ইয়াহিয়া খানের সাক্ষ্য
ইয়াহিয়া খানের ভূত দীর্ঘদিন পাকিস্তানে আস্তানা গেড়েছিলেন। সেটা ক্ষমতায় হােক কিংবা কারাগারে। দীর্ঘদিন ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের দৃশ্যপটে একটা অপরিহার্য চরিত্র ছিল। ক্ষমতা হারানাের দুই বছর পরেও ইয়াহিয়া খান ছিলেন। সকলের মুখে মুখে। সংবাদ মাধ্যম ইয়াহিয়া খানের প্রতিটি বিষয় খুঁটিনাটি যাই। পেত লিখে ফেলত। কারাগারে তার ব্যক্তিগত জীবনের ছােট একটা ঘটনার সন্ধান পেলেও সেটা বিস্তারিতভাবে গুরুত্বের সাথে লিখত। ইয়াহিয়া খানের ভবিষ্যৎ পরিণতির সাথে পাকিস্তানের রাজনীতির ভবিষ্যৎ জড়িত ছিল। একই সাথে ভুট্টো তার জনগণকে কীভাবে মােকাবেলা করবেন সেটারও যােগসূত্র ছিল ইয়াহিয়া খানের সাথে। জনতার আদালতে ইয়াহিয়া খানের বিচারের একটা শক্ত দাবি থাকার পরেও জনাব ভুট্টো বিষয়টাকে দূরদর্শিতার সাথে আর শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম ও রাজনৈতিক মহল এটাও ভাবতে শুরু করেছিল পাকিস্তানের পরাজয়ে জনাব ভুট্টোর অবদান কতটুকু ছিল। জল্পনা কল্পনা কেবল রাজনৈতিক কৌতূহলের সাথে সম্পর্কিত ছিল না বরং এটা ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবনের সাথেও সম্পর্কিত ছিল। ভুট্টো ভেবেছিলেন জনতার আদালতে বিচার হলে যেই গুজব আর জল্পনা কল্পনা ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে রাজনৈতিক মহল আর সংবাদ মাধ্যম তুলেছিল সেটাকে কিছু হলেও দূর করা যাবে। রাজনৈতিক নাটকীয় মুহূর্ত পট পরিবর্তন এর পরিণতি সব কিছু বিবেচনা করে জনাব ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের বিপর্যয়ে ও এর পরাজয়ের মূলে কী কারণ ছিল সেটা তিনি উদঘাটন করবেন। সে জন্য তিনি একটা উচ্চ স্তরের কমিশন গঠন করেছিলেন। একই সাথে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এই কমিশনের কোনাে রিপাের্ট তিনি জনগণের সামনে প্রকাশ করবেন না।
বরং এটাকে গােপন রাখবেন। পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি জনাব হামিদুর রহমান এই কমিশনের প্রধান হিসেবে কাজ করছিলেন। পাকিস্তানের সর্বশেষ যুদ্ধের সাথে জড়িত অসংখ্য লােকজনকে তিনি কমিশনের সামনে উপস্থিত করেছিলেন। অনেক জেনারেল, রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি কমিশনের কাছে তাদের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান ও তার আশপাশের খুব কাছের কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা কমিশনের সামনে নিজেদের বিবৃতি ও সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। জেনারেল রাও ফরমান আলী ও জেনারেল নিয়াজি তখন ভারতের কাছে বন্দী। ভারত সরকার বিশেষ বিবেচনায় রাজনৈতিক পথে তাদেরকে নিজ নিজ রিপাের্ট কমিশনের কাছে উপস্থিত করার সুযোেগ দিয়েছিল। কমিশনের এই পুরাে কাজটা পাকিস্তানি সরকার অত্যন্ত গােপনীয়তার সাথে করছিল। তারপরেও কমিশনের কিছু রিপাের্ট জনগণের কাছে চলে আসল। কমিশনের সবচেয়ে বড় নির্দেশনা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার উচ্চপদস্থ জেনারেলদের কোর্ট মার্শালে বিচার করা। কমিশনকে এটাও বলা হলাে যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান সার্বিক পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনা করে নিজের পেশাগত দক্ষতা প্রদর্শন করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিলেন। একই সাথে ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ জেনারেল আব্দুল হামিদ পরিস্থিতিকে খুব বাজেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন।
সাবেক বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল রহিম পাকিস্তানের বিমান। বাহিনীকে সর্বশেষ যুদ্ধে বলতে গেলে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছিলেন। একই সাথে কমিশনকে জানানাে হলাে যে ন্যায়বিচারের স্বার্থে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের দণ্ড দেয়া উচিত। কমিশন জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সহযােগী কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেনাকর্মকর্তার বিচারের জন্য উচ্চতর শক্তিশালী ট্রাইবুনাল গঠনের নির্দেশনা দিল। জনাব ভুট্টো কমিশনের একের পর এক নির্দেশনা এড়িয়ে যাচ্ছিলেন। তবে এর মধ্যেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান নিজেই ভুট্টোর কাছে তাকে বিচার করে দণ্ড দেয়া কিংবা মুক্তির জন্য বার বার চিঠি লিখে ছিলেন। ১৯৭৩ এর অক্টোবরে তিনি ভুট্টোর কাছে সর্বশেষ চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি ভুট্টোর। কাছে অনুরােধ করেন পবিত্র রমজান মাসের জন্য তাকে যেন মুক্তি দেয়া হয়। ইয়াহিয়া খানকে যখন কারাগারে আনা হয়েছিল তখন তাকে বলা হয়েছিল যে এটা শুধু মাত্র তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য করা হয়েছে তবে সাবেক পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারছিলেন যে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষীবলয়ে তার ভয় নেই এবং তাকে স্বাধীনভাবে চলতে দেয়া উচিত পাকিস্তানের নাবা এ ওয়াক্ত উল্লেখ করে যে ইয়াহিয়া খানকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল তিনি যদি নিজের মুখ বন্ধ রাখতে পারেন তাহলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে। যেভাবে প্রেসিডেন্ট হয়ে তিনি রাষ্ট্রের গােপন তথ্য প্রকাশ না করতে শপথ নিয়েছিলেন সেভাবে তাকে চুপ থাকতে হবে। তবে জনাব ভুট্টো তাকে মুক্ত করতে চাইছিলেন না।
এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে যখন ইয়াহিয়া খানকে গ্রেফতার করা হয় তখন ঘােষণা করা হয়েছিল ডিসেম্বরের পরাজয়ের পেছনে কারা কারা দায়ী ছিল তাদেরকে বের করা হবে এবং জনতার আদালতে প্রকাশ্যে তাদের বিচারের মুখােমুখি করা হবে। পরে বিচার দণ্ডের এই পরিকল্পনা সরিয়ে রাখা হয়। পুরাে বিষয়টাকে অনুসন্ধানের জন্য একটা কমিশন গঠন করা হয় পরবর্তীতে কমিশন যখন অনুসন্ধান করে বিচার দণ্ডের সুপারিশ করল তখন এই বিষয়ে জনাব ভুট্টোর নীরবতা আবার সবাইকে কৌতূহলী করে তুলল পাকিস্তান জুড়ে অনুসন্ধান করে কমিশন কী তথ্য পেল সেটা প্রকাশের তীব্র দাবি থাকা সত্ত্বেও ভুট্টো কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন এটাও বড় একটা রহস্য হয়ে থাকল। ভুট্টো কেন কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশ করতে অনীহা জানাচ্ছিলেন সে বিষয়ে তেহরিকে ইসতিকলাল দলের প্রধান নেতা এয়ার মার্শাল আসগর খান বলেন যে ডিসেম্বরের যুদ্ধের সাথে ভুট্টোর অজানা কোনাে আতংক জড়িয়ে ছিল। কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশিত হলে যুদ্ধে পরাজয়ের সাথে ভুট্টোর কোনাে হাত থাকতে পারে সেটা প্রকাশ হওয়ার ভয়ে ভুট্টো কমিশনের রিপাের্ট প্রকাশ করতে নিষেধ করছিলেন। ইয়াহিয়া খানের নিজের বলার মতাে গল্প ছিল। ইয়াহিয়া খানের সাক্ষ্যসহ বিচারপতি হামিদুর রহমানের কমিশনের কিছুই তখনাে প্রকাশ করা হয়নি, তারপরেও ইয়াহিয়া খান কমিশনে যা বলেছিলেন তার বিশাল একটা অংশ সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৭২ এর মে মাসে প্রেস এশিয়া ইন্টারন্যাশনালের লন্ডন ভিত্তিক পাকিস্তানি সাংবাদিক আহমেদ মালিক বিচারপতি হামিদুর রহমানের কমিশনে ইয়াহিয়া খান কী বলেছিলেন তা নিয়ে দারুণ উত্তেজনাপূর্ণ রিপাের্ট প্রকাশ করে এই রিপাের্টটি একই সাথে ইন্ডিয়াসহ দ্য নিউজ উইক, বিবিসি এবং ফার ইস্টার্ন ইকোনােমিক রিভিউ এর মতাে পত্রিকায় একের পর এক প্রকাশিত হয়।
ভারত পাকিস্তানের শিমলা চুক্তির সময় শিমলাতে আমি অনেক পাকিস্তানি সাংবাদিকদেরকে ইয়াহিয়া খানের সাক্ষ্যের বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে শুনেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে শিমলা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য মাদারল্যান্ড, নিউ দিল্লি নিউজ পেপারে ইয়াহিয়া খানের সাক্ষ্যের বিষয়গুলাে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়। পত্রিকার এই ধরনের রিপাের্টে পাকিস্তানি আমন্ত্রিত অতিথি ও রাজনীতিবিদরা বেশ ব্রিত হয়ে পড়লেন। রিপাের্টগুলাের মাঝে কিছু বৈষাদৃশ্য নিয়ে আমি যখন আলােচনা তুললাম তখন আমাকে বলা হলাে জনাব ভুট্টো এই ধরনের সংশয়পূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে চাচ্ছেন যেন এর সমাপ্তি হয়। পরিস্থিতির একটু উন্নতি হলে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছায় বিষয়টা আস্তে আস্তে ধামা চাপা পড়ে যায়।
ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত ইমেজ তত ভালাে ছিল না এবং নিঃসন্দেহে ডিসেম্বরের যুদ্ধে ইয়াহিয়া খানের দুর্বলতার কারণেই পাকিস্তানের উপর দুর্যোগ নেমে এসেছিল। এখন আমরা পরীক্ষা করে দেখব ইয়াহিয়া খান এই যুদ্ধের পরাজয়ের বিষয়ে বিচারপতি হামিদুর রহমানের কমিশনে কী বলেছিল। | পাকিস্তানি ডিপ্লোমেটিক জোনের সূত্র অনুযায়ী পি এ আই পাকিস্তানি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব আহমেদ মালিক উল্লেখ করেন যে ইয়াহিয়া খান দুবার কমিশনের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি প্রায় সাত ঘণ্টা কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে সাক্ষ্য দেয়ার সময় ইয়াহিয়া খান যথেষ্ট পরিমাণ সতর্ক ছিলেন এবং ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন। তিনি শুরু করেছিলেন এটা বলে যে তাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে তবে তিনি কমিশনকে সর্বোচ্চ সহায়তা করবেন। পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য এবং সত্য উদঘাটনের জন্য তিনি সবরকমের সাহায্য করতে প্রস্তুত। ইয়াহিয়া খান যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তা কমিশনের অন্য সদস্যরা একে অপরে পাল্টাপাল্টি করে পরীক্ষা করে দেখেছিলেন। কমিশনের ভাষায় যাকে বলে ক্রস চেক। ইয়াহিয়া খানের সাক্ষ্য কমিশনের কাছে প্রায় পঞ্চাশ পৃষ্ঠার রিপাের্ট আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ইয়াহিয়া খানের সাক্ষ্যের মূল বিষয়গুলাের সারমর্ম ছিল এইরকম: ইয়াহিয়া খান তার সাক্ষ্য শুরু করেন এটা বলে যে তিনি কখনাে তার। ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। ১৯৬৯ সনে তার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় যখন ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের ক্ষমতায় পাকিস্তানে বিশৃঙ্খলা চলছিল। তিনি কোনাে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। বরং জনতার উদ্বেগ ও নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাদের সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় বসেছিলেন। একদিকে আইয়ুব খান তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন অন্যদিকে সমস্ত রাজনীতিবিদরা তাকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন। তার শাসনামলের শেষের দিকে পাকিস্তানের ইতিহাসে যে মর্মাদ ঘটনা ঘটল তার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে এটাকে কোনাে পৃথক বিষয় হিসেবে না দেখে বরং এটা নিয়ে আরাে বিস্তর গবেষণার প্রয়ােজন। পাশাপাশি তিনি এটাও উল্লেখ করেন যে তিনি হলেন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি পাকিস্তানে কোনাে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়ােজন করেছিলেন। তার কট্টর সমালােচকরাও এটা স্বীকার করবেন যে তিনি পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপগুলাে নিয়েছিলেন।
তিনি আরাে বলেন যে তিনিই সর্বপ্রথম বাঙালিদের চাহিদা মেনে নিয়েছিলেন এবং জনগণের সংখ্যার ভিত্তিতে তিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টে আসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি বলেন যে তিনিই সেই ব্যক্তি যে কিনা পাকিস্তানের বিরােধীদের চাহিদা মেনে নিয়েছিলেন এবং চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর শাসনামলে যে এক ইউনিট প্রচলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেটা তিনি রদ করেছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানে চারটা প্রদেশে ফেডারেল অটোনােমি প্রতিষ্ঠা করা উচিত। ইয়াহিয়া খান আরাে উল্লেখ করেন যে ১৯৭১ এর মার্চ মাসে তার উদ্যোগে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির আয়ােজন করা হয়। কারণ তিনি ভেবেছিলেন। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের আসন্ন রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা বন্ধ করা যাবে এবং শান্তির সাথে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে। কিন্তু এই উদ্যোগ নেয়ার পর বিভিন্ন উৎস থেকে আমাকে সতর্ক করা হলাে এমনকি জনাব ভুট্টো আমাকে বললেন যে এভাবে শেখ মুজিবকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তার পথে চলতে দিলে সেটা খুব ভয়াবহ হবে পাকিস্তানের জন্য ।
ইতােমধ্যে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযোেগ এসেছিল যে তিনি ভারত ও পাকিস্তানের অন্যান্য শক্রদের সাথে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ঐক্য বিনষ্ট করার জন্য ষড়যন্ত্র করছেন। তারপরেও ইয়াহিয়া খান আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলােচনায় বসে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারবেন। কিন্তু এই সময় পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো তাকে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সম্পূর্ণভাবে বয়কট করার হুমকি দিয়েছিলেন। ১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারি মাসে লাহােরের এক সম্মেলনে ভুট্টো ঘােষণা দিলেন যে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির কোনাে সদস্য যদি ঢাকার অ্যাসেম্বলি সেশনে অংশ গ্রহণ করতে যায় তাহলে আমরা তাদের হাত পা ভেঙে দেব।’ | শুধু তাই না ইয়াহিয়া খান আরাে অভিযােগ করেন যে যদি তিনি ঢাকায় ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির আয়ােজন করেন তাহলে ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে ভয়াবহ বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেবেন। | ইয়াহিয়ার মতে এটা ছিল একের পর এক ভয়াবহ পরিণতি তৈরি করার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভুট্টোর এই পদক্ষেপের কারণে পাকিস্তানে ধারাবাহিক বিপর্যয়ের শুরু হয়েছিল। যা পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। ইয়াহিয়া খান আরেকটা অভিযােগ করেছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের মিলিটারি গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের বিরুদ্ধে। তিনি অভিযােগ করেন যে টিক্কা খান গােপনে ভুট্টোর সাথে হাত মিলিয়ে কিছু পদক্ষেপ নেন যা তার। বিরুদ্ধে গিয়েছিল। প্রমাণস্বরূপ ইয়াহিয়া খান বলেন যে টিক্কা খান তাকে। কখনাে পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে গােয়েন্দা রিপাের্টগুলাে পরিপূর্ণভাবে পাঠাননি। উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন যে টিক্কা খান তাকে বলেছিল যে পূর্ব পাকিস্তানের সব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এবং সেখানে কোনাে বিশৃঙ্খলা নেই। পরিবেশ শান্ত। আমি আন অফিসিয়ালি সংবাদটা ভুট্টোকে জানিয়েছিলাম। অথচ আমার কাছে অন্যান্য উৎস থেকে যে খবর এসেছিল তাতে করে বােঝা যাচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা তখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ইয়াহিয়া খান আরাে অভিযােগ করেন যে জেনারেল গুল হাসান ও এয়ার মার্শাল রহিম গােপনে আমার বিরুদ্ধে ভুট্টোর সাথে ষড়যন্ত্র করছিলেন যাতে করে আমি পূর্ব পাকিস্তানের গােলযােগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি ।
তিনি আরাে বলেন যে এই ষড়যন্ত্রের পুরস্কার স্বরূপ ভুট্টো ক্ষমতা দখলের পর জেনারেল গুল হাসানকে চিফ অব আর্মি স্টাফ পদে বহাল করেন এবং এয়ার মার্শাল রহিমকে এয়ার চিফ হিসেবে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে বলেন। শুধু তাই নয় চিফ অব এয়ারকে বলা হয় তিনি ইয়াহিয়া খান যদি পিছু না হটে। তাহলে প্রেসিডেন্ট হাউসে বােম্বিং করা হবে- এই মর্মে যেন হুমকি দেন। ফলে পরবর্তীতে জনাব ভুট্টো ক্ষমতায় বসার পর তার নতুন প্রশাসনে এই দুজনকে প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী যার যার আসনে কাজ চালিয়ে যেতে বলেন। ইয়াহিয়া খান তার সাক্ষ্যে আরাে বলেন যে শুধু তাই নয় এই ধারাবাহিকতায় জনাব ভুট্টো ক্ষমতা গ্রহণের পর তার চরিত্রে কালিমা লেপনের সর্বাত্মক চেষ্টা চালান। তাকে নারী লােভী, যৌনদানব, মাতাল সেনাঅফিসার হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। তিনি এই সবের তীব্র নিন্দা ও বিরােধিতা করছেন। | ইয়াহিয়া খান কমিশনের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে বলেন যে বর্তমান শাসক গােষ্ঠী তার চেয়ে ভালাে কিছু নয়। এদের অনেক গােপন কর্মকাণ্ড কমিশন এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছে। | ইয়াহিয়া খানের এই সমস্ত সাক্ষ্যের জন্য পরিস্থিতি এতটাই ঘােলা হয়ে যায় যে ১৯৭১ এ আসলে পাকিস্তানের দুর্ভোগের পেছনে কী ছিল সেটা বের করা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছিল।
ইয়াহিয়া খান কমিশনকে বেশ দৃঢ়তার সাথেই অনুরােধ করেন যে তার চরিত্র ও ব্যক্তিগত বিষয়ে যে সমস্ত গল্পগুজব ছড়ানাে হচ্ছে সেগুলাে যেন দ্রুততার সাথে বন্ধ করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীর মতে ইয়াহিয়া খান কমিশনের কাছে আবেদন করেন যে কমিশন যেন কিছু পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়। এর মধ্যেছিল তার চরিত্রহরণের জন্য কিছু ভিত্তিহীন গল্প প্রচারের অভিযােগে পিপলস পার্টির মুখপত্র মুছাওয়াত পত্রিকাটির বিরুদ্ধে যেন কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়। ইয়াহিয়া খান নিজেও জানতেন তার চরিত্রের অবস্থা আশানুরূপ ছিল না। কারণ ক্ষমতার শেষ বছরটিতে তিনি যৌনতা আর মদের জন্য প্রায় উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খান নিজের সাক্ষ্যে আরাে বলেন যে তিনি শুধু মাত্র রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরই শিকার নন বরং একজন পাঠান হওয়ায় তিনি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের ষড়যন্ত্রের শিকার। তিনি আরাে বলেন যে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে কিছু সূত্র তাকে এই তথ্য দিয়েছিল যে ক্ষমতাবান পাঞ্জাবরা তাকে রিজিওনাল ও সেক্টর গ্রাউন্ড থেকে সরানাের ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু তিনি এই সব তথ্যের বিরুদ্ধে তেমন জোরদার কোনাে পদক্ষেপ নেননি। কারণ তিনি নিজেও দীর্ঘদিন ক্ষমতা হস্তগত করে রাখতে চাইছিলেন না। সবচেয়ে গুরুতর যে অভিযোেগ ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোর বিরুদ্ধে করেছিলেন যে ভুট্টো তাকে পররাষ্ট্র বিষয়ে অন্ধকারে রেখেছিলেন। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পাকিস্তানের পক্ষে চীন ও আমেরিকার ভূমিকা কী হবে এই বিষয়ে ভুট্টো তাকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেন যে ভুট্টো সেই সময় চীনে গিয়েছিলেন। চীন থেকে ফিরে এসে তিনি রিপাের্ট দিলেন যদি দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায় তাহলে চীন সরাসরি তার বাহিনী নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকে যাবে। এই হিসেব নিকেশ করে পূর্ব পাকিস্তানের বাহিনীর উপর শক্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। অন্য দিকে জনাব ভুট্টো আমেরিকা থেকেও এই নিশ্চয়তা এনেছিলেন যে নিউইয়র্ক তার সপ্তম নৌবহর খুব শিগগির পাকিস্তানের জলসীমানায় পাঠিয়ে দেবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান আরাে বলেন যে ডিসেম্বরের ৯ তারিখ ভারত পাকিস্তানকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যদি স্বেচ্ছায় ঢাকা ছেড়ে চলে যায় তাহলে ভারতীয় বাহিনী তাদের উপর কোনাে অবরােধ করবে না এবং যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদেরকে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাবে। কিন্তু ভুট্টোর বাধার মুখে এই প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দিতে হয়েছিল। কারণ ভুট্টো বলছিলেন ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ তাদের কাছে চীন ও আমেরিকার কাছ থেকে বড় আকারে সাহায্য আসছে। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ ভুট্টো জরুরি খবর পাঠালেন যে পাকিস্তান যেন একটু অপেক্ষা করে কারণ আমেরিকা তাদের সাহায্য পাঠিয়ে দিচ্ছে। ইয়াহিয়া খান অভিযােগ করেন যে ভুট্টো শুধু মাত্র নিজের ক্ষমতার পথকে পরিষ্কার করার জন্য এই ধরনের ভুয়া খবর পাঠিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্মান ও ক্ষমতাকে খর্ব করেছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যুদ্ধ পরিকল্পনায় কোনাে ভুল ছিল না। তিনি জানতেন যে বড় কোনাে ধরনের সাহায্য না আসলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দিয়ে এই যুদ্ধ জেতা সম্ভব ছিল না। এই জন্য তিনি নিজেদের এয়ার ফোর্সকে ব্যবহার করে শক্তিক্ষয় করতে চাননি। কারণ তাকে বােঝানাে হয়েছিল ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে।
আমেরিকার সপ্তম নৌবহর তার বিমান বাহিনী নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঝাপিয়ে পড়বে। যাই হােক জেনারেল ইয়াহিয়া খান নানা ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে তার যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে সঠিক ছিল। শুধুমাত্র রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের কারণে পাকিস্তান তার আশানুরূপ ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়েছে। এবােতাবাদ কারাগারে থাকাকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান মদ। খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। তবে অনেকে বলে যে প্রাদেশিক গভর্নমেন্ট সেই অঞ্চলে মদ নিষিদ্ধ করেছে। আরাে বলা হয় যে এই সময়টাতে তিনি তার নেতৃত্বে সর্বশেষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও নিজের জীবন নিয়ে একটা বই লেখার কাজ করছেন। তবে সকলের ধারণা জনাব ভুট্টো ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তার এই বই কখনাে প্রকাশিত হবে না। এই সময়টাতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে তা নিয়ে প্রায় প্রতিদিন নানা রকম পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদ ছাপা হতাে। ১৯৭৩ এর জুলাই সংখ্যায় লাহােরের মাশরিক পত্রিকায় সংবাদ বের হয় যে ইয়াহিয়া খানের ক্ষুধা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি বলে যে ইয়াহিয়া খান তার প্রতিদিনের রেশনে আড়াই কেজি গরুর মাংসের কাবাব আর এক বােতল স্কচ বরাদ্দ করতেন। ইতােপূর্বে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পান করতেন বেশি খেতেন কম। তাকে পরামর্শ দেয়া হলাে তার খাবার আর পানীয় যেন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শুধু তাই ডাক্তার তাকে। বলেছেন তার কিডনির অবস্থা খুব খারাপ। পানীয় তাকে বন্ধ করে দিতে হবে। কারাগারে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি জনাব ভুট্টোর সহনশীল আচরণের কারণে কিছু পত্রিকা তীব্রভাবে ভুট্টোর সমালােচনা করল। লাহােরের নাবাএ ওয়াক্ত উল্লেখ করে কিছু দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তাকে ক্ষুদ্র বিষয়ে বন্দী করে তাদেরকে কারাগারে নির্মমভাবে রাখা হয়েছে সেখানে ইয়াহিয়া খানকে ভিআইপি মর্যাদায় আরাম আয়েশে বিশ্রামের সুযােগ দেয়া হয়েছে। এই রিপাের্টগুলাে প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাস পর পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম ভিন্ন ধরনের আরেকটা সংবাদ প্রকাশ করল। তারা উল্লেখ করল যে ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিজীবনে দারুণ পরিবর্তন হয়েছে। পিপলস পার্টির মুখপত্র মুছাওয়াত পত্রিকা ১৯৭৩ এর নভেম্বরে একটা সংবাদ প্রকাশ করে। তারা বলে যে সাবেক প্রেসিডেন্ট মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার জীবনে প্রথমবারের মতাে তিনি রােজা রাখছেন।
আমেরিকার সপ্তম নৌবহর তার বিমান বাহিনী নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ঝাপিয়ে পড়বে। যাই হােক জেনারেল ইয়াহিয়া খান নানা ধরনের যুক্তিতর্ক দিয়ে বুঝিয়েছিলেন যে তার যুদ্ধ পরিকল্পনা সম্পূর্ণভাবে সঠিক ছিল। শুধুমাত্র রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের কারণে পাকিস্তান তার আশানুরূপ ফলাফল পেতে ব্যর্থ হয়েছে। এবােতাবাদ কারাগারে থাকাকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান মদ। খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। তবে অনেকে বলে যে প্রাদেশিক গভর্নমেন্ট সেই অঞ্চলে মদ নিষিদ্ধ করেছে। আরাে বলা হয় যে এই সময়টাতে তিনি তার নেতৃত্বে সর্বশেষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও নিজের জীবন নিয়ে একটা বই লেখার কাজ করছেন। তবে সকলের ধারণা জনাব ভুট্টো ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তার এই বই কখনাে প্রকাশিত হবে না। এই সময়টাতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত জীবন ও স্বাস্থ্য কেমন যাচ্ছে তা নিয়ে প্রায় প্রতিদিন নানা রকম পত্রিকার প্রথম পাতায় সংবাদ ছাপা হতাে। ১৯৭৩ এর জুলাই সংখ্যায় লাহােরের মাশরিক পত্রিকায় সংবাদ বের হয় যে ইয়াহিয়া খানের ক্ষুধা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রিকাটি বলে যে ইয়াহিয়া খান তার প্রতিদিনের রেশনে আড়াই কেজি গরুর মাংসের কাবাব আর এক বােতল স্কচ বরাদ্দ করতেন। ইতােপূর্বে। জেনারেল ইয়াহিয়া খান পান করতেন বেশি খেতেন কম। তাকে পরামর্শ দেয়া হলাে তার খাবার আর পানীয় যেন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। শুধু তাই ডাক্তার তাকে। বলেছেন তার কিডনির অবস্থা খুব খারাপ। পানীয় তাকে বন্ধ করে দিতে হবে। কারাগারে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রতি জনাব ভুট্টোর সহনশীল আচরণের কারণে কিছু পত্রিকা তীব্রভাবে ভুট্টোর সমালােচনা করল। লাহােরের নাবাএ ওয়াক্ত উল্লেখ করে কিছু দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তাকে ক্ষুদ্র বিষয়ে বন্দী করে তাদেরকে কারাগারে নির্মমভাবে রাখা হয়েছে সেখানে ইয়াহিয়া খানকে ভিআইপি মর্যাদায় আরাম আয়েশে বিশ্রামের সুযােগ দেয়া হয়েছে। এই রিপাের্টগুলাে প্রকাশিত হওয়ার কয়েক মাস পর পাকিস্তানি সংবাদ মাধ্যম ভিন্ন ধরনের আরেকটা সংবাদ প্রকাশ করল। তারা উল্লেখ করল যে ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিজীবনে দারুণ পরিবর্তন হয়েছে। পিপলস পার্টির মুখপত্র মুছাওয়াত পত্রিকা ১৯৭৩ এর নভেম্বরে একটা সংবাদ প্রকাশ করে। তারা বলে যে সাবেক প্রেসিডেন্ট মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন এবং তার জীবনে প্রথমবারের মতাে তিনি রােজা রাখছেন।
পরবর্তীতে আরাে কয়েকটা রিপাের্টে বলা হয় যে ইয়াহিয়া খান তার পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ উৎসব পালন করেছেন এবং তিনি সম্পূর্ণ রকম ধার্মিক মানুষে পাল্টে গেছেন। এর কয়েকমাস আগে পত্রিকাগুলাে রিপাের্ট পেশ করে যে এবােতাবাদে অত্যন্ত কড়া নিরাপত্তায় জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে একটি বাংলােতে বন্দী রাখা হয়েছে। সেখানে তার পরিবারের সদস্যদেরকে তার সাথে থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে। বেগম ইয়াহিয়া তার সাথে আছেন। তিনি নিজ হাতে খাবার তৈরি করে দিচ্ছেন। সেহরির সময় তাকে জাগিয়ে তুলছেন। বেগম ইয়াহিয়া তার স্বামীর সব ভুল ক্ষমা করে দিয়েছেন। | ইয়াহিয়া খানের পারিবারিক এক ঘনিষ্ঠ সূত্র বলে যে রােজার কারণে ইয়াহিয়া খানের স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে। তাকে এখন বেশ স্বাস্থ্যবান মনে হয়। গত তিনবছরে তার স্বাস্থ্যের এত উন্নতি হয়নি। তার ছেলে আলী ইয়াহিয়া যে কিনা বাবার সাথে কালাে সুন্দরীকে নিয়ে ঝগড়া করেছিল সেও বাবার সাথে সব কিছু মিটমাট করে একসাথে বসবাস করছে। প্রথম প্রথম আলী ইয়াহিয়া বাবার জন্য হাল্কা পরিমাণে হুইস্কির জোগান দিত। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আলী ভুট্টো নির্দিষ্ট পরিমাণ হুইস্কি ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠাত। কারণ হঠাৎ করে হুইস্কির পরিমাণ বন্ধ করে * দিলে ইয়াহিয়া হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যাবেন। ইয়াহিয়া খানের সাবেক খানসামা জান মােহাম্মদের বরাত দিয়ে পাকিস্তানি। পত্রিকাগুলাে বলে যে ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ এ ভারতের সাথে যুদ্ধকালে এক বােতল মদ আর আধ বােতল ব্ল্যাক ডগ স্কচ খেতেন প্রতিদিন। তিনি যখন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতেন তখন সব সময় জিংকের বােতল তার সামনে রাখতেন। জিংকের সুবিধা ছিল এটা দেখতে বাইরে থেকে সাধারণ পানির মতাে ছিল। কারাগারে থাকা অবস্থায় তার মদ খাওয়ার পরিমাণ কমে গেল। সেটা প্রতিদিন এক বােতল থেকে নেমে এসে সপ্তাহে এক বােতল হলাে। তারপর সেটা তিনি এক মাসে নামিয়ে আনলেন। এভাবে তিনি নিজের ধূমপানের অভ্যেসও ত্যাগ করলেন। তার বাংলাে থেকে মিসেস ইয়াহিয়া কয়েকশাে খালি বােতল বাইরে ফেলে দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের ছেলে আলী ইয়াহিয়া তার বাবার পরিবর্তন নিয়ে বলে যে, বাবা সব সময় একজন খােদভীরু ধার্মিক মানুষ ছিলেন। তার প্রেসিডেন্সির সর্বশেষ ছয়মাস কিছু বাজে লােকের সাথে মেশার কারণে তার অবনতি হয়েছিল। তিনি অত্যন্ত দ্রুত সেই অবস্থা থেকে ফিরে এসেছেন। তিনি প্রমাণ করেছেন যা ঘটেছে সেগুলাে ছিল একটা দুঃস্বপ্ন। ফলে যে কেউ প্রত্যাশা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে তার ভবিষ্যতের দিকে এগুতে পারে।’
সূত্র : প্রাইভেট লাইফ অফ ইয়াহিয়া খান – দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ