You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৬৫ সালের যুদ্ধ

ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্তির মূলে রয়েছে ঘৃণা ও শক্রতা। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের কারণ ছিল পারস্পরিক অবিশ্বাস দূর করার ব্যর্থতা। জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হয় এবং সব বিচ্ছেদ দূরীকরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। স্কুল অভ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস, যেখানে আমি কমান্ড্যান্ট ছিলাম, সেটা বন্ধ হয়ে আসে। স্টুডেন্ট অফিসার এবং ইনস্ট্রাক্টরদের তাদের নিজ নিজ ইউনিট ও ব্যুহে ফিরে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। নূন্যতম কিছু কর্মচারী রয়ে যায় অস্ত্রশস্ত্র, যন্ত্রপাতি, স্টোর ও বাসস্থান দেখাশােনা করার জন্য। আমাকে ১৪ প্যারা ব্রিগেডের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়, যেটা ভাই ফাইরুতে অবস্থিত এবং লাহাের থেকে প্রায় ৩০ মাইল দূরে। আমি সিগনাল কোরের ব্রিগেডিয়ার সুলেমানের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করি। মেজর জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৭ম পদাতিক বাহিনীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন লে. জেনারেল আলতাফ কাদিরের কাছ থেকে। অভিজ্ঞতা ও যুদ্ধ পরবর্তী কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে অফিসারদের বিভিন্ন ব্যুহ ও ইউনিটে নিয়োেগ দেয়া হয়। যুদ্ধ শুরু হবার সাথে যে সব অফিসারকে যুদ্ধকালে সামরিক অভিযানে অক্ষম বলে বিবেচনা করা হয়, তাদেরকে বিভিন্ন ইউনিট ও ব্যুহের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে নেয়া  ১৪ প্যারা ব্রিগেডের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর আমি সত্যিকারের যত্নের সঙ্গে আমার ব্রিগেডকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। আমার ব্রিগেড ছিল মেজর জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বাধীন ৭ ডিভিশনের অংশ। এ সময়ে, কাশ্মিরে অপারেশন জিব্রাল্টার পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অপারেশন জিব্রাল্টার পরিচালনার নেতৃত্ব দেবার কথা বলা হয় ১২ ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আখতার মালিককে। জেনারেল আখতারের অনুরােধে আমাকে রাওয়ালপিন্ডিতে জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে তলব করা হয়। সেখানে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় মারিতে অবস্থিত ১২ ডিভিশনের হেডকোয়ার্টাসে রিপাের্ট করার। জেনারেল আখতারকে আমি ভালােভাবে চিনতাম, যখন আমি মেজর হিসেবে কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজের ট্যাকটিক্যাল উইং-এর ইন্সট্রাক্টর ছিলাম। ইয়াহিয়া খান ও আখতার মালিক দুজনেই লেফটেন্যান্ট কর্নেল থাকাকালে স্টাফ উইং-এর ইন্সট্রাক্টর ছিলেন। ১০ ব্রেইথওয়েট রােডে এক বাড়িতে আমরা তিনমাস একত্রে বসবাস করেছি। আমাদের পরিবার আমাদের সঙ্গে না থাকায় আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

৭ ডিভিশন থেকে আমি আমার ব্রিগেড হেড কোয়াটার্স ও এক ব্যাটালিয়ন সহ ১২ ডিভিশনে স্থানান্তরিত হই। এটা ছিল জিওসি ১২ ডিভিশনের বিশেষ অনুরােধ। আমার ব্রিগেড মেজর ইমতিয়াজ (আর মেজর জেনারেল)-কে সঙ্গে নিয়ে আমি মারিতে ১২ ডিভিশনের হেড কোয়ার্টার্সের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। জেনারেল আখতার আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি আমাকে মুজাফফরাবাদে ১নং সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণের কথা বলেন। তার চাম্ব-জুরিয়ান অপারেশনের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় গভীরভাবে জড়িত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকায় তার। অবর্তমানে আজাদ কাশ্মিরের রাজধানী মুজাফফরাবাদের দায়িত্ব গ্রহণ করার মতাে একজন বিশ্বস্ত অফিসারের প্রয়ােজন ছিল। অবস্থান আশানুরূপ পরিবর্তন হওয়াতে ১২ ডিভিশন কমান্ডারের পক্ষে যে-কোনাে সিদ্ধান্ত দ্রুত নেয়া হয়। | ভারতীয় সৈন্য কর্তৃক দখলকৃত এলাকা সম্পর্কে তিনি মানচিত্রে ব্যাখ্যা করেন, এখানে ভারতীয়রা সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। এখান থেকে মুজাফফরাবাদ দখলের জন্য অপারেশন পরিচালনা করা তাদের পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে। তিনি আমাকে পরদিন অপারেশন অঞ্চলে রওনা হবার নির্দেশ দেন। তিনি আমাকে আরাে নির্দেশ দেন যে, কোনাে অবস্থায় শক্ররা যেন মুজাফফরাবাদের দিকে এগিয়ে আসতে না পারে। জেনারেল আখতার একই দিনে চাষ-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কর্নেল স্টাফ কর্নেল ইজাজ (পরে মেজর জেনারেল) -কে রেখে আসা হয় ১২ ডিভিশন অপরেশন রুম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। যখন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, জেনারেল মুসা এবং তাদের স্টাফ অফিসাররা এসে পৌছেন, আমি তখনাে ১২ ডিভিশন হেডকোয়ার্টার্সের অপারেশন রুমে ছিলাম। আখনুর দখলের পরিকল্পনায় সামান্য পরিবর্তন করা হয়। এটা ছিল খুবই চমক্কার পরিকল্পনা, কিন্তু আলােচনার সময় ধরা পড়েছে এতে একটি ক্রটি রয়েছে। অন্যান্য সেক্টরের নিরাপত্তার চিন্তা না করে এ পরিকল্পনা নেয়া হয়। শত্রুর আনুষঙ্গিক বিষয়, পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সংশ্লিষ্টতা এবং সার্বিক পরিকল্পনা, বিশেষ করে শত্রুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার কথা বিবেচনা করা হয়নি।

আমি বললাম “যেহেতু আখনুর দখল করে নিলে জম্মু কাশ্মিরের গুরুত্বপূর্ণ পথ বিচ্ছিন্ন হবে, কিন্তু ভারত আমাদের মনোেযােগ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ধরুন লাহােরের বিরুদ্ধে, অথবা পাঞ্জাবের জন্য হুমকি হতে পারে এমন কাজের জন্য আমাদের ওপর মানসিক চাপ বৃদ্ধি করতে প্ররােচিত করবে না তাে?’ যা হােক, অপারেশন জিব্রাল্টার-এর সম্ভাব্য সাফল্যে সবাই এত বেশি উদ্বেলিত ছিল যে আমার কথা কেউ শােনেনি। সব বিবেচনা স্রেফ বাতিল হয়ে যায়। পরদিন আমি মুজাফফরাবাদে পৌছলাম এবং ১ আজাদ কাশির ব্রিগেডের। দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম। কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খিলজি তখন উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু তার বিএম এবং ডিকিউ উপস্থিত ছিলেন। ১৪ প্যারা ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার্স ও তার একটি ব্যাটালিয়ন ১/১ পাঞ্জাব যার নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল নসরুল্লাহ। আমাদের সঙ্গে মুজাফফরাবাদে যােগ দেয়। ৫ পাঞ্জাব (শেরডিলস)-এর পাল্টা হামলা আমি ৫ পাঞ্জাব (শেরডিলস)-এ পৌছলাম সকালে। কামানগুলাে যখন গন্তব্যে নেয়া হচ্ছিল, আমি ব্যাটারি কমান্ডার মেজর জায়েদিকে সঙ্গে নিই, তিনি আমার কাছে কামান মােতায়েন ও কামানের নির্দিষ্ট লক্ষ্যস্থলের ব্যাখ্যা দেন। লে. কর্নেল হাসান আমাকে সৈন্য মােতায়েন ও গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত স্থানের বর্ণনা দেন। ভারতীয়দের অবস্থান ছিল উচু ভূমিতে, আর ৫ পাঞ্জাবের অবস্থান ছিল তুলনামূলক নিচু। জায়গায়। আমাদের অবস্থানের এক জায়গায় ঢালু একটা জায়গা ছিল যা সুবিধাজনক বলে মনে হয়, কারণ উঁচু অবস্থান থেকে শত্রুরা ঢালু বেয়ে নেমে এলে তারা আমাদের ছােট ছােট অস্ত্রের আওতায় এসে পড়বে। পেছনের অবস্থান থেকে আজাদ কাশ্মির ব্যাটালিয়নও শত্রুর ওপর মেশিনগানের গুলি চালাতে পারবে। দুটি ব্যাটালিয়ন পরস্পরকে সহায়তা করে যাচ্ছিল। এলাকায় একটি পাহাড় ছিল, যে কেউ এখান থেকে পাকিস্তানিদের তৎপরতা দেখতে পাবে।

লে. কর্নেল হাসান আমাকে বললেন যে পাহাড়টি আগে আমাদের ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা ভারতীয়রা দখল করে নেয়। আপনি আসার একদিন আগে আমরা অবস্থানটি হারাই। এটা এখন দখল করে নিয়েছে দুটো ভারতীয় সেনাদল।’  আমি কর্নেল হাসানকে নির্দেশ দিই পরদিন পাল্টা হামলা চালিয়ে পাহাড়টি দখল করতে।  যেহেতু ব্যাটারি কমান্ডার উপস্থিত ছিলেন, তাকে শত্রুর কয়েকটি লক্ষ্যস্থল দেখান হয়। পরদিন সকালে আকস্মিক হামলা চালিয়ে শেরডিল পাহাড়টি দখল করে। ভারতীয় সৈন্যদের বদলি নিয়ােগ দেয়া হচ্ছিল-পুরান সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য মােতায়েন করা হচ্ছিল। ৫ পাঞ্জাবের পাঁচজন আহত হন। নিহত হন এন-এম, নিয়াজি। সফল অভিযানের জন্য আমি ৫ পাঞ্জাবকে অভিনন্দন জানাই এবং তাদেরকে নতুন এলাকার দায়িত্ব দিই।  আমি জেনারেল আখতারের সঙ্গে যােগাযােগ করি এবং পাল্টা হামলীর সাফল্য সম্পর্কে তাকে অবহিত করি। তিনি খুশি হন। আমাকে পরিস্থিতির প্রয়ােজনে যেকোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেন। আমি ব্রিগেডের ব্যাটালিয়নগুলাে পরিদর্শন করি এবং কিছু পরিবর্তন করি। এক জায়গায়, বিচ্ছিন্ন লড়াই বেঁধে যায়। সরাসরি অ্যান্টি ট্যাংক গান ফায়ার করে আমরা শত্রুর অবস্থান মুক্ত করি। অস্ত্রগুলাে খুলে। নেয়া হয় এবং জায়গা মতাে বয়ে নিয়ে আবার পুনর্গঠন করা হয়।

এলাকাটা ভালােভাবে পর্যবেক্ষণ করার পর আমি উড়ি দখলের সিদ্ধান্ত নিই। রাওয়ালপিন্ডির অস্ত্রাগার থেকে আমি দুটো মাউন্টেনগান পাই এবং এগুলাে এমন এক আদর্শ জায়গায় স্থাপন করি যেখান থেকে উড়িতে গােলাবর্ষণ করা যায়। কিন্তু উড়িতে আক্রমণ চালানাের আগে আমাকে শিয়ালকোট যাবার নির্দেশ দেয়া হয়, যেখানে শক্রদের হামলা শুরু হয়েছে। মেজর জেনারেল আবরার আমার ১৪ প্যারা ব্রিগেডকে তার অধীনে স্থানান্তর করার অনুরােধ জানান। আমি আজাদ কাশ্মির ত্যাগ। করি, শিয়ালকোট সেক্টরে পৌছাই এবং জিওসি ও সাঁজোয়া ডিভিশনের কাছে রিপাের্ট করি। এভাবে ১২ ডিভিশন থেকে আমি ও সাঁজোয়া ডিভিশনে স্থানান্তরিত হই এবং জেনারেল আবরারের নেতৃত্বে বেদিয়ানা, চাবিন্দা ও জাফরওয়ালে যুদ্ধ করি। মেজর জেনারেল আখতার মালিকের অনুরােধে আমাকে ১২ ডিভিশনে। ফিরিয়ে নেয়া হয় এবং মেজর জেনারেল অবরার হুসাইনের অনুরােধে আমাকে নেয়া হয় শিয়ালকোট সেক্টরে ।। শিয়ালকোট সেক্টর ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৯টায় আমি ডিউটির জন্য ৬ সাজোয়া ডিভিশনের কমান্ডার মেজর জেনারেল আবরার হুসাইন, এমবিই-এর কাছে রিপাের্ট করি। স্বাভাবিক আলাপ-আলােচনা এবং এক কাপ গরম চা পান করার পর মানচিত্রে তিনি আমাকে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। তিনি রাখ বাবা বড় শাহ-এর ওপর জোরে চাপ দিয়ে বলেন যে দ্রুত এটা দখল করতে হবে। রাখ বাবা বড় শাহ জায়গাটি ছিল গাছপালায় আচ্ছাদিত শত্ৰু ট্যাংক লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা। ট্যাংকগুলােতে রাতের বেলা পুনরায় জ্বালানি ভরে নেয়া হয় ও নতুন করে সরবরাহ করা হয়। এই জায়গাটা থেকে শত্রুকে বিতাড়ন করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জায়গাটা আমাদের অবস্থানের খুব কাছে। যেকোনাে মূল্যে এটা দখল করতে হবে যেন এখান থেকে শত্রুরা পরবর্তী হামলা করতে না পারে। আমাকে জানানাে হয় যে বেদিয়ানা গ্রাম, যেটা শিয়ালকোট, পামরুর এবং নারায়াল সংযােগ রাস্তার ওপর অবস্থিত, সেটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ গ্রামের পরের গ্রামগুলাে রয়েছে ভারতীয়দের দখলে। তাদের প্রধান অবস্থান ছিল রাখ-এ।

আমি ভূপালওয়ালায় যাই যেখানে আমার ব্রিগেড রয়েছে এবং অভিযানের জন্য আমি নির্দেশ দিই। পরদিন রাত দুটোর দিকে ব্যাটালিয়নগুলাে তাদের নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌছে। ব্যাটালিয়ন গুলাে পরিদর্শনের পরে আমি ১/১ পাঞ্জাবকে এক ঘন্টার নােটিশে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করি। বেদিয়ানা ও আশেপাশের এলাকা অনুসন্ধান করার জন্য আমি এক সেকশন সৈন্য নিয়ে রওনা দিই। যখন আমি গ্রামে ঢুকলাম আমার ড্রাইভার আলম জান মাসুদ ও আমি দেখতে পাই যে এক ডজন ভারতীয় সৈন্য একটি ওয়ারলেস সেটের চারদিকে জড়ো হয়ে বসে আছে। তারা মনােযােগ দিয়ে কিছু একটা শুনছিল। থামলাম আমরা, জিপটা উল্টো দিকে নিয়ে বেদিয়ানা থেকে প্রায় তিনশ গজ দূরে একটি মন্দিরের দিকে। এগিয়ে গেলাম। এসকর্ট সেকশনকে নির্দেশ দেয়া হয় মন্দিরে ট্রাক থেকে নেমে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান করার জন্য এবং ১/১ পাঞ্জাবের জন্য অপেক্ষা করার জন্য। যদি শক্ররা এক প্লাটুন বা তার বেশি সৈন্য নিয়ে এসকটের ওপর হামলা চালায়, তাহলে তারা অবস্থান ত্যাগ করে নুল্লাহর ভেতর দিয়ে এসে মন্দিরে আমার সঙ্গে যােগ দেবে। এক ঘণ্টা পর ১/১ পাঞ্জাব-এর আলফা কোম্পানি মন্দিরে এসে পৌছাল। তাদের প্লাটুনকে ইতােমধ্যে গ্রামের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থান গ্রহণকারী এসকর্ট সেকশনের সঙ্গে যােগ দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। কয়েক মিনিট পর গােলাগুলি শুরু হয়, তারপর পুরােপুরি থেমে যায়। কোম্পানি কমান্ডার মেজর জামান কায়ানিকে সামনে পাঠান হয় সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য। তিনি ফিরে আসেন প্রায় ৩০ মিনিট পর। তিনি জানান যে ভারতীয়রা এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে হামলা চালিয়েছে। হামলা প্রতিহত করা হয়েছে। শত্রুরা দ্রুত পালিয়ে গেছে গ্রামের দিকে। কোম্পানি কমান্ডার বেদিয়ানা গ্রামের চারদিকে তার কোম্পানি মােতায়েন করেছেন। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ ও খনন কাজ শুরু হয়। আমার এসকট তখনাে এসে পৌছেনি। এর মধ্যে লে. কর্নেল আমির গুলিস্তান জানজুয়া (পরে ব্রিগেডিয়ার এবং গভর্নর, এন ডব্লিউ এফ পি) , সিও গাইডস ক্যাভারলি এবং তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর ফজলে হক (পরে লেফটেন্যানন্ট জেনারেল এবং গভর্নর, এন ডব্লিউ এফ পি) একটি জিপে আরােহণ করেন।

জানজুয়া আমাকে বলেন যে ১৯ ল্যান্ডার গ্রামের অপর প্রান্তের এলাকা শত্রু মুক্ত করার জন্য এগিয়ে যাচ্ছে এবং তার রেজিমেন্ট, গাইড ক্যাভারলি তাদেরকে সাহায্য করবে যদি ভারতীয় সাজোয়া বাহিনী হামলা চালায়। এ সময়ে ট্যাংক ফায়ার শুরু হয় এবং ১৯ ল্যান্সার গাইড ক্যাভারলির কয়েকটা ট্যাংক ধ্বংস করে। আমি জেনারেল আবরারকে অবহিত করি যে বেদিয়ানা গ্রাম আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং ১৪ প্যারা ব্রিগেড সৈন্যরা এ গ্রাম থেকে ভারতীয়দের তাড়িয়ে দিয়েছে। সে কারণে ১৯ ল্যান্সারের আক্রমণ থামাতে হবে। এলাকাটি ১/১ পাঞ্জাবের নিয়ন্ত্রণে থাকার কারণে পরবর্তী আক্রমণ স্থগিত রাখা হয়। রাখ বাবা বড় শাহ-এ আক্রমণ। ১/১ পাঞ্জাবের বাকি সৈনিকরা এসে পৌছাল। এই ব্যাটালিয়নকে বেদিয়ানা ও মন্দিরে মােতায়েন করা হয়। লে. কর্নেল নসরুল্লাহ, সিওকে বলা হয় এলাকায় টহল দিতে। রাখ-এ আক্রমণের এইচ আওয়ার পরদিন সকাল ৯টার আগে নয়। এ সময়টাকে নির্ধারণ করা হয় শত্ৰু ট্যাংকগুলােকে তাদের যুদ্ধক্ষেত্র অবস্থানে এগিয়ে আসতে দেবার জন্য।

কামানের লক্ষ্য নির্ধারণ ও একটি কার্যকর আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্ট পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য আর্টিলারির লে. কর্নেল আতা মুহাম্মদ (পরে ব্রিগেডিয়ার) নসরুল্লাহর সঙ্গে অবস্থান করেন। পরদিন ভােরে, আমি সাড়ে ৬টার দিকে এলাকায় পৌছাই। লে. কর্নেল নসরুল্লাহ ও লে. কর্নেল আতা মুহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে আমি বেদিয়ানার অবজারভেশন পােস্টে যাই। আগেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, বামপার্শ্ব থেকে দুটো কোম্পানি আক্রমণ চালাবে। নসরুল্লাহকে আমি নির্দেশ দিলাম দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে নুল্লাহর মধ্য দিয়ে তার তৃতীয় কোম্পানি নিয়ে অগ্রসর হবার। নুল্লাহতে অনেক ঝােপঝাড় ও বাক ছিল। এটা ছিল নিজেদের আড়াল করা ও শত্রুর মনােযােগ বিভক্ত করার মতাে জায়গা। মনে হবে দুদিক দিয়েই তারা আক্রান্ত হচ্ছে। সকাল ৯টায় এইচ আওয়ার নির্ধারণ করা হয়। ১/১ পাঞ্জাবের দুটো কোম্পানি তাদের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর লালখানের। নেতৃত্বে সূর্যোদয়ের আগে এগিয়ে যায় তাদের ফরমিং আপ প্লেস (এফ ইউ পি)-এর দিকে, সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তাদের অবস্থান টের পাওয়া যায় নি। ব্রিগেডের। তিনটি ব্যাটালিয়নের মর্টার প্লাটুন কর্নেল আতার নেতৃত্বে মধ্যভাগে অবস্থান নেয়। তার সঙ্গে ছিল একটি সংযুক্ত ফিল্ড রেজিমেন্ট। দক্ষিণ পার্শ্বে দুটো ব্যাটালিয়নের যােলটি ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের সমন্বয়ে একটি অ্যান্টি-ট্যাংক স্ক্রিন তৈরি করা হয়। অ্যান্টি ট্যাংক ফ্রিন স্থাপন করা হয় মেজর মেহতাব-এর নেতৃত্বে, যিনি আর্টিলারির আরেকজন সুদক্ষ অফিসার ছিলেন। আমাদের দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে শত্রু ট্যাংকগুলাে এগিয়ে এলে সেগুলাে ধরাশায়ী হয় মেজর মেহতাবের অস্ত্রের কাছে। মর্টার ও আর্টিলারির গােলাবর্ষণ ছিল চমৎকার এবং এতে রাখ-এর ঘাসে আগুন ধরে যায়। ১/১ পাঞ্জাব আক্রমণে অংশগ্রহণ করার আগে টার্গেট যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১/১ পাঞ্জাবের দুটি কোম্পানি এফ ইউ পি থেকে রণাঙ্গনে প্রবেশ করার সময় কর্নেল আতা ও আমি দেখতে পেলাম তিনটি শক্র ট্যাংক প্রায় ৮০০ গজ দূরে বাম। পার্শ্বে এগিয়ে আসছে। বামপার্শ্ব থেকে গােলাবর্ষণ করলে আক্রমণকারী সেনাদলের ওপর বিধ্বংসী প্রভাব ফেলতে পারত। বামপার্শ্বে অবস্থানরত ১/১ পাঞ্জাবের চারটি ট্যাংক বিধ্বংসী কামান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি কারণ শত্ৰু ট্যাংকগুলাে একটা ডােবায় লুকিয়ে পড়ে।

লে. কর্নেল আতা ওয়ারলেসে ১৫ ডিভিশনের কমান্ডার আর্টিলারির সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং আর্টিলারি ফায়ারের জন্য তাদের মাঝারি রেজিমেন্ট সহ সাহায্য চান। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ১৫ ডিভিশন আর্টিলারি শত্রুর কয়েকটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে গােলাবর্ষণ শুরু করে। এ গােলাবর্ষণে শক্রর একটি ট্যাংকে আগুন ধরে। যায় এবং অন্য দুটি ট্যাংক পালিয়ে যায়। | আমাদের পদাতিক বাহিনীকে রণাঙ্গনে যেতে বলা হয় আবার আক্রমণ করার জন্য। তাদের আক্রমণ সফল হয়। শত্রুর গােলাবর্ষণ সত্ত্বেও ক্ষতির পরিমাণ ছিল। সামান্য। শক্ররা অবস্থান ছেড়ে চলে যায়, ওটা দখল করে নেয় ১/১ পাঞ্জাবের দুটো কোম্পানি। নুল্লাহ থেকে অগ্রসরমান কোম্পানি তাদের সম্মুখ ভাগের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করার পর এ দুটো কোম্পানির সঙ্গে যােগ দেয় এবং রাখ-এর ভেতরে শক্ত ঘাঁটি গড়ে তােলে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার তার চতুর্থ কোম্পানি ও ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার্সকে সামনের দিকে নিয়ে আসেন। সদ্য দখলকৃত এলাকা রক্ষায় অ্যান্টি ট্যাংক স্ক্রিনকেও এগিয়ে আনা হয়। নসরুল্লাহকে বলা হয় শত্রুদের পরিত্যক্ত অবস্থান ধ্বংস করার জন্য। সন্ধ্যার মধ্যে রাখ বাবা বড় শাহ দখল সম্পন্ন হয় এবং এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় ১/১ পাঞ্জাব।

আলহার-এ আক্রমণ

একদিন বিশ্রামের পর আমি আলহার গ্রামে আক্রমণের জন্য জিওসির অনুমতি চাইলাম। ১/১ পাঞ্জাব রাখ বাবা বড় শাহে অবস্থান করছিল। তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ। সম্প্রসারিত করা হয়েছিল রেল লাইনের ওপারে একশ গজ সামনে। এটা ছিল একটি চমৎকার প্রতিরক্ষা বিন্যাস, কিন্তু তাদের সম্মুখ ও দক্ষিণপার্শ্ব উন্মােচিত হয়ে পড়ে। অল্প কয়েকটা মাইন ও অল্প কয়েকটা ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের সাহায্যে তাদের পক্ষে শক্রর সঁজোয়া ও পদাতিক হামলা প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না। তখন পর্যন্ত এ প্রচণ্ড লড়াইয়ে আমাদের সাঁজোয়া বহর ধ্বংস করার জন্য শত্রুপক্ষ তাদের সাঁজোয়া বাহিনী ব্যবহার করছিল। আমাদের সাঁজোয়া বহর ধ্বংস করার জন্য ভারতীয়দের এ কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় তারা সাঁজোয়া বাহিনীর সমর্থন নিয়ে পদাতিক হামলা শুরু করে। ১/১ পাঞ্জাবের অবস্থানে শক্রর হামলার আশংকা ছিল। তাই প্রতিরক্ষা ব্রিগেড চালিয়ে যাবার জন্য ও তার অখণ্ডতা ধরে রাখার জন্য আমাদের জন্য আলহার গ্রাম দখল করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ গ্রামটির অবস্থান ছিল রাখ বাবা বড় শাহ থেকে প্রায় বারশাে গজ দক্ষিণে। | সাঁজোয়া বাহিনীর সাহায্য ছাড়া এই সুরক্ষিত জায়গাটা দখল করা ছিল একটি। দুঃসাধ্য কাজ, এতে প্রচুর প্রাণহানি ঘটতে পারত। মর্টার ও আর্টিলারির তীব্র গােলাবর্ষণে একটি সুরক্ষিত এলাকা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য প্রচণ্ড আঘাত, ভবন ধ্বংস ও প্রতিপক্ষের অবস্থান তছনছ করার প্রয়ােজন হয়। পদাতিক হামলা শুরুর আগে এ ধরনের কাজ অপরিহার্য। কর্নেল আতার সঙ্গে ফায়ার সাপাের্ট নিয়ে আলােচনা করা হয়। এ হামলার জন্য দুটো ব্রিগেড মর্টার প্লাটুন ও দুটো আর্টিলারি রেজিমেন্ট পাওয়া যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর মনােবল ভেঙে দেয়ার জন্য রেলওয়ে স্টেশন ও তার পাকা ভবন গুলােতে হামলা চালানাের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। আমি লে. কর্নেল ইলাম দোস্ত, সিও বেলুচ ব্যাটালিয়ন-এর সামনে আমার পরিকল্পনা তুলে ধরি।

এইচ আওয়ার নির্ধারণ করা হয় রাত ১ টায়। তাদের সাথে আক্রমণকারী কোম্পানির আর্টিলারি অফিসাররা ছিল। হামলা শুরু হয় এবং আর্টিলারি ফায়ার শুরু হয় এইচ মাইনাস ৫ থেকে এইচ প্লাস ৪-এ। রেলওয়ে স্টেশনের ওপর ফায়ার করে ফিল্ড আর্টিলারি এবং আলহারে ফায়ার করে মর্টার প্লাটুন। এইচ থেকে এইচ প্লাস হতে মর্টারগুলাে রেলওয়ে স্টেশনে স্থানান্তর করা হয়। এবং এইচ প্লাস ২ থেকে এইচ প্লাস ৪-এ আর্টিলারি ও মর্টারের সাহায্যে সরাসরি আলহারে আঘাত হানা হয়। দুটো অবস্থানই দখল করা হয়। পনেরটি মৃতদেহ রেখে পালিয়ে যায় শক্ররা। আমাদের হতাহত হয় প্রায় বার জন। আলহার দখলে আসায় ব্রিগেডের প্রতিরক্ষা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সেখানে ব্রিগেডের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সমঝােতামূলক সমর্থন, গভীরতা ও ধারাবাহিকতা ছিল। সৈন্যদের চমৎকার নৈপুণ্যের জন্য কমান্ডিং অফিসারকে অভিনন্দন জানানাের পর ডিভিশন হেড কোয়ার্টার্সকে গ্রাম দখলের খবর জানালাম। লে. কর্নেল ইলাম দোস্তকে ইমতিয়াজ-ই-সনদ পুরস্কার দেয়া হয়।

জাফরওয়ালে অভিযান

যুদ্ধের উত্তাপ চরমে পৌঁছে। আলহার দখলের পরদিন জেনারেল আবরার আমাকে ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার্সে ডেকে পাঠান। তিনি আমাকে রাখ বাবা বড় শাহে ১/১ পাঞ্জাব রেখে ব্রিগেডের অপর দুটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে জাফরওয়াল যেতে বলেন। জাফরওয়ালের অবস্থান আমাদের বর্তমান অবস্থান সড়কপথে প্রায় চল্লিশ মাইল। দূরে। সােজা পথে এই দূরত্ব খুব কম। গােয়েন্দা রিপাের্ট অনুযায়ী, ভারতীয়রা জাফরওয়াল অক্ষে তাদের সৈন্য সমাবেশ ঘটাচ্ছে। এ তৎপরতায় কেবল আমাদের ডিভিশনের দক্ষিণ পাই উন্মোচিত হবে না, উপরন্তু গুজরানওয়ালা-লাহাের সড়কেও ভারতীয় সেনা হামলার আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা। প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর হামলা প্রতিহত করতে জাফরওয়াল দখল করা জরুরি হয়ে ওঠে। দুটো ব্যাটালিয়নের অভিযানের সময় নির্ধারণ এবং প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দানের পর আমি প্রায় ৩টার সময় রেকি গ্রুপ নিয়ে জাফরওয়ালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার) মাহমুদ, সবার কাছে টনি মাহমুদ নামে পরিচিত, তার অধীনস্থ ৪ এফএফ-এর একটি সেকশনসহ এসকর্ট হিসেবে আমার সঙ্গী হন। আমরা জাফরওয়ালে পৌঁছলাম রাতে। তখনাে শহরে কিছু বেসামরিক লােকজন। ছিল। আমি একটি হাইস্কুলে আমার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার্স স্থাপন করি এবং স্থানীয় একটি রেকি করি। ৪ এফ এফ, যেটা আমাকে অনুসরণ করছিল, তাকে মােতায়ন করা হয় জাফরওয়ালের চারদিকে। পরদিন ভােরে এক কাপ চা পান করার পর আমি এলাকাটা অনুসন্ধান করার জন্য বেরিয়ে পড়লাম এবং দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন মােতায়েন করার জন্য জায়গা খুঁজে বের করলাম। দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ন একটি অস্থায়ী অবস্থানে রাত কাটায়। মেজর ইমতিয়াজ আমার সঙ্গে ছিলেন। জাফরওয়াল ছিল প্রায় এক হাজার গজ প্রশস্ত এক শুষ্ক নদীর তীরে অবস্থিত। নদীর অপর তীরে ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ গাছ ও লম্বা ঘাস। এগুলাের উপস্থিতি প্রতিরক্ষার জন্য ভালাে।

অবস্থান গ্রহণের জন্য দুটি শক্ত জায়গা বাছাই করা হয়। একটি জাফরওয়ালে, আরেকটি নদীর অন্য ধারে। এটা শত্রু বাহিনীকে দুভাগে ভাগ করবে। দুটি অবস্থান দখল করা ছাড়া শত্রুর পক্ষে এগিয়ে আসা সম্ভব নয়। সেকেন্ড ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের কাছে এ এলাকার দায়িত্ব দেয়া হয়। তাকে নদীর অন্যপারে তার ব্যাটালিয়ন মােতায়েন করার নির্দেশ দেয়া হয়। ব্যাটালিয়ন রওনা হবার আগে মেজর টনি মাহমুদ আমাকে জানান যে নদীর অপর পারে শক্রর ট্যাংকে চলাচল করতে দেখা গেছে। তাদের সংখ্যা প্রায় এক স্কোয়াড্রন। ওরা এত কাছে এসে পড়ায় মনে হচ্ছিল ওরা জাফরওয়ালে আমাদের উপস্থিতি টের পায়নি। | আমি জেনারেল আবরারকে আমাদের এলাকায় সামরিক ট্যাংক চলাচল সম্পর্কে অবহিত করি। তিনি আমাকে বললেন যে শত্রুরা চাবিন্দা এলাকায় প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করেছে, সেখানে ভয়াবহ ট্যাংক যুদ্ধ চলছে। পদাতিক বাহিনী গােপনে তাদেরকে অনুসরণ করছে। তিনি বলেন যে জাফরওয়াল এলাকার ট্যাংকগুলাে উদ্দেশ্যবিহীন হতে পারে। এগুলােকে থামানাে নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা সেক্টরে গিয়ে যুদ্ধে যােগ দিতে না পারে। আমি মেজর টনিকে বললাম আমাদের বাম পার্শ্ব রক্ষায় মােতায়েনকৃত ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের দায়িত্ব নিতে এবং শক্র ট্যাংকগুলােকে মােকাবিলা করতে। তিনি তৎপর হয়ে ওঠেন। পনের মিনিট পরে ট্যাংক বিধ্বংসী কামানের গর্জন শােনা যায়। শত্রুকে মােকাবিলা করতে আরাে ট্যাংক বিধ্বংসী কামান মােতায়েন করা হয়। টনির কাছে একটি পদাতিক রাইফেল কোম্পানি ও দুটো এমজি পাঠানাে হয় তার প্রতিরক্ষা ও গােলাশক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। টনির দক্ষ বাহিনীর ট্যাংক বিধ্বংসী গােলাবর্ষণে শক্র ট্যাংকগুলাে পিছু হটে। এক ঘণ্টা পর আমি আবার জেনারেল আবরারের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি আমাকে বললেন যে তারা শত্রুপক্ষের একটি বার্তা মনিটর করেছেন যাতে বলা হয়েছে জাফরওয়ালে তাদের রেজিমেন্ট আক্রান্ত হয়েছে। তিনি সৈন্যদের কর্মতৎপরতায় সন্তুষ্ট এবং আমাকে বললেন জাফরওয়ালের প্রতিরক্ষা আরাে সংহত করতে। দুটো ব্যাটালিয়নকে সতর্ক রাখা হয় শত্রুর। আক্রমণের আশঙ্কায় । কিন্তু কোনাে কিছু না ঘটায় তাদেরকে সরিয়ে আনা হয়। স্ক্রিন ও টহলদলকে সামনে পাঠান হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য।

বেদিয়ানায় প্রত্যাবর্তন

প্রায় সাড়ে ৪টার দিকে আমাকে নির্দেশ দেয়া হয় আমার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার্স ও দুটো ব্যাটালিয়ানকে বেদিয়ানা এলাকার মূল অবস্থানে সরিয়ে নিতে । আশঙ্কা করা হচ্ছিল শক্ররা এ এলাকায় রাতে হামলা চালাবে। ডিভিশনাল কমান্ডারের কাছে রিজার্ভ সৈন্য ছিল না। তাই প্রথম লাইন প্রতিরক্ষা ভেঙে শত্রুরা সামনের দিকে এগিয়ে গেলে তা প্রতিহত করা কঠিন বলে বিবেচিত হয়। ১৪ প্যারা ব্রিগেডকে নির্দেশ দেয়া হয় বেদিয়ানায় এগিয়ে যাবার। জাফরওয়ালের অবস্থান তুলে দেয়া হয়। রেকি দলের সদস্য ও সহায়তা দানকারী ব্যাটালিয়নের হাতে। আমাদের জন্য প্রাপ্ত যানবাহনে উঠে আমরা দ্রুত রওনা হলাম এবং মূল। অবস্থানে পৌছলাম। আমি রিপাের্ট করলাম জেনারেল আবরারের কাছে। তিনি ১৪ প্যারা ব্রিগেডকে চেয়ে ২৪ ব্রিগেডকে অব্যাহতি দিতে চাইলেন, কিন্তু ২৪ ব্রিগেড প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধে ব্যস্ত ছিল তাই পরিবর্তন করা সম্ভব হয়নি। আমি ২৪ ব্রিগেডের। পেছনে ১৪ প্যারা ব্রিগেডকে মােতায়েন করার পরামর্শ দিলাম। ডিভিশনাল কমান্ডার এতে রাজি হন। ব্যাটালিয়ন গুলাে যথাযথভাবে মােতায়েন করা হয়। শত্রুদের আক্রমণ কোনাে উন্নতি করতে পারেনি এবং তারা ক্রমে নিঃশেষিত হয়ে যায়। শত্রুদের ট্যাংক ও পদাতিক বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আক্রমণ ব্যর্থ হবার পর শত্রুরা চলে যায় আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে।

জাফরওয়ালের যুদ্ধ

এক রাত সুন্দরভাবে কাটানাের পর সন্ধ্যায় আমাকে আবার ডেকে পাঠান জেনারেল আবরার। তিনি আমাকে বললেন, “আমার আশঙ্কা আপনাকে আবার জাফরওয়াল দখল করতে হবে। আমি এই অক্ষরেখা সম্পর্কে এখনাে শঙ্কিত। এটা দুর্বলভাবে ধরে রাখা যাবে না। রাল এবং আলহারে দুটো ব্যাটালিয়ন রেখে তৃতীয় ব্যাটালিয়ন। নিয়ে জাফরওয়ালে রওনা হন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি এক ব্যাটালিয়ন নিয়ে জাফরওয়াল দখল করতে পারব কিনা। যা, এটা সম্ভব। এটা প্রচুর ঘরবাড়ি অধ্যুষিত এলাকা হওয়ায় গােলাবর্ষণের জন্য ভালাে ক্ষেত্র,’ তাকে বললাম আমি, এবং অনুরােধ করলাম সাজোয়া ও গােলন্দাজ সমর্থন দেবার জন্য। তার আশির্বাদ ও সাজোয়াবাহিনীর সমর্থনের আশ্বাস পেয়ে আমি জাফরওয়ালের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ৪-এফএফ-কে অবিলম্বে এগিয়ে যাবার নির্দেশ দেয়া হয় । এটা ছিল সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শত্রুর আগে সেখানে পৌছান এক প্রতিযােগিতা। কয়েকদিন আগে আমরা জাফরওয়ালের যে স্কুলে অবস্থান। নিয়েছিলাম সেই একই স্কুলে আমি অবস্থান নিই। ৪-এফএফ এসে পৌঁছে যায় এবং এটাকে জাফরওয়াল গ্রামে মােতায়েন করা হয়। ৪-এফএফ আগেও এখানে এসেছিল। তাই এলাকাটি চিনতে তাদের কষ্ট হয় নি। মেজর হাশেম খানের নেতৃত্বে ২২ ক্যাভালরির এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক ও ফিল্ড রেজিমেন্টের একটি ব্যাটারি আমার অধীনে দেয়া হয়। ঠিক করা হয় ট্যাংকের অবস্থান। আর্টিলারির গােলাবর্ষণের জন্যও টার্গেট নির্বাচন করা হয় । আমি ভাের চারটায় বিগ্রেড হেড কোয়ার্টার্সে ফিরে এলাম। ঘুমাতে চলে গেলাম এবং ব্যাটমানকে বললাম বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া আমাকে না জাগাতে।  সকাল ৬টায় আমার বিগ্রেড মেজর, মেজর ইমতিয়াজ জেগে ওঠেন এবং আমাকে জানান যে, ৪-এফএফ শত্রুর গােলাবর্ষণের আওতায় এবং আক্রান্ত হওয়ার পথে রয়েছে। কমান্ডিং অফিসার ভীত হয়ে পড়লেন। আমি ৪-এফএফ-এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল লতিফের সঙ্গে আলাপ করলাম। তিনি আমাকে জানালেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী তার বাহিনীকে ঘেরাও করে ফেলেছে। আমি তাকে বললাম।

যে, জাফরওয়ালে প্রচুর পাকা বাড়িঘর রয়েছে এবং জায়গাটি উঁচু, তাই এখানে খুব। ভালােভাবে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়া সম্ভব এবং এখান থেকে শত্রুর ওপর। দক্ষতার সঙ্গে গােলাবর্ষণও সহজতর। আবার পনেরাে মিনিট পর তিনি আমাকে ফোন করলেন এবং বললেন যে, তারা সবাই মারা পড়বে। আমি তার এ ভীতি দেখে হতাশ হলাম এবং বুঝতে পারলাম। যে, তার এ ধরনের ভীরু মানসিকতার প্রভাবে তার অধীনস্থ অফিসার ও সৈন্যদের। মনােবল ভেঙে পড়বে। তখন আমি তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ডকে ডাকতে বললাম। তার সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন একজন পাঠান। নাম মেজর মােহাম্মদ হায়াত। এবং তিনি এ ব্যাটালিয়নে নতুন যােগ দিয়েছেন। আমি মেজর হায়াতকে বললাম, তােমার কমান্ডিং অফিসার ভেঙে পড়েছেন। তুমি কি দায়িত্ব গ্রহণ এবং যুদ্ধ চালিয়ে। যেতে পারবে?’ জবাবে তিনি ছিলেন আত্মবিশ্বাসী। বললেন, ‘ইনশাল্লাহ, আমরা শত্রুকে পিছু হটিয়ে দেব।’ আমি লে. কর্নেল লতিফকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি । দিই। তিনি ফিরে আসতে চাইলেন কিন্তু আমি তাকে ফিরে আসার অনুমতি দিলাম । আমি তাকে বললাম ট্রেঞ্চে বসে থাকতে এবং সৈন্যদের সামনে না যেতে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পর মেজর হায়াত আমাকে ফোন করলেন। তিনি আমাকে। বললেন যে, শক্রর হামলা প্রতিহত করা হয়েছে। শত্রুরা এক স্কোয়াড্রন ট্যাংক ও দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে হামলা চালায়। দুটি ট্যাংক ঘায়েল হয়। মেজর হায়াত শক্রর পশ্চাদ্ধাবনে আমার অনুমতি প্রার্থনা করেন। আমি তাকে শক্রদের অনুসরণ করার অনুমতি দিলাম। তবে তাকে সতর্ক করে দিলাম শক্রর ফাঁদে পা না দেয়ার জন্য। মাত্র একজন ব্যক্তি পরিস্থিতি বদলে দেন। মেজর হায়াতের সাহস ও দৃঢ়তায়। তার সৈন্যরা অনুপ্রাণিত হয়। এটা সত্য যে যুদ্ধ জয়ে বহু লােক নয়, একজনই। যথেষ্ট। বীরত্বের জন্য মেজর হায়াতকে সিতারা-ই-জুরাত পদকে ভূষিত করা হয়। ভারি কামানের কামান্ডার মেজর দিলওয়ার ভাই শত্রুর ট্যাংকগুলাের প্রতি আতংক সৃষ্টি করেন। তাকেও সিতারা-ই-জুরাত পুরস্কার দেয়া হয়। ফিল্ড ব্যাটারি কমান্ডার। মেজর হাশেমের আওতাধীন কামানের ওপর সার্বক্ষণিক গােলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু। তা সত্ত্বেও তিনি চমৎকার নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। আমার যতদূর মনে পড়ে মেজর হাশেমকে সিতারা-ই-সনদে ভূষিত করা হয়েছিল। ট্যাংক বহরের স্কোয়াড্রন কমান্ডার ও তার দুজন সৈন্য পালিয়ে যায়। তবে একজন সৈন্য ফিরে এসে যুদ্ধে। অংশগ্রহণ করেছিল। যুদ্ধ থেমে যাবার পর এ স্কোয়াড্রন কমান্ডারের কোর্ট মার্শালে বিচার হয়।  ৩/১৪ পাঞ্জাবের একটি কোম্পানি আমার সঙ্গে ছিল এবং এ কোম্পানিকে। জাফরওয়ালে ৪-এফএফ-এর সঙ্গে যােগদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। আমি তাদের সঙ্গে রওনা হলাম। অফিসার ও জওয়ানদের মনােবল ছিল খুবই দৃঢ়। তাদের সঙ্গে এক কাপ চা পানের পর আমি আমার ব্রিগেড সদর দপ্তরের উদ্দেশে। 

যাত্রা করলাম। লে. কর্নেল লতিফকে ডিভিশনাল হেড কোয়ার্টার্সে রিপাের্ট করতে বলা হয়, সেখান থেকে তাকে পাঠানাে হয় তার রেজিমেন্টাল সেন্টারে। | যুদ্ধ স্থিত হয়ে এল। ফ্রন্ট স্থিতিশীল। ভারতীয় সেনাবাহিনী কোণঠাসা অবস্থায়। ব্রিগেডিয়ার রিয়াজুল করিমকে ব্রিগেডিয়ার ইফেন্দির স্থলাভিষিক্ত করা হয়। ডিভিশনের অবস্থা তখন অত্যন্ত সংহত। এর সবকিছুই জেনারেল আবরারের। দক্ষতা, ব্যক্তিগত স্পর্শ ও সম্মােহনী ব্যক্তিত্বের কারণে হয়। | আমি হারানাে এলাকা পুনরুদ্ধারে ভারতীয়দের ওপর হামলা করার জন্য জেনারেল আবরারের কাছে প্রস্তাব করি। এ সময় ভারতীয়দের অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। রণাঙ্গনে তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। তখন যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতাে অবস্থা তাদের ছিল না। পরদিন আমরা রওনা হলাম। আমি বিস্তারিতভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করলাম। স্থির করা হয় যে, বাম পাশ থেকে আমার ব্যক্তিগত কমান্ডে দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য ওয়াদিনওয়ালা গ্রামে হামলা চালাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট আমার সঙ্গে যােগ দেবে। তৃতীয় ব্যাটালিয়নকে অগ্রবর্তী হামলার জন্য প্রস্তুত রাখা হবে। মূল লড়াই করবে দুটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন। তাদেরকে সহায়তা দেবে একটি ট্যাংক রেজিমেন্ট। জেনারেল আবরার প্রতিশ্রুতি দেন যে, আমরা ওয়াদিনওয়ালা থেকে দু মাইল দূরে একটি গ্রামে পৌছালে একটি ট্যাংক রেজিমেন্টের সহায়তা নিয়ে সাজোয়া বাহিনী আমাদের দক্ষিণ পাশে শক্রর ওপর হামলা চালাবে।

হেড কোয়ার্টার্স জেনারেল আবরার অনুমােদিত এ পরিকল্পনা জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে পাঠায়। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এ পরিকল্পনা পর্যালােচনা করে তাতে সম্মতি দেয়। জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সের অনুমােদন লাভের পর জেনারেল আবরার সবুজ সংকেত দেন। আমি আমার ট্যাকটিক্যাল হেড কোয়ার্টার্সসহ দুটি ব্যাটালিয়ন। নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছে যাই। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ শুরু হবে। হঠাৎ নির্দেশ এল, ‘অপারেশন বন্ধ করাে। বসে থাকো চুপচাপ। পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধ। বন্ধে সম্মত হয়। যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দেয়া হলাে। এভাবে থেমে গেল ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ। | জেনারেল আবরারের সৈন্যরা প্রচণ্ড গতিতে যুদ্ধ করেছে। আমার অধীনস্থ ১৪ প্যারা ব্রিগেড লড়াইকালে ১৩৪ মাইল পথ অতিক্রম করেছে এবং কয়েকটি ভয়াবহ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে, শিয়ালকোট যুদ্ধে বিজয়ের সবটুকু কৃতিত্ব দেয়া হয় জেনারেল টিক্কাকে। এ ধরনের বিভ্রান্তি আজো আমাদের মাঝে বিরাজ করছে। জেনারেল আবরারের ৬ সাজোয়া ডিভিশন এবং তাঁর। নেতৃত্বাধীন পদাতিক বাহিনী বেদিয়ানা থেকে রাভি নদী পর্যন্ত বিশাল এলাকা রক্ষা করেছে। জেনারেল আবরার এবং তার ব্রিগেড, ব্যাটালিয়ন ও কোম্পানি কামান্ডাররাই শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধে জিতেছে। যুদ্ধে পদক প্রাপ্তির ঘটনাই প্রকৃত সত্য তুলে ধরছে। ১৯৬৫ সালে যুদ্ধের পর পরিকল্পনা ও বীরত্বের জন্য জেনারেল আবরারকে হিলাল-ই-জুরাত খেতাব দেয়া হয়। একইভাবে ব্রিগেডিয়ার আব্দুল আলী ও আমি হিলাল-ই-জুরাত পুরষ্কার পেয়েছিলাম যুদ্ধে অসাধারণ দক্ষতার জন্য। পক্ষান্তরে, জেনারেল টিক্কা খান অথবা তার ব্রিগেড কমান্ডারদের কেউই কোননা পদক পান নি। সত্যি কথা বলতে কী, জেনারেল টিক্কা যুদ্ধকালে তার অবস্থানের পেছনে ভারতীয় গেরিলা তৎপরতা সম্পর্কে অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন। এজন্য তার বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গের অভিযােগ। আনা হয়। তবে অল্পের জন্য তিনি রেহাই পেয়ে যান। জেনারেল টিক্কা যুদ্ধের পুরােটা সময় ছায়ার পেছনে ছুটেছেন। কারণ যুদ্ধে ভারতীয় গেরিলাদের কোনাে। তৎপরতা ছিল না। কিন্তু টিক্কার রিপাের্টে অহেতুক ভীতি সৃষ্টি হয়। | আমি আমার বক্তব্যের সমর্থনে ছােট্ট একটি ঘটনার বর্ণনা দেব। যুদ্ধ বিরতির পর আমি আমার বন্ধু টিক্কা খানের অধীনস্থ একজন ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মাহমুদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। একটি তাঁবুতে বসা ছিলেন তিনি। আমাকে বললেন, তাঁবু থেকে বের হয়ে যেতে। আমি এর কারণ জানতে চাইলাম। তিনি আমাকে বললেন যে, কয়েকজন অতিথি আসছেন। যেহেতু আমাদের ডিভিশন কোনাে যুদ্ধ করে নি, তাই আমি তাদেরকে ৬ষ্ঠ সাজোয়া ডিভিশনের এলাকায় নিয়ে যাব এবং যুদ্ধক্ষেত্র দেখাব। তােমার সামনে আমি ব্ৰিত বােধ করছি, তােমরা যখন যুদ্ধ করেছ, আমরা তখন ছিলাম শিয়ালকোটে।

হিলাল-ই-জুরাত সম্মাননা

‘ব্রিগেডিয়ার এ. এ, কে, নিয়াজি ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক যুদ্ধে একটি ফোর্সের অধিনায়কত্ব করেছেন। সাজোয়া বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট শক্রর তীব্র হামলার মুখে তিনি তার ব্রিগেডের প্রতিরক্ষা সংগঠিত করেছেন এবং অত্যন্ত সংকটময় মুহূর্তে তার এলাকা রক্ষা করেছেন। তাঁর অসামান্য বীরত্ব ও অদম্য দৃঢ়তার কারণেই শক্রর উপর্যুপরি হামলাগুলাে ব্যর্থ হয়েছে। আরেক ঘটনায় তিনি এমন এক এলাকার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন যে এলাকার ওপর শক্রর চাপ ছিল প্রচণ্ড। তার নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে পুরােপুরি উপেক্ষা করে তিনি শুধু শক্রর প্রচণ্ড হামলা প্রতিহতই করেননি, শত্রুকে তার এলাকা ত্যাগে বাধ্য করেছেন। তার অসাধারণ সাহসকিতা, বীরত্ব এবং দক্ষতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তাকে হিলাল-ই-জুরাত পদক দেয়া হয়েছে।’ কুচ-এর রানে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ হয়েছে। সেখানে টিক্কার ভূমিকা কিছুই ছিল না। তাকে শিয়ালকোটে অবস্থিত ১৫ ডিভিশনের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। তার আওতাধীন ব্রিগেডের মধ্যে ২৪ ব্রিগেডকে জেনারেল আবরারের নেতৃত্বাধীন ৬ষ্ঠ সাজোয়া ডিভিশনের অধীনে ন্যস্ত করা হয়। এবং ১১৫ ব্রিগেডকে নারােয়াল। এলাকায় মােতায়েন করা হয়। তৃতীয় ব্রিগেডকে মােতায়েন করা হয় শিয়ালকোটের আশপাশে। ডিভিশনাল সদর দপ্তর স্থাপন করা হয় শিয়ালকোট শহরে। সাধারণভাবে জেনারেল টিক্কা সাংবাদিক ও দর্শনার্থীদের ব্রিফ করতেন। লােকজন যেসব উপহার সামগ্রী পাঠাতাে তিনি সেগুলাে বিতরণ করতেন সৈন্যদের মধ্যে। ৬ষ্ঠ সাজোয়া ডিভিশনের আওতাধীন ব্রিগেড যেসব লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল তিনি সেসব লড়াই এবং যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি বর্ণনা করতেন। এতে টিক্কার ভাবমূর্তি সম্পর্কে একটি উঁচু ধারণার সৃষ্টি হয়। কিন্তু ঘটনা ছিল অন্যরকম। যুদ্ধের নায়ক জেনারেল আবরার বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে যান বিভ্রান্তির তােড়ে। জেনারেল টিকাকে বানানাে হয় বীর। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে তার কোনাে কৃতিত্বই। নেই। তিনি নায়ক ছিলেন না, ছিলেন খলনায়ক। যুদ্ধ করেছিলেন আবরার। আর তাঁর কৃতিত্ব নিয়েছেন টিক্কা। ইতিহাস কখনাে কখনাে অবিচার করে। সে কখনাে বামনকে বানায় দানব। আবার মহাবীরকেও সে স্বীকৃতি দিতে কুষ্ঠিত হয়।

যুদ্ধের পর

১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেল। এরপর যুদ্ধ থেকে শান্তিতে উত্তরণ ঘটে। অফিসারদের বদলি ও রদবদল শুরু হয়। আমি ১৪ প্যারা ব্রিগেডের কমান্ডেই রয়ে গেলাম। যুদ্ধ থেমে যাবার পর আজাদ কাশির এবং শিয়ালকোট অপারেশনের সময় নেতৃত্ব দেয় ব্রিগেড ১। এরপর আমার বদলির আদেশ এল। আবার আমাকে কোয়েটায় স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসের কমান্ড্যান্ট হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। এ বদলিতে খুশি হলাম আমি। ট্রেনিং ইনস্টিটিউশনের কমান্ড্যান্ট হিসেবে আমি কিছু প্রজেক্ট শুরু করলাম। আমি চেয়েছিলাম অসমাপ্ত কাজগুলােকে সমাপ্ত করতে। স্কুল অব ইনফ্যান্ট্রি এন্ড ট্যাকটিকসে কয়েক মাস অবস্থানের পর আমাকে পদোন্নতি দিয়ে শিয়ালকোটে ৮ম ডিভিশনে বদলি করা হলাে। ১৯৬৬ সালের ১৮ অক্টোবর আমি মেজর জেনারেল মােজাফফর উদ্দিনের কাছ থেকে ৮ম ডিভিশনের কমান্ড গ্রহণ করলাম। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমি এ এলাকাতেই ছিলাম, তাই আমাকে নতুন করে এলাকার সঙ্গে পরিচিতি হতে হয় নি। তারপরও আমি আরাে কিছু জানার চেষ্টা করলাম। মাঝে মাঝে আমরা কোথাও তাবু খাটিয়ে বেশ কিছুদিন কাটাতাম। আমি ডিভিশনের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করলাম। বিভিন্ন ইউনিটের শক্তিসামর্থ্যের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। ব্যাটালিয়নের প্রতিরক্ষামূলক কাঠামাের আওতায় প্রতিটি কোম্পানির প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। সত্যিকার অর্থে আমি আমার ডিভিশনের আওতায় প্রতিটি এলাকা হেঁটে বেড়াতাম। গােলাবর্ষণের কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার পর প্রতিটি মেশিনগান ও ট্যাংক-বিধ্বংসী কামানের অবস্থান নির্বাচন এবং এসব অবস্থান তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করা হয়। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলাে তদারক করা হতাে, উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভূয়সী প্রশংসা করতেন। কোর কমান্ডার জেনারেল আবদুল হামিদ খান প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খানও প্রশংসা করতেন। ৮ম ডিভিশনের প্রতিরক্ষা অবস্থান ঠিক হলে আমাকে লাহােরে ১০ম ডিভিশনে নিয়ােগ দেয়া হলাে।  ৮ম ডিভিশনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে আমাকে অক্লান্ত পরিশ্রম এবং যথেষ্ট ঘাম ঝরাতে হয়েছে। তারপরও আমাকে এ ডিভিশন থেকে অন্যত্র বদলি করা । হয়। এ ব্যাপারে জেনারেল হামিদকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান যে, ১০ম। ডিভিশনে আমাকে দুটি কারণে বদলি করা হয়েছে। প্রথমত ৮ম ডিভিশনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেভাবে সাজানাে হয়েছে, একইভাবে ১০ম ডিভিশনের প্রতিরক্ষা। ব্যবস্থা সাজানাের জন্য কমান্ডার-ইন-চিফের ইচ্ছা এবং দ্বিতীয়ত সামরিক শাসনের দায়িত্ব পালনের জন্য। সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে করাচিতে আমার অভিজ্ঞতা। ও তৎপরতা বিচার করে আমাকে লাহােরে পাঠানাে হলাে।

আমি মেজর জেনারেল খােদাদাদের কাছ থেকে ১৯৬৯ সালের ২২ জুন ১০ম ডিভিশনের কমান্ড গ্রহণ করলাম। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমি অপারেশনাল এলাকায় টহল দান শুরু করি এবং ১০ম ডিভিশনের প্রতিরক্ষা বিন্যাস সম্পন্ন করি। ৮ম ডিভিশনের চেয়েও এখানে এ কাজ চমৎকারভাবে সম্পন্ন হয়। শিয়ালকোটে যেসব ঘাটতি ও বাধা-বিপত্তি ছিল লাহােরে ১০ ডিভিশনের ক্ষেত্রে অনুরূপ ঘাটতি ও বিপত্তিগুলাে দূর করা হলাে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়া হলাে সৈন্য সংখ্যা ও প্রাপ্ত অস্ত্রশস্ত্রের ভিত্তিতে। ১০ম ডিভিশনের বিন্যাস আমি যেভাবে রেখে এসেছিলাম, এত বছর পর তখনাে সেভাবেই ছিল। অন্য কোনাে জেনারেল এতে কোনাে মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারেন নি। দুটো ডিভিশনের ফ্রন্টই ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ধাক্কা সামলেছে। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে ভারতীয়রা আমাদেরকে ১০ম ডিভিশনের এলাকা বামবানওয়ালা-রাভিবেদিয়ানা সংযােগ খাল (বিআরবি) বরাবর সৈন্য মােতায়েনে বাধ্য করে। বিআরবি এলাকার অপর পাশের সব এলাকা দখল করে নেয় ভারতীয়রা। সেখানে বলতে গেলে ভারতীয় সৈন্যরা বিনা বাধায় প্রবেশ করে এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। বিনা প্রতিরােধে মাইলের পর মাইল ভূখণ্ড শক্রর হস্তগত হওয়ায় সেনাবাহিনী ও জনগণ উভয়ের মনােবলে প্রচণ্ড ধাক্কা খায়। আমি ১০ম ডিভিশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে আমাদের অতীত ভুলগুলাে শােধরানাের চেষ্টা করি।  নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী ১০ম ডিভিশনের প্রতিরক্ষা লাইনকে বিআরবি ডিঙিয়ে আরাে সামনে এগিয়ে নেয়া হয়। যাতে শত্রুকে আমাদের সীমান্তেই থামিয়ে দেয়া যায়। আমার প্রতিরক্ষা বিন্যাসে বিআরবি প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ব্যুহে পরিণত হয়। আমাদের দূরদর্শিতার জন্য শক্রকে তাদের ভূখণ্ডের তিন মাইল ভেতরে প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে বাধ্য হতে হয়। আরাে, আমি ১০ম ডিভিশনের অবস্থানের সামনে ট্যাংক-প্রতিরােধকারী খালের পাড় বরাবর কিকার ও রাবার গাছ রােপণ করেছিলাম। এ গাছগুলাে এখন ঘন জঙ্গলে পরিণত হয়েছে এবং সৈন্যদের আত্মগােপন এবং আচ্ছাদনে প্রচুর সহায়ক হয়েছে। 

সূত্র : দ্য বিট্রেয়াল অভ ইস্ট পাকিস্তান – লে. জে. এ. এ. কে. নিয়াজি (অনুবাদ)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!