পনেরই আগস্ট কোনাে সামরিক অভ্যুত্থান হয়নি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন মহান দেশপ্রেমিক
মেজর জেনারেল কে, এম, শফিউল্লাহ
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সশস্ত্র বাহিনীর চিফ অফ আর্মি স্টাফ, পরবর্তীকালে রাষ্ট্রদূত, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল কে, এম, শফিউল্লাহ বীরউত্তম বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানক হত্যা ও অন্যান্য ঘটনাবলি সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না, তা ছিল সেনাবাহিনীর ভেতরের ও বাইরের একটি ছােট গ্রুপের একটি সন্ত্রাসী কাজ। তবে স্বীয় দায়িত্ব পালন সম্পর্কে তৎকালীন পরিস্থিতি ও অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে তিনি বেদনার সঙ্গে স্মরণ করেন যে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে ব্যারাকে আনন্দ প্রকাশ করতে দেখে তিনি হতাশ ও একাকী হয়ে পড়েছিলেন। বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার জেনারেল শফিউল্লাহর বাসভবনে ভােরের কাগজ-এর জন্য দীর্ঘ এক একান্ত সাক্ষাৎকারে ঐ সময় সামরিক বাহিনীর অবস্থা, রক্ষীবাহিনী, ১৫ আগস্টের ঘটনা, অব্যবহিত পরের পরিস্থিতি, নিজের ভূমিকা, বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার মূল্যায়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি একজন মহান দেশপ্রেমিক বলে অভিহিত করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনকে ব্যর্থ বলা যায় না।
সাক্ষাৎকার কথােপকথনের বিবরণ :
প্রশ্ন : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৮ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে। সে সময়ে আপনি আর্মি চিফ অফ স্টাফ ছিলেন। সেই ঘটনাবলির কথা মনে হলে আপনার কি প্রতিক্রিয়া হয়?
উত্তর : দেখুন, বলতে গেলে ১৫ আগস্টের ঘটনাবলির পর থেকে আমি সতেরাে বছর দেশের বাইরে ছিলাম। এই পুরাে সময়টা বিদেশের মাটিতে এই দিনটি আমাকে একভাবে নাড়া দিতাে। তখন একাই ভেবেছি। দেশে ফিরে আসার পর এই দিনটি আরেকভাবে আমাকে নাড়া দেয়। দেখি, মানুষ যেভাবে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে, অতীত নিয়ে যেভাবে ভাবে, তখন অনেক কিছু মনে পড়ে। আমি ভাবি, সেদিন যদি একটি সৈন্যদল নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম তাহলে কি হতাে? তাহলে হয়তাে বঙ্গবন্ধুকে বাঁচানাে যেতাে। এ সব ভেবে মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে একাত্তর সাল থেকেই আমি অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়েছি। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দুই বার শত্রুর মুখােমুখি হয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেছি। তখন থেকেই আমি ভাবি যা ঘটবার তা ঘটবেই। তবুও সতর্ক হওয়া উচিত। সকল রকম প্রস্তুতি নেয়া দরকার। পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, পনেরােই আগস্টে কি করা যেতাে, কিছু করা সম্ভব ছিল কি না। এ সব ভেবে মন খারাপ হয়।
প্রশ্ন : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনকে কি আপনি সামরিক অভুত্থান বলবেন?
উত্তর : পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলিকে আমি সামরিক অ্যুত্থান বলে উল্লেখ করতে চাই না। যদিও পরবর্তীতে এটি সামরিক অভ্যুত্থান বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আসলে, সামরিক অফিসারদের একটি ছােট গ্রুপ, সেনাবাহিনীর ভেতরে এবং বাইরে যাদের অবস্থান ছিল, তারাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে। সে সময়ে এমন একটা পরিস্থিতি ছিল যেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ ছিল মানুষের মধ্যে। আবার সামরিক বাহিনীর মধ্যেও তা ছিল। এ পটভূমিতে এই যে একটি ঘটনা, পরবর্তীতে মস্ত বড়াে বিপদ ডেকে নিয়ে আসে, সেটা ঘটিয়েছিল একটি ছােট গ্রুপ। এটা সামরিক অভ্যুত্থান নয়। এটা একটা সন্ত্রাসী কাজ, একটি ছােট গ্রুপের কাজ।
প্রশ্ন : সামরিক বাহিনীর ভিতর থেকে কেন এই ঘটনা হতে পারলাে?
উত্তর : তখন সরকারের কিছু কার্যকলাপে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছিল। আবার সেনাবাহিনীর মধ্যেও তা ছিল। সরকারী বিরােধী কিছু রাজনৈতিক শক্তি এই অবস্থার সুযােগের সদ্ব্যবহার করেছে। তারা কিছু অফিসার এবং জোয়ানদের বিভ্রান্ত করতে পেরেছিল। এদের অবস্থান সরকারের ভিতরেও ছিল এবং বাইরেতাে ছিলই। এই শক্তিটা সক্রিয় ছিল। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে এপটি ১৫ আগস্টের দুঃখজনক ঘটনা ঘটায়।
প্রশ্ন : এ রকম ঘটনার সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছু আঁচ করতে পেরেছিলেন?
উত্তর : সামরিক বাহিনীর মধ্যে যে একটা অসন্তুষ্টির মনােভাব ছিল সেটা। কিছুটা টের পেয়েছিলাম। এই অসন্তুষ্টির কারণে কিছু পকেটে’ (গ্যারিসন) সরকার সম্পর্কে সমালােচনা দেখা দিচ্ছিল। আর, এই ঘটনার মাস ৫/৬ আগে আমাদের হাতে একটি লিফলেট আসে, কিছু সিপাই, এনসিও পর্যায়ের লােক সরকারের কার্যকলাপে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এটি বের করেছিল। সেটাসহ একজন এনসিও’কে ধরা হয়েছিল। এটা যখন ধরা পড়ে তখন আমাদের গােয়েন্দা সংস্থা ভালোভাবে সংগঠিত ছিল না। কার্যতঃ পুরাে সামরিক বাহিনীই তখন এ্যাডহক ভিত্তিতে কাজ করছিল। আমরা পুরাে বাহিনীকে সংগঠিত করার জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিলাম। সেটা সরকারের কাছে ছিল অনুমােদনের জন্য। যেহেতু এটা বিলম্বিত হচ্ছিল সে জন্য প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করি। বিষয়টি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ ছিল সে জন্য আমি প্রতিমন্ত্রীকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে যাই। উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের পুরাে পরিকল্পনার মধ্য থেকে অন্ততপক্ষে গােয়েন্দা বিভাগকে সংগঠিত করার সম্মতি দেয়ার জন্য অনুরােধ জানানাে; কারণ, এটা ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলাম। যেটা আমার সামনে। অসে, লিফলেট নিয়ে ধরা পড়ার ঘটনা, সেটা পেয়েছিলাম একটি ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে।
আমি বঙ্গবন্ধুকে অনুরােধ করার পরও সে অনুমােদন পাইনি। তিনি তখন বলেছিলেন, কেন রউফ তােমাকে সব খবর দেয় না? ব্রিগেডিয়ার রউফ তখন ডিজিএফআই ছিলেন। আমার মনে হলাে, আমি যে খবরটা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়েছিলাম, সেটা উনি জানেন । যেহেতু এটা সামরিক বাহিনীর ভিতরের ঘটনা, সেটা ডিজিএফআই’র জানার কথা। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, কেন রউফ তােমাকে বলেনি। আমার বিশ্বাস হয়েছিল, ডিজিএফআই এই খবর বঙ্গবন্ধুকে দিয়েছিল। আমি বলি, রউফ আমাকে এ খবর দেয়নি। আমি পেয়েছি একটি ফিল্ড ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের মাধ্যমে। এই যে কিছু জানতাম, কিছু জানতাম না, নিয়ে বলা যায়, কিছু আঁচ পেয়েছিলাম। কিন্তু এটা যে এ রকম রূপ নেবে, সেটা চিন্তা করিনি। আমরা ভেবেছিলাম, যেটা হতে পারে, সেটা সিপাই এসিওদের মধ্য থেকে হতে পারে । অফিসাররাই এমন কিছু একটা করছে, সেটা ধারণার বাইরে ছিল।
প্রশ্ন : সেই সম্ভাব্য ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভেবেছিলেন কি?
উত্তর : তখন বঙ্গবন্ধুর সাথে কথাবলার পর, গ্যারিসন কমান্ডারদেরও এ সমস্যা সম্পর্কে সচেতন করা হয়। তবে এটাকে এত বড় কিছু মনে করে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। পরে ব্রিগ্রেডিয়ার রউফের সাথে এ নিয়ে আর কোনাে কথা হয়নি। হতে পারে সে ইচ্ছে করে আমাকে পুরােটা জানতে দেয়নি। এই অভিযােগ আমি বঙ্গবন্ধুর কাছেও করেছিলাম। আমি সে সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং মুখ্য সচিব রুহুল কুদুসের সাথে কথা বলেছি বার বার। তিনি আমাদের পরিকল্পনা অনুমােদন করবেন করবেন করেও করতে পারেননি। এই কাজে সে সময়ে কিছুটা সাবােটাজও হয়েছিল বলে মনে হয়।
প্রশ্ন : তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটিকে বঙ্গবন্ধু কি হালকাভাবে নিয়েছিলেন?
উত্তর : আমার মনে হয় তিনি ব্যাপারটিকে এত গুরুত্ব দেননি। আমি যখন বলি, আমি সম্পূর্ণ অন্ধকারে, তখন তিনি বলেন, তুমি খবর চাও, আমি তােমাকে খবর দেবাে। আমি কিছুটা হতাশ হই। কারণ, আমি যে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছিলাম, সেটা তিনি দেননি। অধ্যাপক নূরুল ইসলামও বলেছিলেন। আমরা তখনও ভাবিনি এ থেকে এত বড়ো ঘটনা ঘটে যেতে পারে, এত অফি।ররাও যুক্ত থাকতে পারে।
প্রশ্ন : ১৫ই আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে আপনি কখন জানতে পারলেন?
উত্তর : ১৫ই আগষ্ট ভােরে ফজরের নামাজের পরে আমি এ সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। ১৪ তারিখ সারাদিনই কিছু ঘটনা ঘটে। সেদিন চট্টগ্রামে একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের একটি হেলিকপ্টার ছিল। সেদিন ওটা কলকাতা যাচ্ছিল। সেটা যখন ফেনীর উপর তখন দুর্ঘটনা ঘটে। হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। আরােহীরা সকলে মারা যায়। এ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম সারাদিন। পরের দিন (১৫ই আগস্ট) বঙ্গবন্ধুর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা। সেদিন (১৪ আগস্ট) বিকালে ঐ মঞ্চে এবং এর আশেপাশে কিছু বিস্ফোরণ ঘটে। আরও বিস্ফোরক আছে কিনা, সেটা দেখার জন্য পুলিশের আইজি নূরুল ইসলাম আমাকে ঐ এলাকাকে বিপদমুক্ত করার অনুরােধ জানান। সে জন্য কিছু বিস্ফোরক উদ্ধার। বিশেষজ্ঞদের কয়েকটি দল পাঠাই। এ সব নিয়ে সারাদিন ব্যস্ত থাকি। এ সব কিছু শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে যায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি। সেদিন খুব সকালে সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের পরিচালক লে. কর্নেল সালাহউদ্দিন এসে আমাকে খবর দেয়, স্যার, আপনি কি আর্মড এবং আর্টিলারী রেজিমেন্টকে শহরে পাঠিয়েছেন? তারাতাে শহরে যাচ্ছে। তারা রেডিও অফিস দখল করেছে। তারা গণভবন, ধানমণ্ডির দিকে যাচ্ছে। এ কথাগুলাে শুনতে শুনতে আমার মধ্যে বিদ্যুতের মতাে প্রতিক্রিয়া হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, ঢাকার বিগ্রেড কমান্ডার জানেন? তারপর আমি তাকে বলি, যদি তারা এভাবে গিয়ে থাকে, তাহলে তুমি তাড়াতাড়ি ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের কাছে যাও, ইনফেন্টি ব্যাটালিয়নকে প্রস্তুত করে প্রতিরােধ করতে বলাে।
প্রশ্ন : এই ঘটনা জানার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে কি আপনার কোনাে যােগাযােগ হয়েছিল?
উত্তর : লে. কর্নেল সালাহউদ্দিনকে এই নির্দেশ দিয়ে, ঘরে গিয়ে লাল টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করি। দেখি, তার টেলিফোন ব্যস্ত। তখন আমার স্ত্রীকে লাল টেলিফোন ঘােরাতে বলি। আর, আমি অন্য টেলিফোনে চেষ্টা করি। এই সময়ের মধ্যে যদি বঙ্গবন্ধুও আমাকে চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তিনি আমাকে পাননি। আমি জানার পরে যদি তিনি চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে তাে পাওয়ার কথা নয়, আমার টেলিফোনতাে তখন ব্যস্ত। | কয়েকটি টেলিফোন করার পর আমি আবার টেলিফোন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে যােগাযােগ করার চেষ্টা করি। ৬টা বাজার ৩/৪ মিনিট আগে আমি টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে যাই। আমার সাথে শুধু কয়েকটি কথা হয়। তিনি বলেন, শফিউল্লাহ তােমার ফোর্স আমার বাড়ি এ্যাটাক করেছে। কামালকে বােধহয় মাইরা ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও। আমি বলি, Sir, I am doing something. Can you get out of the house? আমি এই কথা বলার পর তার গলা আমি আর শুনতে পাইনি। মনে হলাে, টেলিফোনটি টেবিলের উপর রেখে দিয়েছেন। আমি হ্যালাে, হ্যালাে করছি। সে সময়েই আমি টেলিফোনের মধ্য দিয়ে গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। তারপরই টেলিফোনটা অকেজো হয়ে যায়।
প্রশ্ন : আপনি কি কিছু করতে পেরেছিলেন? আপনার চেষ্টার ফল কি হলো?
উত্তর : সিকোয়েন্সটা হলাে এ রকম। আমি প্রথমে কথা বলি শাফায়াত জামিলের সাথে। আর মনে হলাে, আমি তাকে ঘুম থেকে উঠিয়েছি। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি জানেন যে আর্মড এবং আর্টিলারী ইউনিট শহরের দিকে গেছে? তিনি বলেন, জানেন না। তখন আমি তাকে তখন প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে ঐ গ্রুপটিকে প্রতিরােধ করার জন্য নির্দেশ দিই। এই কথা বলে আমি বিমানবাহিনীর প্রধান এ কে খন্দকার এবং নৌবাহিনীর প্রধান এম এইচ খানকে ফোন করি এবং কথা বলি। আমি বুঝলাম, তারাও কিছু জানেন না। এরপর আমি জেনারেল জিয়ার সাথে কথা বলি, আমার মনে হলাে, তিনি আমার কাছ থেকেই ঘটনা সম্পর্কে প্রথম শুনলেন। আমি তাকে বলি, আপনি দ্রুত আমার বাসায় চলে আসুন। তারপর ফোন করি খালেদ মােশাররফকে। তাকেও আমার বাসায় আসতে বলি। এরপর ডিজিএফআইর ব্রিগেডিয়ার রউফকে ফোন করি। তার বাসায় কেউ ফোন ধরেনি। তারপর কর্নেল জামিলকে (নতুন ডিজিএফআই) ফোন করি। তাকে আমি পাই, তিনি বললেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকেছেন। আমি তার বাসায় যাচ্ছি। আমি বলি, আমি বঙ্গবন্ধুকে যােগাযােগ করার চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছি না। তুমি যেহেতু বঙ্গবন্ধুর কাছে যাচ্ছে তাকে বললাে, আমি কিছু করার চেষ্টা করছি। আর যদি পারাে, তাকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যেয়ো। এ সব কিছুর পর, আমি বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পাই এবং কথা বলি। সে কথা আগেই বলেছি। তারপর আমি আবার ফোন করি কর্নেল শাফায়াত জামিলকে। কারণ তখন পর্যন্ত কিছুটা সময় ছিল। ১৫/২০ মিনিটের বেশি হয়ে গেছে, কিন্তু আমি কোনাে প্রতিক্রিয়া বা কোনাে তৎপরতার খবর পাচ্ছিলাম না। এমনটা কেন হচ্ছে, আমি বুঝতে পারছিলাম না। আমি তাকে না পেয়ে এক্সচেঞ্জকে বললাম আমাকে ধরিয়ে দিতে। এক্সচেঞ্জ থেকে বলা হয়, মনে হয় টেলিফোনটা তুলে রাখা হয়েছে। আমি ভাবলাম, হয়তাে উত্তেজনয় টেলিফোনটা তিনি ঠিক জায়গায় রাখতে পারেননি। অথবা যারা কু করেছে, তারা তাকে আটকে রেখেছে। এই সময়ের মধ্যে জেনারেল জিয়া চলে আসেন। খালেদও আসে। এই সময়ে আমার বেটম্যান রেডিও খুলে দেয়। আমি ডালিমের গলা শুনতে পাই। আমি তাদের বললাম, শাফায়াত কি করছে? আমি বুঝতে পারছি না। আমি বাসায় বসে কিছু করতে পারছি না। আমি অফিসে যাবাে। আমি যখন কাপড় বদলাতে ভিতরে যাই, তখন দেখি রউফ আমার পিছনের দেয়াল টপকে ভিতরে এসে পড়েছে। সে তখন লুঙ্গি গেঞ্জি পরা অবস্থায় ছিলাে। আমি ওকে বাসায় গিয়ে কাপড় বদলিয়ে আসতে বলি। আমি প্রস্তুত হয়ে আমার অফিসিয়াল গাড়িতে অফিসে যাই। জিয়া আমার পর পর আমার অফিসে আসে। ইতিমধ্যে খালেদও চলে আসে। আমি ওকে শাফায়াতের ব্রিগেডে যেতে বলি এবং কেন ওরা কিছু করছে না, সেটা জানতে বলি। কোনাে তৎপরতা দেখছি না কেন, ইতিমধ্যেতাে দ্রুত তৎপরতা শুরু হওয়া উচিত
প্রশ্ন : আপনি বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর কখন জানলেন?
উত্তর : এরপর আমার এডিসিকে খবর নিতে এবং আমাকে জানাতে বলি। তারপর আমি ঢাকার বাইরে অন্যান্য ব্রিগেড কমান্ডারদের সাথে টেলিফোনে কথা বলি। ইতিমধ্যে তারা রেডিও থেকে খবর জেনে গেছে। আমি তাদের বলি, যা ঘটেছে, সেটা আমার অজ্ঞাতে হয়েছে। আমি ঢাকার কমান্ডারকে প্রতিরােধের জন্য। বলেছি। পরবর্তী নির্দেশের জন্য আমি তাদের অপেক্ষা করতে বলি। এরপর খালেদ মােশাররফ আমাকে টেলিফোন করে, আমি জিজ্ঞাস করি, কি হচ্ছে। তখন সে বলে, স্যার, ওরা আপনাকে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে চায়। আমি বলি ওরা কারা? সে বলে, আমাকে সব বলতে দিচ্ছে না। আমি বলি, যা হােক তুমি আসাে। সে বলে, আমাকে পনের মিনিটের জন্য আসতে দিচ্ছে। আমি ওকে আসতে বলি। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই এডিসি এসে বলে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এই প্রথম আমি শুনি এবং আমার মধ্যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয়। এ খবর আমি বিশ্বাস করতে পারিনি এডিসি চলে যাওয়ার পর খালেদ আসে। সে বলে, বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। পুরাে গ্যারিসন মনে করে আপনার নির্দেশে কু হয়েছে। ওরা আনন্দ করছে। কেউ নড়ছে না। যখন খালেদ কথা বলছিল, তখন জেনারেল জিয়া এবং কর্নেল নাসিম আমার অফিস কক্ষে ছিল।
প্রশ্ন : আপনার কাছে যড়যন্ত্রকারীদের পক্ষ থেকে প্রথম কি প্রস্তাব এসেছিল সে দিন সকালে?
উত্তর : খালেদ মােশাররফ কথা শেষ করার পরপরই আমার অফিসের সামনে দুটি গাড়ি বেশ আওয়াজ করে থামে। বাইরে কিছু হৈ চৈ’র শব্দ শােনা যায়। তারপরই সজোরে ধাক্কা দিয়ে দরােজা খুলে ডালিম এবং তার সাথে প্রায় দশ/বারাে জন সশস্ত্র সৈনিক আমার অফিস ঘরে ঢােকে এবং আমার দিকে অস্ত্র তাক করে চিফ কোথায়, চিফ কোথায়, বলে চীকার করতে থাকে। তখন কর্নেল নাসিম উচ্চকণ্ঠে বলে ওঠে, দেখছাে না চিফ সামনেই। ডালিমের এই ঔদ্ধতাপনা দেখে আমি প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে বলি, তুমি যে অস্ত্র আমার দিকে তাক করছাে, আদৌ সেটা যদি ব্যবহার করতে চাও করাে। আর যদি কথা বলতে এসে থাকো, তাহলে অস্ত্র বাইরে রেখে আসাে। এই কথার পর ও অস্ত্র নামিয়ে নিয়ে বলে, স্যার, প্রেসিডেন্ট আপনাদের রেডিও স্টেশনে যেতে বলেছেন। | আমি বললাম, আমি জানি প্রেসিডেন্ট নিহত হয়েছেন। তখন সে বলে, স্যার, আপনার জানা উচিত, খন্দকার মােশতাক আহমদ এখন রাষ্ট্রপ্রধান। আমি বলি খন্দকার মােশতাক তােমার রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে, কিন্তু আমার নয়। এ কথার পর ডালিম বলে, স্যার আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেন না যেটা আমি চাই না। আমি বলি, তুমি যা কিছু করতে চাও, করতে পারাে। আমি তােমার সাথে কোথাও যাচ্ছি না। আমি আমার সৈন্যদের কাছে যাচ্ছি। এ কথা বলে এডিসিকে গাড়ি আনতে বলে আমি উঠে দাঁড়াই। গাড়িতে উঠে সরাসরি ৪৬ ব্রিগেডে যাই। ওখানে গিয়ে দেখি সৈন্যরা সবাই আনন্দ করছে। এমনকি সেখানে বঙ্গবন্ধুর কিছু ছবিও ভাঙ্গা হয়েছে। এ সব দেখে তখন আমার মূক বধির হবার অবস্থা। তথন কয়েকজন অফিসার আমাকে পথনির্দেশ করে পাশের একটি ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি মেজর হাফিজ এবং মেজর রশীদ। ওরা এসে। আমাকে অনুরােধ করে, স্যার আপনি রেডিও স্টেশনে যান। তখন আমি বললাম, আমিতাে একা যাবে না। অন্য দুই চিফের সাথে কথা বলবাে। তারাই আমাকে দুই বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করিয়ে দেয়। দুই প্রধান বলেন, আপেক্ষা করুন, আমরা আসছি।
প্রশ্ন : আপনার সাথে খন্দকার মােশতাকের কখন কোথায় কথা হলাে?
উত্তর : আমি যখন ওদের জন্য অপেক্ষা করছি, সে সময়ে আমি ভাবছিলাম, আমার কি করা দরকার। আমার সামনে দুটি প্রশ্ন (এক) বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে আমার কোনাে সংশয় থাকতাে না। আমি সরাসরি সংঘর্যে যেতাম। (দুই) যেহেতু বঙ্গবন্ধু বেঁচে নেই তাতে আমি সংঘর্ষে গিয়ে কি লাভ করতে পারবাে? পারি, গৃহযুদ্ধের দিকে দেশকে নিয়ে যেতে। এতে আরও রক্তপাত হবে। এটা কি লাভজনক হবে। এই কথা ভাবতে ভাবতে ওরা চলে আসে। কিছু কথা হবার পর সবাই আমরা রেডিও স্টেশনে চলে যাই। | সেখানে যাওয়ার পর আমাদেরকে খন্দকার মােশতাক যে ঘরে বসা ছিল। সেখানে নিয়ে যাওয়া হলাে। সেখানে যাওয়ার সাথে সাথে খন্দকার মােশতাক আমাকে বলেন, অভিনন্দন শফিউল্লাহ, তােমার সৈন্যরা একটি বিরাট কাজ করেছে। এখন বাকিটা করাে। আমি বললাম, আর বাকি কি আছে? তিনি বলেন, তোমারই সেটা জানার কথা। এটা বলার সাথে সাথে আমি বলি, তাহলে সেটা আমার উপরই ছেড়ে দিন। এ কথা বলে চলে আসার সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুর সুন্দর মােশতাককে বলেন, স্যার, ওনাকে থামতে বলুন। ওনাকে থাকতে হবে। রেডিওতে একটা ঘােষণা দিতে হবে এবং আমাদের গতিরােধ করা হলাে। সে সময়ে তাহের ঠাকুর একটা কাগজে ঘােষণা লিখে দিল। সেটা আমরা একে একে পড়ি। সেটাই পরে রেডিওতে ঘােষিত হয়। এ সব কিছুর পর খন্দকার মােশতাক বলেন, আমি এখনই বঙ্গভবনে যাচ্ছি। জুম্মার নামাজের আগেই সেখানে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। আমি চাই, আমার সকল প্রধানরা সেখানে উপস্থিত থাকবেন। এরপর আমরা সবাই ক্যান্টনমেন্টে চলে আসি এবং সকল অফিসারদের একত্রিত করে পুরাে ঘটনা বর্ণনা করি। সবাইকে সেনাবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য বলি। তারপর বঙ্গভবনের দিকে চলে যাই। তখন প্রায় ১১টা বেজে গেছে। বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলাে। প্রধান বিচারপতি অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন।
প্রশ্ন : শপথ গ্রহণের পর কি হলাে? আপনি কি করলেন?
উত্তর : শপথ গ্রহণের পর খন্দকার মােশতাক বললেন, আমার চিফদের দরকার। আমরা তিন জনই থেকে গেলাম আলােচনার জন্য। নামাজের পর বৈঠক শুরু হলাে। খন্দকার মােশতাক, তিন বাহিনীর প্রধান, জিয়া এবং খালেদও ছিল। আলােচনার বিষয় ছিলাে মার্শাল ল’ দেয়া হবে কি হবে না। অল্প কিছুক্ষণ বৈঠক হবার পর স্থগিত হয়ে গেলাে। বিকেল-সন্ধ্যায় আবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। সেটার পর আবার বৈঠক। তখন সবাই আর নেই। | দ্বিতীয়বারের শপথের পর কর্নেল মঞ্জুরকে বঙ্গভবনে দেখে আমি বিস্মিত হই। তখন সে দিল্লীতে কর্মরত ছিল। আমি জিজ্ঞেস করি, তুমি কিভাবে আসলে? সে বলে, আমি খবর জেনে রাস্তা দিয়ে ঢাকায় চলে এসেছি। এখনও সে প্রশ্ন, সে ঢাকায় কিভাবে এবং কেন এলাে? এক সময়ে যখন সবাই সম্মেলন কক্ষে তখন রাষ্ট্রপতির ভারপ্রাপ্ত সামরিক সচিব এসে বলেন, স্যার, আপনার একটি টেলিফোন। অন্যদিক থেকে জেনারেল ওসমানির কণ্ঠস্বর শুনলাম। তিনি বলেন, শফিউল্লাহ অভিনন্দন নাও। আমি বললাম, স্যার, আপনি কি মনে করেন এটা অভিনন্দনযােগ্য? তিনি বলেন, তুমি কি জানাে না যে তুমি দেশকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এরপর সম্মেলন কক্ষে ঢুকে দেখি, এক কোণায় খন্দকার মােশতাক আর কর্নেল মঞ্জুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে কথা বলছে। তখন আমি আরও ভাবলাম, কে তাকে আসতে বলেছে। আমি তাকে আসতে বলিনি। আমি সেনাপ্রধান। সে তখন দিল্লীতে মিলিটারী এটাসি। খন্দকার মােশতাকতাে সেদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন না? তাহলে তাদের এই ঘনিষ্ঠতার কি ছিল? বৈঠক আবার শুরু হলাে। এক পর্যায়ে কথা উঠলাে, মার্শাল ল’ দেয়া হবে কিনা? আমি বললাম, এ নিয়ে আলােচনার কি আছে? এটাতাে ঘােষিত হয়ে গেছে। এখন শুধু এটা আনুষ্ঠানিকতার প্রশ্ন। এতে খন্দকার মােশতাক বলেন, কে এর দায়িত্ব নেবে? আমি বললাম, রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, কেন রাষ্ট্রপতি? তােমার বাহিনী এটা করেছে। তােমাকে দায়িত্ব নিতে হবে। এ কথা বলার সাথে সাথে আমি বলি, আমি দায়িত্ব নিতে ভীত নই, কিন্তু ওরা যদি আমার বাহিনী হতাে তাহলে তাে আমার নাম ঘােষণা দিতাে। তারাতাে আপনার নামে ঘােষণা দিয়েছে। তখন তিনি কথা ঘুরিয়ে নেন। তিনি আমাকে বলেন, আমরা আলােচনা করছি সামরিক আইন করা হবে কিনা, তা নিয়ে। এই রকম আলােচনা আরও দুই দিন চললাে। এই তিন। দিন পুরাে সময়টা আমাকে ওরা বঙ্গভবনে ব্যস্ত রাখে। অন্য সমরিক কর্মকর্তরা বার বার বাসায় বা অফিসে ফিরে যাচ্ছিল। ওরা আসা যাওয়ার মধ্যে ছিল।
প্রশ্ন : তাহলে আপনাকে কি ওরা ভয় পাচ্ছিল?
উত্তর : হতে পারে। সে জন্যই তাে ২৪ আগস্ট তারিখে আমাকে পদচ্যুত করে। এই তিন দিন সময়কালের মধ্যে এক দিন আমাকে রক্ষী বাহিনীর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে সাভার যেতে হয়। তখন তাদের মধ্যে। উত্তেজনা ছিল। এবং একজন রক্ষী নিজেকে গুলি করে আত্মহত্যা করে। ওদেরকে সামাল দেয়ার জন্য আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। এ রকম এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে আমি যখন বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলাম এমন সময় একদিন (১৭ আগস্ট) খালেদ মােশারফ আমাকে এসে বলেন, স্যার, আপনি কি জানেন, ট্যাঙ্কগুলাে কোনাে রকম গােলা-বারুদ ছাড়াই একশনে গিয়েছিল? তখনও আমি জানতাম না যে, ওদের ট্যাঙ্ক-কামানে গােলা ছিল না। তাৎক্ষণিকভাবে আমার মধ্যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যে, তাহলেতাে ওদের নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন কিছু নয়। এ কথা ভেবে আমি খালেদকে বলি, এটা কি সত্যি? খালেদ বলে হ্যা স্যার, আমি তাে পরশু দিনই (১৫ই আগস্ট) ওদের গোলা-বারুদ দিয়েছি। আমি বললাম, তুমি এ সময় ওদের গোলা-বারুদ দিলে আমাকে জিজ্ঞেস করলে না? এরা এমন জঘন্য কাজ করেছে, এখনতাে ওরা আমার মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে উঠবে। সে বললাে, আমি ভেবেছি সব কিছু শেষ হয়ে গেছে। আমি বলি, ওরা যদি গােলা-বারুদ ছাড়া এমন কাণ্ড করতে পারে তাহলে ওরাতাে এখন আরও অনেক কিছু করতে পারে। খালেদ চলে যাওয়ার পর এক সময় মেজর রশীদ। আসে আমার কাছে। আমি প্রশ্ন করি, তােমরা কিভাবে এমন জঘন্য কাজ করতে পারলে? রশীদ বললাে, স্যার এটাতে বেশ দীর্ঘ কথা। সে বললাে, রােজার ঈদের দিন আপনার বাসায় গিয়েছিলাম। আমি সস্ত্রীক দেড় ঘণ্টা ছিলাম। সেদিন ইচ্ছে ছিল আপনাকে বলা । তখন আমি জিজ্ঞেস করি, বললে না কেন? সে উত্তর দেয়, সাহস পাইনি। আমি বলি, সাহস না। পেয়ে থাকলে, তাহলে করতে গেলে কেন? অন্যরা কি জানতাে? সে বলে, হ্যা, স্যার অনেকে জানতো। সে আরও বলে, আমাদের সাফল্য লাভ করার সম্ভাবনা ছিল মাত্র ০১% তবুও আমরা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলাম । যদি আমরা ব্যর্থ হতাম তাহলে মরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত যদি কোনাে সুযােগ পেতাম, তাহলে বলে যেতাম অনেক সিনিয়র অফিসার এর সাথে যুক্ত ছিল। তার এই কথাগুলাে শুনে আমি বিমর্ষ হয়ে পড়ি। আমি যে সময়ের কথা বলছি, তখনও আলােচনা চলছে। আমি বঙ্গভবনেই। আছি, সে রাতেই শেষ কথা হলাে, একটা খসড়া তৈরি করতে হবে। সে রাতে বিমান ও নৌবাহিনীর প্রধানসহ আমি এবং ব্রিগেডিয়ার খলিল আর ঘুমাইনি। খুব সকালে খন্দকার মােশতাক আমাদের কাছে এসে একটি খসড়া দেয়। সেটাই পরে ঘােষণা করা হয়। তারপর আমরা চা খেয়ে বঙ্গভবন থেকে চলে আসি। আমি অফিসে যাই এবং খালেদকে বলি, আমাদের বৈঠক হওয়া দরকার। রাতেই সেটা হওয়া দরকার। সে রাতের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিন বাহিনীর প্রধান, পুলিশের আইজি, জেনারেল জিয়া, পিএসও, ব্রিগেডিয়ার রউফ, খালেদ মােশাররফ, ডিএমও কর্নেল মালেক, জিএসও ওয়ান লে. কর্নেল নুরুদ্দিন আহমেদ। ওখানে যখন সম্মেলন। করছি, সে রাতে রউফ বলেন, আমরা ওখানে যত কথাই বলি, সব ফাস হয়ে যায়। সে জন্য গােপন কথা বলতে হলে আমাদের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে। সেটা করা হলাে। সভায় সবাই বললাে সেনাবাহিনীর কমান্ড ভেঙ্গে গেছে। অ্যুথানকারীদের শাস্তি হওয়া দরকার। এ রকমই সিদ্ধান্ত হলাে যে, যারা বঙ্গভবনে আছে তাদেরকে ফিরিয়ে আনতে হবে। সামরিক বাহিনীর চেইন অফ কমান্ড ফিরিয়ে আনতে একই সঙ্গে ১৯ তারিখে সকল ব্রিগেড কমান্ডারদের নিয়ে বৈঠক ডাকি। সেদিন সকালে বৈঠকের সময় ফারুক আর রশীদকেও হেড কোয়ার্টারে উপস্থিত থাকতে বলা হয়। সকালে সম্মেলনে গিয়ে আমি সকলকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাই কি পরিস্থিতিতে পুরাে দায়িত্ব নিতে হয়, তা ব্যাখ্যা করি। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কথা বলি।
প্রশ্ন : ১৯ আগস্টের পর কি হলাে?
উত্তর : দেখলাম আমাদের সব কথা জানাজানি হয়ে গেছে। যে সব গােপন সিদ্ধান্ত নিই সেগুলােও বঙ্গভবনে সকলে জানে। এ সময়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম ফারুক-রশীদ ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসে কি না। আমি খন্দকার মােশতাকের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, ওরা ভীত। সময় দাও। এভাবে ২৪ তারিখ এসে যায়। সে দিন দুপুর ১২টার রেডিওর খবরে জানানাে হয়, জেনারেল ওসমানীকে। প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা করা হয়েছে। এর পরপরই খন্দকার মােশতাক আমাকে টেলিফোন করে বলেন, তুমি খবর শুনেছাে? বললাম, এটা ভালাে খবর। তিনি । বললেন, আমি তােমাকে সাড় পাঁচটায় বঙ্গভবনে চাই। আমি বঙ্গভবনে যেতেই একজন অফিসার বললেন, জেনারেল ওসমানী আমাকে সালাম দিয়েছেন। আমি তার ঘরে গেলাম। তিনি আমাকে বসতে বলে কিছু কথা বললেন। তিনি আমার প্রশংসা করলেন। তারপর উনি বললেন, তুমি দেশের জন্য অনেক করেছ। দেশ তােমাকে চায়। এখন তােমার ভূমিকা বিদেশের মাটিতে দেখতে চাই। তােমাকে বিদেশে রাষ্ট্রদূত করে পাঠানাে হবে। এটা আমার জন্য পাতের মতাে শোনালাে। আমি বললাম, খন্দকার মােশতাকের সাথে কথা বলতে চাই। আমরা গেলাম, তিনি অনেক কথা বললেন। বললেন, এখন বিদেশে তােমার কাজ দেখতে চাই। আমি তাকে বলি, আমাকে যখন সেনাবাহিনীর প্রধান করেন বঙ্গবন্ধু, তখন বলেছিলাম বিশেষ পরিস্থিতিতে আমাকে দায়িত্ব নিতে হলাে। এখনও বলি, এবার আমি পরিস্থিতির শিকার হলাম। আগন্টই আমার চাকুরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রেষণে পাঠানাে হয়।
প্রশ্ন : ১৫ আগস্টের ঘটনা প্রতিরোধ করতে পারলেন না, এটা কি আপনার ব্যর্থতা বলে মনে করেন?
উত্তর : প্রশ্ন হলাে এ রকম অবস্থায় একজন সেনাপ্রধান কি করতে পারেন? তিনি তাে একজন একক ব্যক্তি। তিনি তার সহকর্মী, অধীনস্থ অফিসারদের দিয়ে কাজ পরিচালনা করেন। সে সময়ে যার সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেয়া প্রয়ােজন ছিল, তিনি ছিলেন ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার। তাকে নিষ্ক্রিয় দেখে, চিফ অফ জেনারেল স্টাফকে পাঠালাম। তিনিও উৎসাহজনক রিপাের্ট দিলেন না। তখন আমি নিজে যাই এবং ৪৬নং ব্রিগেড়ে গিয়ে যখন দেখি, আমি একা, তখন আমার কি করণীয় থাকে? আমার মনে হয়, আমার যদি কোন ব্যর্থতা থেকে থাকে, সেটা হলাে আমার নিজের আত্মহুতি প্রদান। এটাই যদি আমার কর্তব্য হয়ে থাকে তাহলে সেখানে আমি আমার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। সেটা করে কোনাে যদি লাভ হতাে, তাহলে সেটা আমার ব্যর্থতা।
প্রশ্ন : কেন এই অভুত্থান সফল হলো?
উত্তর : এ জন্য একটু পটভূমি ব্যাখ্যা করা দরকার। সেনাবাহিনীর সদস্যবৃন্দ এ রকম মনােভাব ছিল যে, তারা কিছুটা অবহেলিত। যদিও ব্যাপারটা পুরােপুরি সত্য ছিল না। তবে কতগুলাে কার্যকলাপ; যেমন, রক্ষীবাহিনীর আবির্ভাবটা অসন্তোষের একটা বড়াে কারণ ছিল। বিরােধী পক্ষ এর পুরাে সুযােগ নেয়। তারা এটা প্রচার করে অনেকের মধ্যে এটা প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় যে, শেষ পর্যন্ত রক্ষীবাহিনী সেনাবাহিনীর জায়গা নিয়ে নেবে। আর, এ জন্য কিছু ঘটনা কাজ করেছে। সেটা হলাে, সেনাবাহিনীর প্রায় সব কিছুই ছিল পুরনাে বা পূর্ব ব্যবহৃত। এটা নয় যে, এগুলাে তাদের দেয়া হয়। এগুলাে তাদেরই ছিল। দেশে যা ছিল, সেটা দিয়ে সেনাবাহিনীকে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু রক্ষীবাহিনী যখন তৈরি করা হয় তখন তাদের জন্যতাে কিছু ছিল না। তাদের অস্ত্র, পােশাক, যানবাহন বা অন্য কোনাে কিছুই ছিল না। সে জন্য সবকিছুই নতুন করতে হয় । তাই ওদের সবকিছু নতুন ছিল। পােশাক, অন্ত্র, যানবাহন, থাকার জায়গা সবই নতুন ছিল। এ সব কিছুই নতুন ছিল। পােশাক, অস্ত্র, যানবাহন, থাকার জায়গা সবই নতুন ছিল। এ সব কিছুই সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে কিছুটা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। রক্ষীবাহিনীকে যখন দেখতাে, অন্যরা মনে করতাে আমরা অবহেলিত। এর উপর আরেকটি বড়ো ব্যাপার ছিল। রক্ষীবাহিনীকে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়, যা দিয়ে তারা। যে কাউকে গ্রেফতার করতে পারতাে। যার প্রেক্ষিতে কিছু কিছু দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল দুই বাহিনীর মধ্যে।
প্রশ্ন : তাহলে তাে দেখা যায়, এটাই আবার সত্য বলে প্রমাণিত হলাে সেনাবাহিনী কখনােই বিকল্প কোন বাহিনীকে মেনে নিতে পারে না?
উত্তর : এটা ঠিক, তারা ভাবে যে, দেশের প্রতিরক্ষা বিষয়টিতে তাদের উপর ন্যস্ত। যদি তাই হয় তাহলে বিকল্পের কি প্রয়ােজন।
প্রশ্ন : কেন রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল?
উত্তর : এটা করা হয়েছিল মূলত পুলিশকে সাহায্য করার জন্য। পুলিশ তখন কার্যকর ছিল না। তাদের পক্ষে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার মতাে অবস্থা ছিল না। এ অবস্থায় হয়তাে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়। পরে এমন প্রচার হচ্ছিল যে, রক্ষীবাহিনীর সংখ্যা প্রায় এক লক্ষের কাছে চলে গেছে। পরেতাে ১৫ আগস্টের পর দেখা গেল তাদের সংখ্যা ছির ১০/১২ হাজারের মতাে। বলা হতাে, ওদের কামান দেয়া হয়েছে। পরে প্রমাণ হলাে, সেটা ছিল না। এগুলােও সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজ করেছে।
প্রশ্ন : বৃক্ষীবাহিনী কি প্রতিরােধের কথা ভেবেছিল?
উত্তর : এটা আমি বলতে পারবাে না। তবে মনে হয় সমগ্র পরিস্থিতি তাদেরও অপ্রস্তুত করে ফেলে। তাছাড়া ট্যাঙ্কের উপস্থিতি তাদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি। করতে পেরেছিল। তবে তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব ছিল কিনা সে সম্পর্কে রক্ষীবাহিনীর তৎকালীন সমর নায়করা বলতে পারবেন।
প্রশ্ন : অ্যুত্থান সম্পর্কে অনেকে বলে, এটা হয়েছিল ব্যক্তি আক্রোশের। কারণে?
উত্তর : না, তবে কিছু সংখ্যক সামরিক অফিসার চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন, সেগুলােতে কিছুটা অন্যায় হয়েছিল। তা নিয়ে কিছু বিক্ষোভ ছিল। এটা হলাে একটি গ্রুপের ব্যাপার। অন্যরা যেমন, রশীদ, ফারুক, তারাতাে সেনাবাহিনীতেই ছিল। তারা এতে নেতৃত্ব দিয়েছিল বিশেষ রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তারা অন্যদের ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। তখন সরকারের মধ্যেও একটা অংশও বােধহয় ওদের ইন্ধন যােগায়। আর, সরকারের বাইরের কিছু শক্তি এর সাথে যােগসাজশে ছিল।
প্রশ্ন : এই ঘটনার পিছনে কোন বিদেশীদের হাত ছিল বলে মনে করেন?
উত্তর : এ ব্যাপারে আমার কাছে কোনাে প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। তবে তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপে বাইরের কোনাে কোনাে শক্তির হাত ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি। এমন হতে পারে, বঙ্গবন্ধুর সরকারের পতনের পর যারা অত্যন্ত দ্রুততার সাথে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, স্বাগত জানায়; তা দিয়ে তা তাদের পরােক্ষ সমর্থন ছিল বলে মনে করার কারণ রয়েছে।
প্রশ্ন : সেনাবাহিনীর ভিতরে তখন সামগ্রিক দেশের অবস্থার প্রতিফলন ছিল।
উত্তর : দেশের তৎকালীন অবস্থায়, যেমন বাকশাল’ গঠন ইত্যাদি নিয়েও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিক্রিয়া ছিল। আমার মধ্যে কিছু প্রশ্ন ছিল। সেগুলাে নিয়ে। আমি কথা বলেছিলাম। এ ব্যাপারে আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে প্রশ্ন করি, স্যার, সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছেন। হঠাৎ করে এক পার্টিতে কেন যাচ্ছেন তিনি। বললেন, শফিউল্লাহ তুমি বুঝবে না, যে ব্যক্তি সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, সে কি তা ভুলতে পারে? দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আন, আবার গণতন্ত্রে ফিরে। আসবাে। আমার উপর বিশ্বাস রাখাে। তখন বঙ্গবন্ধুর উপরে রাজনীতি নিয়ে কথা বলার ক্ষমতা অন্তত আমার ছিল না। আমিও মেনে নিয়েছিলাম তার ঐ বক্তব্য। যদিও আমরা যারা গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছিলাম, এ থেকে সরে যাওয়া মেনে নিতে পারছিলাম না। তবে বঙ্গবন্ধুর ব্যাখা সে অবস্থায় মেনে নিয়েছিলাম। মনে হয় এ সব কিছুর পরও যদি রক্ষীবাহিনী সামনে না আসতাে তাহলে হয়তাে সেনাবাহিনী সেগুলাে মেনে নিত।
প্রশ্ন : সেনাবাহিনীর ব্যাপারে কি বঙ্গবন্ধুর মধ্যেই কোনাে সন্দেহ বা অনাস্থা ছিল বলে মনে করেন?
উত্তর : না, সেটা মনে করি না। হলেতাে আনােয়ার সাদাতের কাছ থেকে ট্যাঙ্ক, মার্শাল টিটোর কাছ থেকে এক ডিভিশনের অস্ত্র আনাতাে না। সে সময়ের প্রেক্ষিতে বলা যায়, সে সময়ে কিছু অসুবিধা ছিল। কোনাে অবকাঠামাে ছিল না। শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না। যানবাহন বলতে কিছু ছিল না। বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। বৈদেশিক প্রকল্প চুড়ান্ত করা যাচ্ছিল না তাদের পুরানাে ঋণ মেনে না নেয়া পর্যন্ত। এ সব সমস্যা নিয়ে তারা কাজ শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনীর উন্নয়ন। চাচ্ছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না। কেননা তখন অগ্রাধিকার তাে অন্যত্র ছিল। অমািদের পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করা যাচ্ছিল না। সে জন্যও অর্থের প্রয়োজন ছিল।
প্রশ্ন : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আপনি কি ভাবেন—আপনার মূল্যায়ন কি?
উত্তর : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন সত্যিকার অর্থে একজন মহান দেশপ্রেমিক। ছাত্র জীবন থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয়া পর্যন্ত বাঙালী জাতি এবং বাংলাদেশের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলে এসেছেন। সে জন্য তাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তার নিজের কর্মজীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, মিথ্যার কাছে কখন তিনি মাথা নত করেননি। দেশের স্বার্থকেই সব সময়ে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছেন। নিজের কি হবে না হবে, সেটা কখনাে ভাবেননি। সে জন্য একজন প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে যে নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়ার কথা ছিল সেটাও তিনি কখনাে নেননি। | পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বঙ্গবন্ধু মূলত বিরােধী দলীয় রাজনীতি করেন। এ জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার যে অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন ছিল তা হয়তাে পুরােটা অর্জন। করার সময় পাননি। তার অর্থ এই নয় যে, তিনি তা জানতেন না বা তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তার সাড়ে তিন বছরের রাষ্ট্র পরিচালনায় তিনি সফল, এটাই বলবাে। ব্যর্থ বলবাে না। সামগ্রিক পরিস্থিতির পটভূমিসহ বলা যায় যে অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বিষয়ে সফল হয়েছিলেন। এমনকি বর্তমান সেনাবাহিনীর কাঠামোও তার শাসনামলে তৈরী। ভিত্তিতে সেখান থেকেই। বলতে হবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে গড়ে তুলতে তিনি যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন। আমি বঙ্গবন্ধুর কথা সব সময়েই স্মরণ করি। যতদিন পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধু হিসেবে স্বীকৃতি না পাবেন ততদিন আমি মানসিকভাবে স্বস্তি পাবাে না। তারই আহ্বানে আমি এবং আমার সহকর্মীরা জীবনের সকল ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম। ব্যক্তিগতভাবেও আমি তাঁর স্নেহভাজন ছিলাম। এখনও বহু স্মৃতি ভীড় জমায় মনে। তার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ