বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৯শে জুলাই, শুক্রবার, ২রা শ্রাবণ, ১৩৮১
চুয়াত্তরের আমদানি নীতি
আমদানি নীতি নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। অনেক বিবৃতিও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যে। এসব লেখা ও বিবৃতি বা সংবাদ এর মূল বক্তব্য ছিল আমদানি নীতি ঘোষণায় সংশ্লিষ্ট দপ্তর অহেতুক বিলম্ব করছেন। অবশেষে ’৭৪ সালের আমদানি নীতি দু-একদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে বলে গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, এই আমদানি নীতির মেয়াদ তিন মাস হবে না ছয় মাস (৩০শে ডিসেম্বর পর্যন্ত) হবে তা এখনো নির্ণীত হয়নি।
জানা গেছে যে, আমদানি নীতিতে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি এবং অপরিহার্য জিনিসপত্র আমদানির ওপর প্রাধান্য দেয়া হবে। শিল্পের জন্য রাসায়নিক দ্রব্যাদি, কাঁচামাল, খুচরা যন্ত্রাংশ, জীবন যাত্রার জন্য অপরিহার্য দ্রব্যাদি বাংলাদেশের পাওয়া যায় না বা উৎপাদিত হয় না তা আমদানি করা হবে। তবে আমদানি নীতিতে বিলাস দ্রব্যাদি (যা না হলেও জীবন যাত্রার কোন বিঘ্ন হয় না) এরূপ দ্রব্যাদি আমদানি পরিহারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমদানি নীতিটি বর্তমানে অনুমোদনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, প্রত্যেক বাণিজ্য মৌসুমের প্রথম দিকে জুলাই মাসের শেষ দিকে আমদানি নীতি ঘোষণা প্রথাসিদ্ধ নিয়ম রয়েছে। চলতি বছরের আমদানি নীতি ঘোষণায় বিলম্ব হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্য মধ্যে কিছু কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
যাইহোক, প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে বলা যায় যে দু-একদিনের মধ্যেই আমদানি নীতি ঘোষণা করা হচ্ছে এটা ধরে নেয়া যেতে পারে।
নয়া আমদানি নীতিতে অত্যাবশ্যকীয় দ্রব্যাদির প্রতি যে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তা অত্যন্ত সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত বলে আমাদের ধারণা। এ ধরনের সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেওয়া উচিত ছিল। কেননা আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের যে বর্তমান চেহারা তাদের ঘাঁটতি হয়েছে চারশো পঞ্চান্ন কোটি টাকা। এই হিসাব ’৭৩-৭৪ সালের। চলতি বছরে অর্থাৎ ৭৪-৭৫ সালে ঘাটতির পরিমান অনুমোদন করা হচ্ছে ৪শ’ ৩৮ কোটি টাকা।
চলতি সপ্তাহে পরিকল্পনা কমিশন প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশে গত বছর ৩২৫ কোটি টাকার পণ্য রফতানি করেছে। ৭৩-৭৪ সালের রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ১৫ কোটি টাকা কম। গত বছর বাংলাদেশে ১শ’ কোটি টাকার কাঁচাপাট, ১৬০ কোটি টাকার পাটজাত দ্রব্য, ৪০ কোটি টাকার বিভিন্ন দ্রব্য রপ্তানি করেছে। এছাড়া অদৃশ্য উপায়ে অর্জিত হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। সে তুলনায় ৭৩-৭৪ সালে আমদানি হয়েছে ৭৮০ কোটি টাকার পণ্যদ্রব্য লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৭০ কোটি টাকার বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে। খাদ্য দ্রব্য আমদানি হয়েছে ২৪০ কোটি টাকার। পণ্য আমদানি হয়েছে ৪৯৪ কোটি টাকার। ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ৪৯৪ কোটি টাকা। অদৃশ্য খাতে ব্যয় হয়েছে ১৪ কোটি টাকা। গত বছরের ৪৫৫ কোটি টাকার ঘাটতি পূরণ হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রায়। এরমধ্যে ৩০৭ কোটি টাকা এসেছে বৈদেশিক সাহায্য থেকে। বাকি ১৪৮ কোটি টাকা এসেছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ খাতে। বিবরণে ৭৩-৭৪ সালের রপ্তানি আমদানি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশকে কঠোরভাবে সংগ্রাম করতে হয়েছে। এ বছরেও উক্ত সুবিধা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা খুব কম। যদিও চলতি বছরের রপ্তানির পরিমাণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ১৯৬৯-৭০ সালের বিদেশি শিল্পসমূহ উৎপাদন, সেই বছরের মাথাপিছু ভোগ্য পণ্য সরবরাহ অক্ষুন্ন ও বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন লক্ষ্য সামনে রয়েছে বলে আমদানি খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে।
পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট থেকে এ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে যে, এ বছরে ‘আমদানি খাতে ব্যয়ের পরিমাণ’ বেড়ে যাবে। আর যদি বেশি হয় তাহলে তার পরিমাণ কি হয় তা সকলেরই জানা আছে। তাছাড়া বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার অবস্থা বিশেষ সুবিধাজনক নয়। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ মাত্র ৫২ কোটি ২৯ লক্ষ টাকা। এবং বর্তমানে বিনিময়যোগ্য বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ মজুদ রয়েছে তা ১৯৭৩ সালের পহেলা জুলাই মজুতের চাইতে ৫৪ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা কম। সুতরাং চলতি বছরের আমদানি নীতি প্রণয়নের যথেষ্ট সর্তকতা অবলম্বন করতে হচ্ছে বা হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। অবস্থার চাপেই তা করতে হবে। তবে এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, আমদানি নীতি প্রকাশে বিলম্ব হলে নানান বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারের যে অবস্থা তাতে পণ্যের দাম কোন অবস্থাতেই স্থিতিশীল থাকছে না। কাজেই আগেভাগে পণ্য ক্রয় সম্পর্কিত চুক্তি সম্পাদিত হলে যে সুবিধাটুকু পাওয়া যায় পরে তা আর পাওয়া যায় না। পরিশেষে এটাও উল্লেখ করতে হয় যে, আমদানি নীতি প্রণয়নের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে যে, কোন পণ্য কোন সময় পাওয়া যায় এবং সে অনুযায়ী পণ্যের তালিকা প্রণয়ন করা উচিত। অন্যথায় সবকিছুই যায় ওলট-পালট হয়ে। তাতে আমদানিকৃত পণ্যের দামও বৃদ্ধি পায়। এবং এই অবস্থার শিকার বাংলাদেশ ইতিপূর্বে হয়েছে। সার্বিক অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রেখেই সংশ্লিষ্ট দপ্তর আমদানি তালিকা প্রণয়ন করবেন এটাই আমরা আশা করি।
ঢাকা কর্পোরেশন
নাম বদলেছে ঢাকার। এখন থেকে ঢাকা আর শুধু ঢাকা নয়, পরিচিত হবে ঢাকা কর্পোরেশন নামে। মেয়র হবে, ডেপুটি মেয়র হবে আরও নির্বাচিত হবেন কমিশনাররা। নাগরিকদের ভালো-মন্দ দেখাশোনার দায়িত্ব পড়বে তাদের উপর। এতদিন দায়িত্ব ছিল মিউনিসিপ্যালিটির উপর। আর দশটি শহরের মত পৌরসভা দেখাশোনা করত ঢাকা নগরবাসীও।
স্বাধীনতা-পূর্ব কালে সংস্থা পরিচালিত হতো আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায়। জনগণের দাবি ছিল গণপ্রতিনিধিদের কাছে এই ক্ষমতা অর্পিত করা হোক। স্বাধীনতার পর তা বাস্তবায়িত হবে বলে জনসাধারণ আশা করেছিল। সে আশা তাদের পুরণ হতে চলেছে। ইতিমধ্যে পৌরসভাগুলোর নির্বাচন শেষ হয়েছে। নির্বাচিত হয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। এবার ঢাকার পালা। এদিক থেকে জনগণের একটা বিজয় অর্জিত হয়েছে। এখন মূল সমস্যাগুলো সমাধানের প্রশ্ন। শুধু নামে যে কিছু এসে যায় না তার প্রমাণ অনেক কিছুতেই মিলবে। কাজের কি পরিবর্তন হবে, মান্ধাতার আমলের ঢিমে তালে অগ্রসর হবার নীতি কতটুকু পরিবর্তন ঘটবে, বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে ঢাকা কর্পোরেশনের কাজের সমন্বয় কতটুকু বিধান করা সম্ভব হবে তার উপর নির্ভর করবে নতুন পদক্ষেপের সার্থকতা। ঢাকা মিউনিসিপালিটি থাকাকালীন অবস্থায় এর বিরুদ্ধে অভিযোগ খুব কম ছিলনা। ছিলনা বিভিন্ন কাজে পৌরসভার একটা সীমা নির্ধারিত। কর্তাব্যক্তিরাও গা করতেন না সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে বসে কোন সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণে। তাই দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ এমনকি কোনো কোনো মাসের পর মাস চলছে একের পর এক বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি। সংস্কারের অভাবে রাজধানীর পথে ঘাটে কি অবস্থায় রয়েছে তার ঢাকাবাসী কাউকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে হয় না। অভিযোগ থাকায় সাধারণ একটা খবরের মত গ্রহণ করতেই পৌর কর্মকর্তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
স্বাস্থ্যের দিকটাই ধরা যাক। মিউনিসিপ্যালিটির রয়েছে দাতব্য চিকিৎসালয়, রয়েছে বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক গ্রহণে জনগণকে সাহায্য করার জন্য কর্মচারী। নামকাওয়াস্তে সে দায়িত্ব পালনের জন্য তারা কখনও কখনও এক এদিক ওদিকে একটু ঢু মেরে আসেন। আর বাকি সময়টা চলে অন্য কাজে ব্যস্ততা। পথের পাশে অথবা খাবার দোকান গুলোতে এদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা অথবা ক্ষতিকর খাবার পরিবেশনের ব্যাপারে অনুসন্ধান পরিচালনার দায়িত্ব তারা শুধু অনেক উপর থেকে আদিষ্ট হলেই অথবা সূর্য তৎপরতা প্রদর্শনের জন্য বছরে একবার পালন করেন। এমনই হাজার অভিযোগ কাগজে ছাপা হয়েছে, ঢাকাবাসীরা মর্মে মর্মে সে সকল অভিযোগের যথার্থতা উপলব্ধি করেছে। কিন্তু ফলোদয় হয়নি।
কর্পোরেশন হিসেবে পরিচিত হবার পরের কর্মক্ষেত্র যেমনি বৃদ্ধি পাবে তেমনি বৃদ্ধি পাবে কর্মকর্তাদের দায়িত্বও। সে দায়িত্ব পালনের নতুন যারা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে আসবেন তাদের কর্ম ক্ষমতা এবং আন্তরিকতার উপর নির্ভর করবে নূতন নামে ঢাকা কর্পোরেশন কোন নূতন সাজে সজ্জিত হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক