You dont have javascript enabled! Please enable it!

নারী মাংসের প্রতি লােভ

১৯৭২ এর জানুয়ারির ৫ তারিখ করাচির বাম ঘরানার আল ফাতেহ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা কালাে সুন্দরী’ শিরােনামে একটি স্টোরি করে একদম প্রথম পাতায়। আল ফাতেহ পত্রিকা তাকে বলেছে ইয়াহিয়া খানের চারপাশের ডাইনি প্রতিভা। এই পত্রিকার মাধ্যমেই পাকিস্তানের লােকজন সর্বপ্রথম কালাে সুন্দরী নামের এই পতিতা চরিত্র নামের মেয়েটির বিষয়ে জানতে পারে। ব্ল্যাক বিউটি বা কালাে সুন্দরীর নাম এই গ্রন্থের পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলােতেও বেশ কয়েকবার এসেছে। এই কালাে সুন্দরীর নাম ছিল মিসেস শামিম কে হুসাইন। পত্রিকায় তার নাম আসার আগেই মােটামুটি তার কানাঘুষা সব জায়গায় শােনা যাচ্ছিল। তবে আল ফাতেহ পত্রিকার উস্কানির মাধ্যমে এই কালাে সুন্দরী দীর্ঘদিন পত্রিকাওয়ালাদের কৌতূহল আর রসালাে আলাপের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ব্ল্যাক বিউটির অবাক করা সব গল্প লিখতে গিয়ে আল ফাতেহ পত্রিকা উল্লেখ করে যে, ইয়াহিয়া খানের সাথে জড়িত অন্ধকারাচ্ছন্ন সমস্ত কাজগুলাের মধ্যে কালাে সুন্দরীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রকট ও ঘৃণ্য । পূর্ব পাকিস্তানের একজন পুলিশ অফিসারের স্ত্রী ছিল সে ইয়াহিয়া খানের সাথে শুধু মাত্র যৌন কলংকারিই নয় বরং একই সাথে সে আরাে নানাবিধ দুর্নীতি ও কেলেংকারিতে জড়িয়ে পড়েছিল। পাকিস্তান পতনের শেষ দিন পর্যন্ত পররাষ্ট্র বিষয়ক অফিসগুলােতে তার অবাধ বিচরণ ছিল। ঊর্ধ্বতন পররাষ্ট্র বিষয়ক কর্মকর্তাদের বদলি, তাদের স্বার্থ রক্ষা, কূটনৈতিকদের আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করার সুযােগ। তৈরি করা নানাবিধ বিষয়ে সে সরাসরি জড়িত থাকত। যুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত যত রাত হােক না কেন ইয়াহিয়া খানের অন্দরমহলে তার প্রবেশাধিকার ছিল। সে অনায়াসে ঢুকে যেত ইয়াহিয়া খানের কাছে। নিজের স্বার্থ চিন্তা করে সে অনেক কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত পাল্টে দিত।

এই রমণীটি যাকে কেবল মনে করা হতাে একজন সাধারণ গৃহিণী, যে ঘরের কাজকর্ম রান্নাবান্না ছাড়া আর কিছু করতে পারত না এবং বাচ্চাদের লালন পালনই শুধু করত সে- শুধুমাত্র ইয়াহিয়া খানের প্রধান নারীই হয়ে উঠল। বরং পাকিস্তানের জটিল সময়ের অংশ হয়ে উঠল। শুধু তাই নয় তাকে মনে। করা হতাে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক রানি। এই রকম একজন নারী যখন সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রধান হর্তাকর্তা হয়ে উঠে তখন বুঝতে হবে যে আমরা পাকিস্তানিরা ইতােপূর্বে যা করেছি সব ভুল করেছি।’ নাবায়ে ওয়াক্ত নামের আরেকটি বিরােধী পত্রিকা কালাে সুন্দরীর নামে আরাে কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছিল। পত্রিকাটি উল্লেখ করে যে ‘পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক পুরাে বিষয়টাকে কালাে সুন্দরী একটি অর্থনৈতিক বিষয়ে দাঁড় করেছিল। পররাষ্ট্র বিষয়ে যে কোনাে ধরনের নিয়ােগ, বদলি ও পদোন্নতি সে নিয়ন্ত্রণ করত। এই বিষয়ে অত্যন্ত নির্মমভাবে সে টাকা লেনদেন করত।’ কালাে সুন্দরীর নামে এই সমস্ত তথ্য বাজারে চালু থাকলেও বিরােধী দল সেনাবাহিনীর মাফিয়া চক্র ও সেনাশাসনের ভয়ে চুপ থাকত। ইয়াহিয়া খান ১৯৬৯ সনে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করে যখন ঢাকায় যান তখনাে ব্ল্যাক বিউটি নামটি একবারেই অপরিচিত ছিল। বিষয়টা সত্যিকার অর্থেই কিছুটা অবাক করা যে পাঁচ সন্তানের মা যার দুজন কিশােরী আর একজন একুশ বছর বয়সের যুবক ছেলে- এমন একজন নারীর প্রতি ইয়াহিয়া খান কেন আগ্রহী হলেন। ঢাকায় এসে ইয়াহিয়া খান। কালাে সুন্দরীর স্বামী জনাব কে এম হুসাইনকে নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী। হিসেবে মনােনীত করেন। সেনাবাহিনীর কিছু বিশ্বস্ত তথ্য মতে ইয়াহিয়া খান কালাে সুন্দরীর প্রতি যত না আকৃষ্ট ছিলেন তার চেয়ে বেশি তার স্বামী কে এম হুসাইনকে বিশ্বাস করতেন। মিডিয়া যেভাবে কালাে সুন্দরীকে ইয়াহিয়া খানের। সাথে জড়িত করে বর্ণনা করেছে আসলে বিষয়টা মােটেও সেরকম নয়। ইয়াহিয়া খান কালাে সুন্দরীর প্রতি শারীরিকভাবে তেমন দুর্বল ছিলেন না। যেমনটা বলা হয় কালাে সুন্দরী দেখতে তত আকর্ষণীয় কিংবা সুন্দরী ছিল না। ইয়াহিয়া খানের চারপাশে তখন যত সুন্দরী মেয়েরা ছিল তাদেরকে ফেলে কালাে সুন্দরীকে নিয়ে ইয়াহিয়া খান ব্যস্ত হয়ে পড়বেন তেমন আকর্ষণীয়া ছিল কালাে সুন্দরী। 

সংবাদ মাধ্যম যেভাবে ইয়াহিয়া খানকে চিত্রায়িত করতে চেয়েছিল তার চেয়ে বেশি কিছু ব্যতিক্রম আর জটিল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন ইয়াহিয়া। খান। নারী মাংসের প্রতি তার লােভ আর পানীয়ের প্রতি তার আকর্ষণ ছিল।  অটুট। একই সাথে শিল্প সাহিত্য নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আলােচনার প্রতিও তার মনােযােগ ছিল। সেই আলােচনাটা কোনাে আকর্ষণীয় নারীর সাথে হলে সেটা ছিল আরাে বেশি উপভােগ্য । এটা সত্য ইয়াহিয়া খান যখন যেই নারীর সাথে পরিচিত হয়েছেন তাকেই বিছানায় নিয়ে গিয়েছেন। একই সাথে তিনি সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্পকলায় যারা বােদ্ধা তাদের প্রতিও নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করেছিলেন। কালাে সুন্দরী মিসেস কে এম হুসাইন ছিল জ্ঞানী পণ্ডিত মহিলা। শুদ্ধ ইংরেজি বলতে পারত। শেক্সপিয়ার, বায়রনের বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা ছিল তার। এই দুইজন কবি আবার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রিয় কবি ছিলেন। ফলে কালাে সুন্দরীর সাথে মদ পানের আবেশে তিনি এই সব আলােচনাকে খুব উপভােগ করতেন। কালাে সুন্দরীর প্রতি তার দুর্বলতার এটাও একটা বিশাল কারণ হতে পারে। আরেকটা কারণ হতে পারে কালাে সুন্দরী ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বংশােদ্ভূত। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে খুব বিশ্বাসযােগ্য কাউকে খোঁজ করছিলেন। কারণ ইয়াহিয়া সব সময় ভীত সন্ত্রস্ত ছিলেন যে বাঙালিরা তাকে হত্যা করবে। তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত এমন একজন বাঙালি দেশপ্রেমিককে খোঁজ করছিলেন যে সব সময় তাকে পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়ে সতর্ক রাখতে পারবে এবং আওয়ামী লীগের বিপজ্জনক কার্যক্রম থেকে তাকে আগাম বার্তা দিতে পারবে। তার এই দুর্বলতা পূর্ব। পাকিস্তানের সমস্ত আওয়ামী বিরােধী মানুষগুলাের প্রতিই ছিল। ব্ল্যাক বিউটি সে রকম একজন মহিলা ছিল যাকে বিশ্বাস করা যায়। কালাে সুন্দরী আর তার স্বামী কে এম হুসাইন ছিল সেই রকম অল্প কতক বিশ্বাসী পূর্ব পাকিস্তানি যাদের উপর ইয়াহিয়া খান পূর্ণ আস্থা রাখতে পেরেছিলেন। ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় কালাে সুন্দরীর দুর্দান্ত প্রতাপের এটাও একটা বিশাল কারণ ছিল। ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যম আরাে কিছু বিষয়ে অজ্ঞাত ছিল।

ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিগত কিছু সহকর্মী যাদের সাথে আমার পরিচিতি ছিল তাদের কাছ থেকে আমি নতুন কিছু বিষয় জানতে পেরেছিলাম। ইয়াহিয়া খান তার বন্ধু মহল ও তার অধীনস্ত উর্ধ্বতন সহকর্মীদের সব সময় বলতেন যে একমাত্র কালাে সুন্দরীর পরিবারের সাথেই তার পারিবারিকভাবে ভালাে সম্পর্ক ছিল। এমনকি ইয়াহিয়া খানের ছেলের সাথে কালাে সুন্দরীর। সন্তানদেরও সব সময় যােগাযােগ থাকত। কালাে সুন্দরীর সন্তানদের ইয়াহিয়া খান বেশ স্নেহের চোখে দেখতেন।  উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশ ক্রাইসিসের সময় যখন বাংলাদেশের মানুষের অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ আকার নিয়েছিল তখন কালাে সুন্দরীর মেয়ে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে উপহারস্বরূপ বিদেশি বাদক দলের উপস্থিতি চেয়েছিল। ইয়াহিয়া খান নিজের তত্ত্বাবধানে কয়েক লাখ টাকা খরচ করে পশ্চিম জার্মানি। থেকে বাদকদল হাজির করেছিলেন। ‘পপ মিউজিকের প্রতি ভালােবাসা কালাে সুন্দরীর সাথে ইয়াহিয়া খানের সুসম্পর্কের আরেকটা কারণ ছিল। তারা উভয়েই নিজ নিজ সন্তানদের সাথে এই বিষয়টা নিয়ে আলােচনা করতেন। ইয়াহিয়া খান উভয় পরিবারের সন্তানদের আয়ােজনে রাওয়ালপিন্ডির ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে মিউজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন। সেখানে নিজে তার ছেলেমেয়ে আর ব্ল্যাক বিউটির ছেলেমেয়ের সাথে নাচ গান করতেন। প্রচুর টাকা খরচ করে তিনি পশ্চিমা সংগীতের বিশাল পরিমাণ ডিস্ক নিজের লাইব্রেরিতে সংগ্রহ করেছিলেন। কালাে সুন্দরী নিজের তত্ত্বাবধানে ইয়াহিয়া খানের সংগীত ও সংস্কৃতি। বিষয়ক বিশাল সংগ্রহশালা দেখাশােনা করত। জেনারেল রানি এদের নিয়ে একটা গল্প বলেছিল। তার দাবি ছিল কালাে। সুন্দরীকে পূর্ব পাকিস্তানের শত্রুপক্ষ অত্যন্ত সুকৌশলে ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল। পরবর্তীতে কালাে সুন্দরী ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব দখল নিয়ে নেয়। এমনকি সে পাকিস্তান সরকারের অত্যন্ত গােপন নথির বিষয়ে অনেক কিছু জানত। কালাে সুন্দরী বাঙালি হওয়ার কারণে ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় বেশ ব্যতিক্রম একটা জায়গা দখলে নিতে পেরেছিল। 

পাকিস্তানের বিখ্যাত পত্রিকা আল ফাতেহের মতে ইয়াহিয়া খানের হারেমের অন্য সুন্দরীরা যেভাবে শুধু মাত্র শরীরের জন্য ব্যবহৃত হতাে কালাে সুন্দরী তেমনটা ছিল না। কালাে সুন্দরী বাঙালি ছিল একই সাথে অত্যন্ত শিক্ষিত ইংরেজি জানা ও শিল্প সাহিত্যের বিষয়ে পাণ্ডিত্য ছিল। ফলে তার অবস্থানটা ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় আর স্পর্শকাতর। তাকে নিয়ে কেউ কিছু বলার। সাহস পেত না। সে ছিল সবার মধ্যে অত্যন্ত বিপজ্জনক। পাকিস্তানের নাবায়ে ওয়াক্ত একটা রিপাের্ট প্রকাশ করেছিল যে ইয়াহিয়া খানের শেষ মুহূর্তগুলােতে পররাষ্ট্র বিষয়ে একমাত্র জেনারেল পিরজাদা যিনি তখন ইয়াহিয়া খানের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র দফতর দেখাশােনা করতেন তিনি ছাড়া আর কেউ কথা বলার সাহস পেতেন না। হাতে গােনা কয়েকটা মাত্র। পত্রিকা তখন কালাে সুন্দরীর এই ক্ষমতার বিষয়টাকে ছাপতে সাহস করেছিল। যাই হােক ১৯৭১ এর এপ্রিল থেকে ইয়াহিয়া খানের সাথে কালাে সুন্দরীর সম্পর্ক সুদৃঢ় হতে শুরু করে যা বজায় থাকে ইয়াহিয়া খানের পতন পর্যন্ত। জেনারেল রানির মতে এই কালাে সুন্দরীই ইয়াহিয়া খানের হাত দিয়ে পাকিস্তানের পতন ডেকে এনেছিল। | কালাে সুন্দরী নিজের শারীরিক চমৎকারিত্ব আর বুদ্ধিবৃত্তি এবং জ্ঞান দিয়ে নিজের স্বামীকে প্রেসিডেন্ট হাউসের চিফ সিভিলিয়ান সিকিউরিটি অফিসার হিসেবে মনােনয়ন দেয় এবং তার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাকে অস্ট্রেলিয়াতে পাঠায়। অবশ্য কারাে কারাে মতে ইয়াহিয়া খান নিজেই উদ্যোগী হয়ে কালাে সুন্দরীর স্বামী জনাব কে এম হুসাইনকে অস্ট্রেলিয়াতে নিয়ােগ দেন। যাতে করে ইয়াহিয়া খান পরিপূর্ণভাবে কালাে সুন্দরীকে নিজের হাতের মুঠোয় সব সময়ের জন্য পেতে পারেন।  প্রত্যাশিতভাবে কালাে সুন্দরী এটা চাইছিল।

ইয়াহিয়া খান কালাে সুন্দরীকে পররাষ্ট্র অফিসে বিশেষ দায়িত্ব দেন। কী ধরনের বিশেষ কাজ তিনি করতেন সেটা কেউ বলতে পারে না। পররাষ্ট্র বিষয়ে কালাে সুন্দরীর নানা ধরনের কাজের কথা আমরা এর মধ্যে বলেছি। ইয়াহিয়া খানের সুন্দরী রমণীদের মধ্যে একমাত্র কালাে সুন্দরীই খুব ভালাে ইংরেজি বলতে পড়তে আর লিখতে পারত। সেজন্য জেনারেলদের কাছে পররাষ্ট্র বিষয়ে যত ফাইল। আসত সবগুলাে ফাইলে কালাে সুন্দরী চোখ বুলাত।  ইয়াহিয়া খানের একটা অভ্যেস ছিল তিনি নিজের ঘরে বসে রাত দশটার পর এই সব ফাইলগুলােতে চোখ বুলাতেন। তখন কালাে সুন্দরী তার সাথে পররাষ্ট্র বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করত। যখন সব কিছু শেষ হয়ে আসছিল আর যুদ্ধের পরাজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল তখন ইয়াহিয়া খান কালাে সুন্দরীকে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত হিসেবে মনােনয়ন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবশ্য তিনি অত্যুথানের কারণে দায়িত্ব নিতে পারেনি। সুইস গভর্নমেন্টও এই ধরনের দায়িত্বে কালাে সুন্দরীর মতাে একজনকে মনােনয়নের বিষয়ে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে আপত্তি জানিয়েছিল। অসংখ্য পাকিস্তানি মনে করে যে ইয়াহিয়া খানকে শুধু শারীরিক সঙ্গ দিতেই কালাে সুন্দরী ছিল না বরং একই সাথে বসের জন্য নানা চাহিদার সুন্দরীদের যােগান ও বসের শিল্প সংস্কৃতিগত আত্মার খােরাকের যােগান দেয়ার কাজটাও সে করত। 

এটা অবশ্য দারুণ মজার বিষয় যে ইয়াহিয়া খানের সাথে যে সমস্ত নারী তার যৌন জীবনের সাথি হয়েছিল তারা আদর্শগত কারণেই ইয়াহিয়ার সাথে থাকত। এবং ইয়াহিয়া খানের হয়ে গােয়েন্দাগিরি করত। ইয়াহিয়া খান নিজে অবশ্য কখনাে কোনাে সুন্দরীকে প্রতারণাপূর্ণভাবে কিংবা ছিনালি করে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্ররােচিত করেননি। কথাটা ইয়াহিয়ার পক্ষে চলে যায়। তবে এটাই সত্য ছিল। এই রকম কোনাে অভিযােগ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে উথাপিত হয়নি যে সুন্দরী রমণীরা অতীতে ভালাে ছিল কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সাথে মিশে তারা নষ্ট হয়ে গেছে। বরং ইয়াহিয়া খানের সাথে মেশার আগেই তাদের চরিত্র খারাপ ছিল।  কালাে সুন্দরী মিসেস হােসাইনও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আমি (গ্রন্থের লেখক) নিজে পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকার খুব উচ্চ পদস্থ এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনেছিলাম যে কালাে সুন্দরীর স্বামী জনাব হােসাইন ইসলামাবাদে বদলি হওয়ার আগেই মিসেস হােসাইনের ছিনালিপনার কানাঘুষা ঢাকায় শােনা যাচ্ছিল। আমেরিকান তেল কোম্পানির একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সাথে তার দহরম ছিল ঢাকার উচ্চবিত্ত সমাজের রসালাে আলাপের অংশ। ইয়াহিয়া খানের সাথে পরিচিত হওয়ার আগেই কালাে সুন্দরী তার আমেরিকার বন্ধুর নিমন্ত্রণে আমেরিকা থেকে ঘুরে এসেছিল। ১৯৭২ এর মার্চ মাসে লাহােরের নাবায়ে ওয়াক্ত পত্রিকা কালাে সুন্দরী। আর ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে নতুন একটা সংবাদ প্রকাশ করে যা ইয়াহিয়া খান ও কালাে সুন্দরীর লাম্পট্যময় সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দিয়েছিল।  সংবাদপত্রের রিপাের্ট অনুযায়ী ইয়াহিয়া খানের বড় ছেলে পঁচিশ বছরের আলী ইয়াহিয়া কালাে সুন্দরীর জন্য প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিল। সে প্রায়ই রাওয়ালপিন্ডির হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে কালাে সুন্দরীর অভিজাত ফ্লাটে ঘুরতে যেত। ততদিনে কালাে সুন্দরী মিসেস হােসাইনকে তার ছেলেমেয়েরা ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ছেলেমেয়েরা আলাদা বাংলাে নিয়ে সেখানে বসবাস করত। ডিসেম্বরের এক সকালে ইয়াহিয়া খান আর তার ছেলে আলী ইয়াহিয়া দুজনেই কালাে সুন্দরীর জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল।

ইয়াহিয়া খান কালাে সুন্দরীর জন্য অস্থির হয়ে তার বাংলােতে গিয়ে নিজের ছেলেকে দেখতে পান। তখন তিনি ক্রোধে উন্মাদ হয়ে ছেলেকে চলে যেতে বলেন। কিন্তু তার ছেলে। চলে যেতে রাজি হয়নি। ইয়াহিয়া খান সে সময় ছেলের বেয়াদবি সহ্য করতে পেরে ছেলেকে বন্দুক দিয়ে তাড়া করেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে যে এই সময় কালাে সুন্দরীর হস্তক্ষেপে বিষয়টার মীমাংসা হয়। কালাে সুন্দরী ছেলেকে চলে যেতে বলে। একই সাথে আরাে কিছু পত্রিকা এই সময় বলে যে ইয়াহিয়া খানের ছেলে আলী ইয়াহিয়া বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সাথে দেখা করে তার বাবার চরিত্রের বিষয়ে নানা রকম কথা বলে বেড়ানাে শুরু করেছিল। ঘটনা শুনে ইয়াহিয়া খান। ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেকে গভর্নমেন্ট হাউসে ঢােকা নিষেধ করে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় হাউসের আশপাশে তাকে দেখলে কারাগারে পাঠানাে হবে বলেও হুমকি দিয়েছিলেন। পুরাে পরিস্থিতিটা তখন বেগম ইয়াহিয়া নিজে সামাল দিয়েছিলেন। বেগম ইয়াহিয়া ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত ধার্মিক আর পরহেজগার ছিলেন। ছেলে আর পিতার সম্পর্ক এবং যেভাবে তাদের পদস্খলন হয়েছিল সেটা নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তায় ছিলেন। পিতা-পুত্রের অধপতনকে তিনি পুরাে জাতির জন্য একটি দুর্যোগ বলে মনে করতেন। | পশ্চিম পাকিস্তানের আমার খুব ভালাে একজন বন্ধু যে কিনা পাকিস্তানে বেশ সুদৃঢ় অবস্থানে ছিলেন আমাকে কালাে সুন্দরীকে নিয়ে পিতা-পুত্রের মাঝে যে বৈরী সম্পর্ক চলছিল সে বিষয়ে একটা ঘটনা বলেছেন। আমি দ্য ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়াতে এই বিষয়ে একটা কলাম লিখেছিলাম। আমার বন্ধুর তথ্য মতে ইয়াহিয়া খানের ছেলে আলী ইয়াহিয়া কালাে সুন্দরীর প্রতি আকৃষ্ট ছিল না। বরং সে কালাে সুন্দরীর উনিশ বছরের কন্যার জন্য উন্মাদ ছিল। তাদের দুজনকে বেশ কয়েকবার ব্রিতকর অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। কালাে সুন্দরী তখন ইয়াহিয়া খানের মাধ্যমে বিষয়টা মিটমাট করতে চেয়েছে। তিনি আরাে বলেন যে ইয়াহিয়া খান মাঝে মধ্যে ইন্টার কন্টিনেন্টালে কালাে সুন্দরীর সাথে দেখা করতে আসতেন। তবে ইয়াহিয়া খান আর তার ছেলের মধ্যে কালাে সুন্দরীকে নিয়ে যে নাটকীয় ঘটনার বর্ণনা নাবায়ে ওয়াক্ত উল্লেখ করেছিল সেটার আসলে কোনাে ভিত্তি নেই। 

নয়া দিল্লির সাথে পাকিস্তানের একটি উচ্চতর বৈঠকের সময় আমি পাকিস্তানের সদস্যদের সাথে আসা একজন সাংবাদিক বন্ধুকে এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন নাবায়ে ওয়াক্ত ইয়াহিয়া খান আর তার ছেলের সাথে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যে ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার সত্যতা আছে। তিনি আরাে উল্লেখ করেন যে এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের মনােনীত আরাে অনেক ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন যারা তাদের বসের ইমেজকে অটুট রাখতে সব সময় চেষ্টা করেছেন এবং সব সময় বলেছেন কালাে সুন্দরীর সাথে ইয়াহিয়া খানের কোনাে শারীরিক সম্পর্ক ছিল না। আমার সাংবাদিক বন্ধু বেশ দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন যে বাবা আর ছেলে দুজনেই নারী আর মদের বিষয়ে উন্মাদ ছিলেন। তাদের মধ্যে যেন একটা প্রতিযােগিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আলী ইয়াহিয়া যখন দেখল যে কালাে সুন্দরী কেবল তার বাবার জন্যই কাজ করছে এবং কালাে সুন্দরীকে কোনােভাবে নিজের জন্য বাগে আনা যাবে না তখন সে নিজের চাইতে দ্বিগুণ বয়সী নারীদের সাথে মেলামেশা করতে শুরু করল। বাপ আর ছেলের মাঝ খানে কালাে সুন্দরী যেন তাদের যৌন জীবনের একটা। মানদণ্ড হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। 

এখানে আরাে উল্লেখ্য যে, দেশের ভেতরে রাজনৈতিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে কালাে সুন্দরী ছিল একমাত্র বাঙালি নারী যে যুদ্ধের পরে পাকিস্তানের নানা পরিবর্তনের পরেও নিজের ক্ষমতাকে ধরে রাখতে পেরেছিল। এমনকি তার স্বামী নিজ কাজে ফিরে আসার পর এবং কালাে সুন্দরী পররাষ্ট্র বিষয়ক সমস্ত কাজ থেকে অবসরে যাওয়ার পরেও রাওয়ালপিন্ডিতে বেশ দাপটের সাথেই বসবাস করত। শুধু তাই নয় নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তার ঊর্ধ্বতন। কর্মকর্তাদের সাথেও বেশ ভালাে সম্পর্ক ছিল তার।  পাকিস্তানের প্রথম সারির পত্রিকাগুলাে কালাে সুন্দরীর এই ধরনের জীবন যাপনের কারণে তাকে ডাকত ক্লিওপেট্টা অব পাকিস্তান নামে। শােনা যায় যে, সে ১৯৭১ এর আগস্টের পর মধ্য ইয়ােরােপে চলে যায়। সেখানেই তার স্বামী সন্তানসহ বসবাস করতে শুরু করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সে দেশের সরকার নতুন পাসপাের্টের জন্য আবেদন করতে বললেও সে তাতে সাড়া দেয়নি। পাকিস্তানের পাসপোের্ট নিয়েই সেখানে থেকে যায়  আমার মতে বাংলাদেশের পাসপাের্ট নিয়ে তার আসলে করার মতাে কিছু। ছিল না। বাংলাদেশের সগ্রামেও তার করার মতাে কিছু ছিল না। কারণ। বাংলাদেশের দেশ প্রেমিক মানুষ কিছুতেই তাকে গ্রহণ করত না। বরং তার প্রতি এক ধরনের ঘৃণা ছিল সকলের। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সংগ্রামের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তাকে হত্যা করার জন্য একবার আত্মঘাতী হামলা হয়েছিল।  বাংলাদেশের আমার বন্ধুরা অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের দোসররা বাংলাদেশের উপর যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছিল তা থেকে কিছুটা হলেও ইয়াহিয়া খানকে রক্ষা করার জন্য কালাে সুন্দরীকে। সামনে নিয়ে এসেছিল। 

সূত্র : প্রাইভেট লাইফ অফ ইয়াহিয়া খান – দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!