You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | সেনাবাহিনী ও গণবাহিনীর ৩ জন প্রাক্তন সদস্যের সাংবাদিক সম্মেলন | ২১শে মে ১৯৮১ - বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক

সেনাবাহিনী ও গণবাহিনীর ৩ জন প্রাক্তন সদস্যের সাংবাদিক সম্মেলন।

সেনাবাহিনীর ৩ জন সাবেক সদস্য বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তারিখের সামরিক অভ্যুত্থান এবং সপরিবারে শেখ মুজিব হত্যার ব্যাপারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং বর্তমান ডেমােক্রেটিক লীগে যােগদানকারী আওয়ামী লীগের তৎকালীন গ্রুপ দায়ী। ২১শে মে ১৯৮১ তে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই তথ্য প্রকাশকারী সেনাবাহিনীর ৩ জন সাবেক কর্মচারীর। পরিচয় হচ্ছে সাবেক নায়েক সুবেদার মােহাম্মদ জলাল উদ্দিন, সহ-সভাপতি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা (সাবেক গণবাহিনী) দফতর সম্পাদক মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রাম পরিষদ সদস্য জেলা জাসদ কমিটি, বগুড়া; সাবেক নায়েক মােহাম্মদ আসাদুজ্জামান (আসাদ) সদস্য বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সাবেক সভাপতি সরিষাবাড়ী থানা জাসদ, জামালপুর। গতকাল হতে তারা জাসদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কচ্ছেদের কথা ঘােষণা করেন। সাংবাদিক সম্মেলনে সাবেক নায়েক সুবেদার মােঃ জালাল উদ্দিন একটি লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন। এতে বলা হয় যে, ১৯৭৫ সালে গুলশানের এক বাড়িতে শেখ হত্যার প্রস্তাব করা হয়েছিল। উক্ত নীল নক্শা মােতাবেকই তিনি সপরিবারে নিহত হন। এই প্রেক্ষিতে প্রশ্ন রাখা হয় যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থান এবং সপরিবারে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার জন্য জাসদ নেতৃবৃন্দ দায়ী কি না? উত্তরে জনাব জালাল উদ্দিন বলেন যে, বর্তমান ডেমােক্রেটিক লীগের কিছু নেতা যারা তকালে আওয়ামী লীগে ছিলেন ওরা এবং সেনাবাহিনীর কয়েকজন অফিসারের সঙ্গে জাসদ গুলশানের এক বাড়িতে উক্ত নীল নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে জাসদকে পিছনে ফেলে বাদবাকীরা প্রথম অভ্যুত্থান সংঘটিত করে। জনাব জালাল উদ্দিন এক প্রশ্নের জবাবে বলেন যে, ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের দিন সেনাবাহিনীর পােশাক পরিহিত অবস্থায় তিনি একটি বাহিনীর সহিত ঢাকায় ৫টি থানায় অস্ত্রোদ্ধারের জন্য গিয়েছিলেন। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের জানান যে, ১৯৮০ সালের জুন মাস হতে বিভিন্ন কারণে তার মােট ৬ বৎসর জেল হয়েছিল। সাংবাদিক সম্মেলনে পঠিত বক্তব্য হুবহু নিম্নে প্রদত্ত হলােঃ

প্রিয় সাংবাদিক ভাইয়েরা,

আমাদের আমন্ত্রণে আপনারা মেহেরবানী করে উপস্থিত হয়েছেন, সে জন্য প্রথমেই আমাদের সশ্রদ্ধ ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।

আপনারা জানেন আমরা ছিলাম তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য। ১৯৭১-এর আমরাও জীবনকে বাজী রেখে লড়াই করেছিলাম। বিজয়ের পর স্বভাবতঃই রাষ্ট্র পরিচালনার দায় দায়িত্ব রাজনীতিবিদদের হাতে ছেড়ে দিয়ে আমরা । ফিরে গিয়েছিলাম ব্যারাকে। আর ঠিক এমনি সময়ে ঝড়ের মতাে আবির্ভূত হলাে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ। এই দলের নামের সঙ্গে হিটলারের ন্যাশন্যাল সােস্যালিষ্ট পার্টির নামের হুবহু মিল। জাসদ নেতাদের ভারতীয় সামরিক গােয়েন্দা কর্মকর্তা জেনারেল সুজন সিং উবান কর্তৃক বিশেষ ট্রেনিং দান, ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার বােহরার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ইত্যাদি সব কিছুকে ছাপিয়ে যে মুহূর্তে আমাদের নজর এল জাসদের তারুণ্য, সমাজতন্ত্রের বক্তব্য ও ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুঃসাহস। স্বভাবতঃই আমরা এদের সঙ্গে ক্রমশঃ জড়িয়ে গেলাম।  ১৯৭৪ সালের ১৭ই মার্চ জাসদ তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ৪৭টি থানা ঘেরাও ও অস্ত্র লুটের কর্মসূচি গ্রহণ করে। জনাব সিরাজুল আলম খান তার কিছু সংখ্যক বিশ্বস্ত কর্মীকে ডেকে নিয়ে বলেন যে, আন্দোলনকে গণতান্ত্রিক পর্যায় থেকে বিপ্লবী পর্যায় রূপান্তর করার জন্য চাই জাম্প বা উল্লম্ফন। তারই নির্দেশ মােতাবেক সেদিন জাসদের কিছু সংখ্যক কর্মী মিছিলে হাত বােমা ফাটিয়ে এবং পুলিশের প্রতি গুলি বর্ষণ করে পুলিশকে বেপােরােয়া গুলি বর্ষণে বাধ্য করে। থানা লুটের ৩৭টি কর্মসূচির মধ্যে খুলনায় একটি কর্মসূচি সফল হয়। ফলশ্রতিতে দেশব্যাপী জাসদ কর্মীদের উপর নেমে আসে বেপরােয়া নির্যাতন। আর এই পরিস্থিতিতেই ১৯৭৪ সালের জুন মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠন করা হয়। বিপ্লবী গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বীরােত্তম কর্নেল তাহের হলেন সৈনিক সংস্থার প্রধান। জাসদের তরফ থেকে যােগাযােগের দায়িত্বে থাকলেন হাসানুল হক ইনু।

ক্যান্টনমেন্টে গােপনে গঠিত করা হতে লাগলাে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ইউনিট। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসে জাসদ আবার দেশব্যাপী এক হরতাল আহবান করে এবং সরকারের সঙ্গে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার কর্মসূচি দেয়। হরতালের পূর্বদিন জাসদের অন্যতম কর্মী প্রকৌশলী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিখিল চন্দ্র সাহা বােমা বানাতে গিয়ে মারা যান। তার নামানুসারে এই বােমার নাম রাখে নিখিল বােমা। ১৯৭৫ সনের জানুয়ারি মাসে শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করেন এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়। এমতাবস্থায় হীনবল ও উপায়ান্তরহীন জাসদ নেতৃত্ব শেখ মুজিবের কাছে বাকশালে যােগদানের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু ক্ষমতার মদে মত্ত শেখ মুজিব তখন এই প্রস্তাবকে আমল দেননি। ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে জাসদ নেতৃত্ব সেনাবাহিনীর কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অফিসারের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করে। তাদের সঙ্গে মিলে গড়ে তােলা হয় বিপ্লবী ফোরাম। এই ফোরামের ঘন ঘন বৈঠক বসতে থাকে এখানে সেখানে। গুলশানের এক বাড়িতে বসে নির্ধারিত হয় অভ্যুত্থানের নীল নকশা। সেই বৈঠকেই জাসদের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করার প্রস্তাব প্রদান করা হয়। যুক্তি হিসেবে বলা হয় যে, শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হয়েছেন এই সংবাদে সারা দেশব্যাপী বাকশালীদের মনােবল ও প্রতিরােধ ক্ষমতাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেবে, অন্যথায় অভ্যুত্থানের ফলাফলকে দলে রাখা মুস্কিল হবে। দীর্ঘ আলাপআলােচনার পর সকলেই এ ব্যাপারে একমত হন। অনেকের ধারণা জাসদ কোন বিদেশী শক্তির নির্দেশেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই নীল নক্‌শা মােতাবেকই ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন। জাসদ নেতারা বিশেষত গণবাহিনী ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নেতারা প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর জিপে করে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে কুরিয়ারদের পাঠিয়ে দেয়া হয়। নির্দেশ দেয়া হয়, এই অভ্যুত্থান জাসদের স্বপক্ষে অ্যুত্থান এবং এখনকার বিপ্লবী দায়িত্ব হলাে বিভিন্ন ফাড়ি ও ট্রেজারিসমূহ থেকে যতটা সম্ভব অস্ত্র ও গােলা বারুদ সংগ্রহ করা। এই নির্দেশ অনুযায়ী মােহাম্মদপুর ফঁাড়ি ও নারায়ণগঞ্জের একটি ফাড়ি প্রকাশ্য লুট করা হয় এবং লুণ্ঠিত অস্ত্র শস্ত্র তােলা হয় পিটার কাস্টার্সের এলিফেন্ট রােডস্থ বাসভবনে। পরবর্তীকালে পিটার কাস্টার্স এই অস্ত্র-শস্ত্রসহই গ্রেফতার হয়।

ভারত থেকে ২৪ ঘণ্টার নােটিশে বহিস্কৃত পিটার কাস্টার্সের সঙ্গে জাসদের কি সম্পর্ক ছিল তা জাসদ নেতারা কখনােই পরিষ্কার করে বলেনি। তবে জেলখানায় পিটার কাস্টার্স প্রকাশ্যেই বলে বেড়াতাে যে, সে জাসদকে চল্লিশ লক্ষ টাকা দিয়েছে। জাসদের কেউই এর কোনাে প্রতিবাদ করতাে না। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে ১৫ই আগস্টের নির্দেশের পরিপেক্ষিতে সারা দেশব্যপী তিনটি ফাড়ি লুট করা সম্ভবপর হয়। স্বভাবতঃই জাসদ খন্দকার মােশতাক সরকারের বিরুদ্ধে কোনাে শব্দই উচ্চারণ করেনি। কিন্তু কিছু দিন অতিবাহিত হবার পর জাসদ দেখল তাদের লাভ নেই। তখন তারা পুনরায় তৎপর হয়ে উঠে। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর খন্দকার মােশতাক সরকারের পতন ঘটে এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশারফ ক্ষমতায় আসেন। এতে বাকশালী মহলে আনন্দের হিল্লোল বয়ে যায়। তারা রাস্তায় রাস্তায় মিছিল বের করে বিজয়ােৎসব করতে থাকে। ভারতীয় বেতার থেকেও প্রকাশ করা হতে থাকে বিপুল আনন্দধ্বনী।

এমতবস্থায় দেশপ্রেমিক প্রতিটি নাগরিক এবং সিপাহীই প্রমাদ গুণতে থাকে। এই পটভূমিতে ৭ই নভেম্বর সংগঠিত হয় দেশপ্রেমিক সিপাহী জনতার মহান বিপ্লব। পাদ প্রদীপের সামনে চলে আসেন জেনারেল জিয়া। ক্ষমতা লােলুপ জাসদ দাবী করে যে এই বিপ্লবে নাকি তাদেরই নেতৃত্ব ছিল। কিন্তু আমরা যারা এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম তারা জানি যে বিপ্লবের সাফল্যের পর সিপাহীদের তরফ থেকেই জেনারেল জিয়ার কাছে ১২ দফা দাবী পেশ করা হয়, কিন্তু জাসদের সঙ্গে তার কোনাে প্রকার চুক্তি বা অঙ্গীকারই ছিল না। জেনারেল জিয়া এই ১২ দফা দাবীর কতিপয় দাবী সঙ্গে সঙ্গে পূরণ করেন এবং ধাপে ধাপে পূরণ করা হবে বলে আশ্বাস প্রদান করেন। ১২ই নভেম্বর জাসদ সিপাহী জনতার মহান বিপ্লবের ফলে অধিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করার বক্তব্য দেয়। ১৬ই নভেম্বর জলিল-রবের ব্যক্তিগত নামে প্রচার পত্র বিলি করা হয় এবং নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে অধিষ্ঠিত সরকারকে উৎখাত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। | ক্যান্টনমেন্টে বিলি করা হয় প্রচার পত্র। মেজর জিয়া উদ্দীনকে বেশ কিছু সংখ্যক সিপাহী ও অস্ত্র-শস্ত্রসহ পাঠিয়ে দেয়া হয় সুন্দরবন, প্রত্যেক ইউনিটে নির্দেশ দেয়া হয় চূড়ান্ত প্রস্তুতির, কিন্তু চক্রান্ত সরকারের গােচরীভূত হয়ে যায়। ফলে ২২শে নভেম্বর জলিল, রব, হাসানুল হক ইনু গ্রেফতার হন। ২৪শে নভেম্বর ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হল থেকে সিপাহী ও অন্যান্যদের সঙ্গে পরিকল্পনার অবস্থায় গ্রেফতার হন কর্নেল তাহের। পরিকল্পনা ভেঙে যাওয়ায় কর্মীদের কাছে মুখ রক্ষার উদ্দেশ্যে এবং জনগণের মধ্যে জাসদ ভারতীয় দালাল বলে যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল তার কবল থেকে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে জনাব সিরাজুল আলম খানের ব্যক্তিগত নির্দেশে ২৬শে নভেম্বর ভারতীয় হাই কমিশনের উপর ব্যর্থ হামলা চালানাে হয়। 

ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নায়কদের যে স্বাভাবিক পরিণতি সর্ব দেশে সর্বকালে ঘটে থাকে কর্নেল তাহেরের ব্যাপারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ১৯৭৬ সালের ২১ই জুলাই তারিখে কর্নেল তাহেরের ফাসি হয়। বস্তুত স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী কর্নেল তাহেরের জাসদ নেতৃত্বের দ্বারা সম্পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়েছিলেন। কর্নেল তাহেরের অনুসারীদের সান্ত্বনা দেয়ার উদ্দেশ্যে জাসদ ৩০শে জুলাই দেশব্যাপী এক হরতাল আহবান করে। ফঁাসির ৯ দিন পর আহুত এই হরতাল সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়। কর্নেল তাহেরের ফাসি ও মেজর জিয়া উদ্দিনসহ অন্যান্য নেতাদের গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে বাইরের আন্দোলনের কিছুটা ভাটা দেখা দেয়। কিন্তু জনাব সিরাজুল আলম খান, মেজর জলিল, জনাব এ.বি. এম শাহাজান, জনাব | হাসানুল হক ইনু প্রমুখ স্ব স্ব চ্যানেলে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যােগাযােগের প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। এই চক্রান্তের ফলশ্রুতিতেই জাসদ ১৯৭৭ সালের ২রা অক্টোবর এর ব্যর্থ অভ্যুত্থানর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৯৮০ সালে ১৭ই জুনের মধ্যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। তাদের যােগসাজশে আজও তারা চক্রান্ত ও অভ্যুত্থানের প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। জাসদ ১৯৭৪ সালের তাদের থিসিসে চীনের কম্যুনিস্ট পার্টিকে সঠিক পাটি বলে অভিহিত করে এবং জনৈক কাদের সাহেবকে লন্ডন পাঠিয়ে তার মাধ্যমে চীনের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে। কিন্তু চীন এ ব্যাপারে তেমন কোনাে উৎসাহই প্রদর্শন করে না। | জাসদ মনে করে যে জনগণ প্রধান ফ্যাক্টর নয়। এ দেশে ক্ষমতা দখল করতে হলে চাই সেনাবাহিনীর একটি অংশ ও বিদেশী মদদ। তাই চীন যখন উৎসাহ | দেখালাে না তখন তারা থিসিস পরিবর্তন না করেই রাশিয়ার কৃপা ভিক্ষার জন্য হন্যে হয়ে উঠে। জনাব আ, স, ম, আবদুর রব পশ্চিম জার্মানি গিয়ে নানাভাবে রাশিয়ার সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করেন এবং এক পর্যায়ে রাশিয়া থেকে ঘুরেও আসেন। জাসদ এ কথাও বুঝতে পারেন যে সিপিবি বাকশালকে ডিঙ্গিয়ে রাশিয়া জাসদকে কখনােই কোলে নিয়ে বসবে না। সুতরাং বাকশালের মনােরঞ্জন অপরিহার্য। তাই যে জাসদ ১৯৭৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়ও বাকশালকে এক নম্বর শত্রু বলে অভিহিত করেছিল, ১৯৭৯ সালে বাস্তব অবস্থা একই থাকা সত্ত্বেও জাসদ সেই বাকশালের সঙ্গেই মিত্রতার তত্ত্ব দিয়ে বসে এবং কার্যত বাকশালের লেজুড় বৃত্তি শুরু করে। উল্লেখযােগ্য যে, ১৯৮০ সালে বাকশালীরা জাসদের অফিস পুনরায় ভস্মিভূত করে দিলেও এবং তাদের কর্মীদের বেধড়ক  পিটিয়ে দিলেও বাকশালরা নারাজ হতে পারে এই ভয়ে জাসদ বাকশালীদের গায়ে একটি টোকা দেয়া থেকে পর্যন্ত বিরত থাকে।

আর ভারতের সঙ্গে এক গােপন রহস্যময় যােগাযােগ সর্বদাই রক্ষা করে  এসেছেন জাসদের রহস্য প্রিয় নেতা জনাব সিরাজুল আলম খান। তিনি দুই-এক মাস অন্তর অন্তরই অকস্মাৎ দিল্লী চলে যেতেন। জাসদের কর্মীদের যখন হন্যে হয়ে খুঁজছে, জাসদের সমর্থকদের পরিবার পরিজন পর্যন্ত যখন বেপরােয়া নির্যাতনের | শিকার হচ্ছে, তখন জনাব সিরাজুল আলম খান প্রকাশে পাসপাের্টের মাধ্যমেই দিল্লী  কোলকাতা চলে যেতাে এবং কেউ তাকে ধরার কোনাে চেষ্টাই করতাে না। এই প্রসঙ্গে জনাব মােমিনুল হায়দার চৌধুরী ওরফে হায়দার সাহেবের কথাটি বলে রাখা দরকার। ভারতের সােশ্যালিস্ট ইউনিট সেন্টার (এস, ইউ, সি) এর কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হায়দার সাহেব ১৯৭২ সালেই এস, ইউ. সি-এর একটি বাংলাদেশী সংস্করণ গঠন করার দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে আসেন এবং বিভিন্ন মহলে ঘােরা ফেরার পর জাসদকে কাজের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে  নেন। তিনি প্রথম থেকেই বছরের অর্ধেক সময় ভারতে এবং অর্ধেক সময় বাংলাদেশে বসবাস করতেন শােনা যায়। তার ভারতীয় ও বাংলা এশী উভয় প্রকারের পাসপাের্ট রয়েছে। জনাব সিরাজুল আলম খান এই ভদ্রলােকর সঙ্গেও বেশ ক’বার ভারতে গমনাগমন করেন। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার পর জনাব হায়দার জাসদের মধ্যে তার কিছু অনুসারী সৃষ্টি করতে সমর্থ হন এবং সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের কোন্দলের কোন ফয়সালা না হওয়ায় তার উচ্চভিলাষী তরুণ অনুসারীদের দিয়ে বাসদ গঠন করান। জনাব খান যেমন জাসদের নেপথ্য গুরু জনাব হায়দারও তেমনি বাসদের নেপথ্য গুরু। উচ্চভিলাষী অথচ অস্থির চিত্ত নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত জাসদ কোনাে কর্মসূচিতেই লেগে থাকতাে না বরং সর্বদাই চক্রান্তের পথ খুঁজে বেড়াতাে। তাদের এই নৈরাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের বেদীমূলেই প্রাণ দিয়েছিল কর্নেল তাহের, কর্পোরাল আলতাফ, সিদ্দিক মাস্টার, আবুল কালাম আজাদ, হাদী, মন্টু, মফিজ, হেলাল, রােকন, মীর মােস্তফাসহ শত শত রাজনৈতিক কর্মী ও সিপাহী। বিরান হয়ে গিয়েছিল অসংখ্য পরিবার আর কতজন যে ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের শিকার হয়েছিল তার কোনাে ইয়ত্তা নেই। কিন্তু জাসদ নেতৃত্ব এদের প্রতি কোনাে দায় দায়িত্ব। কোনাে দিন স্বীকার করেনি। কথা ও কাজের মধ্যেও জাসদ নেতৃত্বের কোনাে দিন কোনাে মিল ছিল না। তারা মুখে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলতাে, কিন্তু কার্যত নেতারা বিলাসবহুলতার মধ্যে দিয়ে জীবনকে উপভােগ করতেন। সাধারণ কর্মীরা যে না খেয়ে থাকতাে তাদের যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুর্দশা, সেদিকে নজর দেয়ার ফুরসত মিলতাে না জাসদ নেতাদের। 

 

সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ