বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৭ই জুলাই, বুধবার, ৩২শে আষাঢ়, ১৩৮১
এ নাজুক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতেই হবে
দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক হয়ে পড়েছে। জানা গেছে; বাংলাদেশে নাকি বিশ্বের তৃতীয় তম দরিদ্র দেশ থেকে বর্তমানে একমাত্র দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে সরকার বহু প্রচেষ্টা চালিয়েছেন উৎপাদন বাড়িয়ে অবস্থার উন্নতি করার জন্য। তবু ১৯৬৯-৭০ সালের থেকে ’৭৩-৭৪ সালের উৎপাদন অনেক কম। পরিকল্পনা কমিশনের অভিমত থেকেই এটা প্রতীয়মান হয়েছে। ধরা হয়েছিল যে, ১৯৭২-৭৩ সালের চেয়ে ১৯৭৩-৭৪ সালের রাজস্ব অনেক বেশি হবে–কিন্তু তা হয়নি, বরং অনেক কম হয়েছে। এতদসত্ত্বেও গত বছরের তুলনায় এবার রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এবারের বাজেটে ৭০ কোটি টাকা অনুৎপাদন খাতে বরাদ্দ করা হয়েছে। যদিও এটা অপর্যাপ্ত। এছাড়া খাদ্যে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়েছে ভর্তুকি হিসেবে। এর ফলে রাজস্ব খাতে প্রস্তাবিত উদ্ধৃত্ত ঘাটতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যাতে করে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি হ্রাস পেয়েছে, বিদেশি সাহায্যে অর্থ যোগান সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে এবং ঘাটতি অর্থও সংস্থান করতে হচ্ছে। বাজারে প্রতিটি জিনিসের মূল্য বৃদ্ধির ফলে আমদানি হ্রাস এবং তা সত্বেও সার্বিক দায় পরিশোধের ভারসাম্যের উপর দারুন চাপ পড়েছে। যার ফলে রিজার্ভ ও স্বল্পমেয়াদী বৈদেশিক ঋণ উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। এর দরুন রাজস্ব আয় শতকরা ২৪ ভাগ কম হয়েছে এবং শতকরা ১২ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজস্ব ব্যয় বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান থেকে বাঙ্গালীদের প্রত্যাবর্তন ও বেতন কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করার দরুন রাজস্ব ব্যয় বেড়েছে। এদিকে পরিকল্পনায় ঘোষিত নীতিসমূহের রোধ করা সম্ভব হয়নি বরং ৪০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলধন বিনিয়োগ হয়নি। ১৯৭২-৭৩ সালের দ্রব্যমূল্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৩-৭৪ সালের সরকারি খাতে উন্নয়ন ব্যয় কমপক্ষে ৬০০ কোটি টাকা হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪০০ কোটি টাকা। ১৯৭২-৭৩ সালের তুলনায় ১৯৭৩-৭৪ সালের আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়েছে মাত্র ১২ ভাগ। এ হার অবশ্য ১৯৭২-৭৩ সালের দ্রব্যমূল্য মাত্রায়। যে সকল খাতে বেড়েছে তাহলে কৃষি, পশু, বন ও মৎস্য। এছাড়া শিল্প, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও যানবাহনেও কিছু ভাগ বেড়েছে।
১৯৭৪-৭৫ সালের যে উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে তাতে কিছু কিছু অবস্থার উন্নতি সাধন হবে বলে আশা করা হয়েছে। কৃষির উন্নয়নের ওপর সমধিক জোর দেওয়া হয়েছে। যদিও ১৯৭৪-৭৫ সালের উন্নয়ন কর্মসূচি বৈদেশিক সাহায্যের উপর বেশি পরিমাণে নির্ভরশীল সেহেতু কিছু অনিশ্চয়তাও রয়ে গেছে। আশা করা হয়েছে যে, চলতি অর্থবছরের সামগ্রিকভাবে মোট উন্নয়ন উৎপাদন ৫ থেকে ৬ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। কৃষিখাতে বৃদ্ধি পাবে শতকরা ৪ ভাগ। পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারলে শিল্প খাতে প্রায় ১০ ভাগ উৎপাদন বাড়বে। খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্য স্থির হয়েছে ১৩১ লাখ টন।
১৯৭৩-৭৪ সালের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিবরণ গত পরশুদিন জাতীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে। এর বিবরণ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি আমরা প্রত্যক্ষ করতে পারছি। আমাদের বার্ষিক পরিকল্পনা যে অংক নির্ধারণ করা হয়েছে তা হলো–৫২৫ কোটি টাকা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য নিজস্ব সম্পদ থেকে ব্যয় হবে ১৩১ কোটি টাকা। অবশিষ্ট ৩৯৪ কোটি টাকা বৈদেশিক সাহায্য থেকে পূরণ করা হবে। পরিকল্পনায় কৃষিখাতের সর্বাধিক ব্যয় বরাদ্দ ধার্য করা হয়েছে। কৃষি, গ্রামীণ সংস্থা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মিলে এর পরিমাণ হল ১৭১ কোটি ৫০ লাখ টাকা। রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে এবং ব্যয় বেড়েছে। উৎপাদন এখনো অনিশ্চিত। বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া যাবেই এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অন্যদিকে আমাদের একমাত্র নির্ভরযোগ্য ফসল পাট -যা দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার নিশ্চয়তা ছিল সেখানেও এবার উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। পাট বিদেশে রপ্তানি করতে গেলে নিজস্ব মেল অচল হয়ে পড়তে পারে। চা- চামড়া থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে তার পরিমাণও উল্লেখ যোগ্য নয়। এমতাবস্থায় দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কাঠামো যে কোন পর্যায়ে পৌঁছুবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অত্যন্ত সঠিক দৃষ্টিকোণ ও পর্যালোচনা করেছেন বলে আমরা মনে করি।
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির শেষ অধ্যায়
ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে বিরক্তিকর টানা-হেঁচড়ার অবসান হতে চলেছে। খুব শিগগিরই প্রতিনিধি সভা ও সিনেটে মিঃ নিক্সনের বিরুদ্ধে হাউস জুডিশিয়ারি কমিটি কর্তৃক প্রণীত ইমপিচমেন্ট বিল উঠবে। সম্পূর্ণভাবে না হলেও ইমপিচমেন্টের কোন কোন ধারা যে অনুমোদন পাবে না তা নয়, তবে আগামী নভেম্বরের নির্বাচনের দিকটা রিপাবলিকান পার্টি বিশেষভাবে ভেবে দেখবে।
ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বীকার করেছেন যে, তার প্রথম কার্যকালের সময় ১৭ জন কর্মকর্তার কথাবার্তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা মূলক তথ্য ফাঁস সংক্রান্ত বিষয়ে টেপ করার ব্যাপারে তিনি নিজেই দায়ী। এ সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সম্পর্কে যে অভিযোগ উঠেছে মিঃ নিক্সন তা খন্ডন করেন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি মিঃ রোনাল্ড জিগলার জানান যে, কমিটির চেয়ারম্যান উইলিয়াম ফুলব্রাইট এর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে মিঃ নিক্সন তার ১৯৭৩-এর ২২শে মে’র বিবৃতির পুনরুল্লেখ করে বলেছেন, তৎকালীন স্থানীয় নিয়মাবলী এবং প্রচলিত বিধি অনুযায়ী তিনি ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে টেপ ব্যবস্থা স্থাপন করেন।
গত দু’বছর ওয়াটার গেটের কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ গুলো বেরিয়ে এসেছে এবং মার্কিন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার যে ঘৃণ্য ও ন্যক্কারজনক দিক উন্মোচিত হয়েছে তাতে অবশ্য সৎ গণতান্ত্রিক মার্কিন নাগরিকরা ক্ষুব্ধ। বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন থেকে শুরু করে নিজের সুরক্ষিত প্রাসাদেও আড়িপাতা, নির্বাচনে বিজয়ের জন্যঢেল অর্থ ঢালাও পুঁজিপতিদের নিকট থেকে অর্থ গ্রহণ এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত উপঠোকনাদি দিয়ে স্ত্রী-কন্যাকে অলংকারে সজ্জিত করা, আয়কর ফাঁকি দেয়া প্রভৃতি যে সকল অভিযোগ প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিরুদ্ধে দিনের-পর-দিন সোচ্চার হয়ে উঠছে বিশেষ করে তার তদন্তের জন্য নিয়োজিত কমিটি যে বিরক্তিকর নীতি গ্রহণ করেছে তাতে এর একটা দ্রুত নিষ্পত্তির সবাই আশা করেন। ইতিমধ্যে প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের অনেকেই কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন অথবা প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। সব শেষ আঘাত এসেছে হেনরি কিসিঞ্জার এর উপর। এতদিন তিনি ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে সকল জল্পনা-কল্পনার ঊর্ধ্বে ছিলেন। পরপর কূটনৈতিক সাফল্য তার জনপ্রিয়তাও অসম্ভব রকম বেড়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। হঠাৎ করে অভিযোগ এল হোয়াইট হাউজের টেপ স্থাপনের ব্যাপারে হেনরি কিসিঞ্জারও জড়িত ছিলেন। হার্ভার্ডের প্রাক্তন শান্তশিষ্ট অধ্যাপকটি এতে ক্ষুব্ধ হলেন। হুমকি দিলেন এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িত করার যদি কোন প্রচেষ্টা চলে তবে তিনি পদত্যাগ করবেন।
মিঃ নিক্সন সে অভিযোগ নিজ স্কন্ধেই নিয়েছেন। এর ফলে সম্প্রতি প্রেসিডেন্টের সাথে কিসিঞ্জারের মতবিরোধের যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল তার ও অবসান ঘটবে। প্রেসিডেন্ট মিঃ নিক্সনের কার্যকালের আর মাত্র দু’বছর বাকি। তিনি দুই দফা প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন সময়ে পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কোন্নয়নের ব্যাপারে পদক্ষেপ সমূহ গ্রহণ করেছেন তা মোটামুটি সফল হয়েছে। একসময়ের উগ্র যুদ্ধাংদেহী নিক্সনকে মাথা নোয়াতে হয়েছে ভিয়েতনামে। অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর সরকারের ‘নীতি’ ও সাফল্যের ব্যাপারে একটা নরম মনোভাব রয়েছে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি শেষ পর্যন্ত তাই তার কার্য কালকে সংক্ষিপ্ত হয়তো করবেনা কিন্তু ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য রেখে যাবে মার্কিন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন