You dont have javascript enabled! Please enable it! পতাকার প্রতি প্রণােদনা - মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া - সংগ্রামের নোটবুক

পতাকার প্রতি প্রণােদনা

মাতৃভূমি এবং মাতৃভূমির পতাকা- এ দুয়ের প্রতি ভালােবাসা, দেশের প্রতি ভালােবাসা থেকেই উৎসারিত এবং বাস্তবিক অর্থে ভালােবাসার এ প্রকরণ অবিভাজ্য। পতাকার প্রতি সম্মান বা অসম্মান দেশের প্রতি সম্মান বা অসম্মান হিসেবেই গণ্য করা হয়। দেশ ছাড়া যেমন জাতীয় পতাকা হয় না তেমনি তার উল্টোটাও সত্য, স্বাধীন দেশের একটি পতাকা থাকা অপরিহার্য। ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা বর্ণিত দেশ স্থাবর বলে তাকে এবং তার মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করে তার পতাকা। দূতাবাস সীমানা নিজের দেশ বিবেচিত হয় বলে সেখানে উড়ানাে হয় সে দেশের পতাকা এবং অতিথি দেশের কোনাে আইন সেখানে প্রযােজ্য হয় একাত্তরের কথা বলি। উত্তাল মার্চের ২ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে ডাকসুর নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রদের উপস্থিতিতে আসম আবদুর রব বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৩ মার্চ পূর্বেকার ‘পাকিস্তান দিবস’কে আওয়ামী লীগের নির্দেশে প্রতিরােধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। কুমিল্লার ছেলে শিব নারায়ণ দাস পতাকাটির নকশা তৈরি করেন। ২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে উড্ডীন ছিল মানচিত্র আঁকা এ পতাকা। কোনােরকম আনুষ্ঠানিক অনুমােদন ছাড়াই এ পতাকাটি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (মুজিবনগর) বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে মানচিত্র আঁকা পতাকাটি উড্ডয়ন করা হয়। এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পতাকাটি সরকারি স্বীকৃতি ও অনুমােদন লাভ করে। অতঃপর বাংলাদেশ সরকারের সদর দফতরেও (কলকাতার ৮ থিয়েটার রােড- বর্তমানে শেকসপিয়ার সরণী) পতাকাটি সরকারিভাবে উড়ানাে হতাে।

২৫শে মার্চ একাত্তরের পর পাকিস্তানি নামের কিছু ইতরের কাছে দেশটার কতৃত্ব চলে যায়। আমরা বাংলাদেশীরা ওদের সশস্ত্র বর্বরতায় অধিকারহীন হয়ে গেলাম। প্রায় ১ কোটি লােক ভারতে আশ্রয়প্রার্থী হল। আমরা মুক্তিযােদ্ধারা মে মাসের মাঝামাঝি সময়ের পর প্রশিক্ষণ ও পুনঃসংগঠনের জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। দেশ নেই, আমরা দেশের পতাকা নিয়ে ঘুরছি। পতাকা নিয়ে ঘুরছি একটি দেশ পাওয়ার জন্য। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প বেশিরভাগই ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতাে। ভােরে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে শুরু হতাে প্রশিক্ষণ। কিছু প্রত্যন্ত ক্যাম্পে পতাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি শুরুতে। আসামের জোয়াইয়ের কাছে মােপিয়াডে ছিল তেমনি একটি ক্যাম্প। ক্যাম্পটি পরিচালনা করত ৫/৫ ঘূর্খা রেজিমেন্ট। প্রশিক্ষণার্থী ছেলেদের প্রচণ্ড দাবি সত্ত্বেও পতাকা জোগাড় হয়নি। অগত্যা দেশাত্মবােধক গান গেয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হতাে। একদিন রাতে খবর হলাে যে, পতাকা সগ্রহ করা হয়েছে। পরদিন ভাের থেকে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ শুরু হবে। আনন্দের সংবাদ। কিন্তু কতাে আনন্দের সংবাদ। এতই আনন্দের সংবাদ যে, উত্তেজনায় একটি ছেলেও সারারাত ঘুমায়নি। ভাের হলাে। ছেলেরা ‘ফল ইন’ হল। কারও গায়ে গেঞ্জি, লুঙ্গি কাছা মারা; কারও পরনে হাফপ্যান্ট, শার্ট; কেউ খালি গা, খালি পা। প্রতীক্ষিত ক্ষণ এলাে। দ্বিজেন্দ্র লাল রায়ের ধন ধান্য পুষ্পে ভরা, আমাদেরই বসুন্ধরা…’ গানের সঙ্গে পতাকা। উঠছে। যখন গানের এই অংশ ‘ভায়ের মায়ের এত স্নেহ/কোথায় গেলে পাবে কেহ/ওমা তােমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি/আমার এই দেশেতে জন্ম যেন/এই দেশেতে মরি’ গাওয়া হচ্ছিল প্রত্যেকটি ছেলের কপােল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। সেদিন স্বাধীনতা হারিয়ে আমরা বুঝেছিলাম স্বাধীনতা কাকে বলে।

তারও আগের কথা। ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বিএসএফ আমাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে পতাকা তুলতে আপত্তি জানায়। তাদের যুক্তি-এটি ভিন্ন দেশের পতাকা, যেখানে-সেখানে যখন-তখন উড়ানাে যাবে না। আমরা বলেছি এটি যে দেশের পতাকা সে দেশকে তােমাদের সরকার এখনও স্বীকৃতি দেয়নি, কাজেই তােমাদের যুক্তি টিকছে না। তারপরও পতাকা উত্তোলনের বিষয়ে তােমাদের আপত্তি থাকলে আমরা তােমাদের দেশ ছেড়ে চলে যাবাে, কিন্তু আমরা পতাকা ছাড়বাে না।  কুড়িগ্রামের রৌমারী থানা ছিল মুক্তাঞ্চল। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা বহু চেষ্টা করেও রৌমারী তাদের আয়ত্তে নিতে পারেনি। যমুনা নদীর পূর্ব প্রান্তে কোদালকাঠিতে ভয়াবহ যুদ্ধ হয়। বহু মৃতদেহ গুনতে হয় পাকিস্তানিদের। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ অসংখ্য মৃতদেহ কোদালকাঠিতে ফেলে তারা যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ে চিলমারী পশ্চাদপসরণ করে। চিলমারী পানি উন্নয়ন বাের্ডের এলাকায় ছিল তাদের ঘাঁটি। সেপ্টেম্বরের ৯ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত আমেরিকান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশনের ক্যাপ্টেন রবার্ট রজার্স তার দল নিয়ে রৌমারি মুক্তাঞ্চল সফর করেন। সেখানে ছবি তােলেন মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ একাডেমীর এবং মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের। এক পর্যায়ে তারা পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধের ছবিও তুলতে চান। ক্যাপ্টেন রবার্ট রজার্স আমেরিকার পক্ষে ভিয়েতনামে যুদ্ধ করেন সত্তর দশকের শুরুতে। মুক্তিযােদ্ধাদের তাই তেমন গুরুত্ব সহকারে * দেখছিলেন না। নৌকায় করে তাদের নদীর অপর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।  (পরবর্তী সময়ে বীর বিক্রম) বাঁশের মাচা বানিয়ে তাকে উপরে বসান। তারপর পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলা নিক্ষেপের আদেশ দেন। শুরু হয় তুমুল গােলাগুলি। ক্যাপ্টেন রবার্ট তখন নামার জন্য অস্থির। নিজে নিজেই লাফিয়ে পড়েন মাচার ওপর থেকে। বাঁশের কঞ্চির আঁচড়ে তার সাদা চামড়া ছিড়ে রক্ত ঝরছে।

সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই। লাফ দিয়ে বেচারা পড়েন গােবরের গর্তে। সে এক দৃশ্য। বারবার বলতে থাকেন, ভিয়েতনামেও এমন ভয়াবহ যুদ্ধ হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের দক্ষতা আর যােগ্যতার ওপর তার আস্থা বাড়ে। এরপর পাকিস্তান আর্মির প্রহরায় তারা চলে যান চিলমারী পাকিস্তানি ক্যাম্পে। সেখানে তারা দেখতে পান এক অদ্ভুত দৃশ্য। পাকিস্তানি ক্যাম্পে উড্ডীন পাকিস্তানি পতাকাটি একটি কাক ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে টুকরাে টুকরাে করছে। দৃশ্যটি তারা ধারণ করেন ক্যামেরায়। এটা সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের ঘটনা। সব নিয়ে তারা একটি বিখ্যাত ছবি তৈরি করেন “দি কান্ট্রি মেড ফর ডিজাস্টার’। বাংলার কাকও বুঝেছিলাে এই পতাকাটিই সব নষ্টের মূল।  একটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে ৪টি রাইফেল কোম্পানি ও একটি হেডকোয়ার্টার কোম্পানি থাকে। রাইফেল কোম্পানিগুলাে এ বি সি ও ডি কোম্পানি বা আলফা, ব্রাভাে, চার্লি, ডেলটা কোম্পানি। শুধু মুক্তিযুদ্ধের সময় গণযােদ্ধাদের সমন্বয়ে ই বা ইকো কোম্পানি নামে আরেকটি কোম্পানি গঠন করা হয়। ৪ ডিসেম্বর সকালে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মৌলভীবাজারের ভানুগাছ আক্রমণ করে। আর্টিলারি ফায়ার সহায়তা দেয় বাংলাদেশের ২ ফিল্ড ব্যাটারি ১০৫ মি.মি, কামান দ্বারা। পাকিস্তানিরা পরাজিত হয়ে পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। আমাদের যােদ্ধারা তাদের পিছু ধাওয়া করে। কেউই খেয়াল করেনি ভানুগাছ থানায় তখনও পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে। ইকো কোম্পানির ১৪/১৫ বছরের এক কিশাের এই যুদ্ধের মধ্যেই বাংলাদেশের এক পতাকা কোথেকে জোগাড় করে। শত্রু কভারিং ফায়ারের মাধ্যমে পিছু হটছে। ছেলেটি কোনাে কিছু হৃক্ষেপ না করে কাউকে কিছু না জানিয়ে পােল বেয়ে উপরে উঠে গেলাে। পাকিস্তানি পতাকাটি নামিয়ে সে বাংলাদেশের পতাকাটি উড়িয়ে দিল। লাগানাে শেষ, অমনি শত্রুর এক ঝাক গুলি তাকে ভেদ করে যায়। ছেলেটি ধপ করে ওপর থেকে পড়ে। [পাকিস্তানি ক্রিকেট দল ঢাকা যখন আসে তখন আমাদের ছেলেমেয়েদের তাদের ক্রিকেট দলের সমর্থক হিসেবে। গালে পাকিস্তানি পতাকা আঁকা দেখেছি। কষ্টে বুকটা ভারি হয়ে গিয়েছিলাে। বাস্তবিক অর্থেই শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। যারা গালে পতাকা এঁকেছিল তারা এখন একটু বড় হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধা এ বুড়াে মানুষটার কষ্ট পাওয়ার কারণ জানলে জানিও।

এই পতাকা নিয়ে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধ জয় করে রাইফেলের নলে এই পতাকা দিয়ে বিজয় কেতন উড়িয়েছি। কদাচিৎ সুযােগ হতাে যদিও, এই পতাকা দিয়ে গুলিবিদ্ধ শহীদের পবিত্র শরীর আবৃত করেছি। ১৬ই ডিসেম্বর এ পতাকা দিয়ে দেশ ছেয়ে ফেলেছে মানুষ, পাকিস্তানিদের অত্যাচারের পরও এতাে পতাকা জনগণ কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলাে। ১৯৭২ সালের ৩১শে অক্টোবর প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার ১৩১-এর মাধ্যমে জাতীয় পতাকা থেকে মানচিত্র তুলে দেয়া হয়। কিন্তু পতাকাটি রয়ে গেল মনের গহীনে, হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। পতাকার প্রতি সে আমাদের প্রথম প্রেম। প্রথম ভালােলাগাগুলাে সে শৈশব, কৈশোের আর যৌবনেরই হােক, ভােলা যায় না। এ জাতির সবচেয়ে সংকটময় মুহূর্তের পতাকা ভুলি কী করে?  আজকের লাল-সবুজের পতাকাটি চোখে পড়লেই মনে আসে আমার প্রিয় মাতৃভূমি-বাংলাদেশ। আর মানচিত্র আঁকা পতাকাটি দেখলে দৃশ্যমান হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ- আমাদের আজনমের অহংকার। সরকারি নিয়মানুযায়ী মুক্তিযােদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানে সমাহিত করা হয়, কফিনের উপরে থাকে জাতীয় পতাকার আচ্ছাদন। আমার একান্ত ইচ্ছা আমার মৃত্যুর পর আমি আবৃত হই আমাদের মানচিত্র আঁকা পতাকা দ্বারা। এ পতাকাটির প্রতি আমার ভালােবাসা অতি গাঢ়। এ পতাকার প্রতি আমার প্রণােদনা যেনো পূরণ হয় আমার মরণে।

সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)