বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২০শে জুলাই, শনিবার, ৩রা শ্রাবণ, ১৩৮১
প্রকৃত অবস্থাটা জানানো হোক
লাভ-লোকসান, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ মিলে রাষ্ট্রায়ত্ত মিল কারখানার অবস্থা জনসাধারণের সামনে একটা ধুম্রজালের সৃষ্টি করেছে। সাধারণ মানুষ প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে সঠিক তথ্য লাভে ব্যর্থ হচ্ছে আর এই অস্পষ্টতার সুযোগ গ্রহণ করে স্বার্থবাদী চক্র তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য ঢালাও অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই অপপ্রচার জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং এই অবস্থা যদি অব্যাহত থাকে তবে জানিনা রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প-কারখানার ভবিষ্যৎ কি হবে।
আমরা বহুবার বহু সময় সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছি। বলেছি প্রকৃত অবস্থা জনসাধারণকে জানানো হোক। কিন্তু এদিকে করবার অবসর কারো আছে বলে মনে হয়নি। গত পরশু সংসদে কথা উঠেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত জুটমিল গুলোর লাভ-লোকসানের প্রশ্নে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মোট ৭৭টি জুটমিলে লোকসান হয়েছে ২৫ কোটি ৮৪ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ওই মিলগুলোতে ’৭৩-৭৪ সালের লাভ-লোকসানের খতিয়ান মন্ত্রীমহোদয় না দিলেও আদমজী জুট মিলের লাভ-লোকসান সংবাদে তিনি যা বলেছেন তা হল ১৯৭২-৭৩ সালে ওই মিলে লোকসান হয়েছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা অথচ ১৯৭৩-৭৪ সালে তারা লোকসান দিয়েছে মাত্র ৫২ লাখ টাকা।
আদমজী মিলের হিসাব থেকে বোঝা যায় সেই মিল পূর্ব বৎসরের লোকসান অনেকটা কমিয়ে এনেছে। আমাদের মনে রাখা দরকার এটা শুধু জাতীয়করণের পরই মিলসমূহের চিত্র নয়–এই চিত্র স্বাধীনতা-উত্তর কালের চিত্র, যখন বিদেশ থেকে স্পেয়ার পার্টস আমদানি, অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় দেশ প্রায় অসমর্থ।
এছাড়া রয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, যন্ত্রাংশের অভাবে মেশিন বন্ধ থাকার দরুন বিনা উৎপাদনে মজুরি প্রদান প্রভৃতি কারণ। এসব বাস্তব অসুবিধার জন্য ’৭২-৭৩ সালে উৎপাদন যত বাধাগ্রস্ত হয়েছে ’৭৩-৭৪ সালে সে বাঁধা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে।
যারা সাদা চোখে অবস্থা উপলব্ধি করেন তারা নিশ্চয়ই আমাদের সাথে একমত হবেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে যেখানে যতটুকু উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে সেখানে সে উৎপাদনের জন্য মূলতঃ দায়ী কাঁচামালের স্বল্পতা, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ আমদানিতে সরকারের ব্যর্থতা এবং আমলাতান্ত্রিক কারচুপি। সত্যি কথা যে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পে শ্রমিকদের সঠিক দায়িত্ব পালনের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়নি তেমনি তাদের সংগঠিত এবং শিক্ষিত করে তোলা হয়নি আশানুরূপভাবে। তবুও গত ৩০ মাসে শ্রমিক সমাজ যে দেশপ্রেমীকতা এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত খুব বেশি একটা খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।
অথচ একটা স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলক ভাবে প্রচার করে চলেছে শ্রমিকদের কাজে অনীহা এবং সরকারের জাতীয়করণ নীতির ফলে দেশীয় শিল্পের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। এতে সরকারের একাংশের যে মত নেই তা বিশ্বাস করবার কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
আমরা তাই সরকারের কাছে এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করছি। আসলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসমূহের কি অবস্থা, যে সকল কারখানায় লোকসান হচ্ছে অথবা উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে সে সকল শিল্পের লোকসান অথবা উৎপাদন হ্রাসের কারণ কি তা সুস্পষ্টভাবে জানানো হোক।
শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য
পরীক্ষা না দিয়েই যে কোনো রকমে পাশ করার প্রবণতায় সম্প্রতি এক শ্রেণীর শিক্ষার্থী যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনও প্রকাশিত তথ্যে বলা হয়েছে যে, ঢাকা বোর্ডের কিছুসংখ্যক এইচ,এস,সি পরীক্ষার্থী গত বুধবার ১৬ই জুলাই অফিসে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে যে কোন প্রকারে পাস করিয়ে দেওয়ার দাবি জানায়। তারা জনৈক পদস্থ কর্মকর্তা কে অস্ত্র হুমকিও দেয়।
প্রতিবেদন সূত্রে আরও বলা হয় ঢাকা বোর্ডের এইচ,এস,সি পরীক্ষার সমস্ত কেন্দ্রের খাতা বোর্ড অফিসে গত ত্রিশে এপ্রিলের মধ্যে এসে পৌঁছেছিল। এবং খাতা সংগ্রহ করার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রতিদিনের পরীক্ষার খাতা প্রতিদিন রেল পার্সেলযোগে আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। অথচ ডাকযোগে মফস্বলের কোন একটি কলেজ কেন্দ্রের একটি প্যাকেট মে মাসের প্রথম সপ্তাহে বোর্ড অফিসে এসে পৌঁছে। প্যাকেট খুলে দেখা যায় -৭২ জন পরীক্ষার্থীর নাম ও রোল নাম্বার সহ ভিন্ন ভিন্ন খাতা আছে। একই সঙ্গে সব বিষয়ের খাতা দেখে স্বভাবতই কর্তৃপক্ষ সন্ধিহান হন এবং মনোহরদি কলেজ অধ্যক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন যে উল্লেখিত পরীক্ষার্থীগণ কোন কলেজ থেকে পরীক্ষাই দেয়নি।
এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট মহলে বেশ সাড়া পড়ে যায় এবং তদন্ত চলে। বোর্ড কর্তৃপক্ষ ৭২ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন জেনেই উল্লেখিত পরীক্ষার্থীদের একটি দল গত বুধবার বোর্ড অফিসের চড়াও হয় প্রতিবেদন সূত্রের তথ্যে প্রকাশ।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ফরম জমা দেওয়া, রোল নাম্বার বসানো, কলেজ কেন্দ্রের ইনভিজিলেটরের স্বাক্ষর প্রভৃতি আনুষ্ঠানিকতা মুলক ক্রিয়াকর্ম ঐ সকল ভুয়ো পরীক্ষার্থীরা অত্যন্ত নিপুণভাবে সমাধা করে। এই ব্যাপারে বোর্ড অফিসের কিছু কর্মচারীর যোগসাজশ আছে বলে প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে উক্ত তথ্যের মাধ্যমে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্যমূলক তৎপরতারই একটা নিদর্শন আমরা পাই। এবং এই নৈরাজ্য শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করারও যথেষ্ট অবকাশ আছে। কারণ এমন কতগুলো কাজ আছে যা নকল করতে গেলে শুধু ছাত্রের বুদ্ধি ও সামর্থে কুলোবার কথা নয়। তবু যখন দেখা যায় শিক্ষার্থীরা সেগুলো সংগ্রহ করছে এবং নিখুঁত ভাবে সব কাজ সারতে পারছে তখন সংশ্লিষ্ট মহলের কিছু কর্মচারীদের প্রতি সন্দেহ জাগায় স্বাভাবিক এবং যুক্তিযুক্ত।
এক প্রতিবেদনে কয়েকজন বি, এ, পরীক্ষার্থীর পরীক্ষায় পাস সংক্রান্তঃ দুর্নীতির কথা প্রকাশিত হয়েছিল। ওই শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিল, টেবুলেশন শীটের নম্বর কেটে তার উপর দিয়ে পাশ নম্বর লেখা ইত্যাদি কাজ অতি নিপুণভাবে করে সাফল্যের সঙ্গে পাস সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করে ফেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা লকার ভেঙ্গে প্রশ্নপত্র চুরি করে–এমন খবরও পাওয়া যায়। এসব দুর্নীতি নিঃসন্দেহে শিক্ষাঙ্গনকে কলুষিত করে তুলছে এবং একটা নতুন দেশ ও জাতির ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক ক্ষতি ডেকে আনবে।
এই প্রসঙ্গেই বলতে হয় শিক্ষার্থীদের অন্যতর দুর্নীতি প্রবনতার কথা। পরীক্ষার রুটিন বদলানো, দিন বদলানো এবং পাঠ্যসূচি কমিয়ে দেয়ার জন্য সর্বশ্রেনীর শিক্ষার্থী অহরহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা দপ্তরের কর্মকর্তাদের প্রতি অন্যায় ভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। তারপরে পরীক্ষার হলে নকলের হার এত বেড়েছে যে, ভালো ছাত্র বেছে বের করা প্রায় অসম্ভব।
এতে একদিকে শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে এবং ভাল ছাত্রদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। হয়তো দেখা গেল বিশেষ উদ্যোগে একটি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীরা নকল প্রতিরোধ করে পরীক্ষা দিয়ে অন্যান্য খারাপ ছাত্রদের তুলনায় পরীক্ষায় খারাপ করলো। তখন স্বভাবতঃই ভাল ছাত্ররা আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়বে। দুর্নীতিবাজ ছাত্ররা কিছু না জেনেই সার্টিফিকেট এর বদৌলতে ভালো চাকরি সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। আর অন্যদিকে ভাল ছাত্ররা তাদের কর্ম, নিষ্ঠা ও পাঠ্যানুশীলনের মূল্য না পেয়ে ক্রমশঃ হতাশা এবং পরে হতাশাজনিত বিক্রিয়ার শিকার হবে। জাতি ও দেশের জন্য তা ধ্বংসাত্মক।
অতএব শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্যকে যেকোনো মূল্যে আজ রুখে দাঁড়াতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি যে, সংশ্লিষ্ট মহলের কিছু কর্মচারীর প্রত্যক্ষ যোগসাজশ ছাড়া পরীক্ষার খাতা বা নম্বর অথবা ট্যাবুলেশন শীট নিয়ে কারচুপি হতে পারে না। হয়তো কিছু অর্থের লোভে এসমস্ত কর্মী কিছু ব্যক্তি নিযুক্ত হন। যথাসময়ে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করলে সেসব তথ্যও ফাঁস হতে বাধ্য।
শিক্ষাঙ্গনের পবিত্র পরিবেশ, ছাত্রদের পাঠ প্রবণতা ও দেশের জন্য ভালো ছাত্র উৎপাদন করার কাজে যারা সুপরিকল্পিতভাবে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে, নিজের স্বার্থের জন্য শিক্ষার মানকে পর্যুদস্ত করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার বন্দোবস্ত করা হোক। কারণ শিক্ষাঙ্গনের নৈরাজ্য একটা জাতির মেরুদন্ডকে দুর্বল করে ফেলে। এতবড় অভিশাপের নিশ্চিত হুমকিকে আমরা বরদাশ্ত করতে পারিনা।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক