নিজের দায়িত্বের ব্যর্থতা কারাে ঘাড়ে চাপাইনি কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিলের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে মেজর জেনারেল (অব.) সফিউল্লাহ
গত ১৫ ও ১৬ আগস্ট ভােরের কাগজে প্রকাশিত আমার সাক্ষাৎকারটির কিছু মন্তব্য প্রসঙ্গে কর্নেল শাফায়াত জামিল কিছু বক্তব্য রেখেছেন। তাঁর বক্তব্যের সূত্র ধরেই আমি কিছু মন্তব্য করতে চাই। | কর্নেল (অব.) শাফায়াত জামিল ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সব ব্যাপারে তিনি আপত্তি বা ভিন্ন তথ্য উত্থাপন করেছেন এবং আমাকে দোষারূপ করেছেন সেগুলাে নিম্নরূপ
১, ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সকল দায়ভার সেনাপ্রধান তার (কর্নেল। জামিলের) ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছেন।
২. সামরিক গােয়েন্দা বিভাগ বিদ্রোহের আগাম পূর্বভাষ জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। তার সকল দায়-দায়িত্ব সেনাপ্রধানকেই নিতে হবে।
৩. ট্যাংক রেজিমেন্ট সেনাপ্রধানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতাে এবং গােলন্দাজ রেজিমেন্ট ঢাকা ব্রিগেডের অধীনস্থ ছিল।
৪. তৎকালীন ডিএমআই লেঃ কর্নেল সালাহউদ্দিন ১৫ আগস্ট ‘৭৫-এর ভাের | ৪-৩০ মিনিটে সেনাপ্রধানকে খবর দিয়েছিলেন। | ৫. সেনাপ্রধান সেদিন দেড় ঘণ্টা সময় অপচয় করে তারপর বিদ্রোহের কথা তাকে (কর্নেল জামিল) জানায়।
৬. সেনাপ্রধানের টেলিফোন পাওয়ার আগেই নাকি বিদ্রোহীদের নেতা মেজর রশিদ এসে তাকে জানান যে, প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব নিহত হয়েছেন।
৭. বিদ্রোহ প্রতিরােধে সেনাপ্রধান সময়ােচিত পদক্ষেপ নেননি।
৮, বিদ্রোহ মােকাবিলার জন্য ১,২ এবং ৪ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে তিনি (কর্নেল জামিল) নির্দেশ দিয়েছিলেন।
৯. কর্নেল জামিল তার দফতরের সামনে দুটি ট্যাঙ্ক দেখতে পান এবং জানতে পারেন যে মিরপুর থেকে গােলন্দাজ বাহিনী তার এলাকায় গােলাবর্ষণ করতে প্রস্তুত।
১০. চাপের মুখে অবৈধ ও অগণতান্ত্রিক সরকারের আনুগত্য স্বীকার করেছেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান।
১১. সেনাপ্রধান এখন তাকে ‘escape goat’ বানাতে চাইছেন। আগস্টের বিদ্রোহ দমনে সেদিন তিনি তাকে কোনাে নির্দেশ দেননি।
১২. ট্যাঙ্কগুলাের মধ্যে গােলা ছিল না। ১৫ আগস্টের দিন তাদের গােলা সরবরাহ করা হয়। চীফ অফ জেনারেল স্টাফ খালেদ মােশাররফ সেনাপ্রধানের নির্দেশেই ঐদিন গােলা সরবরাহ করেছিলেন।
১৩. সেনাপ্রধান সেদিন কোনাে যৌথ পরিকল্পনা নিতে পারেননি। বরং অবৈধ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
১৪. ১৯ আগস্ট সেনাসদরে সম্মেলনে কর্নেল জামিলের প্রতিবাদ।
১৫. ২৪ আগস্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে আমাকে যেতে তিনি নিষেধ করেছিলেন।
১৬. পরিশেষে লেঃ কর্নেল হামিদের বই সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য।
উপরােল্লিখিত বিষয়গুলােতে কর্নেল শাফায়াত জামিলের বক্তব্যের উপর আমার মন্তব্য হলাে ?
১। আমার নিজের দায়িত্বের ব্যর্থতা শাফায়াত জামিল বা অন্য কারও ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার হীন মনােবৃত্তি আমার কখনাে ছিল না এবং এখনাে নেই। তবে। শাফায়াত জামিল তার নাতিদীর্ঘ বক্তব্যের অনেক জায়গায় আমাকে দুর্বলচিত্ত ও কাপুরুষ প্রতীয়মান করার চেষ্টা করেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট যে জঘন্য ঘটনা ঘটেছিল সেই ঘটনার দায়িত্ব আমি কখননা এড়াতে চাইনি এবং তা কখনাে এড়াতে পারবাে না। কারণ সেদিন যারা এই জঘন্য ও নির্মম ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা। সেনাবাহিনীর সদস্য ছিল এবং আমি, তখন সেনাপ্রধান। সেদিনের ঐ ঘটনার দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়েছি বলে শাফায়াত জামিল যে বক্তব্য রেখেছেন তা সত্য নয়। কর্নেল শাফায়াত তার বক্তব্যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে আমাকে জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন।
২। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সামরিক গােয়ন্দা বিভাগ কিভাবে পরিচালিত হতাে সে সম্পর্কে কিছু মন্তব্য আমার সাক্ষাৎকারের প্রথমাংশে রয়েছে। তবুও সকলের জ্ঞাতার্থে এতটুকুই বলবাে যে, শুধু গােয়েন্দা বিভাগ নয়, পুরাে সেনাবাহিনীই তখন। পরিচালিত হচ্ছিলাে এ্যাডহক ভিত্তিতে। তৎকালীন সামরিক গােয়েন্দা বিভাগ সমগ্র পরিস্থিতি বিশেষকরে, গভীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে পুরাে তথ্য উদ্ঘাটনে যে সক্ষম ছিল , সেটা তৎকালীন সরকারের অজানা ছিল না। এই সংস্থাকে আরাে শক্তিশালী ও দক্ষ করার প্রচেষ্টা আমি গ্রহণ করেছিলাম, যার সাক্ষ্য দিতে পারেন তকালীন প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী। যেহেতু এই সংস্থা সামরিক বাহিনীর অধীনে এবং তারা সময়মতাে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে ও জানাতে পারেনি। তাই এর দায়ভার আমার নিতে কোনাে দ্বিধা নেই। সেজন্য এর ভিতরের যে দুর্বল দিকটি ছিল, আমি সেই দিকটির প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবাে। আমি আবার বলতে চাই যে, সামগ্রিকভাবে সামরিক বাহিনী বিশেষকরে, গােয়েন্দা বিভাগকে আরাে সংগঠিত করার যে প্রচেষ্টা আমি নিয়েছিলাম সেটা হলে ১৫ আগস্টের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অগ্রিম তথ্য এবং কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়তাে সম্ভব হতাে। তারপরও ডিজিএফআই বিগেঃ রউফ (যিনি সরাসরি প্রেসিডেন্টের অধীনস্ত ছিলেন) যতটুকু অবহিত হয়েছিল, সেটাও আমাকে জানাননি তিনি। এই পরিস্থিতিতে আমার অবস্থা হয়েছিল একজন মুষ্টিযােদ্ধাকে চোখ, কান বন্ধ করে বক্সিং রিং-এ ছেড়ে দেয়ার মতােই।
৩। ট্যাঙ্ক এবং গােলন্দাজ রেজিমেন্ট সম্পর্কে কর্নেল শাফায়াত জামিল যে বক্তব্য রেখেছেন সে সম্পর্কে আমি শুধু বলবাে, তখন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে একটি মাত্র ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট ছিল। এই রেজিমেন্ট প্রশিক্ষণের জন্য চীফ অফ জেনারেল স্টাফ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফের অধীনে ছিল। প্রশাসনিক দিক থেকে লজিস্টিক এরিয়ার অধীনে ছিল। আর, গােলন্দাজ রেজিমেন্টটি ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডের অধীনে ছিল। সমগ্ৰ সেনাবাহিনী সেনাপ্রধানের অধীনে ঠিকই কিন্তু এই দুটি রেজিমেন্ট ছিল সরাসরি দুই কমান্ডারের অধীনে। এ দুটি রেজিমেন্ট মাসে দুবার বৃহস্পতি/শুক্রবার নৈশকালীন প্রশিক্ষণে বাইরে যেতাে। সে অনুমতি তাদের ছিল। এবং তাদের কার্যকলাপ সেনাপ্রধানের জানার পূর্বে এই দুই কমান্ডারের জানার কথা। এদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বভার সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে আমার উপরে যতটুকু বর্তায় তার চেয়ে কম দায়ভাগ দুই কমান্ডারের ছিল না। বরং বেশিই ছিলাে; কারণ তারাই ছিলেন সরাসরি দায়িত্বে নিয়ােজিত। দুর্ভাগ্যবশতঃ ১৪/১৫ আগস্ট রাতে ছিল সেই বৃহস্পতিবার/শুক্রবার রাত। তাই এই রাতে এই দুই রেজিমেন্টের গতিবিধি সম্পর্কে কোনাে সন্দেহ দেখা দেয়নি কারাে মধ্যে। সবাই ধরে নিয়েছিল এ রাতেও তারা ট্রেনিং-এ বেরিয়েছে।
৪। লে. কর্নেল সালাউদ্দিন আহমেদ আমাকে অভ্যুত্থানের খবর ভাের সাড়ে চারটার সময় দেয় বলে কর্নেল জামিল যা বলেছেন, সেটা সঠিক নয়। কেননা তিনি আমাকে ফজরের নামাজের পর ঘুম থেকে উঠিয়ে এ খবর দিয়েছেন। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম নেতা মেজর ফারুকের এক সাক্ষাৎকার (বাংলাবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট ১৯৯২) থেকে জানা যায় যে, ট্যাঙ্কগুলাে যখন বের হয় তখন ক্যান্টমেন্টের সেন্ট্রাল মসজিদে ফজরের আজান হয়ে গেছে। যদিও ট্যাঙ্ক বাহিনীর প্রতি নির্দেশ ছিল সাড়ে চারটায় বের হওয়ার। এই বক্তব্য যদি সত্য হয় তাহলে ডিএমআই প্রধানতাে কোনােভাবেই সাড়ে চারটায় আমাকে খবর দিতে পারেন না।
৫। ডিএমআই আমাকে খবর দেয়ার পর প্রথম যার সাথে আমি কথা বলি, তিনি ছিলেন ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। সে সময়ে যদিওআমি ঘড়ি দেখিনি, তবুও বলবাে, তখন সময় ছিল খুব সম্ভবতঃ ৫টা বেজে ৩০ বা। ৪০ মিনিট। আমি তার সঙ্গে যখন কথা বলছি, তখন আমার মনে হচ্ছিলাে আমি যেন তাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছি। কর্নেল শাফায়াত জামিলের বক্তব্যে আমি দেড় ঘণ্টা সময় অপচয় করেছি বলে যে কথা বলা হয়েছে, সেটা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর এবং দুঃখজনক।
৬। কর্নেল শাফায়াতের দেয়া বক্তব্য থেকে জানা গেলাে যে, সেনাপ্রধানের টেলিফোন পাওয়ার আগেই যড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম মেজর রশীদ এসে তাকে বঙ্গবন্ধুর নিহত হওয়া এবং খন্দকার মােশতাকের ক্ষমতা গ্রহণের খবর জানায়। যদিও এর আগের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, মেজর রশীদ এসে তার ঘরে ঢুকে বলে, “We have Killed Shekh Mujib”। এখানে প্রশ্ন হলাে, কর্নেল শাফায়াত এই খবর যদি আগেই জেনে থাকেন তাহলে তা সেনাপ্রধানকে জানাননি। কেন এবং তিনি দ্রুত এর বিরুদ্ধে কোনাে রকম ব্যবস্থা নেননি কেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর পেয়েও এর বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়া কি একজন দায়িত্বশীল কমান্ডারের কর্তব্য ছিল না? এ কথা শােনার পরও কি কোনাে নির্দেশের প্রয়ােজন ছিল। (যদিও আমি সর্বপ্রথম তাকেই যােগাযােগ করি এবং প্রতিরােধের নির্দেশ দিই)। সেদিন অতি প্রত্যুষে যদি আমি কোনাে নির্দেশ না দিয়ে থাকি, তাহলে সে সময়ে আমি তাকে কেন টেলিফোন করেছিলাম?
৭। সেনাবাহিনীর প্রধান নিষ্ক্রিয় ছিলেন বা সময়ােচিত পদক্ষেপ নেননি বলে কর্নেল জামিল উল্লেখ করেছেন। আসলে সেনাপ্রধান হিসেবে আমি সেদিন সকালে কি প্রচেষ্টা নিয়েছিলাম সে সম্পর্কে ‘ভােরের কাগজ’-এ দেয়া আমার সাক্ষাৎকারে বিস্তারিত বলেছি। তবুও সংক্ষেপে আবার বলা যায় যে, আমি প্রথমে কর্নেল শাফায়াত জামিলকে বিদ্রোহ দমনের নির্দেশ দেই। তাকে নিষ্ক্রিয় দেখে সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে ৪৬ ব্রিগেডকে সক্রিয় করতে পাঠাই ও পরে নিজেও সেখানে যাই এবং গিয়ে দেখি পুরাে গ্যারিসন আনন্দে মেতে উঠেছে। দেখে আমার মধ্যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয় এবং তখন অত্যন্ত নিঃসঙ্গ মনে হয় নিজেকে।
৮। বিদ্রোহ মােকাবিলায় কর্নেল জামিল যদি ১ম, ২য় এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নির্দেশ দিয়ে থাকেন, তাহলে তারা সে নির্দেশ পালন করেনি কেন? তাহলে কি এটা বলা যায় না যে, তারই অধীনস্থ সৈন্যরা তার নির্দেশ মানেনি। শুধু তাই নয়, তারা তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল।
৯। এই তথ্য কি এটা প্রমাণ করে না যে, সে কারণে কোনাে রকম ব্যবস্থা নেয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি বা নিতে তিনি সাহস পাননি।
১০। আমার সাত নাম্বার বিষয়ে আলােচনা এবং পূর্বের সাক্ষাৎকার থেকে প্রমাণিত হয় যে, সেদিন আমাকে কোন অবস্থায় সমগ্র পরিস্থিতি মােকাবিলা করতে হয়েছিল। আজকে সেদিনের ঘটনাবলি নিয়ে বহু পর্যালােচনা বা বিতর্ক করা যায়।
কিন্তু সেদিন সকালের সকল ঘটনা, বিশেষকরে, সামরিক বাহিনীর ভেতরের যে অবস্থা ছিল, তাতে অন্য কোনাে বিকল্প আমার মাথায় আসেনি। তাছাড়া, বঙ্গবন্ধু তখন নিহত, জীবিত অন্য কেউ বা কোনাে রাজনৈতিক নেতৃত্বও প্রতিবাদ ও প্রতিরােধে এগিয়ে আসেননি সেদিন। ঢাকা গ্যারিসনের অবস্থা ছিল প্রতিকূল, তারা বিদ্রোহীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছিল। সে অবস্থায় অন্য কি বিকল্প ছিল যে কোনাে রকম প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা কি দেশকে আরাে রক্তপাত বা গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতাে না? এটা কি দেশের জন্য কোনাে মঙ্গল বয়ে আনতাে? সর্বোপরি সে সময় দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের যে কোনাে উদ্যোগ কি ফলপ্রসূ হতাে? তাহলে ৩ নভেম্বরের অভুত্থান সফল হলাে না কেন? পরে ৭ নভেম্বরের। ঘটনাবলি আমাদের জন্য কি অভিজ্ঞতা বয়ে নিয়ে এলাে?
১১। আমার সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান হিসেবে আমি সেদিনের ঘটনা ও পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগত আক্রোশবশতঃ কোনাে মন্তব্য করিনি। তাকে escape goat করার কোনাে উদ্দেশ্য আমার নেই আর কর্নেল জামিলের বিরুদ্ধেও আমার কোনাে ব্যক্তিগত আক্রোশ নেই। আমার সাক্ষাঙ্কার তার ব্যাপারে শুধু নিক্ষিতার কথা বলেছি। সেদিন তাকে যেভবে দেখেছি সেভাবেই আমি মন্তব্য করেছি। সে ব্যাপারে তিনি ভিন্নমত পােষণ করতে পারেন। সে সময় সেনাবাহিনীর ভিতরে যে অবস্থা ছিল তাতে তার পক্ষে অন্য কোনাে ভূমিকা নেয়া কি সম্ভব ছিল বলে তিনি মনে করেন।
১২। চীফ অফ জেনারেল স্টাফ খালেদ মােশাররফ সেনাপ্রধানের নির্দেশে বিদ্রোহীদের শূন্য ট্যাঙ্কে গােলা সরবরাহ করেছেন বলে কর্নেল জামিল যা বলেছেন। সেটা সত্য নয়। আসলে খালেদ মােশাররফ আমার সঙ্গে কোনাে কথা না বলেই ১৫ আগস্ট ট্যাঙ্কের জন্য গােলা সরবরাহ করেন এবং ১৭ আগস্ট আমাকে তা জানান।
১৩। সেদিন যৌথ পরিকল্পনা করিনি বলে আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ এনেছেন কর্নেল জামিল। প্রশ্ন হলাে, কাকে নিয়ে যৌথ পরিকল্পনা করবাে? কর্নেল জামিল নিক্রিয় থাকলেন (যে কোনাে কারণেই হােক) অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়) ঢাকা গ্যারিসনের মধ্যে আনন্দ-উল্লাস, সে অবস্থায় কাকে নিয়ে যৌথ পরিকল্পনা করবাে। তারপরও আমি সেদিন সকালে কর্নেল জামিলসহ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। নির্দেশ দিয়েছি, কিন্তু উদ্যোগও নিয়েছিলাম, কিন্তু কোনাে কিছুই করা যায়নি।
১৪। সেদিন সেনাসদরে বৈঠকের ব্যাপারে কর্নেল জামিল যা বলেছেন তা আংশিক সত্য। সেদিনের বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ছিল সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অফ কমান্ড’ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একটি যৌথ সিদ্ধান্তে পৌছানাে। বৈঠকে এ ব্যাপারে আলােচনা ও সিদ্ধান্তের পরই মেজর রশীদ ও ফারুককে ঐ বৈঠকে ডাকা
হয়েছিল তাদের এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়ার জন্য। তাদের বৈঠকে আসার জন্য। সিজিএস খালেদ মােশাররফের মাধ্যমে খবর দেই তাদেরকে বৈঠকে নিয়ে ঢুকি বলে কর্নেল জামিল যা বলেছেন সেটা সঠিক নয়। তাদেরকে বৈঠকের বাইরে অপেক্ষা। করে থাকতে হয়েছিল সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রাথমিক ব্রীফিং দেয়া। পর্যন্ত। তাদেরকে বৈঠকে ঢাকার উদ্দেশ্য ছিল সকলের সামনে সেনাক্যাম্পে ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে সম্মত করানাে। তাদের সামনে আলােচনা শেষে যুক্তিসঙ্গত আলােচনার মাধ্যমে যখন সেনাবাহিনীতে ‘চেইন অফ কমান্ড’ পুনঃ প্রতিষ্ঠার আলােচনার সময় কর্নেল জামিল তাদের বিরুদ্ধে ঐ কথাগুলাে বলেন, যা তিনি তার। বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন তার ফলে সেদিনের বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য নষ্ট হয়ে যায় বলে তখনই আমি উপলব্ধি করি। তারপর তারা আর ফিরে আসেনি।
১৫। এ ব্যাপারে সত্য ঘটনা হলাে যে, সেনাপ্রধানের পদ থেকে অামাকে অপসারণ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে প্রেরণের সিদ্ধান্ত আমি জানার পর সেনাভবনে ফিরে এসে এ বিষয়টি প্রথম কর্নেল জামিলকে অবহিত করি। সমগ্র পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করি। তিনি সব শুনে বললেন, এ ব্যাপারে এখন আমাদের কিছু করার নেই। তিনি আমাকে অবৈধ সরকারের অবৈধ আদেশ মানতে বাধ্য নন’ বলে যে কথার উল্লেখ করেছেন সেটা আদৌ সত্য নয়।
১৬। ১৫ আগস্ট প্রসঙ্গে লে. কর্নেল হামিদ কি লিখেছেন, সেটাতাে আমার জানার বিষয় নয়। আমার সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গেও সে কথা আসে না। সব শেষে আমি এ কথা বলতে চাই যে, ‘৭৫-এর ১৫ আগস্ট যে ঘটনা ঘটেছে, সে ব্যাপারে সেনাপ্রধান হিসেবে আমার দায়িত্ব এড়াতে পারি না। আজকে সেদিনের ঘটনা বর্ণনা বা পর্যালােচনায় অনেকেই অনেক কথা বলতে পারেন, কিন্তু তালীন। ঘটনাকে বিবেচনায় নিতে হবে। আর একটি কথা হলাে, কারাে বিরুদ্ধেই আমার কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ বা বিদ্ধেষ নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। আমি চাই যে, অন্যরাও যাতে আমার বিরুদ্ধে অসত্য বলে জনসমক্ষে আমাকে নিন্দনীয় বা হেয় না করে তােলেন। ১৫ আগস্টের ঘটনাবলি, বিশেষকরে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারের নিহত হবার মতাে নৃশংস ঘটনা যতােদিন আমি বেঁচে থাকবে তা আমাকে তাড়িত করবে। জীবনে আমি কখনাে শান্তি পাবে না। অত্যন্ত দুঃখজনক সেই ঘটনাকে আমি ভুলতে পারবাে না।
সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ