জাতীয় সংসদে বিসমিল্লাহ নিয়ে বিতর্ক
গত ১ আগষ্ট জাতীয় সংসদে সরকার ও বিরােধী দলের দু’জন সদস্যের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা দেখা দেয়। সম্পূরক বাজেট সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বিরােধী দলীয় সাংসদদের উদ্দেশ্যে বলেন, “সংবিধানে বিসমিল্লাহ লেখা আছে, একজন হিন্দু হয়েও আমি একথা স্বীকার করি অথচ সংবিধানে জাতির জনক হিসাবে বঙ্গবন্ধুর কথা লেখা আছে। কিন্তু আপনারা তা স্বীকার করেন না। সব ধর্মের মানুষ বিসমিল্লাহ বলে না বলে বঙ্গবন্ধু সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযােজন করেন নি। তার এই বক্তব্যকে অন্যভাবে উপস্থাপন করে বিএনপি’র জনাব শামসুজ্জামান দুদু বলেন, “উনি কোরান শরীফের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তুলনা করেছেন। একজন হিন্দুর পক্ষেই এটা সম্ভব ।” এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে সরকার ও বিরােধী দলীয় সাংসদদের মধ্যে চরম উত্তেজনা, এমনকি হাতাহাতির উপক্রম হয়। সরকার ও বিরােধী দলীয় সংশ্লিষ্ট দু’জন সাংসদের বক্তব্য ও পাল্টা বক্তব্য ছিলাে অনেকটা ধর্মীয়। আর সংসদের উভয়পক্ষে কয়েকজন ধর্ম বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তারা ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকে ব্যাপারটার একটা ব্যাখ্যা প্রদান করলে আমার মনে হয়, পরিস্থিতি এতটা গড়াতাে নয়। স্পিকারকে সংসদ মূলতবি করে প্রায় সােয়া ঘণ্টা বৈঠকে ব্যয় করতে হতাে না। কেন জানি সরকার ও বিরােধী উভয় পক্ষের আলেম সাহেবরা সবাই নীরব বসেছিলেন। অথচ তাদের সামনেই ইসলামের নামে ইসলাম বিরােধী বক্তব্য দেয়া হচ্ছিল। মানবাধিকার সম্পর্কিত ইসলামের এই সাধারণ বিধানগুলােও তারা জানেন না, এটাই বা কিভাবে মেনে নেয়া যায়। নীরব থেকে নিজেদের নিরাপদ রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু তারা বােধ হয় মহানবী (সঃ) একটি বাণীর প্রতি লক্ষ্য করেননি। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ন্যায় ও সত্য কথা না বলে নীরব তাকে সে বােবা শয়তান।” গত কদিন থেকে কয়েকটি সংবাদপত্র ও একটি মুখচেনা মহল জাতীয় সংসদে মীমাংসিত ব্যাপারটা বাইরে টেনে এনে ঘােলা পানিতে মাছ শিকারের জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। বস্তুত বিগত দু’বছর আগে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে উক্ত মহলটিকে মাঠে ময়দানে বড় একটা। দেখা যায়নি।
বর্তমানে কোন না কোন ছুতা অবলম্বন করে তারা মাঠে নামার চেষ্টা করছে। সে যাই হােক, সেদিন মিঃ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভ সংসদে তার বক্তৃতায় একটা কথা বলেছেন। তা হচ্ছে “সব ধর্মের মানুষ বিসমিল্লাহ্ বলে না বলে বঙ্গবন্ধু সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযােজন করেননি। তিনি তার এ কথার কোন ব্যাখ্যা প্রদান করেননি। অবশ্য সরকারি দলের আলেম সাংসদরা এই সুযােগের সদ্ব্যবহার করতে পারতেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযােজন না করায় অন্তত একটা ইসলামী ব্যাখ্যা আমরা তাদের নিকট আশা করেছিলাম। আর তা হত পবিত্র ধর্ম ও আওয়ামী লীগকে জড়িয়ে স্বার্থান্বেষী মহলের অপপ্রচারের একটা জবাব। দেশের প্রতিটি রাজনীতি সচেতন নাগরিক জানেন, উপমহাদেশে তথাকথিত ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ হচ্ছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতার মূলভিত্তি। ১৯৪৭ সাল ও তার আগে পরে এই অবাস্তব ধারণার ঘূর্ণিপাকের শিকার হয়ে উপমহাদেশের লাখাে মানুষকে বাস্তুভিটাচ্যুত হতে হয়েছে, মান-মাল দিতে হয়েছে। কারাে কারাে মতে সে সময় সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার চোরাবালিতে অন্তত অর্ধ কোটি লােক প্রাণ হারিয়েছে। দীর্ঘ ৫০ বছরেও উপমহাদেশের ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলাে এই রাহুমুক্ত হতে পারেনি। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শ্লোগানের মাধ্যমে পাকিস্তান কায়েম হলেও পরে পাকিস্তানের জনক মােহাম্মদ আলী জিন্নাহই এই ধারণার কবর দিতে চেয়েছিলেন। তিনি গভর্নর জেনারেল হিসাবে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে ঘােষণা করেন, “পাকিস্তানের নাগরিকরা আজ থেকে কোন মুসলমান মুসলমান নয়, কোন হিন্দু হিন্দু নয়,সবাই আমরা পাকিস্তানী ।” মিঃ জিন্নাহ বেঁচে থাকা পর্যন্ত পাকিস্তান শব্দের আগে ইসলামী প্রজাতন্ত্র সংযােগ করা হয়নি। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তান কায়েম করা হলেও একই ধর্মের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও আমরা সাবেক পাকিস্তানের এই অংশের মুসলমানরাও পশ্চিম পাকিস্তানীদের শশাষণ নির্যাতন থেকে রেহাই পাইনি। তারা আমাদের ধর্ম বিশ্বাস ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে কটাক্ষ করতে দ্বিধা করেনি।
এক্ষেত্রে একটা ঘটনা উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। পাকিস্তান আমলে, বিশেষ করে ষাটের দশকের শেষ দিকে পাকিস্তানের উর্দু পত্রিকাগুলােতে বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও ৬ দফার সমালােচনা করে এমন সব কথা লেখা হতাে, যেগুলাে ইংরেজি সংবাদপত্রে আসতাে না। সে সময় আমি প্রায় প্রতিদিন উর্দু পত্রিকাগুলােতে আওয়ামী লীগ বিরােধী অপপ্রচারের একটা সারসংক্ষেপ তৈরি করে বঙ্গবুন্ধকে দিতাম। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর পিপলস পার্টির মুখপত্র উর্দু দৈনিক মুসাওয়াতে বাঙালিদের ধর্মবিশ্বাসের উপর কটাক্ষ করে একটি প্রবন্ধ লেখা হয়। প্রবন্ধটি লেখেন পত্রিকার সম্পাদক হানিফ রামে স্বয়ং এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বললেন, অপেক্ষা কর । ভুট্টো তার দলবল নিয়ে আমার সাথে আলােচনা করার জন্য আসছে। হানিফ রামেও আসবে। আমি সুযােগ করে দিব, তখন তুমি ব্যাপারটা উঠাবে। তার ক’দিন পরই জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা আসেন। হানিফ রামেও তার সাথে ছিলেন। ভুট্টো তার দলবল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে বুড়িগঙ্গায় নৌভ্রমণে যান। এক সুযােগে বঙ্গবন্ধু আমাকে ইঙ্গিত করেন। বঙ্গবন্ধু ও ভুট্টোর সামনে আমি হানিফ রামেকে জিজ্ঞেস করে বসলাম। আপনি মুসাওয়াতে প্রকাশিত একটি লেখায় বাঙালি। মুসলমানদের সম্পর্কে মারাত্মক আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। আপনার এসব কথার। কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়ে আপনাকে শুধু এতটুকু বলবাে যে, আপনারা পাঞ্জাবি মুসলমানরা ইসলামী ইতিহাস-ঐতিহ্যকে যতটা কালিমা লিপ্ত করেছেন, বাঙালি মুসলমানরা তার একভাগও করেনি। হানিফ রামে বললেন একটা দৃষ্টান্ত দিন। বললাম, রনজিত সিংহ লাহাের শাহী মসজিদকে ঘােড়ার আস্তাবলে পরিণত করার সময় তার মন্ত্রী ছিলেন ফকির বংশের একজন পাঞ্জাবি মুসলমান। আপনার নামের শেষেও তাে বিজাতির প্রতীক রয়েছে।
জাতীয় সংহতির স্বার্থেই আমাদের কারােই এ ধরনের কথা লেখা বা বলা ঠিক নয়। যাক সে অনেক কথা, অনেক ইতিহাস। পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলায় আমরা মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লােকেরা পবিত্র ইসলামের নামে পাকিস্তানীদের এই অন্যায়-অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াই। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে দু’চার জন দালাল ছাড়া গােটা বাঙালি জাতি সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ি। সেদিন আমাদের চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সংগ্রামের পিছনে একটি যৌথ চেতনা ও মূল্যবােধ কার্যকর ছিল। এই চেতনা ও মূল্যবােধকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ নামে। অভিহিত করি।”আর তা হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ হবে গণপ্রজাতন্ত্রী। বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কেউ শােষিত বঞ্চিত হবে না। তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের মত কোন সম্প্রদায়ের ধর্মকে রাজনীতি ও শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের আলােকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালা নির্ধারণ করা হয়। সংবিধানে যাতে পাকিস্তানের মত পবিত্র ধর্ম রাজনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকার ক্ষুন্ন না হয় সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। সংবিধানে প্রস্তাবনায় পরিস্কার বলা হয়, “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়ােগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণােৎসর্গ করতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল … সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” | সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনা মূলনীতির দ্বিতীয় বিভাগের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল, “ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলােপ করা হইবে।” বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় নীতিমালার এসব কথায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবােধ সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল।
এই বাস্তব সত্য কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধে আমরা এদেশের চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চারটি সম্প্রদায়ের জন্য একটি পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার ও চুক্তি ছাড়া কিছু নয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের আলােকে প্রণীত সংবিধান এদেশের চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের যৌথ সম্পদ। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালা ও সংবিধানের এই সর্বজনীনতা অক্ষুন্ন রাখা হয়নি। বিগত ২১ বছরে পাকিস্তানী স্টাইলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ধর্মপরায়ণতাকে রাজনৈতিক পুঁজি করার হীন উদ্দেশ্যে সংবিধানে অনেক পরিবর্তন ও সংযােজন-বিয়ােজন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তন ও সংযােজন-বিয়ােজন শুধু মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোেধই নয়, ইসলামী মূল্যবােধেরও পরিপন্থী। বস্তুত রাষ্ট্র পরিচালনায় আমরা মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ বিরােধী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর তা চাপিয়ে দেয়া ইসলামও সমর্থন করে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, “তবে। অংশীবাদীদের মধ্যে যাদের সাথে তোমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে যারা তােমাদের সাথে চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করেনি আর তােমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে। আল্লাহ তাে ন্যায়নিষ্ঠদের পছন্দ করেন।” (৯৪) | পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমান ও অমুসলমানদের সম্পর্কে হলেও এর আবেদন ব্যাপক ও চিরন্তন। সকল যুগে সকল দেশের মুসলমান ও অমুসলমানদের জন্যই আল্লাহতায়ালার উক্ত আয়াত পথনির্দেশ হিসাবে কার্যকর। সুতরাং ১৯৭২ সালে প্রণিত সংবিধানের মূলনীতিমালা, বিশেষ করে ধর্মীয় অধিকার সংক্রান্ত দিকটি ইসলামী দৃষ্টিকোন থেকেও আমরা পরিবর্তন করতে পারি না। আমরা মুসলমানরা যেকোন কাজ করার আগে বিসমিল্লাহ বা আল্লাহর নামে শুরু করি। কিন্তু বাংলাদেশের অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লােকেরা বিসমিল্লাহ বলে তারা তাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী অন্য কিছু বলে।
এরূপ অবস্থায় সংবিধানের শুরুতে বিসমিল্লাহ সংযােজন করা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ বিরােধী পদক্ষেপ ছাড়া কিছু নয়। এ কথা স্বীকৃত ব্যাপার যে, বাংলাদেশের সংবিধান এককভাবে মুসলমানদের সম্পদ নয়। তাতে অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়েরও ন্যায়ত ও আইনত অধিকার রয়েছে। তারাও এই সংবিধান স্পর্শ করবে, পড়বে, যেখানে সেখানে রাখবে। এমনকি বিদেশেও এই সংবিধান যাচ্ছে এবং যাবে। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় ও ধর্মহীনরাও এই সংবিধান ব্যবহার করছে এবং করবে। বিসমিল্লাহ হচ্ছে পবিত্র কোরআনের অংশ বিশেষ। আর পবিত্র কোরআন বা তার কোন আয়াত স্পর্শ করা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলছেন, “নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কোরআন যা সুরক্ষিত আছে কিতাবে, যারা পূত পবিত্র তারা ছাড়া অন্য কেউ তা স্পর্শ করবে না। এটা বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ। তবু কি তােমরা এই বাণীকে তুচ্ছ গণ্য করবে?” (৫৬৭৭-৭৮) আল্লাহতায়ালার এই বাণীতে পূত পবিত্র অবস্থায় পবিত্র কোরআন স্পর্শ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করতে বারণ করা হয়েছে। এই পবিত্রতা বলতে বিশ্বাসগত ও শারীরিক উভয় পবিত্রতা বুঝানাে হয়েছে। সােজা কথায় পবিত্র কোরআন বা কোন আয়াত স্পর্শকারীকে মুমিন মুসলমান হতে হবে এবং শারীরিক দিক থেকে পূত পবিত্র হতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের ন্যায়ত ও আইনত অধিকার স্বীকৃত সংবিধানের শুরুতে পবিত্র কোরআনের অংশ বিশেষ বিসমিল্লাহ লেখা এবং অমুসলিমদের স্পর্শ করার আইনত অধিকার দেয়া ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই বৈধ হতে পারে না। এজন্যই ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণয়নকালে শুরুতে বিসমিল্লাহ লেখা হয়নি। মিঃ ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্বু সেদিন জাতীয় সংসদে এ কথাটাই অন্যভাবে বলেছেন, ‘সব ধর্মের। মানুষ বিসমিল্লাহ বলে না বলে বঙ্গবন্ধু সংবিধানে বিসমিল্লাহ সংযােজন করেননি। এ প্রসঙ্গে আমাদের সংবিধানে পবিত্র ইসলামের নামে ইসলাম অননুমােদিত পন্থায় আরাে দুটো সংযােজন উল্লেখ করা যায়।
সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় প্যারায় এবং দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে অন্যতম মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেয়া হয়েছে এবং প্রথম মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে, “(১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস।” এক্ষেত্রে প্রথমে বলতে হয়, ধর্মনিরপেক্ষতা কি মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধবিরােধী, না। ধর্মবিরােধী? কোনটাই নয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের সার কথাই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ইহজাগতিকতা বা অন্য যা কিছুই করা হােক না কেন, এর অর্থ কিন্তু ধর্মহীনতা নয়। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লােকেরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও নিজস্ব সম্প্রদায়গত পরিমণ্ডলে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। রাষ্ট্রীয় জীবনে তারা ধর্মমত। নির্বিশেষে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে পরিচিত হবে। ধর্মমতের জন্য কেউ রাষ্ট্রীয় পক্ষপাতিত্ব কিংবা বৈষম্যের শিকার হবে না। অন্যভাবে বলা যায়, রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব কিংবা বৈষম্য করা হবে না। রাষ্ট্র ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্মও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে প্রভাব বিস্তার করবে না। রাষ্ট্র ও ধর্ম নিজ নিজ পরিমণ্ডলে স্বাধীন থাকবে। এটাই তাে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের সারকথা। অপর দিকে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলামও পরধর্মে হস্তক্ষেপ অনুমােদন করে না। পরমতের প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার জন্য মুসলমানদের উপদেশ দান প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে মিথ্যে মাবুদকে ডাকে, তােমরা তাদের গালি দিও না। তাহলে তারাও শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকে মন্দ বলবে।” (৬ঃ ১০৮) তাতে করে পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে মানুষের বিবেক ও জীবনপদ্ধতি। গ্রহণের স্বাধীনতার কথা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে। বস্তুত ইসলাম বিশ্বাস। করে জোর করে কারাে উপর চাপিয়ে দেয়া কোন সত্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট সত্য হিসেবে বিবেচিত হয় না। সত্যের অন্বেষণ এবং তা অনুসরণের অপরিহার্য শর্ত হলাে। বিবেকের স্বাধীনতা। বিবেকের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। পবিত্র কোরআনে মহানবীকে (সঃ) উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে, এবং যদি তােমার প্রতিপালক ইচ্ছে করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সবাই একযােগে বিশ্বাস স্থাপন করতাে। তা সত্ত্বেও কি সবাই মুমিন বা বিশ্বাসী না হওয়া পর্যন্ত তুমি লােকদের উপর বল প্রয়ােগ করবে?” (১০ঃ ৯৯) পবিত্র কোরআনের উপরােক্ত ভাষ্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট। ব্যাখ্যার কোন প্রয়ােজন নেই। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মহান বাণীর প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়েই ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তিনি তার বিভিন্ন ভাষণে এ কথাই বহুবার উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “এদেশের প্রতিটি নাগরিক স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।
কেউ কারাে ধর্মীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।” সংবিধানে এই ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিয়ে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে, “আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা আমাদের ধর্মের মূলকথা। এই বিশ্বাস ছাড়া কাউকে মুসলমানই ভাবা যায় না। কিন্তু সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে এই বাক্যটি সংযােজনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, সংখ্যায় যতােটা কমই হােক না কেন, এদেশে মুসলমান ছাড়া আরাে তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে। তাদেরও সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে অধিকার রয়েছে। তারা এ ব্যাপারে মুসলমানদের সাথে অভিন্ন মত পােষণ করে কিনা তা দেখা উচিত। এ কথা কেউ বলে না যে, এ ক্ষেত্রে অন্য তিনটি ধর্মের অনুসারীরা আমাদের সাথে অভিন্ন মত পােষণ করে। যদি করতাে, তারা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান হিসেবে পরিচিত হতাে না। তাহলে বলতে হয়, এই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যে মহান ধর্ম ইসলামের নামে এই কাজটি করা হলাে, ইসলাম কি তা সমর্থন করে? এরূপ জবরদস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহানবীকে (সঃ) উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “ওরা যা বলে আমি তা জানি, তােমাদের গুদের উপর জবরদস্তি করার জন্য পাঠানাে হয়নি, সুতরাং যে আমার শাস্তিকে ভয় করে তাকে কোরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও। (৫৩ ৫৪) “ধর্মে কোনপ্রকার জোর-জবরদস্তি নেই।” (২:২৫৬) পবিত্র কোরআনের এসব ভাষা অত্যন্ত স্পষ্ট। আল্লাহতায়ালা এসব আয়াতে ধর্মমত কারাে উপর চাপিয়ে দিতে বারণ করেছেন। কিন্তু আমাদের সংবিধানের মূলনীতিতে “আল্লাহতায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” বাক্যটি সংযােজন করে আল্লাহ কর্তৃক নিষেধকৃত কাজটিই করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও এই মূলনীতি গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে আল্লাহর নামে আল্লাহ নিষিদ্ধ কাজ। এবারে সংবিধানে সংযােজিত রাষ্ট্রধর্মের কথায় আসা যাক। সংবিধানের প্রথম ভাগের (২ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।” | রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে অনেকে বলতে পারেন, পৃথিবীর কোন কোন দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। আমাদের সংবিধানে থাকতে আপত্তি কেন। অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের দেশের পার্থক্য আছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করে। একথা অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, সেদিন কোন হিন্দু বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান মুক্তিযুদ্ধে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অস্ত্রধারণ করেনি। পবিত্র ধর্মের নামে শােষণ, বঞ্চনা ও প্রতারণামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিলাে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষের সমর্থন লাভের কূট উদ্দেশ্যে অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংস্করণে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা হবে একটি পরিষ্কার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। বলা চলে, অপর তিনটি সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আর এই বিশ্বাসঘাতকতা স্বয়ং আল্লাহতায়ালার নিকটই নিন্দনীয় কাজ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ্ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।” (৮ ঃ ৫৮) সুতরাং অন্য দেশের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘােষণা জাগতিক ও ধর্মীয় কোন দিক থেকেই সমর্থনযােগ্য নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘােষণার তাৎপর্যটা কি? বাংলাদেশ কি ধর্মশাসিত রাষ্ট্র হবে, না রাষ্ট্রশাসিত ধর্ম হবে? যদি বলা হয়, ধর্ম রাষ্ট্রকে শাসন করবে। এই প্রশ্নে অপর তিনটি সম্প্রদায়ের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতাই থাকে না। পাকিস্তানই তাে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল। পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে আর একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র করার কি প্রয়ােজন ছিল? যদি বলা হয়, রাষ্ট্র ধর্মকে শাসন করবে। এ কথার সরল অর্থ দাঁড়ায়, কোরআনহাদীস ও ইসলামী বিধি-বিধানের প্রয়ােজন নেই। রাষ্ট্রের আদেশ-নিষেধই ধর্মীয় বিধান হিসেবে গণ্য করতে হবে। এটা কি ইসলামের নামে ইসলাম বিরােধিতা নয়? এক্ষেত্রে আরাে একটা বিষয় উপেক্ষা করা যায় না। কোন দেশের সংবিধানের প্রতি সে দেশের প্রতিটি নাগরিকের আস্থা ও আনুগত্য থাকতে হবে। কারাে আস্থা ও আনুগত্য না থাকলে রাষ্ট্রীয় বিচারে সে হবে রাষ্ট্রদ্রোহী। স্বভাবতই বলা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানে সংযােজিত উল্লিখিত তিনটি বিষয়ের প্রতি অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আস্থা ও আনুগত্য নেই। তাহলে এর সরল অর্থ দাঁড়ায়, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে উল্লিখিত তিনটি বিষয় সংবিধানে সংযােজনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অপর তিনটি সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রদ্রোহী হতে বাধ্য করা হয়েছে। সংবিধানে পবিত্র ইসলামের নামে ইসলাম বিরােধী সংযােজনের পরিণতি কি দাড়ায়। মহান জাতীয় সংসদের সদস্যদের প্রতি ভাবাবেগমুক্ত হয়ে গভীরভাবে বিবেচনা করার অনুরােধ করছি।
সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল