মুরতাদের শাস্তির নামে একাত্তরের বদলা নেয়ার পাঁয়তারা
পবিত্র ধর্মই যুগে যুগে মানব জাতির মুক্তি ও কল্যাণের পথনির্দেশ নিয়ে আবির্ভূত হলেও এই ধর্মই আবার মানুষকে শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ধর্মকে শােষণের হাতিয়ার ও স্লোগান হিসেবে ব্যবহারের প্রবণতা সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। শোষক শ্রেণী বা কায়েমী স্বার্থবাদীরা এর চেয়ে কার্যকর কোন হাতিয়ার কিংবা স্লোগান এখনাে আবিষ্কার করতে পারেনি। ফলে তাদের এই প্রবণতা মানব সভ্যতার সূচনাকাল থেকে শুরু করে আজো অব্যাহত রয়েছে। ধর্মের এই ব্যবহারও বিচিত্র ধরনের লক্ষ্য। করা যায়। কখনাে ধর্ম বিশেষজ্ঞের দাবিদার ভাড়াটিয়া শ্রেণী দ্বারা ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন ভাষ্যের অপব্যাখ্যা করা হয়, কখনাে ধর্মের নামে বাস্তব বিবর্জিত কোন কোন বিষয় উত্থাপন করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হয়। আবার কখনাে ধর্মের নানা বিষয়ের অবতারনা করে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনাকাক্ষিত ও মানবকল্যাণ বিরােধী উন্মাদনার সৃষ্টি করা হয়। এই পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করে শাসক ও শােষক শ্রেণী তাদের শােষণ অব্যাহত রাখে। পবিত্র ধর্মের নামে এই অপতৎপরতা মানুষকে শুধু তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত কিংবা অগ্রগতি ব্যাহত করে না, অনেক সময় জাতীয় বিপর্যয়ও ডেকে আনে। বিভিন্ন জাতির ইতিহাসে এ ধরনের বহু প্রমাণ রয়েছে। প্রাচীন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে শাসকগােষ্ঠী ভাড়াটিয়া পাদরীদের মাধ্যমে পরিকল্পিতবাবে খ্রিস্ট ধর্মের নানা তাত্ত্বিক বিষয়ে বিতর্কের অবতারণা করে সারাদেশে ছড়িয়ে দিত। দেশের সাধারণ মানুষ এসব কূটতর্কে জড়িয়ে পড়তাে। এই সুযােগে শাসক ও শােষক শ্রেণী নিরাপদে তাদের শাসন-শােষণ চালিয়ে যেতাে। মুসলমানদের হাতে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য পতনের মাত্র ক’দিন আগের কথা। রাজধানী কনস্টান্টিনােপল বা বর্তমান ইস্তাম্বুলে পাদরীরা এক বাহাসে লিপ্ত ছিলেন। এই ধর্মীয় বিতর্কের বিষয় ছিল যিশুকে কি রুটি খাইয়ে শূলে চড়ানাে হয়েছিল। একদল পাদরী বলছিলেন শূলে চড়ানাের আগ মুহূর্তে তাকে চাপাতি রুটি খাওয়ানাে হয়েছিল। অপর দল বলছিলেন না, যিশুকে তন্দুরী রুটি খাওয়ানাে হয়েছিল। এ কূটতর্কে দীর্ঘ চল্লিশ দিন রাজধানী কনস্টান্টিনােপল মত্ত ছিল। শাসকগােষ্ঠীও এই বাহাস উপভােগ করছিলেন। ওদিকে মুসলিম বাহিনী ঝটিকা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। মুসলমানদের হাতে রাজধানী কনস্টান্টিনােপলের পতন ঘটে। প্রাচীনকালে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির দরুন এভাবে বহু জাতির জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে, অনেক শাসকের পতন ঘটে।
পবিত্র ধর্ম নিয়ে এ ধরনের বাড়াবাড়ির বিরুদ্ধে মহানবী (সঃ) মুসলমানদের সতর্ক করে গেছেন। বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “তােমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করাে না। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে অতীতে অনেক জাতি ধ্বংস হতে গেছে।” এ কথা অপ্রিয় হলেও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মহানবীর। (সঃ) সাবধান বাণী থাকা সত্ত্বেও মুসলমানরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি থেকে দূরে থাকতে পারেনি। মহানবীর (সঃ) ইন্তেকালের পর মুসলমানরা শিয়া, খারেজী, রাফেজী, মুতাজিলা প্রভৃতি নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে ধর্মের নানা তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে কূটতর্ক-বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। এসব দল-উপদলের লােকেরা একে অপরকে কাফের মুরতাদ আখ্যায়িত করতে থাকে। হযরত ইমাম আবু হানিফার (রঃ) মত বিদগ্ধ মনীষীকেও কাফের ফতােয়া দেয়া হয়। উমাইয়া খলিফা মামুনের আমলে পবিত্র কোরআন নশ্বর’ বা ‘অবিনশ্বর এই কূটতর্কে সারা মুসলিম বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। সমকালীন শাসকগােষ্ঠীও তাদের শাসন-শােষণ অবারিত রাখার স্বার্থে এ ধরনের বাড়াবাড়ির পেছনে ইন্ধন যােগাতে থাকে। উপমহাদেশেও মুসলমানদের মধ্যে মানবকল্যাণ ও সামাজিক-সম্প্রীতি বিরােধী এ ধরনের অবাঞ্ছিত অবস্থার উদ্ভব ঘটে। এখানে ধর্মের খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কেন্দ্র করে নানা উপদলের সৃষ্টি হয়। তারা একে অপরকে কাফের-মুরতাদ অস্ত্রে বিদ্ধ করতে দ্বিধা করে না। দেওবন্দীদের দৃষ্টিতে বেরলবী ধ্যান-ধারণার লােকেরা কাফের। আবার বেরলবীদের দৃষ্টিতে দেওবন্দীরা কাফের। এমনকি স্যার সৈয়দ আহমদ, আল্লামা ইকবাল, কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধেও একশ্রেণীর ফতােয়াবাজ কাফের ফতােয়া প্রদান করে। পাকিস্তান আমলেও পরিকল্পিতভাবে ধর্মীয় উন্মাদনা জিইয়ে রাখা হয়। বিশেষ করে আমরা বাঙালিরা যখনই আমাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবি। তুলেছি, তখনই বলা হতাে, ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়েছে। বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে (দালালরা বাদে) ইসলামের দুশমন, রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করা হতাে। একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে পবিত্র ধর্মের নামে এই উন্মাদনা পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ জোরেসােরে চালানাে হয়। বর্তমানে যারা পবিত্র ইসলাম। রক্ষা ও মুরতাদদের শাস্তির নামে রাজপথ-জনপদে উথাল পাতাল করছে, খোজ নিলে জানা যাবে, এরাই সেদিন বলে বেড়াতাে, পাকিস্তান না টিকলে এদেশে ইসলাম থাকবে। ইসলাম রক্ষার জন্যই পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে হবে।
সে সময় এই স্লোগান তুলে তারা হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ, নারী ধর্ষণ ও বাঙালি নিধনে সহযােগিতা করেছে। কিন্তু আল্লাতায়ালা সে সময় পবিত্র ধর্মের নামে তাদের অপতৎপরতা পছন্দ করেন নি। যদি করতেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হতাে না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাই প্রমাণ করে তাদের সে সময়ের ভূমিকা ছিলাে ধর্ম ও মানবতা বিরােধী এবং আল্লাহতায়ালার অপছন্দনীয় কাজ। কিন্তু এরপরও তাদের শিক্ষা হয়নি। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকে শাসকগােষ্ঠীর ছত্রছায়ায় তারা সংগঠিত হতে থাকে। একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশােধ নেয়ার জন্য বর্তমানে তারা উঠে পড়ে লেগেছে। তারা একাত্তরের ভাষায় কথা বলছে। একাত্তর সালে যেমন দেশপ্রেমিক বাঙালি ও মুক্তিযােদ্ধাদের ইসলামের দুশমন, রাষ্ট্রদ্রোহী’বলে গালিগালাজ করতাে, আজও তাই করা হচ্ছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, যে দেশের স্বাধীনতার তারা বিরােধিতা করেছে, তারাই আজ সে দেশের রক্ষক ও নীতিনির্ধারক সেজে বসেছে। যারা দেশটা স্বাধীন করলাে তাদেরকে উল্টে একাত্তরের ভাষায় ইসলামের দুশমন ও রাষ্ট্রদোহী আখ্যায়িত করা হচ্ছে। স্বাধীনতা বিরােধীরা এই অপতৎপরতায় সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে দু’একটা নতুন টেকনিক উদ্ভাবন করেছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে যাকে ইচ্ছে ‘মুরতাদ” আখ্যায়িত করে মৃত্যুদণ্ড শাস্তি দাবি করা। ইসলামের পরিভাষায় যে ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগের ঘােষণা প্রদান করে তাকে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী বলা হয়। নিজে ইসলাম ত্যাগ করার ঘােষণা না দেয়া পর্যন্ত কেউ অন্য কারাে কথায় বা ফতােয়ার দ্বারা মুরতাদ হয়। আমরা যতটুকু জানি, বাংলাদেশে কোন মুসলমান নিজ ধর্ম ত্যাগ করার কোন ঘােষণা প্রদান করেনি। সুতরাং এদেশে কাউকে মুরতাদ বলা এবং তার শাস্তি দাবি করা পবিত্র ইসলামের নামে ইসলাম বিরােধী দাবি ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া কেউ নিজেকে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগী ঘােষণা করলেও তার শাস্তি দাবি করা, তাকে হত্যা করা, কিংবা শাস্তি দেয়ার অধিকার কোন ফতােয়াবাজ শ্রেণী কিংবা সরকারকে আল্লাহতায়ালা প্রদান করেননি।
মুরতাদের শাস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তােমাদের মধ্যে যে কেউ নিজের দ্বীন থেকে ফিরে যায় এবং কাফির হিসেবে মৃত্যুবরণ করে, ইহকাল ও পরকালে তাদের কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। এরাই অগ্নিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।” (২ঃ২১৭) পবিত্র কোরআনের উপরােক্ত ভাষ্যে মুরতাদ বা ধর্মত্যাগীদের জাগতিক কোন শাস্তি ঘােষণা করা হয়নি। বরং বলা হয়েছে, “সে কাফির হিসেবে মৃত্যুবরণ করে।” এর অর্থ হচ্ছে, ধর্ম ত্যাগ করার জন্য তাকে জাগতিক শাস্তি দেয়া হবে না, কতল কিংবা ফাসিও দেয়া হবে না সে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করবে। মুরতাদের আধ্যাত্মিক পরিণতি হচ্ছে, তার আমল কল্যাণকর কর্ম নষ্ট হয়ে যাবে। পরকালে সে নরকের অধিবাসী হবে পরকালে বিশ্বাসীদের নিকট এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? পবিত্র কোরআন বলছে, পরকালে তার শাস্তি নরকবাস নির্ধারণ করা হয়েছে অপরদিকে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর মুফতি, খতিব শায়খুল হাদীস উপাধিধারী ফতােয়াবাজরা বলছেন, মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। এখন দেশের সচেতন নাগরিক ও সরকারের নিকট আমাদের জিজ্ঞাসা, আপনারা কার নির্দেশ শুনবেন, আল্লাতায়ালার নির্দেশ, নানা একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশােধ নেয়ার উন্মাদনায় মত্ত ফতােয়াবাজদের নির্দেশ! কোন মুরতাদ ধর্মত্যাগীকে মৃত্যুদণ্ড বা অপর কোন জাগতিক শাস্তি প্রদান করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আত্মিক স্বাধীনতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই স্বাধীন। কোন মতাদর্শ যেমন জোর করে কারাে উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না, তেমনি কেউ কোন ধর্মীয় মতবাদ গ্রহণ করলে তা বর্জন না করার জন্য তাকে বাধ্য করা যাবে না। গ্রহণ ও বর্জন উভয় ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা থাকা অপরিহার্য কারণ কোন ধর্ম মতের প্রতি বিশ্বাস আসার পরই কেউ তা গ্রহণ করে। তার আগে তা গ্রহণ করে না। অনুরূপ আস্থাহীন হওয়ার পরই সে ব্যক্তি তা বর্জন করে। গ্রহণের সময় যেমন কোন জবরদস্তি করা হয় না, গ্রহণ না করলে মৃত্যুদণ্ডের ভয় দেখনাে হয় না, বর্জনের বেলা জোরজবরদস্তি, মৃত্যুদণ্ড কিংবা অন্যকোন শাস্তি দেয়া হবে কেন। এরূপ করা যুক্তিগ্রাহ্য নয়। যদি জোরজবরদস্তি করে, শাস্তির বিধান করে কাউকে ধর্মত্যাগ থেকে ফিরিয়ে রাখা সম্ভবও হয়, এটা হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মােনাফেক হতে বাধ্য করা।
কারণ কোন ধর্মমত গ্রহণ করা বা না করা সম্পূর্ণ ঈমান বা বিশ্বাসের ব্যাপার। যদি কোন ধর্ম বা মতবাদের প্রতি কারাে বিশ্বাসই না থাকে শাস্তির ভয়ে সে নীরব থাকলেও অন্তরে কখনাে সে উক্ত ধর্মমতকে সত্যজ্ঞান করবে না। তার মানে লােকটির অন্তরে অবিশ্বাস, মুখে বিশ্বাস বা নীরবতা। আর এটাইতাে মােনাফেকী। তাছাড়া যদি মেনে নেয়াও হয় যে, কোন ধর্মমত একবার গ্রহণ করলে তা বর্জন করা যাবে না, করলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আর পৃথিবীর সব ক’টি ধর্মের জন্যই যদি এই নীতি স্বীকার করে নেয়া হয়, যেমন সব ক’টি ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতা রয়েছে, তাহলে তাবলীগ বা ধর্মপ্রচারের জন্য কোন লােকই পাওয়া যাবে না। তখন কোন অমুসলিমকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য আহ্বানই করা যাবে না। কারণ কোন লােক অন্য ধর্মত্যাগ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের কথা ঘােষণা করলে পূর্ব ধর্মের লােকেরা তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করবে। এখন যেমন জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী অন্য কোন ধর্ম প্রচারে আমরা বাধা দিতে পারি না, অনুরূপ অন্য ধর্মত্যাগী কোন লােককে তার পূর্ব ধর্মের লােকদের মৃত্যুদণ্ড শাস্তি থেকেও আইনানুগ পন্থায় রক্ষা করতে পারবাে না। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মুসলমানদের নির্দেশ করে বলেছেন, “তােমরা মানুষকে সুভাষণের মাধ্যমে তােমাদের প্রতিপালকের প্রতি আহ্বান করাে।” বাংলাদেশের ফতােয়াবাজদের দাবি অনুযায়ী মুরতাদদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বিধান করা হলে আমরা আল্লাহতায়ালার এই নির্দেশও পালন করতে পারবাে না। কারণ অন্য ধর্মত্যাগীদেরকে সংশ্লিষ্ট ধর্মের লােকেরা মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আইনত অধিকার পাবে এবং তারা তা কার্যকর করবে। এরূপ দাবি করাও যুক্তিগ্রাহ্য হবে না যে, অন্য ধর্ম ত্যাগ করে ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্ব ধর্মের লােকেরা তাকে ফাঁসি দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করলে মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।
বস্তুত ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্ম গ্রহণ ও বর্জনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এ ব্যাপারে কোন প্রকার জোরজবরদস্তি কিংবা জাগতিক শাস্তি ইসলাম অনুমােদন করে । পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “যারা বিশ্বাস করে ও পরে সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং আবার বিশ্বাস করে, আবার সত্য প্রত্যাখ্যান করে, অতঃপর তাদের সত্য প্রত্যাখ্যান প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়; আল্লাহ তাদেরকে কিছুতেই ক্ষমা করবেন না এবং তাদেরকে কোন পথও দেখাবেন না।” (৪ঃ১৩৭) কেউ একবার ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন অস্বীকার করলেই মুরতাদ হয়ে যায় মুরতাদের জাগতিক শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হলে পবিত্র কোরআনের উপরােক্ত আয়াতে একাধিকবার ধর্ম গ্রহণ-বর্জনের যে অধিকার বা স্বাধীনতা আল্লাহতায়ালা মানুষকে দিয়েছেন তা ক্ষুন্ন হবে। ফতােয়াবাজদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার কোরআন বিরােধী দাবি কোন মুসলমানই মেনে নিতে পারে বস্তুত ধর্মীয় ব্যাপারে আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে মানব জাতিকে পুরাে স্বাধীনতা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বল, সত্য তােমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রেরিত, সুতরাং যার ইচ্ছা বিশ্বাস করুক ও যার ইচ্ছা সত্য প্রত্যাখ্যান করুক।” (১৮ঃ২৯) বিবেক এবং নিজের মনােনীত জীবন পদ্ধতি গ্রহণের স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্বারােপ করে পবিত্র কোরআনের অপর এক স্থানে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “দ্বীন বা জীবন ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে কোন প্রকার জবরদস্তি নেই।” (২ঃ২৫৬) | উপরােক্ত আয়াতের সারকথা হলাে, পৃথিবীতে মানুষ ধর্ম গ্রহণ বা বর্জনের স্বাধীনতা ভােগ করবে। ধর্ম গ্রহণের জন্য, ভাল কাজের জন্য আল্লাহতায়ালা নিজে পুরস্কৃত করবেন। অনুরূপ ধর্মত্যাগ বা মন্দ কাজের তিনিই পরকালে মানুষকে শাস্তি প্রদান করবেন। এক্ষেত্রে ভাল বা মন্দ ফলাফল দেয়ার দায়িত্ব আল্লাহতায়ালা কোন ফতােয়াবাজ শ্রেণী কিংবা সরকারকে প্রদান করেননি। এরপরও যদি কোন বিশেষ শ্রেণী বা সরকার গায়ের জোরে কোন মুরতাদকে শাস্তি প্রদানের উদ্যোগ নেয় সেটা হবে খােদার উপর খােদকারীর অপচেষ্টা। মূলতঃ পরমতের প্রতি ইসলাম অত্যন্ত সহিষ্ণু। পরমতসহিষ্ণু হওয়ার জন্য মুসলমানদের নির্দেশ দান প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে মিথ্যে মাবুদকে ডাকে, তাদের তােমরা গালি দিও না। তাহলে তারাও শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকে মন্দ বলবে।” (৬ঃ১০৮) তাতে করে পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে মানুষের বিবেক ও জীবনপদ্ধতি বেছে নেয়ার স্বাধীনতার কথা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের এক শ্রেণীর ফতােয়াবাজ বলছেন, একবার মুসলমান হলে আর বের হওয়া যাবে না। বের হলে মৃত্যুদণ্ড। ইসলামের নামের কিরূপ অনৈসলামিক কথা!
অবশ্য কোন কোন হাদীসে মুরতাদকে মৃত্যুদণ্ড দেয়ার উল্লেখ রয়েছে। এসব হাদীস নিয়ে এক শ্রেণীর ফতােয়াবাজ ও তাদের সমর্থক কয়েকটি সংবাদপত্র ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। মুসলমান হিসেবে মহানবীর (সঃ) সত্যিকার বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা থাকা সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলাে সম্পর্কে আমাদের কিছু কথা আছে কথা হলাে মহানবীর (সঃ) ইন্তেকালের পর ছদ্মবেশী ইহুদিরা হাজার হাজার মিথ্যে হাদীস সারা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। সম্ভবত উমাইয়াদের আমলে এরূপ দুই ব্যক্তি ধরা পড়ে। তাদের বিচারের জন্য হাজির করা হলে তারা বলে, আমাদের হত্যা করা হলেও দুঃখ নেই। কারণ ইতিমধ্যে আমরা কয়েক হাজার মিথ্যে হাদীস ছড়িয়ে দিয়েছি। এসব দিক বিবেচনা করে হানাফী মাযহাবের ইমাম হযরত আবু হানিফা (রঃ) বলেছেন, “হাদীস হলেই আমি মেনে নিতে প্রস্তুত নই। আমারও বিবেক আছে।” হাদীস সম্পর্কে একটা মূলনীতি হলাে, পবিত্র কোরআনের ভাষ্যের সাথে যদি কোন হাদীসের বৈপরীত্য দেখা দেয়, তাহলে এরূপ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে । মুরতাদদের শাস্তি আল্লাহতায়ালা পরলােকে নির্ধারণ করেছেন। ইহলােকে তাদেরকে শান্তি দেয়ার কোন অধিকার কাউকে প্রদান করেননি। আর এটা কোরআনের বিধান। সুতরাং এর বিপরীতে হাদীসে বর্ণিত মৃত্যুদণ্ডের বিধান গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। তাছাড়া উক্ত হাদীসগুলাের প্রেক্ষাপট ও পটভূমির দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে, মুরতাদ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট বিধানের বিপরীতে শুধু ধর্মত্যাগের কারণে মহানবী (সঃ) কাউকে শাস্তি দিতে বলেন নি এইসঙ্গে আর একটা কারণ ছিল। আর তা ছিল রাষ্ট্রদ্রোহিতা। যারা ধর্মত্যাগ করে মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। সশস্ত্র বিদ্রোহ করে, কেবলমাত্র তাদেরই তিনি অস্ত্র দ্বারা প্রতিহত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মুরতাদের হত্যার নির্দেশের কারণ ধর্মত্যাগ নয়, বরং সশস্ত্র বিদ্রোহ। দৃষ্টান্ত হিসেবে ইয়ামামার মুরতাদদের উল্লেখ করা যায়। মহানবীর (সঃ) জীবিতকালে মুসায়লামা কাযযাব নামের নবুয়তের দাবিদার এক ব্যক্তির নেতৃত্বে ইয়ামামার মহানবী (সঃ) তাদেরকে কোন প্রকার জাগতিক শাস্তি কিংবা হত্যার নির্দেশ দেননি।
মহানবীর (সঃ) ইন্তেকালের পর মুসায়লামা ও তার অনুসারীরা মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং ইয়ামামার মুসলমানদের ইসলাম ধর্ম পালনে বাধা প্রদান করে। এরূপ পরিস্থিতিতে হযরত আবু বকর (রাঃ) মুসায়লামা ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে সৈন্যবাহিনী পাঠান এবং অস্ত্র প্রয়ােগ করে বিদ্রোহ দমন করেন। মুসায়লামা ও তার অনেক অনুসারী নিহত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে আবি সারাহ নামের একজন ওহী লেখক মুরতাদ হয়ে যায়। মহানবী (সঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ প্রদান করেননি। একবার এক বেদুঈন মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করে। পরদিন কোন কারণে তার জ্বর উঠে। লােকটি মনে করে ইসলাম গ্রহণের কারণে তার এই বিপদ হয়েছে। সে মহানবীর (সঃ) নিকট এসে ইসলাম ত্যাগের কথা বলে এবং মদীনা থেকে চলে যায়। মহানবী (সঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি। প্রথম দিকে মুসলমানরা বায়তুল মােকাদ্দাসের দিক হয়ে নামাজ পড়তেন। মদীনায় হিযরতের ১৬/১৭ মাস পর মহানবী (সঃ) কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ লাভ করেন। কাবা ঘরের দিক হয়ে নামাজ পড়া শুরু করেন। এ সময় বহু মুসলমান মুরতাদ হয়ে যায়। কিন্তু এ সময়ের কোন মুরতাদকে তিনি হত্যার নির্দেশ প্রদান করেননি। সারকথা, মুরদাত হওয়ার পর যারা মুসলিম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে, তাদেরকেই হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহী ছাড়া কোন মুরতাদকে হত্যার নির্দেশ প্রদান করা হয়নি। এই পটভূমি উল্লেখ না করে এক শ্রেণীর ফতােয়াবাজ মহানবীর (সঃ) কয়েকটি হাদীস দ্বারা প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে, মুরতাদদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। সাধারণ মুরতাদ আর রাষ্ট্রদ্রোহী মুরতাদ এক ব্যাপার নয়। সাধারণ মুরতাদদের জাগতিক শাস্তির কোন বিধান কোরআন-হাদীসে নেই। যদি থাকতে মহানবী (সঃ) তার জীবদ্দশায় তা বাস্তবায়ন করতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালা পরকালে মুরতাদকে শাস্তি প্রদান করবেন। পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ঘােষণা রয়েছে। আর রাষ্ট্রদ্রোহী শুধু মুরতাদ নয়, মুসলমানেরও শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
এটা প্রমানের জন্য কোরআন-হাদীসের অপব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। জাগতিক আইন-কানুন দ্বারাও তা প্রমাণিত। আমাদের এই আলােচনার উদ্দেশ্য কোন মুরতাদকে সমর্থন করা নয়। যারা নিজেদের নাম ফুটানাের জন্য পবিত্র কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে স্বঘােষিত বিজ্ঞ সেজে আবােল-তাবােল লিখছে, মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে তাদের। প্রতিও আমদের কোন প্রকার সমর্থন নেই। আবার যারা দেশের বাইরে, বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে ঘুরে এসে নন ইস্যুকে ইস্যু বানিয়ে পবিত্র ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করছে, মানুষ হত্যার জন্য পুরস্কার ঘােষণা করছে, কল্পকথা ছাড়িয়ে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দারিদ্র্য বিমােচনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, বিশ্বের দরবারে সংগ্রামী বাঙালি জাতিকে, বাংলাদেশকে হেয় প্রতিপন্ন করছে, তাদেরকেও আমরা সমর্থন করি না। তারা ইসলাম রক্ষার নামে মানুষকে সহিংসতার প্রতি উস্কে দিচ্ছে, মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটছে, সামাজিক সম্প্রীতি বিনষ্ট করছে, সমাজে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তােমরা পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করাে না। আল্লাহ বিশৃংখলা সৃষ্টিকারীদের পছন্দ করেন না। কিন্তু তারা আল্লাহতায়ালার এই নির্দেশের প্রতি দৃষ্টিপাত করছে না। আল্লাহতায়ালা সুন্দর ভাষণের মাধ্যমে তার প্রতি মানুষকে আহ্বান করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু এই শ্রেণীটি ইসলাম রক্ষার নামে যৌক্তিক পথ পরিহার করে পেশীশক্তির জোরে মানুষের বিবেকের স্বাধীনতা স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। সংবাদপত্রের অফিসে হামলা করছে। মানুষকে সহিংসতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে। তাতে করে তারা সরকারের অদূরদর্শিতার সুযােগে একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশােধ নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। এই জন্য আমরা এসব মুখােশধারীদের ঘৃণা করি। দেশের সাধারণ মানুষের নিকট এই শ্রেণীটির মুখােশ অনাবৃত করা, তাদের হীন উদ্দেশ্য সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা আমাদের এই আলােচনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। নতুবা স্বাধীন বাংলাদেশে মুরতাদ সম্পর্কে কিছু লিখতে হবে কিংবা লিখার কথা কোন দিন কল্পনাও করি নি।
জনকণ্ঠ, আজকের কাগজ ঃ ২০-৭-৯৪
সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল