সর্বশেষ হাসি
ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তি জীবন এবং জনতার সাথে তার আচরণ ছিল পারস্পরিক বৈপরীত্যে পূর্ণ। পাকিস্তানের দুর্যোগের দিনগুলােতে আসলেই এর অভ্যন্তরে কী ঘটেছিল তার সত্যিকারের চিত্র বিশ্ব হয়তাে কখনােই দেখতে পাবে না যাই হােক সাধারণ মানুষের সুসংগঠিত প্রচেষ্টায় এটা বের হয়ে এসেছিল যে ইয়াহিয়া খান একাই পাকিস্তানি জনগণের দুর্ভোগের জন্য দায়ী ছিলেন আরেকজন ছিলেন জনাব ভুট্টো যিনি ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে পাকিস্তান যা হারিয়েছিল তা উদ্ধার করতে সক্ষম ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের শেষের দিকে মদ আর নারীর প্রতি তীব্র বাসনাই ইয়াহিয়া খানের পতন ডেকে এনেছিল এবং পাকিস্তানের দুর্যোগের প্রতিটি পদক্ষেপের জন্য তিনি দায়ী ছিলেন একজন সুপরিচিত পাকিস্তানি কলামিস্ট এম, এস নাবাএ ওয়াক্ত পত্রিকায় লিখেন যে, “নিঃসন্দেহে এই লােকটা তার সমস্ত পাপের ভাগীদার ও সমস্ত দুর্ভোগের জন্য দায়ী। একচোখা ইতিহাসবিদদের উচিত এই লােকটাকে নিয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ লেখা লিখতে যিনি মদ আর নারীতে পুঁদ হয়ে জাতির জন্য আত্মহত্যামূলক সিদ্ধান্তগুলাে নিয়েছিলেন। কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে ইতিহাসে ইয়াহিয়া খান ছিলেন সবচেয়ে ভয়াবহ মদ্যপায়ী ও নারীলােভী পুরুষ তার মতাে এমনটা আর দেখা যায় না। জনতার আদালতে সকলের সম্মুখে তার বিচার হওয়া উচিত ছিল যাতে মানুষ দেখতে পারে যে লােকটা পাকিস্তানকে ভূতলে নামিয়ে দিয়েছে তার পরিণতি কী হওয়া উচিত কিন্তু পাকিস্তানের রক্ষাকর্তারা ভাবলেন হয়তাে জনগণ তাদেরকে এমন প্রশ্ন করে বসতে কিংবা এমন দাবি করে বসতে পারে যা তাদের অস্বস্তির কারণ হবে ফলে এমনটা আর হলাে না।’ যাই হােক কলাম লেখক এম, এস ব্যক্তিগত জীবনে মােহাম্মদ সফিউল্লাহ নামে পরিচিত ছিলেন।
ইয়াহিয়া খানের জীবনের সর্বশেষ সময় নিয়ে চমকপ্রদ সংবাদ দিয়েছিলেন এয়ার মার্শাল আসগর খান। পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের সাবেক প্রধান, একই সাথে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ার লাইনসের প্রধান এয়ার মার্শাল আসগর খান ছিলেন ভুট্টোর শাসনামলের সবচেয়ে শক্ত সমালােচক। একই সাথে তিনি আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানেরও প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। যদিও ভুট্টো এয়ার মার্শাল আসগর খানের সভায় হামলা করে, তাকে হত্যা করে নানাভাবে তার মুখ বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আসগর খান বিরত হননি। বরং আর্মড ফোর্সের সাথে তার পূর্বের যােগাযােগ থাকার কারণে তিনি প্রায় সময় যে সমস্ত অনাকাক্ষিত নিরাপত্তাগুলাে পেতেন সেটাকে খুব আনন্দের সাথে ভােগ করতেন। নিরাত্তার এই সুবিধাটুকু নিয়ে জনাব আসগর খান ভুট্টোর বিরুদ্ধে কট্টোর সমালােচনায় মেতে উঠেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে যতটুকু সম্ভব দলিল প্রমাণসহ অনেক কিছুই প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলেন।
তার এই সমস্ত লেখা। আর চেষ্টার শিরােনাম দিয়েছিলেন তিনি ইয়াহিয়া খানের মতাে আরেক দানব প্রতিভা’ নামে তার এই সমস্ত লেখা বক্তব্য পাকিস্তানি কোনাে পত্রিকা প্রকাশ করার সাহস করেনি। বরং বেশ সীমিত আকারেই এগুলাে প্রকাশিত হতাে। বিদেশি পত্রিকা, সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে তিনি এই সব বলতেন। তার খুঁটিনাটি বক্তব্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কেউ কেউ প্রকাশ করলে সেই সব পত্রিকাগুলােকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এয়ার মার্শাল আসগর খান ভুট্টোর বিরুদ্ধে সবচেয়ে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছিলেন ১৯৭২ এর অক্টোবরে লাহােরে একটা জনসভায়। সেখানে নাবাএ ওয়াক্ত পত্রিকা সূত্র ধরে এয়ার মার্শাল বলেন ১৯৭১ এ এই ভুট্টোর কারণেই ভারতের সাথে পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। ভুট্টোই জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করেছিলেন। ভুট্টো বলেছিলেন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে চীন আর আমেরিকা তাদেরকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে। আসবে। এয়ার মার্শাল আসগার ৫০ হাজার লােকের সমাবেশে ভুট্টোকে একেবারে সামনে থেকে সামলােচনা করে বলেন যে ইয়াহিয়া খান বােকার মতাে অনেকগুলাে পাপ করলেও তিনি ভুট্টোর হাতের পুতুল হয়ে গিয়েছিলেন। ভুট্টোই জেনারেল ইয়াহিয়া খানের চারপার্শ্বে নানা ধরনের সামরিক বেসামরিক লােকদেরকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় বসার পর থেকে তার পতন পর্যন্ত এই ভুট্টোই একদম তার কাছকাছি ছিলেন। ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতার প্রথম থেকে শুরু করে একদম শেষ পর্যন্ত ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।’ ভুট্টো কীভাবে যুদ্ধের সময় ইয়াহিয়া খানকে ভুল পথে পরিচালিত করেছেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন, ‘ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ১৯৭১ এর নভেম্বর মাসে বুঝিয়ে পিকিং এ গিয়েছিলেন। ফিরে এসে ইয়াহিয়া খানকে ভুট্টো বােঝালেন পাক ভারত সংঘর্ষে পিকিং পাকিস্তানের পাশে থেকে যুদ্ধে সহযােগিতা করবে।’
এই ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায় ‘৭১ এর নভেম্বরে লাহােরে ভুট্টোর এক জনসভায়। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধের কথা বলেছি। ইয়াহিয়ার উচিত যুদ্ধ করা কারণ এখন যুদ্ধের সময়। আমি তাকে বলেছি এখন যদি সে যুদ্ধ না করে তাহলে ঐতিহাসিকরা কিংবা পাকিস্তানের মানুষ কখনাে তাকে ক্ষমা করবে না। এখনি তার উচিত জাতির শত্রুদেরকে এমন শিক্ষা দেয়া যা তারা কখনাে ভুলবে না। যারা ভারতের সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে। তাদের জেনে রাখা দরকার এই যুদ্ধে আমাদের পাশে বিশ্বের শক্তিশালী সব। রাষ্ট্র দাঁড়াবে। আমি আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে চাই আমাদের সকল বন্ধুরা সম্ভাব্য সব পথে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত। ভুট্টোর এই সমস্ত কথা পাকিস্তানের শীর্ষ পত্রিকা মাশরিক অব লাহাের ও ভুট্টোর রাজনৈতিক দল পিপলস পার্টির মুখপত্র মুছাওয়াত বড় বড় শিরােনামে ছেপেছিল। ফলে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে যখন পাকিস্তানের পরাজয় নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে তখন পত্রিকাগুলাে এটা বলতে শুরু করল যে আমাদের উচিত হবে না। পাকিস্তানের পরাজয়ের পেছনে কেবল জেনারেল রানি ও অন্যান্য সুন্দরী মহিলাদেরকে দায়ী করা বরং এই পরাজয়ের পেছনে আরাে অনেক উর্ধ্বতন রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও দায়ী ছিলেন।’
লাহােরের সমাবেশে এয়ার মার্শাল আসগর খান আরাে বলেন, যুদ্ধের সময় চীন ভুট্টোকে বলেছিল যে তাদের পক্ষে পাকিস্তানকে সমরাস্ত্র বা সমরসঙ্গী হিসেবে সাহায্য করা সম্ভব নয়। এর মূল কারণ হলাে সিংকিয়াং এর কাছে রাশিয়ার সীমান্ত হুমকি। এই কথার পরেও ভুট্টো চাইছিলেন যেভাবেই হােক যুদ্ধটা চলুক। তিনি শুধু ইয়াহিয়া খানকে ভুল বােঝাননি একই সাথে তিনি পাকিস্তান আর চীনের মধ্যেও একটা ভুল বােঝাবুঝি তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয় ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে ফিরে এসে জানালেন যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন পূর্ব পাকিস্তানে তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে পাকিস্তানকে সহায়তা করবেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান এই কথা শুনে জেনারেল রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের পরামর্শটা বাতিল করে দিয়ে যুদ্ধের ঘােষণা দিলেন এবং প্রেসিডেন্ট হাউসে শ্যাম্পেন আর হুইস্কি দিয়ে তার উদযাপন করলেন। অথচ মূল কথা হলাে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর দিয়ে। যুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে চাইনি বরং ভারতের সাথে শান্তিপূর্ণ, যৌক্তিক ও সম্মানজনক আত্মসমর্পণ ও সমঝােতার বিষয়ে সাহায্য করতে চেয়েছিল। কিন্তু ভুট্টোর স্বার্থপর চিন্তা ভাবনার কারণে পাকিস্তানের জন্য এই সুযােগটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এয়ার মার্শাল আসগর খান চ্যালেঞ্জ করে বলেন যে তার এই কথায় যদি কোনাে ভুল থাকে তাহলে কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী ভুট্টো তাকে যে শাস্তি দেবেন তিনি মেনে নেবেন। এই লেখক লাহােরে এয়ার মার্শাল আসগর খানের সাথে মুখােমুখি হলে। আসগার খান তখনাে বলেন যে ভুট্টো যদি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ঠিকমত পরিচালনা করতে পারতেন তাহলে পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্নরকম হতাে।
আসগর ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন পূর্ব পাকিস্তানকে পৃথক করার পেছনে একটা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কাজ করেছিল। আসগর খান তার সাক্ষাৎকারে জোর দিয়ে বলেন যে ভারত যদিও মুক্তিবাহিনীকে যুদ্ধে সহায়তা করেছিল কিন্তু এর পরেও যুদ্ধ নিয়ে তারা যথেষ্ট ব্ৰিত ছিল। কারণ সােভিয়েত সমর্থন কতটুকু আসবে বা কীভাবে আসবে সে বিষয়ে তারা তখন পর্যন্ত পুরােপুরি নিশ্চিত হতে পারছিল না। এ ছাড়া নিজেদের দেশের অভ্যন্তরে শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান চাপে অর্থনীতির চাপের বিষয়টা নিয়েও তারা চিন্তা করছিল। ফলে সব কিছু ঠিক ঠাক রেখে কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়া যায় তার একটা রাস্তা ভারত খুঁজছিল। এই অবস্থায় ভারত চীন ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সমর্থনে আত্মসমর্পণের যে প্রস্তাব ইয়াহিয়া খানকে দেয়া হয়েছিল সেই প্রস্তাবটা গ্রহণ করাই ছিল ইয়াহিয়া খানের একমাত্র পথ। | এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করে তাকে অনুনয় করে বলেছিলেন যে তিনি যেন আপস করেন। আসগর খান আরাে দাবি করেন যে তিনি ইয়াহিয়া খানকে অনুরােধ করেছেন যেন শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দেয়া হয়, শুধু তাই নয় তিনি শেখ মুজিব আর ইয়াহিয়া খানের মধ্যে একটা মিটিঙের আয়ােজন প্রায় করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাদের এই কথার মাঝে হঠাৎ করে ভুট্টো এসে হাজির হন। ভুট্টো বলেন যে শেখ মুজিবের সাথে যে কোনাে ধরনের আপস হবে পাকিস্তানের আদর্শের বিরােধিতা করা ও পাকিস্তান জাতিসত্তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। একই সাথে এই আপসের মাধ্যমে পাকিস্তানের বন্ধু রাষ্ট্রগুলাের সাথেও বন্ধুত্ব নষ্ট হবে। ভুট্টো আরাে হুমকি দেন যে যদি শেখ মুজিবের সাথে আপস করা হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে যাবে। যেটা নিয়ন্ত্রণ করা কষ্ট হবে। এয়ার মার্শাল আসগর খানের কথার সমর্থনে আমি যখন ইসলামাবাদ গেলাম তখন এক পাকিস্তানি সাংবাদিক প্রসঙ্গক্রমে আমাকে বলেছিলেন যে হ্যা ১৯৭১ এর অক্টোবরের মাঝামাঝি একটা আশার আলাে দেখা গিয়েছিল।
পাকিস্তানি ও বিদেশি কিছু নেতৃবৃন্দ শান্তিপূর্ণ উপায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটা খসড়া তৈরি করেছিলেন। কয়েকজন পর্যবেক্ষকের মতে খসড়াটা ড. কিসিঞ্জার তৈরি করেছিলেন। তিনি সেই সময় পাকিস্তানে এসে আবার চীনে গিয়েছিলেন। খসড়া প্রস্তাবটা ড. কামাল হােসেনকেও দেখানাে হয়েছিল। তিনি এখন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সেই সময় তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বন্দী ছিলেন এবং একই সাথে তিনি আওয়ামী লীগের আইন ও সংবিধান বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন। সমঝোতা প্রস্তাবের খসড়াটি পাকিস্তানের খ্যাতিমান আইনজীবী এ. কে বারােহি সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সরকার শেখ মুজিবকে প্রতিহত করার জন্য নিয়ােগ দিয়েছিল। জনাব বারােহি ১৯৭২ এর জুন মাসে করাচির বহুল প্রচারিত আখবারে বারােহি পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে ‘৭১ এর সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ও পাকিস্তানি গভর্নমেন্টের মাঝে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সমঝােতা প্রায় হয়ে গিয়েছিল। তিনি আরাে বলেন যে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের মাঝে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দারুণ একটা সুযােগ তৈরি হলাে। তিনি সব সময় বলেছেন তার দেশের মানুষের প্রতি যেন ন্যায়বিচার করা হয়। তিনি বলেছেন তাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিশ্বস্ত প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নেওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তার আলােচনা হতে পারে। বারােহি আরাে বলেন যে সব কিছুই ঠিকঠাক মতাে চলছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সম্মত হয়েছিলেন কিন্তু হঠাৎ করেই সরকারের অভ্যন্তরের কিছু নেতৃবৃন্দ ও বাইরের কিছু পরামর্শে সব কিছু তালগােল পেকে গেল। জনাব বারােহি দৃঢ়তার সাথেই বলেন যে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের কিছু উর্ধ্বতন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ভুল পথে পরিচালিত করেছিলেন। তারা যদি ভুল আর দুর্ভাগ্যজনক উপদেশ ইয়াহিয়া খানকে না দিতেন তাহলে পাকিস্তান আজ দুভাগে বিভক্ত হতাে না। এই লেখক ১৯৭১ এর সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যখন প্রধানমন্ত্রীর সাংবাদিক বহরের সাথে মস্কো গিয়েছিলেন সেখানেও তিনি শুনতে পেয়েছিলেন যে খুব শিগগির শেখ মুজিবুর রহমান ও জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে একটা সমঝােতা হতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয় একজন সােভিয়েত সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন যে সমঝােতার খসড়া প্রস্তাবটি এই মুহূর্তে সােপভয়েত, ওয়াশিংটন, ইসলামাবাদ ও দিল্লিতে আলােচনাধীন অবস্থায় আছে।
শুধু তাই না ১৯৭১ এর অক্টোবরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যমেও এটা নিয়ে নানা ধরনের আলােচনা হয়েছিল। এয়ার মার্শাল আসগর খানের মতে এই সমঝােতা প্রস্তাব নষ্ট করে দেয়ার জন্য জনাব ভুট্টো এককভাবে দায়ী ছিলেন। তার মতে এতে করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দুর্বল ও আদর্শগতভাবে বিনষ্ট প্রমাণিত হবে। একটা পাকিস্তানি সাপ্তাহিক জিন্দেগির মতে ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে চীন ও আমেরিকার সহায়তার বিষয়ে কেবল ভুল তথ্যই দেননি বরং একই সাথে ডিসেম্বরের ১৩ তারিখ ভুট্টো সরাসরি প্রেসিডেন্টকে ফোন করে। জানালেন যে ১৫ তারিখের মধ্যে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের সাহায্য চলে আসবে চিটাগাং রেঞ্জ দিয়ে আক্রমণ করতে। ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপেক্ষা করতে পারলে যুদ্ধের একটা যৌক্তিক ফলাফল পাওয়া যাবে। এই তথ্য পাওয়ার পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান পরবর্তী আরাে ৪৮ ঘণ্টা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ঘােষণা দেন এবং একই সাথে জেনারেল রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের পরামর্শ বাতিল করে দেন। | অবশ্য দ্য জিন্দেগি নামের একটি পত্রিকা এই দাবির সম্পূর্ণ বিপরীত একটি রিপাের্ট প্রকাশ করে। তাদের মতে ইয়াহিয়া খান জেনারেল রাও ফরমান আলীর প্রস্তাব বাতিল করে দিয়েছিলেন কারণ তখন তিনি নারী আর মদ নিয়ে এতটাই মাতাল ছিলেন যে এই প্রস্তাব নিয়ে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার মতাে ক্ষমতা তার ছিল না।
আবার কিছু কিছু পত্রিকা জনাব ভুট্টোর বিরুদ্ধে ভুল পরামর্শ দেয়ার যে অভিযােগ উঠেছিল তার বিরােধিতা করেছে। | দ্য পাকিস্তান টাইমস নামের একটি পত্রিকা বলে যে জনাব ভুট্টো তার পরামর্শ দেয়ার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ রকম স্বচ্ছ আর সৎ ছিলেন। সেই পরিস্থিতিতে তিনি যতটুকু সংবাদ পেয়েছিলেন তার সবটুকুই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছিলেন। পিকিং এবং ওয়াশিংটন তাকে যা জানিয়েছিল তিনি সেটাই ইয়াহিয়া খানকে বলেছিলেন। | এই রকম আরাে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে লেফটেনেন্ট জেনারেল রাও ফরমান আলীর বাসায় এমন কিছু কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছিল যা থেকে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে সুপার পাওয়াররা পাকিস্তানের আত্মসমর্পণটা দেরিতে হােক এটা চাইছিলেন। ১৯৭২-এর প্রথম দিকে কয়েকটা আমেরিকান সংবাদপত্র রিপাের্ট প্রকাশ করে যে ঢাকায় ইউ এস কনসুলেট জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণের বিষয়টা আরাে বিশ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন। | আরাে অভিযােগ করা হয় যে এই সময় আমেরিকার সি আই এ এজেন্ট ঢাকায় তখন আরাে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ করতে চাইছিল। তাদেরকে সহায়তা। করছিল দুটো ভয়ংকর সংগঠন আল বদর ও আল শামস। ঢাকায় ইউ এস কনসুলেট তখন সি আই এর হাতের পুতুল হয়ে কাজ করছিল। সি আই এ এবং অন্য দুটি সংগঠন আল বদর ও আল শামসের নেতৃত্বে ঢাকার শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয় এই সময়। একই সাথে আরাে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে ঢাকার কাছে। মােহাম্মদপুরে স্বাধীনতার যুদ্ধের পর তাদের গণকবর আবিষ্কার করা হয়। ঘটনা যাই হােক এই সমস্ত রিপাের্ট অনুযায়ী সত্য কথা হলাে অধিকাংশ শিক্ষিত পাকিস্তানির মতে বিশেষ করে সেনা অফিসারদের মতে ভারতের শর্ত অনুযায়ী যদি পাকিস্তান আরাে আগেই আত্মসমর্পণ করত তাহলে পাকিস্তানি সৈন্য ও সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কম হতাে। তবে সাধারণ মত হলাে এই সমস্ত ঘটনার জন্য ইয়াহিয়া খানকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়। কারণ তিনি সেই সময় জেনারেল রাও ফরমান আলীর আত্মসমর্পণের পরামর্শটুকু গ্রহণ করেননি। এমনকি রাও ফরমান আলীকে। সমর্থন জানিয়ে জেনারেল নিয়াজির অনুরােধও ইয়াহিয়া খান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবে এত প্রমাণাদি থাকার পরেও এবং ইয়াহিয়া খানের চারিত্রিক অবনতি ও পদস্খলনের পরেও জেনারেল ইয়াহিয়া খান সকল স্বৈরশাসকদের উপর তার শেষ হাসিটুকু হাসার সুযােগ হয়তাে পাবেন।
সূত্র : প্রাইভেট লাইফ অফ ইয়াহিয়া খান – দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ