বীরশ্রেষ্ঠদের অন্তিম শয়ান
১৯৯৪ সাল। সিঙ্গাপুরের ছাংগি বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছি। পাসপাের্টে এন্ট্রি ভিসা লাগানাে হবে। আমার সামনে পাঁচ-ছয়জন যাত্রী। ইমিগ্রেশন অফিসার বয়সে তরুণ। হঠাৎ কানে এলাে, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আমাদের লাইনের একেবারে সামনে দাঁড়ানাে এক বৃদ্ধ লােক উচ্চস্বরে ইমিগ্রেশন অফিসারকে রাগতস্বরে ভৎসনা করছেন। বিদেশে সচরাচর কেউ উচ্চস্বরে কথা বলে না, বিশেষ করে এ ধরনের স্থানে। বৃদ্ধের বয়স ষাটের নিচে বলে মনে হলাে ছ’ফুটের উপর উচ্চতা। প্যান্টের ওপর রঙিন হাফ হাতা শার্ট। উপস্থিত সবাই হতচকিত। অনেকের মতাে আমিও আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। বৃদ্ধ বাস্তবিকই রাগান্বিত। ইমিগ্রেশন অফিসারকে বলছেন, পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর যে দেশ তার নাম হাঙ্গেরি। আর আপনি বলছেন আপনি হাঙ্গেরি চেনেন না? তরুণ অফিসারটি হয়তাে তার স্বল্প চাকরি জীবনে কখনও হাঙ্গেরিয় পাসপাের্ট হ্যান্ডেল করেননি। তা তাে হতেই পারে। কিন্তু সে কথাটি তরুণ অফিসারটি যেভাবে উপস্থাপন করেছেন তা হাঙ্গেরিয় এ বৃদ্ধকে আহত করেছে দারুণভাবে। বহু রক্ত, বহু কষ্ট করেছে হাঙ্গেরিয়রা তাদের স্বাধীনতার জন্য। সে ইতিহাস দীর্থ, সে ইতিহাস নিদারুণ কষ্টের। তারা সােভিয়েত ইউনিয়নের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য সাহায্য চেয়েছে জাতিসংঘের এবং পশ্চিমা দেশগুলাের কাছে। তখন সবাই নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। সােভিয়েত ট্যাঙ্ক রাজধানী বুদাপেস্টে ঢুকে যায় ১৯৫৬’র ২৪ অক্টোবর। একই বছর ৩ নভেম্বর সােভিয়েত বিশাল ট্যাঙ্ক বাহিনী হাঙ্গেরির সব গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােতে কর্তৃত্ব স্থাপন করে এবং ট্যাঙ্ক বাহিনী দিয়ে হাঙ্গেরির সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। সে হাঙ্গেরি ১৯৯৪-এ সার্বভৌম রাষ্ট্র। পৃথিবী হাঙ্গেরিয়দের স্বাধীনতাস্পৃহা আর আত্মত্যাগের কথা খুব কমই জানে। আজকের এই বৃদ্ধ সেই স্মৃতি বহন করে আছেন। ইমরে নাগি, গেরাে, কাদার নামের তাদের নিজেদের নেতারা সােভিয়েত ইউনিয়নের দালালি করেছে। সেখানে বসে সােভিয়েত মদদপুষ্ট তাবেদার সরকার গঠন করেছে। সােভিয়েত সাঁজোয়া যানে চড়ে বুদাপেস্টে ফিরেছে, নিজ দেশের মুক্তিকামী ও স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের ওপর ট্যাঙ্ক চালিয়েছে। এ বৃদ্ধের গর্ব তার দেশের স্বাধীনতাকামী আপামর মানুষ আর অপার নৈসর্গিক সৌন্দর্য। তার গভীর অনুভূতিতে অল্পতে আঘাত তাে লাগবেই এবং স্বাভাবিকভাবেই। অতল আবেগ থেকে উৎসারিত বৃদ্ধের এ অহংবােধ কতটা যৌক্তিক তা আপাত গুরুত্বের নয় ভিনদেশীদের কাছে। হঠাৎ করেই নিজের মধ্যে প্রচণ্ড ঝাকুনি খেলাম। তাই তাে বিদেশের মাটিতে আমার প্রিয় বাংলাদেশকে কী পরিচয়ে পরিচিত করবাে? ১৯৮৩ সালে চীনের বেইজিং ভাষা ও সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষার ওপর লেখাপড়া করছিলাম।
আলাপকালে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরাসি ভাষার ছাত্র ওয়াং হুই নামের এক চীনা যুবক আমাকে চীনা ভাষায় প্রশ্ন করলাে, “তােমরা তােমাদের প্রেসিডেন্টদের মেরে ফেলাে কেন?” প্রশ্নটির উত্তর আছে কিন্তু সে প্রশ্নের সঠিক উত্তর আদতেই আমি জানি না। যদিও আমি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করি, বিরােধ যাই-ই হােক হত্যা তার সমাধান কোনােভাবেই হতে পারে না। কিন্তু প্রশ্ন শুনে আমি লজ্জায় মরে যাই। আমার ভেতরের লজ্জা কিছুটা হয়তাে আমার চেহারায় এসে গিয়েছিল। উত্তরের জন্য মুহূর্ত অপেক্ষা না করে বুদ্ধিমান ছেলে ওয়াং প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আমাকে নিদারুণ লজ্জা থেকে উদ্ধার করলাে। বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার Jean (Morris Eugis Clement) Koctou T EGA, “If I love anything more than my motherland that is my mothertongue. And if I love anything more than France that is French’। আমরা বাংলাদেশীরা বাহান্নোয় বাংলা ভাষার জন্য এবং একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলাম। এ অহঙ্কার। গােটা বিশ্বে শুধু আমাদের, বাংলাদেশীদের। মাতৃভাষা ও মাতৃভূমির জন্য যুগপৎ এমন অমিয় দরদ পৃথিবীর আর কোনাে জাতি দেখাতে পারেনি বা দেখানাের সুযােগ। পায়নি। দারিদ্র্য, দুর্নীতি আর হীনমন্যতা যেন আমাদের প্রশস্ত বুককে সঙ্কুচিত না করে ফেলে। বাদলা দিন কোন জাতির ছিলাে না? নষ্ট ডিম তাে কিছু থাকতেই পারে। কিন্তু তাতে ভবিষ্যৎ কালিমাময় হবে কেন? এতাে রক্ত দিয়ে আমাদের সন্তানদের যে স্বাধীনতা এনে দিয়ে গেলাম সে স্বাধীনতা তারা আরও সংহত করবে, জাতিকে এগিয়ে নেবে। পাকিস্তান-ভারত বা আমেরিকা-চীনপন্থী হওয়ার জন্য বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। মরতে যদি হয়ই তবে আমরা চৌদ্দ কোটি মানুষ দু’পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে লড়ে মরবাে। হাঁটুর ওপর ভর করে বাঁচবাে না, সে বাঁচা যত স্বাচ্ছন্দ্যেরই হােক না কেন। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের কার্ডিফে আমাদের ছেলেরা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলকে হারিয়ে দিলে মধ্যরাতে ঢাকার। রাস্তায় আনন্দ মিছিল বের হয়েছিলাে। সে মিছিলের একটাই স্লোগান-বাংলাদেশ’ বাংলাদেশ”।
হাতে নানা আকারের বাংলাদেশের পতাকা। গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। চোখের নােনাজলের এক ধরনের বৈপরীত্য আছে-কষ্টেও বের হয়, আনন্দেও। অন্তর্গত এক আনন্দে আমার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলাে। মুক্তিযুদ্ধে নিদারুণ কষ্ট, অন্তহীন অভাব আর স্বাধীনতার আকাক্ষা নিয়ে আমরা পাকিস্তানি দানব বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছি এমনই একটা জাতি দেখতে যারা এমনিভাবে বুক ফাটিয়ে চিৎকার করবে বাংলাদেশ বাংলাদেশ। মুহূর্তেই ৩৪ বছরের কষ্ট আর মনে। রইলাে না। মনে হলাে এই তাে আমার স্বপ্নের মিছিল। একের পর এক অর্জন আর দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে চলা। খুব ইচ্ছা হলাে আমার সন্তানতুল্য ছেলেদের সঙ্গে আমিও উল্লসিত হয়ে স্লোগান দিই, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। এক মাথা সাদা চুল। আর একগাল সাদা দাড়ি নিয়ে শেষতক আর ইচ্ছা পূরণ হলাে না। কবরে যাওয়ার আগে বড় সাধ রইল গৌরবে উদ্দীপ্ত, অহংকারে উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির এমন একটি বিশাল অহংকারের মিছিলে নাচার আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করার, যে মিছিলে শুধু একটি স্লোগানই থাকবে বাংলাদেশ, বাংলাদেশ’। যুদ্ধের মাঠে। আমাদের ছেলেদের প্রাণ বিলিয়ে দেয়ার দৃশ্যগুলাে ঘুরেফিরেই স্মৃতিতে ভর করে। স্বাধীনতার জন্য ওরা ছিল কত অকৃপণ। সিলেটের ধামাই চা বাগানে ক্যাডেট ইমদাদ যুদ্ধ করতে করতে শক্রর একদম কাছে চলে যায়। গায়ে একটা চাদর, বাম হাতে চামড়ার বেল্টে বাঁধা ঘড়ি। ল্যান্স নায়েক তারু মিয়া বলে, ‘স্যার আর এগুবেন , গুলি লাগবে।’ এমদাদ পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমি থেকে পালিয়ে এসেছে যুদ্ধ করবে বলে। এমদাদ জবাব দেয়, তারু, যুদ্ধ তাে আমাদের জন্য করছি না। যুদ্ধ করছি আমাদের সন্তানদের জন্য, যেন ওরা স্বাধীন দেশে স্বাধীনভাবে সুখে। থাকতে পারে।’ এটাই ছিল এমদাদের শেষ কথা। একঝাঁক গুলি তার বুক ভেদ করে যায় ঠিক তক্ষুণি।
একটা গুলি তার বাম হাতে কজির নিচ দিয়ে ঢুকে চামড়ার বেল্ট ছিদ্র করে ঘড়ির ডায়ালের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। মানিকগঞ্জের ১৩ বছরের কিশাের টিটো। তার কমান্ডার নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর কাছে বারবার অনুরােধ করতাে, সে স্বাধীনতা দেখতে চায়। ১৪ ডিসেম্বর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে সাভারের জিরাববার কাছে বাচ্চুর নিষেধ সত্ত্বেও যােগ দেয় টিটো। শক্রর একঝাক গুলি টিটোর কিশাের নিস্পাপ দেহটি তিন/চার ফুট উঁচুতে তুলে ফেলে। বাঁচার কোনাে আশাই নেই। বাজুদের অবারিত অশ্রু উপেক্ষা করে টিটো বারবার বলতে থাকে, বাদু ভাই, আমি স্বাধীনতা দেখবাে। স্বাধীনতা যেন একটি মৃন্ময়ী বস্তু। বলতে বলতেই সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যায় টিটো। হা স্বাধীনতা! মুক্তিযুদ্ধের অগণন শহীদদের মধ্যে আমরা সাতজনকে দেশের সর্বোচ্চ বীরত্ব উপাধি, বীর শ্রেষ্ঠতে ভূষিত করেছি। সব শহীদের কবরের ঠিকানা আমরা জানি । জানা সম্ভবও না। সহযােদ্ধারা যারা তাদের যুদ্ধের মাঠে সমাহিত করেছেন তার। সঠিক অবস্থান আজ তাদেরও মনে নেই। তবে আমরা সাত বীর শ্রেষ্ঠর কবরের। ঠিকানা জানি। মতিউর রহমানকে পাকিস্তানের করাচির অদূরে মসরুর বিমান ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে গােসল ও জানাজা ছাড়া চরম অসম্মানের সঙ্গে সমাহিত করেছে পাকিস্তানিরা। রুহুল আমীনের কবর খুলনার রূপসা ঘাটের অপর পারে নদীর কিনারায় বাঁধানাে অবস্থায়, নদীভাঙনে যে কোনাে সময় বিলীন হয়ে যেতে পারে। নূর মােহাম্মদ শেখ যশােরের শার্শা থানার কাশিপুর গ্রামে শায়িত। রাঙ্গামাটি জেলার নানিয়ারচর থানার কাপ্তাই হ্রদের মধ্যে একখণ্ড উচু জমিতে সমাহিত মুন্সি আবদুর রউফ। বর্ষায় কবরটি প্রায় তলিয়ে যায় পানিতে। হামিদুর রহমানকে সমাহিত করা হয়েছিলাে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাশা এলাকায়। আমরা কয়েকজন ২০০৭ সালের ১১ ডিসেম্বর হামিদুরকে দেশে আনি। তাকে সমাহিত করা হয় মিরপুর, বুদ্ধিজীবি কবরস্থানে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা থানার গঙ্গাসাগরের কাছে দরুইন গ্রামে যেখানে শহীদ হয়েছিলেন সেখানেই শায়িত মােস্তফা কামাল। মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি শহীদ হলে যেনাে তার প্রিয় সেক্টর কমান্ডার মেজর নাজমুল হকের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। তার ইচ্ছানুযায়ী চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার সােনামসজিদ কম্পাউন্ডে মেজর নাজমুল হকের পাশে তিনি চিরদ্রিায় শায়িত।
বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ বাংলাদেশে আনা হয়েছে। অতি আনন্দের কথা। সে অসম সাহসী বৈমানিক দুই দুগ্ধপােষ্য শিশু এবং প্রিয়তমা স্ত্রীকে অনিশ্চিত নিয়তির কাছে ন্যস্ত করে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তিনি তিন যুগ পর আপন দেশে এসেছেন। তিনিও শায়িত মিরপুর, বুদ্ধিজীবী কবর স্থানে। বাকি পাঁচজন বীরশ্রেষ্ঠ শায়িত দেশের বিভিন্ন এলাকায়। সে এলাকাগুলাে দুর্গম। আমরা যেতে পারি না। রুহের মাগফেরাত কামনা করতে তাদের সমাধিতে যাওয়া অত্যাবশ্যক নয়। পৃথিবীর অপর প্রান্ত থেকেও তা করা যায়। তবুও সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ পাশাপাশি শায়িত থাক এবং সেটা হােক সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের ভেতর। আমরা সাধারণ মানুষ সহজেই তাদের কাছে যেতে পারবাে- ফাতেহা পড়বাে, জিয়ারত করবাে এবং ফুলের তােড়া রেখে শ্রদ্ধা জানাবাে। তারা হয়ে থাকবেন আমাদের অনন্তকালের গর্বের উৎস। মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি পােস্টার ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করুন, তারা আমাদেরই সন্তান। আজ আমরা পিতামহ হয়ে গেছি। সহযােদ্ধা অনেকেই আজ আর নেই। আজ আবারও আমাদের পুত্র, পৌত্র এবং অনাগত প্রপৌত্রদের সাহায্য চাই। তােমরা দেখিয়ে দিও বিশ্বকে- এই বাংলা কেবল বীরদের জন্মই দেয়নি, তাদের সম্মানও করতে জানে।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)