বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৬ই জুলাই, মঙ্গলবার, ৩১শে আষাঢ়, ১৩৮১
অপপ্রচার এবং ষড়যন্ত্রের জবাব
শ্রমিক লীগের সম্মেলনকে উপলক্ষ করে বাংলাদেশের মেহনতী মানুষ আর একবার তাদের বক্তব্য অত্যন্ত জোরালো এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা যে সকল ক্ষেত্রে তারা লাভ করেছেন তার সবগুলো ক্ষেত্রেই শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন বৃদ্ধি তথা সামাজিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছেন। অথচ একটা অপপ্রচার চারদিকে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে সেই শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধেই। বলা হচ্ছে উৎপাদন বৃদ্ধিতে শ্রমিক সমাজের অনীহার ফলেই মিল-কারখানার উৎপাদন ক্ষেত্রে একটা নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রমিক শ্রেণীর প্রথম থেকেই প্রশাসক পরিচালকদের দুর্নীতির কারসাজি এবং ষড়যন্ত্র, পর্যাপ্ত কাঁচামালের অভাব, কারখানার স্পেয়ার পার্টস আমদানিতে গরিমশি প্রভৃতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছিল। কিন্তু কেউ সে দিকটা গা করেনি। এই অবহেলার ফলে উৎপাদনে ভাটা পড়েছে, কাঁচামাল এবং স্পেয়ার পার্টস-এর অভাবে বন্ধ থেকেছে অনেক কলকারখানা।
এদিকটায় সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমরাও বহু চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সংবাদপত্রে এই কাঁচামালের স্বল্পতা, স্পেয়ার পার্টস এর অভাব, প্রশাসক পরিচালকদের দুর্নীতির খবর প্রতিদিনের ছাপা হচ্ছে। অথচ কর্তাব্যক্তিদের তরফ থেকে নেয়া হয়নি বাস্তব কোন পদক্ষেপ। কাঁচামাল এবং স্পেয়ার পার্টস আমদানি বেসরকারি আর্থিক লিমিটনেস সম্পর্কে আমরা কিন্তু ওয়াকিবহাল যে মাল অথবা যন্ত্রপাতি চট্টগ্রামে এসে পৌঁছেছে তা মিল-কারখানায় পৌঁছানোর এবং যে নিদারুণ কারচুপি এবং ‘রেড –টেপিজম’ এর প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে তার জন্য দায়ী কে?
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় উৎপাদন ব্যবস্থায় একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য প্রথম থেকেই একটি বিশেষ মহল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হচ্ছিল। সরকারের জাতীয়করণ কর্মসূচি এবং সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য নির্ধারণে তাদের আক্রোশের মূল কারণ। এই অপকর্মে মিল-কারখানার পুরনো মালিক, জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি এবং পুঁজিবাদী মনোভাব আমলাদের সঙ্গে বৈদেশিক মহলের যোগসাজশ থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। উৎপাদন ক্ষেত্রে নৈরাজ্য সৃষ্টি সকল অপকর্মের পাশাপাশি তারা প্রচারণা চালান শ্রমিকশ্রেণীর বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে সে অপপ্রচার আর এক ধাপ এগিয়ে শুরু হয় সরকারের জাতীয় করণ কর্মসূচির বিরুদ্ধে। এখনতো তারা অনেক সংহত এবং সংগঠিত। একের পর এক তারা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে সরকারের সকল প্রগতিশীল কর্মসূচির বিরুদ্ধে। এরা যেমন সরকারের বাইরে থেকে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তেমনি অনেকে সরকারের ভিতরে থেকেও গণবিরোধী শক্তির মদদ জুগিয়ে চলেছে। গণ স্বার্থবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের অশুভ তৎপরতা আংশিকভাবে হলেও যে জনমনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে তা আজ আর অস্বীকার করবার উপায় নেই। প্রথম থেকে শক্ত হাতে সরকার এদের মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে। সমাজতন্ত্র বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তোলায় সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষ শক্তি সমূহও যেমন সাংগঠনিক তৎপরতা স্বাক্ষর রাখেনি। সুসংগঠিত না হওয়ায় শ্রমিকশ্রেণী কার্যকরীভাবে প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়করণ বিরোধী শক্তিকে মোকাবিলা করতে পারেনি।
শ্রমিক লীগের সম্মেলনের আহ্বান জানানো হয়েছে গণবিরোধী চক্রের বিরুদ্ধে সুতীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলার। যতদিন না সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ‘কৃষক-শ্রমিক রাজ’ কায়েম হবে ততদিন এই সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে। যে কোন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় শ্রমিকশ্রেণীকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। আমরা শ্রমিকশ্রেণীর সচেতনতা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তাদের দৃঢ় মনোবলের প্রতি আস্থাশীল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক, মধ্যবিত্ত, দেশপ্রেমিক শক্তি যে কোন ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় সফলতা অর্জনে সক্ষম হবে সে বিশ্বাস আমাদের আছে। এজন্য চাই নতুন কর্মপ্রয়াস, সুশৃংখল সংগঠন, আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা এবং প্রগতিশীল দেশ প্রেমিক গণমানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। সেদিন বেশি দূরে নয় যেদিন পুঁজিবাদী ধ্যান-ধারণা, সমাজতন্ত্র এবং শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে সকল ষড়যন্ত্র পরাভূত হবে।
সাদা কাগজের সংকট
চলতি সপ্তাহের সাদা কাগজ সংকট নিয়ে পত্রিকান্তরের মাধ্যমে যে সমস্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে তাতে মনে হয় এ সংকট কৃত্রিম। কারণ কাগজের মিলে উৎপাদন যে নেই তা নয়। সাদা কাগজ উৎপাদনকারী মিল দুটির মধ্যে কর্ণফুলীতে স্বাধীনতার পূর্বে ৩০ হাজার টন কাগজ উৎপাদন হতো। তার মধ্যে ১৮ হাজার টন কাগজ সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদান করা হতো এবং বাকি ১২ হাজার টন কাগজ এখানে খরচ হতো। ১৯৭৩-৭৪ সালের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে দেশে বছরে ২২ হাজার টন কাগজ উৎপাদিত হয়। অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ সাদা কাগজ এখন দেশের ব্যবহারের জন্য আমরা পাচ্ছি। প্রশ্ন জাগে, তবু এই সংকট কেন?
সহযোগী দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, বর্তমানে কর্ণফুলী কাগজের মিলে বাংলাদেশে কাগজ ও বোর্ড সংস্থার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এবং বলতে গেলে কর্ণফুলী কাগজ কল স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। ফলে কাগজ বন্টনের ক্ষেত্রে কোন নিয়ম-কানুন নেই বললেই চলে। আমাদের ধারণায় কাগজ উৎপাদনের পর সুষ্ঠু বিতরণের প্রশ্নটি যদি উপেক্ষিত হয়–তাহলে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে তারই ফলশ্রুতিতে কাগজ সংকট দেখা দিতে বাধ্য।
একই প্রতিবেদন সূত্র আরো জানায় যে, ইতিপূর্বে কর্পোরেশন প্রতি জেলায় ৪ জন ও মহাকুমায় ২ জন করে কাগজের ডিলার নিযুক্ত করার সুপারিশ করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট এলাকার ডি,সি বা এস,ডি,ও’র সঙ্গে পরামর্শক্রমেই এই ডিলার নিযুক্ত করার কথা। অথচ ঘটনা দৃশ্য দেখা যায় মিলের কর্মকর্তারা তাদের ইচ্ছামাফিক বিশাল নিযুক্ত করেন। ফলে কাগজ যথাস্থানে যায় না এবং দুর্নীতির নৈরাজ্য শুরু হয়। অতঃপর কাগজের সংকট দেখা দেয়।
এছাড়াও তেলেসমাতি আছে। কাগজ উৎপাদনের জন্য দেশি সামগ্রী তথা লবণ ও অন্যান্য ছোট-খাটো প্রয়োজনীয় কাঁচামাল প্রথমতঃ সময়মতো সংগ্রহ করা হয় না, এবং দ্বিতীয়তঃ ওই সব সরঞ্জামাদি কেনার ব্যাপারেও উদ্দেশ্যমূলক কারসাজি করা হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, উত্তরবঙ্গের যে একটা সাদা কাগজের মিল আছে সেখানকার উৎপাদনে হতাশার অংক। ১৯৭৩-৭৪ সালের জুলাই-জুন বছরে এই মিলে কাগজ উৎপাদন হবার কথা ছিল ১৮ হাজার টন কিন্তু উৎপাদন হয়েছে ৩ হাজার টন। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও রাসায়নিক দ্রব্যাদি মজুদ থাকা সত্বেও উৎপাদনের এই ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে। প্রতিবেদন সূত্রে যতটা জানা যায়–এখানেও সেই তেলেসমাতি, অর্থ আত্মসাত করার চমকপ্রদ লীলা।
আবার ১৮ হাজার টাকার পরিবর্তে ৩ হাজার টন সাদা কাগজ উৎপাদন করে কর্তৃপক্ষ শুধু যে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত রেখেছেন তাই নয়, তার আরও একটু রঙ্গ আছে। প্রতিবেদন সূত্রে বলা হয়েছে, এই তিন হাজার কাগজের সবটুকুই রঙিন মোড়কের কাগজ। সাদা কাগজ তথা লেখার কাগজ নয়।
অভিযোগে প্রকাশ, একদিকে উৎপাদন ঘাটতি এবং প্রয়োজনননুগ সাদা কাগজ উৎপাদন না করা আর অপরদিকে অদূরদর্শিতার জন্য সাদা কাগজ উৎপাদনের অত্যাবশ্বকীয় বিভাগ ‘ক্লোরিন্ট প্লান্ট’ মেরামতে খামখেয়ালীর আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। ক্লোরিন গ্যাস সরবরাহের পুরাতন জি,আই পাইপ পাল্টিয়ে একবার পি,ভি,সি পাইপ লাগানো এবং পুনরায় পি,ভি,সি পাইপ পাল্টিয়ে জি,আই পাইপ লাগাতে গিয়ে অযথা হাজার হাজার গ্যালন জ্বালানি তেল নষ্ট করা হয়েছে এবং হাজার হাজার টাকা মেরামত বাবদ ঠিকাদারকে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন সূত্রে পাওয়া উত্তরবঙ্গের মিল সংক্রান্ত সংবাদগুলি যদি সত্যি হয়–তাহলে সেখানে অবিলম্বে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ আবশ্যক। মিলটির যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করে তা পুরোপুরি চালু করে পূর্ণ উৎপাদনের পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আর ডিলারশিপ নিয়ে যে অভিযোগ–এ আজকের নয়। অনেকদিন ধরেই এ নৈরাজ্য চলছে। ডিলারশিপের মাধ্যমে যথার্থভাবে কাগজ সরবরাহের ন্যায্য পদক্ষেপ নিতে হবে এবং তা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণের গোচরে আনতে হবে। এক কথায় ডিলারশিপের কারসাজি যেকোনো তৎপরতার মাধ্যমে বন্ধ করতেই হবে। পরিশেষে বলা যায়, দেশে যা কাগজ উৎপাদিত হচ্ছে তাতে সাদা কাগজ সংকট দেখা দেয়ার কথা নয়। তবু যখন আছে তখন এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া এবং পাঠ্যপুস্তক সহ সর্বপ্রকার পুস্তক প্রকাশনা চরম সংকটের মধ্যে পড়বে। চাইকি কাগজ কিনতে প্রচুর অর্থ ব্যয়ও করতে হতে পারে। তদুপরি জাতীয়করণকৃত একটি লাভজনক শিল্প কারখানায় লাল বাতি জ্বলবে এবং দুর্নীতির নৈরাজ্য অধিকতর জোরদার হবে, বর্তমান পরিস্থিতিতে এর কোনটাই দেশের জন্য মঙ্গল জনক নয়। অতএব সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জাতীয় উন্নতি-অগ্রগতি সহ একটা বিশেষ উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন মহলকে ন্যায়দন্ড হাতে এগিয়ে আসতে হবে এবং জাতীয়করণকৃত একটি লাভজনক শিল্প প্রতিষ্ঠানের এহেন দুরবস্থা ঘটানোর জন্য দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দিতে হবে। এ জনগণেরই দাবি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক