মুক্তিযুদ্ধে কিশাের যােদ্ধারা
এক ইংরেজিতে যেমন ১৩ থেকে ১৯ বছরের ছেলেমেয়েদের বয়সকে ‘টিন-এজ বয়স বলা হয় অর্থাৎ যে সব, সংখ্যাসমূহের ইংরেজি বানানের শেষ অংশ Teen দিয়ে শেষ হয়-Thirteen থেকে Nineteen বাংলায় কিন্তু তেমনটি নয়। কিশাের বয়স বলতে আমরা ১৫-১৬ বয়সের ছেলেদের বুঝি। ১৬ থেকে ১৯ বছরের ছেলেদের কিশাের বলি না, তাদের বলি তরুণ। তার উপরের বয়সের ছেলেদের বলি যুবক। এ লেখায় আমরা কিশাের-তরুণদের নিয়ে আলােচনা করব অর্থাৎ সেই ‘টিন-এজ’।
শুরুতেই সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের বয়সানুযায়ী একটি পরিসংখ্যান দেখা যাক (সব সংখ্যা যুক্তিনির্ভর অনুমান)। মােট মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ১,২০,০০০।
১. সেনাবাহিনী(৫টি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ান ছাড়াও অন্যান্য আর্মস, সার্ভিসেস, এস্টাবলিসমেন্ট ও সদর দপ্তরে কর্মরত সৈনিকসহ) ৭০০০
২. বিমান বাহিনী ৫০০
৩. নৌ বাহিনী ৫০০
৪, প্রাক্তন ইপিআর ১২০০০
৫. পুলিশ ১১০০০
৬. আনসার ও মুজাহিদ ৫০০০
৭. অবসরপ্রাপ্ত অথচ সক্ষম সেনা, নৌ ও বিমান সেনা ৪০০০
৮. পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে আসা সেনা ও বিমান সেনা। ২০০০
৪২,০০০ গণযােদ্ধাদের সংখ্যা-১,২০,০০০-৪২,০০০ = ৭৮,০০০। ৭৮,০০০ গণযােদ্ধার ৮৫% ছিলাে কিশাের ও তরুণ যােদ্ধা অর্থাৎ ৬৬,৩০০। একটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে ৪টি রাইফেল কোম্পানি এবং একটি হেডকোয়ার্টার কোম্পানি থাকে। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণযােদ্ধাদের দ্বারা আরেকটি রাইফেল কোম্পানি প্রত্যেক ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। প্রচলিত এ, বি, সি এবং ডি কোম্পানির সঙ্গে ‘ই’ কোম্পানি সংযুক্ত করা হয় যার ৮৫ শতাংশ ছিল ১৯ বছরের নিচের কিশাের যােদ্ধা। – ২৬ মার্চ ১৯৭১ যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন বাংলাদেশে ৫টি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন ছিল : ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানের খারিয়া সেনানিবাসে যাওয়ার আদেশ দেয়া হয়। পূর্ব থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির আগে সৈনিকদের ২ মাসের ‘প্রি এম্বারকেশন’ ছুটি দেয়া হতাে। সে অনুযায়ী ২৬ মার্চ ব্যাটালিয়নের অর্ধেক সৈনিক ছিল ছুটিতে। ৩০ মার্চ ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন যশাের সেনানিবাসে পাকিস্তানিদের দ্বারা আক্রান্ত হয় তখন তারা বাঁচার তাগিদে প্রতিরােধ গড়ে তােলে এবং পরবর্তীতে যুদ্ধ। করতে করতে সেনানিবাস ত্যাগ করে। বহু সৈনিক হতাহত হয়। মাত্র ১৮৮ জন চৌগাছায় একত্রিত হতে সক্ষম হয়। পরবর্তী সময়ে গণযােদ্ধাদের সৈনিক হিসেবে ভর্তি করে ৬ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ প্রদান করে সৈন্য সংখ্যা পূরণ করা হয়। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৭০ চট্টগ্রাম সেনানিবাসে গঠন করা হয় ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
জেনারেল হেডকোয়াটার্স, রাওয়ালপিণ্ডির নীতিমালা অনুযায়ী মােট ৮টি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের ৪টি থাকার কথা পূর্ব পাকিস্তানে এবং ৪টি পশ্চিম পাকিস্তানে। ১ম, ২য়, ৩য় এবং ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন পূর্ব পাকিস্তানে ছিল বলে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা সেনানিবাসে বদলির আদেশ জারি করা হয়। আদেশানুসারে অ্যাডভান্স পার্টি বা অগ্রগামী দল (১৫০ জন) ব্যাটালিয়নের ভারী অস্ত্রসহ পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায়। ২৬ মার্চের পর সৈন্য সংখ্যা পূরণ করা হয় গণযােদ্ধাদের ভর্তি করে। ২য়, ৩য় ও ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যথাক্রমে জয়দেবপুর, সৈয়দপুর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে বিদ্রোহ করে এবং যুদ্ধ করতে করতে নিরাপদ স্থানে সরে যায়। যুদ্ধের সময় সেপ্টেম্বরঅক্টোবর মাসে প্রধানত এই তরুণদের দিয়েই এবং অল্প কিছু পুরানাে সৈন্য দিয়ে গঠিত হয় ৯ম, ১০ম ও ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। ৩ আগস্ট। ময়মনসিংহ সীমান্তে নকশি বিওপিতে পাকিস্তানিদের শক্ত প্রতিরক্ষাব্যুহ। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি ক্যাপ্টেন আমীন আহম্মদ চৌধুরীর নেতৃত্বে শক্রর প্রতিরক্ষা অবস্থান দখল করার জন্য আক্রমণ রচনা করবে। আক্রমণ পরিচালনা করবেন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মেজর আবু জাফর মােহাম্মদ আমিনুল হক। আক্রমণের সময় রাত ৩টা ৪৫ মিনিট। দুই কোম্পানির মােট ৩০০ জনের মধ্যে দশজন পদাতিক সৈনিক, আটজন ইপিআর, তিনজন পুলিশ, বাকি সবাই সাতদিনের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রাম বাংলার অতি সাধারণ কিশাের, ছাত্র, জনতা-আমাদের গণযােদ্ধা।
পাকিস্তানিরা পরিকল্পিত এ প্রতিরক্ষার সামনে মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের আশংকায় মাইন ফিল্ড, সূঁচালাে বাঁশের কঞ্চি (পাঞ্জি), নিচু কাঁটাতারের বেড়া, উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে সুরক্ষিত করেছে। আক্রমণ স্থান (Forming Up Place) থেকে শত্রুর অবস্থানের (Objective) দূরত্ব প্রায় ৬০০ গজের মতাে। এর আগেও একবার শক্রর এই অবস্থানের ওপর আক্রমণ রচনা করে সফলতা লাভ করা। যায়নি। কাজেই এবারের আক্রমণের জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। ভারতীয় আর্টিলারি ফায়ার সাপাের্টেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়। আক্রমণের জন্য সবাই আক্রমণ স্থানে উপুড় হয়ে শুয়ে অপেক্ষা করছে। নির্দেশ পেলেই অস্ত্র ফায়ারিং পজিশনে নিয়ে ওঠে দাঁড়াবে। ঠিক ৩-৪৫ মিনিটে ক্যাপ্টেন আমীন আক্রমণপূর্ব গােলন্দাজ সহায়তা চেয়ে বেতার যন্ত্রে জোরে মার” শব্দদ্বয় ব্যবহার করলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় আমাদের গােলাবর্ষণ। এই শব্দদ্বয়ের অর্থ ছিল আর্টিলারি সমর্থন চাওয়া। আক্রমণের প্রথম বিপত্তি দেখা দিলাে তখনই। নিজেদের কয়েকটি গােলা ভুলে পড়ে আক্রমণ স্থানে-আক্রমণকারী যােদ্ধাদের উপর। অযাচিত এক ভয়াবহ বিপর্যয়। আহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিশৃঙ্খলাও দেখা দেয়। ছেলেরা সব হতবিহ্বল ও বিরক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে গােলাপড়া বন্ধ হলাে। পুনঃ সংগঠিত করা হল আক্রমণকারী যােদ্ধাদের। আক্রমণ শুরু হলাে। শক্রর আর্টিলারি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গর্জে উঠলাে। নির্ভীক যােদ্ধারা শত্রুর গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। নিজেদের আর্টিলারি ফায়ার শক্র প্রতিরক্ষায় তেমন কোনাে পরিবর্তন বা ধ্বংসই আনতে পারলাে না। পাকিস্তানিদের শক্ত এ প্রতিরক্ষায় বাংকারগুলাে আর্টিলারি ফায়ারে যেনাে ক্ষতি না হয় সেভাবে সুরক্ষিত করা হয়েছে। আমাদের হতাহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে, তবে আক্রমণকারী কিছু ছেলে এরই মধ্যে শত্রু অবস্থানে পৌছে গেছে। বাকিরা অনেকেই আটকে গেছে শত্রুর পোতা মাইন ফিল্ডে এবং কাঁটাতারের বেড়ায়। হতাহতের সংখ্যা বেড়ে এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে, আক্রমণে শত্রু অবস্থান দখলের সৈন্য সংখ্যা তখন আর নেই। আমীন তবুও আক্রমণ অব্যাহত রাখতে চেঁচিয়ে ছেলেদের মনােবল উঁচু রাখার চেষ্টা করছেন।
তিনি জানেন আর কিছু যােদ্ধা নিয়ে শত্রু অবস্থানে পৌছতে পারলেই জয় সম্ভব। শত্রুর পোঁতা সঁচালাে বাঁশের কঞ্চি অলক্ষ্যে আমীনের বাম পায়ে বিধে তিনি পড়ে গেলেন মাটিতে। এ পর্যায়ে আক্রমণ আর পরিকল্পিত রইলাে না। এ অবস্থায় এক শত্রুসেনা ক্যাপ্টেন আমীনকে বেয়নেট দিয়ে চার্জ করতে এগিয়ে আসে। পাশেই ছিল অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সালাম। শত্রুসেনা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুহূর্তেই সালাম তার ৩০৩ রাইফেলের মাথার বেয়নেট দিয়ে ওকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে ফেললাে। এক সুবেদার মেজরের ছেলে সালাম। বর্বর পাকিস্তানি পশুরা তার বাবা-মা, ভাই-বােনদের নির্মমভাবে তারই সামনে হত্যা করে। আপনজনদের হত্যার এই বিভীষিকা এই কিশােরকে করেছে এক প্রত্যয়ী যােদ্ধা। বহুদিন, বহুবার সালাম। ক্যাপ্টেন আমীনকে অনুরােধ করেছে- তাকে আক্রমণে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এক জীবনে কত কষ্টের ভার বহন করা যায়। বাবা-মা হারা এই ছােট ছেলেটির বুকে। কতাে গভীর ক্ষত, আমীন তা কিছুটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সালামকে বিভিন্নভাবে বুঝিয়ে আক্রমণ থেকে বিরত রাখতেন। কিন্তু কোনাে বাৎসল্যই সালামকে আটকিয়ে রাখতে পারেনি। পিছুটানের আর কিছুই ছিল না সালামের এই পৃথিবীতে। তার অন্তরে অপ্রতিরােধ্য প্রতিশােধস্পৃহা। আক্রমণের আগে সমবেত এলাকায় (Assembly Area) আমীন বিস্ময়ে লক্ষ্য করেন সালাম রাইফেল নিয়ে আক্রমণকারী দলে যােগ দিয়েছে। আমীনকে দেখেই অন্যান্য সৈনিকের আড়ালে নিজেকে লুকাবার চেষ্টা করছিলাে। পাছে ক্যাপ্টেন আমীন তাকে আক্রমণে যেতে দেন। আমীন সব দেখেও কিছু বলেননি। নির্বিকার থেকে সালামের ইচ্ছা পূরণের সম্মতি দিলেন।
বিচ্ছিন্নভাবে হলেও আক্রমণ এগিয়ে যাচ্ছে। শক্রর অবস্থানের প্রায় পাঁচ গজ কাছে এলে আমীনের ডান হাতের কনুইয়ে গুলি লাগে। আর এগােনাে সম্ভব নয়। শত্ৰু পিছিয়ে গিয়ে পুনঃসংগঠিত হয়ে প্রতি আক্রমণের (Counter Attack) প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাইড রােল করে আমীন তার অসাড় দেহ নিয়ে পশ্চাৎপসরণের চেষ্টা করছেন। ছােটখাটো গড়নের এবং খর্বকার দেহের ক্যাপ্টেন আমীনের দেহ থেকে অঝােরে রক্ত ঝরছে। শরীর হিম হয়ে আসছে দ্রুত। সালাম সেই থেকেই। আমীনের পাশে পাশে। হঠাৎ সালাম নিজের রাইফেল ফেলে নিহত এক যােদ্ধার পড়ে থাকা এলএমজি (হালকা মেশিনগান) তুলে নিয়ে ‘জয় বাংলা’ হুংকার দিয়ে গুলি করতে করতে শত্রুর অবস্থানের দিকে একাই দৌড়াতে শুরু করে। গুলি করছে। আর চিকার করছে। এই যুদ্ধের মাঠে গােলাগুলির প্রচণ্ড শব্দে কেউ শুনছে না। সালামকে আমীন শুনছে-সালাম চিল্কার করে বলছে, “তােরা আমার বাবা-মাভাই-বােনদের মেরেছিস, তােরা কি মনে করেছিস আমি তােদের এমনিতেই ছেড়ে দেব?’ এইটুকুন এই ছেলে সালামই কিছুক্ষণ আগে বেয়নেট দিয়ে শত্রুসেনাকে হত্যা করে ক্যাপ্টেন আমীনের প্রাণ বাঁচিয়েছে। রক্তস্নাত, নির্ভীক আমীন অতিকষ্টে ক্ষীণস্বরে ডাকলেন, ‘সালাম চলে এসাে, সালাম চলে এসাে’। সালামের জ্বক্ষেপ। নেই। হাতে এলএমজি, সামনে পাকিস্তানি পশু; আর ভাবনা নেই, আর ভয় নেই। এখনই তাে প্রতিশােধের সময়। সালাম আর ফেরেনি। প্রাণভরে, প্রাণ দিয়ে সালাম তার সব প্রতিশােধ নিয়েছে। সেপ্টেম্বর মাস। মেলাঘরের সদর দফতরে মেজর খালেদ, মেজর মতিন এবং ক্যাপ্টেন হায়দার কী নিয়ে আলাপ করছেন। আমাকে মেজর খালেদ ডেকে পাঠিয়েছেন কেন, আমি জানি না। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ফিল্ড টেলিফোন বেজে উঠলাে। মেজর খালেদ ফোন ধরলেন। বােধকরি মনােযােগ চলমান আলােচনায় থাকায় তিনি টেলিফোনের আলাপে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। কে টেলিফোন করেছে জানি না। জানা সম্ভবও ছিলাে না। ক’সেকেন্ডের কথা শুনে। খালেদ বললেন, সবাইকে চোখ বেঁধে রেখে দাও।’ এরপর ঘণ্টা দুয়েকের আলােচনা শেষে মেজর খালেদ ক্যাপ্টেন গফফারের সাব-সেক্টর সদর দফতর।
কোণাবন যাবেন। আমাকে বললেন গাড়িতে উঠতে। M-38 খােলা জিপের পেছনে উঠে বসলাম। গাড়ি মেইন আরপি (Regimental Police) চেকপোেস্ট পার হয়ে ১৫-২০ গজ পেরিয়ে গেছে। হঠাৎ খালেদ গাড়ি পেছাতে বললেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় ৮-৯ জন ১৪/১৫ বছরের কিশোের। খালেদ আরপি হাবিলদারের কাছে। জানতে চাইলেন, কেন এদের চোখ বেঁধে রাখা হয়েছে। আরপি হাবিলদার জানাল, ‘স্যার, আপনিই তাে এদের চোখ বেঁধে রাখতে বলেছেন।’ খালেদের এবার হয়তাে মনে পড়লাে; আদেশ দিলেন ওদের চোখ খুলে দিতে। জিজ্ঞাসা করলেন ওদের, ওরা কী চায়। মুহুর্তের মধ্যে সবগুলাে কিশাের ক্রোধে খালেদের ওপর ফেটে পড়লাে। এরা আর্মি চেনে না, এরা মেজর চেনে না, এরা সেক্টর কমান্ডার কী জানে তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “আপনি আমাদের চোখ বাঁধার হুকুম দেয়ার কে? আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে না দিলে আমরা অন্য জায়গায় যুদ্ধ করবাে। বাংলাদেশ কি একা আপনার?’ খালেদ হাসছেন। এ হাসির অর্থ আছে। এ হাসি আত্মবিশ্বাসের হাসি। এ হাসির অর্থ-এ প্রত্যয়ী জাতির যেভাবেই হােক, যতােদিনেই হােক যুদ্ধে। বিজয় অনিবার্য। এই কিশােরদের দিয়েই স্টুডেন্ট কোম্পানি এলাকায় সেদিনই সাময়িকভাবে ১৮০ পাউন্ড তাবু লাগিয়ে খালেদ তৈরি করলেন ‘ওয়াই প্লাটুন (Young Platoon)। ২১ পাউন্ড ওজনের ব্রিটিশ ৩০৩ ব্রাউনিং (এলএমজি) এরা। তুলতে পারতাে না, কিন্তু তারপরও এদের অসাধ্য এমন কিছুই ছিলাে না। যে কারণেই হােক খালেদ এবং হায়দারের স্নেহভাজন ছিলাম এবং সেই সুবাদে এদের। সঙ্গে কাজ করার, থাকার এবং ঘােরার সুযোেগ ছিলাে। দেখতাম এই কিশােরদের খালেদ পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের বাংকার দেখিয়ে বলতেন, যারা আমার সামনে শক্রর ওই বাংকারগুলাের ভেতর গ্রেনেড ফেলে আসতে পারবে তাদের জন্য পুরস্কার এই ঘড়ি’। ঘড়ি পুরস্কারের জন্য নয়, অদম্য সাহস আর কী প্রবল দেশাত্মবােধ ছিল এ কিশােরদের।
এ আদেশ শুনে প্রথম দিন খালেদকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। কিন্তু না। দিনের আলােয় আমাদের সবার সামনে পাকিস্তানি বাংকারগুলাে প্রকম্পিত করে ধুলার আঁধার বানিয়ে ফেললাে এরা। অশ্রুসিক্ত চোখে খালেদ ছেলেদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন। এ যেন এক পিতা তার সন্তানদের কাঁধে ওজন রেখে হাঁটতে শেখাচ্ছেন। মাত্রায় কে বড়, তার বিচারের কোনাে অবকাশ নেই। আমি ভাবি আর অবাক হই। একাত্তরের ওই কিশােরদের কীর্তি কি আসলেই সত্যি ছিল? বাছুর বয়স চেীদ্দ। বাবা-মা হারা, পিতামহও গত বাঙ্গুর। বাচ্চু লিকলিকে শরীর নিয়ে যুদ্ধ করে অত্যন্ত সাহসের সাথে। কখনাে মুখে রা নেই। তার কাজ শুধু হুকুম। তামিল করা এবং সাহসের সাথে যুদ্ধ করা। বুড়ি দাদির ভিক্ষার অন্নে লালিত বাচ্চু। সেবাদাসরা একে ঘুম থেকে তুলে তাদের প্রভুদের কাছে নিয়ে রাজাকারে ভর্তি করে দিয়ে আসে। বাচ্চু একদিন। নিজের রাইফেল আর ৫ রাউন্ড গুলি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা হবে বলে আমাদের কাছে চলে আসে। ১৯৭৬ সালে অক্ষরজ্ঞানহীন এই ছেলেটিকে একে ওকে অনুরােধ করে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (আমার ইউনটি) ভর্তি করে দিয়েছিলাম সুইপার হিসেবে। পরে শুনেছি বাদু চাকরিচ্যুত হয়েছে। ভালাে যুদ্ধ করতে পারাটাই যে ভালাে সুইপার হওয়ার পূর্বযােগ্যতা নয়, বাচ্চুকে বুঝিয়েছি। কিন্তু ছেলেটা বােধহয় কিছুই বােঝে না।
মন্দবাগ রেল স্টেশন আক্রমণ করছি। শত্রুর প্রায় সামনে থেকে আক্রমণ। রেল লাইনের পশ্চিম পার্শ্বে স্টেশন। আমরা আক্রমণ করবাে পূর্ব দিক থেকে। অর্থাৎ এক পর্যায়ে রেল লাইন আড়াআড়িভাবে পার হতে হবে। এমন আক্রমণে প্রচুর হতাহত হবে আমরা সবাই জানি, শুধু জানি না তারা কারা। সে মুহূর্তে পৃথিবীর সব মায়া ছিন্ন করতে হয়। | আক্রমণ এগিয়ে চলছে। শক্ররা বাংকারে সুরক্ষিত অবস্থায় আমাদের দেখে দেখে মুষলধারে গুলি করে চলেছে। রেল লাইনের উপরে কেবল উঠেছি হঠাৎ কে যেন দুহাত দিয়ে আমার কোমর জড়িয়ে ধরলাে। শক্রর একদম সামনে, রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে। নির্ঘাত মৃত্যুর মুখােমুখি। তাকিয়ে দেখি ১৪/১৫ বছরের এক কিশাের, কষ্ট করে তাকিয়ে বললাে, স্যার ডাক্তার ডাকেন আমি বাঁচবাে’। চেয়ে দেখি ওর নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে গেছে। ডাক্তার নেই, ডাকবাে কোথেকে। আমারও প্রতি সেকেন্ডের অংশভাগে মৃত্যুর সম্ভাবনা। নিশ্চিত মৃত্যু ছেলেটির। কাজেই আমি তার হাত খুলে এগিয়ে যেতে পারি। সাধ্যে কুলায় তবু সব কাজ করা যায় না। কেননা আমরা মানুষ। আমাদের বােধ আছে, উপলব্ধি আছে এবং চৈতন্য আছে। সেকেন্ডের ভাবনার মধ্যেই ছেলেটির হাত দুটি অসাড় হয়ে পড়ে গেলাে। আমি বাঁচলাম। মন্দবাগ রেল ষ্টেশন দখল হলাে। হতাশা আর বিষাদে একাত্তরের এই ছেলেরাই এখন প্রেরণা, অন্তত আমার এবং আমার মতাে আমাদের। যুদ্ধের মাঠে প্রাধান্য যৌবন আর তারুণ্যের। আমাদের কিশাের-তরুণ গণযােদ্ধারা।
মাত্র ৬ সপ্তাহের অতি সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেছে সংগঠিত, অভিজ্ঞ এবং প্রশিক্ষিত এক আধুনিক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। যুদ্ধের মাঠই ছিল তাদের প্রশিক্ষণ একাডেমী। শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে তারা উদ্ভাবন করেছে নতুন নতুন রণকৌশল। সেসব রণকৌশল নিয়ে অপ্রচলিত যুদ্ধ বিষয়ক কোনাে গবেষণা হয়নি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতেও। অথচ কতাে সাফল্য এসেছে তাদের সেই রণকৌশল প্রয়ােগের ফলে। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের নিয়মিত বাহিনী; এস ফোর্স, কে ফোর্স এবং জেড ফোর্সের ৮টি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন যুদ্ধ করেছে সীমান্ত এলাকায়। তারা বাংলাদেশের গভীর অভ্যন্তরে যুদ্ধ করেনি ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ এর আগে। সেটা অবশ্য যুদ্ধের স্ট্রাটেজির কারণে। এই গণযােদ্ধারাই, এই কিশাের-তরুণ যােদ্ধারাই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছে দেশের অভ্যন্তরে, মাও সে তুং গেরিলা সম্বন্ধে সেই বিখ্যাত উক্তি অনুসারে, দিন তােমাদের, রাত আমাদের রৌদ্র তােমাদের, বৃষ্টি আমাদের শহর তােমাদের, গ্রাম আমাদের। মােটা দাগের হিসেবে সব মিলিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের (নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনী) ৮০ শতাংশই ছিল কিশাের-তরুণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণ কিশােরতরুণদের সাহস, সাফল্য আর শৌর্যে মণ্ডিত । অজানা কাহিনী বাদ দিলেও জানা কাহিনীগুলােও লিখে শেষ করা প্রায় অসম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের অকুতােভয় সেই কিশাের-তরুণদের আমাদের অভিবাদন।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)