মৃত্যুঞ্জয়ী বীর লে. মেহবুবুর রহমান
লে, কর্নেল মেহবুবুর রহমান, বীর উত্তম ১৯৮১ সালের ৩০ মে সেনাবাহিনীর এক অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষে নিহত হন। অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। অন্তত আমাদের জন্য, আমরা যারা তার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, বিশেষ করে একাত্তরের রণাঙ্গনে। একটু কম বয়সেই মেহবুব সিনিয়র ক্যামব্রিজ (এইচএসসি) পাস করেন পাকিস্তান বিমান বাহিনী কলেজ (পিএএফ কলেজ) সার্গোদা, পাকিস্তান থেকে। মাত্র ১৯-উর্ধ্ব বয়সে ১৯৬৮ সালে কমিশন পান ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। একহারা দেহের পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার সাধারণ গড়ন। লে, মেহবুবকে নিয়ে এ লেখা তার প্রশংসাপত্র বলে ভুল হতে পারে। আদতে এ লেখা তার প্রাপ্য স্তুতির খণ্ডাংশ মাত্র। আরেক অর্থে আমার নিজের পক্ষে দায়মােচনও। মেহবুব একাত্তরে ছিলেন ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে লেফট্যানেন্ট র্যাংকের একজন অফিসার। এ লেখা লে, মেহবুবের। একাত্তর নিয়ে। মেজর খালেদ মােশাররফ তার সেক্টরের (২ নম্বর সেক্টর) সুষ্ঠু অপারেশন পরিচালনার জন্য সেক্টরকে ছয়টি সব সেক্টরে ভাগ করেন-সালদানদী, কোনাবন, মন্তলা, রাজনগর, নির্ভয়পুর এবং মতিনগর। লে. মেহবুব ছিলেন নির্ভরপুর সাবসেক্টরের কমান্ডার। নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর এবং লাকসাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। লে, মেহবুবের অপারেশনের জন্য। দায়িত্বপূর্ণ এলাকা ছিল সীমান্তের অনেক ভেতরে। তাতে স্বভাবতই সীমান্তের ওপর অবস্থিত মূল ঘাঁটি থেকে বা সেক্টর সদর দফতর থেকে সাহায্য বা রসদ সরবরাহ পাওয়া ছিলাে অসম্ভব। লে, মেহবুব শুরু থেকে ছােট-বড় এতাে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন যে তার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া দুঃসাধ্য। তিনি নিজেও লিখে রাখেননি। বা তা যথাযথভাবে কোথাও সংরক্ষিত হয়নি। কুমিল্লার দক্ষিণে জগমােহনপুর নামক স্থানে পাকিস্তানিদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। লে, মেহবুব বিকালে দিনের আলােতে এবং রাতে শক্ত অবস্থানটি রেকি করেন নিজেই। ৩১শে মে রাত ৩টায় এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে তিনি রেইড। করেন। অকস্মাৎ এ ধরনের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য শত্রু মােটেও প্রস্তুত ছিল।
সফল এ রেইডে ১২ জন শত্রু হতাহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। অনেক অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিজেদের হস্তগত হয়। ৬ই জুন একটি ডেমােলিশন পার্টিকে লাকসামের দক্ষিণে পাঠানাে হয়। এই দলটি হিলা নামক স্থানে কয়েকটি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পুঁতে রাস্তার পাশে এম্বুশ অবস্থান গ্রহণ করে। ভাের ৫টায় কুমিল্লা থেকে ২টি জিপ ও ১টি শত্রুবাহী ট্রাক নােয়াখালী যাওয়ার পথে মাইনের ওপর পড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। একই সঙ্গে শুরু হয় এম্বুশ অবস্থান থেকে গুলি। এ যুদ্ধে ৪ জন অফিসার এবং ৭ জন শত্রু মারা যায়। একটি দল কুমিল্লার দক্ষিণে ধনপুর বিওপির কাছে পাকসেনাদের অপেক্ষায় এম্বুশ পাতে। সকাল ৯টায় পাকসেনারা দালালদের মাধ্যমে এ খবর পেয়ে যায়। কুমিল্লা থেকে। শক্রর ১ জন অফিসারসহ ১ প্লাটুন সৈন্য গ্রামের ভেতর দিয়ে এসে আমাদের এম্বুশ পার্টিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এম্বুশ পার্টি তৎক্ষণাৎ পিছু পিছু হটে গিয়ে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ প্রায় ১ ঘণ্টা স্থায়ী হয়। ইতােমধ্যে লে, মেহবুবের কাছে এ খবর। পৌছে যায়। তিনি সে, লে, কবীরকে নিয়ে অকুস্থলে পৌছান এবং শত্রুদের ঘিরে লে, মেহবুবুর রহমান। ফেলেন। পাকিস্তানিরা দু’দিন থেকে আক্রান্ত বীর উত্তম হয়ে গ্রামের ভেতর লুকিয়ে পড়ে এবং দালালদের সাহায্যে এ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়। এ সংঘর্ষে ৫ জন শত্ৰু নিহত হয়। ১০ই জুন লে, মেহবুৰ ১টি প্লাটুন নিয়ে রাতে মিয়ারবাজারের দক্ষিণে রাজারমার দীঘি ও জগমােহনপুর হ্যাচারির শক্ত অবস্থানের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ চালান। শত্রু এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায়। আমাদের সৈনিকরা শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করে। এ আক্রমণে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন। আহত হয়। এরপর আমাদের সৈনিকরা অবস্থানটি দখল করে বাংকারগুলাে ধ্বংস করে দেয় এবং শত্রুর পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত করে। জুন মাসের মাঝামাঝি লে, মেহবুব ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানি থেকে একটি প্লাটুনকে পাকসেনাদের যাতায়াতের রাস্তা ধ্বংস করার জন্য কুমিল্লার দক্ষিণে প্রেরণ করেন। এ দলটি ১৮ই জুন সন্ধ্যা ৬টায় কুমিল্লা লাকসামের বিজয়পুর রেলওয়ে ব্রিজ এবং কুমিল্লা বাগমারা সেতু উড়িয়ে দেয়। এই সেতু দু’টি ধ্বংসের ফলে কুমিল্লার দক্ষিণে সড়ক এবং রেলওয়ে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। ওইদিনই দলটি বিজয়পুর এবং মিয়ারবাজারের কাছে কয়েকটি ইলেকট্রিক পাইলন।
উড়িয়ে কাপ্তাই থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। শক্রর একটি প্লাটুন। সন্ধ্যার সময় চৌয়ারার কাছে পেট্রোলিং করতে আসে। এ দলটিকে এম্বুশ করা হয়। এতে ২ জন শত্রুসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা পরে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে জ্বালিয়ে দেয় এবং অত্যাচার চালায়। আমাদের পেট্রোল পাটি খবর আনে, পাকিস্তানিদের প্রায় এক কোম্পানি সৈন্য মিয়ারবাজারের উত্তরে একটি গােডাউনের মধ্যে অবস্থান করছে। পেট্রোলটি এই গােডাউনটিতে পৌছনাের গােপন রাস্তা, পাকিস্তানিদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অন্যান্য বিস্তারিত খবর নিয়ে আসে। এ সংবাদ পেয়ে লে. মেহবুব ৩৩ জনের একটি কমান্ডাে প্লাটুন, ব্লেন্ডেসাইড ও ৮১ মি.মি, মর্টারসহ রাত ৯টায় গুদামটি আক্রমণের জন্য পাঠিয়ে দেন। দলটি রাত ১২টার সময় শত্রু অবস্থানের কাছে পৌছে যায়। তারা একটি রেকি দল পাঠিয়ে শত্রু অবস্থানে সর্বশেষ খবর নেয় এবং জানতে পারে পাকসেনারা অবস্থানটিতে বেশি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। রাত ১টায় কমান্ডাে প্লাটুনটি অতর্কিতে শত্রুর অবস্থানের ভেতর অনুপ্রবেশ করে এবং হালকা অস্ত্রের সাহায্যে অবিরাম গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকসেনারা অনেকেই গুলিতে আহত হয়। তারা কমান্ডাে প্লাটুনের ওপর পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়।
একই দিন (১৮ই জুন) রাত ১টায় মিয়ারবাজারের দক্ষিণে আরেকটি প্লাটুন পাকিস্তানিদের ২টি বাংকারের ওপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা এরপর সমস্ত রাত মর্টার এবং হালকা অস্ত্র ফায়ার করতে থাকে। একই দল ফিলা রেলস্টেশনের কাছে কয়েকটি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইল রাস্তায় পুঁতে রাখে। পাকিস্তানিদের ১টি জিপ মাইনে পুড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এবং ৫ জন নিহত হয়। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে ১টি প্লাটুন মিয়াবাজার থেকে ফুলতলীতে টহল দিতে যায়। রাত ৩টার সময় তারা দেখতে পায় ১টি জিপ এবং ২টি ট্রাক কুমিল্লা থেকে দক্ষিণে টহল দিতে যাচ্ছে। এর সঙ্গে প্লাটুনটি কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তার উপর এম্বুশ। লাগিয়ে এই গাড়িগুলাে ফেরত আসার জন্য অপেক্ষায় থাকে। রাস্তার দু’দিকে তারা ১টি মেশিনগান এবং ২টি হালকা মেশিনগান স্থাপন করে। রাত সাড়ে ৪টায় গাড়িগুলাে মিয়ারবাজার অবস্থানে ফেরত আসে। অবিলম্বে গাড়িগুলাে এম্বুশে পড়ে যায়। এম্বুশ অবস্থান রাস্তার নিকট দূরত্বে হওয়ার গাড়িগুলাের সমূহ ক্ষতি হয়। পাকসেনারা গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করে কিন্তু এতেও তাদের অনেক লােক মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয়। পাকসেনাদের অন্তত ৩ জন অফিসার এবং ২১ জন নিহত এবং ১৫ জন আহত হয়। পরে খবর পাওয়া যায় নিহতদের মধ্যে ১ জন লে. কর্নেলও ছিলেন। এ এম্বুশের সময় পাকসেনারা কুমিল্লা বিমানবন্দর হতে তাদের সাথীদের সাহায্যার্থে কামানের সাহায্যে আমাদের এম্বুশ। অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গােলা ছুড়তে থাকে। গােলার মুখে বেশিক্ষণ টিকতে না পেরে এম্বুশ পাটি অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে আসে।
চাদপুর কোম্পানি যােগাযােগ ব্যবস্থা অকার্যকর করার লক্ষ্যে স্থানীয়। জনসাধারণের সহায়তায় হাজীগঞ্জ, লাকসাম, চাঁদপুর, কুমিল্লা সিএন্ডবি রাস্তা ও রেললাইন কেটে ধ্বংস করে দেয়। এ সময় পাকিস্তানিরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিন ড্রাইভার এবং শ্রমিক এনে রাস্তাগুলাে মেরামত করার চেষ্টা চালায়। গেরিলারা এসব পাকিস্তানি রেলওয়ে কর্মচারীদের মেরে তাদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এর ফলে রেল এবং সড়ক যােগাযােগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে ২৬শে জুলাই পাকবাহিনী ১টি কোম্পানিকে চাঁদপুর থেকে এখানে। পাঠায়। পাকসেনাদের এ কোম্পানিটি রেলওয়ে লাইনের সঙ্গে লাকসামের দিকে। অগ্রসর হয়। ঠাকুরবাজারের কাছে আমাদের একটি এম্বুশ পার্টি আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। দুপুর ২টায় পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি যখন এম্বুশ অবস্থানের মধ্যে আসে তখন দলটি গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে শক্রর ১ জন সুবেদারসহ ২২। জন হতাহত হয়। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালিয়ে যায়। এর পরদিন। গেরিলারা মধু রেলস্টেশনের কাছে রেলসেতু এবং সড়ক সেতু ধ্বংস করে দেয় এবং যে পাকিস্তানি ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্শনের জন্য আসে তাকেও আহত করে। জুলাই মাসের শেষের দিকে তার সাব-সেক্টর মিয়ারবাজার, চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার করেন। পাকসেনারা। মিয়ারবাজারে যে ক্যাম্প করেছিল সেখান থেকে চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রাস্তা আবার চালু করার। চেষ্টা করে। লে, মেহবুব মিয়ারবাজার শত্রু ক্যাম্পটি রেইড করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৩শে জুলাই লে, মেহবুব ১৫ জনের একটি কমান্ডাে দলকে মিয়ারবাজার পাকিস্তানিদের ক্যাম্প রেইড করার জন্য পাঠান। এই দলটি সন্ধ্যায় মিয়ারবাজারের কাছে পৌছে যায়। সেখান থেকে তাদের একটি ছােট রেকি দল পাক সেনাদের অবস্থান সম্পর্কে পুনুরূপ খবর সংগ্রহ করে। এই অতর্কিত হামলার জন্য পাকিস্তানিরা মােটেও প্রস্তুত ছিল না। তারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে যায়। আমাদের কমান্ডাে দলটি এ অবস্থার সুযােগ নিয়ে শত্রুর বেশ কয়েকটি বাংকার গ্রেনেড ছুড়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা আক্রান্ত হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে এবং প্রায় ২০ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। ১ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আমাদের কমান্ডাে দল শক্রর প্রচুর ক্ষতিসাধন করে।
ইতােমধ্যে পাকিস্তানিরা চাঁদপুরে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। তােলে। চাঁদপুরের এই ঘাঁটি থেকে তারা বিভিন্ন জায়গায় গাড়িতে পেট্রোলিং করত। পেট্রোলিংয়ের জন্য ২/৩টি জিপ এবং ২/৩টি ট্রাক কনভয়ের আকারে ব্যবহার করতাে। দিনে ও রাতের যে কোন সময় এই পেট্রোলিং পরিচালিত হতাে। গাড়ি ব্যবধান থাকত ৫০ থেকে ১০০ গজ। এ সংবাদ গেরিলারা লে. মেহবুবের কাছে পৌছায়। খবর পেয়ে লে. মেহবুব দু’টি প্লাটুন ২০শে জুলাই চাঁদপুরের পূর্বে পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুন দুটি চাদপুর থানার আশিকাটির কাছে এম্বুশ পাতে। পরদিন ভাের ৫টায় চাঁদপুর থেকে শত্রু একই কনভয় আশিকাটির দিকে অগ্রসর হয়। কনভয়টি যখন এম্বুশ অবস্থানের মধ্যে পৌছে তখনই এম্বুশ পাটি মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালায়। এর ফলে কনভয়ের প্রথম ৩টি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায় এবং অবশিষ্ট গাড়িগুলােরও যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করা হয়। পাকিস্তানিরা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু এম্বুশ পার্টির গুলিতে তাদের অন্তত ১০ জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। বাকিরা মৃত্যু অনিবার্য জেনে পালিয়ে যায়।
অপরদিকে আশিকাটির ৩ মাইল পশ্চিমে আরেকটি এম্বুশ পার্টি পাকসেনাদের আরেকটি কনভয়কে এম্বুশ করে। সেখানে শক্রর ৩ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। এবং ১টি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ এম্বুশ পার্টির হস্তগত হয়। ১টি মােটরসাইকেলও পাওয়া যায়। এম্বুশের খবর পেয়ে পাকসেনারা তাদের হাজীগঞ্জ ক্যাম্প থেকে একটি শক্তিশালী কোম্পানি এম্বুশ পার্টিকে আক্রমণের জন্য পাঠায়। এই কোম্পানিটি ১ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। ততােক্ষণে আমাদের এম্বুশ পাটি সংঘর্ষ শেষে মােটামুটি প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিল। পাকসেনারা। ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গে এম্বুশ পার্টি আবার তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এর ফলে শত্রুর ১২ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল হাজীগঞ্জের কাছে নরসিংপুরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনারা ওই এলাকার চতুর্দিকে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই ঘাটিকে আক্রমণ করার জন্য লে, মেহবুব নিয়ােজিত ও গণবাহিনীর একটি সম্মিলিত কোম্পানি পাঠিয়ে দেন। এই কোম্পানিটি ১৭ই জুলাই হাজীগঞ্জের দক্ষিণে তাদের অস্থায়ী গােপন অবস্থান তৈরি করে। এরপর পেট্রোল পাঠিয়ে পাকসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে। ১৭ই জুলাই সন্ধ্যায় কোম্পানিটি অতর্কিতে পাকসেনাদের ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩ জন নিহত ও প্রচুর আহত হয়। কোম্পানিটি নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফেরত আসে। | পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল কুমিল্লার দক্ষিণে পায়েলগাছা থেকে নারায়ণপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং নারায়ণপুরের অনেক বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় ও নারী নির্যাতন করে। ২/৩ ঘণ্টা তাদের অত্যাচার চলে। নারায়ণপুরের কাছে। অবস্থিত মাত্র ১৩ সদস্যের ছােট একটি গেরিলা দলপাক সেনাদের নারায়ণপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। পরে এই দল পায়েলগাছার রাস্তায় এম্বুশ পাতে। পাকসেনারা নারায়ণপুরে অত্যাচার চালাবার পর ফেরার পথে তাদের এম্বুশের আওতায় পড়লে গেরিলা আক্রমণ চালায়। আক্রমনে ১৪ জন পাকসেনা ও ২৮ জন রাজাকার নিহত এবং ১৩ জন পাকসেনা ও ১৬ রাজাকার আহত হয়। বীর যােদ্ধারা প্রাণপণে লড়ে যায়। এই এম্বুশে ১৩ জনের মধ্যে ৫ জনই শহীদ হয়, বাকি ৮ জন ফিরে আসতে সক্ষম হয়।
কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের কংশতলা ঘাটি আমাদের গেরিলা বাহিনীর যাতায়াতে বিশেষ অসুবিধা সৃষ্টি করছিল। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনাদের দখলদার দল আমাদের যাতায়াত পথে বিশেষ তৎপরতা চালাত। এই ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়ার জন্য সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফ লে, মেহবুবকে নির্দেশ দেন। বিশেষ তথ্য অনুসন্ধান করে ৫০ জনের একটি দল ক্যাপ্টেন মেহবুবের নেতৃত্বে ৩০শে সেপ্টেম্বর রাত ১টায় এই ঘাটিতে অনুপ্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর সুবেদার শাহজাহানসহ ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। এই আক্রমণের ফলে পাকসেনারা এতই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে সেখান থেকে তারা তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে কুমিল্লা চলে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়াবাজারের কাছে এটি ঘাঁটি স্থাপন করে। আগস্ট মাসে লে, মেহবুব তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে পাকসেনাদের এখান থেকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
পুনরায় এই ঘাঁটি স্থাপন করায় এটা বুঝা গেল যে পাকিস্তানিরা আবার কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তা চালু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের এই পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্য প্রথম অবস্থাতেই মিয়াবাজারের শক্ত ঘাঁটি ধ্বংস করে দেবার জন্য লে. মেহবুব এটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখ রাত ৭টায় একটি কোম্পানি পাকসেনাদের ঘাঁটি রেইড করার উদ্দেশ্যে তাদের নিজেদের ঘাঁটি থেকে রওনা হয়। রাত প্রায় ১১টায় শক্র ঘাঁটির ওপর তারা। আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড়ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর শক্রর ২ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি নিজ অবস্থানে নিরাপদে ফেরত আসে। এর ৩ দিন পর ২০শে অক্টোবর ভাের ৪টায় মিয়াবাজারের আরেকটি শত্রু ঘাঁটির ওপর মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এই অবস্থায় আক্রমণে শত্রু বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ২ ঘন্টা যুদ্ধের পর ২১ জন পাকসেনা নিহত এবং অনেক আহত হয়। নিহত ও আহত। পাকসেনাদের পরের দিন গাড়িতে করে কুমিল্লা নিয়ে যেতে দেখা যায়। মুক্তিযােদ্ধারা যে রাস্তায় ফেরত আসে সে রাস্তায় বুবি ট্র্যাপ’ (মাইন দিয়ে ফঁাদ বানানাে) লাগিয়ে আসে। পরদিন (২১শে অক্টোবর) সকালে পাকসেনাদের একটি দল সেই রাস্তায় খবরাখবর নেয়ার জন্য অগ্রসর হলে বুবি ট্র্যাপে পড়ে যায়। মাইন বিস্ফোরণের ফলে তাদের ১৬ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। লে, মেহবুবের নেতৃত্ব ও পরিকল্পনায় যতাে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে তার কিয়দাংশও এখানে বর্ণিত হয়নি, বর্ণনা করা সম্ভবও নয় সেকথা শুরুতেই বলেছি। ১ প্লাটুন সৈনিক নিয়ে লালমাই এলাকায় ১৮টি শক্রবােঝাই গাড়ি (গাড়ির সংখ্যা আগে জানা যায়নি) এম্বুশ করে তিনি এবং তার সহযােদ্ধারা নিশ্চিত মৃত্যু ফাঁদে পড়েছিলেন। মৃত্যুঝুঁকি মেহবুব দু’পায়ে মাড়াতেন। পাকিস্তানিদের কাছে লে. মেহবুব ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক। কিন্তু দেখে বুঝবার জো নেই। মৃদুভাষী, অমায়িক আচরণের নির্ভীক এ যােদ্ধার দেশপ্রেম ছিল আ-বুক। যতবার, যত প্রসঙ্গে নির্ভয়পুরের লে. মেহবুব স্মৃতিতে আসে ততােবারই তাকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রণতি জানাই। মেহবুবদের সংখ্যা বরাবরই বিরল। তারাই আমাদের অনাদিকালের দেশপ্রেমের প্রেরণা।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)