠানদের বসতির শেষ পূর্ব প্রান্ত। এছাড়া নিয়াজিরা উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জেলা বানু, কোহাট ও ডেরা ইসমাইল খান এবং বেলুচিস্তানের কোয়েটা ও পিসিন জেলাতেও বসবাস করে। করাচি ও ফয়সালাবাদেও তাদের বসতি রয়েছে। ১৯৪৭ এর আগস্টে দেশ বিভাগের পর ভারতের পাঞ্জাবের হােশিয়ারপুর ও জলন্ধরে বসবাসকারী বহু নিয়াজি পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে, যদিও কিছু রয়ে গেছে বিশেষ করে বেরিলি ও রামপুরে। নিয়াজিদের একটা বিরাট অংশ এখনাে আফগানিস্তানে রয়ে গেছে। নিয়াজিদের গ্রামীণ জীবনে পরিলক্ষিত হয় উপজাতীয় প্রথা ও ঐতিহ্য। আজকের দিনেও সেখানে বন্দুকের জয়। প্রতিশােধ এবং পাল্টা প্রতিশােধের ঘটনা সাধারণ দৃশ্য। প্রতিশােধ গ্রহণের আদিম ইচ্ছায় একটা পরিবার অধিক পুত্র সন্তান কামনা করে। সবচেয়ে বেশি মূল্য দেয়া হয় বন্ধুত্ব এবং আনুগত্যকে। নিয়াজিরা সৈনিক হিসেবে চাকরি করে আসছে শত শত বছর ধরে। সৈনিক বৃত্তি হলাে তাদের পেশা। তাদের কবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র। নিয়াজিদের মধ্যে কিছু বিখ্যাত জেনারেলের জন্ম হয়েছে। মােগল সম্রাট বাবর তার বইয়ে লিখেছেন যে হিন্দুস্তান অভিযানের সময় যখনই তিনি নিয়াজি অধীন ভূখণ্ড অতিক্রম করতেন, চলাচল কিংবা তাঁবুতে থাকাকালীন আক্রমণের ভয়ে তিনি নিজেই নিজের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখাশুনা করতেন।
নিয়াজিদের স্বর্ণযুগ শুরু হয় শের শাহ সুরি ক্ষমতায় এলে। ওলাফ ক্যারাে-এর মতে এ গােত্রের বিপুল সংখ্যক লােক শের শাহ-এর সেনাবাহিনীতে যােগ দেয়। ১৫৪০ সালে তার বিশ্বস্ত সেনাপতি হায়বাত খান, যিনি একজন নিয়াজি, বাবরের পুত্র মােগল বাদশাহ হুমায়ুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে বিরাট অবদান রাখেন। এরপর শেরশাহ পাঞ্জাব ছাড়েন হায়বাত খানের ওপর দায়িত্ব দিয়ে। হায়বাত খান ৩০,০০০ আফগান অশ্বারােহী সেনাদল নিয়ে দখল করেন রােটাস দূর্গ। যখন তিনি বালুচদের কাছ থেকে মুলতান এবং তার আশেপাশের অঞ্চল দখল করেন, তখন তাকে সর্বোচ্চ পদে উন্নীত করা হয় এবং তাকে খেতাব দেয়া হয় ‘মসনদ-ই-আলা, আজম হুমায়ুন’। এ খেতাব ইতােপূর্বে মাত্র দুজনকে দেয়া হয়। ইসা খান নিয়াজি শের শাহ কর্তৃক নির্বাচিত হয়েছিলেন ভারত থেকে হুমায়ুনকে বিতাড়িত করার জন্য। ১৯৬৫-এর যুদ্ধে সাবমেরিন গাজি-এর কমান্ডার হিসেবে অ্যাডমিরাল কেরামত রহমান নিয়াজি তার সাহসিকতা প্রমাণ করেছিলেন ভারতীয়দের বিরুদ্ধে। তার চমৎকার কৃতিত্বের জন্য তাকে এস জে (সিতারা-ই-জুরাত) খেতাব দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন মেহবুব খান নিয়াজি কোনাে পাকিস্তানি অফিসার যিনি প্রথম এসজে পুরস্কার পেলেন কাশ্মীর অপারেশনে। ১৯৬৫-এর যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য। ক্যাপ্টেন হেদায়েত উল্লাহ খান নিয়াজি (পরে মেজর জেনারেল) এবং মেজর আব্দুল রব নিয়াজি (পরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল) কে এসজে খেতাব প্রদান করা হয় । রেঞ্জার্সের নায়েক আব্দুল সাত্তার খান নিয়াজিকে পূর্ব পাকিস্তানে তাঁর সাহস ও বীরত্বের জন্য ভারতীয়রা সামরিক মর্যাদায় সমাধিস্থ করে। পুলিশের ডেপুটি সুপারেন্টেডেন্ট ইকরাম উল্লাহ খান নিয়াজিকে দস্যুদের বিরুদ্ধে অতুলনীয় সাহস দেখানাের জন্য পুলিশ পদক প্রদান করা হয়। তাঁর বীরত্বের নিদর্শন হিসেবে রাভি ব্রিজের কাছে (লাহাের) একটা গ্রামের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে। | খেলাধুলাও নিয়াজিরা নাম করেছেন। তারিক এবং কাইয়ুম নিয়াজি হকিতে অনেক আন্তর্জাতিক ম্যাচে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ক্রিকেট জগতের কিংবদন্তি ইমরান খান নিয়াজির কোনাে জুড়ি নেই। আমার ছেলে মেজর আমান উল্লাহ খান নিয়াজি হলাে পাকিস্তানের দ্রুততম দৌড়বিদ এবং আমার ছােট ছেলে হাবিব উল্লাহ নিয়াজি তেহরান থেকে ঢাকা পর্যন্ত একটানা গাড়ি চালনা প্রতিযােগিতায় ট্রফি পেয়েছে।
আমার ছেলেবেলায় গ্রামীণ জীবন ছিল সাধারণ । জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি ছিলেন। পরিবারের কর্তা এবং তার ছিল সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা। রাতে মুরব্বিরা বৈঠকখানায় বসে হুক্কা খেতে খেতে কিংবা এক চিমটি নস্যি নিতে নিতে গল্প করতেন। কাবাডি ছিল একটি জনপ্রিয় খেলা। দু’গ্রামের মধ্যে খেলা হতাে এবং ছেলে বুড়াে সবাই তা দেখতে। কোয়েল, তিতির এবং খরগােশ শিকার খুব জনপ্রিয় ছিল। বর্শা দিয়ে শূকর শিকার ছিল একটি সাধারণ খেলা। ছােট ছােট ছেলেদের ব্যক্তিগত অস্ত্র ছিল গুলতি, এটা তারা হাতে রাখত কিংবা গলায় ঝুলিয়ে রাখত। | গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল মাত্র একটি। মাধ্যমিক ও উচ্চ বিদ্যালয় ছিল মিয়ানওয়ালিতে। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় দু’মাইল দূরে। বাচ্চাদের কিংবা তাদের বাবা-মায়ের কারাে স্কুলের প্রতি আগ্রহ ছিল না। প্রতিটা শিশু যেত গ্রামের মসজিদে, প্রার্থনা করত এবং পবিত্র কোরান তেলওয়াত করত। গ্রামে প্রবেশিকা পরীক্ষাকে বিবেচনা করা হতাে উন্নতি লাভের সর্বোচ্চ সিড়ি। মিয়ানওয়ালি জেলায় কোনাে কলেজ ছিল না। ম্যাট্রিক পাশ করার পর আমি সেনাবাহিনীতে যােগ দিই ‘ওয়াই ক্যাডেট হিসেবে।
শুরুতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা ছিল ব্রিটিশ। ভারতীয়রা কেবল পদোন্নতি পেত সুবেদার-মেজর, সুবেদার অথবা জমাদার র্যাংকে যাকে বলা হতাে। ভিসিও (ভাইস রয়েস কমিশন্ড অফিসার্স)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সরকার কিছু নির্বাচিত ভারতীয়দের কমিশন প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এসব কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্যান্ডহান্টে পাঠান হতাে এবং তাদেরকে বলা হতাে কে সি ও (কিং’স কমিশনন্ড অফিসার্স)। পরে এ উদ্দেশ্যে দেরাদুনে ইনডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি (আই এম এ) খােলা হয়। আই এম এ-তে ঢুকতে হতাে উন্মুক্ত প্রতিযােগিতার মাধ্যমে, সশস্ত্র বাহিনী থেকেও কিছু কিছু প্রার্থীকে আই এম এ-তে নেয়া হতাে। তাদেরকে ইনডিয়ান আর্মি স্পেশাল ক্লাস উত্তীর্ণ হতে হতাে, তারপর মুখােমুখি হতে হতাে সিলেকশন বাের্ডের। দেরাদুন থেকে যেসব ক্যাডেট বের হয়ে আসত, তাদেরকে বলা হতাে আই সিও (ইনডিয়ান কমিশন্ড অফিসার্স)। এই আই সি ও দের আবাসিত করার জন্য কয়েকটা ভারতীয় ব্যাটালিয়ন ও রেজিমেন্ট গঠন করা হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
ইতােমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। পরিস্থিতি মােকাবেলার জন্য কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দানে অফিসার ট্রেনিং স্কুল খােলা হয়। অফিসার ট্রেনিং স্কুল থেকে বের হওয়া কর্মকর্তাদের ইসিও (ইমার্জেন্সি কমিশন্ড অফিসার্স) বলা হতাে। আমি ব্যাঙালাের অফিসার ট্রেনিং স্কুল থেকে বের হই ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ এবং নিয়ােগ পাই রাজপুত রেজিমেন্টে, যার ট্রেনিং সেন্টার ছিল ফতেহগড়ে। ব্যাঙালােরে প্রশিক্ষণ কালে আমাকে মেজর ব্লেয়ার-এর অধীনে একাদশ কোম্পানির ক্যাডেট কোম্পানি কমান্ডার হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয়। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ থেমে গেলে সব ইসিও-কে সিলেকশন বাের্ডে উপস্থিত থাকতে বলা হয় এবং যারা অনুমতি পায় তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর রেগুলার অফিসার হয়। এদেরকে এরপর থেকে বলা হতাে আই সি ও (ইনডিয়ান কমিশন্ড অফিসার্স)। আমি সিঙ্গাপুরে সিলেকশন বাের্ডে হাজির হই। আমি অনুমতি পাই এবং আইসিও ৯০৬ হই। | ট্রেনিং সেন্টার থেকে লে, প্যাডক ও আমি ওয়েস্টার্ন ডেসার্টে ৪/৭ রাজপুত ফাইটিংয়ে যােগ দিই। ১৯৪২-এর ৩০ অক্টোবর আমরা মিশরের উদ্দেশ্যে বােম্বাই থেকে জাহাজে চড়ি। জাহাজ থেকে পাের্ট ইসমাইলিয়ায় নামার পর আমাদেরকে নেয়া হয় মিনা ক্যাম্পে, ওটা কায়রাের উপকণ্ঠে পিরামিড গুলাের কাছে। আমাদের নিজ নিজ ইউনিটে পাঠানাের আগে অফিসার ও জওয়ানদের ব্যাপক অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এবং শত্রুর অস্ত্রশস্ত্র ও মরুভূমির প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলাে সম্পর্কে জ্ঞান দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ শেষ হয় মহড়ার মাধ্যমে, এ মহড়ায় কামান, মর্টার ও মেশিনগান থেকে তাজাগুলি ছােড়া হয়। মহড়ায় আমি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে আক্রমণ কারী কোম্পানির নেতৃত্ব প্রদান করি। আমার দক্ষতা ও গভীর আগ্রহ দেখে সিনিয়র অফিসাররা এত খুশি হন যে আমাকে মিনা ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়ােগ দেবার প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু আমি ক্যাম্পে দায়িত্বপালন করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি এবং ব্যাটালিয়নে যােগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করি। | আমাকে ৪/৭ রাজপুত রেজিমেন্টের ইনটেলিজেন্স অফিসার হিসেবে নিয়ােগ
দেয়া হয়। আমাদের ব্যাটালিয়ন ছিল ব্রিগেডিয়ার হিউজের নেতৃত্বাধীন ১৬১ ব্রিগেডের অংশ। মেজর জেনারেল ব্রিগস ছিলেন পঞ্চম ভারতীয় ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং। আমি যুদ্ধের বাস্তব অভিজ্ঞতা লাভ করি যা পরবর্তীতে ভারত, বার্মা, মালয়, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে অত্যন্ত কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়। পঞ্চম ভারতীয় ডিভিশনকে শীঘ্রই ইরাকে পাঠানাে হয় এবং এটা পারস্য-ইরাক ফোর্সের অংশে পরিণত হয়। ইরাকে সৈন্য সংগ্রহ করা হয় ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ইন্দো-ইউরােপীয় অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ইরান ও ইরাকে জার্মান আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য । | মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফিরে আমরা চলে যাই ফতেহগড়ে, আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে । ফতেহগড় থেকে আমরা যাই চাস-এ। এটা বিহারের রাঁচির কাছে একটা ছােট্ট শহর, যেখানে আমাদের ডিভিশনকে জড় করা হয় বার্মার উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগে জঙ্গল প্রশিক্ষণের জন্য। প্রশিক্ষণ এলাকা থেকে ১৬১ ব্রিগেডকে বাংলার টেকনাফ উপদ্বীপে সরিয়ে নেয়া হয়, যেটা বার্মা সীমান্তের খুব কাছে। আমাদের ব্যাটালিয়ন অবস্থান করে নিহলায় । এখানে আমরা ব্যাপক জঙ্গলযুদ্ধ প্রশিক্ষণ শুরু করি। আমাদের ব্রিগেডকে প্রথমে নির্দেশ দেয়া হয় বার্মার আরাকানে রাজালিন দুর্গ দখলের, যা আমরা সাফল্যের সঙ্গে শেষ করি। যদিও আমাদের প্রচুর ক্ষতি হয়, তবু আমরা মরুভূমি ও জঙ্গল যুদ্ধের পার্থক্য বুঝতে পারি ।
বাউথি-দায়ুং টানেল
আমাদের পরবর্তী অ্যাসাইনমেন্ট ছিল বাউথি-দায়ুং। এটা আরাকানের একটা ছােট শহর। শহরটা চারদিক দিয়ে নিচু পাহাড় ও ঘন জঙ্গল দিয়ে ঘেরা। বর্ষাকালে ভূমি ধসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার কারণে রেল লাইন যােগাযােগের গুরুত্ব বেড়ে যেত। পাহাড়ি এলাকায় যাবার জন্য ছিল দুটি রেল লাইন সুড়ঙ্গ, একটা থেকে আরেকটার দূরত্ব ছিল প্রায় একশ গজ, শহর থেকে সুড়ঙ্গের অবস্থান ছিল প্রায় এক হাজার গজ দূরে। শত্রুরা সুড়ঙ্গ দুটো ধ্বংস করে ফেললে কিংবা দখল করে নিলে বাউথি-দায়ুং অথবা সামনের দিকে আমাদের অভিযান থেমে যেত। অগ্রগামী সৈনিকদের কাছে মালপত্র পৌঁছে দেয়া নিশ্চিত করার জন্য সুড়ঙ্গ দুটোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া অপরিহার্য হয়ে ওঠে। সুড়ঙ্গ দুটো দখলের দায়িত্ব দেয়া হয় ১৬১ ব্রিগেডকে। ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন ৪/৭ রাজপুত, ১/১ পাঞ্জাবি এবং রয়্যাল ওয়েস্ট কেন্ট-এর কিছু গেরিলা প্লাটুন নিয়ে একটি গেরিলা কোম্পানি গঠন করেন। আমাকে এ গেরিলা কোম্পানির অধিনায়ক করা হয়। শক্রর সৈন্য সমাবেশের প্রতি দৃষ্টি রেখে দু পর্যায়ে সুড়ঙ্গ দুটো দখলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। প্রথম পর্যায়ে আমরা হামলা করি এবং দক্ষিণ সুড়ঙ্গ দখল করি। শত্রু পক্ষের পাঁচ জন মারা যায় এবং চার জন আহত হয়। এরপর বাম সুড়ঙ্গে। হামলা চালিয়ে তা দখল করা হয়। সাতটি মৃতদেহ ফেলে পালিয়ে যায় শক্ররা। আমাদের পক্ষে নিহত হয় দুজন এবং মারাত্মক আহত হয় আট জন।
আমার কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল কার্গিল এবং ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন খুশি হন এ অপারেশনের সফলতায়। আমাকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অর্ডার (ডিএসও) পদক প্রদানের জন্য সুপারিশ করা হয়। যদিও নিয়ম অনুযায়ী সিনিয়র অফিসারদের ডিএসও দেয়া হয়, কিন্তু আমিই একমাত্র লেফটেন্যান্ট (ভারপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন) যাকে এ পদকের জন্য মনােনীত করা হয়। সুপারিশে আমার কৃতিত্বের কথা উল্লেখ করা হয়। সেক্রেটারি অভ স্টেট কর্তৃক স্বাক্ষরিত যে প্রশংসাপত্র আমাকে প্রদান করা হয় তা নিচে দেয়া হলাে ৫ এপ্রিল, ১৯৪৫-এর লন্ডন গেজেটে প্রকাশিত সূত্র ও সুপারিশের ভিত্তিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭ম রাজপুত রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন (ভারপ্রাপ্ত) আমির আব্দুল্লাহ খান, এম. সি.-কে তার বীরত্বের জন্য আমি রাজার পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং তাকে প্রশংসাপত্র প্রদান করছি।
এস, আই, গ্রিস
সেক্রেটারি অভ স্টেট ফর ওয়ার
ইতােমধ্যে জাপানির বার্মা দখল করে ভারত আক্রমণ করে এবং আসামে ঢুকে পড়ে। ১৬১ ভারতীয় পদাতিক বাহিনীকে বার্মা থেকে আসামের কোহিমায় এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। উদ্দেশ্য অগ্রগামী জাপানিদের বাধা দেয়া। ৫ম ভারতীয় ডিভিশনের বাকি সৈন্যদের নির্দেশ দেয়া হয় আসামের ইম্ফলে যাবার জন্য। কোহিমাতে পৌছতে না পৌছতে জাপানিদের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। জাপানিদের প্রচুর ভারী মটার ও ভারী কামান ছিল, যেগুলাে তারা হাতি দিয়ে বয়ে আনে। জঙ্গল যুদ্ধে ছিল তারা অভিজ্ঞ, তারা দক্ষতা ও সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকে। তারা আমাদের ওপর অবিরাম চাপ সৃষ্টি করে অবস্থার পরিবর্তন ও সাঁড়াশি হামলা চালিয়ে। জাপানিদের অগ্রসর হবার এক মাত্র রাস্তাটি ছিল আমাদের নিয়ন্ত্রণে। গর্তে অবস্থান করার আগে আমাদের ওপর মর্টার ও কামানের গােলাবর্ষণ করে প্রচুর ক্ষতি করা হয়। আমাদের জীবিত সৈন্যরা গর্তে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করে এবং যােগাযােগ রক্ষা করে চলে নিজেদের মধ্যে। আমাদের চেয়ে জাপানিরা আশেপাশের উচু পাহাড় গুলাে দখল করে নেয়। তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে এবং গুলি করে। রাতের অন্ধকারে আমাদের তৎপরতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। | আমাদের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন ছিলেন সাহসী ব্যক্তি। তিনি আমাদের শিখিয়ে ছিলেন যে নিষ্ক্রিয়তা হচ্ছে মৃত্যুর সমান। তাই আমরা টহল, চোরাগুপ্তা হামলা ও নজরদারির মাধ্যমে আমাদের সৈন্যদের মনােবল জোরদার করে তুললাম। প্রায় এক সপ্তাহ পর আক্রমণের তীব্রতা কমে যায়, তবে অব্যাহত থাকে অবরােধ। আমাকে দায়িত্ব দেয়া হয় একটি জাপানি রসদবাহী সৈন্যদলের ওপর হামলা চালানাের । আমরা সফল হই। হামলায় দশ জনের সবাই মারা যায়। | শেষমেষ আমাদের উদ্ধার করার জন্য ২য় ব্রিটিশ ডিভিশন এগিয়ে আসে এবং তের দিন পর অবরােধ ভেঙে পড়ে। ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে তার সৈন্যদের মােতায়েন করেছিলেন এবং চমৎকারভাবে আত্মরক্ষামূলক কৌশল গ্রহণ করেছিলেন। সীমিত সম্পদ নিয়ে তিনি কোহিমায় তের দিন জাপানিদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করতে সক্ষম হন এবং এ অঞ্চল দখলে জাপানিদের আশা খুঁড়িয়ে দেন। তাকে ডি এস ও প্রদান করা হয়। জাপানিরা ভারতের অভ্যন্তরে আরাে অগ্রাভিযানের ঝুঁকি উপলব্ধি করতে পেরে তাদের পরিকল্পনা ত্যাগ করে এবং আসাম থেকে সৈন্য প্রত্যাহার শুরু করে সুশৃঙ্খলভাবে।
ঢালু পাহাড়ে ফাঁদ
দু’ সপ্তাহ বিশ্রামের পর আমাদেরকে ভাতা দেয়া হয়। ১৬১ ব্রিগেডকে নির্দেশ দেয়া হয় জাপানি সৈন্য প্রত্যাহারে বাধা, তাদের হয়রানি এবং তাদের দল ও যানবাহন ধ্বংস করতে। বিগ্রেডের পরিকল্পনা অনুযায়ী ৪/৭ রাজপুতকে নির্দেশ দেয়া হয় রাস্তা অবরােধ, শক্রদের ওপর হামলা ও তাদের হয়রানি করার। একজন লেফটেন্যান্ট হিসেবে ব্রাভাে ও চার্লি কোম্পানির সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় আমাকে। আমি ছিলাম। লেফটেন্যান্ট রিচার্ডসন এর সিনিয়র, তিনি চার্লি কোম্পানিকে নেতৃত্ব দিতেন। নিয়ম। অনুযায়ী দুটি সম্মিলিত কোম্পানির অপারেশনে নেতৃত্ব দিতে হয় ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড (২১/সি) কে। কিন্তু এই কঠিন মিশনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আমাকে। আমি এমন উচু জায়গায় সৈন্য মােতায়েন করি, যেখান থেকে গুলি করা। সহজ হয়। ট্রেনচগুলাে ছিল শত্রুদের ধোকা দেবার জন্য সঠিক। ফাঁদে ফেলতে আমরা জাপানিদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পরদিন একদল সৈন্য রাস্তা ধরে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি সুবেদার ভরত সিং-এর অধীনে একটি প্লাটুন পাঠাই আগে থেকে প্রস্তুত পেছনের একটি অবস্থানে, মূল। বাহিনী থেকে অগ্রসরমান জাপানি সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন করার জন্য। অগ্রসরমান জাপানি সেনাদল ভরত সিং-এর সেনাদলকে অতিক্রম করা মাত্র তাদের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু হয় এবং তাদেরকে মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় । আমরা গুলি করা থেকে বিরত থাকি। আমাদের অবস্থান অদখলকৃত ভেবে জাপানি সেনা কমান্ডার পাহাড়ের চূড়ার দিকে ছুটে যান কিন্তু তার সৈন্যরা আমাদের গােলাবর্ষণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। জাপানি কমান্ডার এক অংশ সৈন্য উদ্ধার করেন। এবং আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করেন। জাপানি অফিসাররা তলােয়ার বহন করায় তাদেরকে শনাক্ত করা সহজ হয়। লে, রিচার্ডসনকে সৈন্যদের দায়িত্বে রেখে আমি এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রু অধিকৃত একটি এলাকা ঘেরাও করি। ক্রলিং করে ও নিজেদেরকে আড়াল করে আমরা তাদের কাছে এসে পড়ি। এক ঘণ্টার মধ্যে বেশির ভাগ জাপানি সৈন্য।
নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তারা হয় তাদের নিজেদের গুলিতে আত্মহত্যা করে অথবা আমাদের গুলিতে মারা যায়। তারা কখনাে আত্মসমর্পণ করেনি। দলের কমান্ডার তখনাে জীবিত ছিলেন। তিনি ছিলেন গর্বিত ও দুঃসাহসী । তিনি অবজ্ঞার সঙ্গে তার তলােয়ার উচু করে ধরলেন এবং আমাকে আহ্বান করলেন তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে। আমি আমার লােকদের বললাম তাকে যেন গুলি না করে। দুজন জওয়ানকে পাঠালাম আশেপাশে কোনাে জাপানি সৈন্য আছে কিনা তা দেখতে। আমি আমার অবস্থান থেকে উঠে এলাম, জাপানি অফিসার যুদ্ধ করার ভঙ্গিতে দাঁড়ালেন। তিনি ছিলেন আমার চেয়ে বয়স্ক । কুদ্ধ ষাড়ের মতাে তিনি আমাকে আক্রমণ করলেন। আমি প্রতিহত করলাম তার আক্রমণ। তার দ্বিতীয় আক্রমণের সময় আমি তার গলায় বর্শা নিক্ষেপ করলাম। এটা আমি কিনেছিলাম কোহিমায় এক নাগার কাছ আমার সৈন্যরা শৃঙ্খলা ও সাহস প্রদর্শন করে। প্রশংসা করা হয় এ কর্মকাণ্ডের এবং আমাকে দ্রুত পদোন্নতি দেয়া হয়। বিগ্রেডিয়ার ওয়ারেন তখন আমাকে ‘টাইগার’ নাম দেন। এরপর থেকে আমি এ নামে পরিচিত হয়ে উঠি।
কিকরিমার টেকরিজ
রাজপুত রেজিমেন্টকে এরপর মােতায়েন করা হয় কিকরিমায়, এটা আসামের একটি গ্রাম। এলাকাটা ছিল পাহাড়ি এবং ঘন জঙ্গলে ঘেরা। সব ঋতুতে উপযােগী একটি রাস্তা কিকরিমা থেকে টেকরিজের দিকে গেছে, এরপর হঠাৎ বাঁক নিয়ে একটি এলাকা দিয়ে গেছে যেখানে ১/১ পাঞ্জাব, ১৬১ ব্রিগেডের আরেকটি ব্যাটালিয়ন মােতায়েন ছিল। জাপানিরা টেকরিজ দখল করে নিয়েছিল এবং তারা রাস্তাটি নিয়ন্ত্রণ করত। টেকরিজে শত্রুর শক্তি সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য লে. কর্নেল কারগিল আমাকে দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে আমার সেনাদল উঠিয়ে নিয়ে সেদিকে যাবার নির্দেশ দেন। আমি এ অপারেশনের বিস্তারিত বিবরণ দেব না। আমার কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল কারগিল যে রিপাের্ট তৈরি করেছিলেন এবং ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন অনুমােদন করেছিলেন, তা নিচে দেয়া হলাে। এতে যুদ্ধের সঠিক চিত্র ফুটে উঠেছে। “এই অফিসারকে ১৯৪৪ সালের ১১ জুন নির্দেশ দেয়া হয় আসাম বার্মা সম্মুখ ভাগের জেসামি সড়কে কিকরিমা এলাকায় আমাদের অবস্থানের বাইরে তার সেনাদলকে নিয়ে যাবার জন্য শত্রুর শক্তি সম্পর্কে ধারণা করতে। তিনি ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার্সে এসে রিপাের্ট করেন যে শক্রর অবস্থান খুব শক্তিশালী এবং তিনি অনেক বাংকার দেখতে পেয়েছেন। তার মতে, যদি তিনি হামলা চালাতেন তাহলে তিনি আকস্মিক বিজয় অর্জন ও শক্রর মারাত্মক ক্ষতি করতে পারতেন। ৩৫ জন সৈন্য (তখনকার দিনে কোম্পানি কমান্ডার সহ ৩৫ জন। সৈন্য নিয়ে একটা কোম্পানি গঠন হতাে) নিয়ে তাকে এ হামলা চালানাের অনুমতি
দেয়া হয়। এত দক্ষতার সঙ্গে তিনি অভিযান পরিচালনা করেন যে তার অগ্রবর্তী প্লাটুন শত্রুর তিনটি বাংকার পুরােপুরি ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। অগ্রবর্তী প্লাটুনে প্রাণহানি শুরু হলে ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ নিজে দ্বিতীয় প্লাটুনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এবং শক্রর তিনটে বাংকার দখল করেন। অগ্রবর্তী প্লাটুন রিপাের্ট করে শত্রুরা পাল্টা হামলার জন্য তাদের দক্ষিণ পার্শ্বে সংগঠিত হচ্ছে । | ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ প্রচণ্ড গােলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে সুনিপুণভাবে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যান এবং ই ওয়াই রাইফেলের সাহায্যে পাঁচটি গ্রেনেডের সব কটি ছুঁড়ে মারেন। এতে শত্রুপক্ষের অন্তত ৩০ জন মারা যায় এবং তিনি শক্রর পাল্টা হামলার প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। এরপর তিনি তার সেনাদলের অবস্থান পুনর্বিন্যাস করেন। এবং শত্রুর অব্যর্থগুলি ও প্রচণ্ড হামলার মুখে তার অবস্থান ধরে রাখেন। তাকে অবস্থান ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হলে অত্যন্ত দক্ষতা ও ঠাণ্ডা মাথায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সব। প্লাটুন প্রত্যাহার করেন, এ সময় প্রতিবার তিনি সবার পেছনে থাকতেন। যুদ্ধে জাপানিরা কমপক্ষে ৬০ জন মারা যায়। এরপর দিন জাপানিরা ছেড়ে যায় এলাকা যার কৃতিত্ব ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহর। | বিজয়ের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয় আমাদের; আট জন মারা যায়, বাকিরা। আহত হয়, কেউ সামান্য এবং কেউ মারাত্মক। তিনটি গুলি লাগে আমার। একটি গুলি আমার রসদবাহী থলে ভেদ করে উরুতে, দ্বিতীয়টি আমার কাঁধের ব্যাগ ছিড়ে ফেলে এবং তৃতীয়টি ছিড়ে ফেলে আমার বুটের তলা। আমার ক্ষতগুলাে মারাত্মক ছিল না। ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার্স একটু উঁচু জায়গায় থাকায় সেখানে থেকে লক্ষ্যস্থল দেখা যেত। লে. কর্নেল কার্গিল এবং ব্রিগেডিয়ার জাডি ওয়ারেন যুদ্ধের অগ্রগতির পুরাে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন বাইনােকুলারের সাহায্য। টেকরি দখলের পর লে. কর্নেল কার্গিল নীরবতা ভেঙে আমাকে অভিনন্দন জানান আমার সৈন্যদের চমৎকার কৃতিত্বের জন্য। যুদ্ধের ফলাফলে খুব আনন্দিত হন ব্রিগেডিয়ার ওয়ারেন। আমাকে তৎক্ষণাৎ মিলেটারি ক্রস (এম সি) পদক দেয়া হয়। কোর কমান্ডার, টেলিফোনে অভিনন্দন জানান আমাকে। সরকারি নথি পরে পাঠান হয়।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান
বার্মার যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। ১৪তম আর্মি কমান্ডার জেনারেল স্লিমকে নাইট এবং তার তিনজন সেনা কমান্ডার ও কিছু সিনিয়র অফিসারকে পুরস্কার দেয়া হয়। একই দিনে একজন ভারতীয় অফিসার ও আরাে একজন ভারতীয় ভাইসরয় কমিশন্ড অফিসার (ভিসিও) কেও পুরস্কৃত করা হয়। ভারতের ভাইসরয়ের কাছ থেকে একজন ভারতীয় অফিসারের যুদ্ধের জন্য পুরস্কার হিসেবে পদক প্রাপ্তি এক বিশাল সম্মানের ব্যাপার। ১৪তম আর্মি থেকে আমিই ছিলাম সেই ভারতীয় অফিসার যাকে এই সম্মান দেয়া হয় এবং যতদূর মনে। পড়ে সুবেদার মান বাহাদুর থাপা ভিসিওকেও মনােনীত করা হয়। ভারতের সবচেয়ে। উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা স্কোয়াড্রন লিডার মেহের সিং অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেন পদকগুলাে ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের কাছে হস্তান্তর । করেন, তিনি নিজ হাতে এসব পদক পিন দিয়ে আমাদের বুকে এঁটে দেন। এরপর, লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন জাভা পৌছলেন, তাকে ৫ম ভারতীয় ডিভিশন গার্ড। অভ অনার প্রদান করে। এ গার্ড গভ অনারে নেতৃত্ব আমি দেই ফৌজি আক-এ সংবাদ প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ সালের ২৫ মে। পূর্ব এশিয়ার সর্বাধিনায়ক অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেন যখন নেদারল্যান্ডের ইস্ট ইন্ডিস সফরকালে বাটাভিয়া সফর করেন, সেখানে বিমান বন্দরে তাকে অভ্যর্থনা। জানান মেজর নিয়াজি, এম সি, গ্রাম-বাললা খেল, ডাকঘর-মিয়ানওয়ালি, পাঞ্জাব। মেজর নিয়াজি রাজপুত রেজিমেন্টের ৪র্থ ব্যাটালিয়ন আয়ােজিত গার্ড অভ অনারের কমান্ডার ছিলেন। অ্যাডমিরাল মাউন্টব্যাটেন মেজরের প্রশংসা করেন তার চৌকস উপস্থিতির জন্য। এবং যুদ্ধে তার বীরত্ব সম্পর্কে তিনি খোঁজ নেন। মেজর নিয়াজি সেনাবাহিনীতে যােগ দেন ১১ বছর আগে, তিনি পশ্চিম মরুতে ৫ম ডিভিশনে দায়িত্ব পালন করেন, যতদিন না তাদেরকে বার্মা ফ্রন্টে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৪৩ সালে সামরিক রিপাের্টে তার কথা উল্লেখ করা হয় এবং কোহিমার জঙ্গলে অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন ও নেতৃত্ব। দানের জন্য তাকে মিলিটারি ক্রস প্রদান করা হয়। তিনি এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন-‘ডি’ কোম্পানির, যেটা ব্যাটালিয়নের দুটি মুসলিম কোম্পানির একটি।
মেজর নিয়াজি গত বছর সুরাবায়া পৌঁছান এবং এমন একটি অভিযানে । অংশগ্রহণ করেন যার ফলে এ শহর সশস্ত্র দস্যুমুক্ত হয়। এরপর তার ব্রিগেড বাটাভিয়ায় স্থানান্তরিত করা হয় যেখানে থেকে তারা বান্দুং-এ শরণার্থীদের জন্য। খাদ্য বােঝাই করা কনভয় পাহারা দিয়ে পৌঁছে দেন। ভারতে প্রত্যাবর্তন বার্মা থেকে আমাদেরকে সিঙ্গাপুর আক্রমণের জন্য পাঠান হয়, কিন্তু এ আক্রমণ। শুরু হবার আগে জাপানিরা আত্মসমর্পণ করে। ওখান থেকে আমাদের ইন্দোনেশিয়া। পাঠান হয়। প্রায় তিন মাস ওখানে অবস্থান করি আমরা, তারপর ভারতে ফিরে যাই। | আমরা জাভা ত্যাগ করি ১৯৪৬ সালের ৩০ মে। জাকার্তায় জাহাজে চড়ে যাত্রা। করি, নামি মাদ্রাজে। ৫ম ভারতীয় ডিভিশন ছিল রাচিতে। অধিকাংশ পদে রদবদল করা হয়। আমাদের নতুন কমান্ডিং অফিসার ছিলেন একজন বৃদ্ধ ইংরেজ, নাম । বার্টন। ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন দক্ষিণ ভারতের ব্রিগেডিয়ার থােরাট। ডিভিশনাল।
কমান্ডার ছিলেন জেনারেল রাসেল, তিনি পরিচিত ছিলেন রাসেল পাশা নামে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল ব্যাংকেন ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ড কমান্ডার। অবিলম্বে আমি ট্যাকটিক্যাল কোর্স করার জন্য দেরাদুনের কাছে ক্লিমেন্ট টাউনে যাই। এ কোর্সে উধ্বর্তন ব্রিটিশ ও ভারতীয় অফিসাররা যােগ দেন। আমাদের দুজন কিং’স কমিশন্ড অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল মােহাম্মদ আফজাল জানজুয়া এবং মেজর আফজাল শেখ, যিনি পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোয়াটার মাস্টার। জেনারেল হয়েছিলেন। এ কোর্সে অনেক ভারতীয় কমিশন প্রাপ্ত অফিসারও। অংশগ্রহণ করেছিলেন। আমি এভারেস্ট গ্রেডের চেয়ে ভালাে করি এবং আমাকে। ইন্সট্রাক্টর হিসেবে ক্লিমেন্ট টাউন ট্যাকটিক্যাল স্কুলে নিয়ােগ দেয়া হয়। | দেশ বিভাগের সময় আমি ক্লেমেন্ট টাউনে ইন্সট্রাকটর ছিলাম। যেসব ছাত্র। এখানে কোর্স করছিলেন তাদের অনেকেই ছিলেন মুসলমান। সেখানে কর্মরত। অনেক কেরানিও ছিলেন মুসলমান। কায়েদ-ই-আজম -এর প্রচেষ্টায় অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে রওনা হবার জন্য আমরা আমাদের জিনিসপত্র গােছাতে। থাকি।
পাকিস্তানে আগমন
অগ্রবর্তীদল হিসেবে আমাকে পাকিস্তানে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। পালামপুর বিমানবন্দরে আমি বিমানে আরােহণ করি এবং অবতরণ করি লাহােরে। আমি । রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে যাই। সেখানে আমি রিপাের্ট করি। কর্নেল লাউদার (পরে মেজর জেনারেল)-এর কাছে যাকে নিয়ােগ দেয়া হয়েছিল স্টাফ কলেজের কমান্ড্যান্ট হিসেবে। তিনি আমাকে কোয়েটা যাবার নির্দেশ দেন। যেখানে অন্য ইন্সট্রাক্টররাও যাচ্ছেন। আমাকে জানান হয় যে, লেফটেন্যান্ট কর্নেল । ইয়াহিয়া খান (পরে জেনারেল এবং সি-ইন-সি) সেখানে রয়েছেন। আমি কর্নেল। ইয়াহিয়ার কাছে স্টাফ কলেজকে কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজ নামকরণ এবং এটাকে দুটি অংশে-স্টাফ ও ট্যাকটিক্যাল করার প্রস্তাব দিই। আমাকে ট্যাকটিক্যাল উইং এর কাজ চালাবার জন্য শ্রেণীকক্ষগুলাের অর্ধেকটা নিতে বলা হয়। স্টাফ কলেজের লাইব্রেরি ছিল অবিভক্ত ভারতের সেরা লাইব্রেরি । অনেকে। অন্যায়ভাবে অভিযোেগ করেছেন যে, দেশ বিভাগের পর তারা এর মালিকানা নিয়ে নেয়; এটা আমি কী করেছিলাম তার সত্যি গল্প । যখন আমি কোয়েটা পৌঁছলাম, সেখানে ইতােমধ্যে হিন্দু, শিখ ও ব্রিটিশ ছাত্র, স্টাফ ইনস্ট্রাক্টররা রয়েছে। মেজর লতিফ (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার লতিফ, যিনি রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন) এ কলেজের একজন ছাত্র। ছিলেন। তাকে লাইব্রেরির দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। লাইব্রেরিয়ান ছিলেন একজন ভারতীয় খ্রিস্টান যিনি লাইব্রেরির গুরুত্বপূর্ণ বইগুলাে লুকাতে শুরু করেছিলেন। লাইব্রেরিয়ান এবং লতিফের মধ্যে বিবাদ শুরু হয়। পরিস্থিতি খারাপের
দিকে গেলে লে. কর্নেল ইয়াহিয়া খান আমাকে এ লাইব্রেরির দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেন। আমি লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে সমঝােতা করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার আচরণ ছিল নােংরা। শীঘ্রই আমি উপলব্ধি করি যে অন্য কৌশল অবলম্বন করে লাইব্রেরির দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তাই আমি ক্যাপ্টেন ইসহাককে বালুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে, যেটা কোয়েটাতে অবস্থিত, সেখানে যেতে বলি এবং সেখান থেকে এক সেকশন পদাতিক সৈন্য নিয়ে আসতে বলি। লাইব্রেরিয়ান লাইব্রেরি বন্ধ করতে গেলে আমি তাকে ঘুষি মারি এবং চাবি ছিনিয়ে নিই। ক্যাপ্টেন ইসহাককে আমি নির্দেশ দেই একজন সশস্ত্র প্রহরী মােতায়েনের যাতে কেউ লাইব্রেরির তালা ভাঙতে পারে। আমি অফিসারদের ফেরত দেয়া বইগুলাে সংরক্ষণে একটি রুমের ব্যবস্থা করি যে পর্যন্ত না নতুন লাইব্রেরিয়ান দায়িত্ব গ্রহণ করে। যখন আমি লে. কর্নেল ইয়াহিয়া খানের কাছে রিপাের্ট পেশ করলাম, তিনি বললেন, “ঠিক আছে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত কিছুদিন অদৃশ্য থাকুন।’ তাই করলাম আমি। |
১৯৪৮ সালের শেষটা পর্যন্ত আমি কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে নিয়ােজিত। ছিলাম। স্টাফ কলেজের পর্ব আমি শেষ করি ১৯৪৯ সালে এবং আমাকে পিএসসি। (পাসড স্টাফ কলেজ) পুরস্কারে ভূষিত করা হয় । | কোয়েটা থেকে আমাকে কোহাটে অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড টু হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয়। কর্নেল হালসে, যিনি ছিলেন স্টাফ কলেজের ট্যাকটিক্যাল উইং-এর কমান্ডিং অফিসার, তাকে অফিসার ট্রেনিং স্কুলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয় । ১৯৫১ সালে ডিএসও জেনারেল মােহাম্মদ আকবর খানের যােগসাজসে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র সংঘটিত হয়। এ সময় তাল-এ অবস্থানরত ২/১ পাঞ্জাব এর নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল এন. এম. আবরার। ব্যাটালিয়নের অ্যাডিজুট্যান্ট ছিলেন ক্যাপ্টেন খিজির। এ রকম অভিযােগ ছিল যে, আবরারের নেতৃত্বাধীন ২/১ পাঞ্জাব। পিন্ডিতে পৌছে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করবে এবং সিনিয়র অফিসারদের গ্রেফতার করবে। কিন্তু তার বদলে আবরার ও খিজির গ্রেফতার হয়ে যান। কমান্ডিং অফিসার গ্রেফতার হওয়ায় ২/১ পাঞ্জাব নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। জেনারেল মােহাম্মদ আয়ুব খান, দ্য সি-ইন-সি, ২/১ পাঞ্জাব -এর নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একজন সৎ ও দক্ষ অফিসারকে নিয়ােগের নির্দেশ দেন। তার প্রথম কাজ হবে ২১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্টদের সম্পর্কে তদন্ত করা ও রিপাের্ট প্রদান করা। আমাকে ২/১ পাঞ্জাব-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নির্বাচিত করা হয় ও নিয়ােগ দেয়া হয়, যদিও আমি ১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কেউ ছিলাম না। আমি ছিলাম ৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এবং অনেকের চেয়ে জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদোন্নতি দিয়ে আমাকে এ পদে নিয়ােগ দেয়া হয়। ১৯৫১ সালের এপ্রিলে আমি কমান্ড গ্রহণ করি।
পুংখানুপুঙ্খ তদন্তের পর আমি ব্যাটালিয়নের কোনাে দোষ দেখতে পেলাম না। এবং আমি এ সংক্রান্ত একটি রিপাের্ট দাখিল করলাম। ব্যাটালিয়নকে লাহােরে স্থানান্তর করা হয় এবং প্রশিক্ষণ মৌসুমের পর এটিকে ১০ ডিভিশনের শ্রেষ্ঠ ব্যাটালিয়ন হিসেবে ঘােষণা করা হয়। ফিল্ড মার্শাল অচিন লেক আমাদেরকে পরিদর্শন করেন ১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কর্নেল কমান্ড্যান্ট হিসেবে। পরিদর্শন শেষে তিনি বলেন, ৬৬ (২/১ পাঞ্জাবের পুরান নাম)-এর অবস্থা খুব ভালাে এবং যে। কোনাে বিচারে এটি শ্রেষ্ঠ ব্যাটালিয়ন হওয়ায় দাবি রাখে। আমি সত্যি এ ব্যাটালিয়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছি। আমার কমান্ড ছিল ২৪ অক্টোবর ১৯৫৩ পর্যন্ত। ২১ পাঞ্জাব থেকে আমাকে নিয়ােগ দেয়া হয় কোয়েটার স্কুল অভ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিস-এ। আমি ক্লাস ‘এ’ ইনস্ট্রাক্টর হিসেবে জুনিয়র লিডারস উইং-এর দায়িত্ব গ্রহণ করি। এ স্কুলে আমি দায়িত্বে থাকি ২৬ আগস্ট ১৯৫৬ পর্যন্ত, এরপর আমাকে নিয়ােগ দেয়া হয় ৮ ডিভিশনে জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড হিসেবে। এটাও কোয়েটায় অবস্থিত। আমি ৮ ডিভিশনে থাকি ২০ জুন ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত। এরপর আবার রেজিমেন্টের কাজে ফিরে যাই। আমাকে ১/১৪ পাঞ্জাব (৫ পাঞ্জাব শেরডিলস) রেজিমেন্টে নিয়ােগ দেয়া হয়, এটি পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকায় অবস্থিত। আমি ৮ ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং জেনারেল বখতিয়ার রানা, এম সি,-কে আমার ডিউটির দু’ বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই আমার বদলির কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাই। তিনি উত্তর দেন, ‘আমি আমার ডিভিশনে তােমাকে। নিয়ােগ দেয়ার জন্য সামরিক সচিবকে অনুরােধ করেছিলাম। আমি খুব খুশি তােমার কাজ ও শৃঙ্খলায় । কিন্তু তােমার বর্তমান নিয়ােগ হয়েছে কমান্ডার ইন চিফ জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে। যেহেতু ১/১৪ (শেরডিলস) হলাে চিফের নিজের ব্যাটালিয়ন, তাই তিনি সব সময় নিজে ১৪ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার নির্বাচন করেন।’ সুতরাং আমাকে আবার রেজিমেন্টাল কাজ পরিবর্তন করতে হয়। ৮ পাঞ্জাব থেকে ১ পাঞ্জাবে পরিবর্তিত হই এবং এরপর আমি ১৪ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের হয়ে যাই। ১/১৪ পাঞ্জাব (শেরডিলস) ছিল মেজর জেনারেল ওমরাও খান, একজন দক্ষ জেনারেল-এর নেতৃত্বাধীন ১৪ ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার্স ব্যাটালিয়ন। ঢাকায় অবস্থান কালে শেরডিলস অফিসারদের ভারসাম্য রক্ষা, সম্মান এবং সৈন্য বহনে সুনাম অর্জন করে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি রাস্তা আমার নামে টাইগার রােড” নামকরণ করা হয়। এ নাম পরিবর্তন করা হয়নি। ক্যপ্টেন গওহর আইয়ুব, জাতীয় পরিষদের সাবেক স্পিকার, লে, আসিফ নেওয়াজ, পরে সি ও এ এস, এবং লে. আলম জান মাসুদ, পরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সবাই ১/১৪ পাঞ্জাবে আমার নেতৃত্বে কাজ করেছেন।
পূর্ব পাকিস্তানে আমার কর্তব্য সফলভাবে শেষ হবার পর আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে জাহাজে উঠি ১৯৫৭ সালের ১০ নভেম্বর। করাচি থেকে ১/১৪ পাঞ্জাবকে ট্রেনযােগে লাহরে নেয়া হয়। সেখানে আমরা ১০৬ তম ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত হই যার নেতৃত্বে ছিলেন ১০ ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার ওয়াহিদ হায়দার এবং জেনারেল অফিসার কমান্ডিং হিসেবে মেজর জেনারেল আজম খান। লাহােরে আসার পর থেকে আমরা সেনাবাহিনীর একটা নতুন ট্যাকটিক্যাল প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করি যেটা নিউ কনসেপ্ট’ নামে পরিচিত। এটা ছিল কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল আইয়ুব খানের আইডিয়া। এ কনসেপ্টের মূল বিষয়বস্তু যাতে প্রত্যেক অফিসার বুঝতে পারে সেজন্য পেপারগুলাে লিখতে হতাে, আলােচনা করা হতাে, কিন্তু কাক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়নি। এ কারণে প্রতিরক্ষা কৌশলের সব দিক তুলে ধরার জন্য ডেমােন্সট্রেশনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। | ১০৩ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার গুল মওয়াজকে দেয়া হয় ডেমােন্সট্রেশনের দায়িত্ব। ১০৩ ব্রিগেডের অবস্থান লাহাের ক্যান্টনমেন্টে। মেজর জেনারেল (পরে জেনারেল) হামিদ ও তার স্টাফ অফিসার কর্নেল উমর (পরে মেজর জেনারেল) পেপারওয়ার্ক করছিলেন। এ সময়ে একজন পরামর্শ দিল যে যেহেতু লে. কর্নেল নিয়াজির যুদ্ধে বিরাট অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তিনি একজন ইনস্ট্রাক্টরও ছিলেন। তাই ডেমােন্সট্রেশনের দায়িত্ব তার ওপর ছেড়ে দেয়া হােক। সুতরাং আমার ব্যাটালিয়ন। ১০৬ ব্রিগেড থেকে ১০৩ ব্রিগেডে স্থানান্তরিত হয়। আমার ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় প্রতিরক্ষা কৌশলের ডেমােন্সট্রেশন প্রদানের-আমাদের নতুন কনসেপ্ট।
আমি টিলা ফিল্ড ফায়ারিং এলাকায় ট্যাকটিক্যাল কনসেপ্ট অনুযায়ী ব্যাটালিয়নকে বিভিন্ন পর্যায়ে মােতায়েন করি। কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খান এবং আমন্ত্রিত বিদেশি মিলিটারি অ্যাটাশে গণ-ডেমােন্সট্রেশন প্রত্যক্ষ করেন। ডেমােন্সট্রেশনে শেরডিলস-এর উচু মানের কর্মকাণ্ড দেখে মুগ্ধ হন জেনারেল আইয়ুব খান।
আমি ৫ পাঞ্জাব (শেরডিল)-এর নেতৃত্ব দেই ১০ জুন ১৯৬১ পর্যন্ত। এরপর আমাকে নিয়ােগ দেয়া হয় ৫১ ব্রিগেডে, তার কমান্ডার হিসেবে। এ ব্রিগেডকে সিয়াটোর অধীনে লাওসে পাঠানাের জন্য মনােনীত করা হয়। তখন আমি ছিলাম একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার ব্যাংকে পদোন্নতি লাভ করার মতাে যথেষ্ট সিনিয়র নই। তবু ৫১ ব্রিগেড কমান্ড করার জন্য নির্বাচন করা হয় আমাকে। আমাকে রাতারাতি পদোন্নতি দেয়া হয়। লাওসে চ্যালেঞ্জ মােকাবিলার জন্য আমাকে ব্যাপক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা যাইনি। এর কারণ জানান হয়নি আমাদের। | করাচিতে ৫১ ব্রিগেড কমান্ডিং ছাড়াও আমাকে করাচি ও সিন্ধুর সামরিক প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বিভিন্ন মহলের চাপ ও প্রলােভনের মুখে কাজ করতে হয়েছে আমাকে। আল্লাহর রহমতে আমি করাচি ও সিন্ধুকে ভালােভাবে এবং সুনামের সঙ্গে শাসন করি। আমাকে সিতারা-ইন-খিদমত পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
গােপনীয়
সংযুক্ত ‘সি’
পত্র-৪৭৭ এর প্রতি সম্মানের নিদর্শন স্বরূপ এস. কে. সম্মামনা। ব্রিগেডিয়ার আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, এইচ জে, এস কে, এম সি। করাচি, হায়দ্রাবাদ, মিরপুর খাস ও বাহওয়ালপুর-এর সিভিল ডিভিশনগুলাের উঠতি ফসল ও ফলবাগান পঙ্গপালের উপদ্রবে ধ্বংস হওয়ার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল, যদি একজন ব্যক্তিকে এসব রক্ষা কৃতিত্বের জন্য বাছাই করতে হয়, তাহলে তিনি হলেন। ব্রিগেডিয়ার আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজি, এম সি, কমান্ডার ৫১ ব্রিগেড। তাকে খুব। সংক্ষিপ্ত নােটিশে পঙ্গপাল দমনের অভিযানের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়। তার সম্পদের পরিমাণ ছিল সীমিত এবং এছাড়া তাকে বিভিন্ন ধরনের বেসামরিক সংস্থাও নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছে। পঙ্গপাল নির্মূলে বিভিন্ন সংস্থার কর্মকাণ্ডের সমন্বয় সাধনে সফল ব্রিগেডিয়ার নিয়াজি, এতে তার বিরাট দক্ষতা, কৌশল, সহিষ্ণুতা ও যােগ্যতার পরিচয় ফুটে ওঠে। | প্রথম দিকে করাচি ও হায়দ্রাবাদের সিভিল ডিভিশন গুলােতে এ অভিযান সীমাবদ্ধ ছিল। পরে এ অভিযান বিস্তৃত হয় খায়েরপুর ও বাহাওয়ালপুরে। এতে প্রচণ্ড চাপ পড়ে তার সম্পদের ওপর। কিন্তু বিশাল মনােবল ও অটল বিশ্বাসে বলীয়ান হওয়ায় তিনি এ সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠেন। এ কাজে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেন তার অধীনস্থ সৈন্য ও সম্পদ। পুরাে অভিযানে তার আচরণ ও কাজ সবাইকে-বিশেষভাবে বেসামরিক প্রশাসনকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং এতে সেনাবাহিনীর সম্মান বেড়েছে। এক মাসের বেশি দিনে প্রায় ২০ ঘণ্টা পরিশ্রম করা সত্ত্বেও তার মুথ প্রফুল্ল ও সতেজ
গােপন তথ্য
৫১ ব্রিগেড থেকে আমাকে কমান্ড্যান্ট হিসেবে স্কুল অভ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস-এ নিয়ােগ দেয়া হয়। আমি সেখানে ১৬ নভেম্বর ১৯৬৩ থেকে ১২ মে ১৯৬৫ পর্যন্ত কর্মরত ছিলাম। সেখানে কঠোর পরিশ্রম করতাম এবং বিশ্রামের জন্য সময় পেতাম খুব কম। সৈন্যবিহীন পুরান ট্যাকটিক্যাল মহড়াগুলাে আবার লেখা হয়। এবং নতুন মহড়া প্রবর্তন করা হয়। আমি যুদ্ধ পরিচালনা সংক্রান্ত একটি নমুনা মহড়া চালু করি, যেটা খুব প্রশংসিত হয় এবং সেনাবাহিনীর কিছু ধরন এ মহড়া প্রবর্তন করে। এছাড়া আমি সেনাবাহিনীকে রােটেটিং রাইফেল রেঞ্জ সিস্টেমও। উপহার দেই। এ ব্যবস্থায় সময় ও জনশক্তি বেঁচে যায়। আমি ট্যাংক বিধ্বংসী। কামান ও মাঝারি মেশিনগানের জন্য নতুন ট্রেঞ্চ খনন করার কৌশল উদ্ভাবন করি। সেনাবাহিনীতে, বিশেষ করে ৮ ও ১০ ডিভিশন প্রতিরক্ষা এলাকায় এখনাে আমার উদ্ভাবিত ট্রেঞ্চ কার্যকর রয়েছে।
সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)