You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাই খলিল, যেখানে থাকুন ভালাে থাকুন

মেজর জেনারেল মােহাম্মদ খলিলুর রহমান ২০শে এপ্রিল ২০০৯ রাতে মারা গেছেন। এটি তাকে নিয়েই একটি স্মারক লেখা। সেনাবাহিনীর নথি অনুযায়ী তার জন্ম ১লা জানুয়ারি ১৯২৭। তিনি ২৬শে আগস্ট ১৯৫০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কমিশন লাভ করেন। কমিশনপ্রাপ্তির পর প্রথমে ঢাকা সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে, পরে (৪.১২.১৯৫২) প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বদলি হন। লে. কর্নেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী তখন প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের (সিনিয়র টাইগার্স) অধিনায়ক, যশাের সেনানিবাসে। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের রেজিমেন্টাল নাচের নাম ছিল ‘খটক’ এবং ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের (পাঠান) ছিল ‘লুডি’। পূর্ব বাংলায় তখন গুরুসদয় দত্ত প্রবর্তিত ব্রতচারী আন্দোলন অত্যন্ত জনপ্রিয়। লে. কর্নেল ওসমানী ব্রতচারী আন্দোলনের কয়েকটি ব্রতচারী নাচ জেনারেল হেডকোয়ার্টার্স, রাওয়ালপিন্ডি থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রেজিমেন্টাল নৃত্য হিসেবে অনুমােদন করিয়ে আনেন। বাঙালি সৈনিকদের জন্য এটি ছিলাে তখন একটি বড় বিজয়। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলের ৪০ জন সৈনিকের একটি দল নিয়ে লে, খলিল প্রথম ‘চল, কোদাল চালাই’, ‘বাংলা মায়ের দুর্নিবার’ নাচগুলাে অনুশীলন করেন। ২২.৯.১৯৬৬-তে লে. কর্নেল, ১৬.৫.১৯৭০-এ কর্নেল, ২৯.৫.১৯৭১-এ বিগ্রেডিয়ার এবং ১৫.৫,১৯৭৫-এ মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন এই পথিকৃত সৈনিক। জেনারেল খলিল মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন। সে অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তিনি একটি অসাধারণ বই লিখেছেন ‘পূর্বাপর ১৯৭১-পাকিস্তানি সেনাগহ্বর থেকে দেখা’ (সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৫) তার বইটি যতাে না তথ্যনির্ভর তার চেয়ে বেশি মানবিক। যদিও প্রাপ্ত তথ্যও প্রচুর এবং দুর্লভ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের ঘটনা বিশ্লেষণসহ উপস্থাপন করেছেন তিনি। বাঙালি অফিসার যারা অপেক্ষাকৃত জুনিয়ার এবং অবিবাহিত তারা কীভাবে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিলেন, সুযােগ থাকা সত্ত্বেও কারা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেননি, কারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ছুটিতে বাংলাদেশে এসে ছুটি শেষে পাকিস্তান ফেরত গিয়েছেন

মােটামুটি উল্লেখ আছে তার বইয়ে। বিচারপতি নুরুল ইসলাম, ড. কাজী দীন মােহাম্মদ, কূটনীতিক রিয়াজ রহমান এবং আরাে অনেকের পাকিস্তানপ্রীতির উল্লেখ এখানে। মেজর কাইউম চৌধুরী এতােই পাকিস্তানপন্থী ছিলেন তিনি। জার্মানি থেকে পাকিস্তানের পক্ষে এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে কঠোর ও শ্লেষাত্মক বক্তব্য দিয়েছিলেন। বাঙালির মুখ থেকে বাঙালির বিরুদ্ধে এমন বক্তব্যে পাকিস্তানিরা এততাই আনন্দিত ও পুলকিত হয়েছিল যে তার বক্তব্য রেডিওতে বারবার মে. জে. এম খলিলুর রহমান প্রচার করা হতাে। স্বাধীনতার পরেও কাইউম চৌধুরী উদ্ধৃত কণ্ঠে বাঙালি জাতিকে গালাগাল করেছেন যে ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৭১ তার ভাই মুনির চৌধুরীকে মুক্তিবাহিনী হত্যা করেছে। জেনারেল খলিল পাকিস্তানি সেনা গহ্বরে অতিবাহিত দিনগুলির কথা এই প্রথম বারের মতাে ব্যক্ত করলেন। সেই সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভেতর মহলের অজানা বিভিন্ন দিক এখানে উদঘাটিত হয়েছে। পাকিস্তানে একাত্তরের কর্মকাণ্ডের উপর এটি একটি আকরগ্রন্থ। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর পথিকৃৎ অফিসারদের একজন হিসেবে মেজর জেনারেল মুহাম্মদ খলিলুর রহমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন উচ্চপদে। দীর্ঘকাল সেনাবাহিনীতে কর্মকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ভেতর কাঠামাের ঘনিষ্ঠ পরিচয় তিনি লাভ করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার প্রেসিডেন্সি কলেজের এক যখন সেনাবাহিনীতে যােগ দেয় তখন এর ব্যতিক্রমী সত্তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই।  তিনি প্রথম বাঙালি যিনি ইংল্যান্ডের ক্যাম্বারলে থেকে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেছেন। ইংল্যান্ড থেকে এ্যামফেবিয়াস ওয়ার কোর্স করেন তিনিই প্রথম। দৃঢ়তার এবং গর্বের সঙ্গে বলতে পারি জেনারেল খলিল মনে এবং মননে ছিলেন প্রকৃত বাঙালি।

মেজর জেনারেল খলিল ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ রাইফেলস-এর মহাপরিচালক থাকাকালীন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পাদনার উদ্যোগ নেন। এটি ছিল স্বাধীনতার পর ইতিহাস রচনার প্রথম প্রয়াস। ১৯৭৭ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও রাইফেলস’ নামে ৫৪২ পৃষ্ঠার বই প্রকাশিত হয় প্রায় নির্ভুল তথ্য নিয়ে। পরবর্তীতে কোনাে এক অজানা কারণে বইটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ হয়।  হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, বন্ধুবৎসল এ মানুষটি ছিলেন সর্বজনপ্রিয়। তার প্রয়াণ সে কারণেই কষ্টকর। লে. কর্নেল আজিজুর রেজা চৌধুরী ছিলেন জেনারেল খলিলের অন্তরঙ্গ বন্ধু। তিনি ৭ই ডিসেম্বর ২০০০ ইন্তেকাল করেন। তার ছেলে হেলাল আহমেদ চৌধুরী একটি স্পাইরাল নোেট বইকে ‘শােক বই’ হিসেবে ব্যবহার করেন। জেনারেল খলিল ১৮ই ডিসেম্বর ২০০০ ‘শেষের চিঠি’ নামে একটি শােকবার্তা লিখে আসেন। শেষের চিঠি প্রেরক : মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান প্রাপক : লে. কর্নেল আজিজুর রেজা চৌধুরী তারিখ : ১৮ ডিসেম্বর ২০০০ অতিপ্রিয় চৌধুরী সাহেব, সেনাবাহিনীর কমিশন পাওয়ার পর আপনার প্রথম রাত কাটে আমার কামরায়। কুর্মিটোলা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে, ১৯৫২ সালে। তখন থেকেই আমরা কামরা সাথী’। বছর শেষে আমরা আর কামরা সাথী দৈহিকভাবে থাকিনি। কিন্তু মানসিকভাবে আমরা কোনাে দিনই কামরা সাথী ছাড়া আর কিছু ছিলাম না; সে রাওয়ালপিন্ডি হােক, ক্যাম্বেলপুর হােক, ঢাকা-চাটগাঁ হােক, আর সিলেট-ঢাকাই হােক।

২০০০ সালের ৭ ডিসেম্বর আপনি ঠিকানা বদল করেছেন। জীবনের এই প্রথমবারের মতাে আপনার ঠিকানা আমার অজানা। কিন্তু তবুও মনে হয় আমরা কামরা সাথী, অর্থাৎ রুমমেট। প্রথম দিন আলাপ করার সময়ই আপনার মুখমণ্ডলের স্নিগ্ধতা এনে দিয়েছিল আমার মনের আশ্বস্তি, আর আপনার দৃষ্টির গভীরতা উদ্রেক করেছিল শ্রদ্ধা। পরে। আমরা একসাথেই প্রত্যক্ষ করতাম মানব চরিত্রের মহান গুণগুলাে, আর তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্বলতার কৌতুকপ্রদ চেহারা। আপনি দুহাত ভরেই উপভােগ করতেন মানব চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলাে।  তবে এর কৌতুকপ্রদ দিকটির প্রতিই ছিল আপনার তীব্র অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন মনটির বেশি আকর্ষণ। এগুলাের বর্ণনা শােনানাে ও বর্ণনা শেষে দীর্ঘ ও সাবলীল উচ্চ হাসিতে যােগ দেওয়ার জন্য প্রয়ােজন পড়ত আমাকে। আমরা চাকুরি করেছি একসাথে, ব্যবসা করেছি একসাথে, ওসমানী ট্রাস্ট করেছি একসাথে, কিন্তু আবার কিছুই করিনি। লােকে মনে করত আমরা অনেক কিছু করছি, অথচ কিছুই করছি । এই ফঁাকির ফঁাকেও আবার উচ্চ হাসি। আপনার বন্ধু ছিলেন অনেক। এদের মধ্যে কেউ কেউ অজানা ঠিকানায়। যারা আছেন, তাঁদের আপনাকে ছাড়া চলতে চায় না। এঁদের সবারই আপনাকে ছাড়া চলল না। এ দোষ আপনারই। ভাই চৌধুরী, যেখানে থাকুন, ভালাে থাকুন। খলিল ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে হেলালের কাছ থেকে লেখাটি পাই। জেনারেল খলিলের সঙ্গে আমার নিবিড় সখ্য। মুক্তিযুদ্ধ ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ইতিহাসসংক্রান্ত গবেষণার কারণে তিনি আদার করে আমাকে ডাকেন ‘পাগলা’। ঢাকায় এসে তাকে টেলিফোন করি। বলি, স্যার, একটি শােকবার্তা পড়ে শােনাই, শশানেন। আমি পড়ছি আর অপর প্রান্ত থেকে হু হু কান্নার শব্দ শুনছি। বলছেন, ‘পাগলা, এ লেখা তুই কোথায় পেলি?’ স্যার, যেখানে আপনি চলে গেছেন সেখানে আর কোনাে টেলিফোন যােগাযােগের সুযােগ নেই। এ পৃথিবীর বহু লােক সশব্দে এবং নিঃশব্দে আপনার জন্য আজ হু হু করে কাঁদছে। আপনি শুনছেন কি? ভাই খলিল, যেখানে থাকুন, ভালাে থাকুন।

সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!