শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের শেষ চিঠি
যেকোনাে যুদ্ধ, যতাে নৈতিক বা যতাে অনৈতিক হােক না কেন, যুদ্ধরত সৈনিকদের দাড় করিয়ে দেয় মৃত্যুর দুয়ারে। এটা বাস্তব যে, যুদ্ধে সবাই মরে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটি সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, ১৫ হাজার উড়ন্ত গুলির মাত্র ১৫ শতাংশ অপর পক্ষের সৈন্যদের গায়ে লাগে। এই ১৫ শতাংশের মাত্র পাঁচজন মারা যায়। বাকিরা আহত হয়। এই হতাহতের অনুপাত যতই কম হােক, যুদ্ধের মুহূর্তটি থাকে অনিশ্চয়তায় ভরা, সবচেয়ে বেশি থাকে শক্রর ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে। দেখা গেছে, আক্রমণে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে কেউ মনােযােগ দিয়ে কোরআন শরিফ পড়ছে, কেউ গাছের নিচে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে চোখের পানি ফেলে দীর্ঘ মােনাজাত করছে। কেউ সহযােদ্ধাদের কাছে জীবনের শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করছে, তার মাকে যেন দেখে, শিশুসন্তানদের দায়িত্ব যেন নেয়। এমনও দেখেছি, প্রিয়তমার কাছে গভীর মনোেযােগর সঙ্গে চিঠি লিখছে যােদ্ধা, যদিও সে জানে, যুদ্ধের মাঠ থেকে চিঠি ডাকে দেওয়া যাবে না। কোনাে কিশােরযােদ্ধা আবেগভরে চিঠি লিখছে মা-বাবার কাছে। যদি না ফিরি’, শেষ কথাটি বলে যাওয়ার শেষ প্রয়াস। সেকেন্ড লে. খন্দকার আজিজুল ইসলামের ডাক নাম বাবুল। একাত্তরের মার্চে ঢাকা কলেজে বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৩ এপ্রিল মাকে বুঝিয়ে ঘর ত্যাগ করেন দেশ পাবার আশায়। যােগ দেন মেজর খালেদ মােশাররফের অধীনে মেলাঘরে ২ নম্বর সেক্টরে। মে মাসে ঢাকা শহরে অপারেশনে আসেন। সেই সময় (সম্ভবত মে মাসের শেষদিকে বড় ভাই নজরুল ইসলামের কাছে লেখা একটি চিঠি রেখে যান বাসায়।) ২২শে এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবার কাছে চন্দ্রপুরে পাকিস্তানি অবস্থান দখল করতে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে শহীদ হন সে, লে, আজিজ ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সাথে। (বাবুলদের অগস্তযাত্রা দ্রষ্টব্য)। সে, লে, খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রমের সেই প্রত্যয়দীপ্ত চিঠি :
১৯শে মে ১৯৭১ ভাইজান, আমার সালাম নেবেন। ভাবীজানকে বলবেন, অপারেশনে এসে ঢাকায় আত্মগােপন করে থাকার সময় তিনি আমার জন্য যা করেছেন ভুলবাে না। বিবর ঘাটিতে দুশমনের প্রত্যাশায় বসে বার বার মনে পড়ে ভাবীর দু’টো কথা, যে দেশকে ভালবাসতে শিখলাে না তার জীবন বৃথা। জানি দেশের সুবিধা শিকারী। রাজনীতিকদের কথা ভাবী বলতে চান। আমরা শুধু খান সেনাদের খতম করছি না, ওদেরকেও খতম করছি। মনে আশা ছিল ঢাকায় থাকার সময় আম্মাকে দেখতে পাব। খবরও দিয়েছিলাম। আম্মা বাড়ী থেকে এলেন না। দেখা হলাে না। তবে আমি আরেকটি মায়ের মুখ দেখেছি। সে আমার দেশমাতৃকার মুখ। মায়ের মুখের অভিযােগ বাংলা মায়ের মুখে শুনেছি। না না ভাইজান। বাবুল বদলা নেবে, কুর্মিটোরায় তার মা বােনকে বাস থেকে পথে নামানাের প্রতিশােধ নেবে। নেবে বাঙ্গালী জাতটাকে ধ্বংস করার যড়যন্ত্রের প্রতিশোেধ। বদলা নেবে লক্ষ লক্ষ শহীদ ভাইয়ের খুনের। অগণিত বােনের সে. লে. খন্দকার আজিজুল ইসলাম বীর বিক্রম অপমানের। বাবুল ওদের নির্মূল করবে। নইলে আমাদের জীবন অর্থহীন। আর গােলাম নয়, কলােনীর বাসিন্দা নয়। আমরা এবার মাথা তুলে দাঁড়াবাে। দুনিয়া দেখবে আমরা কি মহাশক্তির অধিকারী। ভাইজান, দুঃখ করবেন না। হতাশা নয়। আমি মুক্তিবাহিনীর প্রতিটি ভাইয়ের। মুখে দেখেছি আগুন। এ আগুন জ্বলেছিল জর্জ ওয়াশিংটনের আমেরিকায়, লেলিনের বাশিয়ায়, মাওয়ের চীনে। সেই আগুন জ্বলেছে বঙ্গবন্ধুর বাংলায়। আর নয়, আমরা জয়ের বরমালা পরবােই। জানিনা সেই হর্ষোৎফুল্ল জনতার ভীড়ে আমিও থাকবাে কিনা। না থাকলেও প্রতিটি স্বাধীন বাংলাদেশের তরুণের মুখে আমার মুখটি খুঁজবেন। এক বাবুল লক্ষ বাবুল হয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবে। | ভাইজান, শুধু দোয়া করবেন আপনারা। ইতিলাঞ্ছিতা বাংলা মায়ের সন্তান। আপনাদের বাবুল পাঁচ নম্বরের একটি সাব-সেক্টর বারসােরা। সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মাে. মােসলেমউদ্দিন। তিনি সাব-সেক্টরের সাঙ্কেতিক নাম দিয়েছেন ‘বু শার্টস’।
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ থানার সাচনায় পাকিস্তানিদের শক্ত অবস্থান। কেবল বারসােরা সাব-সেক্টরেই নয়, গােটা পাঁচ নম্বর সেক্টরের প্রায় সবাই ছিল গণযােদ্ধা, গা-গেরামের খেটে খাওয়া মানুষ, ছাত্রজনতা। যুদ্ধের কোনাে অভিজ্ঞতার নেই তাদের। সামান্য প্রশিক্ষণ আছে কয়েকজনের, তাও কয়েক সপ্তাহের। বাকিরা যুদ্ধ করেই যুদ্ধ শিখেছে। অতীতে সাচনা দখল করার চেষ্টা করা হয় দুইবার। সম্ভব হয়নি। তৃতীয়বার ৮ আগস্ট চূড়ান্ত আক্রমণ পরিকল্পনা করা হয়। মাে. সিরাজুল ইসলাম এ আক্রমণের একজন গণযােদ্ধা। সিরাজুল ইসলাম সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। সহযােদ্ধারা তাকে একজন সাহসী যােদ্ধা হিসেবেই জানে। বিভিন্ন যুদ্ধে তার কৃত্য আর ঋজুতা তাকে এ পরিচিতি দিয়েছে।
৮ আগস্টের আক্রমণ সফল হয় মুক্তিযােদ্ধাদের। সাচনায় পাকিস্তানি অবস্থান দখল করা সম্ভব হয়। এ আক্রমণের নেতৃত্ব দেয় সিরাজুল। ৩০ জুলাই সিরাজুল একটি চিঠি লেখে তার বাবার কাছে। সাচনার শক্রর অবস্থান দখল করে সিরাজুল ফেরেনি। নেতৃত্ব দিয়ে শাহাদত বরণ করে সে। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে মাে. সিরাজুল ইসলামের বাবা সিরাজুলের লেখা চিঠিটি নিয়ে আসেন মেজর মােসলেমউদ্দিনের কাছে। মেজর মােসলেমউদ্দিন শহীদ সিরাজুলের প্রত্যয়দীপ্ত ও আবেগময় চিঠিটি বিভিন্ন ক্যাম্পে মুক্তিযােদ্ধাদের পড়ে শােনাতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের শিরায় তখন প্রবাহিত হতাে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করার স্পৃহা। ভিন্ন চিঠিতে তিনি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার ইন চিফকে সিরাজুলের চিঠির অনুলিপি দিয়ে চিঠিটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ে শােনানাের অনুরােধ জানান। শহীদ মাে. সিরাজুল ইসলামের চিঠি :
টেকেরঘাট হইতে
তারিখ ৩০-৭-৭১ ইং প্রিয় আব্বাজান,
আমার ছালাম নিবেন। আশা করি খােদার কৃপায় ভালােই আছেন। বাড়ির সকলেরই কাছে আমার শ্রেণীমতাে ছালাম ও স্নেহ রইল। বর্তমানে যুদ্ধে আছি। আলী, রাজা, রওশন, মাত্তাব, রেনু, ইব্রাহীম, ফুলমিয়া সকলেই একত্রে আছি। জীবনকে তুচ্ছ মনে করি, কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোনও মূল্য থাকবে না। তাই যুদ্ধই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে। চাচা, মামাদের ও বড় ভাইদের নিকট আমার ছালাম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যােগদান দিতে নিষেধ করবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিবেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোনও সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্রহারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোনাে কারণ নাই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের
মতাে শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সকল সাধ মিটে যাবে।
দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মির্জাফরী করিও না। কারণ মুক্তিফৌজ তােমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাংলায় তােমাদের জায়গা দিবে না।
ছালাম, দেশবাসী ছালাম। ইতি মাে. সিরাজুল ইসলাম
৩০ জুলাই রাত ৩টা ৩০ মিনিটে প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের দুই কোম্পানি ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে আক্রমণ করে কামালপুরের পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষাদুর্গ। আক্রমণকারী যযাদ্ধাদের প্রায় ৮০ ভাগই ছিল সদ্য ভর্তি করা সাধারণ গ্রামের ছেলে। মাত্র ছয় সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিয়ে তারা শত্রুঅবস্থান প্রায় দখল করে ফেলে। সালাউদ্দিন পৌছে যান শক্রর বাঙ্কারের কাছে। ঠিক তখনই শক্রর গােলা আঘাত করে তাকে। সহযােদ্ধারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার কাছে দৌড়ে আসে। বলে, স্যার কলেমা পড়েন। মৃত্যুঞ্জয়ী যােদ্ধা উত্তর দেন, আমার কলেমা আমি পড়বাে, খােদার কসম, তােরা কেউ পিছু হটবি না। তারপর বিড়বিড় করে স্তিমিত স্বরে বলতে থাকেন, মরতে হয় শত্রুদের মেরে মর, বাংলাদেশের মাটিতে মর। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের নিথর দেহ আনতে গিয়ে প্রাণ দেয় সিপাই হায়াত আলি ও সিপাই সিরাজুল ইসলাম। শক্রর বাঙ্কারের সামনে। থেকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের মৃতদেহ আনা আর সম্ভব হয়নি।
২১ জুলাই ২০০৫, বৃহস্পতিবার। মেজর জেনারেল কাজী মােহাম্মদ সফিউল্লার বাসায় গেছি মুক্তিযুদ্ধের অপ্রকাশিত কিছু তথ্য নিয়ে আলাপ করতে। জেনারেল সফিউল্লা মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত তিনটি ব্রিগেডের একটির (এস ফোর্স, জেড ফোর্স এবং কে ফোর্স) একমাত্র জীবিত ব্রিগেড কমান্ডার। কথায় কথায় বললাম, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্য কামালপুর যুদ্ধের ওপর একটি ডকু-ফিচার ছবি বানিয়েছি। তিনি বললেন, সালাউদ্দিনকে দেখিয়েছ? আমি বললাম, স্যার, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ কামালপুর যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তাকে ছাড়া তাে কামালপুর যুদ্ধের কোনাে ছবিই হয় না। আমাদের সব সাধ্য দিয়ে ওনার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ সাহস, বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে দেখানাের চেষ্টা।
বীর উত্তম
করেছি। বিশেষ করে তার গৌরবদীপ্ত মৃত্যুদৃশ্য। আমি প্রশ্ন করলাম, আপনি সালাউদ্দিনকে চেনেন কীভাবে? ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের আর আপনি ২য় ইস্ট বেঙ্গলের। মনে হয় চাকরিও করেননি তিনি আপনার সঙ্গে। যুদ্ধের সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কোলকাতায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তরে যােগ দেন ৩ জুলাই। আর আপনি তখন সিলেট এলাকায় তিন নম্বর সেক্টর কমান্ড করছেন। জেনারেল সফিউল্লাহ হঠাৎ নীরব হয়ে গেলেন। স্বাভাবিক আলােচনার আনন্দঘন পরিবেশ মিলিয়ে গেলাে। মিনিট খানেক পর মুখ খুললেন তিনি। ১৯৭০ সালে কোয়েটায় সালাউদ্দিন যখন স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসে জুনিয়র টেকটিক্যাল কোর্স (জেটিসি) করছিল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে, তখন থেকেই আমি ওকে জানতাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় জুলাইয়ের ১২ থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত কলকাতায় সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তরে আমাদের সিনিয়র অফিসারদের একটি সম্মেলন ছিলাে। সালাউদ্দিন তখন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসে ওখানে। অপেক্ষা করছিল। পােস্টিংয়ের জন্য। দুই দিন দীর্ঘক্ষণ আলাপ হয় ওর সঙ্গে। দুদিনের আলাপেই আমি ওর দেশপ্রেম এবং পেশাগত জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে যাই। আমি মনে ও মুখে ওর সাফল্য কামনা করি। আমরা কলকাতায় থাকতেই সালাউদ্দিন চলে যায় মেঘালয়ের তেলঢালায় ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। আমি চলে যাই সেক্টরে। আগস্টের ১ বা ২ তারিখে শুনলাম ৩১ জুলাই ভােরে সালাউদ্দিন কামালপুর যুদ্ধে শহীদ হয়েছে। যুদ্ধে সৈন্যরা মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সালাউদ্দিনের মৃত্যু কোনােভাবেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না।
তিনি বলছিলেন, নভেম্বরের ১৭ তারিখ ছিলাে শবে কদর। সে রাতে সেহরি খেয়ে ঘুমিয়েছি। শেষ রাতে একটি দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলাে। স্বপ্নে দেখছি, আমি একটা চৌকিতে চোখ খুলে চিত হয়ে শুয়ে আছি। আমার মাথা যেদিকে তার বিপরীত দিকে ঘরের দরজা। হঠাৎ দেখি, মলিন চেহারা নিয়ে অতি ধীর পায়ে সালাউদ্দিন টুকছে। আমি অবাক। তাহলে কি কামালপুরের যুদ্ধে ও মারা যায়নি। এরই মধ্যে এক পা-দুই পা করে এগিয়ে সালাউদ্দিন পাশে এসে দাঁড়ালাে। আমাকে বললাে, স্যাব একটু সরেন, আমি শােব। পাশে শুয়ে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমাকে বললাে, স্যার দেখলেন, আমাকে না নিয়েই সবাই চলে এল, আমাকে কেউ আনলাে। একটু বিরতি দিয়ে আবারও বললাে, স্যার দেখলেন, আমাকে না নিয়েই সবাই চলে এলাে। | ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে অক্টোবরের ১০ তারিখ মেঘালয়ের তেলঢালা থেকে সিলেটের বিপরীত দিকে নিপুরা রাজ্যের আমবাসায় পৌছেছে। জেনারেল শফিউল্লার ঘুম ভেঙে যায়। চোখে পানি। ভাের হতেই তিনি হেজামুরায় তার সেক্টর হেডকোয়ার্টার থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যান ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আমবাসায়। অধিনায়ক মেজর জিয়াউদ্দিনকে না পেয়ে ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারীকে স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনিয়ে অনুরােধ করেন, একটি মিলাদ দিয়ে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের রুহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করতে।
কোয়েটায় কোর্স করার সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ শেষ চিঠি লেখেন তার মায়ের কাছে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের চিঠি :
Capt Salauddin Momtaz School of Infantry And Tactics
JTC-6 ‘A’ MESS
Quetta
8.3.70 শ্রদ্ধেয় আম্মাজান,
আমার ছালাম নিবেন। আমি কোয়েটাতে আছি একটা Course (কোর্স) করছি। আপনাকে অনেক দিন পত্র লিখি নাই। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি ভালাে আছি। আমার জন্য আল্লার কাছে দোয়া করবেন, যেন আমি কোর্সে First আসতে পারি। দূরে আসলে আপনাকে যে কত মনে পড়ে তা একমাত্র খােদা জানে। আমি আপনার অধম সন্তান, আপনাকে আজ পর্যন্ত দুটো কথা দিয়েও সন্তুষ্ট করতে পারি নাই। তারেক, নাজমু, জুলেখা, কামরুন ও সােহেলাকে আমার দোয়া জানাবেন। ডলু ও নুনুর Address টা জানাবেন। আমি ভালাে আছি, দোন্ন করবেন।
ইতি আপনার বাবর
চার, দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আগে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ শপথ গ্রহণ করাতেন প্রত্যেকের হাতে এক মুঠ মাটি দিয়ে। এ মাটি বাংলাদেশ থেকে আনা মাতৃভূমির মাটি। তিনি বলতেন, তােমাদের হাতে বাংলাদেশের শুধু এক মুঠ মাটি। আমাদের দরকার গােটা বাংলাদেশের মাটি। ছেলেরা দেশপ্রেমের এক প্রগাঢ় মমতায় আরাে প্রত্যয়ী হয়ে উঠতাে। এই মেজর খালেদই যােদ্ধাদের বলতেন, আমি তােমাদের দেশপ্রেম শেখাবাে না। দেশপ্রেম তােমাদের এমনিতেই আছে, তা না হলে তােমরা এখানে আসতে না। আমার কাজ তােমাদের যুদ্ধ শেখানাে। মেজর খালেদ মােশাররফ ছিলেন যুদ্ধউদ্দীপনা জাগানাের এক জাদুকর। তার কথায় ও কাজে মােহবিষ্ট হয়ে যেতাে। ছেলেরা। মাঠে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে বলতেন, যেভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে সৈনিক তৈরি করতে হয় সে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় ও সুযােগ আমার নেই। যুদ্ধের মাঠই তােমাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি। যুদ্ধ করেই তােমাদের যুদ্ধ শিখতে হবে। সামান্য।
প্রশিক্ষণ এবং কোনাে অভিজ্ঞতা ছাড়াই যুদ্ধ করেছে আমাদের ছেলেরা। যুদ্ধ করেছে মাতৃভূমির প্রতি অপার ভালােবাসায়। যুদ্ধে ভুল করেই যুদ্ধ শিখেছে। আমাদের ছেলেরা। কখনাে মারাত্মক ভুলের মাশুল দিতে হয়েছে প্রাণ দিয়ে।
একাত্তরে ননায়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়ি বাঁধের ওপর এক ভুল করা যুদ্ধে জড়িয়ে যায় মুক্তিযােদ্ধারা। প্রয়ােজনীয় রেকি না করেই তারা তাদের ক্যাম্প স্থানান্তর করতে যায় কাচারীহাট। পাকিস্তানিরা পাকবাজার (এখন বাংলাবাজার) এবং বামনীবাজার দুই দিক থেকে আক্রমণ করে। কমান্ডার আবদুর রাজ্জাকের তখন ১০৫ ডিগ্রি জ্বর। কমান্ড করছিল তার উপঅধিনায়ক সালেহ আহমেদ মজুমদার। মুক্তিযােদ্ধারা ঘুরে দাঁড়ায়। তাদের প্রতিআক্রমণে শত্রু রণে ভঙ্গ দেয়। কিন্তু ততােক্ষণে ভুলের মাশুল চড়া হয়ে গেছে।
চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র আমানুল্লাহ চৌধুরী (ফারুক)। জন্ম : ৫ই মে ১৯৫৪। কোনাে ক্লাসেই সেকেন্ড হয়নি কখনাে। বাড়ি নােয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ থানার অম্বরনগর গ্রামের মিয়াবাড়ি। বাবা হালিমউল্লাহ চৌধুরীর বড় ছেলে। উপ-অধিনায়ক সালেহ আহমেদ মজুমদার, বুলু, ফারুক, আখতারুজ্জামান বাবু ও ইসমাইল শহীদ হয়। ১৭ জনের দলের পাঁচজনই শহীদ। মৃত্যুর কদিন আগে ফারুক এক প্রত্যয়দীপ্ত চিঠি লেখে তার বাবার কাছে। শেষে চেয়েছিল দোয়া। নদীতে জোয়ার আসে একটু পরেই। মারাত্মক আহত অবস্থায় ফারুক জোয়ারের পানিতে আটকে যায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সাঁতারাতেও পারছে না। সহযােদ্ধারা অস্ত্রটি ফেলে দিয়ে সাঁতরাতে বলে। ফারুক অস্ত্র ফেলতে নারাজ। জোয়ার ও নিয়তি দুই-ই তখন ফারুকের বিপক্ষে। জোয়ারের পানি ভাসিয়ে নিয়ে যায় ফারুককে বঙ্গোপসাগরে।
বাবার কাছে লেখা ফারুকের চিঠি : জয়তু ফারুক
তাং ২৩-০৫-১৯৭১ ইং। জনাব বাবাজান
আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদৃপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসাবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলার বুকে বর্গী নেমেছে। বাংলার নিরীহ জনতার ওপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে তা জানা সত্ত্বেও আমি বিগত এক মাস পঁচিশ দিন যাবৎ ঘরের মধ্যে বিলাস বাসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি আজ সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্যে যাত্রা শুরু করলাম। সমগ্র বাঙ্গালিরা যেন আমায় ক্ষমা করতে পারেন। আপনি হয়তাে দুঃখ পাবেন। দুঃখ পাওয়ারই কথা। যে সন্তানকে দীর্ঘ যােল বছর ধরে তিন তিল করে হাতে কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপানের আঘাত হেনেছে, যে ছেলে আপনাকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি। অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বারংবার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেন। আপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবত একটি মাত্র কারণে যে, আপনার বুকে পুত্র বাৎসলের রয়েছে প্রবল আকর্ষণ। আজ যদি আপনার জ্যেষ্ঠ পুত্র ফারুক স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, তাহলে আপনি কি দুঃখ পাবেন বাবা? আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে কারণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতা।
আর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতা। গাজী হলে আপনার গর্বের ধন হবাে আমি। শহীদ হলেও আপনার অগৌরবের কিছু হবে না। আপনি হবেন বীর শহীদের বীর জনক। কোনােটার চেয়ে কোনােটা কম নয়। ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে আপনার ওপর। আজ সেই আবদারের ওপর ভিত্তি করেই আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তাে
প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। আপনার মনে কতাে আমানউল্লাহ চৌধুরী (ফারুক)
আশা, কতাে স্বপ্ন। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায়
পাশ করে কলেজে যাবাে। আবার কলেজ। ডিঙ্গিয়ে যাবাে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। মানুষের মতাে মানুষ হবাে আমি।
| আশা শুধু আমি করিনি। আশা আপনিও করেছিলেন। স্বপ্ন আপনিও দেখেছেন। কিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন আজ এক ফুকারে নিভে গেল। বলতে পারেন, এর জন্য দায়ী কে? দায়ী যারা সেই সব নর-ঘাতকদের কথা আপনিও জানেন। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ ওদের কথা জানে। ইংরেজিতে একটা কথা wice-Mother and Motherland are more superior than haven. wa চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমি। আমি তাে যাচ্ছি আমার স্বর্গদপী গরিয়সী সেই মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে। আমি যাচ্ছি শত্রুকে নির্মূল করে আমার দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে। বাবা, শেষ বারের মতাে আপনাকে একটা অনুরােধ করবাে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট সব সময় দোয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারি। আপনি যদি বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
জীবনে বহু অপরাধ করেছি। কিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করেছেন। এবারও আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, এই আশাই আমি করি। আপনি আমার শতকোটি সালাম নেবেন। আম্মাজানকে আমার কদমবুচি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া
করতে বলবেন। ফুফুআম্মাকেও দোয়া করতে বলবেন। ফয়সল, আফতাব, আরজু, এ্যানি ছােটদের আমার স্নেহশীষ দেবেন। আমার জন্য দোয়া করবেন আর সব সময় হুশিয়ার থাকবেন। আপনার স্নেহের ফারুক রণাঙ্গন থেকে যােদ্ধা লেখে, ‘মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোনাে সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তারা তাদের সবটুকুই আমাদের জন্য দিয়ে গেছে। বুক চিতিয়ে গুলি নিয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমরা তাদের পাঠানাে বার্তা পেলাম কই? চোখের দুই ফোটা নােনা জলও কি রেখেছি।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)