বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১লা জুলাই, সোমবার, ১৬ই আষাঢ়, ১৩৮১
আলোচনা ব্যর্থ হ’ল কেন?
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো শতাধিক পারিষদ নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর তিন দিন ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের নেতাদের সাথে আলোচনা করলেন এবং চলে গেলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন জানালেন, আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। তবে আরও আলাপ আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে। দুই দেশের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি নেতার সফর শেষে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশ করা হয়, তাতে জানা যায়, জনাব ভুট্টো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। তিনি সে আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। জনাব ভুট্টো সাংবাদিকদের ডেকে বলেন, একবারে সব সমস্যার সমাধান খোঁজার আশায় মরীচিকা বৈ কিছুই নয়। অর্থাৎ আরো আলোচনা দরকার। বিলক্ষণ! কিন্তু সেই আলোচনা কেন (?) কিসের জন্য (?) তা কেউ স্পষ্ট করে বলেননি। হয়তো বলার সময়ও আসেনি।
গত মাসের ২৭ তারিখে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে স্বাগতম জানিয়ে আমরা বলেছিলাম, “ঢাকা আলোচনায় অনেক বিষয়ের মধ্যে যে বিষয় গুলো আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে দায়দেনা ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। এছাড়া রয়েছে একটি বড় মানবিক প্রশ্ন। লাখ লাখ অবাঙালি পাকিস্তানি নাগরিক। তারা আজ সত্যিই বড় নিঃস্বহায়। গরিব বাংলাদেশ, জনবহুল বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দিয়েছিল। জীবিকা দিয়েছিলো। দিয়েছিলো শান্তির নীড় গড়ে তোলার সকল সুযোগ। তারা তা গ্রহণ করেনি। তারা নিজেদেরকে পাকিস্তানি বলে ভাবতে শিখে ছিল। গর্ব নিয়ে, ভরসা নিয়ে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব দাবি করেছিল। আজ পাকিস্তান তাদের গ্রহণ করবেন কি, করবেন না, সে সম্পর্কে চূড়ান্ত মীমাংসার দিন এসে গিয়েছে। মুজিব-ভুট্টো আলোচনায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে। এই মানবিক সমস্যার মীমাংসা জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কতটা উদার সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারবেন পর্যবেক্ষক মাত্রই সেদিকে লক্ষ্য রাখছেন।
সমস্যা হিসেবে এগুলো তেমন জটিল নয়। জটিলতর সমস্যাগুলো মীমাংসা ইতিপূর্বে করা গেছে। এগুলো উপমহাদেশের নতুন বাস্তবতার অবশিষ্ট সমস্যা। এবং ঢাকায় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠক এগুলির সমাধানের জন্য ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারবে বলে আমরা আশা রাখি। এবং এই আলোচনার সাফল্য নির্ভর করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী কয়েকটি সাধারণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাহসিকতার উপর, সদিচ্ছার ওপর।” জনাব ভুট্টো সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে আলোচনার অগ্রগতি রুদ্ধ হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরের পর উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান–এদের মধ্যে দুটি ক্রমাগত পাকিস্তানকে আনুকূল্য বিলিয়ে এসেছে। ১৯৭২ সালে মিসেস গান্ধী সিমলা সম্মেলনে জনাব ভুট্টোকে রাজকীয় সম্মানে ডেকে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন সেটি ছিল একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। ইতিপূর্বে বিজিত কোন জাতির নেতার প্রতি কোন বিজয়ী জাতি এ ধরনের সমতাপূর্ণ আচরণ করেনি। মিসেস গান্ধী ওই বৈঠকেই পাকিস্তানের হৃত ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। পরবর্তী দিল্লি চুক্তিতে সকল যুদ্ধবন্দীকে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ এই সিদ্ধান্তে সম্মতি দান করেন। ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকেও ছেড়ে দেওয়া হয়। একতরফাভাবে এতগুলো আনুকূল্য প্রদর্শনের পর সকলে আশা করেছিল, জনাব ভুট্টো সাহেব বাংলাদেশে এসে পাকিস্তানের অবাঙালি নাগরিকদের ফিরিয়ে নেবেন। দেনা পরিশোধ করবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করবেন। এবং যোগাযোগ স্থাপিত হবে। উপমহাদেশের দেশগুলির সৎপ্রতিবেশীর মতোই বসবাস করতে শিখবে। ঢাকার কোন কোন পত্রিকা এতটা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে বলেছিল যে, তারা রণক্ষেত্রের উপরে শান্তির তৃণমূল দেখতে পাবেন। জনাব ভুট্টো ঢাকায় এসে জানিয়েছিলেন, তিনি খোলা মন নিয়ে আলোচনা করবেন। কিন্তু হিসেবের খাতা যখন সামনে তুলে ধরা হল তখন তিনি ওগুলো খুলে দেখতে পর্যন্ত সম্মত হননি। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংকে তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকারের গচ্ছিত ধন আই এম এফ-এর টাকা, পিআইএ, ন্যাশনাল শিপিং কর্পোরেশন সহ তদানীন্তন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থাগুলির শতকরা ৫৬ ভাগ বাংলাদেশের সম্পত্তি। ভারত বিভাগের সময় কেন্দ্রীয় সম্পদ জনসংখ্যার ভিত্তিতে ভাগ করে পাকিস্তান-ভারত বিলিবন্টন করে নিয়েছিল। এটাই আন্তর্জাতিক নীতি। এটাই প্রচলিত রেওয়াজ। পাকিস্তান সে দিকে এগোলেন না।
বিহারীদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে তাদের আমরা গ্রহণ করেছি। কিন্তু দুই লাখের মতো অবাঙালি যারা নিজেদের পাকিস্তানের নাগরিক বলে দাবি করছেন এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রস এর মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা পাকিস্তানে ফিরে যেতে চান, তাদেরকে জনাব ভুট্টো গ্রহণ করতে চাচ্ছেন না। বাংলাদেশই বা তাদেরকে রাখবে কি করে? এমন দেশ কি পৃথিবীতে রয়েছে যে দেশ দুই লাখের মতো অনিচ্ছুক বিদেশি নাগরিককে চিরকালের জন্য বা দেশের বুকে রেখে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে পারে! অথচ বাংলাদেশের মতো একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত, গরিব ও অনগ্রসর দেশের উপর নিজের দেশের এতগুলো নাগরিককে চিরস্থায়ীভাবে চাপিয়ে দিয়ে জনাব ভুট্টো সাহেব সুখে থাকতে চান। এই সমস্যার পেছনে যে মানবিক দিক রয়েছে, অনাথ, দুঃস্থ নর নারীর প্রতি সাধারণ মনুষ্যত্বের যে কর্তব্য, সে কর্তব্য পালনেও তিনি বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালে না। এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, সমস্যার মীমাংসা না সমস্যা জিইয়ে রেখেই জনাব ভুট্টো বাজিমাত করতে চান। কিন্তু তা কি কখনো সম্ভব! কেবল বন্ধুত্বের খাতিরে একটি দেশ কি তার কোটি কোটি টাকার পাওনা ছেড়ে দিতে পারে, পারে অসংখ্য বিদেশি নাগরিককে বুকে বেঁধে রাখতে? পারেনা বলেই বাংলাদেশের আজ আর কিছু করণীয় নেই। বল জনাব ভুট্টোর কোর্টে! সেই বল তিনি যতদিন ফিরিয়ে না দিচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি, শান্তির তৃণক্ষেত নির্মাণ ইত্যাদি কথাগুলো অবাস্তব প্রগলভ ছাড়া অন্য কোনো অর্থ বহন করবে না। যেমন করেনি ঢাকা বৈঠককালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাকচাতুর্যের আদিখ্যেতা বুলিগুলি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক