মুক্তিযুদ্ধে গণমানুষের ভূমিকা
আগ্নেয়গিরির অগ্নৎপাতে বর্ধিষ্ণু জনপদের ধ্বংসলীলা, উৎপীড়িত জনগণের প্রবল বিদ্রোহ বা মাতৃভূমির উপর বন্যবর্বর জাতির আক্রমণের মতাে বিরাট ঘটনা প্রত্যক্ষ করার সুযােগ যদি কেউ পায়, তবে তার উচিত যা কিছু দেখেছে লিখে রাখা। ইতিহাসের ভাষা লিপিবদ্ধ করার নৈপুণ্য যদি তার না থাকে, লেখনীর ব্যবহার থাকে অনায়ত্ত, তবে তার উচিত কোনাে অভিজ্ঞ লিপিকারের কাছে সে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করা। লিপিকার লিখে রেখে পৌত্রপ্রপৌত্রদের শিক্ষার নিমিত্তে তা অক্ষয় করে রাখবেন।
-ভ. ইয়ান, ‘চেঙ্গিস খা”
একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এ দেশের গণমানুষের অকুণ্ঠচিত্তের সমর্থন ও সার্বিক অংশগ্রহণের এক অনুপম দৃষ্টান্ত। এমন জনযুদ্ধ পৃথিবী আর দেখেনি। জনযুদ্ধের বহুমাত্রিকতায় সর্বোচ্চ ত্যাগের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন এ দেশের মাটিবর্তী মানুষ, অসাধারণ ঋজুতা নিয়ে। এই আমজনতাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক। অপরদিকে সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্যরা যারা প্রশস্ত বুকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। লড়েছেন তাদের কাহিনীও অনুপম অহংকারের। এ যুদ্ধ করেছে সাধারণ মানুষ। এমন সাধারণ হতে অসাধারণ গুণাবলির প্রয়ােজন। বস্তুত প্রায় এক লাখ বিশ। হাজার গণযােদ্ধা আর জনগণের সাথে মিশে পেশাদার সৈনিকরাও জনযুদ্ধের গণযােদ্ধাই হয়ে গিয়েছিলাে। এ লেখায় যখন মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি বলছি তখন আমি একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের কথাই কেবল বলছি। রাজনৈতিক বিবর্তন ছাড়া যুদ্ধ অনিবার্য হয় কোনাে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বকথা গণমানুষের বঞ্চনার ইতিহাস, Betsafeco 2167 261 Deprived Psychosis. স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রসঙ্গে বলতে বা লিখতে গেলে জনগণের ভূমিকা সম্বন্ধে সচরাচর বলা হয় তা হলাে- বাংলাদেশের ছাত্র, কৃষক, জনতা, পেশাজীবী শ্রেণীগােত্র নির্বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তারপর আলােচনার চরিত্র ক্রমাগত সীমিত হয়ে আসে অল্প কিছু রাজনৈতিক নেতা, কিছু সামরিক ব্যক্তিত্ব, কিছু বুদ্ধিজীবী এবং আরাে অল্প কিছু নির্বাচিত ব্যক্তির মধ্যে। সাড়ে সাত কোটি জনগণের জন্য বরাদ্দ রইল ওই একটি লাইন, কখনােবা একটি প্যারাগ্রাফ বড়জোর। ঐতিহাসিকরা গ্রহণের চেয়ে বর্জন করেন বেশি- অমলেশ ত্রিপাঠির এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। ইতিহাস লিখতে গিয়ে একজন ঐতিহাসিক সব ঘটনা তাে লিখতে পারেন না, যেসব ঘটনা তিনি ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক বলে বিবেচনা করেন তাই শুধু গ্রহণ করেন। এই পছন্দ-অপছন্দ নির্ভর করছে ঐতিহাসিকের মনন ও মনস্তত্বের ওপর। জনযুদ্ধের এসব গণযােদ্ধা ঐতিহাসিকদের গ্রহণ-বর্জনের যে ছাকনি, তার ভেতর দিয়ে বার বার নিচে পড়ে গেছে। তারা না পেরেছে নিজেদের কথা লিখতে, না পেরেছে ঐতিহাসিকদের কলমে বা কথায় উঠে আসতে। অল্পশিক্ষিত, অশিক্ষিত এবং সমাজের নিচুতলার এ যােদ্ধারা স্বাধীনতা উত্তরকালে নিজেরাও তাদের সেই লড়াইয়ের কথা কোথাও বলতে পারেনি, বলতে অনুরুদ্ধও হননি। এ সুযোেগ হরণ করে নিলাে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী ও সামরিক বাহিনীর কিছু মুক্তিযােদ্ধা।
একাত্তর এ জাতির সবচেয়ে স্মরণীয় সময় বেশিটাই গর্বের, যদিও গ্লানির অংশও একেবারে কম নয়। মার্চ-ডিসেম্বর সময়টা এ জাতির পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক কাল। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছেলে আলম নীলফামারীর ছাতনাইবালাপাড়ার যুদ্ধে হাতে, কোমরে, আটটি গুলিতে আহত হলাে। ভুরুঙ্গামারীর গেরস্তের কামলা ছেলে খালেক হাতিবান্ধার যুদ্ধে শক্রর অপ্রতিরােধ্য মেশিনগান পােস্টে গ্রেনেড ছুড়ে তা স্তব্ধ করে দিলেও নিজে মারাত্মক আহত অবস্থায় শক্রর হাতে ধরা পড়লাে এবং অমানুষিক নির্যাতনের পর নিহত হলাে। তিরিশের কোঠার। মদন থানার সলাজ চাষানী মিরাশের মা’র রক্তে স্বাধীনতার বান বইলাে-পাঁচজন সতীর্থ যােদ্ধার সাথে এক কোম্পানি শক্রর অগ্রাভিযান এবং নদী অতিক্রম ঠেকিয়ে। দিলাে-পাল্টে গেলাে মগড়া নদীর পানির রং শক্রর রক্তে লাল পানি বইল মগড়ায়। অন্যদিকে বহু বিদ্বান ব্যক্তি এ যুদ্ধে মাঠে নামতে পারেননি। পারেননি কারণ-এ যুদ্ধ কেবল বিদ্যা ও বুদ্ধির যুদ্ধ ছিলাে না। এ যুদ্ধ ছিলাে নিরেট দেশপ্রেম, বাঁধভাঙা সাহস আর সুতীব্র আবেগের একটি কঠিন সংমিশ্রন। কলমের কাজ অস্ত্র দিয়ে হয় না। তেমনি তার উল্টোটাও সত্য। আর যখন এই রক্তের ডাক এলাে তখন যুক্তি দেয়া হলাে- সবাই যদি রাইফেল হাতে যুদ্ধে যাবে, তবে এই বৃহত্তর সংগ্রামের মেধার জোগান আসবে কোখেকে। শেষমেষ রাইফেল হাতে নেবার দায়িত্ব পড়লাে এই আমজনতার ওপর। এরা অসাধারণভাবে সাধারণ। জনযুদ্ধের এরাই নায়ক-এরাই সেই গণযােদ্ধা। কুমিল্লার চান্দিনা থানার সামনের রাস্তাটা পশ্চিম দিকে শ’দেড়েক গজ গিয়ে মােড় নিয়ে পঁচিশ গজের মতাে গিয়েছে উত্তর দিকে। তারপরই পশ্চিম দিকে বাঁক নিয়ে চলে গেছে মাধাইয়া, ইলিয়টগঞ্জ হয়ে দাউদকান্দি। দ্বিতীয় মােড়ের লাগােয়া পূর্ব দিকে একজোড়া বাঁধানাে কবর। এখান থেকে পশ্চিম দিকের কয়েকশ’ গজ পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে বাজার, বাসস্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জসহ থানা সদরের যাবতীয় স্থাপনা। কবরগুলাের কাছেই রাস্তার উত্তরপার্শ্বে বিশাল কয়েকটি পাটগুদাম। আমরা খোজখবর দিয়ে নিশ্চিত হলাম চান্দিনা থানা থেকে পশ্চিম বাজার পেরিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অবধি পাকসেনাদের ছােট দল রাতে পেট্রোলিং করে। এদের অস্ত্র সাধারণত হাতে কিংবা স্লিং এর সাহায্যে কাঁধে ঝােলানাে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সাথে এ যাবত এদের কোনাে মােকাবেলা হয়নি। এ পেট্রোলিং তাই গা-ছাড়া। ধরণের নৈমিত্তিক কাজে রূপ নিয়েছে। এম্বুশের জন্য রণকৌশলগত বিবেচনায় সব দিক দিয়ে আদর্শ টার্গেট। আমরা এ পেট্রোল এম্বুশের পরিকল্পনা করলাম।
একহারা গড়নের লােক আব্বাস। উপরের পাটির মাঝখানের কয়েকটি দাত সবসময়ই উলঙ্গ থাকে। বর্ণ পরিচয়হীন এ লােকটি শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। সে মুক্তিযােদ্ধা নয়, যুদ্ধের কোনাে প্রথাগত প্রশিক্ষণও তার নেই। যুদ্ধের শুরু থেকেই সে আমাদের সাথে আছে। গায়ে শক্তি নেই, কিন্তু মনের শক্তি অফুরন্ত। যুদ্ধ সংক্রান্ত যে কোনাে কাজের জন্য সে একপায়ে খাড়া। বুঝশক্তি কম, বােধশক্তিও ভোতা। আব্বাসের সাথে আমাদের কোনাে পূর্বপরিচয় নেই। আমাদের সঙ্গে একটা কোষা নৌকা ছিলাে। নৌপথে রেকি বা যাতায়াতের জন্য আমরা এটাকে ব্যবহার করি। আব্বাস এ নৌকার মাঝি । আমাদের সঙ্গে থেকে থেকে আব্বাস আমাদেরই একজন হয়ে গেছে। আমাদের সব কাজেই তার সীমাহীন উৎসাহ। যেহেতু আমাদের কোনাে বেতার যােগাযােগ ছিল না, তাই খবর আদানপ্রদান করতে হতাে লােক মারফত। আব্বাস সেজন্যও অত্যন্ত কার্যকরী। বার্তাবাহক। শুধু বিশ্বাসযােগ্যতার কারণেই নয়, তার চলাচলের দ্রুততার জন্যও। ও হাঁটতে পারতাে না, দৌড়াবার মতাে ছিল তার ছন্দোবদ্ধ চলন। ক্ষুধা নেই, পিপাসা নেই- শ্রান্তিহীন এক কর্মী। লগি, বৈঠা, হাতিয়ার-তার দুটো হাত সবকিছুর জন্যই সই। একাত্তরের সেপ্টেম্বর। রাত সাড়ে বারােটার দিকে আমরা পাঁচজন পৌছলাম বাজারের উত্তর দিকে থেকে এসে। কবরগুলাের কাছে রাস্তার লাগােয়া উত্তর পাশে। শূন্য পাটের গুদামে রাস্তার দিকে মুখ করে অবস্থান নিলাম। ঘরের কিছু অংশ খুঁড়ে ফায়ার করার সুযােগ করতে হলাে। আব্বাসও আছে আমাদের সাথে। সবার কাছে এসএমসিসহ ২৮ রাউন্ড করে দুই ম্যাগাজিন ভর্তি গুলি। কঠোর নির্দেশ দেয়া আছে- আমি গুলি করার আগে কেউ গুলি করবে না এবং বন্ধ করতে বলা মাত্রই সবাই গুলি বদ্ধ করবে। আমাদের পশ্চাদপসরণের পথ এবং মিলনস্থান পূর্ব নির্ধারিত ছিলাে।
তবুও আমরা একেবারে নির্ভয়ে ছিলাম না। দালালদের গায়ে সাইনবোের্ড থাকে না। তাছাড়া ভেতরে পশু হলেও গড়ন, গঠন তাে মানুষেরই মতাে। রাত দু’টার কিছু বেশি বাজে। চাঁদনি রাত। নিশ্ৰুপ অপেক্ষা করছি। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি পাঁচজন পাকিস্তানি সৈন্য কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে গল্প করতে করতে থানার দিকে থেকে বাজারের দিকে আসছে। আব্বাস আমার পাশে। রাতের নিস্তব্ধতায় ওদের কথা পরিষ্কার শােনা যাচ্ছে। ওরা তখনাে প্রায় পনেরাে গজ দূরে। আমাদের সামনে এলে দূরত্ব হবে পাঁচ গজের কাছাকাছি। স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। একজন বলছে, ‘শালা, মুক্তিলােগ কিধার হ্যায়? উসকো পাতা নেহি মিলতা হ্যায়। আব্বাস উর্দু জানে না, অর্থ বােঝারও কথা নয়। শিশু হােক আর পশু হােক-আদর, স্নেহ, ঘৃণা, অবজ্ঞা, ভালােবাসা সবাই এসবের মর্ম বােঝে। হয়তাে তেমনই কিছু একটা বুঝলাে আব্বাস। আমার কোনাে অনুমতির অপেক্ষা না করেই বলে উঠলাে, স্যার, আমি পাতা মিলাইয়া দেই’-বলেই ফায়ার। এক লম্বা বান্টে বােধহয় এক ম্যাগাজিনের গুলি ওর শেষ হয়ে গেলাে। ক্ষণভঙ্গুর সেই মুহূর্তে আমাদের সময় নষ্ট করার সময় ছিলাে না। উপর্যুপরি কয়েক বাস্ট ফায়ার করে শুধু ওদের, আমাদের মাতৃভূমির উপরে চেপে বা মানুষের স্বরূপে কিছু অমানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করলাম। | পাকিস্তানিদের সঙ্গে মুরাদনগম হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের ভালাে ওঠাবসা এবং ঘনিষ্ট আলাপ পরিচয়। আমাদের সাথে কথা বলার প্রস্তাবে হ্যা বা না কিছু বললেও পরে প্রাণের ভয়ে নিজ উদ্যোগে আমাদের সঙ্গে খােলা মনে আলাপ করলেন। মুরাদনগর-কোম্পানীগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানিদের অবস্থান ও সংখ্যা দ্রলােক সঠিক এবং নির্ভুলভাবে আমাদের দিতে লাগলেন। তার দেয়া খবরাখবরের ভিত্তিতে অপারেশন পরিকল্পনার তথ্য সংগ্রহের জন্য আব্বাস ও আমি নৌকা নিয়ে মুরাদনগর থানা এলাকায় শক্ত অবস্থান রেকি করতে রওনা হলাম। নৌকা দুরে কোথাও রেখে বেশ কিছু হাঁটাহাটি আছে। চার/পাঁচ ফুট পানির উপর মসৃন আঁচলের মতাে ধানক্ষেত।
নৌকার পাটাতনের নিচে বাঁশের মাচার উপর আমাদের হাতিয়ার। আমরা মুরাদনগর থানার উত্তরে করিমপুর গ্রামের কাছে আসতেই রাস্তার উপর জড়াে হওয়া কিছু লােক আমাদেন নৌকা পাড়ে ভেড়াতে বললাে। আব্বাস সাথে সাথেই নৌকা থামিয়ে দিল। পরক্ষণেই দেখলাম কিছু লােক বর্শা, কোচ, রামদা নিয়ে আমাদের নৌকা ধরবার জন্য এগিয়ে আসছে। আব্বাস বললাে স্যার, শালাগাে সব লাশ ফালাইয়া দেই?’ আমি ধমক দিয়ে বললাম, তুমি নৌকা ঘােরাও।’ আব্বাস তবুও এসএমসি বের করে পাটাতনের উপর রাখলাে। নৌকা ঘুরিয়ে লগি বাইছে সে সর্বশক্তিতে। হঠাৎ দেখি এক লোেক বুক পানিতে নেমে আমাদের নৌকার সামনে দু’হাত প্রসারিত করে নৌকা থামাতে বলছে। এ লােকটি যে কোন দিক দিয়ে এসেছে আমরা খেয়ালই করিনি। আমার দৃষ্টি ছিল ‘শহীদী’ দরজা পাবার জন্য যারা আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল তাদের। দিকে। আমি লােকটিকে সরে দাড়াতে বললাম। বললাম যে এক্ষুণি সরে না। দাঁড়ালে গুলি করবাে। কিছুই হলাে না। লােকটি দু’হাত দিয়ে নৌকা ধরে দাড়িয়ে রইলাে। ধাবমান জেহাদী’রা পানি ভেঙ্গে আমাদের দিকে ছুটে আসছে। আর সময় দেয়া গেল না। লােকটির উরুতে গুলি করলাম। সে পানিতে পড়ে গেল। আব্বাস প্রাণপণে লগি বাইছে। আমার হাত ‘কক’ করা এসএমসি-র ট্রিগারের উপর, দৃষ্টি প্রসারিত। দূরে কয়েকটি গুলির শব্দ শুনলাম। রাজাকারদের গুলি লক্ষ্যবস্তুতে লাগে আমাদের গায়েও লাগলাে না। আমরা নিরাপদ স্থানে পৌছে গেলাম। আব্বাস কাঁচা রাস্তার উপর সটান হয়ে শুয়ে পড়ল। তার মুখের দু’কোনায় ফেনা। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। আব্বাসকে তুলে বুকে জড়িয়ে ধরে, মনেই রইলাে না। যত সাধারণই হােক না কেন, বলবার মতাে প্রত্যেকেরই আপন আপন কিছু গল্প থাকে। মােকছেদেরও আছে। পেশিবহুল সুঠামদেহী পুরুষ মােকছেদ। সুন্দর একটি কোষা নৌকা তার। নৌকাটি নিয়ে সে আমাদের সাথে থাকে। কবে, কোথায় সে। আমাদের সাথে তার নৌকাটি নিয়ে এসেছিল মনে পড়ে না।
প্রয়ােজনও ছিল না। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেও বিয়ে করেনি মােকছেদ। গাঁ-গেরামে এ বয়সে এক ঘর। পােলাপানের বাপ হওয়া যায়। তিতাস নদীতে মােকছেদের নৌকায় বসে জিজ্ঞাসা করলাম, মােকছেদ বিয়া করােনি ক্যান?’ মােকছেদ হাসতে হাসতে বললাে, “বিয়া আর করতাম না। ক্যান?’ হঠাৎ হাসি মিলিয়ে গেল মােকছেদের। নৌকায় বসে মাঝির চোখে চোখ রেখে কেউ গল্প করে না। তবুও কেন জানি ঘুরে তাকালাম মােকছেদের দিকে। দূরে ঈশান কোনে মেঘটা ঠায় দাড়িয়ে রইলাে। ভর দুপুরে অন্ধকার হয়ে এল বেলা। পূর্বদিকে ঘােড়াশাল গ্রাম পার হয়ে কোষা নৌকা চলছে। আমাদের মােকছেদ নৌকা বাইছে কী বাইছে না, তার নিজেরও খেয়াল নেই। ক’সেকেন্ডে বহু বছরের অতীত পথ ঘুরে ফেললাে মােকছেদ। বললাে, ‘স্যার’ হেইডা একটা সাগর।’ জীবনে কিছু কিছু কথা থাকে, যা সবাইকে বলা যায়। কিছু কিছু কথা থাকে যা কেবলমাত্র আপন মুষ্টিমেয় স্বজনকে বলা যায়। কিছু কথা থাকে শুধুমাত্র একান্ত এক-দুইজনকে বলা যায়। তারপরও কিছু কথা থাকে জীবনে, যা কাউকেই বলা যায় না। মােকছেদের সেই ‘সাগর’ কাউকেই বলবার নয়। বেদনাবিধূর এক মধুর অতীত, একান্তই আপনার। বললাম, মােকছেদ কালাডুমুর পৌছতে আর। কতক্ষণ লাগবে?’ মােকছেদ আমার প্রশ্নের উদ্দেশ্য ভালােই বুঝলাে। নিরুত্তর নৌকা। বেয়ে চললাে মােকছেদ। প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি আমারও প্রয়ােজন ছিলাে না। আমিও যেনাে কী ভাবছিলাম এর মধ্যে ঘণ্টাখানেক সময় হয়তাে পার হয়ে থাকবে। মােকছেদ মুখ খুললাে আবার ‘স্যার, আমরাও মানুষটি সাড়ে তিন হাত, পাঞ্জাবিরাও মানুষটি সাড়ে তিন হাত, খাইছে কেবল তারার ওই দেড় আইত্যায় (দেড় হাতি অস্ত্রটায়)। আমরারেও দেন স্যার অস্ত্র। দেশ আবার সেদিন অয় না ক্যামনে দেহি। মােকছেদকে অস্ত্র দেয়া হয়নি। ওকে অস্ত্র দেয়া যায় না। কেননা দেয়া যায় না ওকে সেটি বােঝাবার চেষ্টা করলাম না। অস্ত্র ছাড়াই এক আশ্চার্য যুদ্ধ করেছে মােকছেদ। | কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কের উপর ইলিয়াটগঞ্জ এবং মাধাইয়া বাজারের মাঝামাঝি স্থানে যে সেতুটি, সে এলাকার নাম খাদঘর। মােকছেদ একদিন বললাে, “স্যার, কয়ডা পাঞ্জাবি আর পাঁচ/ছয় রাজাকার পােলডা পাহারা দেয়।
ইডিরে ধইরা লইয়া আই?’ ক্যামনে আমি জানতে চাইলাম। মােকছেদ মনে মনে এ পরিকল্পনা যে বহুদিন যাবত করেছে তাতে কোনাে সন্দেহ রইলাে না। দেখলাম তার পরিকল্পনার কমা-সেমিকোলনগুলােও সে যথাস্থানে বসিয়েছে। দু’জন ছেলে এসএমসি নিয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে বেবিট্যাক্সিতে মাধাইয়া বাজারের পশ্চিম দিক থেকে ইলিয়টগঞ্জের দিকে রওনা হবে। বেবিট্যাক্সি খাদঘর সেতুর কাছে এলে পাঞ্জাবিরা বা রাজাকাররা আরােহীদের তল্লাশী করতে থামাবে। আর যদি না থামায় তবে তারা নিজেরাই সেতুর পূর্বদিকে শত্রুর বাংকারের কাছে থামবে। ফলে নিশ্চিত যে শক্রর কেউ না কেউ বেবিট্যাক্সী থামার কারণ জিজ্ঞাসা করতে আসবে। এমন অবস্থায় অস্ত্র হয় থাকবে শক্রর কাধে অথবা ঝুলন্ত অবস্থায় তাদের হাতে। যেহেতু বেবিট্যাক্সিতে আমাদের ছেলেরা গুলি করার জন্য প্রস্তুত থাকবে-সেহেতু মুহূর্তেই তাদের উপর গুলি করা যাবে এবং পরক্ষণই বাকিদের হত্যা করা যাবে। কেননা কয়েক সেকেন্ড তারা যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে পারবে না। আমাদের কিছু ছেলে আগে থেকেই অবস্থান নিয়ে থাকবে লাগােয়া উত্তর দিকের গ্রামে। অতএব, ওদের হত্যা করা এবং শত্রুর সব অস্ত্র দখল করা যাবে। মােটামুটি এই ছিল সংক্ষেপে মােকছেদের পরিকল্পনা। অতিমাত্রায় উচ্চাকাঙ্খী ও সাহসী পরিকল্পনা, সন্দেহ নেই। আমার বিস্ময়ের সীমা রইলাে না। অপূর্ব এ রেইডের পরিকল্পনা মােকছেদের মাথায় এলাে কী করে? মােকছেদকে তার এই পরিকল্পনার ওপর কোনাে মন্তব্যই করলাম না। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করবাে বলে মনস্থির করলাম। রণকৌশলগত কারণে এ পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে হলাে। তবে মােকছেদই রইলাে এ পরিকল্পনার মূল প্রণেতা।
বেবিট্যাক্সীর দু’জন ছেলেকে এসএমসি ‘লােড এবং ‘কক’ করতে বলা হলাে ‘সেফটি ক্যাচ অফ অবস্থায়। দু’জনের প্রত্যেকের কাছে দেয়া হল দুটি করে প্রাইম করা গ্রেনেড। বাংকারের ভেতরে অবস্থানরত শক্রদের উদ্দেশ্যে ‘লব’ করার জন্য দেয়া হয়েছিল গ্রেনেডগুলি। কিছুই না বলে দৃশ্যত অকারণেই অপারেশনের সময় গুলির বাক্স কাধে দিয়ে সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম মােকছেদকে। মােকছেদ বসে বসে দেখলাে মিনিট দুয়েকের মধ্যে কীভাবে তার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলাে। জয়পুরহাট চিনিকলের ‘এফ’ টাইপ কলােনীতে থাকে জনাব আলী। জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ানে শত্রু পাকিস্তানি অবস্থান। আক্রমণে সহযােদ্ধা হাদীউজ্জামান শত্রুর মর্টারের স্প্রিন্টারের আঘাতে ঘাড়ে-পিঠে মারাত্মকভাবে আহত হয়। উষ্ণ রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। আরেক সতীর্থ প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে হাদীউজ্জামানকে ক্রলিং করে পেছনে নিয়ে আসে। প্রচণ্ড কষ্টে কাতরাচ্ছে হাদী। জনাব আলীকে সে ডাকে চাচা। চিকিৎসার জন্য কোলে করে যখন জনাব আলী। তাকে নিয়ে যাচ্ছে ব্যথায় কাতর হাদীউজ্জামান ক্ষীণকণ্ঠে অনুরােধ করে, “চাচা, তুমি আমাকে দেশের গানটা শােনাও। চোখ দিয়ে টিপটিপ করে পানি পড়ছে। জনাব আলীর। হাদীউজ্জামানকে কোলে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বেসুরে গাইতে থাকে, আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি।’ দেশের গান কি। মৃত্যুযন্ত্রণা লাঘব করে? আমরা যারা অযথা বেঁচে আছি তারা বলব কী করে?
শ্রীমঙ্গল চা বাগানে পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। অফিসাররা থাকে ম্যানেজারের বাংলােয়। বাংলাের আশেপাশে যাওয়ার জো নেই। নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা পাকিস্তানিদের। যুদ্ধের মাঠে দেশপ্রেম এক উন্মাদনার নাম। আলী আজগর এবং তার এক সহযােদ্ধা মিলে পরিকল্পনা করলাে বাংলাের সামনে কাঁচা রাস্তায় এম-১৪ এন্টিপারসােনাল মাইন লাগাবে। আস্তানার এতাে কাছে মুক্তিবাহিনী আসবে শক্ররও কল্পনার বাইরে। রাস্তার দু’পাশে ঘন চা বাগান। চারটি করে আটটি মাইন লাগাবে। তারা। আলী আজগর যখন তার শেষ মাইনটি গর্তের ভেতরে ঢােকাচ্ছে, তখন হঠাৎ খেয়াল করলাে চারজন পাকিস্তানি অফিসার গল্প করতে করতে বাংলাের দিকে। হেঁটে আসছে। খামখেয়ালি ভাব। আজগরের অবস্থান থেকে পাকিস্তানিদের এবং মাইন পাতায় ব্যস্ত তার বন্ধুর দূরত্ব প্রায় সমান। ডাকতে গেলে পাকিস্তানিরা শুনে ফেলবেই শুধু নয়, তাকে দেখেও ফেলবে। দূরত্ব মাত্র দশ-বারাে গজ অথচ তার বন্ধুর পিঠ তখন শত্রুর দিকে। এতটুকুও আঁচ করতে পারছে না সে। সেকেন্ডের অংশভাগ সিদ্ধান্ত নিতে হলাে আলী আজগরের। নিরুপায় হয়ে গড়িয়ে ঢুকে গেল ঘন চা বাগানের ভেতর। শত্রুরা খেয়ালই করতে পারলাে না। সহযােদ্ধা বন্ধুটি ধরা পড়লাে মাইন লাগানাে অবস্থায়। একদম সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলাে অস্ত্রের আর বুটের আঘাত। মাইনের ভয়ে এরা আর স্থানত্যাগও করছে না। পরিণতি নির্ণীত, মুহূর্তেই বুঝে ফেললাে যােদ্ধা। শরীরের সব শক্তি দিয়ে নিজেকে একটু হালকা করে নিলাে। তারপর একটু আগে নিজের পোতা একটি মাইনের ওপর ডান পায়ের সজোরে আঘাত। চোখের পলকে বিকট শব্দ উড়ে গেল সবাই- আমরা নাম ধাম কিছুই। জানি না সেও মুক্তিযােদ্ধা।
পাঁচ নম্বর সেক্টরের বালাট সাব-সেক্টরে যােদ্ধা নিজামউদ্দিন লস্কর। এপ্রিলেই উপস্থিত সীমান্ত পার হয়ে ভারতে। সুনামগঞ্জ অঞ্চল তখনাে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাংগঠনিক আওতায় আসেনি। ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টে আগত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের আয়ােজন করা হয়েছে। কঠোর প্রশিক্ষণ, জীর্ণ খাবার। সকালে এক ঘণ্টার পিটি শেষ করে লস্কর এলুমিনিয়ামের থালা আর মগ নিয়ে লঙ্গরে গেছে খাবার আনতে। থালায় দেয়া হলাে চাল, ডাল আর পাথরকুচি মিশ্রিত লেই জাতীয় একরকম খাবার। তারপরও খেতে হবে, বেঁচে থাকার জন্য। হাতে থালা নিয়ে খাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে লস্কর। তখনাে সে জানে না একজোড়া চোখ নিবিষ্ট তার ওপর। সতেরাে-আঠারাে বছরের এক যুবক চোখে ছলছল জল নিয়ে থালা হাতে লঙ্করের দিকে তাকিয়ে আছে। লস্কর জিজ্ঞাসা করে, ‘খাবে না’? আরশ আলী। নিচুস্বরে জবাব দেয়, ওরা আমাদের দেশটা কেড়ে নিয়েছে মুখের গ্রাস তাে এর তুলনায় কিছুই না। খাই কী করে?’ নিজামউদ্দিন লস্করের রণাঙ্গনের ওপর একটি লেখা পড়েই আমি তার ভক্ত হয়ে গেছি। কোনাে পরিচয় নেই তার সঙ্গে, আলাপচারিতাও না। আমার উপর্যুপরি অনুরােধে সব কাজে ফেলে সিলেট থেকে এসেছেন ঢাকায় আমার কাছে। ন’মাসের কত কাহিনী। লস্করের চোখ বরাবর ভিজে যাচ্ছে। চোখের পানি লুকাতেও চেষ্টা করছেন না। বলতে বলতে বলেন, ‘তখন জানতাম না আরশ আলী আমার সঙ্গে যুদ্ধে যাবে, জানতাম না আরশ আলী। আমারই সামনে মাথায় গুলি খাবে যুদ্ধে মাঠে, আমি তাকে কলেমা শােনাবাে, আমারই সামনে সে মারা যাবে, স্বাধীনতার পর তার নামে স্কুলে হবে সুনামগঞ্জ থেকে সিলেট আসার পথে জয়কলসের রাস্তার ধারে, সেখানে সে শেষঃনিশ্বাস ত্যাগ করেছিল এবং জানতাম না তার নামের সে সাইনবাের্ডটিও আবার একদিন মুছে ফেলা হবে। সাইত্রিশ বছর পার হতে চলল, এখনাে মাঝে-মধ্যে সকালে খিচুড়ির প্লেট সামনে এলে লস্কর তাকিয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে আরশ আলীর বেদনাক্রান্ত মুখ, ‘খাই কি করে?’।
২৪ এপ্রিল, একাত্তর। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কে শুভপুর ব্রিজ থেকে চট্টগ্রামের। দিকে মাইল তিন গেলে করেরহাট। এক সময়ের ছােটখাটো ব্যবসা কেন্দ্র। পাকিস্তানি পশুদের নৃশংসতায় বিরান হয়ে আছে। মানুষ নেই, পশু-পাখিও ঘর ছেড়েছে। খাঁ খাঁ রােদুরের উত্তাপ উপেক্ষা করে কেবল শ’খানেক ইপিআর সৈন্য। তাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরিতে ব্যস্ত। ক্যাপ্টেন রফিক এ যােদ্ধাদের নিয়েই বারবার শত্রুদের অগ্রাভিযান বিলম্বিত করতে এবং ওদের রক্ত ঝরাতে একের পর এক যুদ্ধ করে চলেছেন। করেরহাট বেহাত হওয়ার অর্থ বহুমাত্রিক বিপর্যয়। শুভপুর ব্রিজ শক্রর দখলে চলে যাবে, যার অর্থ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক শক্রর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া। এখান থেকে একটি রাস্তা পূর্বদিকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রামগড়। তখনাে রামগড়ে মুক্তিযােদ্ধারা পুনঃসংগঠিত হচ্ছে। ওরাও মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। ক্যাপ্টেন রফিক আর তার সহযােদ্ধারা রণক্লান্ত। সৈন্যসংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের অভাব আর গােলাবারুদের স্বল্পতা ক্যাপ্টেন রফিককে ভীষণভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। রসদ নেই, নেই একবেলা আহারেরও কোনাে নিশ্চয়তা। তারপরও শত্রুর আসন্ন অগ্রাভিযান রুখতে হবে। অনিবার্য যুদ্ধ, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। এত সীমাবদ্ধতা নিয়ে সুসংগঠিত ও সুসজ্জিত শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব। তবুও এ লড়াই তাদের করতে হবে। এই যােদ্ধারা ২৫ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে বিদ্রোহ করে ক্রমাগত যুদ্ধ করে আসছে। তারপরও তাদের কোনাে অবসাদ নেই। ঠিক এই সময়ে খবর এলাে মহালছড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থান মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। পাকিস্তানিদের ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি এবং প্রায় দুই ব্যাটালিয়ান মিজো বিদ্রোহী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। অতিরিক্ত সেনাসদস্য চেয়ে পাঠিয়েছেন মেজর মীর শওকত আলী।
অনন্যোপায় ক্যাপ্টেন রফিক ৩০ জনের একটি দল বাধ্য হয়েই পাঠিয়ে দিলেন মহালছড়ি। বাকি ৭০ জন যােদ্ধা দিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি যেনাে শত্রু মুক্তিযােদ্ধাদের সৈন্যের অপ্রতুলতা সহজে আঁচ করতে না পারে। এ হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির উন্নতির বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নেই, ক্যাপ্টেন রফিক সে কথা জানেন। কিন্তু তারপরও তাকে তার যােদ্ধাদের উজ্জীবিত রাখতে হবে। তার এই হতাশা আর দুশ্চিন্তার কোনাে বহিঃপ্রকাশই ঘটলাে না। অপরিহার্য এ মরণখেলার প্রস্তুতি চলতে থাকলাে পূর্ণোদ্যমে। | দুপুর তিনটার মধ্যে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের কাজ শেষ করতেই ক্ষুধা জানান দিলাে। নিজের কাছে সযত্নে রাখা সামান্য সম্বল কিছু চিড়া আর গুড় খেয়েই সামনের খালের ঘােলা পানি দিয়ে জঠর পূর্ণ করলেন। তারপরও মনে হলাে যেন অমৃত। রফিক অবসন্ন দেহ নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেছনে করেরহাট স্কুলের কাছে এলেন। বিক্ষিপ্ত আর্টিলারির গােলাপড়া শুরু হলাে আবারাে। বাতাসে বারুদের গন্ধ। পাশেই তিনটি কুঁড়েঘর আগেই গােলার আঘাতে মাটিতে মিশে গেছে। ধোঁয়া বেরুচ্ছে তখনাে। এর মধ্যে দুজন মহিলা এদিক-ওদিক ছােটাছুটি করছেন। পাশেই পড়ে আছে রক্তস্নাত এক নিথর কিশাের। শত্রুর আর্টিলারি শেলের ধারালাে প্লিন্টার তার পেটটা কেটে দেহ দু’ভাগ করে ফেলেছে। ক্যাপ্টেন রফিক চিকার করে তাদের দৌড়াদৌড়ি না করে শেলিং বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত মাটিতে শুয়ে থাকতে বললেন।
তােমরা কারা? এক মহিলা ধীরপ্রশান্তে জিজ্ঞাসা করলেন গভীর বেদনাহত কণ্ঠে। আমরা আপনাদেরই সন্তান’ বলা শেষ করেই শক্ত করে ধরা হাতের। এসএমজিটি নিয়ে ক্যাপ্টেন রফিক পা বাড়ালেন স্কুলের দিকে। আকাশের দিকে মুখ। করে শরীর এলিয়ে দিলেন মাঠের ঘাসে। একজন মহিলা ধীরে হাঁটু গেড়ে বসে। পড়লেন মৃত কিশােরটির পাশে। দোয়ার ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা দুটি হাত উঠলাে আকাশে। ট্যাঙ্ক গড়িয়ে আসার শব্দ শােনা যাচ্ছে। এরই নাম যুদ্ধ। গত এক মাসে তিনি ভালােভাবেই জেনেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সব গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেলাে, রাজ্যের ভাবনা আসতে লাগলাে মাথায়। কবে শেষ হবে এ যুদ্ধ, কতদূর সেই স্বপ্নসাধ-স্বাধীনতা। এরই মধ্যে কানে ভেসে আসছে। শূন্যে দুটি হাত তােলা সেই মায়ের দোয়া আল্লাহ, আমার প্রাণপ্রিয় ছেলেটিকে তুই নিয়ে গেছিস, সেজন্য আজ আমার কোনাে অভিযােগ নেই। আমার ছেলের প্রাণের বিনিময়ে আমি শুধু এই ছেলেদের জন্য দোয়া চাইছি, যারা এই দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে। এক মায়ের প্রগাঢ় মমতায় মুহূর্তেই সব ভাবনা উবে গেলাে ক্যাপ্টেন রফিকের। গভীর আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন তিনি। অজান্তেই চোখের দু’পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মনে মনে বললেন, “হে দয়াময় খােদা, এই দুখিনী মায়ের দোয়া তুমি দয়া করে কবুল করাে’।
হাজারাে ছেলের বুকের রক্ত আর সন্তান হারানাে হাজারাে দুখিনী মায়ের চোখের জল করুণাময় প্রভু কবুল করেছেন। এই আমি আর আপনি যদি তা বুঝতাম। একাত্তরে বাংলাদেশে ছিল পাঁচটি ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন-১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৮ম। ১ম এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দুটির পশ্চিম পাকিস্তানে বদলীর আদেশ দেয়। ব্যাটালিয়ন দুটির অগ্রগামী দল’ বা Advance Party পশ্চিম পাকিস্তান চলে যায়, লােকবল যায় কমে। তাছাড়া ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর এক চতুর্থাংশ সৈনিক চলে যায় Pre-embercation ছুটিতে। আন্ত প্রদেশ বদলীর ক্ষেত্রে তখন দুই মাসের Pre-embercation ছুটির প্রচলন ছিল। ২৫ মার্চের আক্রমণের প্রেক্ষিতে এই ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নগুলিই সক্ষমভাবে প্রতিরােধ গড়ে তােলে, যদি স্বাভাবিক কারণে সফলতা তেমন আসেনি। তবে আরাে বেশি প্রাণহানি রহিত হয়। বাঙালি এ সৈনিকের তাদের প্রাক্তন প্রভুদের রণকৌশল এবং মনন সম্বন্ধে অবহিত ছিলাে বলে প্রতিরােধ গড়ে তােলা সহজ হয়। প্রাথমিক প্রতিরােধ শেষে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ব্যাটালিয়নগুলি ভারতে আশ্রয় নেয়। তাদের বিশ্রাম ও পুনঃগঠন অপরিহার্য হয়ে পড়েছিল। এ পর্যায়ে ব্যাপকভাবে গণযােদ্ধাদের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নগুলির সৈন্য সংখ্যার ঘাটতি পূরণ করা হয়। ১৫ থেকে ৪৫ বছরের কিশাের-পৌঢ়রা শ’য়ে শ’য়ে স্বেচ্ছায় লাইনে দাড়িয়ে যেতাে। উচ্চতার চাহিদা ছিল ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। পাঁচ ফুটের নীচের উচ্চতার যশাের শহরের ছেলে মহিউদ্দীন তাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করতে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিনকে অনুনয় করতে থাকে। এক পর্যায়ে সে ক্যাপ্টেন হাফিজের জিপের সামনে আড়াআড়িভাবে শুয়ে পড়ে। অন্যরা তাকে চ্যাংদোলা করে দাঁড় করায়। সে ক্যাপ্টেন হাফিজকে বলে, ‘স্যার, বুকের মাপ আর উচ্চতা দেখে ভর্তি করলে চলবে । আপনারা শত্রু অবস্থান দেখিয়ে দেন এবং আমাদের দেন গ্রেনেড। আপনাদের চোখের সামনে দিনে দুপুরে যে শক্রর উপর গ্রেনেড ছুড়ে আসতে পারবে, তাকেই নেবেন সেনাবাহিনীতে।
১৪ ডিসেম্বর ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যখন সিলেটের এম.সি. কলেজ আক্রমণ করে আমাদের মহিউদ্দীন সে যুদ্ধে শাহাদত বরণ করে। নিয়মানুযায়ী একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নে চারটি কোম্পানি থাকে-এ,বি,সি ও ডি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গণযােদ্ধাদের সমন্বয়ে ‘ই’ বা ইকো কোম্পানি নামে প্রত্যেকটি ব্যাটালিয়ঁন একটি কোম্পানি সংযযাজিত হয়। ‘ইকো’ কোম্পানিগুলাের সাফল্য কিংবদন্তিতুল্য। যুক্তিনির্ভর অনুমান অনুযায়ী প্রশিক্ষিত সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ১,২০,০০০। সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ এবং আনসার বাদ দিয়ে ৭৮,০০০ গণযােদ্ধা, ছাত্র এবং গা-গেরামের খেটে খাওয়া মানুষ। এই মাটিবর্তী মানুষ তাদের সর্বস্ব দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন দিয়েছে। এমন হতাে যে আমরা যে গ্রামে অবস্থান নিয়ে এম্বুশ পরিচালনা করতাম এবং পাকিস্তানিরা পরে এসে সে গ্রামের লােকজনকে হত্যা করতাে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিততা, নারীদের নির্যাতন করতাে, গবাদি পশু নিয়ে যেতাে। তারপরও এমন কখনাে হয়নি কোনাে গ্রামের মানুষ আমাদের অবস্থান গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা শত্রু অবস্থান ও সংখ্যা সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে দিতাে, আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতাে, এমুনিশন ও ভারি সরঞ্জাম বয়ে। নিয়ে যেতাে। আমাদের শহীদদের জানাজা এবং কবরের ব্যবস্থা করতাে এবং আহতদের বহন ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাে। এক কথায় যা প্রয়ােজনীয়, যা সম্ভব এমনকি যা অসম্ভব তাও এই আমজনতা আমাদের জন্য করেছে, এ দেশের স্বাধীনতার জন্য করেছে। এই ব্রাত্যজনদের চিরকালীন স্মারক হয়ে থাকার কথা এই স্বাধীন দেশের জনপদে। অথচ তারা আজ কোথাও নেই আমাদের আমিত্বের দাপটে। আমাদের চৈতন্যে কদাচিৎ আসে যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা মৃন্ময়ী কোনাে বস্তু নয়, গােটা বিষয়টাই চিন্ময়ী। | চীন, ভিয়েতনাম ও কিউবায় জনযুদ্ধ বা Peoples War সংগঠিত হয়।
কিন্তু এদের যুদ্ধ ছিল একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা কম্যুনিজম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। অকম্যুনিস্টরা তাতে অর্ন্তভুক্ত হয়নি, স্বভাবতই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দেশের বৃহত্তর জনগােষ্ঠীকে অর্ন্তভুক্ত করেছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধই প্রকৃত জনযুদ্ধ। উচ্চবর্গের মানুষরা সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, সরকারী আমলা, উকিল-ব্যারিস্টার, বিত্তশালী ব্যবসায়ী, মসজিদের ইমাম, মাদরাসার শিক্ষকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার অহংকার নেই, হাতে গােনা এক দুই জন ব্যতিক্রম বাদ দিলে। ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহের মস্তিষ্ক প্রসূত ‘সাব-অলটার্ন হিস্টরি’-র অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য কতাে আবশ্যক, আমরা যদি তা উপলব্ধি করতাম! বর্তমানের জন্য নয় ভবিষ্যতের জন্য এ বীরগাথা রেখে যাওয়া দরকার। বর্তমান বসে থাকে না। দীনতার কারণে তা করতে ব্যর্থ হলে ভবিষ্যৎ কালিমাময় হয়ে যাবে। করণীয় কাজ যদি কোনােদিন কেউ না করে তাহলে কোথাও পৌছানাে যাবে না। আমি ভবিষ্যৎ বক্তা নই, আগামীতে কী হবে জানি না। তবে একথা নিশ্চিত জানি এ দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের নায়ক আমাদের দেশের গণমানুষ।
বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা
এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা
স্বৰ্গ কি হবে না কেনা।
বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না
এত ঋণ?
রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন।
সূত্র : পতাকার প্রতি প্রণোদনা – মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)