মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধভাষা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধটা আর দশটা যুদ্ধের মতাে নয়। একটা প্রচলিত সেনাবাহিনীর সৈনিকরা যুদ্ধের মাঠে সবই বিনামূল্যে পায়; এমনকি সিগারেটও। আমরা পুরানাে ধাচের একটা অস্ত্র এবং অত্যন্ত সীমিত সংখ্যক গােলাবারুদ নিয়ে যুদ্ধে যেতাম। এক/দুইজন ছাড়া কারাে কাছে তেমন কোনাে পয়সাও ছিল না। ধুমপায়ীরা পাতা কুড়িয়ে বিড়ি বানিয়ে খেয়েছে। একদিন দেখি ক্যাম্পে এক ছেলে মহা আনন্দে চিৎকার করে সবাইকে জানান দিচ্ছে ‘সেমি অটোমেটিক সিগারেট এনেছি’। চেয়ে দেখি ভারতীয় ছােট ফিল্টারের কী এক নামের সিগারেট। তখনকার দিনে বড় ফিল্টারযুক্ত সিগারেট ছিল না বললেই চলে। সেমি অটোমেটিক’ শব্দ দুটি অস্ত্র সম্পর্কিত ভাষা। সিগারেটের ছােট ফিল্টার বুঝাতে সে ভাষা চলে এসেছে মুখে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে কথা এবং ছাপার ভাষায় যুদ্ধে ব্যবহৃত বহু শব্দ ব্যবহারে চলে এসেছে। সব ভাষাই অন্য ভাষা থেকে শব্দ গ্রহণ করে সমৃদ্ধ হয়। কেবল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশের বাংলা ভাষায় যতাে শব্দ অর্ন্তভুক্ত হয়েছে কোনাে একক সময়ে এতাে শব্দ বাংলা ভাষায় আর আসেনি।
নতুন এই শব্দাবলীর সিংহভাগই এসেছে ইংরেজী ভাষা থেকে তন্মধ্যে কিছু শব্দ স্বাধীনতা পূর্বেও ব্যবহৃত হতাে কিন্তু ব্যাপকভাবে নয়। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে ব্যবহারিক অর্থ। পরিবর্তন হয়েছে যেমন, রেশন। স্বাধীনতার পূর্বেও রেশনের মাধ্যমে খাদ্য সামগ্রী তুলনামূলক কম মূল্যে সরকারের পক্ষ থেকে বিক্রি করা হতাে। যুদ্ধের মাঠে। রেশনের ব্যবস্থা এবং গুরুত্বই ছিল ভিন্ন। অবয়ব ছােট রাখার জন্য নিচের শব্দাবলীর ব্যাখ্যা দেয়া থেকে বিরত রইলাম। | রণকৌশল সম্পর্কীয় : এ্যাটাক, এ্যাডভান্স, ডিফেন্স, উইথড্রল, রেইড, এম্বুশ, সেন্ট্রি, রেকি, রেকি পেট্রল, ফাইটিং পেট্রল, কাট অফ পার্টি, পাসওয়ার্ড, ওপি, ট্রেঞ্চ, বাঙ্কার, স্ট্যান্ড টু, স্পটার, সাইন পেস্টিং, গাইড, ইনফরমার, কাউন্টার, এ্যাটাক, রিইনফোর্সমেন্ট, সারপ্রাইজ, স্কেচ, কমান্ড পােস্ট, হাইড আউট, ইনডাকশন, ইনফিলট্রেশন, কনভয়। বিস্ফোরক সম্পর্কিত : এন্টি-ট্যাঙ্ক মাইন, এন্টি-পারসােনাল মাইন, প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, জেলেটিন এক্সপ্লোসিভ, জিসি স্ল্যাব, টিএনটি স্ল্যাব, প্রেসার সুইচ, রিলিজ সুইজ, বি-হাইভ চার্জ, প্লেটার চার্জ, প্রেসার চার্জ, কাটিং চার্জ, সেফটি ফিউজ, পাইমার কর্ড, কর্ডেক্স, ডেটোনেটর, মাইন ফিল্ড, বুবি ট্র্যাপ।
অস্ত্র /গুলি সম্পর্কিত : রাইফেল (এসএলআর, থি-নট-থ্রি, চাইনিজ), এসএমজি, এলএমজি, এমএমজি, এমজি, এসএমসি, স্টেন, এ্যামুনেশন, শেল (মর্টার এবং আর্টিলারি), হ্যান্ড গ্রেনেড, স্লোক গ্রেনেড, ফসফরাস গ্রেনেড, এনারগা গ্রেনেড, মর্টার (২ ইঞ্চি, ৬০ মি.মি., ৩ ইঞ্চি, ৮১ মি.মি. ১২০ মি.মি) আর আর (৭৫ মি.মি. এবং ১০৫ মি.মি.) বেয়ােনেট, জিএফ রাইফেল, সিগন্যাল/ভেরিলাইট পিস্তল, রিভলবার, সাইট। নিয়ােগ বিষয়ক : সিও, টুআইসি, এ্যাডজুটেন্ট, কোয়াটার মাস্টার, কোম্পানি হাবিলদার মেজর (সিএইচএম), সেকশন/প্লাটুন/কোম্পানি কমান্ডার, কমান্ডার, বিএম, ডিকিউ সেক্টর কমান্ডার, সাব-সেক্টর কমান্ডার। | সরঞ্জাম বিষয়ক : ওয়ারলেস সেট, ফিল্ড টেলিফোন, টেন্ট (তাবু), হ্যাভারসেক, পিঠটু, পাঞ্জি, বাইনােকুলার, কম্পাস, বুট, পিটি সু, জঙ্গল বুট। গুলিবর্ষণ সংক্রান্ত : ফায়ারিং পজিশন (স্ট্যান্ডিং পজিশন, হিপ পজিশন, সিটিং পজিশন, লায়িং পজিশন) কভারিং ফায়ার, ফিক্সড লাইন, সিংগেল শট, বা ফায়ার, (ভুল করে ব্রাশ ফায়ার হিসেবে অধিক পরিচিত), রেঞ্জ। বিবিধ : লঙ্গর, ওস্তাদ, রেশন, সাপ্লাই, এমআই রুম, ফার্স্ট এইড, দরবার, ব্যারাক, কুক হাউজ। বাজার, পাজামা, গুরু ইত্যাদি বহু বাংলা শব্দ ইংরেজি ভাষায় এখন ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি চীনা ভাষায়ও বহু ইংরেজি শব্দ প্রচলিত, যেমন থাংখা (ট্যাংক), শাফা (সােফা), লিট্রি (লিচি বা লিচু), মাংগােয়া (ম্যাংগাে বা আম), লাইট। (রাডার)। বর্জনের মাধ্যমে নয় গ্রহণের মাধ্যমেই পৃথিবীর সব ভাষা সমৃদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় অর্জন আমাদের স্বাধীনতা। একই সাথে আমাদের ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে শব্দাবলী সংযােজনও অনুল্লেখযােগ্য নয়।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)