You dont have javascript enabled! Please enable it!

আদিগন্তের সৈনিক শহীদ মেজর নাজমুল হক

একাত্তরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাপ্তাহিক Newsweek এর রণাঙ্গণ সংবাদদাতা Milan J. Cubic স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধরত এক মেজর নাজমুল হকের খোজে দিনাজপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকা ঘুরে ফিরেছেন। ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর থেকে দুই মাইল বাংলাদেশের ভিতর নওগাঁর সাপাহার এলাকায় দেখা পেলেন মেজর নাজমুল হকের তার সহযােদ্ধাদের সমেত। তিনি কয়েক দিন কাটালেন মেজর নাজমুল হকের সঙ্গে, ঘুরলেন শত মাইল, কথা। বললেন বহু লােকের সাথে। কথা হয় একুশ বছর বয়স্ক মেজর নাজমুলের প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা শাহ আবদুল খালেকের সাথে। গাইবান্ধায় কথা হয় এক হাইস্কুল। ছাত্রের সাথে “আমি শরণার্থী হতে চাই না। আমার দেশ চরম সংকটে। আমার কর্তব্য যুদ্ধ করা, পালিয়ে যাওয়া নয়।” আরেক প্রৌঢ়ের ১৭ এবং ২১ বছরের দুই ছেলে গেছে মুক্তিযুদ্ধে। সে আনন্দের সাথে জানায় যে সে ছেলেদের জন্য গর্বিত। তিনি বলেন, ভেড়ার মতাে জবাই হবার চেয়ে রাইফেল হাতে মরা ভালাে। নাতিদীর্ঘ এই প্রতিবেদনটি ছাপা হয় Newsweek এর ১০ মে ১৯৭১ সংখ্যায়। যখন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়নি তখন মেজর নাজমুলের যুদ্ধ পৌছে যায় দেশান্তরে। | নতুন পােস্টিং-এ মেজর নাজমুল হক যােগ দেন ৭ উইং ইপিআর, নওগাঁয়। একাত্তবের মার্চের প্রথম সপ্তাহ নিজের কালাে রঙের মরিস মাইনর গাড়িতে স্ত্রী, দুই শিশু কন্যা সুরভি (২ বছর) এবং শিউলিকে (১১ মাস) নিয়ে ইউনিটে নওগা পৌছেন। পরিস্থিতির বিরূপ। অবাঙালি উইং কমান্ডার মেজর আকরাম ক্ষমতা হস্তান্তর করতে আগ্রহী নন। সামনে দুঃসময় ভেবে কমান্ড হারাতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ২৫শে মার্চের গণহত্যার খবর ৭ উইং নওগাঁয় পৌছে ২৬ শে মার্চ। বগুড়ায় ছিলাে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৯১ আইএপি (ইন্ডিপেনডেন্ট এমুনেশন প্লাটুন)। রংপুরে অবস্থিত ২৩ ব্রিগেডের যাবতীয় গোলাবারুদের রিজার্ভ এখানে রাখা হতাে। ১৫/১৬ লােকের এই প্লাটুনের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল সৈয়দপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। মেজর নাজমুল প্রথমে এই প্লাটুনের গােলাবারুদ যেনাে শত্রুর নিয়ন্ত্রণে না যায় তা নিশ্চিত করেন।

সীমিত এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি অফিসার ক্যাপ্টেন নূর নিহত হয়। ২৭ মার্চ রাজশাহীর জেলা প্রশাসক পুলিশ ওয়ারেলসে নওগাঁর ইপিআর এর কোনাে বাঙালিঅফিসারের সাথে কথা বলতে চান। মেজর নাজমুলের নির্দেশে ক্যাপ্টেন গিয়াস কথা বলেন। জেলা প্রশাসক জানান যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের হত্যা করতে উদ্যত এবং তা যে কোনাে সময়। তিনি বাঙালি সৈনিকদের সাহায্য চান। ২৯ মার্চ সকালে নির্দেশক্রমে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হন ক্যাপ্টেন গিয়াস। একাত্তরের মার্চের উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এবং তখনকার রণকৌশলগত বিবেচনায় নওগাঁ কোনাে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিলাে না, এটা সত্যি। সে অর্থে মেজর নাজমুল হকের পক্ষে ৭ উইং ইপিআর নিয়ে বিদ্রোহ করা কঠিন কিছু ছিলাে না। কেননা নওগাঁর কাছাকাছি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোনাে উপস্থিতি ছিলাে না। নিকটস্থ উপস্থিতি ছিল রংপুরে। এ কারণে তিনি কোনাে রকম বাধা বা হস্তক্ষেপ ছাড়াই দূরবর্তী বিওপি থেকে সব ইপিআর সৈনিক নির্বিঘ্নে এনে জড়াে করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলাে যে গােটা দেশের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টসমূহের বা বাকি ইপিআর উইং-এর সাথে কোননারকম যােগাযোেগ ব্যতিরকে বিদ্রোহের একক সিদ্ধান্ত নেয়া। একটি সুসংগঠিত ও প্রতিষ্ঠিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি মাত্র ইপিআর উইং নিয়ে বিদ্রোহ করে স্বাধীনতার যুদ্ধ করা শুধু অযৌক্তিকই ছিল না, অকল্পনীয়ও ছিল।  ৪ এপ্রিল ১৯৭১ হবিগঞ্জের চা বাগানের। ম্যানেজার বাংলাতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর মেজর নাজমুল হক চাকুরীরত এবং অবসরপ্রাপ্ত অফিসারদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রথম দিকনির্দেশনা আসে এ সম্মেলন থেকেই। এ সম্মেলন যখন অনুষ্ঠিত হয় তখনও গােটা দেশের সম্যক পরিস্থিতি অবগত হওয়া যায়নি। জানা সম্ভব হয়নি ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুরে, ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রামে, ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সৈয়দপুরে এবং ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কী অবস্থায় আছে। এ সম্মেলনে গােটা দেশকে কয়েকটি অঞ্চলে ভাগ করে কয়েকজন মেজরের ওপর কমান্ড করার দায়িত্ব অর্পন করা হয়; চট্টগ্রাম-নােয়াখালী : মেজর জিয়াউর রহমান; কুমিল্লা-ঢাকা : মেজর খালেদ মােশাররফ; সিলেট; মেজর কাজী মােহাম্মদ সফিউল্লাহ : যশাের-কুষ্টিয়া : মেজর আবু ওসমান চৌধুরী : দিনাজপুর-রাজশাহী : মেজর নাজমুল হক। ২৭শে সেপ্টেম্বর শিলিগুড়ি ৩৩ কোর সদর দপ্তরে কোর কমান্ডার লে. জেনারেল মােহন লাল থাপনের সভাপতিত্বে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একটি কনফারেন্স  অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় অফিসারদের সাথে মালদহ ফিরছিলেন মেজর নাজমুল হক ভিন্ন গাড়িতে। তার সামনে গাড়িতে ছিলেন ১০১ কমুনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং গিল। বৃষ্টির মধ্যে মেজর নাজমুলের জিপটি পাহাড়ের নিচে পড়ে যায়। তাৎক্ষণিক তার মৃত্যু হয়। জেনারেল গিল তার মৃতদেহ ও আহত ড্রাইভারকে উদ্ধার করেন। মেজর নাজমুল হক ছিলেন অনুকরণীয় একজন মানুষ। তিনি তার অধীনস্থ যােদ্ধাদের কাছ থেকে কখনাে নেতৃত্ব দাবী করেননি, তারাই তাকে নেতা বানিয়েছে যুদ্ধের মাঠে। তরঙ্গপুরে ছিলাে সেক্টর সদর দপ্তর। তিনি সাধারণ যােদ্ধাদের সাথে থাকতেন, খেতেনও তাদের খাবার। মালদহে থাকতেন তার স্ত্রী ও দুই দুগ্ধপােষ্য কন্যা। কদাচিৎ তিনি রাত কাটিয়েছেন পরিবারের সাথে। গেলেও কয়েক ঘণ্টা। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (বীর শ্রেষ্ঠ) পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মেজর নাজমুল হকের সাথে যােগ দেন। গভীর শ্রদ্ধাবােধ ছিলাে তার মেজর নাজমুলের প্রতি। সে শ্রদ্ধাবােধ থেকেই মেজর নাজমুলকে সােনামসজিদে দাফন করে নাজমুল ভাবীকে বলেছিলেন, ভাবী আমি যদি যুদ্ধে মারা যাই তাহলে স্যারের সাথে আমাকে কবর দেবেন। আমাদের এই আসা তাে যাবার জন্যই। কিন্তু মেজর নাজমুল হকের চলে যাওয়া একদমই অন্যরকম। আর এ জন্যই তার স্মৃতি আজও আমাদের কপােল ভিজিয়ে দেয়। 

সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!