You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.01 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মে দিবসঃ বছর বছর সে ডাক দিয়ে যায় | বেতার যন্ত্রকে জাতিগঠনের কাজে নিয়োজিত করতে হবে | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১লা মে, বুধবার, ১৭ই বৈশাখ, ১৩৮১

মে দিবসঃ বছর বছর সে ডাক দিয়ে যায়

শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির চেতনাবাহি দিন আজ মে দিবস। আজ থেকে অষ্টাশী বৎসর আগে যা ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহর চিকাগোর ঘটনা, তাই আজ প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছে দুনিয়ার খেটে খাওয়া বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনে। আজ তারা শুধু সেই ঘটনার স্মৃতিচারণেই করবে না, নেবে নতুন করে শপথ।
চিকাগোর আদালতে দাঁড়িয়ে ১৮৮৬ সালের সেই ঐতিহাসিক দিনটির অন্যতম স্রষ্টা সায়েজ বলেছিলেন, ‘আমাদের কন্ঠ আজ নিস্তব্ধতা চলেছে, কিন্তু সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন আমাদের নিস্তব্ধতা আমাদের বাগ্মীতার চেয়েও সোচ্চার হয়ে দিকে দিকে অনুরণিত হবে, এবং শোষিত শ্রমিক মুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করে তুলবে।’ চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল পহেলা মে দিবসের সেই মহানায়কদের। আগাষ্টা সায়েজ, পার্সন, ফিলডন, এবং জর্জ এনজেলকে সেদিনের শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার অপরাধে দাঁড়াতে হয়েছিল ফাঁসিকাষ্ঠে। কিন্তু তাদের আশা ব্যর্থ হয়নি, তাদের নিস্তব্ধতার চেয়েও সোচ্চার হয়ে প্রেরণা জুগিয়ে আসছে দুনিয়ার লক্ষ কোটি মেহনতী মানুষকে। বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য ঘোষিত হওয়ার পর তার শ্রমজীবী মানুষের মনে নতুন উদ্যম এবং উৎসাহ সৃষ্টি করেছিল। শুরু হয়েছিল নতুন সমাজ গড়ার কাজ। যে সমাজের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা আগ্রহী হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সয়ং। রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিয়োজিত করা হলো জনগণের সহায়তায় সমাজতন্ত্র বিনির্মাণে। বন্ধুর পথে যাত্রা হল শুরু। এ পথে বাধা আছে, বিঘ্ন আছে, আছে নানা প্রতিবন্ধকতা। সমাজতন্ত্র বিরোধী শক্তি সে প্রচেষ্টা নস্যাতে তৎপর হয়ে উঠলেন। পাশাপাশি অসংগঠিত শ্রমিকদের মানুষ দিনের পর দিন নিজেদের অসহায় বোধ করতে শুরু করলেন। নেমে এলো হতাশা, নৈরাজ্য।
এ নৈরাজ্য এবং হতাশা থেকে মুক্তির দিশা দেখাতে পারে মহান ঐতিহাসিক মে দিবস। এ দিনের তাৎপর্য এবং শিক্ষা শ্রমজীবী মানুষকে নতুন করে করতে পারে অনুপ্রাণিত। যুগে যুগে যে সত্য থেকে গণমানুষকে দূরে সরিয়ে রাখবার জন্য বিভ্রান্তিমূলক অপপ্রচার ও হতাশা ছড়ানো হয়েছে তাকে মোকাবেলার মাধ্যমেই সম্ভব সে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। নিদারুণ অত্যাচার এবং নির্যাতনের মাধ্যমেও মানুষকে তার মুক্তির পথ থেকে বিচ্যুত করা যায়নি। বিভ্রান্তির মধ্যে আটকে রাখা গেছে হয়তো কিছুদিন, কিছুকাল কিছু সংখ্যক লোককে; কিন্তু তা সম্ভব হয়নি সর্বকালের জন্য সর্বসাধারণকে।
বাংলার মেহনতী মানুষকে আজ উপলব্ধি করতে হবে মহান মে দিবসের মূল তাৎপর্য। তার শিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনে শপথ গ্রহণ করতে হবে নতুন করে। বছরে বছরে মে দিবসে ডাক দিয়ে যায়, নতুন সমাজ গড়ার ডাক। শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির আহবান জানিয়ে যায় চিকাগোর বীর সংগ্রামীরা।

বেতার যন্ত্রকে জাতিগঠনের কাজে নিয়োজিত করতে হবে

বাংলাদেশ বেতারের প্রযোজকদের চার দিনব্যাপী এক ট্রেনিং কোর্সের উদ্বোধন হয়েছে গত আটাশ তারিখে। উদ্বোধন করেছেন বেতার ও তথ্য বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। এই ট্রেনিং কোর্সের আয়োজন করেছে যৌথভাবে ইউনেস্কো ও বাংলাদেশ বেতারের কর্তৃপক্ষ। তথ্য ও বেতার বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জনাব তাহেরউদ্দিন ঠাকুর উদ্বোধনী ভাষণে বলেছেন–বেতার মাধ্যমে দেশ ও জাতির সেবায় পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে। বেতারের মানোন্নয়ন ব্যাপারে মন্ত্রী আরও বলেছেন–বিশ্বের অন্যান্য বেতার থেকে নতুন ভাবধারা আহরণ করার জন্য। ট্রেনিংয়ে আগত প্রযোজকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘স্বপ্নের বাংলাদেশকে বাস্তবে রূপায়িত করতে হলে দেশের অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যৎ যত্নসহকারে মূল্যায়ন করতে হবে এবং তারপরেই সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। দেশ গঠনের কাজে বেতার মাধ্যমে অপরিহার্যতার কথাও তিনি জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। দেশের বেতার মাধ্যমে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক। প্রচার কাজের ব্যাপারে আমাদের দেশের সংবাদপত্রের চাইতেও বেতার যন্ত্র অনেক ব্যাপক। দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলের বেতারযন্ত্র রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সংবাদপত্র প্রত্যন্ত গ্রামে এখনো পৌঁছতে পারেনা। সরাসরি এবং দ্রুত সরকারের কর্মসূচি ও অন্যান্য খবরাদি গ্রাম অঞ্চলে পৌঁছে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে। বেতারের শ্রোতার সংখ্যাও প্রচুর, সে তুলনায় সংবাদপত্রের পাঠক সংখ্যাও কম। প্রতিটি দেশের সরকারের প্রচার বিষয়ক কাজের জন্য একমাত্র নির্ভরশীল যন্ত্র হলো বেতার। এই কারণে যে কোনো সরকারই তার আদর্শ ও নীতির দ্বারা গড়ে তোলে বেতারকে। সুন্দর, ন্যায়নিষ্ঠ ও বাস্তবধর্মী প্রচারের কাজে নিয়োজিত করে থাকে বেতার যন্ত্রকে। সে তুলনায় বাংলাদেশ বেতার কি পরিমান অগ্রসর হতে পেরেছে তা অবশ্যই বিবেচ্য। স্বাধীনতা লাভ করার পর আমরা অতীতের ‘রেডিও পাকিস্তানের’ কীর্তিকলাপেরও অবসান কামনা করেছিলাম। অতীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিভিন্ন প্রচার বিষয়ক কর্মসূচির যে মান ও নীতি বিঘোষিত ছিল–বাংলাদেশ বেতারের জন্মের মাধ্যমে তার চির অবসান ঘটুক এটাই ছিল জনগণের আশা। অতীতের রেডিও পাকিস্তান ছিল নেতাদের সেবায় নিয়োজিত। আমরা বাংলাদেশ বেতার কে দেখতে চেয়েছিলাম জনগণের সেবায় নিয়োজিত হতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেতার বিভাগ যে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে–আমরা সে দিক দিয়ে কতটুকু সার্থক তা পর্যালোচনা করা উচিত। জনগণের সত্যিকারের কোন উপকার বেতারের দ্বারা হয় কিনা সেটাও ভাববার বিষয়। আমরা মনে করি, বেতারের প্রতি অনুষ্ঠানকে অত্যন্ত যত্নসহকারে তৈরি করা দরকার। দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণের দিকে দৃষ্টি দেখে প্রতিটি অনুষ্ঠান প্রযোজিত হতে হবে।
বেতার বিভাগ যে সে প্রচেষ্টা করছে না, তা নয়। তবু জাতীয় প্রগতিতে অগ্রাধিকার দিয়ে অত্যন্ত বাস্তবমুখী পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিটি অনুষ্ঠান প্রচারের জন্য মনোনীত করতে হবে। জনগণের মন ও মানসিকতার প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে। বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে এমন কোন অনুষ্ঠানের প্রচার হওয়া উচিত নয়, যাতে কিনা দেশের সার্বিক জনগণের চিন্তা ভাবনার প্রতিচ্ছবির অনুপস্থিত থাকে। আমরাও প্রতিমন্ত্রীর আশাবাদের সঙ্গে এক হয়ে বলবো একটি আদর্শ ও নীতির অনুসারী হয়ে বেতার যন্ত্রকে অবশ্যই জাতি গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন