বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৫ই জুলাই, শুক্রবার, ২০শে আষাঢ়, ১৩৮১
এই আছে এই নেই
গত শুক্রবার রাজধানীতে সারাদিন ধরে বিদ্যুতের লুকোচুরি খেলা চলছিল। এই দিনে শহরের কয়েকটি এলাকায় ২০/২১ বার বিদ্যুৎ চলে যায়। ফকিরাপুল, আরামবাগ, কমলাপুর, শাহজাহানপুর, শান্তিনগর এলাকায় দিনের মধ্যে কতবার যে বিদ্যুৎ চলে গেছে তার কোন হিসেব নেই। তেমনি মতিঝিল, নবাবপুর, নাজিরাবাজার, বংশাল, চকবাজার, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বকশিবাজার প্রভৃতি এলাকায় দেড় ঘন্টার মত কোন বিদ্যুৎ ছিল না বলে সংবাদে প্রকাশ।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান যে, রমনা মেইন অফিসের সাব-স্টেশনে যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য অসুবিধা হয়েছে। তবে গোলযোগের সূত্র কি তা দেখাশোনার জন্য লোকজন রাতদিন কাজকর্ম করছে বলে তারা জানিয়েছেন।
রাজধানীতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কোন নতুন ঘটনা নয়। এ হল নিত্যদিনকার ঘটনা। সামান্য বৃষ্টি, একটু ঝড়ো হাওয়া অথবা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংবাদ প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিদ্যুৎ হাওয়া হয়ে যায়। বিদ্যুৎ বিভ্রাট যে শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ তা নয়। দেশের সর্বত্রই এ ব্যারামের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সৃষ্টি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা। জাতীয় সংসদে পাটকলগুলোতে লোকসান সম্পর্কিত যে তথ্য উদঞাটিত হয়েছে তার কারণগুলোর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাটও একটি। গত বছর খুলনার প্রায় ১১টি পাটকল বিদ্যুৎ বিভ্রাটের জন্য বন্ধ থাকে।
বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে লেখালেখিও হয়েছে প্রচুর। কিন্তু প্রতিবিধান খুব একটা হয়নি। আমরা আগেও বহুবার এ সম্পর্কে কতকগুলো সুস্পষ্ট সুপারিশ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সম্মুখে পেশ করেছিলাম।
এটা বাস্তব সত্য যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে সারা দেশব্যাপী বিদ্যুৎ বিভ্রাটের একটা সুষ্ঠু ও কার্যকরী সমাধান করতে পারবেন না। তা সম্ভবও নয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের সর্বমোট চাহিদা ছিল ২১৮ মেগাওয়াট। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয়ের পর অর্থাৎ ১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বরে তা নেমে আসে ৩০ মেগাওয়াটে।
বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনায় ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এই পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ উপ সেক্টরে ২০১ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ টাকা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র প্রাথমিক পরিবহন, মাধ্যমিক পরিবহন ও বিতরণ লাইন, সাব স্টেশন নির্মাণ এবং আনুষঙ্গিক বিতরণ সুবিধা সৃষ্টি, কংক্রিট, পোল নির্মাণ, কারখানা, যুদ্ধবিধ্বস্ত পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ, পল্লী বৈদ্যুতিকীকরণ, কারিগর ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ প্রভৃতির জন্য ব্যয় করা হবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বড় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের কাজও চলছে। এগুলো হচ্ছে ঘোড়াশাল ১১০ মেগাওয়াট স্কিম, চট্টগ্রামে ৬০ মেগা ওয়াট স্কীম, কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ সম্প্রসারণ এবং সৈয়দপুর ১০৫ মেগাওয়াট ডিজেল স্কিম।
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য চেষ্টা চলছে। সুতরাং এ প্রসঙ্গে বলার কিছু নেই। যা আজকের দিনের সবচেয়ে বড় সমস্যা তা হলো লাল ফিতার দৌরাত্ম্য, বিদ্যুৎ বিভাগের অধিকাংশ কর্মচারীদের ঔদাসীন্য, কর্তব্যকর্মে অবহেলা এবং অবাধে যন্ত্রাংশ চুরি। পত্র পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যাবে ডিজিটাল ফার্নেস তেলের অভাবে অমুক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ ইত্যাদি জাতীয় খবর। তাছাড়া কোন এলাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে কবে বা কখন ফিরে আসবে তা বলার মত লোকও অনেক সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।
এটা সকলে জানেন যে, চাহিদার তুলনায় আমাদের বিদ্যুৎ ঘাটতি রয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে আমরা চাহিদামাফিক বিদ্যুতের যোগান দিতে সক্ষম হয়েছি। বিদ্যুতের ঘাটতির কথা মেনে নিয়েই অনায়াসে বলা যায় যে, এ ঘাটতি মোকাবেলায় পথ তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব। অতি প্রয়োজনীয় সব পত্রিকা, হাসপাতাল, বেতার-টেলিভিশন ইত্যাদি বাদ দিয়ে অন্য এলাকায় দিনের বা রাতের অথবা সপ্তাহের বিশেষ বিশেষ দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রেখে ও সমস্যার মোকাবিলা করা যেতে পারে। এতে অত্যধিক চাপের হাত থেকেও যন্ত্রপাতিগুলো রেহাই পাবে। তাছাড়া যে এলাকায় বিদ্যুৎ থাকবে না সেখানকার অধিবাসীরা আগেভাগে প্রস্তুতিও নিতে পারবেন। অর্থাৎ সোজা কথায় এজন্য চাই সুষ্ঠু ও কার্যকরী পরিকল্পনা প্রণয়ন। আর যাতে চুরি-চামারি বন্ধ হয়, গাফিলতি ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্য কমে সেদিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
আমদানি নীতি ঘোষণায় বিলম্ব
জুলাই থেকে ডিসেম্বর–এ ছ’মাস আমরা বিদেশ থেকে কি আমদানি করব? কোন কোন জিনিসের প্রয়োজন, কোন জিনিস কত পরিমান আনা হবে–এ সম্পর্কে আজ পর্যন্ত কোন নীতি ঘোষণা করা হয়নি। কেউ জানেনা এ ছ’মাস আমাদের কিভাবে চলবে। কল কারখানার কাঁচামাল, ঔষধ কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী, নির্মাণ কাজের জন্য সিমেন্ট, জ্বালানি তেল কি করে আসবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় একেবারে চুপ। অথচ জুলাই-এর পহেলা তারিখেই আমদানির সম্পর্কিত সুস্পষ্ট একটা নীতি ঘোষণা করার কথা ছিল।
আমাদের এই ঘাটতির দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে যেখানে আমরা স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে পারিনি সেখানে আমদানির গুরুত্ব কত বেশি তা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। চাল-গম থেকে শুরু করে সাধারণ ব্যবহারের জিনিসপত্র ও আমাদের বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। কলকারখানার প্রয়োজনীয় কাঁচামালের জন্য তাকিয়ে থাকতে হয় বন্দরে জাহাজ ভিড়ার দিকে।
এমন কিছু বেশি আমদানি আমরা করতে পারি না যাতে করে ছ’মাসী একটা শিপমেন্ট পিরিয়ড পেরিয়ে যাবার পর কিছু দিন সে মালে চালিয়ে নিতে পারি। বরং অবস্থাটা তার উল্টোই। একটা শিপমেন্ট পিরিয়ড এর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির মত সামর্থ্য আমাদের অধিকাংশ সময় থাকেনা। রপ্তানি থেকে যা আয় হয়, আমদানির জন্য সেই আয় যথেষ্ট বলে বিবেচিত হতে পারে না। তাই বাড়তি খরচের জন্য আমাদের নির্ভর করতে হয় বৈদেশিক ঋণ, সাহায্য অথবা ডেফার্ড পেমেন্টের উপর। এরপরও লক্ষমাত্রা অর্জিত হয় না। ’৭৩ সালের শেষ আমদানি মৌসুমে খাদ্যসহ পণ্য আমদানির কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল সাতশো কোটি টাকার। সে কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়নি। এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন আমদানি মৌসুমে যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। ফলে ঘাটতি প্রচুর থেকে গেছে। এই ঘাটির সুযোগ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা।
নয়া আমদানি নীতি ঘোষণা যত বিলম্বিত হবে ব্যবসায়ীদের কারসাজি ততো বাড়বে। হাতে যা কিছু আছে তা তারা মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির অপচেষ্টা চালাবে। ফলে দুর্ভোগ বাড়বে সাধারণ মানুষের। কল কারখানার কাঁচামাল অনেক আগেই টান পড়েছে, উৎপাদনে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই পড়বে।
পত্রিকান্তরে খবরে প্রকাশ, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপারে বাংলাদেশ এখন এক নিদারুণ সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। রপ্তানির মাধ্যমে যে টাকাটা আসবে বলে মনে করা হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই স্বল্প। ঋণ যোগাড় করা হয়েছে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে মাত্র ২৮ কোটি টাকা। অপরদিকে বিদেশি বিক্রেতারা ডেফার্ড পেমেন্টে মাল বিক্রি করতে খুব একটা রাজি হচ্ছে না। এসবেরই প্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নাকি ‘আপদকালীন’ একটি আমদানি নীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছেন।
অবস্থা যাই হোক, আর অর্থের জোগান যতই থাকুক না কেন সেই সীমিত সম্পদের মধ্যেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির একটা সুষ্ঠু কর্মসূচি প্রণয়ন করা হোক। এ কাজে যত বিলম্ব ঘটবে সংকট তত বাড়বে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক