স্বপ্নগুলাে রয়ে গেলাে
১০ই জুলাই ২০০৬। বনানীর এক রেস্টুরেন্টে বসে আমরা ক’জন মুক্তিযােদ্ধা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম “সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ” নামে মুক্তিযুদ্ধের একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গঠন করব। রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেটের সামনে দাড়িয়ে লে. কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহীর, বীর প্রতীক আমার ডান হাতটি ধরে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে একটি অনুরােধ করার অনুমতি চাইলেন। কর্নেল সাজ্জাদ মানুষটি এমনই। কঠিন কথাও কঠিন করে বলতে পারেন না। অনুরােধের কোনাে বিষয় হলে তাে আরও অমায়িক। অনুরােধের অতিশয়তা দেখে অনুমান করলাম ব্যক্তিগত কোনাে বিষয় বােধহয় হবে। আমাকে অবাক করে কর্নেল সাজ্জাদ বললেন, কামরুল আমাদের সেন্টারের উদ্যোগে বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য থেকে বাংলাদেশে আনতে হবে। আমি ১৯৮০ সাল থেকেই বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি করে আর বলাবলি করে দুই কলমের কালি এবং জিহ্বা শুকিয়ে ফেলেছি। কতােদিন পর কর্নেল সাজ্জাদের প্রস্তাব পেয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে বললাম, আর কেউ থাকুক বা না থাকুক আমি আছি। যাত্রা শুরু হল। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের খােয়াই জেলার সদর দফতর আমবাসায় এসে পৌছায় অক্টোবরের ৯ তারিখ। শীঘ্রই শুরু হবে বাংলাদেশ-ভারতের সম্মিলিত চূড়ান্ত অভিযান।
বিশ্রাম এবং পুনঃসংগঠনের জন্য তাঁবু ফেলে ক্যাম্প করা হয়েছে। এরই মধ্যে কোনাে পূর্বপ্রস্তুতির সময় না দিয়েই ভারতীয় ৪ কোর কমান্ডারের আদেশ এলাে যেনাে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট শ্রীমঙ্গলে পূর্বপার্শ্বে সীমান্ত সংলগ্ন পাকিস্তানি অবস্থান ধলই বিওপি দখল করে। এ লেখায় যুদ্ধের বিশদ বর্ণনায় যাচ্ছি না। আক্রমণের সময় এক পর্যায়ে মেজর জেনারেল সগত সিং প্রচণ্ড গােলাগুলির মধ্যে যুদ্ধ অবলােকন করার জন্য এসে দাঁড়ালেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিনের ট্রেঞ্চটি ছিল পাশেই। তিনি ট্রেঞ্চ থেকে উঠে জেনারেল সগত সিং-এর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। বঙ্গ শার্দুলরা তখন সবার সামনেই পাকিস্তানিদের চামড়া তুলে ফেলছে। এমন সময় এডিসি ফ্লাস্ক। থেকে চা ঢেলে জেনারেলকে দিলাে। জেনারেল সগত সিং ক্যাপ্টেন হাফিজকে দেখিয়ে বললেন, ওকে আগে দাও। তারপর ক্যাপ্টেন হাফিজের পিঠ চাপড়িয়ে বললেন, ‘বৎস, তােমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে যাচ্ছাে’। এ যুদ্ধে সিপাই হামিদুর রহমান অসীম সাহস প্রদর্শন করে শাহাদত বরণ করেন। সে বীরত্বের কাহিনী অনুপম অহংকারের। ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত গেজেটে তাকে দেশের সর্বোচ্চ বীরত্ব উপাধি বীর শ্রেষ্ঠ প্রদান করা হয়।
তিনি ২৮ অক্টোবর ১৯৭১ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানি ধলই বিওপি আক্রমণ করে। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন একজন আর্টিলারি অফিসার লে, আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী । খুঁজে খুঁজে সি কোম্পানির সাবেক সৈনিকদের বের করি। জিজ্ঞাসা করি কোথায় সমাহিত করা হয়েছে হামিদুর রহমানকে। কেউই সঠিক ঠিকানা বলতে পারে না। পারার কথাও নয়। পনেরাে দিনও হয়নি তাদের আমবাসার স্থায়িত্বকাল। ধলই বিওপি এখান থেকে প্রায় ৩৫ কি.মি. পশ্চিমে। টুকরাে টুকরাে, খাপছাড়া খবর কিছু পেতে শুরু করলাম। এখন দরকার মিলিটারি। ম্যাপ। ২০০৭ সালের আগস্ট মাসের ১৯ তারিখ বাংলাদেশ রাইফেলস-এর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের অফিসে গেলাম। গােটা বিষয়টা সম্পর্কে তাকে বােঝালাম। তারপর বললাম, তুমি আমাকে ওই এলাকার ১,৫০,০০০ এবং ১:২,৫০,০০০ দুই সেট ম্যাপ দিয়ে সাহায্য করাে যেনাে আমরা ম্যাপ রেকি করতে পারি। এতােক্ষণ মেজর জেনারেল শাকিল একটি কথাও না বলে মনোেযােগ দিয়ে আমার কথা শুনছিলেন। মুখ খুললেন আমার সব বলার শেষে। বললেন, স্যার আমি জানি লে, কর্নেল সাজ্জাদ এবং আপনি এই মহত উদ্যোগটি গ্রহণ করেছেন। আপনারা অবসরপ্রাপ্ত। নিজেদের সময়, নিজেদের শ্রম,
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধ করেন তিনি। অধিনায়ক মেজর জাফর। ইমামের স্টাফ অফিসার হিসেবে এবং পাইওনিয়ার। প্লাটুনের কমান্ডার হিসেবে। তিনি জানান, ফেনীর ফুলগাজী থানার নােয়পুর বিওপি আক্রমণ করা হয়। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে। আক্রমণ সফল হয়নি, শত্রুর অবস্থান দখল করা যায়নি। শহীদ হয় বিধবা মায়ের সন্তান মােসলেহউদ্দিন কচি। তাকে সমাহিত করা হয় সীমান্ত খুঁটির মাত্র ১০০ গজের মধ্যে ভারতীয় ভূখণ্ডে। তার বাড়িও একই। মে. জে. রফিকুল ইসলাম সীমান্ত খুঁটির কাছাকাছি এপারে। স্বাধীনতার পর তার বিধবা মা সীমান্ত খুঁটিটির ওপর দু’হাত রেখে প্রিয় সন্তানের কবরটির দিকে চেয়ে থাকতেন সারাদিন, দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। তার হাত অনবরত রাখার ফলে সীমান্ত খুঁটির অমসৃণ মাথা মসৃণ হয়ে গেছে। এই অজ পাড়াগাঁয়ে বসে কোথেকে তিনি খবর পেয়েছেন আমরা বীর শ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ দেশে এনেছি। সন্তানসম মুস্তাফাকে অনুরােধ করলেন; তােমরা তাে মুক্তিযােদ্ধার কবর ভারত থেকে এনেছাে, আমার কচিকে এনে দাও না। মুস্তাফা ভাই আমাকে বললেন। আমি অনুরােধ করলাম মেজর জেনারেল শাকিলকে। শাকিল বললাে, স্যার এটা কোনাে ব্যাপারই নয়। আপনি সীমান্ত খুঁটির নম্বরটি দেন এবং তারিখ বলেন। আপনারা বসে থাকবেন, আপনাদের সামনেই দেহাবশেষ আনা হবে। ঠিক হলাে মার্চ মাসের কোনাে এক তারিখ আনা হবে। এরই মধ্যে কচির বৃদ্ধা মা মারা গেলেন। এদিকে জেনারেল শাকিল সাক্ষাতে এবং টেলিফোনে কবর আনার তারিখ জানার জন্য তাগাদা দিতে থাকেন। আমি অবাক হই, বলি; শাকিল অনুরােধ করলাম আমরা এখন তাে দেখি তুমিই আমাদের আগে দৌড়াচ্ছাে। জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এক বই প্রকাশনা অনুষ্ঠান শেষে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে সবার সঙ্গে চা খাচ্ছি। শাকিল। এগিয়ে এলাে। বললাে, সার, তারিখটা দিচ্ছেন না। কচির কবরটাও আনতে পারছি
না। কবে আছি কবে নেই। আমার কি এ সৌভাগ্যটুকুই হবে না? ২৫ ফেব্রুয়ারি (২০০৯) কিছু বিপথগামী বিডিআর সৈনিক পিলখানার ভেতর মেজর জেনারেল শাকিলসহ সাতান্নজন অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলাম যশাের সেনানিবাসে ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং। দীর্ঘদিনের সখ্য। মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথা হয়। কেবলই কুশলাদি বিনিময়ের জন্য। এ বছর জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি টেলিফোন করে বললেন; স্যার, ছেলেটা আমেরিকায় লেখাপড়া করে, মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে কিছুই জানে না। আপনি আমাকে বইয়ের তালিকা দিলে আমি বই সংগ্রহ করে ছেলেকে পাঠিয়ে দেবাে। বললাম, ক’টা দিন অপেক্ষা করাে। বই মেলায সব বই পাওয়া। যাবে এবং নতুন বইও প্রকাশিত হবে। আমি সংগ্রহ করে রাখবাে। তুমি কাজে বা ছুটিতে ঢাকা এলে নিয়ে যেও। কথা শেষ। কিশাের বয়সে রফিক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তার আত্মগত ভালােবাসা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। ছেলে যেখানেই থাকুক মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে ধারণ করবে স্বাভাবিকভাবেই সে ইচ্ছাই রফিকের। আমি তবুও কিছুটা বিস্মিত হলাম, খুশিও হলাম। | জীবনের সব স্বপ্ন সত্যি হয় না। জেনারেল রফিকের এই ছােট্ট স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হলাে না। মরণ হঠাৎ তাকে ডাক দিলাে। ৯ মার্চ ২০০৯ যশাের থেকে ঢাকা আসার পথে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় মারা যান মেজর জেনারেল রফিক।
শহীদ মুক্তিযোেদ্ধা মােসলেউদ্দিন কচির সীমান্তবর্তী কবরটা দেশে আনার তার বিধবা মা’র স্বপ্নটা মার্চ মাসে বাস্তবায়ন করার কথা ছিলাে। এরই মধ্যে চলে গেলেন তিনি এবং চলে গেলেন বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল। আহমেদও। মুক্তিযুদ্ধের বইও ছেলেকে দেয়া হলাে না মেজর জেনারেল রফিকুল ইসলামের। স্বপ্ন দুটি খুবই ছােট। যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা চলে গেছেন। স্বপ্নগুলাে রয়ে গেলাে। কচির মা, শাকিল এবং রফিক এ জগতে নেই সত্যি, তবে তাদের স্বপ্নগুলাে আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি, কোনােই কঠিন কাজ নয়। (অন্তকথা-রফিকের স্ত্রীর চোখের পানি শুকায় না। রফিক সম্বন্ধে অন্তহীন সব কথা। রফিককে নতুন করে চিনি। বললেন, একদিন রাতে যশােরে টেলিভিশন। দেখছিলাে জেনারেল রফিক। সে সময় আপনি মুক্তিযুদ্ধের কী এক অনুষ্ঠান করছিলেন টেলিভিশনে। রফিক হঠাৎই দৌড়ে চেয়ার ছেড়ে আমাকে এসে বললাে, তুমি না কামরুল স্যারের কথা বলাে, দেখাে স্যার টেলিভিশনে। রফিক ভাবীর। কাছে ছেলের জন্য মুক্তিযুদ্ধের মােটামুটি সব বই দিয়ে আসলাম ১৮ই মে সন্ধ্যায়। ২০শে জুন সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ রাইফেলস এর বর্তমান মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মইনুল হােসেন কুশল বিনিময় করতে এগিয়ে এলেন। যদিও তিনি। এখন বিডিআর পুনর্গঠনে অতি ব্যস্ত তবু কচির কবর দেশে আনার প্রসঙ্গটা তুললাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম জেনারেল মঈনুলও জেনারেল মাকিলের মতাে উৎসাহে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন। বললাম; তুমি ব্যস্ত, একটু থিতু হয়ে নাও, তারপর। জেনারেল মঈনুলের যেনাে বিলম্ব সইছে না। আমিই বললাম, মূল বিষয়টা কবরটা দেশে আনা, স্বপ্ন পূরণ করা। তুমি একটু অবসর হও, শীতটা আসুক, আমিই তােমাকে বলবাে। ছােট ছােট কিছু স্বপ্ন আমরা অনেকেই অতি সহজেই পূরণ করতে পারি। আমরা দেশবাসী সব এক হবাে, প্রাণপ্রিয় দেশটা এগিয়ে যাবে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)