You dont have javascript enabled! Please enable it! ইয়াহিয়া খানের শাসন আমলের সমালোচনা - উত্থান আর পতন - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়া খানের শাসন আমলের সমালোচনা — উত্থান আর পতন

পাঠান বংশের অত্যন্ত সম্রান্ত কাজিলবাশ পরিবারে আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের জন্ম। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক দুই শাখায় তার পড়াশােনার রেকর্ড ছিল বেশ ভালাে। কাজিলবাশ পাঠানরা সমাজে এমন একটা উচ্চ সম্রান্ত কমিউনিটি তৈরি করতে পেরেছিল যাদের সাথে আফগানিস্তানের পশতু ভাষার সুন্নি সম্প্রদায় ও বিরােধী শিয়া সম্প্রদায় উভয়ের সাথেই ভালাে সম্পর্ক ছিল। কাজিলবাশদের জায়গা জমি ছিল না কিন্তু তারা পাঠান সমাজে বেশ ভালাে অবস্থান তৈরি করেছিল। ইয়াহিয়া খানের বাবা পাঞ্জাব পুলিশে কাজ করতেন। তিনি লাহাের, অমৃতসার, লালপুর ও আম্বালাতে পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার বাবা পুলিশে কাজ শুরু করেছিলেন একজন হেড কনস্টেবল হিসেবে আর পুলিশের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। করাচির আখবারে জাহানের সম্পাদক পাকিস্তানির বিখ্যাত সাংবাদিক মাহমুদ শাম জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বাবার পুলিশে কাজ করার সময় বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য বের করে নিয়ে এসেছিলেন। ঘটনা ছিল এই রকম যে ১৯৩১ এর ২৭ মার্চ লাহাের কারাগারে ব্রিটিশ সৈন্যরা শহীদ ভাগত সিং, রাজ গুরু, আর সুখ দেবকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। ব্রিটিশ সৈন্যরা পুরাে ঘটনাটা অত্যন্ত গােপনীয়তার সাথে করতে চেয়েছিল। সেই রাতেই তিন দেশপ্রেমিকের লাশ ফিরােজপুরে সুতলিজ নদীর তীরে। পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন ব্রিটিশ সেনা অফিসাররা। সেই সময় ইয়াহিয়া খানের বাবা পুলিশের সাব ইনসপেক্টার ছিলেন। এই কাজের ভান্য তাকে ডাকা। হলে তিনি অত্যন্ত দক্ষতা আর গােপনীয়তার সাথে কাজটা সম্পন্ন করেন। তাকে পুরস্কার স্বরূপ সেই সময় খান সাহেব উপাধি দেয়া হয়। এবং একই সাথে তিনি পদোন্নতি লাভ করেন।

ইয়াহিয়া খান ছাত্র হিসেবে যতটুকু ভালাে ছিলেন তার চেয়ে বেশি। অধ্যবসায়ী আর পরিশ্রমী ছিলেন। পাকিস্তান অর্থমন্ত্রণালয়ের বিশেষ সচিব মােহাম্মদ ইউনুস যিনি পাঠান বংশের ছিলেন এবং ইয়াহিয়া খানের সাথে ছাত্রজীবনে এক রুমেই ছিলেন তিনি ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য আমাকে দিয়েছেন। ইউনুস সাহেবের মতে ইয়াহিয়া খান সাদামাটা ছাত্র ছিলেন। শুধু তাই নয় তিনি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনগুলাে থেকে নিজেকে সব সময় দূরে রাখতে পছন্দ করতেন। ইউনুস সাহেবের নেতৃত্বে যতগুলাে আন্দোলন হয়েছিল তার একটিতেও ইয়াহিয়া খান অংশগ্রহণ করেননি। তবে ব্যক্তিগতভাবে ইয়াহিয়া খান নিজের পড়াশােনার বিষয়ে অনেক পরিশ্রমী ছিলেন আর কমিশন অফিসার হিসেবে নিয়ােগ পাওয়ার জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করেছিলেন। সেই সময় মেয়েঘটিত কোনাে অপকর্ম, মদ্য পান, সিগারেট খাওয়া অল্পবয়সের তরুণরা সাধারণত যা করে তার কোনােটার সাথেই ইয়াহিয়া খানের সম্পর্ক ছিল না। ১৯৩৯ সনে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর ইয়াহিয়া খান ইন্ডিয়ান আর্মিতে কমিশনড অফিসার হিসেবে নিয়ােগ পান। তার শিক্ষাগত রেকর্ড খুব ভালাে না হওয়া সত্ত্বেও তিনি সেনাবাহিনীর পরীক্ষাগুলােতে বেশ ভালাে নম্বর পেয়েছিলেন। সেই সময় সেনাবাহিনীতে খুব কম সংখ্যক পাঠান গ্রাজুয়েট অফিসার ছিলেন। অধিকাংশ অফিসারের গ্রাজুয়েশন ছিল না এবং তারা র‌্যাঙ্ক থেকে কমিশন লাভ করেছিলেন। ফলে উচ্চতর পড়াশােনা থাকার কারণে ইয়াহিয়া খান বিশেষভাবে সম্মানিত ছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসারদের মাঝে। দেশ ভাগের পর ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান মিলিটারি হাইকমান্ডে নীল চোখের বালক হিসেবে কদর পেতে শুরু করেন। এই সময়ের ভেতর তিনি পর পর দুবার জেনারেল আইয়ুবের সাথে বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৯-৫০ সনে তিনি জেনারেল আইয়ুবের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানে বন্যার্তদের সাহায্য প্রকল্পে দারুণ সফলতার সাথে কাজ করেন। একই সাথে ভারত পাকিস্তান সীমান্তে চোরাকারবারি ঠেকাতেও যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেন। জেনারেল আইয়ুবের বিশেষ নির্দেশে ১৯৫১ সনে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান আর্মিতে অল্প বয়সে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি লাভ করেন।

১৯৫৭ সনের মধ্যে পর পর বেশ কয়েকটি পদোন্নতির কারণে তিনি দ্রুত চিফ অব জেনারেল স্টাফ হিসেবে নিয়ােগ পান। একই সাথে তিনি পাকিস্তানি আর্মির সব চেয়ে তরুণ মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি লাভ করেন।  ১৯৫৮ সনে মার্শাল ল জারি হওয়ার পর আইয়ুব খান যখন পরবর্তী এগারাে বছরের জন্য পাকিস্তানি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন তখন থেকে ইয়াহিয়া খান খুব ভালাে কিছু করতে পারেননি যা তার সুখ্যাতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।  তবে এই সময় ইয়াহিয়া খানের সবচেয়ে অর্জন ছিল ইসলামাবাদকে পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে গড়ে তােলার প্রকল্পে সফলতা। হুবহু চণ্ডিগড় শহরের মতাে গড়ে তােলা পাকিস্তানের রাজধানীর সিংহ ভাগ কৃতিত্বটুকু চলে যায় ইয়াহিয়া খানের ঝুড়িতে। একজন ভারতীয় কূটনীতিক যিনি সেই সময় পাকিস্তানের নানা বিষয় নিয়ে কাজ করছিলেন তার মতে পণ্ডিত নেহরু যখন চণ্ডিগড় শহরের উন্নতি চাকচিক্য নিয়ে কথা বলতেন তখন সেটা ইয়াহিয়া খানের পছন্দ হতাে না। তিনি নেহরুকে হিংসা করতেন। এমনকি এই বিষয় কথা উঠলে তিনি মাঝে মধ্যে নিজের উত্তাপ ধরে রাখতে পারতেন না। একদিন ইয়াহিয়া খান রাগ করে বলেই ফেললেন যে দুই বছরের মধ্যে চণ্ডিগড়ের চেয়ে আরাে উন্নত আর সুন্দর একটা রাজধানী তিনি তৈরি করবেন। রাজধানী তৈরির সমস্ত পরিকল্পনা আগে থেকেই তৈরি ছিল। এর পর এই প্রকল্পের প্রধান প্রশাসক হিসেবে যখন ইয়াহিয়া খানকে নির্বাচিত করা হলাে তখন তিনি পুনরায় নিজের সুখ্যাতি নিয়ে আবির্ভূত হলেন। অত্যন্ত সফলতার সাথে তিনি এই প্রকল্পটা বাস্তবায়ন করেন।  ইয়াহিয়া খানের হাত দিয়ে সেই সময় কোটি কোটি টাকার প্রকল্প আর চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলাে এই সময় তার বিরুদ্ধে একটি টাকা চুরির কিংবা অন্য কোনাে ধরনের দুর্নীতির ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তিনি ইসলামাবাদকে রাজধানী করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছিলেন। তার সাথে যারা কাজ করেছিল তাদের প্রত্যেককেই কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল।

তিনি সূর্য ওঠার সাথে সাথেই নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে যেতেন আর সন্ধ্যা পর্যন্ত সমস্ত কাজের তদারকি করতেন যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর সমস্ত কার্যক্রম যেন শেষ হয়। এই সময় ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে তেমন কলংকজন কিংবা আলােচনার মতাে কিছু শােনা যায়নি। শুধু তাই নয় আইয়ুব খানের শাসন যখন ক্রমশ অসহনীয় আর নানা রকমের সমালােচনায় ভরে উঠছিল একই  সাথে আইয়ুব খানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের নামও উঠে আসছিল সেই সময়ও ইয়াহিয়া খানের বিষয়ে তেমন কোনাে দুর্নামের খবর পাওয়া যায়নি।  পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের সমাজে কেউ মিশলেই বুঝতে পারত এই সমস্ত সামরিক কর্মকর্তাদের প্রায় প্রত্যেকেই একাধিক বিয়ের সাথে জড়িত ছিলেন। আর সেই বিয়ের সময়কালও ছিল খুব কম- দুই থেকে চার বছরের মধ্যে একজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের জরিপে দেখা যায় যে ১৯৫৯ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানি জেনারেলদের সবচেয়ে বড় সফলতা ছিল বৈবাহিক ক্ষেত্রে। পাকিস্তানি আর্মির দুই ডজনেরও বেশি সেনাকর্মকর্তার এই ধরনের কুখ্যাতি ছিল। এদের মধ্যে যােলােজন বিয়ে করেছিলেন দুইবার আর ছয়জন বিয়ে করেছিলেন পাঁচবারের বেশি অবশ্য এই সময় চিফ অব কমান্ড আইয়ুব খান এই ধরনের বদনাম থেকে দূরে ছিলেন। শুধু তাই না আরাে গুটিকতক সেনা অফিসারদের মধ্যে এই সময় ইয়াহিয়া খান আর টিক্কা খানও ছিলেন। তারা সেই সময় অবশ্য তত বড় সেনা অফিসার হয়ে উঠেননি।

পাকিস্তানের একজন সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে সেই সময় জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সামরিক অফিসারদের ক্লাব বারে রাত আটটার পরে দেখা যেত না। আটটা পর্যন্ত তিনি হয়তাে অন্য অফিসারদের সাথে টুকটাক পান করতেন। তারপর আটটা বাজলেই পরিবারের লােকজনের সাথে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য চলে যেতেন। তার স্ত্রী যে তার মায়ের দিক থেকে খালাতাে বোন ছিল তিনিও কখনাে সেই সময় ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে কোনাে অভিযোেগ করেননি। অন্য সেনা অফিসারদের যেমন অন্য অফিসারদের স্ত্রীদের প্রতি আসক্তিজনিত বদনাম বা অভিযােগ থাকে সেই রকম কোনাে অভিযোেগ তিনি ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে কখনাে করেননি।  একজন আমেরিকান পর্যবেক্ষক-লেখক পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের বিষয়ে গবেষণামূলক একটা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাদের বদনামের সময়গুলােতে ইয়াহিয়া খানকে পাওয়া গিয়েছিল। অত্যন্ত আদর্শবাদী একজন সেনা কর্মকর্তা হিসেবে। তিনি নিজের দায়িত্বে অত্যন্ত মনােযােগী আর কাজ অন্তপ্রাণ ছিলেন। একজন মুসলিম সেনাকর্মকর্তা হিসেবে যেমনটা ভাবা হতাে তিনি ছিলেন তার সমার্থক। রােজার মাসে তিনি রােজা থাকতেন, সারা মাস সব ধরনের পানীয় থেকে দূরে থাকতেন।  এমনকি ১৯৬৩ সনে ইসলামাবাদে একটি জনসভায় আইয়ুব খান ঘােষণা করলেন তােমরা আমাকে ইয়াহিয়া খানের মতাে নৈতিকতায় আর কর্মদক্ষতায় পূর্ণ বারােজন সেনাকর্মকর্তা দাও আমি তােমাদের জন্য পাকিস্তানকে ইসলামিক বিশ্বে একটা আদর্শ রাষ্ট্রের মডেল হিসেবে তৈরি করে দেব। ভারতের সাথে পাকিস্তানের ১৯৬৫ এর যুদ্ধের ভেতর দিয়ে ইয়াহিয়া খান তার জীবনের সেরা সফলতাটুকু অর্জন করেন। এই যুদ্ধের বীরত্বের কারণে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে প্রশংসা কুড়ান। এক অনুষ্ঠানে আইয়ুব খান তখন ইয়াহিয়া খানকে হিলালে জুরাত (ক্রিসেন্ট অব ভেলর) উপাধি দেন। এই উপাধিটি তখন হাতে গােনা অল্প কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাকে দেয়া হয়েছিল।

অবশ্য পাকিস্তানের সাথে ভারতের এই যুদ্ধের সময়ই ভুট্টোর সাথে ইয়াহিয়া খানের এক ধরনের হিসেব নিকেশ শুরু হয়। ভুট্টো তখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিষয়ক সব কিছু দেখা শােনা করতেন। এই সময়ই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের কমান্ডার ইন চিফ মনােনীত হন। ভুট্টো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইস্তফা দেন। তিনি তখন পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জনপ্রিয় নেতা। জনরােষ ফুসে উঠছিল তখন আইয়ুব খানের শাসনের বিরুদ্ধে। এই রকম পরিস্থিতিরে আইয়ুব খান তার কমান্ডার ইন চিফ ইয়াহিয়া খানের উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিলেন।  ইয়াহিয়া খানের কট্টর সমালােচক এয়ার মার্শাল আসগর খান লাহােরের মাশরিক পত্রিকায় ইয়াহিয়া খানের সমালােচনা করে বলেন যে ১৯৬৯ এর সময় পাকিস্তানে যখন তীব্র জনরােষ আর বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল তখন ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের জন্য পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন।  একটা প্রসিদ্ধ গল্প চালু আছে যে ১৯৬৮ এর প্রথম দিকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনাব ভুট্টোকে বলেছিলেন যে তার নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনী জনতার সমস্যা সমাধানে এবং তাদেরকে একটা গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাধান। করতে পূর্ণ প্রস্তুত। সাধারণ জনতার নেতারা অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতারা যদি জনতাকে নিয়ে সেরকম কোনাে পরিস্থিতি কিংবা মঞ্চ তৈরি করতে পারেন তাহলে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী তাদেরকে আন্দোলনকে সমর্থন জানাতে প্রস্তুত।  এই কথা বলে ইয়াহিয়া খান অবশ্য ভুট্টোকে একটা প্রচ্ছন্ন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ভুট্টো সেটা গ্রহণ করেননি। কারণ তার মতে এই রকম কোনাে গণঅত্যুথানের জন্য সেই সময়টা পরিপক হয়নি।

সে যাই হােক আমরা এখন জানার চেষ্টা করি কেন ইয়াহিয়া খানের মতাে একজন পরিচ্ছন্ন ইমেজের মানুষ হঠাৎ করে মদ আর নারীর জন্য মধ্য যুগীয় দানব হয়ে উঠলেন। পাকিস্তানি লেখক সাংবাদিক গবেষকদের কাছে বিষয়টা সত্যিকার অর্থেই কৌতূহলী ছিল। তারা এটা নিয়ে মানুষের চরিত্রের নানা দিকের বিচার বিশ্লেষণ করার সুযােগ পেয়েছিলেন। তবে যারা পাকিস্তানের বাইরে ছিলেন তাদের কাছে অবশ্য এর কোনাে যৌক্তিক কিংবা সমাপ্তিসূচক কোনাে উত্তর ছিল না। মর্নিং নিউজের সম্পাদক জেড এ সুলুরি যার একই সাথে আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের সাথে সুসম্পর্ক ছিল এবং যিনি ইয়াহিয়া খানের পাবলিক রিলেশন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তিনি ভারতীয় এক সাংবাদিকের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন যে ইয়াহিয়া খানের শাসনামলের প্রথম ছয় মাস তিনি একদম পরিচ্ছন্ন ছিলেন। তার চরিত্রের রেকর্ড প্রথমদিকের মতােই অটুট ছিল। তবে পরিস্থিতি যত ঘােলাটে হতে শুরু করে এবং রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হতে শুরু করে তখন রাজনৈতিক বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত নেয়ার দুর্বলতা, অদূরদর্শিতা সার্বিকভাবে এক জটিল পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিক গতিতে মদ আর নারী তার চরিত্রে ঢুকে যেতে শুরু করে। তিনি এতেই জটিল সময়গুলােতে আস্থা পেতে শুরু করেন। মদ আর নারী সব কিছুর উপর কর্তৃত্ব করা শুরু করে।  আমাকে পাকিস্তানের একজন ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা কিছু তথ্য দিয়েছিলেন। নাম না প্রকাশ করার শর্তে তিনি আমাকে এই কথাগুলাে বলেছিলেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ইয়াহিয়া খান যখন কমান্ডার ইন চিফ অব দ্য আর্মি ছিলেন তখনও তিনি তার সাথে কাজ করেছেন। ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অভিজ্ঞতা এই সেনাকর্মকর্তার ছিল। আমাকে তথ্যদাতা এই সেনাকর্মকর্তা অত্যন্ত ধার্মিক আর কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন। তিনি জীবনে মদ পান করেননি এমনকি কখনাে সিগারেট খাননি। ইয়াহিয়া খানের নৈতিক পরিবর্তনের কারণ কী এই সম্পর্কে তিনি বলেন যে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য ইয়াহিয়া খানের পতনের পেছনে অত্যন্ত শক্তিশালী ও আন্তর্জাতিক একটি চক্র কাজ করেছিল। আমার এই ধার্মিক সেনা অফিসার বলেন যে ইয়াহিয়া খান যখন ক্ষমতা গ্রহণ করলেন তখন থেকেই একদল সুযােগ সন্ধানী লােক ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক অদূরদর্শিতার সুযােগ গ্রহণ করতে থাকে। একই সাথে ভারতীয় ও রাশিয়ান চক্রও ইয়াহিয়া খানের বুদ্ধিগত বিষয়টাকে পরাস্ত করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে।

আমার এই সাের্স আরাে বলেন যে ইয়াহিয়া খানের চারপাশে যে সব নারীরা ছিল তাদের অধিকাংশকেই ভারতীয় চক্র নিয়ােগ দিয়েছিল। তিনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন যে এই নারীদের কাউকে কাউকে ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের কোম্পানিতে চাকরি করতে দেখা গেছে। আমি তাকে যখন জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের সেনাবাহিনীর ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ বিষয়টা জানার পরেও কেন সেটা ইয়াহিয়া খানের গােচরে আনেনি? উত্তরে তিনি বলেন যে আল্লাহ যখন কাউকে ধ্বংস করতে চান তখন তাকে অন্ধ করে দেন। পাকিস্তানের দুই তরুণ সাংবাদিক ইশতিয়াক আহমেদ ও শাহিদ সুলেমান বলেন যে ১৯৭০ এর ডিসেম্বর পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান তার পূর্বের চরিত্রের মতােই সৎ ছিলেন। কিন্তু ‘৭০ এর নির্বাচনের পর সব কিছু পাল্টে গেল। ইয়াহিয়া খানের আর্মি ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ তাকে নির্বাচনের বিষয়ে বিশ্বাসযােগ্য সংবাদ দিতে ব্যর্থ হয়। তাদের হিসেব অনুযায়ী পশ্চিমে ভুট্টো ও পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমান আশানুরূপ তেমন কিছু করতে পারবেন না। কিন্তু নির্বাচনের পর তার হিসেব হলাে উল্টো। এই নির্বাচনের কারণে ইয়াহিয়া খানের একনায়ক হিসেবে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। এই রকম উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতিতে নিজের হতাশা থেকে বের হয়ে আসার জন্য তিনি মদ পানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

সুযােগবুঝে এই সময় সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও সেনাকর্মকর্তারা তাদের স্ত্রী বান্ধবী কন্যাদেরকে নিয়ে ইয়াহিয়া খানের চারপাশে ভিড় করতে থাকেন। ইয়াহিয়া খান সেই সুযােগটা গ্রহণ করেন। শাসকগােষ্ঠীর পরিবারের খুব কাছাকাছি আরেকজন মহিলা সাংবাদিক বলেন যে ১৯৭১ এর শুরুর দিকে বেগম ইয়াহিয়ার সাথে ইয়াহিয়া খানের সম্পর্কটা একদম স্বাদহীন আন্তরিকতা শূন্য হয়ে পড়ে। বেগম ইয়াহিয়া অত্যন্ত ধার্মিক মহিলা ছিলেন। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর মধ্যবয়স্ক ইয়াহিয়া খানের শারীরিক চাহিদার ঠিক মতাে সাড়া তিনি দিতে পারছিলেন না বলে ইয়াহিয়া খানের মধ্যেও একরকম হতাশা আর বিরক্তি চলে আসে। ফলে ইয়াহিয়া খানের মতাে একটা শক্ত চরিত্র যখন একবার বিগড়ে যায় তখন আর ফিরে আসার সুযােগ থাকে না।  ইয়াহিয়া খানের হারেমখানার আরেক নারী ইয়াহিয়া খান যাকে জেনারেল রানি হিসেবে ডাকতেন এই গ্রন্থের পরবর্তী বিশাল অংশ জুড়ে তার আলােচনা থাকবে এই মহিলা ইয়াহিয়া খানের পদস্খলনের অন্য আরেকটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। সে সব সময় ইয়াহিয়া খানের পক্ষে কথা বলেছে। তার মতে ইয়াহিয়া খান খুব খারাপ মানুষ ছিলেন না। নিজের শাসনামলের শেষ দিকে তার চরিত্রের অধঃপতন হয় মূলত মিসেস কে এম হুসাইনের কালাে জাদুর কারণে। মিসেস কে এম হুসাইন ইয়াহিয়া খানের হারেমখানায় কালাে সুন্দরী নামে পরিচিত ছিলেন। জেনারেল রানির মতে কালাে সুন্দরী ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলার মেয়ে। সে বাংলাদেশ থেকে কালাে জাদু শিখে ইয়াহিয়া খানের প্রেসিডেন্সি হাউসে এসেছিল। পাকিস্তানের শত্রুরা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য কালাে সুন্দরীকে নিয়ােগ দিয়েছিল। সমস্ত ব্যাখ্যার আড়ালে ইয়াহিয়া খান ছিলেন একজন ট্রাজিক হিরাে। আধুনিক যুগের কিং লিয়ার যিনি নিজের রাজনৈতিক অদক্ষতা, নারী আর মদের লােভের কারণে একই সাথে ভিলেনও ছিলেন। তিনি শুধু নিজের ধ্বংসই নয় বরং একই সাথে পাকিস্তানের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তার সেই ধ্বংসের কাহিনি এক এক করে চলুন দেখা যাক।

সূত্র : প্রাইভেট লাইফ অফ ইয়াহিয়া খান – দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ