You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.11.05 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বঙ্গবন্ধুর কায়রো-কুয়েত সফর | চোরাচালান : অর্থনীতিতে ক্ষয় রোগ | কি সহজ সমাধান ! | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৫ই নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১৮ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

বঙ্গবন্ধুর কায়রো-কুয়েত সফর

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিশর ও কুয়েতে ন’দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে আজ কায়রো রওয়ানা হচ্ছেন। পারস্পরিক মৈত্রী বন্ধনকে সুদৃঢ়করণ ও দ্বিপাক্ষিক, মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে মিশর ও কুয়েতের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা এবং মতবিনিময়ের জন্যই বঙ্গবন্ধু সে দেশে যাচ্ছেন।
বঙ্গবন্ধু এমন একটি সময়ে মধ্যপ্রাচ্য সফরে যাচ্ছেন যখন আবার একটা যুদ্ধের পাঁয়তারা সেখানে শুরু হয়েছে। রাবাত শীর্ষ সম্মেলনে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থাকে প্রবাসী সরকার গঠনের অধিকার দেওয়ার পর থেকেই সাম্রাজ্যবাদী মহলে তুমুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংস্থা তথা সেখানকার নিপীড়িত নির্যাতিত জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সহজে মেনে নিতে পারছে না সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ক্রীড়নক ইসরাইল। একদিকে এ অবস্থা অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির দরুণ উন্নয়নকামী দেশগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। উন্নয়নকামী দেশগুলোর আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো খাদ্য সমস্যা। শুধু তাই নয় বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী কাঁচামালের ন্যায্যমূল্য থেকেও উন্নয়নকামী দেশগুলো বঞ্চিত হচ্ছে।
সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশও আলোচ্য সমস্যাগুলোর বাইরে নয়। বাংলাদেশেও রয়েছে সমস্যা ও সংকট। এ সংকট থেকে পরিত্রাণ লাভ করতে হলে বাংলাদেশের প্রয়োজন বন্ধু দেশগুলোর অকুণ্ঠ সাহায্য ও সহযোগিতা।
স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ স্পষ্ট কন্ঠে ঘোষণা করেছে, শান্তিপূর্ণ সহ অবস্থান ও জোটনিরপেক্ষ নীতিই হবে একমাত্র লক্ষ্য। কারো সঙ্গে শত্রুতা নয় সকলের সঙ্গেই বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের এ ভূমিকা বিশ্বের সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে। আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে, লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে এ কারণেই বাংলাদেশ সকলের বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অকুন্ঠ সমর্থন পেয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের প্রশংসায় শুধু পঞ্চমুখই হননি ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলন শেষে তিনি স্বল্পকালীন সফরে বাংলাদেশেও এসেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রীতি ও ‍শুভেচ্ছার বাণী নিয়ে মিশর ও কুয়েতে যাচ্ছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই মিশরীয় বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করেন। আল আহরাম পত্রিকার সাবেক সম্পাদক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক জনাব হাসনাইন হাইকল বাংলাদেশে শুভেচ্ছা সফরে আসেন। স্বীকৃতি দেবার আগেই দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেন-দেন শুরু হয়। বাংলাদেশ নানান সমস্যা সংকটে জর্জরিত হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের সময়ে শুভেচ্ছার নির্দশন স্বরূপ চা পাঠিয়েছে সে দেশে। কুয়েতের সঙ্গেও রয়েছে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি ভ্রাতৃপ্রতীম শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ কুয়েত সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬০ লাখ কুয়েতী দিনার জমা রেখেছে। সম্প্রতি প্যারিসে অনুষ্ঠিত সাহায্য দাতা কনসোর্টিয়ামের বৈঠকেও কুয়েত যোগদান করে। এ কথা নতুন করে উল্লেখ করার কোনো প্রয়োজন পড়ে না যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও সংকট উত্তরণে দু’টি দেশ এগিয়ে আসবেন। প্রসঙ্গতঃ আরো উল্লেখ্য যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন ইতিপূর্বে সৌদী আরব রওয়ানা হয়ে গেছেন। তিনি মিশরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মিলিত হবেন। সৌদী আরব যদিও এখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানায়নি তবু বন্যার্তদের সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুর বর্তমান সফরকালেই সৌদী আরবের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হবার সম্ভাবনা যে নেই এমন নয়। সব দিক বিচার বিশ্লেষণ করে এ কথাই বলা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর বর্তমান সফর নানান দিক দিয়ে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধুর এ সফর সফল হোক, মিশর-কুয়েতের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় হোক এ কামনাই আমরা করছি।

চোরাচালান : অর্থনীতিতে ক্ষয় রোগ

চোরাচালানী প্রসঙ্গে সম্পাদকীয় লেখার অবকাশ বোধ করি আর নেই! জাতীয় অর্থনীতিতে এটা আজ একটি সবচেয়ে মারাত্মক রোগ। দেশের আর্থিক অবস্থাকে ক্ষয় রোগের মতো ক্রমাগত নিঃশেষ করে দিচ্ছে। স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকেই আমরা সীমান্তের চোরাচালানীর বিষয়টি নিয়ে আমাদের সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছি। দেশের অন্যান্য জাতীয় সংবাদপত্রগুলোও এ ব্যাপারে তাদের সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করেছে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক মহলও চোরাচালান রোধের দাবী তুলেছে। সরকার সীমান্তে চোরাচালানী রোধের জন্য নানা প্রকার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যে গ্রহণ করেছেন—তাও সত্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় চোরাচালানী তাতে রোধ হয়নি বরং বেড়েই চলেছে। বস্তুতঃ দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের মুখে চোরাচালানীর মতো আত্মঘাতী ব্যাপার আর নেই। গোটা জাতীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে চোরাচালানীরা। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রে সীমান্তের চোরাচালান সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। গতকালের একটি দৈনিকে এমনি একটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর থেকে প্রেরিত এ সংবাদে বলা হয়েছে যে, দেশের বিভিন্ন এলাকা দিয়ে পাট, চাল, মাছ ইত্যাদি সীমান্তের ওপারে চলে যাচ্ছে, পরিবর্তে ভারত থেকে আসছে লবণ, মরিচ, সূতা, বিড়িপাতা, সুপারী, কাপড়, মসলা ও সাইকেলের যন্ত্রাংশ। এদিকে মেহেরপুর মহকুমার দীর্ঘ তিরিশ মাইল সীমান্ত বরাবর বিনিময় চোরাচালান চলছে। মেহেরপুর শহর থেকে বহুলোক গরুর গাড়ী, সাইকেল ও রিকশা করে লবণ নিয়ে আসছে। এবং বিভিন্ন জেলার মহাজনরা সে লবণ নিয়ে যাচ্ছে। পাচার করে নিয়ে আসার জন্য কর আদায়ের ব্যবস্থাও নাকি রয়েছে। তেমনি বাংলাদেশ থেকে পাট, চাউল ও ইলিশ মাছ পাচার হযে যাচ্ছে। ভারতীয় মুদ্রার তুলনায় বাংলাদেশের টাকার মান অনেক বেশী নেমে গেছে, ফলে চোরাচালানীরা দ্রব্য পাচার করাকে লাভজনক বলে মনে করছে। ঐ একই সংবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সুনামগঞ্জ থেকে প্রেরিত একটি খবরে জানা গেছে যে, সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকা দিয়ে বহু ধান ভাঙার কল স্থাপিত হয়েছে। গরীব চাষীদের কাছ থেকে একশ্রেণীর মহাজনরা দাদনের মাধ্যমে যে ধান ক্রয় করেছিল তা স্বল্পমূল্যে চাল বানিয়ে পাচার করছে। স্বাধীনতার পূর্বে সুনামগঞ্জ সীমান্ত এলাকায় কোনো চালের কল ছিলনা কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে প্রশাসনিক দুর্বলতার দরুণ সীমান্তের আড়াই মাইলের মধ্যে বহু চালের কল বসানো হয়েছে। এর উদ্দেশ্য সবারই জানার কথা। আর একটি খবরে জানা গেছে, কুমিল্লার সীমান্ত দিয়ে প্রচুর পরিমাণে গুঁড়া দুধ পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কেরোসিন ও বিদেশ থেকে আমদানীকৃত যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ সমূহও পাচার হচ্ছে। বস্তুতঃ লাগামহীন চোরাচালানীর এহেন নজির অতীতে আর দেখা যায়নি। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন তা আমরা জানি না। তবে সীমান্তে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বাহিনী নিয়োগ করেও যে তেমন উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যায়নি তা অনুমান সাপেক্ষ। প্রথম থেকে যদি চোরাচালানীর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হতো তাহলে চোরাচালানী এতো বেশী প্রকট হতে পারতো না। অন্যদিকে চোরাচালানীর পেছনে যে সকল রাজ শক্তি কাজ করছে তার বিরুদ্ধে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও অবস্থা এমনভাবে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতোনা। আমরা তবুও দেশের অর্থনীতিকে ক্ষয়রোগের মতো নিঃশেষ করে দেবার এহেন তৎপরতার বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাবো সত্যিকার অর্থে বা যথার্থভাবে চোরাচালানী রোধের একটি ব্যাপক কার্যক্রম প্রণয়ন করার জন্য।

কি সহজ সমাধান !

বাঙালীদের এককালে নেটিভ ছাড়া কথা বলতো না সাদা চামড়ার শাসকরা। কৃষ্ণবর্ণের জন্য অনেক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে তখন তারা থাকতো বঞ্চিত। কিন্তু আজও দেখা যায় বাঙালীদের নেটিভ নাম বাঙালীদের কাছেই ঘোচেনি।
‘কাস্টমস রুল অনুযায়ী বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী কেউ বিদেশ থেকে ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য মদ আনতে পারে না—’ এ কথা শুনলে হঠাৎ করে বাঙালী সম্পর্কে সাদা চামড়াধারীদের নির্মম মন্তব্যকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। পত্রিকান্তরের প্রতিবেদনে জানা যায়, একজন বিদেশ প্রত্যাগত বাঙালী দু’টো হুইস্কির বোতল নিয়ে ঢাকা বিমান বন্দরে নামলে কাস্টমস থেকে তাকে ঐ কথাগুলো বলা হয়।
এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন একই সঙ্গে মনে আসে। প্রথমতঃ দেশে বাঙালীদের জন্য কি মদ নিষিদ্ধ? দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ব্যক্তির কাছ থেকে মদের বোতল দু’টো ছিনিয়ে নিয়ে সৎ কাস্টমস বিভাগ তার যে সদ্ব্যবহার করতেন—তার কি কোনো হদিস আমরা পেতাম? তৃতীয়তঃ সাদা চামড়ার লোক মদের বোতল বোগলদাবা করে অনায়াসে আনতে পারবে, পারবে না কেবল বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ব্যক্তি—এ কেমন কাস্টমস বিধি? চতুর্থতঃ কাস্টমস বিধি কি তাহলে আজও অবিন্যস্ত না সেখানেও নেভিটদের জন্য ভিন্ন আইন সময় বুঝে আরোপ করা হয়?
উত্তরগুলো না জানা সত্ত্বেও দেখা গেছে বাংলাদেশের পাসপোর্টধারী ব্যক্তিটি শুধু মদ আনেনইনি, সর্বসমক্ষে দু’টি পুরো বোতল মদ ঢক ঢক করে খেয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, এ কাজ নেটিভ বাঙালীও পারে। এবং খালি বোতল দু’টো কাস্টমস-এ জমা দিয়ে আইনের মারপ্যাঁচ থেকেও তিনি উদ্ধার পেয়েছেন। আহা এমনি বুদ্ধি, তৎপরতা সব বাঙালীই আজ অর্জন করতে প্রয়াস পেতো—তাহলে অনেক ভুয়া আইনের মারপ্যাঁচ বাঁচিয়ে নিজেরা ও তারা বেঁচে থাকতে পারতো এবং অপরদিকে সম্ভব হতো সুবিধাবাদীদের ভোতা মুখ থোতা করে দেওয়া। এবং তাহলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান হয়ে যেতো, অহেতুক জটিলতার আবর্ত থেকে আমরা অনেকাংশে রক্ষা পেতাম। রাষ্ট্রীয় জীবনের সমস্যাক্রান্তির জন্য যা আজ একান্তই আবশ্যই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন