You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.16 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | ঈদ এসে গেল | বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই বিপদমুক্ত হবে | বায়তুল্লাহ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৬ই অক্টোবর, বুধবার, ১৯৭৪, ২৯শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

ঈদ এসে গেল

ঈদ এসে গেল। সিয়ামের কঠোর ত্যাগ মন্ডিত দিনগুলো একটি একটি করে খসে গেল রমজান মাসের দিনপঞ্জী থেকে। অধীর আগ্রহে সকল স্তরের মানুষই শওয়ালের চাঁদ দেখার আগ্রহে উৎসুক হয়ে উঠেছে। পশ্চিম আকাশের এক কোণে দেখা যাবে অতি ক্ষীণ বাঁকা এক ফালি চাঁদ। ঈদের সওগাত নিয়ে সে চাঁদ হাসে না কাঁদে বোঝা যায় না। কিন্তু এবারের ঈদ সীমিত আয়ের সংসারে দুঃখের বোঝাকে দুর্বহ-ব্যথার পাষাণে যেন পিষে দিতে আসছে।
মুসলমানদের ঈদুল ফিতরই সবচেয়ে বড় আনন্দের দিন—উৎসবের দিন। পুরো একটি মাস রোজা থাকার পর এই দিনটি আসে বলে এই ঈদের একটা আলাদা তাৎপর্য আছে। তারপর ঈদের জামাতে ধনী-নির্ধন, গরীব-মিসকিন এক কাতারে দাঁড়িয়ে পরম করুণাময়ের উদ্দেশ্যে যে নামাজ আদায় করেন তারও একটা মানবিক আবেদন অবশ্যই আছে। যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ মানবতাবাদী মুসলমানেরা এর সুব্যাখ্যাই করে গেছেন।
যতদূর জানি প্রায় সকল ধর্মের মূল শিক্ষার মধ্যে মানবতাবাদের দিকটাকেই বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। মানুষের প্রতি মমত্ব, সহানুভূতি, সম্পদের সুষম বন্টনের মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনের জটিলতা কমানো, প্রাচুর্য, প্রীতি ও বিলাসের ক্ষতিকর অভ্যাসকে যথাসম্ভব দূরে রাখার সচেতন প্রয়াস ও মানুষের মৌলিক দাবী এবং চাহিদার প্রতি উদার ও নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করার আহ্বান ধর্ম পুস্তকেই থাকে। এ কথাও সত্য যে, মানবতাই হলো সেরা ধর্ম। যার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারলে অনেক ঝঞ্ঝাট ও জাগতিক কুটিলতা থেকে বেশ দূরে থাকা যায়। আমরা কি আজ সেই পথ অনুসরণ করছি?
আজ আমরা ডুবে গেলাম সার্বিক অধর্মের পথে। চুরি, ডাকাতি, খুন, রাহাজানি, লুট, ছিনতাই ধ্বংসাত্মক কাজ, কর্মে অবহেলা, চোরাচালান, মুনাফা লুটা, মওজুতদারী, ভেজাল কারবার ইত্যাকার চূড়ান্ত অধার্মিক কাজে আমরা দেশের আবহাওয়া ও সার্বিক পরিস্থিতিকে বিষাক্ত করে তুলেছি। অন্নের হাহাকারে দেশে আজ দুর্ভিক্ষের মাতম। লক্ষ লক্ষ মানব সন্তান অনন্ত সম্ভাবনা বুকে নিয়ে দানা পানির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে নির্মম মৃত্যুর কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করছে। মানুষের প্রতি মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধা নষ্ট হয়েছে, স্নেহ ভালোবাসা পর্যন্ত গেছে বিকৃত হয়ে। সমস্যা অস্থিরতা আর সার্বিক নৈতিক অধঃপতনের পঙ্কিল আবর্তে এদেশের জনজীবন আজ ছিন্নভিন্ন প্রায়।
তবু ঈদ আসবে। ধনীর ঘরে বর্ণাঢ্য শোভায় হাসবে। প্রাচুর্যের দুলাল রঙীন দামী জামা কাপড় পরে কংকালের পাহাড়ে বাসনার ঘুড়ি ওড়াবে। পালিশ হবে গাড়ী। সাজানো হবে ঘর দোর। ফিরনী, সেমাই, পোলাও কোর্মার মৌ মৌ গন্ধে পরিবেশ লোভাতুর হয়ে উঠবে। তবকে মোড়া পর্যাপ্ত মিষ্টির থালার উপর কতজনের লোভাতুর দৃষ্টি বহুদূর থেকে লুব্ধ রসনায় সিক্ত হয়ে উঠবে। কিন্তু ঈদ তবু সীমিত গন্ডির মধ্যে নির্বিকারে বন্দী থাকবে।
তাই নর্দমার ধারে ফুটপাতের কিনারে এবং ব্যবস্ত জনজীবনের পদতলে যারা আজও ঈদের আশায় শওয়ালের চাঁদ দেখবার বাসনাকে বুকে চেপে রেখেছে তাদের দিকে সবাই ফিরে চান। এবং যে মুষ্টিমেয় কুচক্রী ও সমাজবিরোধীদের পাপ তৎপরতায় ওরা আজ এমনভাবে পঙ্গু, স্বাভাবিক জীবনের আশা আনন্দ ও উৎসব থেকে বঞ্চিত—তাদের মুখোশ খুলে দিলেই প্রকৃত ঈদের সওগাত ঐসব ব্যক্তির মুখে হাসি ফোটাবে। শওয়ালের চাঁদকে ওরা তখন জানাবে ঈদ মুবারক। এবং সেখানে মানবতাই থাকবে শীর্ষে।

বাংলাদেশ খুব শীঘ্রই বিপদমুক্ত হবে

জাপানী প্রতিনিধিসভার ভাইস স্পীকার মিঃ দায়সুকে আকিতা বাংলাদেশ অচিরেই বিপদমুক্ত হবে এবং পুনর্বাবসন পরিকল্পনায় বাস্তবায়নে সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। গতকাল (মঙ্গলবার) রাতে তাঁর সম্মানে প্রদত্ত এক নৈশভোজে তিনি বলেন যে, বঙ্গবন্ধুর চির আকাঙ্ক্ষিত ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন সার্থক হয়ে উঠুক এটাই আমরা কামনা করি।
তিনি বলেন, ডেপুটি স্পীকারের বিশেষ আমন্ত্রণে প্রথমবারের মতো আমরা বাংলাদেশে আসতে পেরে বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
আমার সম্মানে আয়োজিত এই বিশেষ ভোজসভায় উপস্থিত হতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং গর্ববোধ করি।
জাপানের জাতীয় সংসদের সহ-স্পীকার হিসাবে আমার সফরের বিশেষ উদ্দেশ্য হলো আমাদের দুইদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্য আরো দৃঢ়তর করে তোলা এবং সেই জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দুইদেশের সহযোগিতা বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির বিষয়, বিশেষভাবে আলোচনা করা।
এইমাত্র মাননীয় ডেপুটি স্পীকার সাহেব তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন যে, জাপান ও বাংলাদেশ বন্ধুত্বসূত্রে আবদ্ধ হয়ে আসছে।
আপনাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন আমরা আপনাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করেছি এবং এই স্বাধীনতার পরে নতুন বাংলাদেশের সামনে যে সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে সেটা যে আপনারা একান্তই মনোযোগ দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেছেন তাকে আমরা মনেপ্রাণে সমর্থন করে আসছি।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকার, আমি সহ স্পীকার হওয়ার পূর্বে লিবারেল ডেমোক্যাটিক পার্টির অর্থনৈতিক সহযোগী দলীয় সংসদের চেয়ারম্যান ছিলাম। এই সংসদের সাথে আপনাদের দেশ সহ উন্নয়নশীল দেশসমূহের ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য দিনরাত কাজ করে এসেছি। সহ-স্পীকার হিসাবে আজকেও উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য কাজ করে আসছি।
গত আগস্ট মাসে আপনাদের উপর দিয়ে যে ভয়াবহ বন্যার প্রকোপ বয়ে গেছে এবং আপনারা যে সাময়িক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে আমি নিতান্তই মর্মাহত হয়েছি এবং আমরা আপনাদের দেশের জন্য ছয় লক্ষ ষাট হাজার মার্কিন ডলারের সামগ্রী সাহায্য দিয়েছি। আমাদের জাপানী ভাইরা জাপানের রাজপথে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সাময়িক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ভাইবোনকে সাহায্য করার জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছে।
আমি আশা করি আপনারা অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিপদমুক্ত হবেন এবং পুনর্বাসনে সক্ষম হবেন।
গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের দেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করায় আমি এবং আমার জাপানী জনগণ খুবই আনন্দিত হয়েছে। এই সুযোগে আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং জনগণকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই।
মাননীয় ডেপুটি স্পীকার, সর্বশেষে আজকের এই ভোজসভায় জাপানী জনগণের পক্ষ থেকে আপনাদের দেশের শ্রীবৃদ্ধির এবং বঙ্গবন্ধুর চির আকাঙ্ক্ষিত ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন সার্থক করে তুলুন এই কামনা করি।

বায়তুল্লাহ

বাংলাদেশ পার্লামেন্টের ডেপুটি স্পীকার জনাব বায়তুল্লাহ ভোজসভায় মিঃ দায়সুকে সম্বর্ধনা জানিয়ে বলেন, মাননীয় প্রধান অতিথি, আপনাকে ও মাদাম আকিতাকে আমাদের মধ্যে পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছি। আমাদের সকলের পক্ষ থেকে আপনাদের আমি স্বাগত জানাই। আপনি আমাদের নিকট অপরিচিত নহেন, স্বাধীনতা যুদ্ধকাল হতেই আমরা আপনাকে বাংলাদেশের একজন দরদী বন্ধু হিসাবে ভালোভাবেই জানি। বাংলাদেশের মঙ্গলের প্রতি আপনার ব্যক্তিগত উৎসাহ দেখে আমরা অত্যন্ত প্রীত হয়েছি। আমাদের স্বাধীনতা লাভের পর পরই যেভাবে জাপান সরকার ও জনগণ ছিন্নমূল বাঙালীদের দুর্দশা নিরসনের জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, তা আমাদের বেশ মনে আছে। অনুরূপভাবে সাম্প্রতিক বন্যা পীড়িত বাঙালীদের প্রতি আপনি ও আপনার সহকর্মীরা তথা আমাদের জাপানী ভাইরা যে প্রাণঢালা সহানুভূতি দেখিয়েছেন, তাতে আমরা অভিভূত হয়েছি। এই বন্যা লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে গৃহহীন ও অসহায় করে গেছে। আমরা শশ্রদ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি কিরূপে আমাদের জাপানী বন্ধুরা তাঁদের মূল্যবান সময় ও মনোযোগ দিয়ে দুস্থ বাঙালীদের জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
শিল্প ও টেকনোলজিতে জাপান এশিয়ার অগ্রণী দেশ। তাই আপনাদের কাছ থেকে আমরা প্রেরণা ও সহযোগিতা কামনা করি। আপনারা প্রমাণ করেছেন কিরূপে প্রাচ্যের একটি দেশ প্রতীচ্যের উন্নত দেশগুলোর সহিত সফলতার সহিত প্রতিযোগিতা করতে পারে এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদেরকে ছাড়িয়ে যেতে পারে। আপনাদের এ সাফল্যে আমরাও গর্বিত এবং আপনাদের দেশ থেকে পথের সন্ধান পেতে আশা রাখি। পূর্ব হতেই আপনাদের দেশ বাংলাদেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সহযোগিতা করে আসছে। আপনাদের মতো আমাদের দেশও নদীমাতৃক। কাজেই আপনাদের নিকট হতে আমাদের অনেক কিছু শিখবার আছে।
বাংলাদেশ ও জাপান দু’টি বন্ধু দেশ। আপনাদের মতো মহান ব্যক্তিদের আগমন সে বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করেছে। আপনার এ শুভাগমন দীর্ঘতর হলে আমরা আরও খুশী হতাম ও আপনার পক্ষেও আমাদের দেশকে ভালোভাবে দেখা সম্ভব হতো। যাহা হউক আমরা কৃতজ্ঞ যে, অল্পকালের জন্য হলেও আপনি আমাদের দেশে পদার্পণ করতে পেরেছেন। আপনাদের উভয়ের ও বন্ধুসুলভ জাপানী জনগণের স্বাস্থ্য ও উন্নতি কামনা করে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি বাংলাদেশ-জাপান বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হউক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন