You dont have javascript enabled! Please enable it! ফতােয়াবাজদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নীলনকশা- বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ - সংগ্রামের নোটবুক

ফতােয়াবাজদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের নীলনকশা

গত কিছুদিন থেকে প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদপত্রে এক শ্রেণীর ফতােয়াবাজের জাতীয় উন্নয়ন ও স্বার্থবিরােধী অপতৎপরতার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় পবিত্র ইসলামের নামে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছে। এসব ফতােয়াবাজের অপপ্রচারে বগুড়া, সিলেট, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নােয়াখালী, ভােলা, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন তৎপরতা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ফতােয়াবাজরা গ্রামের শিশু-কিশােরকিশােরীদের ব্র্যাক পরিচালিত স্কুলে যেতে বাধা দিচ্ছে। অভিভাবকদের উপর সামাজিক বয়কটের হাতিয়ার প্রয়ােগ করছে। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মহিলা কর্মীদের ঘর থেকে বের হতে দিচ্ছে না। কোন কোন এলাকায় স্বামীকে স্ত্রী পরিত্যাগ করতে বাধ্য করছে। ফতােয়া দিচ্ছে, কেউ এনজিও’র সাথে সংস্রাব রাখলেই ধর্মচ্যুত হবে। এনজিও সংশ্লিষ্ট কারাে মৃত্যু হলে তার জানাজা পড়া যাবে না। স্ত্রীরা এনজিও’র সাথে কাজ করলে তাকে তালাক দেয়া মুসলমান হিসেবে স্বামীর কর্তব্য। এনজিওদের ঋণ নেয়া কিংবা তাদের স্কুলে ছেলেমেয়ে পাঠানাে উচিত নয় । ফতােয়া দেয়া হচ্ছে, এনজিওদের স্কুল এবং তাদের ঋণে নির্মিত বাড়িঘরে আগুন লাগানাে যাবে, তাদের লাগানাে গাছ কেটে ফেলা যাবে। গ্রামেগঞ্জে পবিত্র ইসলামের নামে ইসলাম বিরােধী ফতােয়া ছেপে বিলি করা হচ্ছে। বগুড়ায় মওলানা ইবরাহীম নামের এক ব্যক্তি বাংলাদেশ এন্টি খ্রিস্টান অর্গানাইজেশন (ব্র্যাকো) নামের একটি প্রতিষ্ঠান করে এনজিও বিরােধী তৎপরতা চালিয়েছে। তার অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত হয়ে এক ব্যাক্তি তার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছে। নাজমা নামের এক ব্র্যাক কর্মীর তত্ত্বাবধানে থাকা ২৭ জন যক্ষ্মা রােগীর মধ্যে ১৮ জন ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। তাদের মধ্যে একজন মারাও যায়। সিলেটে এক ব্যক্তিকে তার এনজিও কর্মী ছেলেকে নিজ হাতে পিটাতে বাধ্য করছে। ইসলামের মুখােশধারী এক শ্রেণীর মৌলবী সারা দেশে এনজিও কর্মীদের হয়রানি করছে।  জানা গেছে, ৪৯টি জেলার ১৯৫টি থানাকে ব্র্যাক পরিচালিত উপআনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনা হয়েছে। এই কার্যক্রমে ইতিমধ্যে ২০ হাজার ১৪টি স্কুল স্থাপন করা হয়েছে।

এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩০ জন শিক্ষার্থী শিক্ষা লাভ করছে। তার মধ্যে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২৯৬ জন ছাত্রী রয়েছে। ফতােয়াবাজদের হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে এ পর্যন্ত স্কুলগুলাের প্রায় ৩৭ হাজার শিক্ষার্থী অনিয়মিত কিংবা ড্রপ আউটের শিকার হয়েছে। তার মধ্যে চাঁদপুরের ১৫৬টি স্কুলের ১৫৯৭ জন, বরিশাল ও ভােলার ১৮৪টি স্কুলের ৬৫৫ জন, চট্টগ্রামের ৩৭০টি স্কুলে ৭৩০ জন এবং হবিগঞ্জের ১২১টি স্কুলের ১ হাজার ৪৭৮ জন শিক্ষার্থী রয়েছে।  গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের উন্নয়ন তৎপরতার ক্ষেত্রেও একই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি করা হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় দীনদরিদ্র ও অসহায়। পরিবারগুলাে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ নিয়ে নিজেদেরকে আর্থিক দিক থেকে স্বনির্ভর করে তুলছিল। এসব ঋণগ্রহীতাকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। অপরদিকে অনেক এলাকায় রাস্তাঘাটে লাগানাে গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে। যেসব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলের কায়েমী স্বার্থবাদীরা বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন তৎপরতার প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে। একটি হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের সুদখাের মহাজন শ্রেণী। এরা যুগ যুগ থেকে চড়া সুদে লগ্নির। ব্যবসা করতাে। গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের নামমাত্র মুনাফায় ঋণ। বিতরণ কর্মসূচি গ্রহণের ফলে কেউ আর গ্রামীণ মহাজনদের নিকট কড়া সুদে ঋণ নিতে। যায় না। তাতে তারা সুদের ব্যবসা ও মােড়লী দুটোই হারাতে বসেছে। অপরদিকে। গ্রামগঞ্জের অর্ধশিক্ষিত মােল্লা-মৌলবীরা মক্তব প্রতিষ্ঠা করে টুপাইস কামাই করছিল। ব্র্যাক পরিচালিত উপ-আনুষ্ঠানিক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচী গ্রহণের ফলে কেউ আর অর্থের বিনিময়ে পরিচালিত মক্তব্যে তাদের ছেলেমেয়েদের দিতে চায় না। এর ফলশ্রুতি হিসেবে মােল্লা-মৌলবীদের রােজগার কমে গেছে। এরূপ পরিস্থিতিতে গ্রামাঞ্চলের কায়েমী স্বার্থবাদী উক্ত দুটি শ্রেণী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে। তারা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে, এরা নাকি মানুষের ঈমান-আমান নষ্ট করে ফেলছে। সাহায্য-সহায়তা দিয়ে মানুষকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলছে।

মাতবর-মােড়লরা আড়ালে থেকে মােল্লাদের দ্বারা ফতােয়া দেয়ানাে হচ্ছে, ব্র্যাকের স্কুলে ছেলেমেয়েদের পড়ানাে কিংবা গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করা হারাম। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে মিটিং-মিছিল করা হচ্ছে। কোন কোন এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্ম ও ঋণ গৃহীতাদের বিরুদ্ধে নানা কাল্পনিক অভিযােগ উত্থাপন করে শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। এ হচ্ছে ফতােয়াবাজি অপতৎপরতার একট চিত্র। এই অপতৎপরতার আর একটি চিত্রও রয়েছে। সে চিত্রের শিকড় অনেক গভীরে। মূলত সারা দেশব্যাপী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের সম্পর্কে অপপ্রচার, অপতৎপরতার নীলনকশাকারীই হচ্ছে এই মহলটি। এই মহলটি ‘৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সক্রিয় সহযােগী ছিল। ‘৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শক্তি হয়েও তারা আবার এদেশে রাজনীতি করার সুযােগ লাভ করে। তাদের নির্বাসিত নেতাকর্মীরা আবার স্বাধীন বাংলাদেশে এসে জড়াে হয়। জানা গেছে, তারা দেশে ফেরার সময় দশ বছরের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের একটি নীলনকশা নিয়ে আসে। সঙ্গে নিয়ে আসে অঢেল পেট্রো ডলার। নীলনকশার মধ্যে রয়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, আর্থিক সুযােগ-সুবিধা ও সাহায্য প্রদানের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত পেছি। এই লক্ষ্যে তারা ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি মেডিক্যাল ক্লিনিক স্থাপন করে। পর্যায়ক্রমে এ ক্লিনিকের আওতায় থানা পর্যন্ত এ ধরনের ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অনুরূপ ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে একটি ব্যাংক স্থাপন করা হয়। এর শাখা-প্রশাখা গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে নীলনকশায় সরকার নিয়ন্ত্রিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে নিজেদের কর্মী সৃষ্টি ছাড়াও বিশেষ ধরনের কিন্ডার গার্টেন স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী সারাদেশে ইতিমধ্যে প্রায় ১শ’টি কিন্ডার গার্টেন স্কুল খােলা হয়েছে। এসব স্কুলে দলীয় কর্মী-নেতা ছাড়া বাইরের কাউকে শিক্ষক নিয়ােগ করা হয় না। মেডিক্যাল ক্লিনিক ও ব্যাংক কর্মচারী নিয়ােগের বেলায়ও একই নীতি অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইসলামের মুখােশধারী উক্ত রাজনৈতিক দলটি রাষ্ট্রক্ষমতার দখলের উদ্দেশ্যে তৃণমূল পর্যন্ত তাদের সমর্থক গড়ে তােলার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এছাড়া ৩৪টি দেশী-বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানও তাদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালনা করা হয় । কিন্তু তাদের এই নীলনকশা বাস্তবায়নের পথে বাদ সাধে অন্যান্য দেশী বিদেশী স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাে।

এসব প্রতিষ্ঠানের নিঃস্বার্থ কর্মতৎপরতায় উক্ত স্বাধীনতা বিরােধী ও ইসলামের মুখােশধারী রাজনৈতিক দলটির ক্ষমতা দখলের নীলনকশা ভেস্তে যেতে বসে। ফলে তারা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানগুলাের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তাদের নেতা-কর্মীরা এনজিওগুলাের সমালোচনা শুরু করে। তারা বলতে থাকে, এনজিওগুলাে তওহিদী জনতার ঈমান-আমান নষ্ট করে ফেলছে। উক্ত দলের সাংসদদের জাতীয় সংসদেও এনজিওবিরােধী বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে শােনা যায়। তাদের সংবাদপত্রগুলাে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। কিন্তু তাতেও কোন কাজ হয়  পরবর্তীকালে তারা গ্রামগঞ্জের মাদ্রাসা-মসজিদ-মক্তবে তাদের স্মর্থক মােল্লামৌলবীদের এনজিওগুলাের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। এই সঙ্গে যােগ দেয় গ্রামাঞ্চলের কায়েমী স্বার্থবাদী সুদখাের মােড়ল-মাতবররা। তারা অপপ্রচার শুরু করে, এনজিওগুলাে মহিলাদের বেপরদা করে ফেলছে। অর্থ সাহায্যের প্রলােভন দেখিয়ে মুসলমানদের খ্রিষ্টান করে ফেলছে। কিছুদিন আগে চাঁদপুর জেলায় আমাদের গ্রামের বাড়ি গিয়ে ছিলাম। আমার যাওয়ার কয়েকদিন আগে কয়েকজন মওলানার নেতৃত্বে সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ হয়েছে। এক সকালে গ্রামের কিছু যুবক এসে বললাে, এনজিও, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে আমাদের দেশের হুজুররা বলেন, এই ব্যাংকের কর্মচারীরা নাকি মানুষকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলছে। তারা এই ব্যাংকের ঋণ না নেয়ার জন্য বলছেন। এ সম্পর্কে আপনি কি বলেন। তাদের বললাম, যে হুজুররা এসব কথা বলছেন বিকেলে তাদের নিয়ে এসাে। তাদের সামনে রেখে আমরা আলোচনা করব। বিকেলে কয়েকজন মওলানাসহ যুবকরা আমাদের বাড়ি আসে। এক মওলানা আমাকে জিজ্ঞেস করেন এনজিও সম্পর্কে আমি খোঁজখবর রাখি কিনা। বললাম, কি খবর। মওলানা বললেন, তারা তাে মানুষকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলছে। মওলানাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাদের এলাকায় কোন কোন এনজিও এই কাজ করছে। বললেন, প্রশিকা ও গ্রামীণ ব্যাংক। আচ্ছা এই দুটি প্রতিষ্ঠানের লােকেরা আমাদের এলাকায় ক’জন মুসলমানকে খ্রিষ্টান বানিয়েছে বলতে পারেন? মওলানা বললেন, শুনেছি অনেক খ্রিষ্টান হয়ে গেছে। মওলানাকে বললাম, একজন আলেম হিসেবে আপনার জানার কথা, শােনা কথার উপর ভিত্তি করে কারাে সমালােচনা করা, অপপ্রচার করা ইসলামে নাজায়েজ কাজ। আর আলেম হয়ে আপনারা সে কাজটিই করছেন। আমি জানি, একজনও দেখাতে পারবেন না যাকে খ্রিস্টান বানানাে হয়েছে। একজন বললেন, গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামের লােকদের যে ঋণ দিচ্ছে এসব তাে।

খ্রিষ্টানদের টাকা। মওলানার একথা শুনে আমার রক্তচাপ বেড়ে যাচ্ছিল। নিজেকে সংযত রেখে বললাম, আমাদের বাড়ির সামনে রাস্তাটি কার অর্থে তৈরি হয়েছে। মওলানা বললাে, এই টাকা গ্রামীণ ব্যাংকের নয়। এটা কেয়ারের টাকায় নির্মাণ করা। হয়েছে। মওলানা সাহেবকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, আপনাদের অনেক কথাই শুনলাম। এবার অনুগ্রহ করে আমার দু’একটা কথা শুনুন। আপনারা কোরআন-হাদীস পড়ান, গ্রামে থাকেন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা সম্পর্কে আপনাদের গভীর জ্ঞান না থাকাই স্বাভাবিক। দুঃখজনক ব্যাপার হলাে, আপনাদের কথা শুনে কোরআনহাদীসের জ্ঞান সম্পর্কেও আমি সন্দিহান হয়ে পড়েছি। তবে একটা বিষয়ে আপনারা অত্যন্ত পারদর্শী বলে মনে হচ্ছে। সেটা হচ্ছে, গুজব ও অপবাদ রটানেনা। আপনাদের। দাবি হচ্ছে, এই অঞ্চলে এনজিওগুলাে মুসলমানদের খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলছে। কিন্তু। একজন লােকের নামও বলতে পারলেন না যে খ্রিস্টান হয়েছে। কোন এনজিও কর্মী। কাউকে খ্রিষ্টান হওয়ার জন্য অনুরােগ করেছে, এরূপ একজন লােকের নামধামও আপনার বলতে পারলেন না। অথচ কিছুদিন আগে আপনারা মাদ্রাসার ছাত্র ও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মিছিল-সমাবেশ করলেন, এনজিওদের উন্নয়ন কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তােলার চেষ্টা করলেন। তাদের বিরুদ্ধে অপবাদ ছড়ালেন, অশালীন ভাষায় নিন্দা করলেন। যে ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে আপনারা এসব করলেন সে ধর্মেরই পবিত্র গ্রন্থে আল্লাহতায়ালা পরিষ্কার ঘােষণা করেছে, “দুর্ভোগ প্রত্যেকের যে পশ্চাতে ও সম্মুখে মানুষের নিন্দা করে।”মহানবী (সঃ) বলেছেন, “আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে নিকৃষ্টতম তারা, যারা পরােক্ষ নিন্দা করে, বন্ধুদের মধ্যে বিচ্ছেদ সৃষ্টি করে এবং নিরপরাধ লােকদের দোষ খুঁজে বেড়ায়। আপনাদের কর্মকাণ্ডকে পবিত্র কোরআন ও হাদীসের উপরােক্ত ভাষ্যের আলােকে মূল্যায়ন করে দেখুন পবিত্র ইসলামের নামে আপনারা কিরূপ ইসলাম বিরােধী কাজ করছেন।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, কেয়ারের বিরুদ্ধে আপনাদের অভিযােগ নেই। যতাে সব অভিযোেগ গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য এনজিওদের বিরুদ্ধে। কেয়ার সম্পূর্ণ বিদেশী প্রতিষ্ঠান। গ্রামীণ ব্যাংক ও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা হলেন দু’জন বাঙালি মুসলিম কৃতী সন্তান। এর অর্থ এই নয় যে, কাল আবার কেয়ারের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়ন। আসলে আমাদের দেশে যেমন সচ্ছল লােকেরা গরিবদের ধার দিচ্ছে, সাহায্য দিচ্ছে তেমনি পৃথিবীর ধনী রাষ্ট্রগুলােও আমাদের দেশের মত গরিব দেশগুলােকে ঋণ অনুদান দিচ্ছে। আমাদের উন্নয়ন বাজেটের শতকরা ৯০ ভাগ অর্থ সংগ্রহ করা হয় ধনী রাষ্ট্রগুলাের দেয়া ঋণ ও সাহায্য থেকে। আপনাদের মধ্যে যারা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত মাদ্রাসা বা স্কুলে চাকরি করেন তাদের বেতনের সরকারি অংশটাও বিদেশী ঋণ বা সাহায্য থেকেই দেয়া। হয়। এতাে গেল রাষ্ট্রে রাষ্ট্রের ব্যাপারে। ধনী দেশগুলােতে অনেক বিত্তবান আছেন, যারা বিভিন্ন বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিভিন্ন গরিব দেশের জনগণকে সাহায্য করে থাকে। আমাদের দেশের গরিব লােকদের সাহায্যে এনজিওগুলাের ব্যয়িত অর্থ সাধারণত এভাবেই সংগৃহীত হয়ে থাকে। এসব সাহায্যের পেছনে মানবসেবা ছাড়া। অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। দুস্থ মানবতার সেবা করা ইসলামেরও পথ-নির্দেশ। গ্রামের মহিলাদের বেপর্দার যে প্রশ্ন আপনারা তুলেছেন, পর্দা বলতে আপনারা কি বুঝাতে চান আমার বুঝে আসে না। পর্দার অর্থ মহিলাদের ঘরে আবদ্ধ করে রাখা নয় । পর পুরুষ থেকে নিজ নিজ আবরু ইজ্জত রক্ষা করে চলাই হচ্ছে আসল পর্দা। ঘরে বসে থেকে কোন মহিলা অসামাজিক কাজ করলে তাকে পর্দানশীল মহিলা বলা যাবে  ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলিম মহিলারা যুদ্ধক্ষেত্রে সেবিকার দায়িত্ব পালন করেছেন। মহানবীর স্ত্রী হযরত আয়েশা (রাঃ) উষ্ট্রীয় যুদ্ধে সেনাপতিত্ব করেছেন। তাদের কি পর্দা রক্ষা হয়নি?

মূলত আমাদের দেশের মহিলাদের সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী করতে হলে তাদেরকে আর্থ-সামাজিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে হবে। ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক ও অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান গ্রামের দুস্থ ও গরিব মহিলাদের ঋণ ও সাহায্য দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলছে। তাতে করে অভাবের তাড়নায় তাদেরকে আর পাপ পথে পা বাড়াতে হবে না। এরপর মওলানা সাহেবদের বললাম, এখানকার মত দেশের আরাে কয়েকটি এলাকায় উন্নয়ন কাজে অংশগ্রহণকারী এনজিওগুলাের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তােলার চেষ্টা করা হচ্ছে। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল কর্তৃক আপনাদের অজান্তেই দেশব্যাপী বিশৃংখলা সৃষ্টির হীন উদ্দেশ্যে আপনাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশৃংখরা সৃষ্টির বিরুদ্ধে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “তােমরা পৃথিবীতে বিশৃংখলা সৃষ্টি করাে না। আপনারা যারা বােখারী শরীফ পড়েছেন, তারা নিশ্চয়ই একটি হাদীস। পড়েছেন। তাতে মহানবী (সঃ) বলেছেন, “অচিরেই মানুষ এমন একটা যুগ প্রত্যক্ষ করবে যখন ইসলামের নাম ছাড়া কিছু থাকবে না। কোরআনের অক্ষর ছাড়া কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। তাদের মসজিদগুলাে হবে অট্টালিকা। সেগুলাে হেদায়েত বা মানুষকে সৎপথ প্রদর্শন শূন্য হবে। সে যুগের আলেমরা হবে পৃথিবীতে মানুষের মধ্যে বচেয়ে নিকৃষ্ট। তাদের থেকে বিশৃংখলা উদ্ভব হবে এবং তাদের মধ্যে তা প্রত্যাবর্তিত হবে।” | মহানবীর এই হাদীসটি ব্যাখ্যা করার প্রয়ােজন নেই।

দেশের দুস্থ ও গরিব-দুঃখী মানুষের সেবায়, দেশের উন্নয়নে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে আপনারা যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে চলেছেন, মহানবীর উপরােক্ত বাণীর সাথে আপনাদের ভূমিকা মিলিয়ে দেখুন, এই হাদীসের প্রতিপাদ্য কারা। আপনাদেরই একজন বগুড়ায় লিফলেট ছেপে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষকে লেলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। অথচ এদেশে সাংবিধানিকবাবে খ্রিষ্টধর্মের সমান অধিকার স্বীকৃত। তার ও আপনাদের এই ভূমিকা রাষ্ট্রদ্রোহিতা ছাড়া কিছু নয়। আরাে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় খ্রিস্টধর্মের অনুসারী পাশ্চাত্য বাহিনী যখন ইরাকে বৃষ্টির মত রকেট নিক্ষেপ করছিল, বগুড়ার উক্ত মওলানা ও আপনারা টু শব্দটিও করেননি। আপনাদের নেতারা ঢাকায় হােটেল সােনারগাঁয়ে সেমিনার করে পাশ্চাত্য বাহিনীর মানবতা বিরােধী কর্মকাণ্ডকে বৈধতার সার্টিফিকেট দিয়ে পেট্রো-ডলার দ্বারা আলখেল্লার পকেট ভারি করছিলেন।  সত্যি পবিত্র ইসলামের নামে আপনাদের ইসলাম বিরােধী এসব কর্মকাণ্ড কতাে জঘন্য।  সেদিন এসব কথা বলার পর দু’একজন ছাড়া মওলানাদের প্রায় সবাইকে নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত মনে হলাে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যতিক্রম দু’একজনরা হচ্ছে ইসলামের মুখােশধারী একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য। দেশের উন্নয়ন তৎপরতায় বাধাদানকারী এসব রাষ্ট্রদ্রোহীকে খুঁজে বের করা, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুব একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু কে পালন করবে এই দায়িত্ব। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব যাদের হাতে নিয়ােজিত, তারাতাে স্বাধীনতা বিরােধী এই মহলটিকে ছাড়ই দিয়ে চলেছেন। আমরা যারা একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচার দাবি করেছি, উল্টো আমাদের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগ এনে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে হয়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশের উন্নয়ন তৎপরতা সম্পর্কে অপপ্রচারকারীদের বিরুদ্ধে দেশের সচেতন নাগরিকদের রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের আনাচে-কানাচে মিটিং সমাবেশ করে ক্ষমতা দখলের নীল-নকশাকারী স্বাধীনতা বিরােধী উক্ত বিশেষ রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারীদের মুখােশ খুলে ফেলার উদ্যোগ নিতে হবে।

আজকের কাগজ ঃ ১০-৪-৯৪

সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল