You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.10.03 | ৩রা অক্টোবর ১৯৭৫ সনে খন্দকার মােশতাকের ভাষণ - বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক

৩রা অক্টোবর ১৯৭৫ সনে খন্দকার মােশতাকের ভাষণ

আসসালামু আলায়কুম,

প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বােনেরা, গত ১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পর আমাদের জাতীয় জীবনে সম্ভাবনাময় যে নতুন দিগন্ত দেখা দিয়েছে, আর সে সম্ভাবনা সম্পর্কে দেশবাসীর মধ্যে যে সচেতনতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা সত্যই প্রশংসার ও আশাপ্রদ। ১৫ই আগস্ট রাতে পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমি আপনাদের খেদমতে আমার বক্তব্য রেখেছিলাম। সেদিন এবং আজকের মধ্যে সময়ের ব্যবধান মাত্র পঞ্চাশটি দিনের। গণমন ও গণমানসিকতার পরিমণ্ডলে ইতিমধ্যে যে পরিবর্তন এসেছে, তা অত্যন্ত স্বাভাবিক। এই পরিবর্তনের নিরিখে আমরা একে অন্যকে আরও নিবিড় ও একান্তভাবে বােঝা ও জানার সুযােগ পেয়েছি। এই পঞ্চাশটি দিনের মধ্যে সরকারকে প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক পর্যায়ে অত্যন্ত জরুরী ভিত্তিতে কতকগুলাে সিদ্ধান্ত নিতে ও কার্যকর করতে হয়েছে। প্রতিরক্ষা, পুলিশ ও সাধারণ প্রশাসনসহ সর্ব পর্যায়ে চাহিদা মেটানাের জন্য প্রশাসন ব্যবস্থাকে সাজাতে হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশবাসীকে দেশের সত্যিকারের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিব করার জন্য শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়েছে। আর্থিক জগতের প্রতিকূল শক্তিসমূহকে অনুকূল ও কল্যাণমুখী করবার জন্য একটি অর্থনৈতিক টাস্ক ফোর্স কর্মরত আছে। তাদের সুপারিশনুযায়ী কৃষি, শিল্প, পাট ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রসমূহে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং দেশবাসী আপামর জনগণ সেগুলাের কিছু কিছু সুফল পেতে শুরু করেছেন বলেই আমাদের ধারণা।

প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের জন্য সরকার জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।  ১৫ই আগস্ট ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পর চীন, সৌদি আরব আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। এই স্বীকৃতি দানের জন্য আমরা আনন্দিত। উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্দেশ্যে এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে পাকিস্তানের সঙ্গেও আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন আশু প্রয়ােজন। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ সকল দেশের সঙ্গে আমাদের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক আরােও দৃঢ় ও উন্নত করাই হবে আমাদের প্রয়াস। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারও প্রতি বিদ্বেষ নয়’ এই মৌল কাঠামাের মধ্যে আমরা জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি সক্রিয়ভাবে অনুসরণ করব। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা ভূমণ্ডলীর সমরনীতিতে আমাদের কোন ভূমিকা পালনের অবকাশ নেই। সমস্যা সঙ্কুল আমাদের দেশ। ক্ষুধা, ব্যাধি, দারিদ্র্য, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্যই আমরা আমাদের সর্বশক্তি একনিষ্ঠভাবে ব্যয় করব। এই সব সমস্যার সমাধানে আমরা বিশ্বের সব বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহানুভূতি চাই। বাঙ্গালী জাতি ঐতিহ্যগতভাবে এবং প্রাকৃতিক কারণে কতগুলাে সনাতন ও চিরন্তন মূল্যবােধে বিশ্বাসী বলে আমার বিশ্বাস। এই মূল্যবােধের সহজাত শক্তির নিজস্ব গতি ও প্রকৃতির বাহনে বাঙ্গালী জাতি ও জাতীয়তাবাদীদের উন্মেষ। ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের বিভিন্ন স্তরে এই শক্তি ভিন্ন ভিন্নরূপে নিজেকে প্রকাশ করেছে। রাষ্ট্রীয় জীবন বা রাজনৈতিক স্তরে বাঙ্গালী নাগরিকত্ব গণতান্ত্রিক আচার-আচরণ, বিধি-ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিক অনুশীলনে অভ্যস্ত। ১৯৪৭ সালে যে স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিসমাপ্তি হয়েছিল, সে সংগ্রাম ছিল গণতান্ত্রিক সংগ্রাম এবং বিজয় ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের বিজয়।

১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বাঙ্গালীরা দাবী আদায়ের যত সংগ্রাম করেছেন, তার সব সংগ্রামই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাবলীর মাধ্যমে বৃহত্তর জনগণের আশা-আকাক্ষার বাস্তবায়ন এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। বাংলাদেশের মানুষ সামাজিকভাবে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা ও বিবর্তনের ধারক ও বাহক। বর্তমান শতাব্দীর চতুর্থ দশক থেকে ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত বাঙালীদের সামনে যতগুলাে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তার সবকটিরই জওয়াব তারা সঠিকভাবে দিয়েছেন। কিন্তু ঘটনাচক্রে জনগণ কোন দিনই তাদের সঠিক সিদ্ধান্তের স্বাভাবিক ও স্থায়ী ফলশ্রুতির অধিকারী হতে পারেননি। অবশ্য, অন্যদিকে ঘটনাপ্রবাহ যতই প্রতিকূল হােক না কেন, জাতি হিসেবে বাঙ্গালীরা সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে ও করণীয় কর্তব্য সম্পাদনে কোন দিনই পিছপা হননি। ১৯৭১ সালে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাঙ্গালীরা অভূতপূর্ব ও অকল্পনীয় এক অভিন্ন সিদ্ধান্ত দিয়ে গােটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। পরবর্তীকালে অতীতের মত এবারও ব্যালটের সিদ্ধান্ত বানচাল হতে দেখে গােটা জাতি রুখে দাঁড়ায় এবং শূন্য হাতে বুক পেতে দিয়ে বুলেটের মােকাবিলা করে। ব্যালটের মর্যাদা রক্ষার জন্য বুলেটের মােকাবিলা করবার মত সংগ্রামী চেতনাবােধের নজির পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসে বিরল। বাঙ্গালীরা এই বিরল ইতিহাসের মহানায়ক। কিন্তু এক শ্রেণীর অনুপস্থিত যােদ্ধা এবং কিছু কিছু অসাধু ও তথাকথিত যযাদ্ধাদের যৌথ আঁতাতের বেদীতে জাতীয় আশা-আকাক্ষার বলির অপেক্ষায় এ যাবৎকাল অসহায় হয়ে থাকতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই জাতি একটা গণতান্ত্রিক ও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত সংবিধান আদায় করে নিয়েছিল। এই সংবিধানের অধীনে দেশবাসী গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক এবং গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা আচরণ ও সংরক্ষণকারী একটা জাতীয় পার্লামেন্ট নির্বাচিত করেন। জনগণের আমানতের খেয়ানত করে, নেতৃত্ব জনগণের ম্যান্ডেটের চরমতম অবমাননা ও অপব্যবহার করেছেন।

তাঁদের প্রয়ােজনের চাহিদায় গােটা জাতিকে ন্যক্কারজনকভাবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করে তারা ইতিহাসের প্যারডি রচনা করতে উদ্যোগী হলেন। আর, এই উদ্যোগের অশুভ শক্তির রােলারের নিচে জাতীয় ধ্যান-ধারণা ও সত্ত্বা নিস্পষ্ট হল। গােটা জাতির পেছনে দুর্লংঘ্য একটা প্রাচীর ছাড়া কিছুই আর থাকল না। যেহেতু অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে জাতীয় সত্ত্বাকে বা জাতির আত্মাকে মরণপণ করে সামনে এগুতে হল এবং ১৫ই আগস্টের নতুন সূর্যকে ছিনিয়ে আনতে হল। সমগ্র জাতীয় অস্তিত্ব মুক্তিদাতার রূপ পরিগ্রহ করল সেনাবাহিনীর অসম সাহসী সূর্য সন্তানদের মধ্য দিয়ে। নতুন সূর্য রথের সারথি হয়ে আমাকে আসতে হয়েছে। আমাদের সামনে ছিল নিমজ্জমান নয় নিমজ্জিত একটা তরীকে উদ্ধার করা এবং তাকে নিরাপদে অভীষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব। দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ সততার সঙ্গে আমরা সচেতন আছি এবং আমাদের যােগ্যতার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কেও আমরা সতর্ক। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। গণমানুষের সার্বভৌমত্বের আমরা দাবীদার ও দিশারী। কিন্তু সার্বভৌমত্বের অধিগ্রহণ ও তার অনুশীলন সঠিক ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে না করলে পদে পদে সার্বভৌমত্ব বিঘ্নিত ও হৃত হয়। স্তর পরম্পরায় সমাজকে এই সত্যের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সত্যাশ্রয়ী হয়ে এ ধরনের ঘটনাপ্রবাহের পুনরাবৃত্তি সর্বশক্তি দিয়ে রােধ করতে হবে। সত্য স্বীকারের মধ্যে কোন অগৌরব নেই। সম্মানজনক ব্যতিক্রম ব্যতিরেকে সমাজের সক্রিয় স্তরের অনেকেই নিজেদের ভূমিকা সঠিকভাবে আমরা পালন করতে পারিনি। অন্য কথায় অনেকেই আমরা দুশমনদের পাতা জালে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ফলে পরে আমাদের প্রমাণ করতে হয়েছে যে, আমরা মরিনি। দুর্ভাগ্যের কথা এই যে, এই মৃত্যুর মধ্য দিয়েও আমরা ক্ষমাহীন অত্মপ্রসাদ লাভ করবার চেষ্টা করেছি।

এই আত্মপ্রসাদজনিত আত্মপ্রবঞ্চণার প্রায়শ্চিত্ত অবশ্যই আমাদের করতে হবে। আমি ও আমার সরকার এবং গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের অধীনে নির্বাচিত সংসদ নির্ভেজাল পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা আরও বিশ্বাস করি যে, দেশবাসী গণতন্ত্র চান এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবােধের মাধ্যমে বেআইনী অস্ত্রধারী, দুর্নীতিবাজ ও অগণতান্ত্রিক শক্তির মােকাবিলা করতে তারা সমর্থ। আমরা মনে করি ধৈর্য নিষ্ঠা ও পরমত সহিষ্ণুতা বিশ্বজনীন মূল্য ও মর্যাদাবােধের আলােকে রাষ্ট্ৰীয় চারটি মৌলনীতির ভিত্তিতে সুখী, সমৃদ্ধ, কলুষমুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা সম্ভব। তাই, আজ লায়লাতুল কদরের পরম পবিত্র রাত্রে করুণাময় আল্লাহ তায়ালার অপার অনুগ্রহ ও দেশবাসীর শুভেচ্ছার উপর নির্ভর করে তাদের হৃত গণতান্ত্রিক অধিকার আমি ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি। এই সিদ্ধান্ত মােতাবেক ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা ও কাজকর্মের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী প্রাপ্ত বয়স্কদের বিশ্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সার্বভৌম পার্লামেন্ট গঠন ও পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার কায়েমের জন্য দেশব্যাপী জাতীয় নির্বাচন ইনশা আল্লাহ অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন সংক্রান্ত বিধি-বিধান প্রণয়ন এবং আনুসঙ্গিক ব্যবস্থাদি সম্পন্ন করবার ব্যাপারে আজ থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হওয়ার সময় অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট ১৯৭৬ সাল এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিন পর্যন্ত প্রয়ােজনের তুলনায় সময় কম। এতদসত্ত্বেও আমরা এই জাতীয় কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। দেশে গণতান্ত্রিক পারিপার্শ্বিকতা সৃষ্টির জন্য এখন থেকে শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে আটক বন্দীদের আমরা বিনা শর্তে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

দেশবাসী জেনে খুশী হবেন যে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতবাদের কারণে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে হুলিয়া বা গ্রেফতারী পরােয়ানা জারি নেই। সুনির্দিষ্ট অভিযােগের ভিত্তিতে গ্রেফতারকৃত রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগসমূহের সত্যাসত্য যাচাই করবার জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের বাছাই কমিটি গঠন করা হয়েছে। আনীত অভিযােগ অসত্য বা ভিত্তিহীন বলে প্রতিপন্ন হলে সংশ্লিষ্ট আটক ব্যক্তিদের সসম্মানে মুক্তি দেওয়া হবে। গণতান্ত্রিক মূল্যবােধে বিশ্বাসী বিধায় আমরা বিচার বিভাগকে তার নিজস্ব সম্মানজনক আসনে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। এই কারণে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বা মালিকানা হরণ করায় আমরা বিশ্বাস করি না। কিন্তু উত্তরাধিকার সূত্রে তিনটি দৈনিক সংবাদপত্রের দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তেছে। আমরা মনে করি, সরকারী মালিকানায় সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকা সম্ভব নয়। এই সংবাদপত্র তিনটিকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমরা সক্রিয় কর্মপন্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে সমস্যার সমাধানের নামে আরও অব্যবস্থা চালু করবার পক্ষপাতী আমরা নই। দেশবাসীর হৃত অধিকারসমূহ পুনরুদ্ধার প্রসঙ্গে আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, অধিকার আমাদের ছিল এবং অধিকার আমরা হারিয়ে ছিলাম। সে সব ক্রিয়াকাণ্ডের স্রোতধারা আমাদের অধিকারের পরিমণ্ডল থেকে ভাসিয়ে নিয়ে বঞ্চনার মহাসাগরে নিক্ষেপ করেছিল, সেই সব ক্রিয়াকাণ্ডের নায়কেরা এবং তাদের অনুসারীরা সমাজে আজও বিরাজমান। তারা সুযােগের অপেক্ষায় আছে এবং তারা ক্লীবের পূজারী। অস্ত্র এবং গণতন্ত্র এক সঙ্গে যায় না। সুযােগ দেওয়া সত্ত্বেও যারা বেআইনী অস্ত্র সমর্পণ না করে ধারণ করে আছে, তারা নিঃসন্দেহে গণতান্ত্রিক নয়। যারা বেআইনী অস্ত্রধারী তাদের হাতেই গণজীবনের শান্তি বিপন্ন। তাদের কারণেই।

মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে না এবং তাদের দ্বারাই মা-বােনদের ইজ্জত বিনষ্ট হয়। বেআইনী অস্ত্রধারীরাই স্বার্থবাদী বাংলাদেশ বিরােধী শক্তির ক্রীড়নক হয় এবং রাজনীতির নামে দেশ ও দশের স্বার্থের বিরুদ্ধে বিকারগ্রস্তের মত অশুভ তৎপরতা চালায়। এরাই পা পছন্দ না হওয়ার কারণে কাপড় পরে না এবং বিড়ি ধরানাের জন্য। ঘর জ্বালায়। গণতন্ত্র ফিরিয়ে দিলেই গণতন্ত্র আসে না। গণতন্ত্র আসার পথের সব কাটা তুলে ফেলে দেওয়ার দায়িত্ব জনগণ ও সরকারের কিন্তু গণতন্ত্র কায়েম রাখতে হবে গণ মানুষেই সার্বিক প্রয়াস ও প্রচেষ্টার মাধ্যমে। আমাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় স্বাধীনতা উত্তর কালে মূল্যবােধ ও মনুষ্যত্ব বােধের ক্ষেত্রে যে বিরাট ধ্বংস নেমেছে, ইন্দ্রজালের মাধ্যমে তাকে মেরামত করা যাবে না। অথচ তা মেরামত না করলেও আমাদের চলবে না। এই ধ্বংসের বিভীষিকা থেকে অবশ্যই আমাদের দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে এবং বেরিয়ে আসার একটাই পূর্বশর্ত সেই হচ্ছে নিখাদ-নির্ভেজাল চরিত্র। চরিত্রবান ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বই সব চাইতে শক্তিশালী। জাতীয় ভিত্তিতে এই শক্তিকেই আমাদের আহ্বান করতে হবে এবং বিভিন্ন স্তরে অটুট এই শক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই মহা প্রয়াসে অধৈর্য বা অহনশীল হলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছান সম্ভব নয়। আমাদের অনেকেই স্বভাববশত বিরুদ্ধবাদী এবং হুজুগে ও গুজবে মাতে। তাদের মতবাদ সম্পর্কে মন্তব্য নিষ্প্রয়ােজন। কিন্তু নাকের পরিবর্তে আমরা যেন নরুন দিয়ে আত্ম প্রবঞ্চনা না করি। আমরা যেন নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করবার মত সর্বনাশা খেলায় আর মেতে না উঠি। সুযােগকে বিনষ্ট করবার শক্তিসমূহ সুসংগঠিত। অপরদিকে সুযােগ গ্রহণকারীরা সাধারণত নিষ্ক্রিয় শান্তিবাণী এবং উদাসীন। প্রচলিত এই ব্যবস্থার আশু অবসান হওয়া উচিত। যুক্তিবাদী মন ও মানসিকতা নিয়ে এবং ঘােড়ার আগে গাড়ি জুড়বার প্রবণতা পরিহার করে সুন্দর। শশাভন, মননশীল ও কলুষহীন ভবিষ্যতের দৃঢ় বুনিয়াদ পত্তনের জন্য আমি সবিনয়ে। বাংলদেশের সবার কাছে আবেদন জানাচ্ছি।

১৯৭১ সালে আমরা যে স্বাধীকার অর্জন করেছি, সে স্বাধীকারকে স্বাধীনতায় রূপান্তরিত করবার ব্যাপারে ব্যর্থতার জন্য অতীতের উপর দোষারােপ করে ফায়দা হবে না। আমাদের ভাগ্য আল্লাহর উপর নির্ভর করে আমাদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সমৃদ্ধ লাভের ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ততম কোন পথ নেই। নিজের সম্পদ ও পেশীর। শক্তির উপর নির্ভর করে দৃঢ় মনােভাবের সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম করবার মধ্যে সমৃদ্ধির চাবি লুকানাে। দেশের জন্য স্বনির্ভর অর্থনীতি অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে নিজেদের বাঁচার এবং বিশ্বদরবারে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াবার তাগিদে। দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে যেমন প্রতিটি নাগরিককে রক্ষা করতে হবে নিজ দায়িত্বে ও প্রাণপণে। ঠিক তেমিন স্বাধীনতাকে অর্থবহ করবার জন্য আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে। বাংলার মাটি থেকেই আমাদের ফসল ফলাতে হবে। বাংলার শ্রমিকের পেশীতে ও মনে অদম্য শক্তি আছে। শক্তির আর অপব্যবহার না করে সে শক্তিকে আরও অধিক উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। আমরা অনেক ধ্বংস করেছি। আর নয়। আসুন সবাই ধ্বংস থেকে ক্ষান্ত হই এবং গড়বার কাজে নিয়ােজিত হই। আসুন। সবাই বাসযােগ্য একটা দেশ গড়ে তােলার জন্য কর্মের জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। এই পবিত্র রাতে আমাদের সকলের প্রার্থনা উদয়ের পথে আমাদের যাত্রা হােক শুভ, তমসাচ্ছন্ন রাত্রিশেষে উদয়গগনে যে নবীন সূর্য উঠেছে, সে সূর্যের কিরণে অবগাহন করে পাপ পঙ্কিল জরাজীর্ণ আমাদের দেশটি নিস্পাপ প্রাণবন্ত জীবনের জনপদ হয়ে প্রতিষ্ঠিত হােক বিশ্বদরবারে। অচিরেই আকাশে এক ফালি বাঁকা চাঁদ উঠেছে। আমাদের জীবনের সর্ব প্রকার দুঃখ, দৈন্য ও ক্লেশ সত্ত্বেও ওই চাঁদ ঘরে ঘরে আনন্দ ও খুশীর সওগাত বহন করে আনবে। পবিত্র ঈদের এই আনন্দের দিনকে উপলক্ষ করে দেশবাসী সকলের প্রতি আমি আমার আন্তরিক ঈদ মােবারক জানাচ্ছি। আপনাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ভবিষ্যতের দায়দায়িত্ব তুলে দেওয়ার প্রতীক্ষায় আমি সত্যনিষ্ঠ হয়ে অপেক্ষা করছি। পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা আমাদের সকলের সহায় হােন।

খােদা হাফেজ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং তার এদেশীয় ঘাতকরা। ১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫-এর কালরাত্রিতে যাদের হত্যা করেছে ? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। জনাব আবদুর রব সেরনিয়াবাত। জনাব শেখ ফজলুল হক মনি। জনাব শেখ আবু নাসের। বেগম সামশুন্নেসা মনি। শেখ কমাল। শেখ জামাল। শেখ রাসেল (বঙ্গবন্ধুর ৮ বছরের কনিষ্ঠ পুত্র)। বেগম সুলতানা কামাল। বেগম রোজী কামাল। জনাব শহীদ সেরনিয়াবাত (আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ভ্রাতুস্পুত্র)। বেবী সেরনিয়াবাত (ঐ কন্যা, বয়স ১৪ বছর)। আরিফ সেরনিয়াবাত (ঐ পুত্র, বয়স ১২ বৎসর)। বাবু সেরনিয়াবাত (ঐ দৌহিত্র, বয়স ৫ বৎসর)। নান্টু (ঐ ভাগিনেয়)। কর্নেল জামিল। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কর্তব্যরত ডি. এস. পি। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ও আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির কয়েকজন কর্মচারী। গুলিতে আহত ? বেগম আবদুর রব সেরনিয়াবাত। বেগম আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ (ঐ পুত্র বধূ)। বিউটি সেননিয়াত (ঐ কন্যা)। আবুল খায়ের আবদুল্লাহ (ঐ ভ্রাতুস্পুত্র)। হেনা সেরনিয়াবাত (ঐ কন্যা)। 

সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ