স্বাধীনতা বিরােধীদের আস্ফালন
পেঁচা নাকি দিনে ঘুমায়। দিনকে রাত মনে করে। সূর্যের আগমনকে সে অস্বীকার করে। অন্যদেরও তার মতে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করে। কিন্তু অন্য কোন পাখী পেঁচার মত দিনে ঘুমায় না। এ থেকে প্রমাণ হয়, অন্য পাখীরা পেঁচার এই অবাস্তব ধ্যান-ধারণা সমর্থন করে না। | আমাদের দেশের এক শ্রেণীর স্বাধীনতাবিরােধী ও পাক হানাদার বাহিনীর দোসর এবং তাদের কয়েকটি সংবাদপত্রের ভূমিকা পেঁচার ধ্যান-ধারণা মনে করিয়ে দেয়। তারা নিজেদের স্বাধীনতাবিরােধী ভূমিকার ছাপ মুছে ফেলার জন্য পেঁচার অভিনয় শুরু করেছে। গত শুক্রবার ঢাকা জেলা সমিতি মিলনায়তনে কয়েকজন স্বাধীনতাবিরােধী বলেছেন, “দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নস্যাৎ করে ভারতের সাথে একীভূত করার যে ষড়যন্ত্র বর্তমানে চলছে, তা প্রতিহত করার লক্ষ্যে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিসমূহের ঐক্যের বিকল্প নেই।” এ কথাগুলাে নতুন কিছু নয়। বিগত ৪০ বছর অর্থাৎ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনাকাল থেকে এসব কথা এ দেশবাসী শুনে আসছেন। ৫২ সালে মহান ভাষা আন্দোলনকালেও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নস্যাতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল। ছ’দফা আন্দোলনে, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এমনকি মুক্তিযুদ্ধেও ভারতীয় ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল। এ দেশের বরেণ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে এমন কেউ নেই যাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নস্যাতের ষড়যন্ত্রকারী ও ভারতের দালাল বলে অপবাদ দেয়া হয় নি। শেরে বাংলা এ ” কে ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তথাকথিত দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী ও ইসলাম-পছন্দদের ভাষায় স্বাধীনতাসার্বভৌমত্ব নস্যাতের ষড়যন্ত্রকারী ও ভারতের দালাল ছিলেন। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর শেরে বাংলা কলকাতা গিয়েছিলেন। সেখানে তার ভাষণ থেকে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করা হয়েছিল। পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী একজন বিদেশী সাংবাদিককে ম্যানেজ করেছিলেন হক সাহেবের ভাষণে ষড়যন্ত্র প্রমাণের জন্য। পাকিস্তান আন্দোলনে অসামান্য অবদান ছিলাে সােহরাওয়ার্দী সাহেবের। পাকিস্তান হওয়ার পর সােহরাওয়ার্দী সাহেব স্টীমারযােগে ঢাকা এসেছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে ঢাকায় নামতে দেন নি। তাকে কলকাতায় ফিরে যেতে হয়েছিল।
পঞ্চাশের দশকের প্রথমার্থে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ৯২-ক ধারা জারি করা হয়। শাসক হয়ে আসেন ইসকান্দর মীর্জা। সে সময় মওলানা ভাসানী একটি শান্তি সম্মেলনে যােগদান উপলক্ষে বার্লিনে ছিলেন। ইসকান্দর মীর্জা ঘােষণা করলেন মওলানা ভাসানী ভারতের দালাল, তিনি বিমান থেকে পূর্ব বাংলায় অবতরণ করলে তাকে গুলি করা হবে। মওলানা সাহেবের মত একজন অনন্য সাধারণ সাহসী নেতাও সে সময় পূর্ব বাংলায় ফিরে আসতে পারেন নি। ৯২-ক ধারা তুলে না নেয়া পর্যন্ত তিনি ইউরােপ সফর করে কাটিয়েছেন। বলা চলে, বিদেশে প্রবাসী জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। আর বঙ্গবন্ধুকে তাে কথায় কথায়ই ভারতের দালাল, আমেরিকার দালাল বলা হতাে। তিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থে ৬ দফা ঘােষণা করেন, তখন বলা হলাে, এটা সিআই-এর ষড়যন্ত্র। | মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতেও তারা একই ভাষায় কথা বলেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের বলতাে হিন্দু বাহিনী, দুষ্কৃতকারী, ইসলামের দুশমন। পাকিস্তান না টিকলে এদেশে ইসলাম থাকবে না। ইসলাম রক্ষার জন্যই পাকিস্তানকে রক্ষা করা প্রয়ােজন। এমনকি, স্বাধীনতার পরও যেসব রাজাকার, আলবদর ও তাদের নেতারা বিদেশে পাড়ি জামিয়েছিল, তারা অপপ্রচার করেছে, এ দেশের মানুষকে হিন্দু করে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার ও মসজিদ নির্মাণের নাম করে তারা মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাখ। লাখ ডলার আদায় করেছে। এই অর্থ দিয়ে তাদের কেউ কেউ লন্ডনে বাড়ি পর্যন্ত করেছে। বিগত চার দশক থেকেই মহলটি ভারতীয় জুজু ও পবিত্র ইসলামকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। আমাদের বয়সী যারা তাদের নিকট এসব কথা নতুন কিছু নয়। তবু বলতে হচ্ছে। কারণ, আমাদের নতুন প্রজন্মের অনেকের এসব। তথ্য জানা নেই। তাদের উদ্দেশ্যেই এসব পুরােনাে কথা নতুন করে বলা ।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, যারা সেদিন মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর সক্রিয় সহযােগী ছিল, পাকিস্তান রক্ষার জন্য মুসলমান হয়ে মুসলমান হত্যা ও মুসলিম নারী ধর্ষণে দ্বিধা করে নি, তারাই আজ বাংলাদেশের রক্ষক ও দেশপ্রেমিক বলে দাবি করছে। নতুন করে পুরােনাে স্লোগানগুলাে আওড়ানাে আরম্ভ করেছে। আর যারা দেশটা স্বাধীন করলাে, তারা হয়ে গেছে ভারতের দালাল, ইসলামের দুশমন। কথাটা এভাবেও বলা যায়, যারা পাকিস্তান আসলে ভারতের দালাল’ ছিল পাকিস্তান ও ইসলামের শত্রু ছিল আজো তারা ভারতের দালাল রয়ে গেছে। পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশেও ইসলামের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। গত শুক্রবার ঢাকা জেলা সমিতির মিলনায়তনে আয়ােজিত সেমিনারের বক্তাদের বক্তৃতা ও তাদের অতীত কার্যকলাপের প্রতি তাকালে আমাদের আলােচনার যথার্থতা প্রমাণিত হবে। তবে টেকনিকটা একটু পাল্টানাে হয়েছে। যাদের গায়ে স্বাধীনতা বিরােধিতার ছাপ স্পষ্ট নয়, তাদের দিয়ে ভারতীয় দালাল প্রতিরােধ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সেমিনারে স্বাধীনতা বিরােধীরা বিশেষজ্ঞের বেশে আবির্ভূত হন। পুরােনাে কথাগুলাে নতুন করে বলে পেঁচার অভিনয় করেন। সেসক বক্তব্য স্বাধীনতা বিরােধীদের সংবাদপত্রগুলােতে ফলাও করে ছাপা হচ্ছে। তথাকথিত ভারতীয় দালাল প্রতিরােধ কমিটি আয়ােজিত উক্ত সেমিনারে এক বর্ণচোরা রাজনীতিক বলেছেন, “ভারতীয় দালাল প্রতিরােধ কমিটি গঠন জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার আন্দোলনে একটি মাইলস্টোন। চমৎকার বক্তৃতা। এই চমৎকার বক্তৃতাটি যিনি দিলেন তার অতীতের দিকে তাকালে আরাে চমৎকৃত হতে হয়। এই লােকটি এক সময় বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন, প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিলেন। ‘৬৯-৭০ সালের দিকে তাকে মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ জনাতিনেকের মধ্যে একজন মনে করা হতাে। ১৯৭১ সালে মওলানা সাহেব ভারতে চলে যান। কিন্তু তাঁর অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহচরটি যাননি। তিনি অবরুদ্ধ বাংলাদেশেই থেকে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে দেখা গেছে, তিনি নাকি পাক হানাদার বাহিনীকে ‘মুরগী’ সরবরাহ করতেন। স্বাধীনতার পর কিছুদিন তিনি ঘাপটি মেরে নিষ্ক্রিয় থাকেন। এরপর সময় সুযোেগ বুঝে সক্রিয় হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে স্বৈরাচারী এরশাদের নির্দেশ পেলে ঢাকা শহর। ঝাড়ু দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এই আগ্রহবাণী সংবাদপত্রে ছাপা হয়। সুযােগ আর যায় কোথায়।
এরশাদের মন্ত্রী হন। স্বৈরাচারের সাচ্চা খাদেমে পরিণত হন। কোন কোন চারপায়া জন্তুর মত এ জাতীয় মৌসুমী রাজনীতিকরা খুবই হুঁশিয়ার। তারা মৃদুমন্দ বাতাস থেকেও ঝড়ের পূর্বাভাস আঁচ করতে পারেন। যথাসময়ে তিনি এরশাদের মঞ্চ ছেড়ে কেটে পড়েন। এই দ্রলােকই সেদিন জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ভারতীয় দালাল প্রতিরােধের ফতােয়া দিলেন। আরাে মজার ব্যাপার হলাে, সভা-সমিতি, সেমিনার-সিম্পােজিয়ামে তিনি ফতােয়া দিয়ে বেড়াচ্ছেন, ভারতীয় দালাল প্রতিরােধের জন্য । অপরদিকে তারই কন্যা লেখাপড়া করছে ভারতে। সেদিনের সেমিনারে আরেক বক্তা ছিলেন ঠেডা মালিকার মন্ত্রিসভার সদস্য। স্বাধীনতার পর তিনি শ্রীঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে শােনা গিয়েছিল তিনি নাকি বাল্যকালের পরিচয়ের সূত্র ধরে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কায়েম করেছিলেন কিংবা করার চেষ্টা করেন। তথাকথিত ভারতীয় দালাল প্রতিরােধের স্লোগানধারীদের বায়ােডাটা খুঁজতে গেলে অধিকাংশের এমনি পরিচয় পাওয়া যাবে। আরাে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এসব ভারতীয় দালাল প্রতিরােধকারী ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারীদের মুখে পাকিস্তানের সমালােচনা ভুলেও শােনা যাবে না। পাকিস্তানের নিকট বাংলাদেশের পাওনার পরিমাণ তিন হাজার কোটি টাকা। এই টাকা কোন ব্যাংকে রাখলেও বিগত ২১ বছরে ২৫ হাজার কোটি টাকা হতাে। সুদে আসলে এই বিপুল অর্থ পাকিস্তান থেকে আদায় করতে পারলে এর দ্বারা আমাদের বৈদেশিক ঋণ সব শােধ করা যেতাে। কিন্তু তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা এ ব্যাপারে টু শব্দটিও করে না। বরং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সামনেও তাদের মুখে পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি শােনা যায়। সেদিন তাে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই একজন দেশপ্রেমিক পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দেন। এসব কিসের আলামত। মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে ভারতীয় দালাল আখ্যায়িত করে, তাদেরকে প্রতিরােধের আড়ালে কি তথাকথিত দেশপ্রেমিকরা দেশটাকে একাত্তর পূর্ববর্তী অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে চান? সময়ের চাকা কখনাে পেছনের দিকে ঘােরে না। যেদিন যায় তা ফিরে আসে না। এটা প্রকৃতির অমােঘ বিধান। স্বাধীনতাবিরােধীদের এই খায়েশ কখনাে পূরণ হবে না। এ জন্যই বলছিলাম, এসব বর্ণচোরারা পেঁচার মত দিনে ঘুমিয়ে দিনকে রাত বলছে। অন্যদেরও তা গলাধঃকরণের চেষ্টা করছে। দিন যেমন রাত হবে না, তেমনি তাদেরও খায়েশ কখনাে পূরণ হবে না । বেশি উড়লে পাখা ছিড়ে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এবার বঙ্গবন্ধুর মত কোন মহান ব্যক্তিত্ব নেই যিনি তাদের রক্ষা করবেন। সুতরাং রসনা ও আচার-আচরণ। সংযত করুন। এটা দেশ, জাতি ও আপনাদের সবার জন্যই মঙ্গল।
আল আমীন ঃ ১০-৬-৯২
সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল