You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৬৫- সালের পাক ভারত যুদ্ধ নিয়ে শর্ট মুভি –শয়তানের নৃত্য

১৯৭১ এর ২৬ নভেম্বর, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বিদেশি সাংবাদিকদেরকে প্রেসিডেন্ট ভবনে আমন্ত্রণ জানিয়ে বললেন ভারতের সাথে একটা যুদ্ধ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তার দুজন বিশ্বস্ত জেনারেল, জেনারেল গুল হাসান এবং জেনারেল পিরজাদা তার পাশেই বসে ছিলেন। নতুন দিল্লির অপরাধ আর অবৈধ কর্মকাণ্ডের দীর্ঘ একটা ফিরিস্তি টেনে নাটকীয়ভাবে তিনি ঘােষণা করলেন- যথেষ্ট হয়েছে, এর একটা শেষ হওয়া। উচিত, পাকিস্তান আর সহ্য করবে না। তাই আমি আপনাদেরকে ভারতের আগ্রাসনের বিষয়ে আমার প্রতিক্রিয়াটা পরিষ্কার করতে চাই। হয়তাে দীর্ঘদিন আপনাদের সাথে আমার আর দেখা হবে না, দিন দশেকের মধ্যে আমিও হয়তাে সম্মুখযুদ্ধে নেমে পড়ব।’ ভারতের বিরুদ্ধে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ ঘােষণায় বিশ্ববাসী। হতবাক হয়ে গেল। পাকিস্তানের পত্রিকাগুলাে বড় বড় শিরােনামে তাদের প্রেসিডেন্টের ঘােষণা। ছেপে দিল। উদাহরণস্বরূপ লাহােরের মাশরিক পত্রিকার রিপাের্ট ছিল এই রকম: ‘ভারতের সাথে যুদ্ধ অপরিহার্য’, প্রেসিডেন্টের ঘােষণা;‘দিন দশেকের মধ্যে আমি নিজেই সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেব’। ইন্ডিয়াকে ধ্বংস করাে’ এই জাতীয় স্টিকার হঠাৎ করেই প্রতিটি গাড়ি, হােটেল, স্কুল, হাসপাতাল এমনকি মসজিদের দেয়ালেও দেখা যাচ্ছিল। ইয়াহিয়া খান নির্দেশ দিলেন এই জাতীয় স্টিকার উর্দু আর ইংরেজিতে লক্ষ লক্ষ কপি ছাপিয়ে চারদিকে যেন বিলি করা হয়। টেলিভিশন স্টেশনগুলাে পুরাে পাকিস্তান জুড়ে দেশবাসীকে আসন্ন যুদ্ধের বিষয়ে সতর্ক করতে শুরু করল, যুদ্ধের সময় তারা যেন নিরাপদ স্থানে থাকে সে বিষয়ে বারবার ঘােষণা দিল। ইয়াহিয়া খানের জিনিয়াস সেনা অফিসাররা পত্রিকার সম্পাদকীয় আর টিভি প্রােগ্রামগুলাের মূল সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করতে শুরু করলেন। এই সব অনুষ্ঠানে ১৯৬৫ এর পাক-ভারত যুদ্ধে জেনারেল ইয়াহিয়া খান একজন বীর ছিলেন- সেটাই ছিল মূল আলােচ্য বিষয়। সিনেমা হলে আর টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ব্রিটেনের একদল চিত্র পরিচালকের তৈরি শর্ট মুভি দেখাতে শুরু করল যার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অবশ্যই ১৯৬৫-এর পাকভারত যুদ্ধ, সেখানে কতটুকু বিনয় আর বীরত্বের সাথে তিনি ভারতীয়দের সাথে আচরণ করেছিলেন সেটাকে দারুণভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হলাে। তবে জাং নামের একটা উর্দু দৈনিক পত্রিকা ব্যতিক্রম ছিল।

তাদের এক রিপাের্টে বলা হলাে যুদ্ধের এই সব ফিচার যা টিভি সিনেমাতে দেখানাে হচ্ছে সেগুলাে অতিরঞ্জন আর এগুলাে তৈরি করা হয়েছে ১৯৬৫-এর যুদ্ধের ছয় বছর পর। পাক সেনাবাহিনীর সহায়তায় ও মঞ্চায়নে এই সব যুদ্ধের দৃশ্যায়ন করা হয়েছে। মাওসেতুং এর প্রচারণার ধারণা থেকে চুরি করে পাকিস্তানি সরকারি প্রকাশনা সংস্থা লক্ষ লক্ষ কপি বুকলেট ছাপিয়ে মানুষের মাঝে বিলি করা শুরু করল। যার শিরােনাম ছিল ইয়াহিয়া খানের ভাবনা’। ছােট্ট এই বইটিতে ইয়াহিয়া খানের ব্যক্তিত্ব, তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, সামরিক প্রতিভা সব কিছু নিয়ে অতিরঞ্জন আকারে প্রশংসা করা হলাে। পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ অন্যান্য বিরােধী দলের নেতারা ১৯৭১-এর মার্চের ২৬ তারিখ জেনারেল ইয়াহিয়া খান যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের উপর তার বিষয়ে বিবৃতি দিলেন এই বলে যে, তিনি পাকিস্তানের রক্ষাকর্তা। দেশকে রক্ষা করায় জাতি তার কাছে কৃতজ্ঞ।  ভারতের সাথে যুদ্ধের আগে সব কিছুই আবেগতাড়িত হয়ে এমনভাবে চলছিল যা সত্যিকার অর্থেই একটি অপরিহার্য যুদ্ধের আশু ইঙ্গিত দিচ্ছিল অসংখ্য শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী মানুষ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রশংসায় মেতে উঠলেন। অবশ্য এর কিছুকাল পরেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান যখন রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত হয়ে লাঞ্ছনার প্রতিশব্দে পাল্টে গেলেন তখন বিরােধী দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ আর বুদ্ধিজীবীরা কাদাছােড়াছুড়ি শুরু করলেন। একে অপরকে দোষ দেয়া শুরু করলেন। যাই হােক এটা অন্য গল্প। পরে এই বিষয়ে বিস্তারিত বলা হবে। তবে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান আসলে কী করেছিলেন? এই বিষয়টা খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন ইরানি সাংবাদিক আমির তাহিরি। তিনি সেই সময় ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে ইসলামাবাদে অবস্থান করছিলেন। কায়হান ইন্টারনেশনাল নামের তেহরানের একটি পত্রিকায় তাহিরি বলেন যে ইয়াহিয়া খান এই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের ভূত দিয়ে আতংকগ্রস্ত ছিলেন। শুধু তাই নয় এই সময় তাকে মিসেস ইন্দিরা গান্ধি, মি. জাগজিভান রাম এবং ১৯৭১ এর ডিসেম্বরের শেষের দিকে জনাব ভুট্টোকে নিয়েও ভীতত্রস্ত দেখা গেছে। আমির তাহিরির এই সব বিষয় নিয়ে ভালাে জানার কথা। কারণ এই সময় প্রেসিডেন্ট হাউসের ভেতর কী ঘটছে সে বিষয়ে তার চতুর্ভুজ ধারণা ছিল। তিনি চারপাশ থেকেই সব কিছু দেখছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্সিয়াল গেস্ট হাউজের একদম পাশ ঘেঁষে থাকতেন সেই সময়। কায়হান ইন্টারন্যাশনালের ১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারির ২৭ তারিখের সংখ্যায় আমির তাহিরি লিখেছিলেন যুদ্ধ চলাকালীন সময় জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই বােতল মদ পান করতেন। তার স্নায়ুবিক উত্তেজনাকে রােধ করার জন্য তিনি এটা করতেন। ৭২ এর জানুয়ারি পর্যন্তও যেটা ঠিক হয়নি।

তাহিরির ভাষ্য মতে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাতের বেলা ঘুম থেকে জেগে উঠে চিৎকার করতেন, মুজিবকে এখান থেকে সরাও আর ওকে ফাসিতে ঝুলাও।’ | শুধু তাই নয় জনাব ভুট্টো, মিসেস ইন্দিরা গান্ধি ও জাগজিভান রামকে নিয়ে তিনি সব সময় হেলুসিনেশনে ভুগতেন। তার মনে হতাে এরা তাকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে, তাকে খুন করতে আসছে। প্রায়ই একজন ডাক্তার এসে তাকে শান্ত হওয়ার ওষুধ দিয়ে যেতেন। | ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত যখন ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছিল সেই সময় জেনারেল ইয়াহিয়া খান নভেম্বরে সম্মুখযুদ্ধে থাকার যে দম্ভভরে ঘােষণা দিয়েছিলেন তার পরিবর্তে বেশির ভাগ সময় তার ঘরে দ্রিা পােশাক পরে শুয়ে থাকতেন। এমনকি তার চিফ অব স্টাফদের সাথে তিনি দেখা করতেও আসতেন না। এমনকি ১৬ই ডিসেম্বরের আত্মসর্মপণের ঘােষণার জন্য তাকে জেনারেল গুল হাসান একরকম টেনে এনেছিলেন। কারণ সে সময় তিনি ভরপেট মদ খেয়ে পার মাতাল। ফলে ঘােষণাটা পর্যন্ত দিতে দেরি হয়েছিল। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এক রকম কাল্পনিক ধারণা ছিল যে তিনি একজন তুখাের অভিনেতা আর তার ইংরেজি উচ্চারণ চমৎকার। যুদ্ধের কিছুকাল পূর্বে তিনি বাড়িতে নাটক আয়ােজন করতেন। তার পছন্দের নাটক ছিল জুলিয়াস সিজার যেখানে তিনি মার্ক এন্টোনির ভূমিকায় অভিনয় করতেন। এই নাটকের মঞ্চায়ন অনুষ্ঠানে তার পছন্দের বান্ধবীরা আর পরিবারের ঘনিষ্ঠজনেরা উপস্থিত থাকত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন দিন পর জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার এক অধীনস্ত জেনারেলের আমন্ত্রণে এক অনুষ্ঠানে যান। বেশ আঁকজমকপূর্ণ ছিল সে অনুষ্ঠান। দেশে ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে সেরকম কোনাে কিছুই বােঝা যাচ্ছিল না সেই অনুষ্ঠানে। ইয়াহিয়া খান হঠাৎ করে তার মুখের জ্বলন্ত সিগারেট অনুষ্ঠানের সাজিয়ে রাখা বেলুনগুলাের মধ্যে চেপে ধরতে শুরু করলেন। সিগারেটের আগুনে একটা একটা বেলুন ফাটছিল আর ইয়াহিয়া খান খুশিতে চিৎকার করে উঠছিলেন এই বলে- ‘জাগজিভ রাম ধ্বংস হলাে, তারপর আরেকটা বেলুন ফাটিয়ে বললেন, এই তাে ভুট্টো ধ্বংস হলাে’ এইভাবে একের পর এক বেলুন ধ্বংস করতে করতে শেষ পর্যন্ত বললেন, এখন শেখ মুজিব ধ্বংস হলাে।’  সিগারেট দিয়ে বেলুন ফাটানাের এই নাটক শেষ করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তখন অনুষ্ঠানে উপস্থিত মেহমান পাকিস্তানের তৎকালীন বিখ্যাত গায়িকা ম্যাডাম নুরজাহানকে নিয়ে পাশের একটা ঘরে চলে গেলেন। ঘরের দরজা বন্ধ করে পাঁচ ঘণ্টার মতাে সেখানে থাকলেন। বাইরে অনুষ্ঠান চলছে আর ভেতরে তারা দুজন।

গায়িকা নুরজাহানকে পরবর্তীতে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য এবং ইয়াহিয়া খানকে সঙ্গ দেয়ার জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানি মিডিয়া নুরজাহানকে কালাে তালিকাভুক্ত করেছিল। দীর্ঘদিন তার কোনাে গান রেডিও কিংবা টেলিভিশনে প্রচারিত হয়নি। নুরজাহানকে নিয়ে আমরা এই বইয়ের অন্য অংশে বিস্তারিত আলােচনা করব। | পাকিস্তানি পত্রিকাগুলাে এই খবর প্রকাশ করেছিল যে টিভিতে যখনই ইয়াহিয়া খান কোনাে আলােচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতেন তখন স্নায়ুবিক উত্তেজনার কারণে তার বারবার পানি খাওয়ার দৃশ্যটা দর্শকদের নজর এড়াতে পারেনি। সেই গ্লাসে অবশ্য স্বাভাবিক পানীয় ছিল না। সেখানে ছিল উত্তেজনা দূর করার পানীয়। | শুধু তাই নয় তিনি যখন ভুট্টোর কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের বিষয়টা নিয়ে আলােচনা করছিলেন তখনাে এতটাই মাতাল ছিলেন যে তার বক্তব্যের সারকথাটা তিনি ঠিক মতাে বােঝাতে পারেননি। ভুট্টোর হাতেও তখন একটা শ্যামপেনের বােতল ছিল। তিনিও মাতাল ছিলেন। ফলে পাকিস্তানবাসীকে আত্মসমর্পণের ঘােষণাটা দিতে মধ্যরাত হয়ে গিয়েছিল। এই বিষয়েও বিস্তারিত আলােচনা পরে করা হবে।

যুদ্ধকালীন সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে লিখেছিলেন লাহােরের বিখ্যাত সাপ্তাহিক পাঞ্জাব পাঞ্চ এর সাংবাদিক জাভেদ মাহমুদ। তিনি লিখেছেন : ‘জেনারেল ইয়াহিয়া খান যদি তার অফিসারদের জন্য কঠোর হতেন তাহলে যুদ্ধকালীন সময়ে তিনি শত্রুপক্ষের জন্য ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াতেন। আমাদের অনেকেই জানে না কেন হঠাৎ করে পুরাে জাতি একটা নিদারুণ অন্ধকারের মধ্যে পড়ে গেল, জাতির ভাগ্য আকাশে কেন কালাে মেঘ এসে জমা হলাে, আমাদের পাকিস্তানি সৈন্যরা ভয়াবহ আগ্রাসনে মারা যেতে শুরু করল। কেন শক্রর আঘাতে পাকিস্তানিদের ঘরবাড়ি আগুনে পুড়তে শুরু করল। আমরা এই সব কিছুই জানতে পারলাম না। বরং সেই সময় আমাদের জেনারেল ইয়াহিয়া খান পতিতাদের সাথে আনন্দে সময় কাটাতে ব্যস্ত, পার্টিতে সময় কাটাচ্ছেন, তার অফিসাররা নিজেদের স্ত্রী পুত্র কন্যাদের সাথে আনন্দে সময় পার করছেন। | এটা অবশ্য এখনাে জানা যায়নি যে কেন ডিসেম্বরের ১০ তারিখ থেকে ১৬ তারিখ পর্যন্ত ঢাকা থেকে ইসলামাবাদে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ আর সিদ্ধান্তগুলাে ঠিকমত পৌছায়নি।’ | যাই হােক নানা রকম বিশ্বাসযােগ্য উৎস থেকে এটা জানা যায় যে তখন জেনারেল উমর, জেনারেল গুল হাসানের মতাে বড় বড় সামরিক কর্মকর্তার সূর্যাস্তের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাৎ করা বা যােগাযােগ করা অসম্ভব ছিল।  ডিসেম্বরের ১১ তারিখ ঢাকায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিকের উপস্থিতিতে জেনারেল মানেকশর কাছে আত্মসমর্পণের বিষয়ে আলােচনার অনুমতির জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে জরুরি সংবাদ পাঠাতে জেনারেল নিয়াজিকে বলা হয়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তানি সৈন্যরা যেন নিরাপদে তাদের দেশে ফিরতে পারে এই শর্তে আত্মসমর্পণের নীতি গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী চারদিন পাকিস্তানি সরকার কেমন হবে এই নিয়ে ইন্ডিয়া কিছুটা বিচলিত ছিল।

পাকিস্তান গভর্নমেন্ট হেডকোয়াটারে পাকিস্তানি গােয়েন্দাবাহিনীর কিছু রিপাের্ট এমন ছিল যে ইন্ডিয়া এই যুদ্ধটাকে আর লম্বা করতে চায় না। তারা নিজেদের কম রক্তপাত ঘটিয়ে এর সমাধান খুঁজছে। শুধু তাই নয় বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহর নিয়েও ভারত কিছুটা বেকায়দায় ছিল। তারা দ্রুততম সময়ে দেশের অভ্যন্তরে কম রক্তপাত আর ধ্বংসযজ্ঞ না ঘটিয়ে দ্রুত একটা সমাধান খুঁজছিল। জেনারেল রাও ফরমান আলী আমেরিকান উচ্চপদস্থ  কূটনৈতিকদের মাধ্যমে সরাসরি নিউইয়র্কের সাথে যােগাযােগ করে আত্মসমর্পণের একটা সম্মানজনক পথ বের করেছিলেন। জেনারেল নিয়াজি অবশ্য কিছুটা বাদ সেধেছিলেন। কিন্তু সেদিন দুপুরেই কুষ্টিয়ার পতনের পর জেনারেল নিয়াজি দ্রুত যুদ্ধ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আত্মসমর্পণের শর্তসহ সংবাদ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠান। তবে সেই সময় এই সংবাদ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠানাে অসম্ভব ছিল। কারণ তিনি তখন নিজে মাত্রাতিরিক্ত ভােগ বিলাসে মত্ত ছিলেন। যে রানার তার কাছে এই খবর নিয়ে এসেছিল তিনি চিৎকার করে তার দিকে তেড়ে গিয়েছিলেন। এমনকি ফোনে কথা বলতেও তিনি অস্বীকার করছিলেন। কারণ এই বিষয় নিয়ে ফোনে কথা বললে তার আনন্দটা মাটি হয়ে যেতে পারে। যাই হােক ইয়াহিয়া সেই সময় এতটাই মাতাল ছিলেন যে তার পক্ষে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কারাে সাথে কথা বলা সম্ভব ছিল না। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য মতে অনুষ্ঠানটা ছিল মারাত্মক রকম উন্মত্ততা আর নগ্নতায় ভরপুর। উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তারা তাদের স্ত্রী আর মেয়েদেরকে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। সকলের পশ্চিমা ধাচের অর্ধ নগ্ন পােশাক ছিল। এমন সব কার্যকলাপ সেখানে চলছিল যা ছাপার অযােগ্য। এই সবের ভেতর দিয়েই সে রাতে পাকিস্তানের ভাগ্যকে সিলমােহর মারা হয়েছিল। শয়তানের এই নৃত্য আর উন্মাতাল ফুর্তির ভেতর দিয়ে রাতটা পার হয়। সেই রাতেই করাচির হারবারে আগুন ধরে, চাক লালা বিমানবন্দরে শত্রু পক্ষ তিনদফা বােমা বর্ষণ করে।

এই সব নিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের। কোনাে মাথা ব্যথা ছিল না। কারণ তাকে কালাে সুন্দরী নামের এক জাদুকরী জ্যোতিষী নারী বলেছিল যে তিনি বছরের শেষ সময় তার সফলতা আর অর্জনের শেষ চূড়ায় উঠবেন। তার দুশ্চিন্তা করার কোনাে কারণ নেই। শুধু তাই নয় তার চারপাশের মােসাহেব সেনা অফিসাররাও সব সময় তাকে বলতেন যে তিনি ক্রুসেডকালীন সময়ের মুসলিম বীর স্পেন বিজয়ী জেনারেল তারেকের মতাে দারুণ প্রতিভাবান আর সাহসী একজন সেনা অফিসার। সেই রাতের এবং সেই সময়ের একটি চিত্র বর্ণনা করে লি মন্ডে পত্রিকা। বলছে যে পাকিস্তানির সেই ক্রান্তিকালীন সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে তার অফিসারদের যােগাযােগের সমস্যা। কেউ তার সাথে ঠিক মতাে যােগাযােগ করতে পারতেন না। যত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হােক না কেন কারাে পক্ষেই সকাল এগারােটার আগে কিংবা সন্ধ্যা ছয়টার পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করা সম্ভব ছিল না। ডিসেম্বরের সেই সময়গুলাের অবস্থার বিষয়ে একজন পাকিস্তানি দক্ষ সেনা কর্মকর্তা কর্নেল হায়দার হােসেন লাহােরের নাওয়ায়ে ওয়াক্ত পত্রিকায় লিখেছেন: “সেই সময় ইয়াহিয়া খানের কাছে কারাে প্রবেশ ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। তিনি পর পর দুবার তার পিস্তল বের করে জেনারেল পিরজাদাকে। গুলি করতে গিয়েছিলেন। কারণ পিরজাদা তাকে সম্মুখ যুদ্ধের বিষয়ে খারাপ সংবাদ শুনিয়েছিল।

কারণ জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে বােঝানাে হয়েছিল এই সব খারাপ সংবাদ শত্রু পক্ষ ইচ্ছে করেই তাকে বিব্রত করতে আর তার মানসিক দৃঢ়তাকে নষ্ট করার জন্য ছড়াচ্ছিল।’  এই রকম একটা সংবাদ চাউর ছিল যে আমেরিকার উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নিক্সন চাচ্ছিলেন যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান যেন একটা মধ্যপন্থি কোনাে আয়ােজন করেন যাতে করে ভারত তার জড়িয়ে পড়া সংঘর্ষ থেকে বেশ ভালােভাবে বেড়িয়ে আসতে পারে আর কম রক্তক্ষয় হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সেই সময় এতটাই মাতাল ছিলেন যে তার সাথে ফোনে যখন আমেরিকার কূটনৈতিকরা কথা বলছিলেন তখন তিনি অত্যন্ত ঔদ্ধত্যের সাথে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ‘আত্মসমর্পণের আয়ােজনের জন্য তােমাদের বেজন্ম অফিসারগুলাের আমার প্রয়ােজন নেই।’  ঘটনা যাই হােক না কেন সেই সময়ের পরিস্থিতি ক্রমশই পাকিস্তানের দেশপ্রেমিক সৈন্য ও সেনা কর্মকর্তাদের জন্য হতাশাজনক ছিল।  তারা যে কোনােভাবেই হােক একটা সম্মানজনক আত্মসমর্পণের সমাধান খুঁজছিল।  তবে এই গল্পের সবচেয়ে অবাক করা অংশ হলাে ১৯৬৯ সনে পাকিস্তানি সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করার পূর্বে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ছিলেন অত্যন্ত সুপরিচিত আর সুখ্যাতি সম্পন্ন সেনা কর্মকর্তা, একজন দক্ষ প্রশাসক, দয়ালু বাবা, বিশ্বস্ত স্বামী।  ইয়াহিয়া খানের এই উত্থান পতনের পেছনে ছিল একজন পৌরাণিক নেতা। হওয়ার খায়েশ, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান আর লাম্পট্য।  গ্রন্থের পরবর্তী পৃষ্ঠাগুলােতে কীভাবে একজন মানুষের এরকম পরিবর্তন ঘটল এবং একজন হিরােকে কোন চরিত্রগুলাে মূলত একজন ভিলেনে পাল্টে দিল আমরা সেটা বের করার চেষ্টা করব।  

সূত্র : প্রাইভেট লাইফ অফ ইয়াহিয়া খান – দেওয়ান বারীন্দ্রনাথ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!