সংবিধানে সংযােজন বিয়ােজন
আমি আইনবিদ কিংবা সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। তবু একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে দেশের সংবিধানের প্রতি আমার শুধু আনুগত্য নয়, অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। আমাদের সংবিধান নিয়ে আমি গর্বিত। এই গর্ববােধ সংবিধান প্রণয়ন ও প্রবর্তনের সূচনাকাল থেকেই। কিন্তু সেদিন ১৯৮৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংশােধিত আমাদের সংবিধানটি দেখে আমার এতােদিনের গর্ব এক মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল। আগেই বলেছি, আমি সংবিধান বিশেষজ্ঞ নই। তবু একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, একটা দেশের জনগণের চিন্তা-চেতনার আলােকে সে দেশের মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়। আর এই মূলনীতির আলােকে সংশ্লিষ্ট দেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সংবিধান হচ্ছে দেশের প্রতিটি নাগরিকের অধিকারের রক্ষাকবচ। সংবিধান অপরিবর্তনীয় নয়। জনগণের স্বার্থে প্রতিটি দেশের সংবিধানেই নির্ধারিত নিয়মে সংশােধন, সংযােজন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও প্রতিস্থাপন করা হয়ে থাকে। কিন্তু কোনাে দেশের সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তনের কথা বড় একটা শােনা যায় না। প্রতিবেশী ভারতের সংবিধান গত ৪৪ বছরে বহুবার পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংযােজন করা হয়েছে। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি তাকালেও আমরা একই অবস্থা দেখতে পাই। ইন্দোনেশীয় জাতির জনক ডঃ সুকর্নের আমলে সে দেশে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে পঞ্চশীলা নীতি গ্রহণ করা হয়। এই পঞ্চশীলা নীতি ভিত্তি করে ইন্দোনেশিয়ার সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। বিগত ৪০ বছরেরও অধিক সময়ে বিভিন্ন সময়ে ইন্দোনেশিয়ার সংবিধান সংশােধিত ও সংযােজিত হয়েছে। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন হয় নি। মালয়েশিয়ায় ধর্মবর্ণনির্বিশেষে মালয়েশিয়ান জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শে ষাটের দশকে সে দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ করা হয়। এই মূলনীতির ভিত্তিতে মালয়েশিয়ার সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। সেখানে বিভিন্ন সময়ে নানা প্রয়ােজনে জনস্বার্থে সংবিধান সংশােধন-সংযােজন করা হলেও রাষ্ট্রীয় মূলনীতি পরিবর্তন করা হয়নি।
আধুনিক তুরস্কের জনক মােস্তফা কামাল ১৯২৪ সালে সে দেশের দুটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ করেন। সেবারই তুরস্কের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। অবশ্য ১৯৫৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের সংবিধান বাতিল ঘােষণা করা হয়। ১৯৬১ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা। হয়। কিন্তু আতাতুর্ক মােস্তফা কামালের সময়ে নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নতুন সংবিধানেও বহাল রাখা হয়। বিভিন্ন সময়ে সংবিধান সংশােধন করা হলেও রাষ্ট্রীয় মূলনীতির পরিবর্তন করা হয়নি। আলজিরিয়া, তিউনিসিয়া, মিসর, সিরিয়া, ইরাক প্রভৃতি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ক্ষেত্রে একই অবস্থা আমরা দেখতে পাই। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু আমাদের বাংলাদেশ। এখানে বিগত বিশ বছরে বারবার সংবিধান সংশােধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এসব সংশােধন জনগণের স্বার্থে কতটুকু করা হয়েছে বলা মুশকিল। সবচেয়ে বড় কথা, কোন কোন সংশােধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালাই পাল্টে দেয়া হয়েছে। তাতে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ সংরক্ষণই ব্যাহত হয়ে পড়েছে। এসব সংশােধনীর মধ্যে চতুর্থ সংশােধনী পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে হয়েছে। এই সংশােধনী সম্পর্কে বিগত ১৫ বছরে বহু আলােচনা-সমালােচনা হয়েছে। বর্তমানে খােদ আওয়ামী লীগই এই সংশােধনী বাতিল করার কথা একাধিকবার ঘােষণা করেছে। সুতরাং এ সম্পর্কে আলােচনার প্রয়ােজন আছে বলে আমরা মনে করি না। তবে এক্ষেত্রে দু’টো বিষয় প্রণিধানযােগ্য যে, এই সংশােধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালার কোনাে প্রকার পরিবর্তন করা হয় নি। অপরদিকে আওয়ামী লীগ-পরবর্তী সরকারগুলাে বিগত সতের বছর এই সংশােধনীর সমালােচনা করলেও তারা তা বাতিল করেন নি। বরং তারা এর ফল পুরােপুরি ভােগ করেছেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিগত সতের। বছরে সংবিধানের যেসব পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশােধন করা হয়েছে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধই ব্যাহত হয়েছে। মূল্যবােধের আলােকে নির্ধারিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালাও এই পরিবর্তন থেকে রেহাই পায় নি।
এক্ষেত্রে একটি বিষয় উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, আল্লাহতায়ালা মানবজাতির কল্যাণের জন্য যুগে যুগে তার মনােনীত নবী-রাসূলদের মাধ্যমে ধর্মীয় বিধান পাঠালেও এই ধর্মকেই মানুষের শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে ধর্মের চেয়ে কার্যকর হাতিয়ার শােষক শ্রেণী এখনাে আবিষ্কার করতে সক্ষম। হয়নি। তাই সেই প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সমাজে শােষক শ্ৰেণী ধর্মকে নানাভাবে, নানা কৌশলে ব্যবহার করছে। ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষ, এমনকি অনেক সচেতন ধর্মনিষ্ঠের পক্ষেও শাসক ও শােষক শ্রেণীর এই কূটকৌশল ধরা সম্ভব হয় না। এই পদ্ধতিতে সাধারণ মানুষকে সাময়িকভাবে একটা বিভ্রান্তিতে রাখা সম্ভব হলে শাসক শ্রেণী পার পায় না এবং এর পরিণতি হয় ভয়াবহ। পাকিস্তানী শাসক ও শােষক শ্রেণীর ভূমিকা এক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়। পাকিস্তানের এই অংশের, বাঙালীরা পাকিস্তান আমলে যখনই আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারের দাবী উত্থাপন করেছে, পাকিস্তানী শাসকগােষ্ঠী তাকে ইসলামবিরােধী বলে অপপ্রচার চালিয়েছে। এর পরিণতিতে শুধু পাকিস্তানই ভাভে নি, মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে তারা পবিত্র ইসলামকে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানাের ব্যর্থ চো করেছে। এ জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের আলােকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালা নির্ধারণ করা হয়। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি কিংবা সংবিধানে যাতে পাকিস্তানের মত পবিত্র ধর্ম রাজনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহৃত না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। সংবিধানের প্রস্তাবনায় পরিস্কার বলা হয়, “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়ােগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণােৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনা মূলনীতির দ্বিতীয় বিভাগের ১২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল? “ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলােপ করা হইবে।”
বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালার এ কথাগুলােতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চিন্তা-চেতনা ও মূল্যবােধ সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল। এই বাস্তব সত্য কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুক্তিযুদ্ধে আমরা সাবেক পাকিস্তানের এই অংশের চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালা ও সংবিধানের এই সর্বজনীনতা অক্ষুন্ন রাখা হয়নি। বিগত ১৭ বছরে পাকিস্তানী স্টাইলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ধর্মপরায়ণতাকে রাজনৈতিক পুঁজি করার লক্ষ্যে সংবিধান অনেক পরিবর্তন ও সংযােজন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তন ও সংযােজন শুধু মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোেধই নয়, ইসলামিক মূল্যবােধেরও পরিপন্থী বলে আমরা কনে করি। আমরা বিভিন্নভাবে বহুবার আলােচনা করেছি যে, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য একটি পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি, অঙ্গীকার ও চুক্তি ছাড়া কিছু নয়। আর রাষ্ট্র পরিচালনায় আমরা মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধবিরােধী কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা, অপর তিনটি সম্প্রদায়ের উপর তা চাপিয়ে দেয়া আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই বৈধ হবে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে : “তবে অংশীবাদীদের মধ্যে যাদের সাথে তােমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে যারা তােমাদের চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করে নি আর তােমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুতি পালন করবে। আল্লাহ তাে ন্যায়নিষ্ঠদের পছন্দ করেন।” (৯৪)। পবিত্র কোরআনের এই আয়াতটি ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমান ও অমুসলমানদের সম্পর্কে অবতীর্ণ হলেও এর আবেদন চিরন্তন। বাংলাদেশের সংবিধান এককভাবে মুসলমানদের সম্পদ নয়। তাতে অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়েরও ন্যায়ত ও আইনত অধিকার রয়েছে। তারাও এই গ্রন্থ স্পর্শ করবে, পড়বে, যেখানে সেখানে রাখবে। এমনকি বিদেশেও এই সংবিধান যাবে এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ও ধর্মহীনরা এই সংবিধান ব্যবহার করবে। কিন্তু পবিত্র কোরআন বা তার কোন আয়াত স্পর্শ করা সম্পর্কে আল্লাহতায়ালার বিধান হচ্ছে : “নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কোরআন, যা সুরক্ষিত আছে কিতাবে, যারা পূত পবিত্র তারা ছাড়া অন্য কেউ তা স্পর্শ করবে না। এটা বিশ্বজগতের প্রতিপালকের নিকট থেকে অবতীর্ণ।
তবু কি তােমরা এই বাণীকে তুচ্ছ গণ্য করবে?” (৫৬ ৭৭ – ৮১) আল্লাহ তায়ালার এই বাণীতে পূত পবিত্র অবস্থায় পবিত্র কোরআন স্পর্শ করার কথা বলা হয়েছে। অপবিত্র অবস্থায় স্পর্শ করতে বারণ করা হয়েছে। এই পবিত্রতা বলতে বিশ্বাসগত পবিত্রতা ও শারীরিক পবিত্রতা উভয়ই বােঝানাে হয়েছে। সােজা কথায়, পবিত্র কোরআন বা তার কোন আয়াত স্পর্শকারীকে মুমিন-মুসলমান হতে হবে এবং শারীরিক দিকে থেকেও পূত পবিত্র হতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশের মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের ন্যায়ত ও আইনত অধিকার স্বীকৃত সংবিধানের শুরুতে পবিত্র কোরআনের অংশিবিশেষ ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা এবং অমুসলিমদের স্পর্শ করার আইন অধিকার দেয়া ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেই বৈধ নয়। সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় প্যারায় এবং দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ৮ নং অনুচ্ছেদে অন্যতম ধর্মনিরপেক্ষতা তুলে দেয়া হয়েছে এবং প্রথম মূলনীতি হিসেবে বলা হয়েছে : “(১) সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস । এ ক্ষেত্রে প্রথমে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ করতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মবিরােধী নয়। এ সম্পর্কে আমি ইতিপূর্বে বিস্তারিত আলােচনা করেছি। সুতরাং উক্ত আলােচনার পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়ােজন। | কিন্তু অন্যতম মূলনীতি সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস সম্পর্কে কিছু কথা আছে। আল্লাহতায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস রাখা আমাদের ধর্মের মূলকথা। এই বিশ্বাস ছাড়া কাউকে মুসলমানই ভাবা যায় না। কিন্তু সংবিধানের রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে এই বাক্যটি সংযােজনের ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে, সংখ্যায় যতােটা কমই হােক না কেন, দেশে মুসলমান ছাড়া আরাে তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে। তাদেরও সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে অধিকার রয়েছে। তারা এ ব্যাপারে মুসলমানদের সাথে অভিন্ন মত পােষণ করে কিনা তা দেখা উচিত। এ কথা কেউ বলবে না যে, এ ক্ষেত্রে অন্য তিনটি ধর্মের অনুসারীরা আমাদের সাথে অভিন্ন মত পােষণ করে। যদি করতাে, তারা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান হিসেবে পরিচিত হতাে না। তাহলে বলতে হয়, এই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যে মহান ধর্ম ইসলামের নামে এই কাজটি করা হলো, ইসলাম কি তা সমর্থন করে।
এই জবরদস্তি সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহানবীকে (সঃ) উদ্দেশ্য করে আল্লাহতায়ালা বলেছেন : “ওরা যা বলে আমি তা জানি, তােমাকে গুদের উপর জবরদস্তি করার জন্য পাঠানাে হয়নি; সুতরাং যে আমার শান্তিকে ভয় করে থাকে কোরআনের সাহায্যে উপদেশ দাও।” (৫৩:৫৪) । “তােমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে, পৃথিবীতে যারা আছে তারা সবাই বিশ্বাস করতাে। তবে কি তুমি মুমিন বা বিশ্বাসী হওয়ার জন্য মানুষের উপর জবরদস্তি করবে?” ….. (১০৯) “ধর্মে কোন প্রকার জোর-জবরদস্তি নেই।” (২৫ ২৫৬) পবিত্র কোরআনের এসব সয্য স্পষ্ট। এগুলাে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। আল্লাহতায়ালা এসব আয়াতে ধর্মমত কারাে উপর চাপিয়ে দিতে বারণ করেছেন। কিন্তু আমাদের সংবিধানের মূলনীতিতে “আল্লাহতায়ালার উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন” বাক্যটি সংযােজন করে আল্লাহ কর্তৃক নিষেধকৃত কাজটিই করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়কেও এই মূলনীতি গ্রহণে বাধ্য করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এটা হচ্ছে আল্লাহর নামে আল্লাহ-নিষিদ্ধ কাজ। এবারে সংবিধানে সংযােজিত রাষ্ট্রধর্মের কথায় আসা যাক। সংবিধানের প্রথম ভাগের (২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে ।”
রাষ্ট্রধর্মের ব্যাপারে অনেকে বলতে পারেন, পৃথিবীর বহু দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রয়েছে। আমাদের সংবিধানে থাকতে আপত্তি কেন। অন্যান্য দেশের সাথে আমাদের দেশের পার্থক্য আছে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের দেশ ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের একটি অংশ ছিলাে। বৃটিশ ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। উপমহাদেশের মুসলমান ছাড়া অপর কোন সম্প্রদায় সেদিন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবী সমর্থন করেনি। মুসলমানদেরও একটি অংশ পাকিস্তান দাবী সমর্থন করেনি। তাদের মধ্যে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদেরও একটি বিরাট অংশ ছিলেন। অপরদিকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সশস্ত্র সংগ্রামে চারটি ধর্মীয় সম্প্রদায়। অংশগ্রহণ করে। এ কথা অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, সেদিন কোন হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিষ্টান মুক্তিযােদ্ধা রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার জন্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অস্ত্র ধারণ। করেনি। পবিত্র ধর্মের নামে শােষণ, বঞ্চনা ও প্রতারণামুক্ত একটি গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিলাে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমাদের সবার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু বর্তমানে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপরায়ণ সাধারণ। মানুষের সমর্থন লাভের কুট উদ্দেশ্যে অপর তিনটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে উপেক্ষা করা, মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সংস্করণে রূপান্তরিত করার অপচেষ্টা হবে একটি পরিষ্কার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। বলা চলে, অপর তিনটি সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। আর এই বিশ্বাসঘাতকতা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার নিকটই নিন্দনীয় কাজ। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ্বাস ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।” ( ৮৫৮)। সুতরাং অন্য দেশের দুষ্টান্ত উল্লেখ করে বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘােষণা জাগতিক ও ধর্মীয় কোন দিক থেকেই সমর্থনযোগ্য নয়। তাছাড়া রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘােষণার তাৎপর্যটা কি? বাংলাদেশ কি ধর্মশাসিত রাষ্ট্র হবে, না রাষ্ট্রশাসিত ধর্ম হবে? যদি বলা হয়, ধর্ম রাষ্ট্রকে শাসন করবে। এই প্রশ্নে অপর তিনটি সম্প্রদায়ের কথা বাদ দিলেও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতাই থাকে না।
পাকিস্তানই তাে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ছিল। পাকিস্তান থেকে পৃথক হয়ে আর একটি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র করার কি প্রয়ােজন ছিল? যদি বলা হয়, রাষ্ট্র ধর্মকে শাসন করবে। এ কথার সরল অর্থ দাঁড়ায়, কোরআন-হাদীস ও ইসলামী বিধিবিধানের প্রয়ােজন নেই। রাষ্ট্রের আদেশ-নিষেধই ধর্মীয় বিধান হিসেবে গণ্য করতে হবে। এটা কি ইসলামের নামে ইসলামবিরােধিতা নয়। সংবিধানের এসব সংযােজন ও পরিবর্তন সম্পর্কে কারাে আন্তরিকতা সম্পর্কে কোন প্রকার প্রশ্ন না তুলেও বলা যায়, সংবিধানে যারা এসব করেছেন, সম্ভবত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ধর্মপরায়ণদের প্রতিই তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলাে। তাই তারা সংবিধানে এসব সংযােজন-বিয়ােজন পরবর্তী পরিণতির দিকটা ভাবার প্রয়ােজন বােধ করেন নি। জাতীয় সংসদের সরকারী ও বিরােধী দলীয় সদস্যদের প্রতি অনুরােধ, সংবিধানের এসব সংযােজন-পরিবর্তন সম্পর্কেও আপনারা মূল্যায়ন করবেন। কারণ দেশের সাধারণ মানুষের নিকট বিসমিল্লাহ কায়েমের শ্লোগান দিয়ে আজ হয়তাে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া গেছে। আবার সংবিধানে বিসমিল্লাহ থাকবে’ ঘােষণা দিয়ে জনসমর্থন লাভ করা যাবে। কিন্তু ভবিষ্যৎ বংশধররা সংবিধানের এসব সংযােজন-পরিবর্তন কিভাবে মূল্যায়ন করবে, আমাদের সম্পর্কে তারা কি ভাববে, এ বিষয়টি আমাদের সবার ভেবে দেখে দরকার।
সূত্র : বঙ্গবন্ধু ও ইসলামী মূল্যবোধ – মওলানা আবদুল আউয়াল