You dont have javascript enabled! Please enable it! বাবুলের অগস্ত্যযাত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

বাবুলের অগস্ত্যযাত্রা

একাত্তরে বাবুল ঢাকা কলেজের বিএ ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। দোহারা গড়ন, উচ্চতা পাঁচ ফুট দশ-এগারাে ইঞ্চি। প্রাণচঞ্চল এক যুবক। কিশাের বয়সে স্বপ্ন ছিল জঙ্গিবিমানের বৈমানিক হওয়ার। আর কৈশোের তাে স্বপ্ন দেখার সময়।  একাত্তরের ২৭ মার্চ। ঢাকা থেকে বাবুলরা সপরিবারে চলে যায় গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানার বানিয়ারা গ্রামে। বাবুলরা চার ভাই চার বােন। বড় সংসার। বড় বােনের কোলে কয়েক মাসের শিশু। পাকিস্তানি পশুরা বাংলার মানুষদের প্রাণান্তকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। শিশুর দুধ পাওয়া যাচ্ছে না। শিশুটির দিকে তাকালেই বাবুলের প্রাণটা হু হু করে। বাংলাদেশের কত দুগ্ধপােষ্য শিশু ক্ষুধায় কাদছে। কাঁদে বাবুলেরও মন। বাংলাদেশের শিশুদের খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে বাঙালিদের স্বাভাবিক জীবন। বড় বােনকে বলে, ‘আপা তাের বাচ্চাকে যারা কষ্ট দিচ্ছে আমি তাদের ছাড়বাে না।’ উনসত্তরের গণআন্দোলনে ২০শে জানুয়ারি ঢাকার মােহাম্মদপুরে ছাত্র আসাদ পাকিস্তানি পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। আমাদের বাবুল তখনাে আসাদের পাশে। তার শার্টে, হাতে, রুমালে রক্ত লাগে শহীদ আসাদের। সেদিন সন্ধ্যা ছয়টা থেকে কারফিউ। বাবুল বাসায় ফিরছে না। পরিবারের সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। বাবুল ফিরলাে ছ’টা বাজার কয়েক মিনিট আগে। বড় বােনের কাছে আসাদের রক্তেভেজা। নিজের শার্ট আর রুমালটা দিয়ে বলল, ‘আপা, এই রক্ত বড় পবিত্র। এই শার্ট আর রুমালটা তুই রেখে দে। এ পবিত্র রক্তে আমি গােসল করেছি। কী গৌরবের এই মৃত্যু। আজীবন সবাই তাদের স্মরণ করবে। তারা বেঁচে থাকবে চিরদিন। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যা আর নির্যাতন প্রচণ্ড দ্রোহী করে তােলে বাবুলকে। কৈশাের থেকে যে ছেলের প্রবল বাসনা দেশের জন্য কিছু করার এবার যেন সে সুযােগ এলাে। বাবুল তৈরি হয় যুদ্ধে যাওয়ার। মা মানেন । বাবুল পড়ে যায় কঠিন পরীক্ষায়। একদিকে মা অপরদিকে মাতৃভূমি। বাবুল বলে, ‘মা, তােমার তাে আরাে তিনটি ছেলে আছে। আমাকে তুমি দেশের জন্য ত্যাগ করতে পারাে না? মা নিচুপ। বাবুলও হাল ছাড়ে না।

একদিন অবসরে বাবুল মাকে গল্প শােনায়- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মানিতে রেডিওর মাধ্যমে দেশের সবল, সক্ষম যুবকদের সামরিক বাহিনীতে যােগ দেয়ার জন্য আহ্বান জানানাে হয়। দলে দলে যুবকরা রিক্রুটিং সেন্টারগুলােতে ভিড় জমাতে থাকে। এক বিধবা  মা তার একমাত্র ছেলেকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি হতে পাঠান। রিক্রুটমেন্টের সময় জিজ্ঞাসা করা হতাে সংসারে তাদের কে কে আছে। জবাবে সবাই বলতাে- বাবামা, ভাই-বােন ইত্যাদি আছে। এক ছেলে বললাে যে বাড়িতে শুধু তার মা আছে। তখন কর্তৃপক্ষ তাকে এই বলে ফেরত পাঠায় যে, মাকে দেখাশােনা করাই তার প্রধান দায়িত্ব। ভগ্নহৃদয়ে ছেলেটি বাসায় ফেরে। সামরিক বাহিনীতে টিকতে না পারার কারণ ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেন মা। ছেলের অভিমানী উত্তর, তার জন্য তুমিই দায়ী…। মা নিঃষ্পলক দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে মৌনভাবে সব শুনলেন। ধীর পায়ে ছেলের সামনে থেকে চলে গেলেন পাশের ঘরে। নিজের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে গুলি করলেন। মাকে গল্পটি শুনিয়ে বাবুল প্রশ্ন করে, ‘মা তুমি ওই রকম মা হতে পারাে না? মা এ পাগল। ছেলেকে নিয়ে ধন্দে পড়ে যান। বাবুলের লক্ষ্য স্থির। কদিন পর কাউকে কিছু না বলেই পালিয়ে যুদ্ধে চলে যাচ্ছিল বাবুল। ধরা পড়ে যায় মা’র কাছে। বাবুল মাকে বােঝায়-মা, তুমি তাে সবই দেখছে পাকিস্তানিদের বর্বরতা, অত্যাচার, নারীদের ওপর নির্যাতন। এটা কি সহ্য করা যায়? তােমার তাে চার মেয়ে। তাদের ওপর নির্যাতন হলে তুমি কী করতে? আমি তাে সেই প্রতিশোেধই নিতে যাচ্ছি। ছেলের কথা শুনে মা’র কপােল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। জবাবহীন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। বাবুল চলে যায়। আর পিছনে তাকায় না। পিছনে ফিরলেই মা। মা মানে অন্তহীন মায়া। মার মায়ার শক্ত আঁটুনি অতিক্রম তাকে করতেই হবে, লাখাে মায়ের মাতৃভূমি যে তাকে ডাকছে।  বাবুল উপস্থিত হয় ২ নম্বর সেক্টর সদর দফতর, মতিনগরে মে মাসের মাঝামাঝি, সঙ্গে জসিম, আমান, মহসীন এবং আরাে ক’জন। মতিনগরে ১নং প্লাটুনে এদের স্থান হয়। প্রশিক্ষণ শুরু হয় এখানেই। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে সেক্টর সদর দফতর স্থানান্তরিত হয় মেলঘারে। ট্রেনিয়ের কষ্ট সহ্য হয় না।

খাবারের অভাব। শুধু মােটা চালের বরাদ্দ করা অল্প কিছু ভাত, সামান্য লবণ বা একটা কাঁচামরিচও নেই। বাবুল সবাইকে বােঝায় কষ্ট স্বীকার করতে, স্বাধীনতা কষ্ট ছাড়া আসে না। নিজের সামান্য টাকা থেকে সহযােদ্ধাদের কাপড় বানিয়ে, টাকা দিয়ে সাহায্য করে। কিছুদিন পর সেনাবাহিনীতে অফিসার নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১, ২ এবং ৩ নম্বর সেক্টর থেকে ৩২ জন ক্যাডেট অফিসারকে নির্বাচন করে আগরতলায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর এ্যাসলন হেডকোয়ার্টার্সে একত্রিত করা হয়। বাবুল ছিল নির্বাচিতদের দলে। আরাে ছিল জামিল, সায়ীদ, দুই ভাই মিজানমুনিব, মমতাজ, ওয়াকার, সাদেক, দুই ভাই সেলিম-আনিস, জহির, হাসমি, সাদেক, মাসুদ, দুই ভাই আনিস-আতিক, মনসুরুল আমিন, শওকত, ফজলু, খালেদ, তাহের, মনজুর এবং দীদারসহ আরাে ন’জন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ি এবং ভুটান সীমান্তের কাছে মূর্তি নামের একটি ছােট ভারতীয় সেনানিবাসে এদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। প্রশিক্ষণ শুরু হয় ৩ জুলাই ১৯৭১। বাবুল প্রশিক্ষণ নিতে লাগলাে গুরুত্বের সঙ্গে। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে ৬১ জন ক্যাডেট প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বাবুল সবারই প্রিয়। মৃদুভাষী হলেও সদালাপী, হাসিমুখ, একজন আনসঙ্গ। বাবুল প্রশিক্ষণে সিরিয়াস, দুই-মাঠে ও পাঠে। এই সদাহাস্য চেহারার ভেতরজুড়ে আছে প্রচণ্ড এক দ্রোহ। পাশের বিছানায় থাকে বন্ধু তাহের (মেজর তাহের আহমেদ, বীর প্রতীক)। হাসিঠাট্টার মধ্যে হঠাৎ গম্ভীর বাবুল। তাহেরকে মাঝে মাঝে বলে, “দোস্ত, খরচা হয়ে যাবাে। ৯ অক্টোবর ১৯৭১ কমিশন লাভ করে বাবুল এবং তার আরেক কোর্সমেট সেকেন্ড লে, শাহরিয়ার হুদার পােস্টিং হয় ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ‘কে’ ফোর্স বিগ্রেডের বাকি ইউনিট ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ১ম ফিল্ড ব্যাটারি আর্টিলারি (মুজিব ব্যাটারি নামে সমধিক খ্যাত)। ৯ম ইস্ট বেঙ্গলের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা আখাউড়ার দক্ষিণ হতে কসবা পর্যন্ত। কসবার দক্ষিণের এলাকার দায়িত্ব ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের এক কোম্পানি পুরনাে সৈনিক, ইপিআর, মুজাহিদ, আনসার আর গণযােদ্ধাদের নিয়ে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৯ অক্টোবর ১৯৭১ গঠিত হয়।

সদর দফতর মন্তলি, অধিনায়ক মেজর মােহাম্মদ আইনউদ্দিন। বাবুল এখন সেকেন্ড লে, খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বি কোম্পানির কোম্পানি কমান্ডার।  ২২ অক্টোবর ভােররাতে ৯ ইস্ট বেঙ্গল কসবা এবং পুরান বাজার এলাকায় পাকিস্তানি অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। আক্রমণ সফল হয়। এ আক্রমণ পর্যবেক্ষণ করছিলেন ‘কে’ ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল খালেদ মােশাররফ। শত্রু আর্টিলারি গােলার স্প্রিন্টারের আঘাতে তিনি কপালে মারাত্মকভাবে আহত হন। মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার নিযুক্ত হন। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে মেজর সালেক ভারতীয়দের দ্বারা আদেশপ্রাপ্ত হয়ে মেজর আইনউদ্দিনকে নিয়ে যান ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ড পােস্টে আগরতলা-মেলাঘর রাস্তার পাশে। ভারতীয় অফিসাররা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। একটু পর আসেন ৪ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং, ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি মে, জেনারেল আরডি হিরা এবং ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার তুলি। ভারতীয় সেনানায়কদের তলব পেয়ে এখানে এসেছেন মেজর সালেক এবং মেজর আইনউদ্দিন, কী কাজের জন্য তাদের কিছুই বলা হয়নি। এবার তারা বললেন, ৯ম ইস্ট বেঙ্গল যেন দুই কোম্পানি দিয়ে ২২ নভেম্বর ভােরে চন্দ্রপুরের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান আক্রমণ করে দখল করে। কসবা এবং ইমামবাড়ি রেলস্টেশনের মাঝামাঝি পূর্বদিকে সীমান্তের কাছাকাছি চন্দ্রপুর। দুর্ভেদ্য পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান। কে ফোর্স কমান্ডার মেজর সালেক পরিকল্পনাটিকে অবাস্তব বলে প্রতিবাদ করেন। বাক-বিতণ্ডা চলতে থাকে। বিগ্রেডিয়ার তুলির মুখে পাইপ, তার স্টাফ অফিসার ক্যাপ্টেনের হাতে ধরা এক বিরাট কুকুর। বেড়ানাে আর ফুর্তির মেজাজ। আত্মঘাতী এ আক্রমণ কোন বিবেচনায় পরিকল্পনা করা হলাে কোনাে ব্যাখ্যাই দিতে চাইলেন না বিগ্রেডিয়ার তুলি। বললেন, ‘তােমরা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছাে বলছে কিন্তু তােমরা তাে কনভেনশনাল যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত নও। সঙ্গে সঙ্গেই মেজর আইনউদ্দিনের চোখের সামনে ভেসে উঠলাে তার প্রিয় সৈনিকদের নিথর ও গুলিবিদ্ধ যন্ত্রণাকাতর চেহারা। কঠিন ক’টি শব্দ বেরিয়ে এলাে তার মুখ থেকে। জে, সগত সিং এবং জে, হিরার সামনেই বিগ্রেডিয়ার তুলিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, আপনি জীবনে কয়টা যুদ্ধ করেছেন। আমি আপনার চেয়ে বেশি যুদ্ধ করেছি’। কয়েক মুহুর্তের জন্য হঠাৎ মৌনতা।

ভারতীয় অফিসাররা হতবাক। মে, জেনারেল হিরা অভয় দিলেন এই বলে যে, এতে পরিমাণ আর্টিলারি শেলিং শক্রর অবস্থানের ওপর করা হবে যে হেঁটে গেলেই শক্রর অবস্থান দখল হয়ে যাবে। মৃত্যু নিয়ে অন্যের ওপর সব রােমান্টিক আদেশ। মুক্তিযােদ্ধাদের যােগ্যতা নিয়ে ব্রিগেডিয়ার তুলি আরাে আপত্তিকর কথা বলেন। মেজর সালেক চৌধুরী প্রতিবাদই শুধু করেননি সামরিক বাহিনীতে যা অযাচিত তেমনও বেশ কিছু কড়া কথা শােনালেন। যদিও জানতেন যে তারা অন্যের বাড়িতে জায়গীর আছেন। জায়গীর থাকলে সীমাবদ্ধতা নিয়েই থাকতে হয়। ঠিক হলাে ব্রিগেডিয়ার তুলি ৭৩ মাউন্টেন ব্রিগেডের ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানিও ৯ম বেঙ্গলের দুই কোম্পানির সঙ্গে আক্রমণে যাবে। ১৯ পাঞ্জাবের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল কুলিও আদেশ শুনলেন। আক্রমণের সময় ২১ নভেম্বর ভাের তিনটা। আক্রমণ শুরু হলাে। ভারতীয় আর্টিলারি আক্রমণের পনের মিনিট আগে থেকেই পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের কতটুকু ক্ষতি হলাে তার কিছুই বােঝা যাচ্ছে না। বােঝা গেলাে তখন যখন আমাদের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই শক্রর সব অবস্থান থেকে অবিশ্রান্ত ধারার গুলিবর্ষণ শুরু হলাে। এতে প্রমাণিত হলাে হালকা ওজনের ভারতীয় ৭৫ মি.মি. লাইট আর্টিলারির গােলা সংখ্যায় হাজার হাজার হলেও আটিলারি ফায়ারের প্রটেকশন নেয়া শক্রর ব্যাংকারগুলাের এতটুকু আস্তরও খসাতে পারেনি। একই সঙ্গে শুরু হলাে পাকিস্তানি আর্টিলারির গােলাবর্ষণ। | ৯ ইস্ট বেঙ্গলের বি কোম্পানি নিয়ে সেকেন্ড সে, লে, আজিজ বাম দিকে, সুবেদার রেজাউল করিম সি কোম্পানি নিয়ে ডান দিকে অবস্থান নেয় আক্রমণের জন্য। লে, হারুন-অর-রশিদ আক্রমণের কমান্ডার হিসেবে দুই কোম্পানির মধ্যস্থলে থাকেন। আজিজের পরনে তার প্রিয় জিন্সের প্যান্ট, গায়ে ছাই রংয়ের টি-শার্ট। শহীদ হলেন একজন অফিসার, দুইজন জেসিও এবং ৩৩ জন সৈনিক। আহত হলেন আরাে ৪০ জন। হাসপাতালে মারা গেলেন আরাে দু’জন।

আমাদের শহীদ একমাত্র অফিসারটি বাবুল : সেকেন্ড লে, খন্দকার আজিজুল ইসলাম, বীর বিক্রম। ভারতীয় কোম্পানি কমান্ডার মেজর শ্ৰেভওয়েলসহ মারা যান আরাে ১২ জন। আহত হয় ১৫ জন। কল্পনাপ্রসূত ও অবাস্তব আক্রমণ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পরবর্তীতে বিগ্রেডিয়ার তুলিকে কোর্ট মাশাল করে চাকরিচ্যুত করা হয়। ব্রিগেডিয়ার তুলির ওপরস্থ দুই অফিসার মে. জেনারেল আরডি হিরা এবং লে, জেনারেল সগত সিং এ পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন দিয়েও গায়ে টোকাটি লাগতে দেননি, যেমন নিয়ম সাধারণত। বাবুল নিজেই বলতাে ডিম না ভাঙলে যেমন অমলেট হয় না, রক্ত না দিলেও তেমনি স্বাধীনতা আসে না। বাবুল তার। কোম্পানিসহ শক্রর প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছে যায়। শক্রর গুলিবৃষ্টিতে প্রচুর হতাহত হয় তার কোম্পানির। এক পর্যায়ে লুটিয়ে পড়েন নিজেও। আক্রমণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে যায় হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও কমান্ডারের অভাবে। শত্রুর অবস্থানে শায়িত থাকায় তখন বাবুলের মৃতদেহ আনা সম্ভব হয়নি। সেদিনই বিকেলে পাকিস্তানিরা গ্রামের লােকজনকে ডেকে বাবুলসহ সবার মৃতদেহ কবর দিতে বলে। যে এলাকায় শহীদ হয়েছিলেন তার পাশের গ্রাম লক্ষ্মীপুরে আজো সবাই চিরনিন্দ্রায়। স্বাধীনতার পর তার নামে ঢাকা সেনানিবাসের বীর উত্তম শহীদ আনােয়ারা গার্লস কলেজের পশ্চিম দিকের অফিসার আবাসিক এলাকার নাম রাখা হয় ‘আজিজ পল্লী’ (যদিও দশটি লাইন লেখা নেই তার কৃত্য আর বীরত্ব সম্বন্ধে)। বাবুলের কথাই সত্য হলাে। ও খরচ হয়ে গেছে। বাবুলদের খরচা হতে হয়। স্বাধীনতা খরিদ করতে এ খরচ করতেই হয়। আমরা সবাই দেশকে ভালােবাসি, কিন্তু বাবুলের মতাে দেশের জন্য নিজকে উৎসর্গ করার সৌভাগ্য হয় ক’জনের?  

সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)