You dont have javascript enabled! Please enable it! দুই পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্বের কারণগুলো কী - নিয়াজির লেখার অনুবাদ - সংগ্রামের নোটবুক

বিচ্ছিন্নতার জন্য দায়ী ঘটনাগুলাে

পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা ছিল ভাগ্য ও অভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের বন্ধনে বাঁধা। বিদেশি বিশেষজ্ঞরা ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতার দিকে তাকিয়ে পাকিস্তানকে একটি অস্বাভাবিক রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করতেন।  দেশ ভাগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসরত অধিকাংশ হিন্দু ভারতে চলে যায়। এটা পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ঘটে নি । ধনী ও ক্ষমতাবান হিন্দুরা এখানে থেকে যায়। মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও তাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু ভূস্বামী ও ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুগত। হিন্দুদের মধ্যে শিক্ষার হার বেশি হওয়ায় স্কুল-কলেজের অধিকাংশ শিক্ষকই ছিলেন হিন্দু। এসব শিক্ষক ছাত্রদের শৈশবকালে তাদের চিন্তাধারা গঠনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। পশ্চিম পাকিস্তানিদেরকে সাম্রাজ্যবাদী, উৎপীড়ক ও শােষক হিসেবে চিহ্নিত করা হতাে। এভাবে রােপণ করা হতাে অসন্তোষের বীজ।  ধর্ম ছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর কোনাে বিষয়ে মিল ছিল না। ভৌগােলিক দূরত্ব ছিল একটি বাধা, এতে উভয় প্রদেশের মধ্যে যােগাযােগ বিঘ্নিত হয়। ভাষা ছিল আলাদা। রীতি-নীতি এবং আচার-আচরণও আলাদা। খাদ্যাভ্যাস। ছিল ভিন্ন। পােশাক-পরিচ্ছদও একরকম ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতির সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতির সংঘাত হতাে। প্রত্যেকে বিশ্বাস করতে তাদের নিজেদের মূল্যবােধ, ঐতিহ্য, সামাজিক প্রধা ও নিয়ম-কানুনে।  পশ্চিম পাকিস্তান ছিল ভূস্বামীদের দুর্গ। যারা পরিচিত ছিলেন খান, চৌধুরী, মীর ও ওয়াধেরা হিসেবে। তারা ছিলেন খুব ক্ষমতাবান, মহাজন। কৃষকরা ছিল তাদের প্রতি পুরােপুরি অনুগত। পক্ষান্তরে, পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে। সাধারণ মানুষের ওপর বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও আইনজীবীদের প্রভাব ছিল উল্লেখযােগ্য। সময়ের ব্যবধানে দুটি অংশের মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। সবচেয়ে বিস্ফোরিত বিষয় ছিল ভাষা। বাঙালিরা উর্দু ভাষাকে জাতীয় ভাষা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় এক বিশাল সমাবেশে কায়েদে আযম উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘােষণা করেন, কিন্তু বাঙালিরা ধারণা করে যে, তাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি জানায়। তারা ভাষার মাধ্যমে তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার ইচ্ছা প্রকাশ করে। বাঙালিরা দেখতে পায় যে, রাষ্ট্র ভাষা উর্দু হলে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় আরাে পিছিয়ে পড়বে। পশ্চিম পাকিস্তানিরা ইতােমধ্যেই সশস্ত্র বাহিনী ও সিভিল সার্ভিসে এগিয়ে গিয়েছিল।

এ কারণে বাঙালিরা তাদের দাবির প্রশ্নে অনড় ভূমিকা পালন করে। তারা রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে আন্দোলনে নামে। এভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের সংঘাত বেধে যায়। বাঙালিদের দাবি আদায় না। হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৫৪ সালে বাংলাকে দেশের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। তখন এ ইস্যু নিষ্পত্তি হয়, কিন্তু থেকে যায় ক্ষত। এভাবে বইতে শুরু করে ঘটনাস্রোত। অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানিরা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে যে, যদি জনসংখ্যানুপাতে কেন্দ্রীয় সরকারে বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধিত্ব মেনে নেয়া হয় তাহলে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়বে। তারা বাঙালি রাজনীতির ওপর হিন্দু প্রভাবে শংকিত হয়ে ওঠে। জনসংখ্যার কুড়ি শতাংশ যেখানে শিক্ষিত হিন্দু এবং সমাজ জীবনের সকল স্তরে যেখানে তাদের প্রভাব সেখানে জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারে তাদের রুখবে কে? বাঙালিরা সরকার গঠন করলে সেখানে হিন্দু স্বার্থকেই প্রাধান্য দেয়া হবে। এ কারণে হিন্দু প্রভাব খর্ব করার জন্য প্যারিটি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, প্যারিটি ব্যবস্থার আওতায় উভয় অংশের সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। হিন্দুপ্রভাবিত বাঙালিদের নিষ্পেষণ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থ রক্ষায় এ ব্যবস্থা চালু করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি গােলাম মােহাম্মদ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী এবং বাঙালি খাজা নাজিমুদ্দিনকে বরখাস্ত করায় দেখা দেয় গােলযােগ। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি নেতৃত্ব আন্দোলন শুরু করেন। অধিকাংশ দল তাদের অসন্তোষ প্রকাশে একটি সম্মিলিত ফ্রন্ট গঠন করে। লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন-সহ কুড়ি দফা তৈরি করা হয়। কেবল প্রতিরক্ষা, অর্থ ও পররাষ্ট্র নীতি কেন্দ্রের হাতে রাখার কথা বলা ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে ইস্কান্দার মির্জা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইনচিফ জেনারেল আইয়ুব খানকে সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। আইয়ুব খান নির্ধারণ করেন তার অগ্রাধিকার। তিনি মূল্যবােধ ও আদর্শ সংরক্ষণের চেষ্টা করেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে একটি জাতীয় পুনর্গঠন কর্মসূচি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নেন। পাকিস্তানে যেসব সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল সেগুলাে দূর করাই ছিল তার প্রথম ও প্রধান কাজ। এ লক্ষ্য পূরণে চোরাচালান, মজুদদারি ও দুর্নীতি উচ্ছেদকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা ছিল তার দ্বিতীয় কাজ। শিল্পায়নে আইয়ুব খানের নিরলস প্রচেষ্টা উল্লেখযােগ্যভাবে সফল হয়। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পর জুলফিকার আলি ভুট্টো জাতীয় পরিষদে এক বিবৃতি দেন যার ফলে হৈচৈ পড়ে যায়। তিনি বলেন যে, চীন পূর্ব পাকিস্তান রক্ষা করেছে। এটা কোনাে সাধারণ বিবৃতি নয়, এর ফল সুদূরপ্রসারী।

সংস্থার রিপাের্ট ইয়াহিয়া সরকারকে গডফাদারের ভূমিকা পালনে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়।  নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি বিপজ্জনক আকার ধারণ করে। উভয় অংশে কোনাে দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিবের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই তীব্রতর হয়। জটিল পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে ওঠে। উভয় অংশের নেতৃবৃন্দ এগােতে থাকেন সংঘাতে পথে। উবে যায় আপােস করার ইচ্ছা এবং রাজনৈতিক নীতিবােধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার মানসিকতা  বিরােধী দলীয় নেতার আসনে বসারই ইচ্ছে ভুট্টোর ছিল না। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক সংবিধান তৈরির প্রস্তাব দেন। তিনি এমন এক নেতার মতাে আচরণ করতে থাকেন যেন তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। এবং সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। অন্যদিকে মুজিব নির্বাচনে বিজয়ের পর আরাে আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তিনি ৬-দফা প্রশ্নে অনড় অবস্থান গ্রহণ করেন। ভুট্টো মুজিবের বিজয় মেনে নিতে ব্যর্থ হন। তিনি ঘােষণা করেন যে, পাঞ্জাব ও সিন্ধু হচ্ছে পাকিস্তানের ক্ষমতার দুর্গ। সুতরাং সংবিধান প্রণয়ন এবং কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে তার দলের সহযােগিতা অপিরিহার্য  এভাবে বিপরীত দিকে চলতে থাকে জাতির ভাগ্যের চাকা। ইয়াহিয়া মুজিবকে ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘােষণা করে তাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। মুজিব ফাঁকা বুলিতে বিমােহিত হন নি। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল থাকতে চাইলেন, কিন্তু মুজিব ইয়াহিয়াকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। মুজিবের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ইয়াহিয়া ভুট্টোর বাহুতে আশ্রয় নেন। তিনি ও। তার অনুচরেরা হাঁস শিকারের নামে ভুট্টোর নিজ জেলা লারকানায় যান। সেখানেই লারকানা ষড়যন্ত্র করা হয়। এর মধ্যে ভারত মুজিবকে সহায়তা দিয়েই থেমে থাকে নি, পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যও সীমান্তে সেনা সমাবেশ ঘটায়  এটা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য মুজিবের প্রতি একটি স্পষ্ট সংকেত  ১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি একটি ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে লাহােরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে পুরাে ঘটনা না জেনে দুজন কাশ্মিরী ছিনতাইকারীকে স্বাগত জানাই। কাশ্মিরী ছিনতাইকারীদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়। এভাবে পাকিস্তান একটি ফাদে পা দেয়। ভারত বিমান ছিনতাই ঘটনার অজুহাতে তার ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে পাকিস্তানি বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করে। আবেগ প্রশমিত হয়ে আসে এবং একটি তদন্ত পরিচালিত হয়। তদন্তে দেখা যায় যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে ভারত পরিকল্পিতভাবে এ বিমান ছিনতাই নাটকের অবতারণা করে।

বাঙালিদের চিন্তাধারার আমূল পরিবর্তন হলাে। তাদের কাছে মনে হলাে যে, যদি সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় পুরােটাই পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করে তাহলে সংযুক্ত পাকিস্তানের সঙ্গে বসবাস করা তাদের কাছে অর্থহীন। দ্রুত জোরদার হয়ে ওঠে তাদের এ মনােভাব। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের উদাসীনতায় পরিস্থিতি আরাে ঘােলাটে হয়। তারা বুঝতে পারেন নি পানি কোন দিকে যাচ্ছে। বাঙালিরা আগের যে কোনাে সময়ের তুলনায় সচেতন হয়ে ওঠে এবং তারা বুঝতে পারে যে, তাদেরকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। তবে কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষোভ অমূলক ছিল না।  ধূমায়িত হয়ে ওঠে অসন্তোষ। শেখ মুজিব তার লক্ষ্যে পৌছতে প্রকাশ্য ও গােপন তৎপরতা চালান। ১৯৬৬ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র উদ্ঘাটিত হয়। শেখ মুজিব বেসামরিক আমলা ও সশস্ত্র বাহিনীর জুনিয়র অফিসারদের যােগসাজশে পূর্ব পাকিস্তানে একটি অভ্যুত্থান ঘটাতে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থাগুলাের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ভারতের আগরতলায় তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। এজন্য এটাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র বলা হয়। মুজিব এবং অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেফতার করা হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মােটেও কোনাে কল্প-কাহিনী ছিল না অথবা শেখ মুজিবকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানােরও কোনাে অভিপ্রায় ছিল না। পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই ভারতীয় গােয়েন্দারা পূর্ব পাকিস্তানে তৎপরতা শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দুরা তাদেরকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করতাে। এর সত্যতা মেলে অশােক রায়নার ইনসাইড ‘র’ (দ্য স্টোরি অভ ইনডিয়ান’স সিক্রেট সার্ভিস, বিকাশ পাবলিশিং হাউজ, নিউ দিল্লি, ১৯৮১) নামক বইয়ে যেখানে তিনি মুজিবের এবং ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্স ব্যুরাে অপারেশন (আইআইবিও)-এর মধ্যে যেসব বৈঠক হয়েছে তার বর্ণনা দিয়েছেন। মি, রায়না বলেছেন যে, এম.কে. শংকর নায়ার। মুজিবপন্থী গ্রুপের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতেন। শংকর নায়ার পরে ‘র’-এর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড নিযুক্ত হয়েছিলেন। মুজিবপন্থী গ্রুপ ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের ব্যর্থ চেষ্টা চালালে পাকিস্তানি গােয়েন্দাদের কাছে ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থার তৎপরতা ধরা পড়ে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গােল টেবিল বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে মুজিব ও ভুট্টোসহ সকল প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। ১৯৬৯ সালের ২৬  ফেব্রুয়ারি ও ১০ মার্চ গােল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

শুরু থেকেই এ বৈঠকের প্রতি ভুট্টো অনমনীয়তা দেখিয়ে আসছিলেন। তিনি শুধু বৈঠকে যােগদান থেকেই বিরত থাকেন নি, এ বৈঠকে অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্যও দিয়েছিলেন। একইভাবে, মুজিব ছিলেন তার ৬-দফার প্রশ্নে আপােসহীন। অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাকে বােঝানাের চেষ্টা করেন, কিন্তু তিনি কারাে কথা শােনেন নি। আইয়ুব খান ৬-দফা মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, ৬-দফার অর্থ হচ্ছে ফেডারেল ব্যবস্থার স্থলে কনফেডারেশন, ফলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে। গােল টেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। মুজিবের দৃঢ় আচরণ, ভুট্টোর উদাসীনভাব ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অসহযােগিতাই হচ্ছে এ বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার প্রধান কারণ।  এ সময় জনগণ বিরােধিতা করতে থাকে সামরিক শাসনের। অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবকে সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হয় এবং কমান্ডার-ইন-চিফ জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করেন। তিনি গােল টেবিল বৈঠকের প্রস্তাব মেনে না নিতে মুজিব ও অন্যান্যদের উৎসাহিত করেন। মুজিবকে তিনি আশ্বাস দেন যে, সামরিক আইন জারি করা হবে না এবং সেনাবাহিনী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে বাধা দেবে না। তিনি তার কথা রক্ষা করেছিলেন এবং আইয়ুব খানের স্থলাভিষিক্ত না হওয়া পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেন নি। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন এবং সংবিধান স্থগিত করে ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ইয়াহিয়া সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন। ইয়াহিয়া, মুজিব ও ভুট্টো—এ তিনজনই ছিলেন জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট জেনারেল ইয়াহিয়া ছিলেন সবচেয়ে ক্ষমতাধর। মুজিব ছিলেন একজন দক্ষ রাজনীতিক ও বাগী, তিনি জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তুলতে পারতেন। ভুট্টো ছিলেন আধুনিক তবে উদ্ধত শালীন অথচ নিষ্ঠুর। ভুট্টো দরিদ্র লােকের ভাষায় কথা বলতে পারতেন। এ তিন ব্যক্তি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলে এক তীব্র দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। প্রত্যেকেই ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং একে অপরকে হটাতে তৎপর।

ইয়াহিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। তিনি তার অনুগত জেনারেল, রাজনীতিক ও ব্যুরােক্রেটিক এলিটদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং এমন সিদ্ধান্ত নেন যার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া হয়। ১৯৬৯-এর ২৮ নভেম্বর তিনি এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন এবং এক ব্যক্তির এক ভােট নীতি গ্রহণ করেন। আমরা এত বছর ধরে যা রক্ষা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম ইয়াহিয়া। কলমের এক খোচায় তা বরবাদ করে দেন। প্যারিটির মূলনীতিতে একটি ভূরাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এটাকে সংবিধানের একটি অংশে পরিণত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের যথাযথ সম্মতিতেই তা করা হয়। ইয়াহিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতেও বাঙালিদের সমান প্রতিনিধিত্ব মঞ্জুর করেন। বাঙালিরা সন্তুষ্ট হয় নি। তারা তাদের জনসংখ্যার ভিত্তিতে সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে সমান প্রতিনিধিত্ব দাবি করে। ইয়াহিয়া যতই বাঙালিদের দিতেন তারা ততই আরাে চাইতাে। ইয়াহিয়া স্বায়ত্তশাসন ছাড়া সব দাবি মেনে নেন। এটাকে মুজিব নির্বাচনে কাজে লাগাল। ১৯৭০-এর ১ জানুয়ারি ইয়াহিয়া রাজনৈতিক দলগুলােকে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করার অনুমতি দেন। ১৯৭০ সালের শেষ নাগাদ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ৩০ মার্চ তিনি লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এলএফও) ঘােষণা করেন।  বিশাল নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। মুজিব ও ভুট্টো দুজনে জনগণের মন জয় করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান। মুজিব হয়ে ওঠেন পূর্ব পাকিস্তানের নেতা এবং ভুট্টো হন পশ্চিম পাকিস্তানের। মুজিবের শক্তি এবং ৬-দফার প্রতি তার জেদ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি বিষােদগার ও তাদের সমালােচনা করে ব্যাপক নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে থাকেন। পূর্ব পাকিস্তানের যাবতীয় সমস্যার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানকে দায়ী করেন তিনি। ইতােমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে দেখা দেয় বন্যা। ১৯৭০-এর নভেম্বরে প্রলয়ংকরী সাইক্লোনে জনগণের দুর্ভোগ চরমে পৌছে। গ্রামগুলাে বিধ্বস্ত হয়। ফলে গৃহহীন হয়ে পড়ে লােকজন। বহু প্রাণহানি ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানের হেলিকপ্টার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তির প্রয়ােজন দেখা দেয়। তিনি ত্রাণ তৎপরতা চালাতে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও জনশক্তি সরবরাহে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের কাছে আকুল আবেদন জানান। দাঙ্গা, বিদ্রোহ অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে পরিস্থিতি মােকাবেলায় সরকারকে সহায়তা দান সেনাবাহিনীর একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। মুজিবের আহ্বান এবং আহসানের অনুরােধ সত্ত্বেও জেনারেল ইয়াকুব ত্রাণ তৎপরতায় সৈন্যদের অংশগ্রহণ করতে দেন নি।

যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনাে পরিস্থিতিতেই একজন সামরিক কমান্ডার প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে প্রয়ােজনীয় সহায়তা দানে অস্বীকৃতি জানাতে পারে না। ইয়াকুব যে মুহূর্তে ছিলেন নিশ্চল এবং ইয়াহিয়া নিয়েছিলেন দীর্ঘসূত্রিতার আশ্রয়, ঠিক তখন ইসলামাবাদের অনুমতি ছাড়াই মার্কিন ও ব্রিটিশ ত্রাণ দল ত্রাণ তৎপরতা চালাতে পূর্ব পাকিস্তানে পৌছে যায় । সহায়তা দানে সরকারের অক্ষমতায় বাঙালিরা ক্ষুব্ধ ও মুজিব ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন: বৃটিশ সেনাদের আনা হয়েছে আমাদের কবর দিতে।’ দুর্গত মানবতার দুর্দশা লাঘবে ইয়াকুবের উদাসীনতা ও তার ব্যর্থতা উত্তপ্ত পরিস্থিতিকে আরাে বাড়িয়ে তােলে। আমি সাহেবজাদা ইয়াকুবকে চিনি ১৯৪৯ সাল থেকে। কোয়েটায় একসঙ্গে  স্টাফ কোর্স করেছি আমরা। তিনি চাপা স্বভাবের লােক ছিলেন। ক্লাশে ও মডেল ডিসকাশনে বরাবরই নীরব থাকতেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি আত্মসমর্পণ করেন এবং যুদ্ধবন্দি হন। তাঁর সঙ্গে যারা বন্দি হন তাঁদের সবাই শিবির থেকে পালিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি পালানাের কোনাে চেষ্টা করেন নি। স্টাফ কোর্সের সময়কালে তিনি দ্বি-জাতি তত্ত্বের ঘাের বিরােধিতা করতেন। দ্বি-জাতি তত্ত্বকে তিনি একটি রাজনৈতিক ভ্রান্তি হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন একটি সাজোয়া ডিভিশনের কমান্ডার। তবে তার কমান্ডের এ সাজোয়া ডিভিশন কোনাে লড়াইয়ে অংশ নেয় নি। এসব ঘটনা সত্ত্বেও তিনি তর তর করে ওপরে উঠেছেন। ইংরেজিতে বাকপটু হওয়ায় তিনি পদোন্নতি পেতেন। ১৯৬৯ সালে জেনারেল ইয়াকুবকে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার নিযুক্ত করা হলাে। তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী তার কমান্ডের আওতাধীন সৈন্যদের সংগঠিত ও পুনর্গঠিত করেন। আমি ওয়ার প্ল্যান-এর মূল কথা ছিল, “পূর্ব রণাঙ্গনের যুদ্ধ করা হবে পশ্চিম রণাঙ্গনে”। তিনি ছিলেন নিরাপত্তা পরিকল্পনা-এর লেখক, যার লক্ষ্য ছিল বাঙালিদের উথানকে দমন করা। সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তিনি। মুজিবের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন এবং নুরুল আমিন ও মাওলানা ভাসানীর সঙ্গেও যােগাযােগ রাখতেন।

ইতােমধ্যে রাজনীতির আকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা দেখা দেয়। দুটো পার্টি আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি নির্বাচনী ফ্রন্টে প্রভাব বিস্তার করে। এ দুটি দলের প্রতিটিই নিজ নিজ এলাকায় কেন্দ্রীভূত ছিল। অন্যান্য প্রদেশে এদের কোনাে প্রভাব ছিল না। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুজিবের প্রতি ইয়াকুব খানের ঝুঁকে পড়াটা ছিল সন্দেহজনক। তিনি নেলসনের চোখ আওয়ামী লীগের চাপের দিকে ফিরিয়ে নেন। তিনি পরাজিত হন তার ইচ্ছাশক্তির ঘাটতির কারণে ও মুজিবের কৌশলের কাছে। নির্বাচনে মুজিব বিশ্বয়কর বিজয় লাভ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২টি আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে জয়ী হন। অন্যদিকে, ভুট্টোর পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টি আসন লাভ করে। ফজলুল কাদের চৌধুরী, মৌলভী ফরিদ আহমেদ ও আরাে কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী নেতা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, সামরিক প্রশাসক ইয়াকুব খান সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর দায়িত্ব পালন করলে এবং আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে প্রতারণা করার সুযােগ না দিলে অন্যান্য দল শহরগুলােতে কমপক্ষে ৬০ থেকে ৬৫টি আসন পেত। নির্বাচনের আগে বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থা জরিপ চালিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলের সঙ্গে জরিপ রিপাের্টের বিশাল পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। গােয়েন্দা সংস্থার রিপাের্টে বলা। হয়েছিল যে, কোনাে দলই নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হবে না। গােয়েন্দা  সংস্থার রিপাের্ট ইয়াহিয়া সরকারকে গডফাদারের ভূমিকা পালনে একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়।  নির্বাচনের পরে পরিস্থিতি বিপজ্জনক আকার ধারণ করে। উভয় অংশে কোনাে দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও মুজিবের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই তীব্রতর হয়। জটিল পরিস্থিতি জটিলতর হয়ে ওঠে। উভয় অংশের নেতৃবৃন্দ এগােতে থাকেন সংঘাতে পথে। উবে যায় আপােস করার ইচ্ছা এবং রাজনৈতিক নীতিবােধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার মানসিকতা।

১৯৭১-এর ১১ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। পরদিন পিপিপি কর্মীরা লাহােরে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালায় এবং দলের পতাকায় অগ্নিসংযােগ করে। এরপর ইয়াহিয়া ঘােষণা করেন যে, ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ভুট্টো এ ঘােষণা গ্রহণ করতে পারেন নি। তিনি বলেন, ‘আর্মিরা কেবলমাত্র একটি দলের তৈরি করা সংবিধান অনুমােদন করতে এবং লজ্জা ফিরিয়ে আনতে ওখানে যেতে পারে না।’ ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি লাহারে তার দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, সরকার মুজিবকে সমর্থন দিলে তিনি প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু করবেন। তিনি আরাে বলেন যে, হয় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন হতে দিতে হবে নয়তাে মুজিবকে গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে। ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া ইসলামাবাদে প্রাদেশিক গভর্নরদের সঙ্গে এক বৈঠকে বসেন। ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ও সামরিক আইন প্রশাসক লে, জেনারেল ইয়াকুবও এ বৈঠকে যােগ দেন। এ বৈঠকেই সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা অনুমােদন করা হয়। মুজিব ৬-দফা প্রশ্নে তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হলে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ইয়াকুবকে তার বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়। বৈঠকের পর ইয়াকুব জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে জেনারেল হামিদের সঙ্গে অতিরিক্ত ব্রিগেড সরবরাহের প্রস্তাব দেন। তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন যে, যে কোনাে পরিস্থিতি মােকাবেলায় পূর্ব পাকিস্তানেই পর্যাপ্ত সৈন্য রয়েছে। যখন তিনি ঢাকা পৌছালেন তখন নিজের মনােভাব পরিবর্তন করেন তিনি এবং প্রতিশ্রুত ব্রিগেড পাঠানাের জন্য অনুরােধ করেন। যখন ব্রিগেডের দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকা এসে পৌছাল, তিনি আবার টেলিফোন করেন জেনারেল হামিদের কাছে এবং তাকে জানান যে, সৈন্য সংখ্যা। বৃদ্ধি করায় মুজিব বিরক্ত হয়েছেন এবং তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য প্রেরণ বন্ধ করার অনুরােধ জানিয়েছেন। জেনারেল হামিদ ছিলেন শান্ত ও ঠাণ্ডা মেজাজের লােক কিন্তু তিনি মেজাজ হারালেন ও ইয়াকুবকে বললেন শক্ত হতে।

পরিকল্পনা অনুযায়ী তৃতীয় ব্যাটালিয়নকে ঢাকা পাঠানাে হলাে। আওয়ামী লীগ এসব ঘটনায় এত আতঙ্কিত হয়ে পড়ল যে, তারা ৬-দফা প্রশ্নে নমনীয় হতে সম্মত হয়। ১৯৭১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি গভর্নর আহসান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের সিদ্ধান্ত মুজিবকে অবহিত করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি। ভুট্টো বরাবরের মতাে হুমকি দেন যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হলে তিনি আন্দোলন শুরু করবেন। তিনি সতর্ক করে দেন যে, তার দলের কোনাে সদস্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিলে তাকে হত্যা করা হবে। তিনি আরাে বলেন, হয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বিলম্বিত করতে হবে নয়তাে সংবিধান প্রণয়নে ১২০ দিনের সময়সীমা প্রত্যাহার করতে হবে। এটা ছিল একটা  ফাকা হুমকি, কারণ দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যে কোনাে সময় সংবিধান প্রণয়ন করে নিতে পারতাে। ১ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করা হয়। অধিবেশন স্থগিতের কারণ হিসেবে পিপিপি’র জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জন এবং ভারতের সৃষ্ট উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়। ১১, ১৯ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ভুট্টোর সঙ্গে ইয়াহিয়ার রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ছিল ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার চক্রান্তের একটি অংশ।

 বেসামরিক মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত করা হলাে। অ্যাডমিরাল আহসানকে অপসারণ করা হলাে গভর্নরের পদ থেকে। সাহেবজাদা ইয়াকুব পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করেন—যেসব জেনারেল গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন তারা প্রত্যেকেই সৈন্যদের কমান্ড থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিলেন একমাত্র ইয়াকুব। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে মুজিব ২ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেন। তৎক্ষণাৎ আওয়ামী লীগ কর্মীরা ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর করে এবং বহু দোকানপাট লুট করে। এ বিশৃঙ্খলার সময় সশস্ত্র ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে। অবাঙালিদের ওপর হামলা এবং তাদের হত্যা করা হয়। সেনা ইউনিটও আক্রান্ত হয়। ইয়াহিয়া নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তিনি ১০ মার্চ গােলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন নি যে, আলােচনার সময় শেষ হয়ে গেছে। ৪ মার্চ ১৯৭১ মুজিব অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। আওয়ামী লীগ আবার। উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সেনা কমান্ডার জেনারেল ইয়াকুব ছিলেন পুরােপুরি নীরব, ব্যবস্থা গ্রহণের কোনাে ইচ্ছে তার ছিল না। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার জন্যই পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। এজন্য ভুট্টো ও ইয়াহিয়া সমানভাবে দায়ী ছিলেন। তারা ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা হয়ে দাঁড়ান। ইয়াকুবের নিষ্ক্রিয়তায় বাঙালিরা। হত্যাকাণ্ড এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধে লিপ্ত হয়। ইয়াকুব অঙ্কুরেই এ বিদ্রোহ নির্মূল করতে পারতেন। তখনাে বিদ্রোহ ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। বাঙালি সৈন্যরা তখনাে বিদ্রোহ করেন নি। এ বিদ্রোহ ছিল খুবই সাধারণ মানুষের। শক্তি ও কৌশলের বুদ্ধিদীপ্ত সমন্বয় ঘটিয়ে ইয়াকুব নিরস্ত্র জনতার আন্দোলন পুরােপুরি নৈরাজ্যের দিকে এগিয়ে যাবার আগেই থামিয়ে দিতে পারতেন। সেক্ষেত্রে মুজিব নমনীয় হতে বাধ্য হতেন। | মুজিব মার্চের শুরুতে সামরিক আইনকে অগ্রাহ্য করে একটি সমান্তরাল সরকার গঠনে তার পরিকল্পনা ঘােষণা করেন। এক পক্ষকালের মধ্যে মুজিবের আওয়ামী লীগ এমন নৃশংস ঘটনা ঘটায় যা বর্ণনার অতীত। বগুড়ায় ১৫ হাজার লােককে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। চট্টগ্রামে হাজার হাজার নর-নারীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় এবং ধর্ষণ করা হয়। সিরাজগঞ্জে একদল নারী ও শিশুকে একটি ঘরে তালা দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। এসব হামলার লক্ষবস্তু ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি ও বিহারীরা।

পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এ কর্মরত পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারদেররও হত্যা করা হয়, ধর্ষণ করা হয় তাদের স্ত্রীদের এবং উলঙ্গ হয়ে বাঙালি অফিসারদের খাদ্য পরিবেশনে বাধ্য করা হয়। অথচ দোষ দেয়া হচ্ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের । পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযােগ ছিল একটি অপপ্রচার। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সুনাম ক্ষুন্ন করার জন্যই পরিকল্পিতভাবে এ অপপ্রচার চালানাে হয়। | পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে লে. জেনারেল ইয়াকুব অ্যাডমিরাল এস,এম, আহসানের স্থলাভিষিক্ত হন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ। চার দিনের মাথায় জেনারেল ইয়াকুব গভর্নর ও ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার পদে ইস্তফা দেন এবং বলেন যে, তিনি তার পাকিস্তানি ভাইদের হত্যা করতে পারবেন না।’ ইয়াকুবের এ উক্তিতে বাঙালিরা উল্লসিত হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানিরা হয় ভীত। ইয়াকুব বাঙালিদের ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠতে দেখেছেন। কিন্তু তিনি কিছুই করেন নি। তার সিদ্ধান্তহীনতায় আওয়ামী লীগের সাহস বেড়ে যায়। তারা নৈরাজ্যের পথে ধাবিত হতে থাকে। ইয়াকুবের সমালােচনা শুধু আমিই নই; অন্যান্যরাও করেছেন। তার আচরণ। জেনারেল শের আলীর বইয়ে ফুটে উঠেছে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি জানি নীতিগতভাবে ইয়াকুব সামরিক অভিযানে অসম্মত ছিলেন না। সত্যি এক পর্যায়ে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন এবং ইয়াহিয়া আমাকে এ ব্যাপারে তার সঙ্গে আলােচনা করার নির্দেশ দেন।’ | জেনারেল শের আলী আরাে লিখেছেন, ‘এটা বলতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের কমান্ডার সংকটের সময় তার সৈন্যদের পাশে না দাঁড়িয়ে তিনি তাদের ত্যাগ করেন এবং পদত্যাগ করে চলে আসেন।’ তিনি আরাে লিখেছেন, ‘পদত্যাগের কারণ দেখানাে হয়েছে বিবেকের তাড়না’। তিনি বলেছেন, তিনি তাঁর পাকিস্তানি ভাইদের হত্যা করার নির্দেশ পালন করতে পারেন নি। এখানে এ বিষয়টি বিচার করতে হবে যে, তিনি শুরু থেকেই নীতিগতভাবে সৈন্য ব্যবহারের বিপক্ষে ছিলেন, নাকি কোনাে একটা নির্দিষ্ট সময়ে চলে আসতেন। বিবেকের তাড়নার অজুহাত গ্রহণযােগ্য হতাে যদি তিনি আরাে আগে পদত্যাগ করে চলে আসতেন।  পদত্যাগ করার পর করাচি যান ইয়াকুব। সেখানে তাঁকে স্টেশন হেড কোয়ার্টার্সে যুক্ত করা হয়।

মেজর জেনারেল পদে পদাবনতি ঘটিয়ে তাকে পাঠানাে হয় পেনশনে। তাঁর অপরাধের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইয়াহিয়া তাকে কোর্ট মার্শাল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বিষয়টিতে রাজনেতিক রঙ চড়ানাে হতে পারে বলে তাকে লঘু শাস্তি দেয়া হয়। ভুট্টোর মধ্যে ইয়াকুব দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর অভিভাবকের প্রতিচ্ছবি। ভুট্টো ক্ষমতায় এসে ইয়াকুবের লে. জেনারেল র্যাঙ্কই কেবল ফিরিয়ে দেন নি, তাকে তিনি প্রথমে ফ্রান্স ও পরে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতও নিয়ােগ করেছিলেন। সক্রিয় সার্ভিসে থাকাকালে জাতীয় অঙ্গীকার পালনে অসৈনিকসুলভ আচরণ করায় ইয়াকুব তলিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো তাকে কলমের এক খোচায় সেখান থেকে উদ্ধার করেন। নিয়তি যদি কখনাে কারাে ওপর সদয় হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে যে, ইয়াকুব হচ্ছেন ভাগ্যের সেই বরপুত্রদের একজন। ইয়াকুব পদত্যাগ করার কারণ হিসেবে তার বিবেকের কথা বলেছেন। যখন হাজার হাজার মানুষ মারা গেল বন্যায়, চারদিকে ছিল আহাজারি। যখন বিহারি, পশ্চিম পাকিস্তানি ও ইপিআরে কর্মরত সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়েছিল তখন তিনি ছিলেন নীরব দর্শক। অফিসারদের স্ত্রীদের সম্মান যখন ভুলুষ্ঠিত হচ্ছিল তখন। তার বিবেক ছিল মৃত। টিক্কা তিন ডিভিশন সৈন্যের সাহায্যে বেলুচিস্তানে তথাকথিত বিদ্রোহ দমন করেন, ইয়াকুব খান এ ঘটনার সামান্যতম প্রতিবাদও করেন নি। পূর্ব। পাকিস্তানে ইন্টার্ন কমান্ডের কমান্ডারের পদ থেকে তিনি যে বিবেকের তাড়নায়। পদত্যাগ করেছেন একইভাবে বিবেকের তাড়নায় বেলুচিস্তানের ঘটনার প্রতিবাদেও তার রাষ্ট্রদূতের পদ থেকে ইস্তফা দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেন নি। তার। চিন্তাধারায় আমূল পরিবর্তন আসে। বিপদমুক্ত দূরত্ব বজায় রেখে চলতে শুরু করেন। তার ত্রাণকর্তা ভুট্টোকে যখন ফাসিতে ঝুলানাে হয় তখনাে তিনি মুখ খােলেন নি। উপরন্তু, তিনি জিয়াউল হকের মন্ত্রীসভায় যােগ দেন। জিয়াউলের মৃত্যুর পর তিনি পিপিপি সরকারে যােগ দেন এবং বেনজীরকে অপসারণ করা হলে তিনি নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রী হন। তাঁর মতাে এমন অসৎ চরিত্রের লােক আর কখনাে এত ওপরে উঠতে পারেন নি। একজন জেনারেল বিবেকের দোহাই দিয়ে তার দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। সময়ের পরিবর্তনে বিবেকও পরিবর্তিত হয় যেমনটি ঘটেছে ইয়াকুবের ক্ষেত্রে।

সশস্ত্র বাহিনীর ওপর চাপ ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। আওয়ামী লীগ তাদের পরিকল্পনা কার্যকর করা শুরু করে যা ছিল নিম্নরূপ :

১. সশস্ত্র বাহিনীর কাছে সব ধরনের সমর্থন প্রত্যাখ্যান করা;

২. সব ধরনের সেনা চলাচল ব্যাহত করা;

৩. সব ক্যান্টনমেন্টে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যাহত করা;

৪. সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত সব বেসামরিক কর্মচারীদের কাজ বন্ধ করা;

মুজিব ঘােষণা করেন পাকিস্তান শেষ হয়ে গেছে। আপােষের আর কোনাে আশা নেই। আমি তাদের ভেঙে দেব এবং বাধ্য করব নতজানু হতে।’ এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। মুজিব কার্যত শাসক হয়ে যান এবং তার বাসভবন প্রেসিডেন্সিতে পরিণত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ অমান্য করা হয়। জেনারেল টিক্কা খান ইয়াকুবের স্থলাভিষিক্ত হন ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। টিক্কা বিমানযােগে ঢাকা পৌছান এবং ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার, সামরিক আইন প্রশাসক ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাকে স্বাগত জানানাে হয় নি; বিমান বন্দরে তাকে জুতার মালা উপহার দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি গভর্নর হিসেবে তাকে শপথ বাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। টিক্কা ছিলেন সােজাসাপ্টা, কঠোর পরিশ্রমী ও বিনীত স্বভাবের লােক। তবে ইয়াকুবের মতাে তিনি মার্জিত ছিলেন না। বস্তুত অন্যান্যদের আত্মবিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করার কোনাে গুণ তার ছিল না। তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞার অভাব ছিল। তা সত্ত্বেও তাকে ঘিরে বীরত্বের সৌধ গড়ে ওঠে।

ইস্টার্ন কমান্ডের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর জেনারেল টিক্কা শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা করেন। যদিও মুজিব ইয়াকুবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন কিন্তু টিক্কার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। জেনারেল টিক্কা তার অধীনস্থ সেনাদের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও পুলিশকে নিরস্ত্র এবং চট্টগ্রাম নৌঘাটি ও লালমনিরহাট ও ঈশ্বরদিসহ সকল বিমান বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার নির্দেশ দেন।  টিক্কাকে সশস্ত্র বাঙালিদের নিরস্ত্র করার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তিনি সেই নির্দেশ পালনও করেছিলেন। কিন্তু এ নির্দেশ পালন করতে গিয়ে তিনি ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তার কথা ভুলে যান। এটাই ছিল পরিকল্পনার সবচেয়ে গুরুতর ভুল। এ ভুলের পরিণামে আমরা শুধু প্রাথমিক উদ্যোগেই হেরে যাই নি; কয়েকটি গ্যারিসন শহর ছাড়া গােটা প্রদেশ আমাদের হতাছাড়া হয়ে যায়। জেনারেল টিক্কার আরেকটি ভুল পদক্ষেপ ছিল পূর্ব পাকিস্তান থেকে সব বিদেশি সাংবাদিক, প্রতিনিধি ও টিভি ক্রুদের অত্যন্ত অপমানজনকভাবে বের করে দেয়া। এদের কাউকে কাউকে লাঞ্ছিত করা হয়, তাদের লাগেজ পরীক্ষা করা হয় এবং ক্যামেরা থেকে ফিল্ম খুলে নেয়া হয়। এসব সাংবাদিক পরে ভারতে চলে যায়। এজন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যম আমাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় রঙ চড়াতে থাকে। ভারতীয় এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীরাই ছিল বিদেশি সাংবাদিকদের খবরের উৎস। বিদেশি সাংবাদিকরা অতিরঞ্জিত ও বিকৃত সংবাদ পরিবেশন করায় পাকিস্তান ও পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বিরাট ক্ষতি হয়। আমাদের সরকার এ নিয়ে মাথা ঘামায় নি। ফলে আমাদের নিজেদের লােকজন বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত অতিরঞ্জিত ও বিভ্রান্তিকর রিপাের্ট বিশ্বাস করতে শুরু করে। ১৪ মার্চ ভুট্টো দুজন প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগের একটি প্রস্তাব দেন, তিনি নিজে হবেন পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এবং মুজিব হবেন পূর্ব পাকিস্তানের। তিনি ‘ওধার তুম ইধার হাম’ বলতে দুটি পাকিস্তানকেই বুঝিয়েছেন। জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে যান ১৫ মার্চ। ভুট্টোও সেখানে যান। তিনজনের মধ্যে আলােচনা চলছিল, কিন্তু কোনাে লাভ হচ্ছিল না। কারণ আওয়ামী লীগ এমন এক জায়গায় পৌছে গিয়েছিল যেখান থেকে তার ফেরার পথ ছিল না। মুজিব ভুট্টোর পরামর্শ অনুযায়ী ২২ মার্চ দুটি প্রদেশের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে ইয়াহিয়ার প্রতি আহ্বান জানান।

 ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে পালন করা হয় প্রতিরােধ দিবস। মুজিবের বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানাে হয়। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশন ও সােভিয়েত কনস্যুলেটেও বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানাে হয়। মুজিব কর্নেল ওসমানীকে সার্বিক অপারেশনের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। মেজর জেনারেল (অব.) মাজেদের তত্ত্বাবধানে সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যদের তালিকাভুক্ত করা হয়। ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র ও গােলাবারুদ আসতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ ও পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহীরা পুরােপুরি অস্ত্রসজ্জিত হয়। হাজার হাজার ভারতীয় সৈন্য সাদা পােশাকে অনুপ্রবেশ করে। ভারতের সক্রিয় সহযােগিতায় সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। ২৫ মার্চ সামরিক অভিযান চালানাের জন্য জেনারেল টিক্কা খানের হাতে ছিল শুধু মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার নেতৃত্বাধীন ১৪ তম পদাতিক ডিভিশন। এ ডিভিশনের ৪টি ব্রিগেড পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট ও ক্যাম্পে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে একটি ডিভিশন গঠিত হতাে বারােটি পদাতিক ব্যাটলিয়ন ও একটি মিশ্র কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন নিয়ে এবং অন্যদিকে, পূর্ব পাকিস্তানে ৭টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন ও একটি মিশ্র কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের সমন্বয়ে। এসব ব্যাটালিয়নের অফিসাররা ছিলেন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের। টিক্কা খানের কাছে একটি পদাতিক ডিভিশন ছাড়া আরাে ছিল একটি হালকা ট্যাংক রেজিমেন্ট, ৫টি ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট, এক রেজিমেন্ট হালকা বিমান-বিধ্বংসী আর্টিলারি এবং দুটি মর্টার ব্যাটারি। এসব ইউনিটে সেনা ছিল মিশ্র। ইপিআর-এর সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার। এর প্রায় সব সদস্যই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি। তবে সেখানে কিছু কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসারও কর্মরত ছিলেন। নৌ ও বিমান বাহিনীও ছিল। এদেরকে ঢাকা ও চট্টগ্রামে স্থল বাহিনীর সহায়তায় ব্যবহার করা যেত। এটা মনে রাখা প্রয়ােজন যে, তখনাে বাঙালি সেনারা বিদ্রোহ করে নি। পরিস্থিতি মােকাবিলায় জেনারেল টিক্কার পর্যাপ্ত শক্তি ছিল। প্রয়ােজন ছিল যথার্থ পরিকল্পনা, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অভিযান পরিকল্পনা ও ধৈর্যের। কারণ টিক্কা কোনাে নিয়মিত সেনাবাহিনী নয়, একটি বিদ্রোহী সশস্ত্র বেসামরিক শক্তিকে মােকাবিলা করছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যরাতে জেনারেল টিক্কা আঘাত হানেন। একটি শান্তিপূর্ণ রাত পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে, চারদিকে আর্তনাদ ও অগ্নিসংযােগ। জেনারেল টিক্কা তার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েন যেন তিনি তার নিজের বিপথগামী লােকের সঙ্গে নয় একটি শত্রুর সঙ্গে লড়াই করছেন। ২৫ মার্চের সেই সামরিক অভিযানের হিংস্রতা ও নৃশংসতা বুখারায় চেঙ্গিস খান, বাগদাদে হালাকু খান এবং জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নিষ্ঠুরতাকেও ছাড়িয়ে যায়। সশস্ত্র বাঙালি ইউনিট ও ব্যক্তিবর্গকে নিরস্ত্র এবং বাঙালি নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার জন্য টিকাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি এ দায়িত্ব পালন করার পরিবর্তে বেসামরিক লােকজনকে হত্যা এবং পােড়া মাটি নীতি গ্রহণ করেন। তিনি তার সেনাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘আমি মাটি চাই, মানুষ নয়।’ মেজর জেনারেল ফরমান ও ব্রিগেডিয়ার (পরে লে. জেনারেল) জাহানজেব আরবাব ঢাকায় তার এ নির্দেশ পালন করেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান তার টেবিল ডায়েরিতে লিখেছেন, “পূর্ব পাকিস্তানের শ্যামল মাটি লাল করে দেয়া হবে।’ বাঙালির রক্ত দিয়ে মাটি লাল করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বাঙালিরা গভর্নর হাউস অবরােধ করার পর তারা ফরমানের এ ডায়েরি খুঁজে পায়। বাংলাদেশ সফরকালে মুজিব ভুট্টোকে এ ডায়েরি দেখিয়েছিলেন। আমার সঙ্গে সাক্ষাকালে ভুট্টো এ ডায়েরি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন। তাকে আমি জানিয়েছিলাম যে, ভারতে থাকাকালে আমি এ বিষয়টি শুনেছি। তবে আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানতাম না। কারণ পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক বিষয়ে আমার কোনাে কর্তৃত্ব ছিল না।

জেনারেল টিক্কা তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালন থেকে সরে যাওয়া প্রায় সকল বাঙালি সশস্ত্র ব্যক্তি ও ইউনিট তাদের অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজ-সরঞ্জাম ও পরিবহন নিয়ে পালিয়ে যায় এবং মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে। তাদের সঙ্গে শিগগির ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ও ভারতীয়রা যােগ দেয়। মুজিব ছাড়া সকল নেতৃবৃন্দ পালিয়ে যায় এবং কলকাতায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে। ১৯৭১ সালে ২৫ ও ২৬ মার্চের মাঝরাতে সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার আগে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। ঢাকা ত্যাগের আগে তিনি টিক্কাকে বলেছিলেন, ‘তাদেরকে খুঁজে বের কর।’ টিক্কার নিষ্ঠুরতা দেখার জন্য ভুট্টো ঢাকায় থেকে গেলেন। ভুট্টো দেখতে পেলেন ঢাকা জ্বলছে। তিনি জনগণের আর্তচিৎকার, ট্যাংকের ঘড় ঘড় শব্দ, রকেট ও গােলাগুলির বিস্ফোরণ এবং মেশিনগানের ঠা-ঠা-ঠা আওয়াজ শুনতে পেলেন। সকালে ভুট্টো, টিক্কা, ফরমান ও আরবাবকে পিঠ  চাপড়িয়ে অভিনন্দন জানান। তিনি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশ্বাস দেন ভুট্টো। তার কথা রেখেছিলেন।

টিক্কা খান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্তি পেয়েছিলেন। রাও ফরমান ফৌজি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এবং ব্রিগেডিয়ার আরবাব প্রথমে মেজর জেনারেল ও পরে লে. জেনারেল পদে উন্নীত হন। ২৬ মার্চ করাচি পেীছে ভুট্টো তৃপ্তির সঙ্গে ঘােষণা করেন, ‘আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।  রক্তপাত ছাড়াই টিক্কা তার মিশন সম্পন্ন করতে পারতেন। রাজনীতিবিদদের হেফাজতে নেয়া অথবা বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের তাদের বাড়িঘর ও মেস থেকে গ্রেফতার করা কঠিন ছিল না। ইউনিটের অস্ত্রাগারগুলাে সময়মতাে অবরােধ ও দখল করে নিলে, রেলওয়ে স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড ও সেতুগুলােতে প্রহরা বসালে এবং ট্রাক, বাস ও ফেরিগুলাে বন্ধ রাখলে সশস্ত্র ব্যক্তিদের অধিকাংশ ও রাজনীতিবিদদের গ্রেফতার করা যেত। টিক্কা এ ধরনের ব্যবস্থা নিলে যেসব সশস্ত্র ব্যক্তি পালিয়ে যায়, তাদেরকে ভারি অস্ত্র ও পরিবহন ছাড়াই পালাতে হতাে; সেক্ষেত্রে তাদের সংগঠিত হতে যথেষ্ট সময় লাগতাে। একইভাবে, বিদ্রোহীদের তথাকথিত শক্তঘাঁটিতে জেনারেল টিক্কার ক্ষিপ্র ও তীব্র হামলা চালানাের প্রয়ােজন ছিল না। এগুলাে খুব সহজেই অবরােধ করা যেত এবং এগুলােতে পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ এবং বাইরে থেকে সকল বরবরাহ বন্ধ করে দেয়া যেত। বিদ্রোহীদের সহায়তা দানে বাইরে থেকে হামলার আশংকা এবং ভেতর থেকে হামলা চালানাের অবস্থা বিদ্রোহীদের ছিল না। তাদের আত্মসমর্পণ করতে হতাে অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)