মৌলবাদ শব্দের ব্যবহার নিয়ে বিভ্রান্তি–
বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ
মৌলবাদ বা মৌলবাদী শব্দের ব্যবহার নিয়ে বাংলাদেশে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে। কোন কোন আধুনিক শিক্ষিতও এই বিভ্রান্তিমুক্ত নন। এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে মৌলবাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ থেকে। মৌল শব্দ এসেছে মূল থেকে। মৌল শব্দের অর্থ মূল, সম্বন্ধীয়, মূলাগত। মূলকে আরবীতে বরা হয় ‘আসল’। ফার্সিতে ‘বুনিয়াদ’ শব্দ দ্বারা মৌলবাদ বুঝান হয়। আভিধানিক অর্থে মৌলবাদ বলতে অকৃত্রিম নীতি বা আদর্শ আর তার অনুসারীদের বলা হয় মৌলবাদী। মৌলবাদ বা মৌলবাদী শব্দের একটা ঐতিহাসিক পটভূমিও রয়েছে। আধুনিককালে মৌলবাদ শব্দটির উদ্ভব হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডারউইনের বিবর্তনবাদ প্রচারিত হওয়ার পর উনিশ শতকের শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল প্রােটেস্ট্যান্টরা বাইবেলের পবিত্রতা রক্ষার আন্দোলন শুরু করে। তারা বাইবেলের বিশুদ্ধতা বা অভ্রান্ততা, কুমারী মাতা মেরীর গর্ভে যীশুর জন্ম, যীশুর শারীরিক ও দ্বিতীয়বার উত্থান মৌল সত্য বলে আন্দোলন করে। এসব আন্দোলনকারী খ্রিস্টানদের বলা হতাে মৌলবাদী। মুসলিম বিশ্বে, বিশেষ করে বাংলাদেশে মৌলবাদী শব্দ দ্বারা যাদের বুঝানাে হয়, তারা মৌলবাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ ও ঐতিহাসিক পটভূমি টেনে অপপ্রচার চালিয়ে থাকে, তারামূল বা খাঁটি ইসলামের অনুসারী। এ জন্য তাদের মৌলবাদী বলা হয় এবং তাদের সমালােচনা করার অর্থ ইসলাম ও খাঁটি মুসলমানদের বিরােধিতা করা। আর ইসলামবিরােধী ছাড়া কেউ কোন মুসলমানকে মৌলবাদী বলতে পারে না। মুসলিম মৌলবাদীদের সমালােচনা করা ধর্মদ্রোহী ব্যাপার। সম্ভবত এজন্যই বাংলাদেশের মৌলবাদীরা তাদের সমালােচনাকারীদের ঢালাওভাবে ‘মুরতাদ ও ইসলামের দুশমন বলে থাকে। মৌলবাদ ও মৌলবাদী শব্দ সম্পর্কে এ ধরনের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে অনেক আধুনিক শিক্ষিত ও মুক্তবুদ্ধির লােকও এই শব্দ দুটোর ব্যবহার এড়িয়ে চলেন। কিছুদিন আগে এক প্রগতিশীল লেখক-রাজনীতিক আমাকেও মৌলবাদ ও মৌলবাদী” শব্দ দুটো ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। এই দুটো শব্দ ব্যবহারের পরিবর্তে তিনি আমাকে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্প্রদায়িক শব্দ ব্যবহার করতে বলেছেন। তার এই পরামর্শ গ্রহণের পরও বলা হয়, মৌলবাদী’ শব্দ ব্যবহারে আপত্তি কেন। কারণ কোন শব্দের আভিধানিক অর্থ যেমন রয়েছে তেমনি পারিভাষিক অর্থও রয়েছে। কোন শব্দের পারিভাষিক অর্থ ব্যবহারের নিয়ম পৃথিবীর প্রতিটি ভাষা ও মতবাদেই রয়েছে।
প্রয়ােজনবােধে আভিধানিক কিংবা পারিভাষিক যে কোন অর্থে। শব্দটি ব্যবহার করা যায়। যেমন আরবী ভাষার ‘মুমিন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বিশ্বাসী। আর ‘কাফির’ অর্থ অস্বীকারকারী। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোন বিষয় বিশ্বাস করলেই কাউকে মুমিন বলা যায় না। আবার যে কোন বিষয় অস্বীকার করলেও কাউকে কাফির বলা যায় না। ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহ, রাসূল, পরকাল ও অন্যান্য বিশ্বাস বিষয়গুলাের প্রতি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস স্থাপনকারীকে মুমিন বা বিশ্বাসী বলা হয়। অপরদিকে যারা এসব বিষয় অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে তাদের বলা হয় কাফির। মৌলবাদ বা মৌলবাদীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য। পবিত্র ধর্মকে বৈষয়িক স্বার্থে ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের বাহন হিসেবে গ্রহণ করাকে পারিভাষিক অর্থে মৌলবাদ বলা যায়। যারা এরূপ করে তাদের বলা যায় মৌলবাদী। বর্তমান বিশ্বে এই অর্থেই মৌলবাদ ও মৌলবাদী শব্দ দুটো ব্যবহার হয়ে থাকে। আমরা যতটুকু জানি, এই শব্দ দুটোর। ব্যবহারকারীরা কেউই এর দ্বারা কোন ধর্মের খাটি অনুসারীকে, বিশেষ করে পবিত্র ইসলামের সত্যিকার অনুসারীদের কটাক্ষ করে না। কোন শব্দ বা বিষয়ের উৎপত্তি যতাে ভালই হােক না কেন, স্থান-কাল-নির্বিশেষে সব সময়ই যে তার বৈশিষ্ট্য অক্ষুন্ন থাকবে এরূপ মনে করারও সঙ্গত কোন কারণ নেই। গণতন্ত্রের কথাই ধরা যাক। মানব কল্যাণের মহান লক্ষ্যে এই শব্দ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। প্রকৃতিগতভাবেই মানুষ স্বাধীন। মানুষের এই প্রকৃতিগত মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, নিশ্চয়তা ও মর্যাদা রয়েছে গণতন্ত্রে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় । কিন্তু অতীতে এমনকি বর্তমানে অনেক একনায়কও নিজেকে গণতন্ত্রী দাবি করে দোর্দণ্ড প্রতাপে স্বৈরাচারী শাসন চালায়। সাবেক পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের বুনিয়াদী জমহুরিয়াত বা মৌলিক গণতন্ত্রের কথা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
তিনি তাে আর একনায়ক শাসনব্যবস্থাকে শুধু গণতন্ত্র নয়, মৌলিক গণতন্ত্র নামে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু তার তথাকথিত গণতন্ত্র আর সত্যিকার গণতন্ত্র কি অভিন্ন বিষয় ছিল? সত্যিকার গণতন্ত্রের উৎস আর আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের উৎস কি এক ছিল? আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরােধিতা, সমালােচনা কিংবা নিন্দা করা হলে কি সত্যিকার গণতন্ত্রের বিরােধিতা, সমালােচনা কিংবা নিন্দা মনে করা সঙ্গত হবে? আভিধানিক অর্থে মৌলবাদ। ও বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত মৌলবাদও হুবহু আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্র ও সত্যিকার গণতন্ত্রের মতােই। বর্তমানে প্রচলিত মৌলবাদ বা মৌলবাদীদের সমালােচনাকে আভিধানিক অর্থে মৌলবাদ বা মৌলবাদীদের সমালােচনা গণ্য করা ঠিক হবে না। আলবদর ও রাজাকার শব্দ দুটোও এক্ষেত্রে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বদরের যুদ্ধ ছিল ইসলাম ও মুসলমানদের অগ্রযাত্রার মূল ভিত্তি। এজন্য বদর যুদ্ধের অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের সম্মান ও মর্যাদা অপর যে কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুসলমানদের চেয়ে অনেক বেশি। এই যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের স্বর্গবাসী হওয়ার সুসংবাদ পবিত্র কোরআনে ঘােষণা করা হয়েছে। মােটকথা বদর যােদ্ধা বা বদর বাহিনী ইসলামের ইতিহাসের গৌরব, অহঙ্কার। অপরদিকে আরেক বদর বাহিনী সম্পর্কে বাঙালিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরা ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর দোসর নরঘাতক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত শত শত প্রতিবেদনে এই বদর বাহিনীর নৃশংসতার ভয়াবহ চিত্র রয়েছে। এই চিত্র হিটলারের গেস্টাপাে, ভিয়েতনামের মাইলাই, লেবাননে ফিলিস্তিনীদের সাবরা শাতিলা শিবির কিংবা বসনিয়া হারজেগােভিনায় সার্বদের হত্যাযজ্ঞের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। বাংলাদেশে বদর বাহিনী নামধারীদের এই পাশবিক কর্মকাণ্ডের জন্য এদেশের মানুষের নিকট তারা ঘাতক হিসেবে পরিচিত। প্রতিটি বাঙালির নিকট আলবদর মানে খুনি, নারী ধর্ষণকারী, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযােগকারী, লুটেরা। বাংলাদেশের আলবদরদের ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের নিন্দা করা হলে কেউ যদি বলে, তাতে ইসলামের প্রাথমিক যুগে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মহান ব্যক্তিদের নিন্দা করা হচ্ছে তার বা তাদের এই উক্তি পাগলের প্রলাপ ছাড়া অন্য কিছু ভাববার অবকাশ আছে? মৌলবাদ বা মৌলবাদী শব্দও এর ব্যতিক্রম নয়।
আভিধানিক দিক থেকে মৌলবাদী শব্দের অর্থ যদিও নির্ভেজাল ধর্মাদর্শের অনুসারী, কিন্তু বর্তমানে কেউই এই অর্থে মৌলবাদ বা মৌলবাদী শব্দ ব্যবহার করে না। বর্তমানে সবাই মনে। করে, পবিত্র ধর্মকে যারা বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বাহন করছে, যারা ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষের বিবেক কেনার জন্য ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, যারা ধর্মের মনগড়া বা মানব কল্যাণবিরােধী ব্যাখ্যা দিচ্ছে, যারা ধর্মের স্লোগান দিয়ে সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে, মানুষের হাত-পায়ের রগ কাটছে, মানুষ হত্যা করছে- তারাই মৌলবাদী। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাইবেলের ব্যাখ্যা কেন্দ্র করে রক্ষণশীল প্রােটেস্ট্যান্টরা যে মৌলবাদী আন্দোলন শুরু করে তার সাথেও বর্তমান মৌলবাদীদের কোন মিল নেই। সে আন্দোলনের লক্ষ্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল কিংবা ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল না। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে, বিশেষ করে মুসলিম মৌলবাদীদের লক্ষ্য হচ্ছে, পবিত্র ধর্ম কায়েমের স্লোগান দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। মিসরের ইখওয়ানুল মুসলিমীন বা মুসলিম ভ্রাতৃসংঘকে মুসলমানদের প্রথম মৌলবাদী সংগঠন বলা যায়। ১৯২৮ সালে মিসরের হাসান বান্না নামের এক ব্যক্তি মুসলিম ভ্রাতৃসংঘ গঠন করেন। ১৯৫৪ সালে এই মৌলবাদী সংগঠনের সদস্যরা মিসরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জামাল নাসেরকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। কিন্তু এই ষড়যন্ত্র ফাস হয়ে যায়। ১৯৮১ সালের মিসরের প্রেসিডেন্ট আনােয়ার সাদাত সেখানকার মৌলবাদীদের হাতে নিহত হন। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার দেশ মিসর এখন মৌলবাদীদের সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ক্ষেত্র পরিণত হয়েছে। মিসর সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখার জন্য এক সময় ইসরাইলও মিসরীয় মৌলবাদীদের অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করতাে। ফিলিস্তিনের আল-হামাস সংগঠনকে পিএলও’র প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। বর্তমানে এই সংগঠনই ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তিউনিসিয়ার মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন ‘আননেদাউল মুসলিমীন’, আলজিরিয়ায় ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট, জর্দানের মুসলিম মুজাহিদীন, লেবাননে হিযবুল্লাহ, মালয়েশিয়ায় আল আরকাম, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে জামাতে ইসলামী, ইরানে আয়াতুল্লাহ খােমেনীর দল প্রভৃতি সংগঠন মৌলবাদী সংগঠন। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলাে বহু বছর এসব মৌলবাদী সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দেশ ও রাজনৈতিক শক্তির বিরুদ্ধে লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেছে।
বাংলাদেশে মৌলবাদী সংগঠন জামাত-শিবির একটি কালাে শক্তি, একটি ফ্যাসিস্ট চক্র। তাদের ৫০ বছরাধিককালের ইতিহাসে ফ্যাসিজমের অজস্র প্রমাণ রয়েছে। ইসলামই তাদের আদর্শ প্রচার করা হলেও মহান শান্তির ধর্ম ইসলামের উদারতা, বিশালতা, সহনশীলতা ও পরম সহিষ্ণুতার কোন পরিচয় তাদের কার্যকলাপে পাওয়া যায় না। বিশেষ করে যখন তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মােকাবিলা করে। একাত্তরে তাদের পাশবিক ভূমিকা কোন দিন এদেশবাসী ভুলবে না। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে জামাত ইসলাম রক্ষার নামে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সক্রিয় সহযােগিতা করে। শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর বাহিনী গঠন করে মানুষ হত্যা, হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংসে হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীকে মদদ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “পৃথিবীতে তােমরা ফাসাদ বা সন্ত্রাস সৃষ্টি করাে না। আল্লাহ সন্ত্রাসীদের পছন্দ করে না।” মহানবী (সঃ) বলেছেন, “সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলমান যার হাত ও মুখ থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ।” অথচ প্রায়ই বিভিন্ন সংবাদপত্রে জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের খবর পাওয়া যায়। বাংলাদেশে বিশেষ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটা আমদানি করেছে জামাত-শিবির। আমাদের প্রিয় নবী যুদ্ধজয়ের পর পরাজিতদের প্রতি যে ব্যবহার করেন, দেড় হাজার বছর পরও তা এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, বর্তমানে মুসলিম মৌলবাদীরা বিভিন্ন দেশে আল্লাহর আইন কায়েমের স্লোগান তুলে যে উন্মাদনার সৃষ্টি করছে, এ কোন আল্লাহর আইন। আমরা যে মহান আল্লাহকে বিশ্বাস করি, তার বিধান তার আইনে তাে বিনাবিচারে মানুষ হত্যার কথা নেই। আসলে আল্লাহর আইন কায়েম নয়, রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করাই হচ্ছে তাদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ধর্মপরায়ণ মানুষের মধ্যে সহজে একটা উন্মাদনা জাগিয়ে তােলার কূটকৌশল হিসেবেই মৌলবাদীরা পবিত্র ধর্মের নাম ব্যবহার করে। আমাদের এই উক্তির একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে বর্তমান আফগানিস্তান। সেখানে আল্লাহর আইন কায়েমের স্লোগান দিয়ে মৌলবাদীরা রুশ সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকারকে তাড়িয়েছে। কিন্তু তারপর কি ঘটলাে। এই মৌলবাদী যযাদ্ধারা নিজেদের মধ্যে লড়াই করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে। মৌলবাদীদের কামান, রকেটের গােলায় কতাে নিরপরাধ বেসরকারি লােক নিহত হলাে, কতাে সম্পদ ধ্বংস হলাে। রাষ্ট্রক্ষমতা এখন তাে আফগানিস্তানে মৌলবাদীদের হাতেই। এখন সেখানে গৃহযুদ্ধ বন্ধ হচ্ছে না কেন। মৌলবাদী প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে মৌলবাদী প্রধানমন্ত্রীর অনুগতরা আর প্রেসিডেন্টের অনুগতরা প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে।
অথচ আফগান মৌলবাদী গ্রুপগুলাে আল্লাহর আইন কায়েমের স্লোগান দিয়ে কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে এক হয়ে যুদ্ধ করেছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মৌলবাদীদের আল্লাহর আইন কায়েমের স্লোগান স্রেফ একটা ভাঁওতা। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষমতা। আর এই ক্ষমতার ভাগ নিয়েই আফগানিস্তানে মৌলবাদী গ্রুপগুলাের মধ্যে এখন গৃহযুদ্ধ চলছে। শুধু মুসলমান নয়, প্রতিটি ধর্মীয় মৌলবাদীর ভূমিকাই এক ও অভিন্ন। তারা ধর্মের নামে উন্মাদনা সৃষ্টি করে মানব কল্যাণের জন্য প্রবর্তিত ধর্মকে মানবতা বিরােধী কাজে ব্যবহার করে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলার খ্রিস্টধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে খ্রিস্টান সৈন্যদের ইহুদী নিধনে নিয়ােজিত করে। তার কিছুকাল পর ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মীয় সংহতির ধূয়া তুলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু করা হয়। এই দাঙ্গায় কত লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে তার সঠিক পরিসংখ্যান আজও বের করা সম্ভব হয়নি। বা কেউ করেনি। ১৯৪৬ সালে সৃষ্ট ধর্মীয় দাঙ্গা দীর্ঘ ৪৮ বছর পর আজও চলছে। নানা ব্যাপারকে উপলক্ষ্য করে উপমহাদেশের কোন না কোন এলাকায় প্রায়ই ধর্মীয় দাঙ্গা লেগে যায়। দু’তিন বছর আগে ভারতে হিন্দু মৌলবাদীরা রাম জন্মভূমির ধূয়া তুলে অযােধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংস করে। এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও ছড়িয়ে পড়ে। বহু মন্দির ধ্বংস করা হয়, কোটি কোটি টাকার সম্পদ লুটপাট হয়। এক সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শুধু ভারতের বােম্বাই শহরে বার শ’ লােকের প্রাণহানি ঘটে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে জার্মানিতে ইহুদী নিধন অভিযান হলেও এই ইহুদী মৌলবাদীরাই ফিলিস্তিনে মুসলমানদের অকথ্য নির্যাতন চালায়। হাজার হাজার ফিলিস্তিনী মুসলমানদের তাদের বাস্তুভিটা থেকে তাড়িয়ে দেয়। দীর্ঘ ৪৬ বছর থেকে এসব ফিলিস্তিনী সিরিয়া, লেবানন ও অন্যান্য আরব দেশে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। যাই হােক, মুসলিম মৌলবাদী বলতে বর্তমানে ধর্মের মুখােশে উন্মাদনা সৃষ্টিকারী চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের বুঝানাে হয়। সত্যিকার ইসলামের অনুসারী ও ধর্মনিষ্ঠদের বুঝানাে হয় না। মৌলবাদ বা মৌলবাদী শব্দ দ্বারা নির্ভেজাল ধর্মনিষ্ঠদের সম্পর্কে কোন প্রকার বিদ্বেষ কিংবা কটাক্ষও প্রকাশ করা হয় না। মৌলবাদ শব্দ সম্পর্কে মৌলবাদীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হয়ে এই শব্দটি ব্যাপক ব্যবহার করা দরকার। এ ব্যাপারে কোন প্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করা হলে মৌলবাদীদের অপপ্রচারেই পা দেয়া হবে, প্রকারান্তরে তাদেরকে সহায়তা করা হবে। এই শব্দটি ব্যাপক ব্যবহার করা হলে আমাদের সমাজে বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের নিকট মৌলবাদীরাও রাজাকার আলবদরদের মতাে। গণধিকৃত হয়ে পড়বে। তাতে করে পবিত্র ধর্ম নিয়ে ব্যবসার প্রবণতা সমাজে হ্রাস পাবে। আজ এই মুহূর্ত থেকে সকল মানবতাবাদীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে কোন মৌলবাদী তৎপরতা প্রতিহত করতে হবে।
সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল