জয় বাংলা ৯ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপাত্র
মুজিবনগরঃ প্রথম বর্ষ, নবম সংখ্যা শুক্রবার ২৪শে আষাঢ়, ১৩৭৮, ৯ই জুলাই ১৯৭১
ইয়াহিয়ার জবাব রণক্ষেত্রেই দেওয়া হবে
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের দৃপ্ত ঘোষণা
মুজিবনগর। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জেনারেল ইয়াহিয়ার ভাষণের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে আমাদের প্রতিনিধিকে জানিয়েছেন। ইয়াহিয়া যে ভাষণ দিয়েছে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তা ঘৃণাভরে শুনেছেন। আমরা এখন স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে শত্রু হননের লড়াই লড়ছি। আমাদের স্বাধীনতা রক্ষা করতে বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দের নিশ্চিহ্ন না করে আমরা ক্ষান্ত হব না।
তিনি বলেন ইয়াহিয়ার ঔদ্ধত্যের জবাব মুক্তিবাহিনী ও বাংলার জনগণ রণাঙ্গনেই দেবে। অস্থায়ী ইসলাম রাষ্ট্রপ্রধান সয়ূজ-১১ নভোযানের চন্দ্রনটত্রয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগর্ণীর কাছে এক শোকবাণী পাঠিয়েছেন।
বাণীতে তিনি বলেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই বীর সৈনিকদের মৃত্যুতে গভীরভাবে মর্মাহত। এরা জ্ঞান অনুসন্ধানের অভিযাত্রার মৃত্যুবরণ করেছেন। এদের বিশ্বমানব স্মরণ করবে চিরকাল। তিনি নভোযাত্রী তাদের শোকসন্তপ্ত পরিবারের কাছে বাংলাদেশের জনগণ সরকার ও তার নিজের পক্ষ থেকে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।
‘ ইতিহাসের ন্যায়দন্ডে ইয়াহিয়ার ক্ষমা নেই’
মানব সভ্যতার অবিসংবাদিত জল্লাদ ইয়াহিয়া খান আবার মুখ খুললেন ২৮শে জুন। এছাড়া তিনি ফৌজি ফয়সালার ফিরিস্তি ঝাড়লেন। ঔদ্ধত্যের মেরুদন্ড আরেকটু খাড়া করে ঘোষণা করলেন ঃ আমি নিজের সংবিধান তৈরি করব। এক্সপার্টরা একে পরীক্ষা করে দেখবেন। এতে ফেডারেল সংবিধানের চরিত্র পুরোপুরি ফুটে উঠবে। চার মাসের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকবো। গণপ্রতিনিধিদের হাতে সংবিধান ক্ষমতা তুলে দেবো। তবে তখনো সামরিক আইন থাকবে। আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে করে যেসব আওয়ামী সদস্য এগিয়ে আসবেন তারাই কেবল জাতীয় পরিষদের টিকবেন। বাদবাকিরা খারিজ সেখানে উপনির্বাচন করাবো। সেনাপতি ইয়াহিয়া আরো কয়েকটি কথা উচ্চারণ করেছেন ঃ শেখ মুজিবুর রহমান দেশে মেজরিটি পার্টির নেতা হলেও কোনো দায়িত্ববোধের পরিচয় দেননি। ইত্যাদি। আর একচোট বাহবা দিয়েছেন তারই পোষ্য সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে। কারণ আওয়ামী লীগকে দমনের জন্য তারা তাদের খুনি হাত ভিজিয়েছে শহীদের তাজা রক্তে। তার এবার বয়ান ২৬শে মার্চের পুনরুল্লেখ বৈ আর কি? তবে জঙ্গিবাদী দর্শনের প্রবক্তা ইয়াহিয়ার স্বীয় ভাষণে স্ববিরোধিতার প্রমাদ প্রকট হয়ে উঠেছে। তিনি ৫৫ মিনিটের লম্বা দীর্ঘ ভাষণে একবার বলেছেন বাংলাদেশের সব স্বাভাবিক। আবার বলেছেন -দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে কিছু সময় লাগবে। ইয়াহিয়ার মুখে বাংলা ও বাঙালির কথা ধ্বনিত হলে আমাদের বুকের পাঁজরে প্রতিহিংসার মাতাল আগুন জ্বলে ওঠে। ফোঁসে উঠে হৃদপিন্ডের বিপ্লবী ঘৃণা বোধের বারুদ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষে কথা বলার একতিয়ার ইয়াহিয়ার আর নেই। বিশ্বকে ধোকা দেওয়ার নতুন ঘুটি চেলেছেন তিনি। তার কথায় এক রতি গুরুত্ব দেই না আমরা।
তারা সংবিধান তৈরি থাক। এই মন্ত্র ওষধির বটিকা পশ্চিম পারের লোকেরা উদরসা্ৎ করলে আমাদের বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। নরহত্যা মূলক পিশাচ ইয়াহিয়া উপনির্বাচন করার প্রস্তাব পেড়েছেন, স্ট্র্যাটিজি-ট্যাকটিকটি মোটামুটি মন্দ নয়। জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসন পেয়েছেন। বহু চেষ্টা করেও ঢেঁড়া পিটিয়ে সীমান্তের কাছাকাছি ‘বিসেক্ষপন কাউন্টার’ খুলে সবিনয় অনুরোধ করে এমনকি ওজারতি, লাইসেন্স, পারমিটের প্রলোতনের টোপ দেখিয়ে ও পর্যন্ত আড়াই জনের বেশি ইয়াহিয়া বাগাতে পারেন নি। তাই হুশিয়ার একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের দালাল, তস্য দালালদের দিয়ে উপনির্বাচন করার ঘৃণ্য অপচেষ্টাকে এদেশের বেপরোয়া মেহনতী মানুষের সকল অংশ কঠিন আত্মবিশ্বাসে মোকাবিলা করবেই।
অপকর্মের আকস্মিক সাফল্যে সকল অত্যাচারীই আনন্দে বুঁদ, হয়ে পড়ে কিন্তু অত্যাচারীকে দুনিয়ার অমোঘ নিয়মে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হয়। তারা আপন আবর্তে আপনি বিলুপ্ত হয়। সর্বকালের সর্বযুগের ইতিহাস এর জ্বলন্ত সাক্ষী। চেঙ্গিস, এট্টিলা, হিটলার, নাদিরের রক্তের ঔরসজাত ইয়াহিয়ার কোন ক্ষমা নেই। আমাদের মায়ের ভাইয়ের বোনের শতশত কচি সবুজ প্রাণের বুকের উপর- উপনিবেশিকতার কালো কুৎসিত নিশান পুঁতে মিলিটারি ডেমোক্রেসির পিন্ডি চটকাচ্ছেন তিনি। সবুজ-শ্যামল, শুভ্র মৌসুমী ফসলের মাঠে, পল্লী প্রান্তরে ওদের ধ্বংসের নরককুণ্ড জ্বলছে। দুখিনী মাতার খরকুটর ছাউনি, বসতবাটিগুলো পুড়ে পুড়ে অঙ্গার ভস্মে পরিণত করেছে। বাবা-মার সামনে অসূর্যস্পর্শা সোমত্ত মেয়েদের ইজ্জত আব্রু কেড়ে নিয়েছে আদিম বন্যতায়। মধ্যযুগের নির্মম হিংস্রতায়। বাপ- দাদা, চৌদ্দ পুরুষের ভিটা মাটি ফেলে ছিটকে পড়েছে পৃথিবীর কোন অজানা প্রান্তে তারা। পথে-পথে লক্ষ লক্ষ মলিন মুখের মিছিল। পুষ্পস্তবক এর মত শিশুরা, নবজাতকেরা আজ ক্ষুধায় অস্থি চর্মসার। চারিদিকে শত্রুদের সামরিক শিবির। লাখো শহীদের কাফনে ঘোরানো আমার সবুজ স্বদেশ। দুখিনী মা তার বুকে আজ রাজকীয় আক্রমণের দগদগে ঘা। নোঙ্গর ছেঁড়া নৌকার মত মানব সন্তানের ভেসে চলেছে অনিশ্চয়তার বন্দরে। একটি জাতিকে উলু ঘরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায় ওরা সামরিক বর্বরতায়। অত্যাচারের আরো নতুন উপসর্গ হয়তো আত্মপ্রকাশ করবে। করুক। কিন্তু একটা প্রশ্নঃ কোন দুর্গের অন্তহীন নির্মম অন্ধকারে চাপা দিয়ে রেখেছে স্ব দেশের মহান সন্তানকে? ক্রন্দনীর চোখে চোখে কান্নার করুন স্বরগুলির ধ্বনি তুলছেঃ কোথায় তার আশীর্বাদের বরপুত্র শেখ মুজিব?
এতসব ঘটে গেল। তবু ঢাকঢোল পিটিয়ে ইসলামাবাদের জঙ্গিরাজকে সাহায্য দিচ্ছে চীন। আমেরিকা ও জড় পাল্লা দিয়েছে এতে। আর শলাপরামর্শ চালাবার মানসে পাক ভারত সফরে এসেছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় সংহতি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার। মানবতার এই দুঃখ বহ মুহূর্তে সভ্যজগতে এতটা দূরে দাঁড়িয়ে কেন? এই নরমেধ যজ্ঞের নাটকীয় পরিণতিই কি তাদের কাম্য? ইয়াহিয়ার অসুরিক অহংকার চূর্ণ বিচূর্ণ করার দুঃসাহস বিবেকের শুভ উদ্বোধন ঘটবে নাকি বিশ্বের কোথাও? বিশ্ব জনমতকে আজ ইয়াহিয়ার কর্মকাণ্ডের হালকা ভর্তসনা করেই মানবিকতার শিরদণ্ড কুঁজো করে সব দায়দায়িত্ব সারবে? এখনো জঙ্গী শাহী একাধিক মুরুব্বী রাষ্ট্রের সময় রসদ পাচ্ছে। আরও পাবে। বৈষম্যের সুনিপুণ স্থপতি ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতা এম এম আহমেদ দেশে দেশে ধরনা দিয়েছেন। খুদকুঁড়ো কুড়াচ্ছেন। ৫০ কোটি ডলার প্রার্থনা করেছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের পিটার কারগিল প্রকারান্তরে জানিয়ে গেলেন টাকা পেতে হলে কিছু শর্ত মানতে হবে। এর অন্যতম শর্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক নৈরাশ্যের অবসান ঘটাতে হবে। শরণার্থীদের স্বদেশে ফেরার নিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। ওই দুটো প্রশ্নে মস্কো ওয়াশিংটন বন অটোয়া একমত। বোধহয় লন্ডন ও। ইয়াহিয়ার দৈনিক যুদ্ধের খরচ কুড়ি লক্ষ ডলার। ওদের বৈদেশিক মুদ্রা তহবিল তলানিতে এসে ঠেকেছে। ইয়াহিয়ার নারীর শাহী শোষণ বিশ্ববিবেককে হতচকিত করেছে। এই নিষ্ঠুরতম ক্যানিবালিজম কি ইয়াহিয়ার বিজয়চিহ্ন না আন্তর্জাতিক বিবেকের কলঙ্ক? বাংলাদেশকে অনুগত রাখার বনিকী মনোভাব সবার চোখে স্পষ্টঃতই ধরা পড়ে গেছে তবু বিশ্বের মুরব্বি রাষ্ট্রের দ্বিমুখী নীতির দুমুখো সরীসৃপ কূটবুদ্ধির বাদাড়ে কিলবিল করছে। আর এই মওকার ভিতরে ইয়াহিয়া একটি কুইসলিং সরকার গঠন করতে চান। কিন্তু শেখ মুজিব ইন বাংলাদেশ অচিন্তনীয়। সূর্যোদয়ের একটি সত্যকে চাপা দিয়ে ইয়াহিয়া আর বড় বেশি অগ্রসর হতে পারবে না এবার তার পতনের পালা। ইসলামাবাদ সরকারকে যারা আজ সাহায্য দেবে তারা মানবজাতির মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ধীরে ধীরে বিশ্ববিবেক আমাদের পাশে এগিয়ে আসছে। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে de facto স্বীকৃতি উচ্চারিত হয়েছে। এখন অনিবার্য আবশ্যিক De Jure আইনগত স্বীকৃতির। আমাদের বিশ্বাস আপন শক্তিতে স্বীকৃতি ও আমরা পাব।
গোটা দুনিয়া আজ বিপ্লব মুখী।
বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধ বিশ্ববিপ্লবের এক অনির্বাণ প্রবাহ। মুক্তিবাহিনী গঠন আত্মপ্রত্যয় এই বিদ্যুৎ গর্ভ সংগ্রামের অবিনশ্বর স্বাক্ষর।
মানবতার এই মহা ক্রান্তি খানে কোন দুঃসাহসী বিবেক নেবে তার সক্রিয় ও সবল ভূমিকা? হে বিশ্ব বিবেক সোচ্চার করো তোমার কন্ঠ। বিধ্বংসী যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত করো। দুঃসহ প্রহরের পরিমিতি ও দৈর্ঘ্য খাটো হোক।
শত্রুদের হাতে আর কোনো অস্ত্র নয়। খাদ্য সামগ্রী ও সব রকমের সাহায্য বন্ধ করে দাও। কারণ এসব যুদ্ধাস্ত্রেরই পরিপূরক। আমাদের ঠুনকো গোলাবারুদে চলবে না। শক্তিশালী আধুনিক সমরাস্ত্র চাই। অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজ দিকে দিকে প্রস্তুত। লড়ছে। লড়বে। হানাদারের চিরতরে খতম করবে। ওদের ঔদ্ধত্য আমাদের রণাঙ্গন।
আজ শুধু শত্রু হননের পালা। বিজয় আমাদের প্রত্যাশন্ন। আমাদের এ লড়াই ন্যায়সিদ্ধ স্বাধীনতার লড়াই।
এর কোন হার নেই।
ইতিহাসের ন্যায়দন্ড ইয়াহিয়াকে কোনদিন ক্ষমা করবে না।
চট্টগ্রামের মুক্ত এলাকায় স্বাধীন বাংলার বিজয় পতাকা উড়ছে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলে এলাকায় মুক্তিবাহিনী দখল করেছেন
মুজিবনগর ৭ই জুলাই বঙ্গ বীরাঙ্গনার যোগ্য সন্তান অপরাজেয় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক তৎপরতায় বাংলার অধিকৃত এলাকার বিভিন্ন রণাঙ্গনে কাপুরুষ পাকহানাদার বাহিনী প্রচন্ড মার খাচ্ছে। কাপুরুষ পদ্ম সূরা অনেক স্থানে দুর্দমনীয় বংশধরদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। ফলে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল পূর্বাঞ্চল এবং চট্টগ্রামের অধিকৃত বহু এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে এসেছে। এই সকল মুক্ত এলাকার বাড়িঘর ও বৃক্ষ শীর্ষে বর্তমানে স্বাধীন বাংলার পতাকা পতপত করে উড়ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের বর্ষা আগমনের সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবি দস্যুবাহিনী ভয়ানক বেকাদায় পড়ে গেছে। তারা তিতুমীর সূর্যসেনের দেশের নির্ভীক সেনা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে নদীমাতৃক বাংলার খরস্রোতা নদীর স্রোতে ভাসমান ভূখণ্ডের হাবুডুবু খাচ্ছে।
বাংলার অপ্রতিরোধ্য দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের আক্রমণ আরো জোরদার করেছেন। ফলে হানাদার বাহিনী বর্তমানে দিশেহারা হয়ে প্রাণ নিয়ে পলায়ন করছে এবং তাদের বহু সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে হতাহত হয়েছে।
সিলেট থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে সিলেট ও ময়মনসিংহ এলাকায় গত সপ্তাহে প্রায় তিনশত হানাদার পাক সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। আরো চারশত হানাদার সৈন্য আহত হয়ে সিলেট বেসামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। সামরিক হাসপাতালে ঠাই না থাকার দরুন সিলেটের এই বেসামরিক হাসপাতাল থেকে রাতারাতি সামরিক হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
টাঙ্গাইল থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ মুক্তিবাহিনী সম্প্রতি টাঙ্গাইলে ঢুকে হানাদার সৈন্যদের উপর অতর্কিত হামলা করে তাদের হতাহত এবং বিতাড়িত করে উপজেলার দক্ষিণাঞ্চলের চারটি থানা দখল করে নিয়েছেন।
আসাম মেঘালয় সীমান্তে বাংলাদেশের পাকহানাদার বাহিনী কবলিত ঘাঁটিগুলো মুক্তিবাহিনী দখল করে নিয়েছেন।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে দিনাজপুরে পাক সেনাদের উপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে দুইজন দস্যু সেনাকে খতম করেন এবং তাদের নিকট থেকে গোলাবারুদসহ দুটি হালকা মেশিনগান ছিনিয়ে নেন। মুক্তিযোদ্ধাগণ অম্বর থানা ভজনপুর রোডের উপরে একটি সেতু উড়িয়ে দেন। তারা নাটোরের নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু ধ্বংস করে হানাদার বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলেছেন।
জাহাজের বাঙালি কর্মচারীদের উপর পাকসেনাদের নিষ্ঠুর হামলা
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পাক জাহাজের ৯৫ জন বাঙালি কর্মচারীর আনুগত্য প্রকাশ
গত ২৮শে জুন পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশনের কর্মচারী জাহাজের অফিসার এবং নাবিকসহ ১৫ জন কর্মচারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। তারা অভিযোগ করেন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে জাহাজের পশ্চিম পাকিস্তানী নাবিক এবং অন্যান্য কর্মচারী অযথা জাহাজের বাঙালি কর্মচারীদের প্রতি দুর্ব্যবহার নানাভাবে নাজেহাল এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে। এমনকি তারা বাঙালি কর্মচারীগণ কে অপদস্থ করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যকলাপের আশ্রয় নেয় বলেও তারা জানান।
কর্ণফুলী জাহাজের বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার জনাব নুরুল হুদা অভিযোগ করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের নাবিকরা তার ব্যক্তিগত মালপত্র সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। তিনি এ ব্যাপারে জাহাজের পশ্চিম পাকিস্তানী ক্যাপ্টেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি ব্যাপারটি সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণে অক্ষমতা প্রকাশ করেন।
এই নাবিকদের গত ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর একটি জাহাজের বাঙালি কর্মচারীগণ হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্মমভাবে হত্যারও বর্ণনা দেন। তারা জানান যে, চিনা সমরাস্ত্র বোঝাই এ জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু ডগ কর্মীগণ বাঙালি নিধনের জন্য আমদানিকৃত এসব সমর অস্ত্র খালাস করতে অস্বীকার করলে পাকসেনারা মাল খালাসের নামে জাহাজে উঠে জাহাজের বাঙালি কর্মচারীকে নির্মমভাবে হত্যা করে এবং তাদের মৃতদেহগুলি নদীতে ফেলে দেয়।
পাক গোয়েবলসদের স্বাভাবিক অবস্থার নমুনা!
পাক দস্যু কবলিত বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে বলে পাক বেতার থেকে জঙ্গীশাহী আদাজল খেয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় যতই গলাবাজি করুক না কেন প্রকৃত পক্ষে স্বাভাবিক অবস্থায় জঙ্গিবাদ ছাড়া আর কিছুই নয় একথা বিশ্বের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা সহ বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা সফরকারী বিদেশি প্রতিনিধিগণও স্বীকার করেছেন।
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে ঢাকার বিভিন্ন সরকারি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু সংখ্যক বাঙালি কর্মচারী যোগ দিলেও প্রকৃতপক্ষে অফিসে কোন কাজকর্মই হয় না। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে সময় কাটিয়ে কর্মচারীগণ পাঞ্জাবি জল্লাদদের ভয়ে প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে যান। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ এর আশেপাশের কল কারখানাগুলোতেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। তবে জল আদ্ভানি কোন কোন কল কারখানার মালিক বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের কারখানাগুলোতে পূর্বের ন্যায় নিয়মিত সিটি বাজিয়ে এবং কিছুক্ষণের জন্য কারখানার ইঞ্জিন চালু করে চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে বুঝাতে চায় যে কলকারখানায় কাজ চলছে। কিন্তু ভিতরে জল্লাদ বাহিনীর পদলেহী অবাঙালি উর্দুভাষী একশ্রেণীর লোক কিছুক্ষণ শোরগোল করে থাকে। এরা কাজ কিছুই বুঝে না।
চা বাগানে কাজ বন্ধ
সিলেট থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে সিলেট জেলার চা বাগানগুলোতে কোন কাজই হচ্ছে না। চা বাগানের শ্রমিক গান পশ্চিমাঞ্চল অধ্যায়নের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য শ্রমিক পল্লী ছেড়ে দিয়ে পলায়ন করেছে। অপরদিকে উন্মত্ত জল্লাদ বাহিনী অভুক্ত কুকুর কর্তৃক পরিত্যক্ত ছেড়া জুতা কামড়ানোর মতো চা বাগান শ্রমিকদের পরিত্যক্ত জিনিস গুলো জ্বালিয়ে দিয়ে বীরত্বের ছাপ রেখেছে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা বলতে অধিকৃত এলাকায় কিছু নেই। বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় রেল লাইন উপড়ে ফেলায় এবং রেলওয়ে সেতু ধ্বংস করে দেয়ায় জঙ্গিশাহী এখনো রেলগাড়ি চালু করতে পারেনি। কেবল ঢাকা থেকে নিকটবর্তী নরসিংদী ব্রাহ্মণবাড়িয়া মধ্যে দিনে একটি ট্রেন চলাচল করে থাকে এবং এরা মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত পাক দস্যুদের লাশ উঠা-নামা করায়ে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে।
ঢাকা-কুমিল্লা খুলনা-রাজশাহী চট্টগ্রামে প্রভৃতি শহরের কেবল অবাঙালি ব্যবসায়ীদের কিছু দোকানপাট খোলা হয়ে থাকে।
অধিকৃত পাক বেতার থেকে প্রত্যহ ঢালাও চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার কোন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আসছেন না। কেবল উর্দুভাষী পাঞ্জাবি তবেদারদের কতিপয় অছাত্র ছেলে মেয়ে পাঠ্য তালিক বহির্ভূত কতিপয় বইপত্র বগলতলায় নিয়ে শহরের স্কুল কলেজগুলোতে যাতায়াত করে থাকে।
এছাড়া বাংলার অধিকৃত এলাকায় খেলার মাঠ গুলো শূন্য খাঁ খাঁ করছে। খেলাধুলা নেই, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও বন্ধ। সিনেমা হলগুলোর দরজা তালাবদ্ধ। ঢাকার কয়েকটি ছবি করে কেবল উর্দু ছবি চলছে। এর দর্শক হচ্ছে কেবল উর্দু ভাষীরাই। এই হচ্ছে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি।
বাংলাদেশের ব্যাপারে মধ্যস্থতা
ইন্দিরার নিকট টিটোর পত্র
যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্র প্রেরণ করেছেন। পত্রের বিষয়বস্তু না জানা গেলেও বাংলাদেশের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত আছেন এক ধরনের বক্তব্য রয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল অনুমোদন করছেন।
আন্তর্জাতিক বিচার কমিশন গঠনের দাবি
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অন্যতম সদস্য মিঃ স্টোন হাউস বাংলাদেশের নৃশংস গনহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক বিচার কমিশন গঠনের জন্য জাতিসংঘের কাছে দাবি জানিয়েছেন।
মিঃ স্টোন হাউস বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার জন্য অবিলম্বে জাতিসংঘ বাহিনী প্রেরণের জন্য ও প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন বাংলাদেশের যে পৈশাচিক নৃশংসতা চলছে হিটলারের নৃশংসতা ছাড়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর এরকম আর কোন দৃষ্টান্ত নেই। আয়ারল্যান্ড পার্লামেন্টের সদস্য কোনাল বাংলাদেশে পাক সৈন্যদের গণহত্যার বিষয় আলোচনা করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে জাতিসংঘের সভা আহবানের দাবি জানিয়েছেন।
১৪ ই আগস্ট বিশ্ব সম্মেলন
ভারতের সর্বোদয় নেতা মিঃ জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশে পাক জঙ্গিশাহের নৃশংস গণহত্যার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে আগস্ট মাসের ১৪ তারিখে নয়াদিল্লিতে সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এ সম্মেলনে যোগদান করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সর্বোদয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ন বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন।
সিনেটর কেনেডি কর্তৃক মার্কিন সরকারের ধাপ্পাবাজির স্বরূপ উদঘাটন
পাক জঙ্গিশাহীকে সমরাস্ত্র দানের বিরুদ্ধে বিল উত্থাপনের হুমকি
পাকিস্তানের নতুন করে অস্ত্র সহজ এর বিরুদ্ধে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট কে অভিযুক্ত করেছেন। সিনেটর কেনেডি মার্কিন প্রশাসনকে ধাপ্পা দেন এবং পরস্পর বিরোধী কথা বলার জন্য দায়ী করে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য না দেওয়ার ব্যাপারে কংগ্রেসকে যে কথা দিয়েছিলেন তাঁর বরখেলাপ করেছেন।
তিনি পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য বন্ধ করার জন্য সিনেটে বিল উত্থাপন করবেন বলে জানিয়েছেন। ওয়াশিংটন থেকে অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস জানিয়েছেনঃ বাংলাদেশের মানবতার দিকটাকে মার্কিন সরকার উপেক্ষা করছেন কেন-সিনেটর কেনেডি তা জানতে চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুদেশ বাংলাদেশ সমস্যায় উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কিন্তু মার্কিন সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব রয়েছেন।
বাঙালি নিধন যজ্ঞ গণচীনের ভূমিকা কি?
আজকের বাঙালি নিধন যজ্ঞ গণচীনের ভূমিকায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালি মর্মাহত। কিন্তু আজ তারা যে ভূমিকা নিয়েছে তাকে তাদের পথ ও পন্থা বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীর মনে উদ্রেক আর ঘৃণা সৃষ্টি করেনি?
বর্তমান ভূমিকায় এই সংশয়ময় অধ্যায়ের কথা না বলে এখানে একটি ঐতিহাসিক দলিল প্রকাশ করছে-যা সংগৃহীত হয়েছে চীনের এই প্রকাশিত দলিল থেকে। পৃথিবীর ৩৭ টি দেশের ৩৬৭ জন প্রতিনিধি সম্মেলনে অক্টোবর ১২, ১৯৫২ সালে যে দলিল স্বীকৃত ও স্বাক্ষরিত হয়েছিল বিশ্ব মানবতার নামে তার বিশেষ অংশ এখানে প্রকাশ করা হলোঃ –
“The peoples of the Asian and Pacific regions are determined to wage a relentless struggle against the forces of war and are convinced that by co-operating with all persons of goodwill, they will be able to avert threating catastrophics, dispelling the dark clouds of war and clearing MAN’S horizons for dawn of universal friendship and a lasting peace.”
“The monstrous crulties which accompany the wars of to- day have roused the consciousness of every decent man and woman.The man killing of civilians , the senseless destruction of peaceful which towns and village, the infiction of untold horrors on innocent women and children make modern war an instrument of total annihilation, this genocide by the use of the most fiendish weapons ever invested by man, threateos to reach other lands and peoples.”
এরপরে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই মহাচীনকে আজকের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণকে। এই ভাষণটি আমরা সংগ্রহ করেছি পিকিং থেকে প্রকাশিত চীন সরকারের সরকারি বুলেটিনের (প্রকাশ তারিখ অক্টোবর ১৯৫২) ১৬২ নং পৃষ্ঠা থেকে-
শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণঃ
THE PEACE CONFERENCE OF THE ASIAN AND PACIFIC REGIONS, PEKING
Speech by SK. Mujibur Rahman
It is most inspiring for me to find among the delegates to this August conference, a firm determination to struggle for speech. I feel all the more happy that’s that great Ohinese people has taken the lead lo establishing peace in Asia. The new Ohins, under the leadership of Mao Tse-tung, undoubtedly occupies the leading position in Asia,and the great strides and the spectacular progress made by the people of China and their government on various fronts serve as a beacon light to the down trodden people of the world, particularly of Asia. Millions of people of Asia and the Pacific region, as also of other countries of people of Asia and the Pacific region, as also of other countries of the world, looking toward China for new inspiration, hope and guidance. I can’t chill at the Chinese people on their efforts in rasisting war and establishing peace.
Friends we Pakistanis have pain fully realised the devastation and the horrors of war.
All the the war officially ceased in our country, the miseries and the calamities that the war brought in its wake are still clining to our life, inflation, corruption and black marketing, which concomitants of the war, remain with all their regards and the best message of our people are still grossing under poverty for want of food, health and employment. The people who thrived during the order and built their fortunes are still exploiting the people. As a result not only in our country but in most of the Asian countries, the laborers and peasents are deprived of fair price for their produce due to the expression by the imperialists and their agents. In order toperpetua’s deamination and exploitation the imperialists threating war.
The imperialists are apparently afraid of the rising of the people and very naturally are terrified at the awakening of the people and their movement in various Asian countries. Making hectic preparations for hire everywhere.
Friends I want to assure you that due to the success of the liberation movement in China, the people’s movements in the Asian and Pacific region are gaining strength day by day. The imperialists and the reactionaries on the other hand, in order to crush such movements are employing all methods of coercion and berberous repression.
Friends all of you know that the problems of all the common people in the Asian and Pacific regions are the the name. They do not have enough food, clothes, health and education. They want to live and let others live. They we are no hatred against any other, nor are they envious of others.
Friends we invite the cooperation of all the people of the Asian and Pacific regions as well as of the other parts of the world to unit together in the cause of peace and humanity. The attempts of the American imperialist to remilitarise Japan, for launching aggression against China, has elicited to the universal condemnation of the peace loving people of the world.
We learn from the report of Mr, Kue-Mo-jo that in the last world war. 10 million Chinese lost their life due to Japanese militarism, and properties worth 50 thousand million. US dollars were destroyed. In Indonesia 2 million labourers died on forced labour and tens of thousands of butchered, in Burma, the Philippines and Vietnam and other countries millions of people were killed. On the other hand the losses of the Japanese also collosal. These memories of the horrors of a evoke terrible in the minds of all. In Korea, in Aadhar disregard of human life and property, the American imperialists are wagig war, and the true talks have been going on for the past year on year without final success having been achieved. Being a Rebel to face popular resistance, they are resorting 2 haeteriological and chemical warfare. I have no words to condom this atrocities. But I can assure you that in no distant time the Imperialitis are bound to answer for their deed before the bar of the opinion of the people of the world.
Friends, in conclusion, I want to say that I have been gratified to learn of the activities of the peach partisans of different countries, I want to assure you that our people are are not lagging behind in the fight for peace. The inspiration that we get here will instill quotes and determination in the mind of our students, peasents, workers, people of all professions and different shades of opinion. I want to want the imperialists. “Hands of Asia”. I firmly believe that we will achieve peace in unity.
Long Live World Peace.:
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা আজকের গণ চীনের মহান নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে মানবতার নামে তাদের দায়িত্বের স্মরণ করিয়ে দিতে দোষ কি? যারা বিশ্বের দু:স্থ আর সংগ্রামী মানুষদের দূত হিসেবে নিজেদের স্বীকৃতি কামনা করে -ঘোষণা করে তারা আজ বিশ্ব ত্রাস সৃষ্টিকারী গণহত্যার বিরুদ্ধে কিছু বলছে না কেন?
গণচীন কি গণহত্যার স্বপক্ষে?
অচিরেই ইতিহাস সে স্বাক্ষর বহন করতে চলছে!
তবুও বলব সত্য আর ন্যায়ের জয় অবশ্যম্ভাবী!
ঢাকা থেকে মার্কিন সাংবাদিক বহিস্কৃত বাংলাদেশের নিরীহ নিরস্ত্র জনগণের উপর রক্তপিপাসু পাকসেনাদের নগ্ন হামলার খবর চাপা দেয়ার ব্যর্থ প্রয়াস হিসেবে তথাকথিত পাকিস্তানের সরকার নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকার অধিকৃত ঢাকাস্থ প্রতিনিধি মিঃ সীডনী স্ক্যানবার্গকে ঢাকা থেকে মাত্র ১২ ঘন্টার নোটিশে বহিষ্কার করে দেয়। লন্ডন থেকে গত ৩০শে জুন রয়টার এ খবর পরিবেশন করে জানান যে মিঃ স্কানবার্গ ৯ দিন বাংলাদেশে ছিলেন এবং অধিকৃত এলাকায় পাক দস্যু বাহিনীর পাশবিকতা সম্পর্কে কয়েকটি সংবাদ প্রেরণ করেন।
বিশ্ব জনমতঃ ইয়াহিয়া সরকারের নৃশংসতাকে ঘরোয়া ব্যাপার বলা যায় না
আমেরিকান (জেসুইট খ্রিস্টানদের) পত্রিকা, ‘আমেরিকান উইকলি অফ জেসুইটস অফ ইউনাইটেটস্টেস এন্ড কানাডা’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে যে, বাংলাদেশের যা ঘটেছে তার জন্য ইয়াহিয়া খান এর কেন্দ্রীয় সরকারেই দায়ী। এই সাপ্তাহিকটিতে আর বলা হয়েছে, কোন একটা দেশের অভ্যন্তরে এত লোককে হত্যা করা হলে বিশ্ববাসী সে সম্পর্কে নীরব থাকতে পারে না। পাকিস্তানে গণহত্যাও শরণার্থীদের ভিড় একটা দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারের সীমানা ছাড়িয়ে গিয়েছে। এখন সময় এসেছে এ ব্যাপারে বিশ্ববাসীর নিন্দা করবার। এই ব্যাপক মর্মস্পর্শী ঘটনা দেখে কোন মানুষের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। এই বিরাট বিয়োগান্তক ঘটনা কোন ক্ষমার দৃষ্টি নিয়ে দেখা উচিৎ নয়। পাকিস্তান সরকার গণহত্যা ও অত্যাচারের ব্যপারে মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছেন।
বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে
বিখ্যাত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজ উইক বাংলাদেশের গণহত্যা একটি করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে এই হত্যাযজ্ঞের সাথে ইতিহাসের অন্য কোন ধ্বংসলীলার তুলনা হতে পারে না। শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তাদের আকাশের দিকে ছুড়ে দিয়ে সঙ্গীনের মাথায় গেঁথে ফেলে সৈনিকরা পৈশাচিক তৃপ্তি লাভ করেছে। নারীদের বারবার ধর্ষণ করার পর বেওনেট দিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে। এরকম ভয়াবহ অত্যাচার এর কোন নদীর আধুনিক যুগের ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। হয় সেনাবাহিনীর এই অত্যাচার চালাচ্ছে তাদের রক্ত পিপাসু বিকৃত মনের বাসনা চরিতার্থ করার জন্য অথবা তাদের বলা হয়েছে জনগণের মধ্যে ধ্বংসলীলা চালিয়ে এক ভয়ঙ্কর ত্রাসের রাজত্ব ইচ্ছা করে সৃষ্টি করতে। মনে হয় শেষেরটিই বেশি সম্ভব। সম্ভবত ইয়াহিয়া খান এর অনেক কিছুই জানেন। কারণ টিক্কা খানকে তিনিই আদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু রক্তপিপাসু টিক্কা খানের হত্যালীলা যে এত দূরে এগিয়েছে এবং বর্বরতা যে চরম সীমায় পৌঁছেছে যে হয়তো তিনি জানেন না। কিন্তু তিনি জানুন আর নাই জানুন এই হত্যালীলা ও নরমেধ যজ্ঞের ফল একটিই হচ্ছেঃ পূর্ব পাকিস্তান আজ নামমাত্র পাকিস্তানের অংশ। যে পাশবিকতা চালানো হয়েছে পূর্বাঞ্চলের মানুষের উপর তাতে আর কোনদিন পূর্ব-পশ্চিমের একত্রে জোড়া লাগানো যাবেনা। পাকিস্তানের দুই অংশ চিরদিনের মত বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। রক্তস্নাত বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র। আজকের অসহায় শিশুরা যে ঘৃণ্য বর্বরতা দেখলো, জীবনে তাদের পক্ষে তা আর ভুলে যাওয়া সম্ভব হবে না। ইয়াহিয়ার ভুল সিদ্ধান্তই পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মৃত্যু ঘটিয়ে দিয়েছে।
হাঙ্গেরি সরকারের উদ্বেগ
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী মিঃ জেনো ফক সম্প্রতি পার্লামেন্টে বলেন যে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নরনারী অবর্ণনীয় দুর্দশার নির্যাতনের সংবাদে হাঙ্গেরি সরকার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন রয়েছেন। তিনি আরো বলেন যে বাংলাদেশে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের একান্ত প্রয়োজন।
আরব পাকিস্তানকে চাপ দেবে
সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র প্রেসিডেন্ট জনাব আনোয়ার সাদাত গত ৩রা জুলাই নীলহ্রদের ভারতীয় কৃষি মন্ত্রী জনাব ফখরুদ্দিন আহমেদের সহিত এক সাক্ষাৎকারে তাকে জানান যে বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে তার জন্য স্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টির ব্যাপারে সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র পাক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জোর চেষ্টা চালাবেন।
বৈঠক শেষে ভারতীয় কৃষি মন্ত্রী জনাব আহমেদ সাংবাদিকদের জানান যে প্রেসিডেন্ট সাদাত বাংলাদেশ সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
জঙ্গী শাহের ধ্বংসলীলা সম্পর্কে যা কিছু বলা হয়েছে তা অত্যুক্তি নয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের সদস্য কর্নেলিয়াস গালাঘার বলেছেন, ভারতে শরণার্থী শিবির গুলি নিজের চোখে দেখার আগে আমি মনে করতাম খবরের কাগজে যা কিছু করেছি তা নিশ্চয়ই অনেক পরিমাণে বাড়িয়ে লেখা। কিন্তু ভারতে এসে আগরতলা হাসপাতাল ও অন্যান্য অঞ্চলে যা দেখলাম তা মনে হল খবরের কাগজে যা কিছু বলা হয়েছে তা খুবই কম করে বলা হচ্ছে। গালাঘার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈনিক ছিলেন। তিনি বহু ধ্বংসলীলা নিজের চোখে দেখেছেন। তিনি বলেছেন আমি যুদ্ধে অনেক ভয়াবহ ধ্বংস কান্ড প্রত্যক্ষ করেছি। কিন্তু বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তার তুলনা সে সবের সাথে কোনমতেই করা চলে না। এ এক অতি হৃদয়বিদারক ব্যাপার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি চাইতেও এই ধ্বংসলীলা আরো ভয়াবহ ও বীভৎস।
বাংলাদেশের অবস্থা সম্পর্কে পাক সরকার মিথ্যা প্রচার করছে
ইংল্যান্ডের নামকরা সংবাদপত্র গার্ডিয়ান ও ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত একটি দল বাংলাদেশ সফরে গিয়েছিলেন। তারা ফিরে এসে বলেছেন বাংলাদেশের কোথাও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। এমনকি রাজধানী ঢাকা শহরেও নয়। সেখানেও লোকে বাস করছে এক ত্রাসের রাজত্বে। ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক বলেন তাদের থাকাকালীন অবস্থায় মুক্তিফৌজ টাঙ্গাইল শহর আক্রমণ করেছিল।
পাঞ্জাবীদের প্রভু বাদী মনোভাবই পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য দায়ী
ভিয়েনার kaonen leitung পত্রিকার সাংবাদিক বাংলাদেশ সম্পর্কে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধ দিতে বলা হয়েছে পাঞ্জাবি টা মনে করে যে তারা শাসক। তাদের এই প্রভুপাদ মনোভাবের জন্যই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। শাসক জাতির গর্ব উন্নত পাঞ্জাবীরা বাঙালি দেশের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে; ফলে বাঙালিরা বাধ্য হয়ে ঘোষণা করেছে তাদের স্বাধীনতা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। আর এই সব অস্ত্র এখন ব্যবহার করা হচ্ছে নির্বিকার গণহত্যায়। বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত চলেছে বাঙালি নিধন। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের ফলে পাকিস্তানের ঐক্য চিরতরে বিনষ্ট হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি এখন কেবল সময়ের প্রশ্নমাত্র।
ওলন্দাজ সরকার পাকিস্তানকে আর সাহায্য দেবে না
ওলন্দাজ সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে যে, পাকিস্তানকে ওলন্দাজ সরকার আর কোনো সাহায্য দেবে না। কারেন্ট পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ওলন্দাজ সরকারের কাছে তখন পরিষ্কার নয়। তারা বুঝতে পারছে না পাকিস্তানের অবস্থা নিকট ভবিষ্যতে ঠিক কি হতে যাচ্ছে।
বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী
বুলগেরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মিঃ টোডোর বলেছেন, বাংলাদেশ সমস্যা এখন আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। কেবলমাত্র আন্তর্জাতিক উদ্যোগে রাজনৈতিক উপায়েই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
সোফিয়া মিঃ জীপকভ বলেনঃ বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারত ও পাকিস্তানকে দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা চলে না। ভারতে আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য বিশ্ববাসীর নিশ্চয়তা দেওয়া উচিত।
সিংহলের পররাষ্ট্র দপ্তর
সিংহলের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে ঃ বাংলাদেশ সমস্যা বিশ্বশান্তির জন্য উদ্বেগ স্বরূপ। এর পরিণতিতে বিশ্বশান্তি বিপন্ন হতে পারে।
সিংহলের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক প্রেস রিলিজে বলা হয় ঃ সিংহাল সরকার মনে করে বাংলাদেশ থেকে চলে গিয়ে যেসব লোক ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন-তাদের সমস্যা একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা’। বিশ্ববাসীর উচিত এ সমস্যা অনুধাবন করা।
লন্ডনস্থ বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটি
লন্ডনস্থ বাংলাদেশ সংগ্রাম কমিটি টাইমস অফ লন্ডন-পত্রিকায় একটি পূর্ণ পৃষ্ঠা সংবাদ পরিবেশন করেছেন। এখানে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য মিঃ জন স্টোন হাউস পার্লামেন্টে যে বিতর্ক উত্থাপন করেছেন তার উদ্ধৃতি রয়েছে। এই বিলে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানানো হয়। ২০০ জন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের আহ্বান জানিয়ে এ বিলে স্বাক্ষর। এদের বেশিরভাগেই শ্রমিক দলের সদস্য। বিলটিতে বাংলাদেশের নির্বিচার গণহত্যা চালানোর জন্য পাকিস্তানের তীব্র নিন্দা করা হয়।
একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
২৫ শে মার্চের পর থেকে প্রত্যেকটি রাত মনে হচ্ছিল দুঃস্বপ্নের এক একটা দীর্ঘ ইতিহাস। রাত দশ টা থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত কার্ফু। নটায় খাওয়া দাওয়া সেরে শুয়ে পরি। ঘুম কিছুতেই আসতে চায়না। রাস্তা দিয়ে মিলিটারি ট্রাক যায় রাতের স্তব্ধতা ভঙ্গ করে। ভারী চাকার শব্দ মনে হয় বুকের পাঁজরা গুড়িয়ে দেবে। মাঝে মাঝে এমন হয় হয়তো রাত দেড়টার দুটোর দিকে একটু তন্দ্রাভাব এসেছে এমন সময় মেশিনগানের আওয়াজ। যতক্ষণ আওয়াজ চলে ইচ্ছা হয় দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকি। চিৎকার করে সারা বিশ্ববাসীকে জাগিয়ে দেই, দেখো দেখো এই পিশাচরা কিভাবে নিরীহ বাঙ্গালীদের গুলি করে মারছে।
এর মধ্যে ঢাকার দৈনিক কাগজ গুলোর মধ্যে সংবাদ “ইত্তেফাক” এবং “দি পিপল” বাদে বাকি সব কাগজের প্রকাশনা শুরু হয়েছে। সংবাদপত্র তো নয় মিলিটারির মাউথপিস বললেই চলে। ২৫শে মার্চের পর সামরিক সরকার অবশ্য স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, এখন যা কিছু ছাপা হবে সব আমাদের দেখিয়ে নিতে হবে। রিপোর্ট লিখে পাঠানো হতো ইনফর্মেশন বিভাগে। সেখানে কর্তাব্যক্তিরা সেগুলো দেখে ইচ্ছামত লাইন কেটে ‘সেনসর্ড’ সিল মেরে অফিসে পাঠিয়ে দিতেন। তারপর সেগুলো ছাপা হতো, সেদিন অফিসে গিয়ে দেখি আমাদের সম্পাদক হামিদুল হক চৌধুরীর ডানহাত মাহবুবুল হক স্টাফদের নিয়ে সভা করছেন। মানে উনি সবাইকে এই মর্মে ব্রীফ করছেন যে দুদিনের মধ্যে সবকিছু ঠান্ডা হয়ে যাবে। হুঁ ! মিলিটারির সাথে আবার লড়াই করবে বাঙালিরা। ইত্যাদি ইত্যাদি, আমাদের মধ্যে একজন ছিল ঠোটকাটা। সে বলে যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলি, তাই তো আর স্ট্রাইক বা ধর্মঘট নয় যে দাবি মেনে নিল মালিকপক্ষ ব্যস সবকিছু শেষ। বাঙালির বাঁচামরার প্রশ্ন, সুতরাং এই প্রশ্নের জবাব না পাওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে। আর এই প্রশ্নের জবাব যা তা তো আপনি জানেন, স্বাধীনতা। একথা শুনে মাহবুবুল হকের সুদর্শন মুখটা কালো হয়ে উঠল।
এদিন কয়েকবার আমাদের বলা হলো যে আপনাকে জিনজিরা গিয়ে সব দেখেশুনে এসে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণী লিখতে হবে। বললাম, কি লিখতে হবে? নিশ্চয়ই লিখতে হবে যে সব স্বাভাবিক বাজারে ক্রেতার ভিড় এত বেশি যে হাঁটাচলা করা সম্ভব নয়, পণ্যদ্রব্য রকমারি বিক্রি হচ্ছে। উত্তরা আমার বস একটু হেসে বললেন, আপনি তো জানেন কি লিখতে হবে। সকাল দশটায় বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে যখন জিনজিরা এসে পৌঁছেছি, তখন দেখলাম দলে দলের লোক পাঠাচ্ছে নৌকা করে। কোথায় যাচ্ছে ওরা নিজেরাই জানেনা। কেউ কেউ সর্বস্ব হারিয়ে চলেছেন শহরের দিকে। কারন গ্রামের দিকে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব।
প্রথমে গেলাম বাজারের দিকে, এটা সবারই জানা আছে যে জিঞ্জিরায় রয়েছে, পেঁয়াজ, ডাল ,আদা, শুকনা মরিচ এই সমস্ত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আড়ত। ঢাকা ও আশেপাশের জেলাসহ থেকে বহু ব্যবসায়ী এখানে আসেন পণ্যদ্রব্য কিনতে। কিন্তু সেদিন গিয়ে দেখি আড়তদারদের প্রায় সব দোকানপাট বন্ধ। বাজারে বিক্রি হচ্ছে আলু, পেঁয়াজ, লবণ, চাল, ডাল ইত্যাদি। তাও পরিমাণ অনেক কম। ক্রেতার ভিড় নেই মোটেই, বাজারে যাদের দেখলাম, ওদের চেহারার কোনো স্বাভাবিক সুস্থতার লক্ষণ নেই। মনে হলো কলের পুতুল। বাজার ছাড়িয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেলাম, চোখে পড়লো কয়েকটি পাকা দালান। কোন মতে মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। গোলার আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়েছে দেয়াল। গোলাগুলি করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি আগুন দিয়েছে আর একটু দূরে যাওয়ার পর দেখলাম, একটা বিরাট এলাকা জুড়ে অত্যাচারের ধ্বংসলীলার স্বাক্ষর। দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, কি দোষ করেছিল এই নিরীহ গ্রামবাসীরা। ওরা তো বাঙ্গালী।
খুব কড়া রোদ। তাই একটা গাছের ছায়ার নিচে এসে দাঁড়ালাম। আমার পাশে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ তাকিয়ে দেখি চোখ বেয়ে দরদর অশ্রু ঝরছে। অপলক দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে আছেন সেই ধ্বংসস্তূপের দিকে। আমি যে পাশে দাঁড়িয়ে আছি তা তার মোটেই খেয়াল নেই। কাছে গিয়ে বললাম- বাবা, আপনি কাঁদছেন কেন?
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বুড়ো আমার দিকে তাকালেন। চোখ মুছে বললেন-ওই যে একটা কলসি পইরা রইছে ছাইয়ের গাদার মধ্যে ঐহানে আছিল আমার বাড়ি। সব গেছে। পঞ্চাশ টা আসিলো লাগালাগি শ’চারেক আসিলাম পোলা মাইয়া বুড়া বেবাক মিলাইয়া। পঁচিশ জন আছি অহন। বাকী সব মইরা গেছে। আমার মাইয়াড়ার বিয়া ঠিক হইছিলো তারেও….বলতে বলতে বৃদ্ধ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
ঘন্টা দেড়েক জিঞ্জিরার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরেছি। ক্ষত-বিক্ষত জিঞ্জিরা দেখে এই কথাই বারবার মনে হচ্ছিলো আমার মা-বাবা, ভাই-বোনের। এই রক্তের মূল্য কি বৃথা যেতে পারে? ফেরার পথে এসে নৌকা করে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিচ্ছিলাম, সে বললে, কি কমু স্যার, কেমনে বাইয়া গেছি জানিনা, বউটা মরছে, পোলাডা পলাইয়া বাঁচছে। স্যার, বন্দুক দ্যান একটা, যাই দু-একটা পাঞ্জাবি মাইরা আসি। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম- কতো লোক মরেছে বলে তোমার ধারনা। সে বললে, ক্যামনে কমু স্যার, তো আমার মনে হয় চার পাঁচ হাজার তো কমসে কম হবে।
অফিসে ফিরে এসে রিপোর্ট লিখে দিলাম। পর দিন অফিসে গিয়ে কাগজটা দেখলাম। কাগজের প্রথম পৃষ্ঠায় বেরিয়েছে আমার রিপোর্ট। একটু নমুনা দিচ্ছি- আমাদের পাক রিপোর্টার সম্প্রতি জিঞ্জিরা ঘুরে এসেছেন। তিনি দেখে এসেছেন যে বাজারে ক্রেতার অসম্ভব ভিড়। কেনাকাটা হচ্ছে প্রচুর কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতার লক্ষণ নেই। স্বাভাবিক ভাবে প্রবাহিত হচ্ছে জিঞ্জিরার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। আমাদের স্টাফ রিপোর্টার স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথেও আলাপ করেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন যে জিঞ্জিরায় কোন খাদ্যাভাব নেই, ভীতির কারণ ঘটে এমন কোনো ব্যাপার ঘটেনি, ইত্যাদি ইত্যাদি। এই হচ্ছে বর্তমানে ঢাকার দৈনিক কাগজের রিপোর্টের নমুনা। তবে একটা সুবিধে হচ্ছে এসব মিথ্যা প্রচারে কেউ কান দেয় না। কারণ বাংলাদেশবাসী জানেন কি অবস্থা চলছে। সুতরাং খবরের কাগজ বিক্রি হয় না মোটেই।
মুক্তিযুদ্ধে আপনার করনীয় কি?
( পূর্ব প্রকাশিতের পর)
শত্রু অধিকৃত অঞ্চলে প্রতিটি গ্রামে গোপন সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। একমাত্র মুক্তাঞ্চল ছাড়া শত্রু অধিকৃত অঞ্চলে প্রকাশ্য সংগঠন কিছুতেই করা উচিত হবে না। শত্রু অধিকৃত অঞ্চলে প্রকাশ্য সংগঠন শত্রুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করতেই সাহায্য করবে। এই গোপন সংগঠন গুলোর নাম দেয়া যেতে পারে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটি। তিনজন থেকে পাঁচজন পর্যন্ত বিশ্বস্ত সাহসী এবং বুদ্ধিমান যুবক নিয়ে প্রতিটি গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটি গঠন করা উচিত। কমিটিতে বেশি সংখ্যক সদস্য নেয়া হলে গোপনভাবে কমিটির বৈঠক করা ইত্যাদিতে অসুবিধে হয়। অবশ্য একটি গ্রামে একাধিক কমিটি থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি কমিটি থেকে একজনকে দুজন নিয়ে ছোট একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করতে হবে। যে গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটি আছে তার পাশে কোন গ্রামে যদি কমিটি না থাকে তবে চেষ্টা করতে হবে সে গ্রামে যেন কমিটি গড়ে ওঠে। কমিটি গঠন ব্যাপারে বিশেষ গোপনীয়তায় অবলম্বন করতে হবে। একমাত্র কমিটির লোক ছাড়া অন্য কোন লোকজনও কমিটির গঠন ও বৈঠক ইত্যাদি সম্পর্কে কিছু জানতে না। কমিটিতে ছদ্মবেশে শত্রু চর যাতে না ঢুকতে পারে সে বিষয়ে বিশেষ সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। কারণ শত্রু চর সর্বক্ষণ চেষ্টা করবে এই সমস্ত সংগঠনগুলোতেও ছদ্মবেশে ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষতি করতে। বিভিন্ন গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটির সাথে বিশ্বস্ত লোক মারফৎ যোগাযোগ রাখতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটিগুলোর প্রথম কাজ হবে (১) মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটের সাথে যোগাযোগ করা এবং তাদের নির্দেশ অনুসারে যথাযথ ব্যবস্থা করা।
(২) সতর্কতার সাথে শত্রুর গতিবিধি এবং অবস্থান লক্ষ্য করা এবং তার নিকটস্থ মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটিতে রিপোর্ট করা।
(৩) মুক্তিযোদ্ধা ঘাঁটি থেকে শুরু করে শত্রুর অবস্থানস্থল পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রামে বহু সংখ্যক আশ্রয়স্থল তৈরি করা, মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুকে আক্রমণ প্রস্তুতিকালে এবং সংঘর্ষের পর তাদের আশ্রয় দেয়া।
(৪) মুক্তিযোদ্ধা গ্রামে আশ্রয় নিলে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা এবং গ্রামের চতুর্দিকে কড়া নজর রাখা। শত্রুসেনা মুক্তিযোদ্ধার সন্ধানে গ্রামে এলে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎক্ষণাৎ সরিয়ে নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে যাওয়া।
(৫) গ্রামের শত্রু চর বলে কাউকে সন্দেহ হলে তার নাম ঠিকানা মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট দেয়া এবং শত্রু চর খতম করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা।
(৬) শত্রুকে অতর্কিত আক্রমন করতে কিংবা ফুল রাস্তায় তাদের ধ্বংস করতে সহায়তা করা। কিন্তু এ কাজে মুক্তিযোদ্ধা সহায়ক কমিটির মাত্র দুই জনকে নিয়োগ করা যাবে। অনর্থক উৎসাহ দেখা কমিটির সমস্ত সদস্যদের একসঙ্গে এ কাজে নিযুক্ত হওয়া উচিত হবে না।
(৭) স্বাধীনবাংলা সরকারের প্রচারপত্র গোপনে গ্রামে বিলি করা এবং মুক্তিযুদ্ধের সুনিশ্চিত জয় সম্পর্কে লোকের মনে দৃঢ় প্রত্যয় সৃষ্টি করা।
(৮) গ্রামের দুষ্কৃতিকারীদের উপর নজর রাখা এবং তাদের নাম মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটিতে দেয়া।
মুক্তিযুদ্ধের এ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ কমিটির কর্তব্য এবং দায়িত্ব অপরিসীম। আজ বিবিসি ইত্যাদি বিদেশি সংবাদদাতারা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে প্রতিটি জনগণের মুক্তিযোদ্ধারা অপরিসীম সাফল্য অর্জন করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা বহু পাক সৈন্যকে হতাহত করেছেন। পাকসেনাদের বহু কর্নেল, মেজর, ক্যাপ্টেনকে মুক্তিযোদ্ধারা বন্দি করেছেন। দিনের পর দিন পাকসেনার খাওয়া হচ্ছে তাদের মনোবল ভেঙে যাচ্ছে আর প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধারা শক্তি সঞ্চয় করছে, সাফল্যের উদ্দীপনায় দীপ্ত হয়ে উঠছে। সমস্ত রানাঘাটের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণের সম্মুখে দাঁড়াবার সাধ্য বর্বর পাক সেনার নেই। আজ যদি এই অবস্থায় গ্রামে গ্রামে মুক্তিযুদ্ধা সহায়ক কমিটি গড়ে ওঠে, যদি তারা তৎপরতা এবং বিচক্ষনতার সাথে তাদের দায়িত্ব পালন করেন, তবে অচিরেই সোনারবাংলা শত্রুর রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হবে।
বাংলার মরণজয়ী মানুষ লড়ছে ন্যায়ের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, ধর্ষিত মানবতার উদ্ধারের জন্য। এ যুদ্ধে জয় তাদের সুনিশ্চিত।
– গাজীউল হক।
ক্যাপ্টেন এর জুতো
কামাল মাহবুব
প্রায় দশ মাইল দূর থেকে ওরা এসেছেন। ওর মধ্যে চল্লিশ মাইল বাসে, পঞ্চাশ মাইল লঞ্চে, বাদবাকি হেঁটে। পার্বত্য চট্টগ্রামের নাম-না-জানা পথের চড়াই উতরাই ভেঙে দুদিন পরে ওরা যখন এসে পৌঁছলেন, তখন ২৮শে মার্চের বিকেল ছয়টা পাহাড়ের সূর্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অস্তমিত। তিনখানা ডিজেল বাস থেকে ওরা নামলেন, সংখ্যায় শতাধিক হবে। গাড়ি থেকে নামতেই কজন স্লোগান জুড়ে দিলেন জয় বাংলা।
গোধূলির প্রলেপ ওদের মুখে ছিল। বিষ্ণু ওদের মোটেই ক্লান্ত বোধ হচ্ছিল না। বরং ওদের আকাঙ্ক্ষিত জায়গায় চলে এসে, তৃপ্তির আভাস মুখে ভরে উঠেছিল। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, কোত্থেকে এসেছেন?
আসলাম বর্ডার থেকে। হেসে উত্তর দিলেন তিনি।
কবে রওনা হয়েছেন?
পরশু দুপুরের পর। ২৮ তারিখের ঘটনা জানলাম আমরা। আমি সিগনালে ছিলাম। হঠাৎ রাঙ্গামাটি থেকে খবর এলো পাকিস্তানীরা বাঙ্গালীদের আর ই, পি, আর -এর জওয়ানদের মারছে। আমরা জনাবিশেক এখানে ছিলাম। খবরটা পেয়ে দেরী না করে চলে এলাম।
পথে আসতে অসুবিধা হয়নি তো?
অসুবিধা কি যে বলেন আমরা হচ্ছি ইপিআর, আমাদের আবারো সুবিধা-অসুবিধা কি? বরং পথে আসতে চাকমারা আমাদের খুব সাহায্য করেছে। আমাদের রাইফেল মেশিনগান কিছুই নিজেদের বইতে হয়নি, ওরাই আমাদের সাথে বয়ে নিয়ে এসেছে।
চাকমারা তাহলে শেখ মুজিবের দলে? আমি প্রশ্ন করলাম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সবাই জয়বাংলা। ই,পি,আর জওয়ানটি বললেন, চাকমারা ই হোক আর যাই হোক বাংলাদেশের মানুষ হলেই জয় বাংলা। কথা বলতে বলতে ভিড়ের অন্য পাশে সরে এলাম। বছর পঁচিশের একজন সিগারেট টানছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম আপনার নাম কি?
তসলিম!
দেশ কোথায় আপনার?
ফরিদপুর ।
আপনিতো তাহলে বঙ্গবন্ধুর জেলার লোক।
তা ঠিক। জওয়ানটির চোখে মুখে হাসি উপচে পড়ল। সারা বাংলাদেশেই অবশ্য শেখ সাহেবের।
তসলিমের সাথে আলাপ আলোচনায় কিছুক্ষনের মধ্যে বেশ ভাব হয়ে গেল। হরিণা ক্যাম্পে ছিলেন ওঁরা। সেখান থেকে বরকল হয়ে তারপর রাঙ্গামাটি এসেছেন। ক্রমে তসলিম এর সাথে আমার অন্তরঙ্গতার হল। ওর বাড়ির অনেক গল্প শোনালেন আমাকে। বাবার মেজ ছেলে তসলিম। মেজ ছেলেরা নাকি একটু ডানপিটে ধরনের হয়, তাই তিনি খানিকটা ডানপিটে হয়েছেন। বেশ ক’বছর হল ইপিআর এর খাতায় নাম লিখিয়েছেন। শেখ সাহেব ওদের মধ্যে দারুন পপুলার। আর হবে বা না কেন? দেশের জন্য ফাঁসির কাঠে গিয়ে চড়তে চড়তে বেঁচে এসেছেন। রেডিওতে সাতই মার্চের বক্তৃতা শুনে না কি মনে হয়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
বাঁধা দিয়ে বললাম, হরিণায় কি করে খবর পৌঁছালো?
সিগন্যাল এর খবর। আর ভাগ্যিস সিগনালে ছিল বাঙালি। আমাদের কমান্ডাররা সব পাঞ্জাবি।
পাঞ্জাবি মানে বিস্মিত হয়ে বললাম, ইপিআর এর মধ্যে আবার পাঞ্জাবি কেন? ইপিআর তো হচ্ছে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। আপনি কিছুই জানেন না দেখছি। তসলিম হাসলেন, আমাদের জওয়ানরা প্রায় সবাই বাঙ্গালী। কিন্তু অফিসাররা সব বিহারী। বিহারী মানে অবশ্য পশ্চিমা।
বললাম বাঙালি কমান্ডার নেই?
তসলিম বললেন সুবেদার মেজর পর্যন্ত হয়, তারপর আর উন্নতি হয় না।
কেন? এই অবস্থা কেন?
বাঙ্গালীদের ওরা বিশ্বাস করতে চায় না, তাই প্রমোশন দেয় না। অবাঙ্গালিরা সব কমান্ডে থাকে, যাতে বাঙালিরা তেরিবেরি করতে না পারে।
তাহলে তো মারাত্মক ব্যাপার। বললাম আমি।
সেসব কথা কি আর বলব। তসলিম জানালেন, ওসব বলে লাভ নেই। এই দেখুন, আমাদের ক্যাপ্টেন ছিল পাঞ্জাবি। বেটা ভারী বজ্জাত আর হারামি। আমাদের হুকুম দিলো কিনা রাইফেল জমা দিতে। আবঘারটি দেখুন।
আপনারা কি করলেন?
ব্যাটার ঝামেলা চুকিয়ে দিলাম। বড় বেশি অর্ডার ফর্ডার মারত। সহজ স্বাভাবিক স্বরে তসলিম জানালেন, দিলাম খতম পড়িয়ে।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। হাত মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে নিতে বললেন সুবেদার সাহেব। রাতে ওদের প্লাটুন অপারেশনে বেরিয়ে যাবে। আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তসলিম ওদের দলের মধ্যে ঢুকে পড়লেন।
পর দিন সন্ধার পর আবার দেখা হল তসলিমের সাথে একটু আগেই ওদের প্লাটুন ফিরে এসেছে। নতুন পজিশনে যাবার জন্য খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লেন।
ওঁকে জিজ্ঞেস করলাম, যুদ্ধের খবর কি?
ম্লান হেসে তসলিম জানালেন, ভালো। ওদের এগারো, আমাদের তিন।
তার মানে?
মানে, ওদের এগারো জনের বদলে আমাদের গেছে তিনজন। তবে একজন ও যেত না। আমাদের হাতে একটা মাত্র এলএমজি আর ওরা সব ভারি ভারি হাতিয়ার ব্যবহার করছে। আমাদের হাতিয়ার ছোট।
এখন আবার ওখানেই যাওয়া হচ্ছে?
তা জানিনা কোথায় যাব। তসলিম হাতের সিগারেটটা শেষ টান মেরে ছুড়ে ফেলে দিলেন। তারপর ঘরের এক প্রান্তে এসে কাপড় পড়ে তৈরি হতে লাগলেন। বেশ পাটভাঙ্গা খাকি পোশাক পরলেন তসলিম। একটা রুমাল গুজলেন পকেটে। তারপর জুতো পরতে শুরু করলেন। একজোড়া ক্যাম্বিসের জুতো। এক পাটির পেছনের তলা ছিড়ে হা হয়ে আছে। অত্যন্ত মলিন জুতোজোড়া পায়ে দেওয়ার পরিচ্ছদের সাথে ওটা মোটেই মানালো না। আমার চোখে বেশ দৃষ্টিকটু ঠেকলো। বললাম জুতোজোড়া তো ছিড়ে গেছে। অন্য একজনের পড়ে নেন না কেন? জুতো তো অনেক আছে এখানে।
প্রথমে আমার কথা যেন কানে ঢুকলো না তসলিমের। আবার আমি বললাম জুতোজোড়া পাল্টে নিলে হয়।
আমার চোখের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তসলিম বললেন, ছেলে হলে কি হবে স্যার? এটা সেই ক্যাপ্টেন এর জুতো।
মনে হল পদাধিকারবলে ছোট হয়েও তসলিম পদমর্যাদায় নিজেকে তার সমান মনে করছেন।
অপরাধী কে?
বারবার অধিকৃত বাংলাদেশের এলাকার পাকিস্তান ভেতর থেকে ঘোষিত হচ্ছে একটি আকুল আবেদন। যারা ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন তাদের ক্ষমা করা হয়েছে তারা যেন পত্বর বাড়ি ফিরে আসেন ইত্যাদি। সত্যিই অপূর্ব কর্তব্যনিষ্ঠা আর অপূর্ব মানবিক চেতনা। ক্ষমা বর্বর ইয়াহিয়া ক্ষমা করেছে কাদের? ক্ষমা করার অধিকারের সংবাদ কি এবার নতুন অভিধানের লিখছে তারা যে অপরাধীরাই ক্ষমা করার যোগ্যতা অর্জনকারী।
গণ-হত্যাকারি- ইয়াহিয়া সরকারের বর্বরতার স্বাক্ষর আজ শুধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বুকেই আঁকা -তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেছে সারা বিশ্ববাসীর কণ্ঠ।
লুন্ঠণ- হত্যা- আর ধর্ষণের পথ দিয়ে কোন জাতিকে দাবিয়ে রাখা যায় না, একথা ইয়াহিয়া সরকারের জানা ছিল না মনে হয় না। কিন্তু পৈশাচিক আনন্দ উল্লাসে তারা ভুলে গিয়েছিল ইয়াহিয়া যার ফলে রক্তাক্ত পথযাত্রীরা আজ স্বাধীনতার আলোকোজ্জ্বল পথযাত্রী আর ইয়াহিয়া সরকার নিজের জালে জড়িয়ে আতঙ্কিত। তার প্রিয় অর্থনৈতিক উপদেষ্টা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করেছে অর্থনৈতিক ভরাডুবির পথে পাকিস্তান আজ ধ্বংসের মুখে। নতুন বাজেটে আটটি নতুন কর বসিয়ে ও তার কূল দেখতে পাচ্ছে না অকুল দরিয়ায়। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় পাকিস্তান ধ্বংসের শেষ নমুনা মাত্র। অথচ কাঙালিরা কি চেয়েছিল? যে ছয় দফার মাধ্যমে তাদের নিরঙ্কুশ জয় লাভ -সেই ছয় দফা অনুসারে শুধুমাত্র স্বায়ত্তশাসনেই ছিল তাদের কাম্য। অথচ সেটা পরবর্তী পর্যায়ে সহ্য হলো না কুচক্রী ইয়াহিয়া সরকারের। দলবল নিয়ে বিশ্বাসঘাতক এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন ইয়াহিয়া। ইতিহাসের পৃষ্ঠা কলঙ্কিত হলো ২৫শে মার্চ বর্বর হামলায়। হামলা প্রতিরোধ করতে গিয়ে বাঙালি প্রথম গ্রহণ করল স্বাধীনতার অস্ত্র। তাই আজ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জঙ্গী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। আর বাংলাদেশের পশ্চিম পাকিস্তানিদের অপারেশন একান্ত নিজস্ব ব্যাপার।
বাঙালি নিধন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যারা বিতাড়িত তারা অপরাধী তাই তাদের ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে আবার দেশে ফেরার অনুরোধের মূলে বিশ্ব নিন্দার পরোক্ষ স্বীকৃতি।
আগাখানী সম্প্রদায় আজ পৃথিবীর সব দেশ থেকে বিতাড়িত কিন্তু শুধুমাত্র অর্থ বিনিয়োগকারী হিসেবেই পাকিস্তানের তাদের ব্যবসার অব্যাহত রয়েছে। সেই সম্প্রদায়ের অন্যতম দূত হিসেবে নয় জাতিসংঘের দূত হিসেবে আগা সদরউদ্দিন এর সাম্প্রতিক পরিভ্রমণ ও ঘোষণা বর্বরতার সম্পূর্ণ স্বপক্ষে না হলেও বিপক্ষে মোটেই নয়। তার কাছে প্রশ্ন আজ ঢাকায় আগাখানী যুবক-যুবতীর স্বল্পতার কারণ কী? তাদের অধিকৃত টেলিফোন অপারেটর চেয়ার ব্যাংকের কেরানির চেয়ারগুলো আজ শূন্য কেন? এ কথা কি সত্যি নয় তারাও এই বর্বর শাহির ধর্ষণের শিকার হয়ে -আত্ম রক্ষার তাগিদে পশ্চিম পাকিস্তানের পলায়ন করেছে? তারা ধর্ষিত হতে অস্বীকার করে পালিয়েছে -তাই তারাও কি অপরাধী নয়?
অপরাধের বোঝা যাদের মাথায় আজ তারা ইসলামের আবরণে নিজেদের আত্মশুদ্ধি (!) নয় আত্মরক্ষায় ব্যস্ত এ সত্য আজ বিশ্ববাসীর কাছে উন্মোচিত। যারা নিরস্ত্র মানুষকে অসহায় শিশুকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করেছে -যারা মসজিদ ধ্বংস করেছে, মন্দির, বৌদ্ধ মন্দির লুণ্ঠন করেছে, যারা কবর থেকে হিংসায় উন্মত্ততায় লাশ (শহীদ দারুকে’র লাশ ঢাকার মালিবাগ সিদ্ধেশ্বরীর মোড় থেকে) উঠিয়ে নিয়ে গেছে -যারা মৃতদেহ কুকুর শেয়াল শকুন দিয়ে খাইয়েছে -তাদের অপরাধের বিচার কে করবে?
কিন্তু বিশ্ববাসী মনে করতে পারে যে বিচার তাদের শুরু করেছে বাঙালি মুক্তিফৌজ! বিচারে তাদের শুরু করেছে পাকিস্তান এই ডেকনসোটিয়াম ব্রিটিশ রাজ তাদের আর কোন সাহায্য না দেবার মাধ্যমে! আর বিচারের পটভূমিকা সৃষ্টি করেছে তারাই তাদের বর্বর হামলার মাধ্যমে।
আজ বিশ্ববাসীর কাছে বাঙ্গালীদের ক্ষমা প্রদর্শনের প্রহসনে তাদের অপরাধের গুরুত্ব সত্যিই কমছে কি?
শূন্য অর্থ কৌসার তারা মার্কিন আর চীনা সম্ভার দিয়ে -ভরাতে যতই চেষ্টা করুক না কেন তাদের অপরাধ বিশ্ববাসীর কাছে আরও বাড়বে বৈ কমবে না! পঙ্গু অর্থনীতির মত পঙ্গু রাজনীতিকে বর্বর ইয়াহিয়া সরকার আর যে চালু করতে পারবেনা-এ কথা সবাই জানে।
মেকি অর্থনীতি আজ আর রাজনীতির ভুয়ো মুখোশে চাপা থাকবে না।
সারা বিশ্বের ক্রুদ্ধরোষ আজ আর নির্যাতিত বাঙালির বিপক্ষে নয়-তাই অপরাধীকে একথা বলার অবকাশ নেই। বাঙালির রক্তে রঞ্জিত ওই রক্তমাখা-মুখের আর কোন বানীতে কোন বাঙালির মন আর ভিজবে না। বিচারের অধিকার এখন শুধু মুক্তি ফৌজের!
মুক্তিফৌজ জানে অপরাধী কে? আর তার বিচারের রায় আজ জনতার রায়! শুধু অপরাধী কে- এই ঘোষণা করেই বাংলার মুক্তিবাহিনী ক্ষান্ত হবেনা-তাদের ধ্বংস করার মহাব্রত আজ তারা পালন করছে!
সেদিন বেশি দূরে নেই যেদিন এই বর্বর ইয়াহিয়া- জঙ্গি বাহিনী কে সম্পূর্ণরূপে সংহার করবে মুক্তিবাহিনী। জয় বাংলা।
আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোর কয়েকটি দিক
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সরকারি খাত ও জাতীয়করণ
শুধুমাত্র ক্রমবর্ধমান ট্যাক্স ধার্য করে এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে সম্পদ পুঞ্জিভূত করেন এবং অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোর নিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে সুবিধাভোগী কোটারিকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। কার্যকরভাবে সেক্টরগুলোর জাতীয় করেন এবং ভবিষ্যতেও সেক্টরগুলো সরকারি খাতের অন্তর্ভুক্ত করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সামাজিক ন্যায় বিচারের অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে এ ধরনের জাতীয়করণের কর্মসূচি গ্রহণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পূর্ব শর্ত। অবশ্য, অত্যন্ত সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনা সহকারে জাতীয়করণ কর্মসূচি রূপায়ণ করতে হবে। প্রশাসনিক কর্মচারীর এবং সর্বোপরি দক্ষতার ওপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ে সেদিকে লক্ষ্য রেখে জাতীয়করণের মাত্রা, গতি ও গঠন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা উদ্ভাবিত না হলে মূল্যনির্ধারণ নীতির ত্রুটি এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংগঠনগুলো অদক্ষতায় আক্রান্ত হতে পারে-সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকা এবং এটা স্পষ্ট দেখা যায় যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংগঠনগুলোর পরিচালনার জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সবচেয়ে ভালো পেশাদার কর্মচারী নিয়োগ করলে ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সর্বোচ্চ মানে পৌঁছানো যেতে পারে। উপরোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয় করনের জন্য অগ্রাধিকারের তালিকাটি নিচে দেওয়া হল।
(১) ব্যাংকিং। (২) বিমা ।
(৩) লোহা ও ইস্পাত, খনি, মেশিন যন্ত্রপাতি, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং, পেট্রোকেমিক্যাল, সার, সিমেন্ট, জ্বালানি ও বিদ্যুৎসহ ভারী শিল্প।
(৪) বৈদেশিক বাণিজ্য বিশেষতঃ নিম্নলিখিত পাট ছাড়াও লৌহ, ইস্পাত দ্রব্য, কয়লা, খাদ্যশস্য, সিমেন্ট এবং সার সহ প্রধান প্রধান পণ্যের আমদানি রপ্তানি।
(৫) পাট ব্যবসা।
(৬) শিপিং সহ-প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পরিবহন।
(৭) পরিকল্পনা সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিত অপরাপর মূল শিল্প কারখানা।
ক্রমবর্ধমান করঃ
দেশের বর্তমান কর প্রথায় মুষ্টিমেয় বিশেষ সুবিধা ভোগীর প্রতি চিরাচরিত আনুকূল্যেই প্রতিফলিত হয়েছে এবং এই কর প্রথা পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা পশ্চাদমুখী। উচ্চতর উপার্জনকারী শ্রেণীর উপর ধার্য করের বোঝো আন্তর্জাতিক মানের হিসাবে সবচেয়ে কম। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সাধারণ মানুষের স্কন্ধ পরোক্ষ করের মাধ্যমে যে বোঝা (৭ম)
আওয়ামী লীগের মেনিফেস্টোর কয়েকটি দিক
শিক্ষা
আমাদের সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক উন্নতি সাধন করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবে পরিণত করার জন্য আমাদের অনেক বেশি সম্পদ বরাদ্দের প্রয়োজন। মোট উৎপাদনের চার ভাগ এই খাতে নিয়োজিত করতে হবে। এই অধিক বরাদ্দ থেকে গৃহাদি নির্মাণ বাবদ অপেক্ষাকৃত কম খরচ করে শিক্ষকদের বেতন স্কেল বাড়ানোর জন্য বেশি অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সকল শ্রেণীর জনসাধারণকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বর্তমানে মিশনারি স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ক্যাডেট কলেজ ইত্যাদির মতো উন্নত ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্বল্পসংখ্যক সুবিধাভোগী ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রস্তাবিত শিক্ষা ব্যবস্থা তেমন হবে না। সারাদেশে একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার জন্য এইসব বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হবে।
নিরক্ষরতা দূরীকরণঃ
সমূলে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সকল রকম ব্যবস্থা করা হবে। এই উদ্দেশ্যে নয়া কৌশল এবং প্রচলিত নিয়ম বহির্ভূত পন্থা অবলম্বনের দরকার হবে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দের নিরক্ষরদের শিক্ষাদানের জন্য জাতীয় সার্ভিস প্রোগ্রাম কাজে লাগানো এই ধরনের একটি পন্থা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাঃ
সকলের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে এই লক্ষ্যে পৌঁছা যাবে বলে আশা করা যায়। মাধ্যমিক শিক্ষা সকল শ্রেণীর জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আনা হবে।
কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষাঃ সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমাজের ছাদের ঢালাই করা হবে এবং এই ধরনের প্রয়োজন সম্পর্কে ষষ্ঠ জরিপের পরেই কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা দানের জন্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। পলিটেকনিক ইনস্টিটিউশন সমস্ত দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ঃ
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করা এবং মেধার ভিত্তিতে সকল শ্রেণীর জনসাধারণের জন্য শিক্ষার পথ খুলে দেওয়া হবে। মেধাবী ছেলে মেয়েদের উচ্চশিক্ষালাভের পথে দারিদ্র যেন বাধা হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। সকল ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে দ্রুততার সাথে সমগ্রদেশের মেডিকেল কলেজ এবং কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেকগুলো নয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ স্থাপন করা হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। বিশিষ্ট এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদদের মধ্য থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হবে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাধীনতা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্বকারী সমস্ত আইন বাতিল করা হবে।
শিক্ষকতা পেশাঃ
আমাদের দেশে শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যারা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সবরকম চেষ্টা করা হবে। এ জন্য কেবল তাদের বেতনের স্কেল বৃদ্ধি ও বৈষয়িক সুবিধা দিলে চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে।
স্বাস্থ্য
সমগ্র সমাজে একটি ব্যাপক স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা চালু করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অবিলম্বে প্রত্যেক থানা কেন্দ্র একটা করে মেডিকেল কেন্দ্র এবং প্রত্যেক থানায় একটি করে হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। এই ধরনের মেডিকেল কেন্দ্র ও হাসপাতালের জরুরি ওষুধপত্র পাওয়া যাবে। প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যূনতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের সাহায্যে পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে জাতীয় জাতীয় সার্ভিস চালু করা হবে। এই সকল কেন্দ্রে নিয়োগ এর জন্য অধিক সংখ্যক ট্রেনিংপ্রাপ্ত কর্মচারীর প্রয়োজন হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কমপক্ষে প্রত্যেক গ্রামে পর্যাপ্তসংখ্যক নলকূপ স্থাপনের লক্ষ্য থাকবে।
বসন্ত, যক্ষ্মা এবং কলেরার ন্যায় প্রতিরোধযোগ্য রোগের টিকা এবং ইঞ্জেকশন দানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সেতু
(ক) উত্তরবঙ্গের সঙ্গে স্থলপথে প্রদেশের অন্যান্য স্থানের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে যমুনার ওপর সেতু নির্মাণ কে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
(খ) কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষ্যা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা হবে।
রেলওয়েঃ
রেলওয়ে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন স্কিমে বাংলাদেশের সকল রেলওয়েতে নিম্ন শ্রেণীর ভ্রমণকারীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া হবে।
বন্দরঃ
সামুদ্রিক এবং অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর- উভয় প্রকারের বন্দরের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষমতা দ্বিগুণ করা হবে এবং চালনা বন্দরের ক্ষমতা যথেষ্ট বাড়ানো হবে।
বাসস্থানঃ
আশ্রয় মানুষের জীবনের একটি মৌলিক প্রয়োজন। তাই নিম্নআয়ের লোক এবং পল্লীবাসীর জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রমিকদের জন্য মালিকদের ধরা বাসস্থানের ব্যবস্থা স্কিম ছাড়া ও সরকার বাসস্থান উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
(ক) শহর গুলোতে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য আবাসিক ইউনিট নির্মাণ।
(খ) পল্লী এলাকায় বাসস্থান নির্মাণের জন্য পল্লী উন্নয়নের পরিকল্পনা সদ্ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পল্লী এলাকায় গৃহ নির্মাণে মডেল প্রবর্তন।
নারী সমাজ
আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী। প্রধানতঃ শিক্ষার অভাবে তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে সমর্থ হচ্ছে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের সম্মান সুবিধাভোগের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হবে। সমান কাজের জন্য তাদের সমান বেতন দেওয়া হবে। মেধার ভিত্তিতে তাদের জন্য সকল সরকারি চাকরির দ্বার মুক্ত থাকবে।
যুব সমাজ
কর্ম ক্ষমতায় পরিপূর্ণ এবং আদর্শবাদী অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত আমাদের যুব সমাজ জাতির এক বিরাট সম্পদ। তাদের আদর্শবাদী অনুপ্রেরণা এবং কর্মক্ষমতাকে জাতিগঠনমূলক কাজের অভিসারী না করতে পারলে জাতীয় জীবনের চরম হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতিগঠনমূলক কর্মসূচির সঙ্গে দেশের যুবসমাজকে জড়িত করার অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা গঠন এবং সমবায় স্কিমের কথা বলা যেতে পারে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র দের নিয়ে একটা সার্ভিস কোর গঠন করে গ্রাম, কলকারখানা এবং শহরের বস্তি অঞ্চলে এই ধরনের সেবার জন্য এদের প্রতি আহ্বান জানানো যেতে পারবে।
ভাষা ও সংস্কৃতি
বাংলা ভাষা জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইংরেজির স্থলাভিষিক্ত হতে পারে তার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উন্নয়নকে উৎসাহিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে।
বৈদেশিক নীতি
আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেই আমাদের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হবে। এর সঙ্গে আমাদের বহি সীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নেই নয়, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের প্রশ্ন ও জড়িত রয়েছে।
স্বাধীন জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ঃ
আমাদের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা একটি স্বাধীন জোট-নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য ওয়াদাবদ্ধ। স্বীকার করতে হবে যে এতদিন যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি অনুসৃত হয়েছে তার সঙ্গে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সাবেক নীতির ফলে বৈদেশিক সাহায্য এবং দ্বীনের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঋণ ও দেনার বোঝা বেড়ে গেছে। বিদেশের উপরে ধরনের নির্ভরশীলতা অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আপোষমূলক নীতি গ্রহণ মারাত্মকভাবে বাধ্য করে। ফলে জাতীয় স্বাধীনতাই বিপন্ন হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে নয়া কলা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এই পরস্পর-বিরোধী নীতির অবসান ঘটানোই আমাদের লক্ষ্য। এর ফলে আমরা সত্যিকার ভাবে স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণে সক্ষম হব।
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ঃ
সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয় -এই নীতি অনুসরণে ন্যায় এবং পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশ সহ সকল দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আগ্রহী। দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য বিশ্বে বর্তমানে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে তার প্রতি আকৃষ্ট হবে না এবং আকৃষ্ট হওয়ার মনোবৃত্তি ও আমাদের নেই।
বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানঃ
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের লক্ষ্য অনুযায়ী আমরা সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায় সঙ্গত মীমাংসার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেব।
জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাঃ
আমরা জাতিসংঘ সনদে সন্নিবিষ্ট নীতিগুলো বিশেষ করে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের মৌলিক অধিকার এবং সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সাম্যের ব্যাপারে আমাদের সর্বহীন সমর্থনের কথা ঘোষণা করছি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানব কল্যাণ এর ব্যাপারে আমরা জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন জানান।
সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামঃ
আমরা সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদ এর বিরুদ্ধে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সংগ্রাম এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করছি।
পরিবহন ও যোগাযোগঃ
পরিবহন ও যোগাযোগ অর্থনীতির অন্যতম কাঠামো ও হওয়ায় এর উপর রয়েছে বর্তমান অবস্থার উন্নতি বিধানকল্পে নিম্নলিখিত নির্দিষ্ট লক্ষ্য গ্রহণ করা হবে।
দুর্বার মুক্তিফৌজের হাতে পাক সৈন্যরা নাস্তানাবুদ রণাঙ্গনে
মুক্তিযোদ্ধাদের ভয় কুষ্টিয়া থেকে টিক্কা খানের পলায়ন
বাংলার সিংহশাবক মুক্তিযোদ্ধার ভয়ে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার পাঞ্জাবি হানাদার বাহিনীর নায়ক টিক্কা খান কুষ্টিয়া সফর বাতিল করে হেলিকপ্টারযোগে কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় পলায়ন করতে বাধ্য হয়।
প্রকাশ কুষ্টিয়া জেলার দামুড়হুদা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের স্থাপিত একটি মাইন বিস্ফোরণ হয়েছে নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত এক ট্রাক পাক দস্যুসেনা খতম হয়।
বাংলা মায়ের দামাল ছেলে মুক্তিযোদ্ধাগণ মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করার জন্য বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা মায়ের সিংহশাবকদের প্রথম আক্রমণের মুখে ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে ভয়ানক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।
বাংলাদেশের পূর্ব রণাঙ্গন থেকে মুজিবনগরে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে গত ২৯শে ও ৩০ শে জন কুমিল্লা জেলার বিভিন্নস্থানে পাক দস্যুবাহিনীর ৩০ জন সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছে। এসময় দস্যু বাহিনীর একজন অনুচরকেও খতম করা হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা গত ২৯শে জন কুমিল্লা জেলার ইয়াকুবপুর পাক সৈন্যের শিবির আক্রমণ চালিয়ে ৮জন পাক সৈন্যকে হত্যা করেছেন। আখাউড়ার মুকুন্দপুর এলাকার নয় জন পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। এছাড়া সোনামুড়ার বিপরীত দিকে বিবি বাজারে কমান্ডোদের আক্রমণে এগার জন পাকসেনা নিহত হয় এবং পাঁচজন আহত হয়। কসবায় গঙ্গাসাগরের কাছে বঙ্গ শার্দুলগণ একদল পাক দস্যুকে অতর্কিতে ঘিরে ফেলেন এবং এদের মধ্যে ১১ জনকে হত্যা করেন। এছাড়া মুক্তিফৌজের হাতে দস্যু বাহিনীর পাঁচজন আহত এবং তাদের একটি জীপ বিনষ্ট হয়।
রাজশাহী ঈশ্বরদী লাইনে একটি রেল সড়কের একটি সেতু মুক্তিযোদ্ধাগণ উড়িয়ে দেন। রাজশাহী শহরে তারা সারদা পুলিশ ট্রেনিং শিবিরে অবস্থানরত পাকবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করে সাতজনকে খতম করে। এছাড়া বাংলাদেশের কাদিরপুর এলাকায় পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের এক সংঘর্ষের ফলে কয়েক জন পাকসেনা হতাহত হয়।
মুক্তিফৌজ রংপুর রণাঙ্গনে হানাদার পাক সেনাদের উপর প্রবল আক্রমণ চালিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছেন।
রংপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে পাকসেনারা এমন পিছু হটে চলেছে।
আমার খানায় মুক্তিফৌজের প্রচন্ড আক্রমণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পালিয়ে গেছে। গত ২৬ শে জুন দুই দিন ব্যাপী যুদ্ধে পাকসেনাদের অনেকেই আহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা রায়গঞ্জ এলাকায় টহলদার পাক সেনাদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ২৪ জনকে খতম করেন। পরদিন আরো ছয় জন পাকসেনা গেরিলা যোদ্ধাদের হাতে খতম হয়।
গত সোমবার গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার দখলকৃত ঠাকুরগাঁও শহরের পূর্ব দিকে পাকসেনাদের একটি সীমান্ত ঘাঁটি উড়িয়ে দিয়েছেন।
রংপুরের দশ মাইল উত্তরে বাউরা, হাতীবান্ধা ও বড় খাটি এলাকায়ও মুক্তিফৌজ গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের নাজেহাল করে চলেছেন।
সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিফৌজের গেরিলা যোদ্ধারা পাক সেনাদের উপর আক্রমণাত্মক তৎপরতা আরও জোরদার করে চলেছেন। গত ২৫ শে জুন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডো ইউনিট জাফলং এবং সোনাপুর এলাকায় পাকবাহিনীর উপর অতর্কিত আক্রমণ চালান। গত ২৭শে জুন তারিখে মুক্তিফৌজ রাধানগরের পাকসেনাদের ছাউনির উপর গোলা বর্ষণ করেন।
ময়মনসিংহ রণাঙ্গনের মুক্তিফৌজ গেরিলা যোদ্ধারা অতর্কিত হামলা চালিয়ে পাকসেনাদের নাজেহাল করে চলেছেন। বিব্রত হানাদার পাকসেনারা হন্যে হয়ে গেরিলাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে।
চট্টগ্রামের গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি লঞ্চ ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং একজন প্রহরীরত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যকে করেছেন।
যশোর থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন গত ২৭শে জুন মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি দলের উপর আক্রমণ চালান। সংঘর্ষে পাকসেনাদের অনেকেই হতাহত হয়। পাকসেনারা পিছু হঁটার সময় কাছের গ্রামের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মুক্তিফৌজ গত সপ্তাহে তিনটি মোটর বোট দখল করে নিয়েছে। এই বইগুলোতে মর্টার ফিট করা ছিল বলে জানা গেছে।
মুক্তিযোদ্ধারা মেহেরপুরের উত্তর-পূর্বে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের একটি ঘাটির উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালান। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে গত দুই দিনের যুদ্ধে মুক্তিফৌজ কমান্ডোরা ২৭ জন পাকসেনা কে খতম করেছেন। পাকবাহিনীর সীমান্ত ঘাঁটিগুলোতে এখন সন্ত্রস্ত অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পাকসেনারা মুক্তিফৌজের অতর্কিত আক্রমণের ভয়ে অস্থির। তারা ঘাঁটির চারিদিকে মাইন বসাচ্ছে। এরকম মাইন বসাতে গিয়ে সিলেট অঞ্চলে গত সপ্তাহে ১৯ জন পাকসেনা খতম হয়েছে।
যশোর জেলার কাশিপুর ও বেলতা অঞ্চলে গত মঙ্গলবার মুক্তিফৌজ ও পাক সেনাদের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। দীর্ঘ ১২ ঘন্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পালিয়ে যায়। এখানে সতের জন হানাদার সৈন্য প্রাণ হারায়। পাকবাহিনীর একজন ল্যান্সনায়েক বন্দী হয়েছে এবং তার কাছ থেকে বহু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পাওয়া গেছে।
মুক্তিফৌজ পুরুলিয়ার রোডে মাইন এর সাহায্যে একটি পাকিস্তানি সামরিক উড়িয়ে দিয়েছেন এতে একজন ক্যাপ্টেনসহ চার জন পাকসেনা মারা যায়।
কুষ্টিয়া অঞ্চলের হাতবোমায় দুজন পাক সৈন্য খতম হয়েছে।
ফরিদপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানাচ্ছেন গোপালগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধারা পাক সেনাবাহিনীর তিনটি নৌকার উপর আক্রমণ চালিয়ে ২০ জন শত্রুসৈন্যকে হত্যা করেছেন।
পরদিন তাকেরহাট একটি সামরিক শিবিরের উপর আক্রমণ চালানো হয়। এটি ৩০ জন পাকসেনা নিহত ও একটি জীপ ধ্বংস হয়। কাবিলপুর এর গেরিলা যোদ্ধারা পাক বাহিনীর একটি ছোট দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে চারজন পাক সেনা কে খতম করেন।
মুক্তিফৌজ গেরিলারা ফরিদপুরের গুরুত্বপূর্ণ বাজার পালং এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে ওয়ারলেস সেট নষ্ট করে দেন এবং ৬০০ টি বন্দুক দখল করে নেন। ওই দিনেই মুক্তিযোদ্ধারা নড়িয়া থানার উপর আক্রমণ চালিয়ে একটি বেতারযন্ত্র ধ্বংস করে দেন এবং চারজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে খতম করেন।
মহেশকুণ্ডীতে এক হামলায় মুক্তিফৌজের হাতে তিন জন পাকসেনা প্রাণ হারিয়েছে।