You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | দিনপঞ্জী  কতিপয় ঘটনা- মুজিব হত্যাকাণ্ড - সংগ্রামের নোটবুক

দিনপঞ্জী  কতিপয় ঘটনা

১. মুজিব হত্যার বিষয়টিকে নিয়ে আরাে গভীরে যাওয়া যাক। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী বলে পরিচয় দানকারী লেঃ কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও আবদুর রশিদ এক সাক্ষাৎকারে নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, “বহু পূর্বে হতেই মুজিব হত্যার পরিকল্পনা চলে আসছিল।” যেমন তারা বলেছেন, “প্রকৃতপক্ষে আগস্ট বিপ্লবের সংগঠকরা ১৯৭৩ সালের শেষ দিক থেকেই পরিস্থিতির উপর তীব্র নজর রেখে আসছিলেন। তারা গােটা পরিস্থিতি নিরীক্ষা ও মূল্যায়নের মাধ্যমে একটি সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম নির্বাচন করার ব্যাপারে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৪ সালের নভেম্বর মাসের মধ্যে একটি যৌক্তিক কার্যক্রমের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করে বিস্তারিত কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয় এবং একটি খসড়া সময়সূচিও নির্ধারণ করা হয়। গােপনীয়তা রক্ষা করার স্বার্থেই বিস্তারিত কার্যক্রমের পরিকল্পনা আমরা দুই জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। চূড়ান্ত সময়সূচি ও পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ৬ মাস কেটে যায়। কেননা এটি বেশ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহের, কার্যকারণের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি। পর্যন্ত চূড়ান্ত আঘাত হানার দুটি নির্ধারিত সময়সূচি ছিল। সত্য কথা বলতে কি, দুটি বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বিপ্লবের মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ১৫ই আগস্ট ছিল চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সর্বশেষ সময়সূচি। ১২ আগস্টের মধ্যে আমাদের কাছে এটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে, ১৫ই আগস্ট হচ্ছে চূড়ান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মােক্ষম সময়। চূড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য ১২ই আগস্ট ও ১৫ই অগস্টের মধ্যবর্তী সময়কে বেছে নেয়া হয়। পরিকল্পনা কার্যকরী করার আদেশ প্রদান করা হয় ১৫ই আগস্ট এবং ঐ দিনই সূর্যাস্তের অব্যাহিত পর থেকে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেয়া হয়। সুতরাং এটা প্রতীয়মান হয় যে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড গুটিকয়েক সামরিক অফিসারের হঠাৎ পাগলামী অংশ নয়। আমরা যদি সাক্ষাৎকারটি ভালােভাবে লক্ষ্য করি তাহলে দেখব যে, হত্যাকারীগণ “তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ দেড় বছর সময় নিয়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, “এটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহের সঙ্গে জড়িত।” এ সব উদ্ধৃতি থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে নিম্নোক্ত তথ্যগুলাে পাওয়া যায়—

ক. এটা ছিল একটা পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।

খ. হত্যাকারীদের ভাষ্যমতে ১৯৭৪ সালের শেষের দিক হতেই তারা পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যােগাযােগ স্থাপন করেছে।

১.২ লে, কর্নেল ফারুক ও রশীদের বিবৃতি অনুসারে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরিকল্পনায় তাদের দীর্ঘ সময় লেগেছিল; কারণ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি। তারা ১৯৭৪ সনের মাঝামাঝি। সময় হতেই হত্যা-পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এই সময়ের কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য

১৭ই জুন : ১৯৭৪ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তিন দিনের সফরে বাংলাদেশে

আসেন।

৭ই জুলাই : ছয় জন মন্ত্রী ও তিন জন প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র পেশ। ৯ই জুলাই : দেশের সীমান্ত এলাকা চোরাকারবারীদের দমনের জন্য

প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সেনাবাহিনীকে নির্দেশ প্রদান।

১০ই জুলাই : ভারতীয় হাই কমিশনার কার্যভার গ্রহণের জন্য সমর সেনের

ঢাকা আগমন

১৫ই জুলাই : বন্যার সার্বিক অবনতি

বন্যা পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনীকে

সতর্কাবস্থায় থাকার নির্দেশ।

৩রা সেপ্টেম্বর : কমার্স ও ফরেন টেড মিনিস্টার খন্দকার মােশতাক আহমদের

ছয় দিনব্যাপী ইরান ও আফগানিস্তান সফর শেষে ঢাকা প্রত্যাবর্তন

৪ঠা সেপ্টেম্বর : দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বৈপ্লবিক সরকারের প্রেসিডেয়ামের প্রেসিডেন্ট-এর আগমন এবং লাল গালিচা সম্বর্ধনা প্রদান

৭ই সেপ্টেম্বর : ব্যক্তিগত সফরে ভারতের মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশে আগমন।

১১ই সেপ্টেম্বর : ঘােড়াশালের সার কারখানায় বড় রকমের বিস্ফোরণ ২ জন

নিহত ৭ জন আহত।

১৭ সেপ্টেম্বর : ১৩৬তম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্য পদ প্রাপ্তি।

২০ সেপ্টেম্বর : সরকার কর্তৃক সমুদ্র উপকূলে তেল অনুসন্ধানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দুটি ফার্মের সাথে চুক্তি।

২৫ সেপ্টেম্বর : জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।

১লা অক্টোবর : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ মিনিট আলােচনা।

৩০ অক্টোবর : মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেনরি কিসিঞ্জারের ১৯ ঘন্টার সফরে ঢাকা আগমন।

৫ই নভেম্বর : বঙ্গবন্ধুর কায়রাে যাত্রা।

১১ ডিসেম্বর : লিবিয়ান প্রেসিডেন্ট-এর বিশেষ দূত আলী গাদামাসীর ঢাকা আগমন।

২৩ ডিসেম্বর : সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা।

২৫ জানুয়ারি : জাতীয় সংসদে চতুর্থ সংশােধনী গৃহীত। প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির

প্রবর্তন জাতীয়দল গঠন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ।

৩০ জানুয়ারি : ভারতের জনসংঘ ও ভারতীয় লােকদলের কতিপয় কর্মীর

নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ

প্রদর্শন।

২৪ ফেব্রুয়ারি : জাতীয় দল-বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ/বাকশাল

ঘােষণা।

১০ই মার্চ : কাগমাইর জনসভায় প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব ও মওলানা

ভাসানীর ভাষণ প্রদান।

২৬শে মার্চ : স্বাধীনতা দিবস সমাবেশে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের দ্বিতীয়

বিপ্লবের কর্মসূচি ঘােষণা।

২৭শে জুলাই : প্রধানমন্ত্রী মনসুর আলী জাতীয় সংসদে ঘােষণা করেন,

বাকশাল হলাে সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী কমিটি এবং সরকার

তার কার্যাদেশ নির্বাহ করবে।

১৮ই জুলাই : কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের

১৯৮৪ জন শিক্ষক অফিসারের

বাকশালের সদস্য পদের জন্য আবেদন।

২১শে জুলাই : প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু দুনীতির জন্য যােগাযােগ প্রতিমন্ত্রী নূরুল

ইসলাম মঞ্জুরকে অপসারণ করেন।

২৩শে জুলাই : সরকার কে, এম, কায়সারকে (বার্মায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতকে)

জাতিসংঘের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােগ প্রদান করেন।

২৫শে জুলাই : দেশে ৬৮ জন বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের বাকশালের সদস্য

পদের জন্য আবেদন।

৪ঠা আগস্ট : গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কোর্সে খন্দকার মােশতাক ঘােষণা করেন

যে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধন দৃঢ়তর হবে।

৯ই আগস্ট : প্রধানমন্ত্রী যশােরে ক্যান্টনমেন্টে সামরিক বাহিনীর অফিসার ও

জোওয়ানদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় দ্বিতীয় বিপ্লবের ক্যাডার হবার

আহবান জানান।

১৪ই আগস্ট : বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে ভারতীয় একটি

হেলিকপ্টার ৮ জন লােকসহ নােয়াখালীর রামগতিতে বিধ্বস্ত হয়। ব্রিটিশ হাই কমিশনারের খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে সাক্ষাৎকার।

২. ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্ব পর্যন্ত এক বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক ঘটনার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ ঘটনার পুনরাবৃত্তি জরুরি। এর মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের বিপ্লবী সরকারকে স্বীকৃতি দান ও তার রাষ্ট্রপ্রধানকে বাংলাদেশে লাল গালিচা সম্বর্ধনা, ১৯৭৪ সনের প্রচণ্ড বন্যা ও বন্যা উদ্ভূত দুর্ভিক্ষ, খন্দকার মােশতাকের ইরান সফর এবং মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের ঢাকা আগমন উল্লেখ্য।

৩. মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট ড. হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৪ সনের ৩০ অক্টোবর ১৯ ঘন্টায় সফরে বাংলাদেশে আগমন করেন। তিনি গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দুই ঘন্টা ব্যাপী আলাপ আলােচনা করেন। আলােচনা শেষে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, “A man of vast conception’, Kissinger said, he had rarely met a man who was the father of his Nation and this was a particularly uniqne experience for him, for those who listend to Kissingers dead-pan delivery that then, there was a slight trace of Sarcasm in his voice.” কিন্তু একজন সংবাদদাতা যখন প্রশ্ন তুলল শেখ মুজিবের দূরদর্শিতা ও “বিশাল প্রজ্ঞতা’ যদি এমনই তাহলে আপনি ১৯৭১ সনে বঙ্গোপসাগরে ৭ম নৌবহর পাঠানাের নির্দেশ দিয়েছিলেন কেন? কিসিঞ্জার এর উত্তর না। দিয়ে সম্মেলন কক্ষ ত্যাগ করলে তিন মিনিটের মধ্যেই সাংবাদিক

সম্মেলন শেষ হয়ে যায়। ৪. কোনাে দেশের রাষ্ট্র প্রধান যখন প্রথমবারের মতাে জাতিসংঘে ভাষণ। দিতে যান তখন প্রটোকল প্রথানুযায়ী তাকে সৌজন্যমূলকভাবে  ওয়াশিংটন সফরের আমন্ত্রণ জাননাে হয়। বাংলাদেশ ফরেন মিনিস্ট্রি থেকে বারবার অনুসন্ধান করা সত্ত্বেও শেখ মুজিবের ওয়াশিংটন সফর সম্পর্কে কোনাে সুস্পষ্ট ব্যবস্থা পাওয়া যাচ্ছিল না। শেষ মুহূর্তে যখন পরিষ্কার হয়ে গেল, যাই হােক না কেন শেখ মুজিব ওয়াশিংটনে তার বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য যাবেনই। তখন নিরুপায় হয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট হােয়াইট হাউজে মাত্র ১৫ মিনিটের জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ব্যবস্থা ও অনুষ্ঠানটি ছিল অত্যন্ত শীতল এবং ড. হেনরি কিসিঞ্জার ওয়াশিংটনে শেখ মুজিবের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতও প্রদান করেননি। বরং নিউইয়র্কে জাতিসংঘে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন এবং ছবি তােলেন। তাই লিপস্যুজ মনে করেন শেখ মুজিব সম্পর্কে বিশেষিত শব্দগুলাে ‘এ ম্যান অব ভাস্ট কনসেপশন’ ছিল এক ধরনের কথার কথা। ব্যাঙ্গোক্তি। faroper 131669: “Within a month after Kissinger visit to Dhaka, according to a high-level U.S. source then stationed at the American Embassy in Dhaka the first regular contacts with the coup planning cell bagan.”

৫. কিসিঞ্জারের বাংলাদেশ সফরের পূর্বে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশে ২৪শে জুন ১৯৭৪ তিন দিনের সফরে আসেন। তার সঙ্গে সর্বমােট ১০৭ জন সফর সঙ্গী ছিল। এক জন বিদেশী রাষ্ট্রনায়ককে যােগ্য সম্মান প্রদর্শনের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার যথাযথ ব্যবস্থা করেন, কিন্তু বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যা ও বর্বরতার ভয়াল দিনসমূহের ছবি ভুট্টোর আগমনের দিন সংবাদপত্রগুলাে প্রকাশ করে।

৫.১  ভুট্টোর ঢাকায় পেীছার পূর্বেই একটি অগ্রবর্তী দল ঢাকা আসে। তাদের মধ্যে সামরিক ও বেসামরিক গােয়েন্দাবাহিনীর লােক অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঢাকা এসেই তারা তাদের পুরনাে বন্ধুদের সঙ্গে ত্বরিত যােগাযােগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। কেননা এর পূর্বেই হলিডে পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আসলাম ভুট্টোর এজেন্ট হিসেবে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানীপন্থীদের ছিন্নভিন্ন ও হতােদ্যম শক্তি ও ব্যক্তিবর্গকে চাঙ্গা রাখার ব্যবস্থা করেছিল। প্রচণ্ড ভারত বিরােধিতার পাশাপাশি মুসলিম বাংলার স্বপক্ষে কার্যকর ব্যবস্থা ও আশাবাদ গড়ে তােলার কাজে এই ব্যক্তিটি চীনাপন্থীদের সহযােগিতা, বিশেষকরে হলিডে-চক্রের সহায়তায় অত্যন্ত সংগােপনে কাজ চালিয়েছিল; হলিডে চক্রের সহায়তায় ধরা পড়ার পূর্বে এই ব্যক্তি বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। যা নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্কের সৃষ্টি হয়। যাহােক, পাকিস্তানপন্থীদের মধ্যে ভুট্টোর লােকজন প্রচুর উপঢৌকন, অর্থ ও মদের বােতল দেদারে বিতরণ করে। ভুট্টোর আগমনের দিন ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে প্রচুর লােক আনা। হলাে। ভুট্টোর আগমনকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটনাে হলাে। মন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদার লাঞ্ছিত হন।

৫.২  ভুট্টো বাংলাদেশে আসার আগে আভাস দিয়েছিল সে একটা মিটমাট ও বােঝাপড়া চায়। সে জন্য বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মাহমুদ হারুনকে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে রেখে যাবার জন্য ভুট্টো তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল।

৫.৩  কিন্তু বাংলাদেশে আসার পর ভুট্টোর মনােভাব পরিবর্তিত হলাে কেন? কথিত, ভুট্টোর ‘এক ক্লাসের বন্ধু’ মশিউর রহমান ভুট্টোকে অনুরােধ করে পাঠান যে, সে যেন কোন অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর সাথে সব বিষয়ে ফয়সালা

করে। পিকিংপন্থী এক নেতা হােটেল ইন্টারকনে ভুট্টোর সঙ্গে আগত শীর্ষস্থানীয় কুটনীতিকদের মধ্যে ওয়াজিদ শামসুল হকের সঙ্গে আলােচনা করে বােঝাতে সক্ষম হন যে, বাংলাদেশে চীন পাক মিত্র শক্তির অবস্থান অচিরেই সুদৃঢ় হবে। সুতরাং শেখ মুজিবের সঙ্গে সমঝােতা না করে বরঞ্চ তাকে ও বাংলাদেশকে বর্তমান নাজুক পরিস্থিতিতে কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখতে হবে।

৫.৪ সুতরাং ভুট্টো বাংলাদেশের দায় দেনা ও পাওনা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, “I have not brought a blank cheque” ভুট্টোর সফর পুরােপুরি ব্যর্থ হলাে। এক বিদেশী সাংবাদিক যিনি ভুট্টোর সফর কভার করার জন্য ঢাকা এসেছিলেন, তিনি বললেন, “ভুট্টো ওয়ানটেড সামথিং ফর নাথিং”। কিন্তু ভুট্টো ফিরে গিয়ে বললেন, বাংলাদেশে তার তাৎপর্যপূর্ণ সফর অত্যন্ত ফলপ্রসূ। করাচীর এক দৈনিকে আভাষ দেয়া হলাে, বাংলাদেশে অচিরেই পরিবর্তন ঘটবে।

৬.  সফর যে ফলপ্রসূ তা অচিরেই বােঝা গেল। ১৯৭৪ সনের আগস্ট মাসে ভুট্টোর সফরের আট সপ্তাহ পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ আফগানিস্তান ও ইরান সফরে যান। ইরান-আফগান হয়ে মােশতাক জেদ্দায় গমন করেন। ঐ সময়ে ইরানে চীনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। মােশতাক গােপনে জেদ্দায় গিয়ে পাকিস্তানী দলের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এ সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাকে প্রকাশিত মঞ্চে নেপথ্যে বলা হয়“গত বছরে (১৯৭৪) ইত্তেফাকের একটি নিজস্ব সংবাদে বলা হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যের কোনাে এক স্থানে বাংলাদেশ সরকারের জনৈক নেতার সহিত চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের বিষয় আলােচনা হয় এবং চীনা নেতার তরফ হইতে এ ব্যাপারে বিশেষ অনুকূল সাড়া পাওয়া যায়। গত ২৪শে মে’র নিবন্ধে আমরা তদসম্পর্কে লিখিয়াছিলাম, “বাংলাদেশের সেই নেতা তখন নিজের নাম প্রচারে অস্বীকৃতি জানাইলেও আমরা পরবর্তীকালে জানিতে পারি যে, বাংলাদেশ সরকারের সেই নেতাটি ছিলেন আমাদের বিচক্ষণ বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ। আর অকুস্থলটি ছিল বাগদাদ”। তার আফগানিস্তান সফরকালে কাবুলে চীনা প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার। সাক্ষাৎকারের কথা জানা গিয়াছে। এটা অনস্বীকার্য যে, তিনি ‘ফরেন ট্রেড করার উপলক্ষে বেশ কিছু “ফরেন য়্যাফেয়ার্সের কাজও করিয়াছিলেন এবং তাহা করিতে গিয়া হয়ত কোন কোনও মহলের বিরাগভাজন হইয়াছিলেন।”১০ ৬.১ মােশতাকের এই সাক্ষাৎকারের পর পরই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো কাবুলের মিলিটারি একাডেমিতে এক ভাষণে TIR, “Soon some changes are going to be taken place in this region.১১ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পটভূমিকায় বঙ্গবন্ধুর আমলে তার প্রশাসন এবং প্রশাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের একটি তালিকা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সরকারের বিভিন্ন বিভাগে যেমন বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীতে উচ্চ পদস্থ অফিসারদের জীবন ধারা, কর্মপদ্ধতি এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক ও লবি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যাদি বঙ্গবন্ধু হতাকাণ্ডের উদ্ঘাটনে যথার্থভাবেই সহায়ক হবে সন্দেহ নেই। এ লক্ষ্যে আগ্রহী গবেষকদের দিক নির্দেশের জন্য বর্তমান উপ-অধ্যায়ের অবতারণা করা হয়েছে।

পুলিশ প্রশাসন

১.  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫০ সন থেকে ১৯৭৩ সন পর্যন্ত ইন্টারন্যাশন্যাল পুলিশ সার্ভিস (আই. পি.এস) পরিচালিত হয়েছে যার লক্ষ্য ছিল দ্বিবিধমিত্র দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার উন্নতি সাধন এবং প্রাে-আমেরিকান মানসিকতা তৈরিকরণ। ফলে এ সব গােয়েন্দা ব্যক্তিত্বের মধ্যে হতে সি, আই. এ. সহজেই তাদের বিশ্বস্ত লােক খুঁজে পেতে পারত। ষাট দশকের গােড়ার দিকে ইন্টারন্যাশনাল ডেভলপমেন্টস্ অফিস অব পাব্লিক সেফটি সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানাে হয় এবং বিদেশী পুলিশদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। সি, আই, এ দলিলে দেখা যাচ্ছে, সি, আই, এদের সঙ্গে কার্যকর যােগাযােগ রাখত।

১.১  জেনারেল আইয়ুব খানের শাসনামলে ১৯৬৩ সনের মার্চ মাস হতে বাঙালি পুলিশ অফিসারদের জন্য ইন্টারন্যাশন্যাল পুলিশ সার্ভিস স্কুলে ও ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের দ্বার উন্মুক্ত হয়। একই সাথে অফিস অব পাবলিক সেফটির কর্মকর্তারা ঢাকায় মােতায়েন হন। এদের মধ্যে রবার্ট জানুষ, লিও ক্রে, মন্টস, ওবভাল ডনার ঢাকার পুলিশ ও গােয়েন্দা ট্রেনিং তদারক করতেন। এদের অনেকেই ভিয়েতনামে কাজ। করতেন এবং সি, আই, এর নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। ১.২ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হিসাবে দেখা গেল ১১৩ জন পুলিশ কর্মচারী আমেরিকায় ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন এবং ইনপােলসে’ ট্রেনিং নিয়েছে। এদের মধ্যে চল্লিশ জন ছিলেন ইনটেলিজেন্সের অফিসার এবং হিসাবে। অনুযায়ী এদের সবারই সি, আই. এর সঙ্গে যােগাযােগ ছিল।

১.৩  বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত পুলিশ কর্মকর্তা মার্কিনীদের এ সব প্রশিক্ষণে যােগদান করেছিল তাদের মধ্যে এ, বি, এস, সফদর, আবদুল রহিম এস, এ. হাকিম, মুসা মিয়া চৌধুরী, সৈয়দ আমির খসরু, এম. এন. হুদা, এ.কে, এম, মােসলেহ উদ্দিন, আবু সৈয়দ শাহজাহান, এ. এম. এম. আমিনুর রহমান, গােলাম মাের্শেদ, আলী মােহম্মদ জামসেদ, আব্দুল খালেক খান, এ. এইচ. নূরুল ইসলাম, জাফরুল হক, খন্দকার গােলাম মহিউদ্দিন প্রমুখ।৪

২. খাজা মুহাম্মদ কাইসার ঢাকার নবাব বাড়ির ছেলে এবং ভারত ভাগের পূর্বে ইম্পিরিয়াল পুলিশে কর্মরত ছিলেন। পাকিস্তান আমলে তিনি ফরেন সার্ভিসে ঢুকে পড়েন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কাইসার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে চীনে কর্মরত ছিলেন এবং ঐ সময় মার্কিন-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের হয়ে তিনি চীনের মাও সেতুঙ-চৌ এন লাই-এর সঙ্গে কিসিঞ্জারের মিটিং-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। চৌ এন লাই-এর সঙ্গে তার হদ্যতা ছিল, হৃদ্যতা ছিল। জুলফিকার আলী ভুট্টো ও কিসিঞ্জারের সাথে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অনেক পরে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে অপশন প্রদান করলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাকে বার্মায় রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেন।

২.১ রেঙ্গুনে কাইসারের খুব একটা কাজ ছিল না। সে জন্য তিনি প্রায়ই ঢাকায় আসতেন এবং হােটেল পূর্বানীতে আসর জাকিয়ে বসতেন।

২.২ কাইসারের বৈঠকে যারা যােগ দিতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহিম, এস, এ. হাকিম, মুসা মিয়া চৌধুরী, আমির খসরু, এম, এন, হুদা, এ. কে, মুসলেহ উদ্দিন, আবু সৈয়দ শাহাজাহান, গােলাম মুরশেদ প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সব পুলিশ কর্মচারীরা বাংলাদেশ বিরােধী কাজ করতেন। “আমি কাইসারের আসরে গিয়ে এই সব ইনটেলিজেন্স। অফিসারের দেখা পেতাম। আগেই বলা হয়েছে যে, কাইসার এই সব দলের পাণ্ডা। তার আসরের সবাই ছিলেন মুজিব বিরােধী।

৩. বঙ্গবন্ধু ন্যাশনাল সিকুউরিটি ইনটেলিজেন্স বা এনএস, আই নামে বাংলাদেশের ইনটেলিজেন্সির নামকরণ করলেন এবং ডিরেক্টরের দায়িত্বে নিয়ােগ করলেন এ. বি. এস, সফদরকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সফদর ও আবদুর রহিম ওয়াশিংটনের আমেরিকান পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য গমন করেন। পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা চলাকালে সেদিন যারা প্রবাসে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের অধিকাংশই তখন দেশে ফিরে না এসে প্রবাসেই আন্দোলনে যােগদান করেন। এদের মধ্যে এই দুই জন দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং পাক হানাদার বাহিনীর অধীনে চাকুরীতে যােগদান করেন। সফদর পাকিস্তান সামরিক জান্তার অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে ১৯৭০ সনে কেন্দ্রীয় ইনটেলীজেন্সির পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। নির্বাচন সম্পর্কে সফদরের রিপােট ছিল আওয়ামী লীগ শতকরা ৬০টি আসন পাবে। নির্বাচনের ফলাফল ভ্রান্ত প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা ব্যুরাের প্রধান এন, এ. রিজভীর বিশ্বস্ততা তিনি হারাননি। সে জন্য দেখা যায়, বাংলাদেশের যুদ্ধের সময়ও এই বিশ্বস্ত বাঙালিকে’ কাউন্টার ইনটেলিজেন্সি’র প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান হয়।

৩.১  এ.বি, এস, সফদর এনটেলিজেন্স বিভাগের কাজে যােগদান করেন আর কাউন্টার ইনটেলিজেন্সের বিশিষ্ট কর্মকর্তা হিসেবে আবদুর রহিম তার দক্ষতা প্রমাণে তৎপর হন। রাজাকার বাহিনীর পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আবদুর রহিম।৮

৩.২  ১৯৬৯-এর আগরতলা ষড়যন্ত্রের মামলায় এ, বি এস, সফদর শেখ মুজিবকে ফাঁসানাের জন্য যাবতীয় খবরাদি সংগ্রহ করেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাক সরকার যে ব্রিফ তৈরি করেছিলেন সেটি ছিল সফদরের সংবাদের উপর ভিত্তি করেই। যারা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় উপস্থিত ছিলেন তারা দেখেছিলেন যে সফদর নিজের হাতে ব্রিফকেস। নিয়ে প্রতিদিন কোর্টে যেতেন। বঙ্গবন্ধু এই সফদরকেই গুরুত্বপূর্ণ পদে উন্নীত করলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর মােশতাক সফদরকে এন.এস, আই ডাইরেক্টর জেনারেল পদে প্রমােশন দিলেন।

৩.৩ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রেনিং প্রাপ্ত আবদুর রহিমকে বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েট প্রধান হিসেবে নিয়ােগ করেন, যিনি ইয়াহিয়া খানের। রাজাকার বাহিনীর প্রধান হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কাজ পরিচালনা করতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েটের প্রায়। সকলই যখন অপসৃত অথবা বিদেশে সেই সময় আবদুর রহিম। মােশতাকের পাশে স্বগৌরবে উপস্থিত। অক্টোবরে পার্লামেন্ট সদস্যদের সমাবেশে মােশতাকের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে ‘নােট’ নেবার জন্য বঙ্গভবনে তিনি প্রফুল্লচিত্তে উপস্থিত ছিলেন। জিয়াউর রহমানের সময় তিনি পদোন্নতি পেয়ে সংস্থাপন বিভাগের সচিব। নিযুক্ত হন। তার খুঁটির জোর ছিল এমনি পাকা।

৪. বঙ্গবন্ধু তাদের অতীত সম্পর্কে জ্ঞাত ছিলেন কিনা এ বিষয়ে সংশয় থাকলেও একটি কথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে বঙ্গবন্ধু কর্মক্ষম প্রত্যেক ব্যক্তিকে জাতীয় স্বার্থে কাজে লাগাতে চেয়েছেন। সে জন্য তাদের। অতীতকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু মাথা ঘামিয়েছেন বলে মনে হয় না। তাই দেখা যায় সফদর ও আবদুর রহিমের মতাে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে বঙ্গবন্ধু। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ গােপনীয় দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। অবশ্য এদের। নিয়ােগের বাস্তব অবস্থাও দেশে তৈরি হয়েছিল। স্বাধীনতার পর উগ্র ডান ও বামপন্থীদের সশস্ত্র আক্রমণ, খুন, হত্যা, ডাকাতি ইত্যাদি। মােকাবিলায়, দেশে শান্তি-শৃঙ্খলার স্বার্থে বঙ্গবন্ধু নিরুপায় হয়ে এই সমস্ত অভিজ্ঞ অফিসারদের সাহায্য নিতে শুরু করেন এবং ফলে তাদের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করতে হয়।

৪.১  বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন এই সব কলাবােরেটর অফিসারদের চাকুরিতে পুনর্বাসিত করার ফলে তারা তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবেন, নিষ্ঠা ও আনুগত্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবেন।

৫. মিঃ তসলিম উদ্দিন পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স দপ্তরে উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ছিলেন। কোনাে এক সময়ে তসলিম উদ্দিন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে সেন্টোর ইনটেলিজেন্স বিভাগে কাজ করতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে তিনি আই. জি. পির পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং ২৫শে মার্চ তিনি ঐ পদে ইস্তাফা দেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে তাকে হােম সেক্রেটারির পদে নিয়ােগ করে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তসলিম উদ্দিন কিছুদিন পর চাকুরিতে ইস্তাফা দেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর খন্দকার মােশতাক আহমদ তসলিমউদ্দিনকে পুনরায় হােম সেক্রেটারির পদে নিয়ােগ করেন। তবে এ কথাও প্রকাশিত যে তসলিম উদ্দিন ছিলেন। নির্ভীক ও স্পষ্টবাদী।

৬. বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এম, এন, হুদা আর একজন বেনিফিসিয়ারি। ১৯৬৩ সনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ গ্রহণ করেন এবং পাকিস্তান। স্পেশাল ব্রাঞ্চের পদস্থ কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের। স্বাধীনতার পর এন, এস, আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে সফদরের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে কাজ করতে থাকেন।

লিজে লিখেছেন, ১৯৭৬ সনের জুন মাসে তিনি এন, এস, এস, আই হেড কোয়ার্টারে এক সাক্ষাকারে হুদাকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তারা বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্পর্কে জানতেন কিনা অথবা হত্যায় তারা জড়িত ছিলেন কিনা? লিফজ TICE , “Hoda laughed and said the question was a very very clever one. But he would not answer.”) ১০

৭. এ, এম, আমিনুর রহমান ১৯৬৯ সনের ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমির গ্রাজুয়েট। ১৯৭০ সনে পাকিস্তান আর্মির প্যারা মিলিটারি ফোর্স হিসেবে আলবদর বাহিনী সংগঠিত হচ্ছিল। আলবদর বাহিনীর কমান্ড কাউন্সিলের মওলানা মান্নানের সঙ্গে মত ও পথের দিক থেকে তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর ঢাকা মেট্রোপলিটান পুলিশ ফোর্সের তিনি কমিশনার নিযুক্ত হন।১১

৮.  এ, কে, এম, মুসলিহ উদ্দিন ১৯৭১ সনে মুসলিম লীগ ও সামরিক জান্তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে কাজ করেন। তিনি ১৯৬৮ ও ১৯৬৯ সনে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আই, পি, এ, ও ইনপেলস্ থেকে গ্রাজুয়েশন লাভ করেন। তিনি এস, এস, আই-এর পদস্থ ব্যক্তি হিসেবে কাজ পরিচালনা করতে থাকেন।

৯. আমির খসরু ১৯৭১ সনের একজন কলাবােরেটর। বঙ্গবন্ধু তাকে পুলিশ ক্যাডার হতে সরিয়ে এনে বাংলাদেশের সেই সময়ের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সাহায্য ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ে যুগ্ম সচিব পদে নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরপরই তাকে পদোন্নতি দিয়ে সচিব করা হয়।

১০.  মুসা মিয়া চৌধুরী যিনি এন, এস, আই-এর ডেপুটি ডাইরেক্টর- তার সম্পর্কে লিফজ বিস্তারিতভাবে দেখিয়েছেন যে, সি, আই, এর আর্থিক সাহায্যে পরিচালিত ইনপােসসে, প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী এই বক্তিটি রায়ট কট্রোল কাউন্টার রেভ্যুলেশন’ ও ‘পুলিশ টেরর’ বিষয়াদি সম্পর্কে কিরূপ উচ্ছসিত প্রশংসায় বিগলিত ছিলেন এবং এই সমস্ত আইডিয়া স্বদেশে বাস্তবায়ন করতে তারা কিরূপ পারঙ্গমতার পরিচয় প্রদান করে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মুসা মিয়া চৌধুরীকে প্যারামিলিটারি আর্মস ব্যাটেলিয়ান সংগঠনের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।১২

১১.  সালাহউদ্দিন আহমদ ১৯৬৮-৬৯ সনে আইয়ুব-মমানেমের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন ও ঐ সময়ে শ্রমিক আন্দোলন দমনের জন্য কর্তৃপক্ষের সুনাম অর্জন করেন। কথাবার্তায় অভিজাত এবং কঠোরতাসম্পন্ন এই ব্যক্তিত্ব দেশ স্বাধীন হবার পর রােমে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি (ফান্ড) প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি স্বরাষ্ট্র সচিবের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের হাজার হাজার অনুসারীদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন।

১২.  পুলিশ প্রশাসনের আলােচনায় ই.এ. চৌধুরী প্রসংগ এসে যায়। দক্ষ ও কর্মক্ষম পুলিশ অফিসার হিসেবে ই. এ. চৌধুরীর সুনাম রয়েছে। পাকিস্তান আমলে, পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর সরকারে তার পদোন্নতি অনেককে ঈর্ষার বিষয়ে পরিণত করেছিল। নিষ্ঠাবান, প্রতিশ্রুতিশীল এবং স্মার্ট এই উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার বাংলাদেশের পুলিশ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন প্রত্যুষে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মনসুর আলী সংঘটিত কুদেতার বিরুদ্ধে তাকে পাল্টা যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে মনসুর আলী সাহেবের পুত্র এক সাক্ষাঙ্কারে বলেছেন। ই. এ. চৌধুরীর উজ্জ্বল সাফল্যময় জীবনে ঐ একটি মাত্র অপ্রকাশিত ব্যর্থতা যে, তিনি ১৫ই আগস্টে কিছুই করতে পারেননি। অবশ্য সে সময় তিনি ছিলেন ডি আই জি স্পেশাল ব্রাঞ্জ। লিফজ লিখেছেন, আমেরিকান কন্টিনেন্টাল গ্রেইনস’ নামক একটি ফার্মের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে শফি আহমদ চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পি-এল ৪৮০-এর অধীনে আমদানিকৃত বিপুল পরিমাণ গম হ্যান্ডেল করেন। এতে তার ভাগ্যের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। আজ তিনি বাংলাদেশের রকফেলার’। আমেরিকার বশংবদ শফি আহমদ চৌধুরীর ভাই হলেন ই. এ. চৌধুরী।১৩ এবং কিসিঞ্জার উল্লেখিত কাজী জহিরুল কাইউমের নিকট আত্মীয়। ১৩. অধিকাংশ পুলিশ অফিসার যারা পাক হানাদার বাহিনীর যযাগসাজশে মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের বিরুদ্ধে ‘পিছু নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, স্বাধীনতার পর তারা মানসিক দিক থেকে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন। স্বাধীনতার পরপরই তাদের উপর মুক্তি বাহিনীর খবরদারি ভিতরে ভিতরে পুলিশ প্রশাসনের র্যাক এন্ড ফাইলকে অসন্তুষ্ট করে তােলে। তাদের এ ধরনের অসন্তুষ্ট মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ নানাভাবে ঘটেছে। দুস্কৃতিকারীদের পাকড়াও করার সরকারি নির্দেশ তারা ইচ্ছাকৃতভাবে মুক্তিযােদ্ধা বিশেষ করে আওয়ামী লীগ মুক্তিযােদ্ধাদের যেনতেন কারণে ধরে এনেছে, থানায় আটক করেছে এবং জনসমক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করার ব্যবস্থা নিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই পুলিশ প্রশাসনের থানা, মহকুমা বা জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর সরকার বিরােধীরা, অবৈধ, অত্র ধারী দল ও গ্রুপ নিরাপদ আশ্রয়ে তাদের গণবিরােধী নিষ্ঠুর কার্যকলাপ চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে ধ্বংস করার চেষ্টায় তৎপর থাকতে সমর্থ হয়েছে।

১৪.  এ সব কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যায় পুলিশ বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের অফিসারগণ ছিলেন নির্বিকার।

১৫. বঙ্গবন্ধু হত্যার পূর্বে রাত ১২ টার পর হতে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে তদানীন্তন পুলিশের আইজি নূরুল ইসলামের নেতৃত্বে ১১টি টিমের বিভিন্ন ব্রাঞ্চের লােক উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাদের এই সম্মিলিত শক্তি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রাক্কালে কোনােই কাজে আসেনি।১৪

বেসামরিক প্রশাসন

১.  বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রামকালীন সময়ে

১.১  বাঙালি সি, এস, পি অফিসারের সংখ্যা ছিল ১৮০ জন এবং ই, পি, সি, এস অফিসারের সংখ্যা ছিল ৯৫০ জন। বাঙালি সি, এস, পি অফিসারের মধ্যে মাত্র ১৩ জন মুক্তিযুদ্ধে মুজিব নগরের প্রবাসী সরকারের সঙ্গে যােগদান করেছেন।

১.২  অন্যান্য শ্রেণীভুক্ত অফিসারদের মধ্যে পি, এস, পির দুই জন অফিসার এবং ই, পি, সি, এস-এর হাতে গােনা কয়েকজন অফিসারসহ সর্বস্তরের মাত্র ৫০০ জন সরকারি কর্মচারী মুজিব নগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।২

২.  বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর প্রবাসী সরকার ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলে শুরু হয়ে যায় অলিখিত প্রশাসনিক সংকট। পাক বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য নয় জন প্রাক্তন সি, এস, পি অফিসারসহ ছয় হাজার কর্মচারী চাকুরিচ্যুত হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার ও বাংলাদেশে চাকুরীরত ঐ সময়ের অফিসারগণ সব সময়ই আতঙ্কগ্রস্ত ছিলেন। আমলারা বলতে শুরু করলেন ঃ সংবাদ পত্র দেখে তারপর অফিসে যেতে হবে। কেননা কোনদিন পর্যন্ত তিনি চাকুরীতে থাকবেন কি থাকবেন না তা তাদের জানা নেই।

২.১ মুজিব নগর প্রবাসী সরকারের কর্মরত অফিসারদের প্রতি স্বাভাবিক সহমর্মিতা ও দুর্বলতা থাকার কারণে প্রতিষ্ঠিত সার্ভিস রুলকে নাকচ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অফিসারদের পদোন্নতি ও সুযােগ-সুবিধা দেয়া হয়।

২.২ অন্যদিকে প্রাক্তন সি, এস, পি অফিসার ও ই, পি, সি, এস অফিসারদের মধ্যে চাকুরির স্তর বিন্যাস ও কাঠামাে নিয়ে বিরােধ অব্যাহ থাকে।

৩. ড. মােজাফফর আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত প্রশাসন ও চাকুরি পুনর্বিন্যাস কমিটি প্রাক্তন সি, এস, পি সিস্টেমকে ‘আর্টিফিশিয়েল ইনস্টিটিউশন’ নামে আখ্যায়িত করে সকল বড় বড় পদ সি, এস, পি অফিসারদের প্রাপ্য এই প্রথা ও নিয়মকে বাতিল করে দেয়। এতে সি, এস, পি অফিসারগণ ফুসতে থাকেন। তারা কোনাে কাজ না করে আডড়া মেরে, গালগল্প করে সময় কাটাতে থাকে।

৪. সি, এস, পি অফিসারদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সবচেয়ে বেশি আস্থা যার উপর স্থাপন করেছিলেন তিনি হলেন জনাব রুহুল কুদ্স। জেনারেল ইয়াহিয়া দুর্নীতির দায়ে যে সমস্ত অফিসারদের চাকুরীচ্যুত করেন তাদের মধ্যে রুহুল কুদ্স অন্যতম। বাঙালি উচ্চ পদস্থ অফিসারকে প্রশাসনিক উচ্চ পদ হতে হটানাে হচ্ছে মনে করে সে দিনের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জোয়ারে চাকুরিচ্যুত উক্ত অফিসারগণ বাঙালির সমবেদনা লাভ করেন। এ বিষয়ে তদানীন্তন মন্ত্রী প্রফেসর শামসুল হকের নিকট এ সমস্ত অফিসারদের উপর কেন অন্যায় করা হচ্ছে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, “এদের দুর্নীতির বহর দেখলে তােমরা স্তম্ভিত হয়ে যাবে।” জেনারেল ইয়াহিয়ার দোসর হিসেবে সেদিন তার কথা বিশ্বাসযােগ্য মনে হয়নি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু রুহুল কুদ্সকে সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে নিয়ােগ প্রদান করেন। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই দেখা গেল, এক অজ্ঞাত কারণে বঙ্গবন্ধু তার নিকট ফাইল প্রেরণ বন্ধ করেছেন। ১৯৭৪ সনের দুর্ভিক্ষে দেশের হাজার হাজার মানুষ যখন মারা যাচ্ছে তখন রুহুল কুদুসের গুলশানের প্রাসাদ তৈরি হচ্ছে। অত্যন্ত বিশ্বস্ত রুহুল কুদুসের এই অসময়ােচিত আচরণ বঙ্গবন্ধুকে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের প্রতি অবিশ্বাসী ও হতাশ করে তােলে। আর একজন স্বনামধন্য প্রাক্তন সি, এস, পি অফিসার হলেন শফিউল আযম। স্বাধীনতা সংগ্রাম কালীন সময়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি ছিলেন। পাক হানাদার বাহিনীর আদেশ নির্দেশ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি পালন করেছেন। স্বাধীনতার কিছুকাল পূর্বে তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়। ১৯৪৯ সনে সি, এস, পি পরীক্ষায় তিনি সমস্ত পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম হন। পাক হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশকারী এই প্রবীণ’ ও ‘মেধাবী’ সি, এস, পি অফিসার স্বাধীন বাংলাদেশে চাকুরী না পেয়ে গােপনে বঙ্গবন্ধু বিরােধী সি, এস, পি’দের পরামর্শ দাতার ভূমিকা গ্রহণ করলেন। বােধগম্য কারণে তার ভূমিকা। বঙ্গবন্ধুর স্বপক্ষে ছিল না। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পরই এই জ্ঞানী অফিসারটি চাকুরিতে উচ্চাসন লাভ করেন এবং চাকুরিতে নিয়ম বিরুদ্ধে পদোন্নতি সম্পর্কিত রিভিউ কমিটির প্রধান হয়ে বঙ্গবন্ধুর আমলের পদস্থ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যথাযােগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ ও এডমিনিস্ট্রেশনকে ‘ক্লিন’ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠলেন। অচিরেই পাকিস্তানপন্থী অফিসারদের যথাযােগ্য আসন ও মর্যাদায় উন্নীত করে তিনি তাদের সমহিমায় পুনর্বাসিত করলেন।

৬.  স্বাধীনতার পরপরই পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক প্রশাসনিক কাঠামােকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জাতীয় কাঠামােতে রূপান্তরিত করা ছিল এক দুরূহ ব্যাপার। আমলাদের ভেতর মুক্তিযােদ্ধা-অমুক্তিযােদ্ধা, পাকিস্তান প্রত্যাবর্তকদের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিরসনও সহজসাধ্য ছিল না। বঙ্গবন্ধু এই সংকট নিরসন করতে গিয়ে কোনাে পক্ষেরই পূর্ণ আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হলেন না।

৭.  এ ছাড়া স্বাধীনতার কিছুকাল পরে যুবলীগের প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী প্রচার করতে লাগলেন যে আইয়ুব-মােনায়েমের আমলা দিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রশাসন চলতে পারে না। এ ধরনের প্রচার আমলাবাহিনীকে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধ অবস্থানে ঠেলে দেয়।

৮.  স্বাধীনতার মৌল লক্ষ্য শশাষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে চাইলে ডাক সাইটে আমলাগণ মুখে যাই বলুন না কেন ভেতরে ভেতরে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তারা বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠকদের মদদ জোগাতে থাকে। সরকারি যে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পূর্বেই তা ঢাকার সাধারণ লােকের মুখে মুখে শােনা যেত। এমন হতাে যে, গুরুত্বপূর্ণ কোনাে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত যার গুরুত্ব ও কার্যকারিতা নির্ভর করত গােপন কার্যক্রম বাস্তবায়নের উপর- তা পূর্বে প্রকাশ হয়ে পড়েছে এবং তাতে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছে।

৯. বঙ্গবন্ধু কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন আমার প্রশাসনের শতকরা ৮০ ভাগ কলাবােরেটর। সেই প্রশাসন বঙ্গবন্ধু সরকারের জন্য কোনাে ক্রমেই শুভ ছিল না।

১০. ১৯৭৪ সনে দেশে আর্থ-সামাজিক, আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটলে বঙ্গবন্ধু অভিজ্ঞ আমলাদেরকে কনফিডেন্স নেবার প্রয়াসে তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে উন্নীত করেন। বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল এই সমস্ত আমলারা তাদের পূর্বের বদনাম মােচন করার জন্য দেশ ও জাতির জন্য। যথাসাধ্য কাজ করবে এবং দেশ সেবায় অবদান রাখবে। কিন্তু বাস্তব। অবস্থায় প্রমাণিত হয়েছে পাক আমলের আমলাদের না ছিল কোনাে চরিত্র, ছিল কোনাে আদর্শ। ফলে বঙ্গবন্ধু এদের উপর ভরসা করে ঠকেছেন। বারবার।

১১. প্রশাসনকে গণমুখী, কার্যকর, জনগণের আস্থাভাজন করার জন্য বঙ্গবন্ধু। বললেন, “নতুন সিস্টেম চাই, সেক্রেটারিয়েট থেকে থানা পর্যন্ত প্রশাসনকে ভেঙ্গে ফেলতে হবে।” আমলাগণ সতর্ক হলাে। বঙ্গবন্ধু যখন প্রচলিত আমলাতন্ত্র বাতিল করে জনগণের নির্বাচিত। প্রতিনিধিদের হাতে প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেবার লক্ষ্যে। প্রথমবারের মতাে জেলা গভর্নরদের মনােনীত করলেন তখন আমলাগণ। ক্ষিপ্ত হলাে। জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণকালে আমি ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য করেছি, বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জেলার আমলাদের মধ্য থেকে যে সমস্ত গভর্নর। নিযুক্ত করেছিলেন তারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তারা মনে করতেন, তাদের। ডিগ্রেডেশন করা হয়েছে। লক্ষ্য করেছি জেলা গভর্নরদের প্রশিক্ষণ কোর্স উদ্বোধন কালে জনৈক কবি সি, পি-গভর্নর ছড়া লিখতেন টিপ্পনী করতেন। এবং হাসাহাসি করতেন।

১২. আর একটি কথা বলা এখানে একান্তই প্রয়ােজনীয় যে, ব্রিটিশ উত্তরাধিকারী সূত্রে পাওয়া স্টিলফ্রেমে বাঁধা আমলাতন্ত্র সব সময়ই। গণবিরােধী এবং গণবিচ্ছিন্ন। এরা জনগণের সেবক নয়, শাসক সেজে থেকেছে এবং থাকতে ভালােবাসে। সে জন্য বঙ্গবন্ধু ঘােষিত বাকশাল কর্মসূচির লক্ষ্য শশাষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপযােগী প্রশাসনিক পরিবর্তন সকল শ্রেণীর আমলাকে করেছে সতর্ক ও বিক্ষুব্ধ।

১৩.  এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের অভ্যন্তরে মার্কিন পন্থীদের আসন ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ়। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব রফিক উল্লাহ চৌধুরীর বাড়িতে সন্ধ্যার পর প্রায়ই জমতে জমজমাট আড্ডা। আওয়ামী লীগের মার্কিনপন্থী নেতৃবৃন্দ, ডালিম চক্র, শিল্পপতি, সাংবাদিক, অফিসার ও বিদেশী দূতাবাসের মেহমানদের সম্মিলিত আড্ডায় নানা কেচ্ছা কাহিনী। বিবৃত হতাে। শেখ মুজিবকে নিয়ে ক্যারিক্যাচার হতাে। ঠাট্টা হাসি। হতাে। তাদের টেবিলে দুর্নীতি, ষড়যন্ত্রের নিঘুম রাত কাটতে থাকে। … 

সামরিক বাহিনী।

১. ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জওয়ানদের সংখ্যা ছিল ৫৫ হাজার। তার মধ্যে পাকিস্তান প্রত্যাগত জওয়ানদের সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ান ও মুক্তিযুদ্ধে নতুন করে রিক্রুটদের মিলিয়ে সর্বমােট ছিল ২৭ হাজার। পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সংখ্যা ছিল ১১ শত। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর জওয়ানগণ এক কথায় বলতে গেলে রক্ষণশীল, ভারত বিদ্বেষী এবং স্বাধীনতা বৈরী মুসলিম বিশ্বের প্রতি অনুরক্ত ছিল।১

১.১  রক্ষীবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ হাজার।

১.২  মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিকগণও ভারত বিদ্বেষী ছিলেন। “Almost all members of the armed foreces who had balonged to the Libaretion Army had the feeling that the Indian Army Just walked into Bangladesh when we had already finished the job.” এ ধারণাকে সামনে রেখে তারা মনে করত বাংলাদেশের সশস্ত্র এক গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়কে ভারতীয় বাহিনী ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

১.৩  মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পিকিংপন্থী দল, উপদল, জাসদ, গণবাহিনী ও স্বাধীনতা বৈরী শক্তির সার্বক্ষণিক প্রচারে, সেনাবাহিনীর নিকট বিশ্বাসযােগ্য হয়ে ওঠে যে, ভারত তাদের সকল হাতিয়ার নিয়ে গিয়েছে। তাদেরকে অথর্ব, শক্তিহীন করে রাখা হয়েছে।

১.৪ এই ধারণার সাথে রক্ষী বাহিনী গঠন, ভারতীয় ট্রেনার দ্বারা রক্ষী বাহিনীর অফিসারদের প্রথমে সাভারে ট্রেনিং এবং পরবর্তীকালে রক্ষী বাহিনীর অফিসারদের ভারতের দেরাদূনে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানাে ইত্যাদি মিলিয়ে সেনাবাহিনীর মানসিকতার অবিশ্বাস ও ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।

১.৫ যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠন, উন্নয়নশীল কার্যক্রমের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রতিরক্ষা খাতে সমগ্র বাজেটের শতকরা ১৩ ভাগের বেশি বরাদ্দ করা জাতীয় নীতির সহায়ক নয় বলে বিবেচিত হয়েছিল। আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায় না রেখে সেদিন সেনাবাহিনীর ভেতর ও বাইরে থেকে প্রচারিত হতে থাকল যে, বঙ্গবন্ধু ও তার সরকার সেনাবাহিনীকে দুর্বল ও পরনির্ভরশীল করে রাখতে চায়। সাধারণ জোয়ান অফিসারবৃন্দ পাকিস্তান আমলে তাদের প্রাপ্ত সুযােগ-সুবিধার তুলনামূলক বিচার করে মানসিকভাবে এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিল যে, মুজিব ভারতের নির্দেশে সেনাবাহিনীকে পশ্চাদপদ, নিরুপায় ও দুর্বল করে রেখেছে। ফলে যে সব মিথ্যাচার। বাজারে গুজব আকারে চালু ছিল তাতেই তারা বিশ্বাস স্থাপন করত।

১.৬ সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান ভারত বিদ্বেষী মনােভাব ক্রমান্বয়ে মুজিব বিরােধী মনােভাবে রূপান্তরিত হয়।

১.৭  মুজিব বিরােধী এই মনােভাবের আরাে একটি কারণ ছিল আর তাহলাে পাকিস্তানী প্রত্যাগত সামরিক জওয়ান ও অফিসারগণ পাক কনসেনট্রেসন ক্যাম্প’-এ যে ১৮ মাস আটক ছিলেন সে মাসগুলাের বেতন দাবী করেন। বলাবাহুল্য বঙ্গবন্ধুর সরকার সে দাবী প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে সেনাবাহিনী ও জওয়ানদের স্বার্থহানি হওয়ায় তাদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়।২

১.৮  বঙ্গবন্ধুর সরকার অবিভক্ত বাংলার সিভিল সার্জেন্ট ও প্রাক্তন পূর্ব । পাকিস্তান সরকারের সচিব জনাব এ, রবকে প্রধান করে জাতীয় পে কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেতনের স্কেল নির্ধারণের পরামর্শ দেয়া হয়। কমিশন তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে বুলগেরিয়া, যুগােশ্লাভিয়া ও পূর্ব জার্মানিতে সে দেশের পে পলিসি সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ করার জন্য প্রেরণ করেন। সে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন জিয়াউর রহমান। কমিশন পরামর্শ প্রদান করে এভাবে “Bangladesh should have pay policy involving sharing of hardship in an equitable manner.” অথচ এই পে কমিশনের একজন প্রভাবশালী সদস্যরূপে জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর জন্য যে গ্রেডের ও পে স্কেলের সুপারিশ করেন তা সেনাবাহিনীর বিক্ষোভকে আরাে উত্তপ্ত করে তােলে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর মনােভাব আরাে বিরূপ হয়ে ওঠে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর মাথা গরম করার জন্য এই কৌশল গ্রহণ করেছিলেন বলে সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অফিসারদের কেউ কেউ মনে করেন।

১.৯ বঙ্গবন্ধুর আমলে প্রতিরক্ষা খাতে সমগ্র বাজেটের মধ্যে ১৩ ভাগ ব্যয় হতাে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর জিয়া ক্ষমতায় এলে প্রতিরক্ষা খাতের বাজেটের পরিমাণ দাঁড়ায় সমগ্র বাজেটের ২৫-৩০% ভাগ।

১.১০  সেনাবাহিনীর মাথাব্যথার কারণ ছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী গঠন। ১৯৭২ সনে রক্ষীবাহিনী গঠনের পর তাদের সদস্য সংখ্যা ১৯৭৫ সনে ২০ হাজারে উন্নীত হয়। প্রচার করা হতে থাকে রক্ষীবাহিনীকে নতুন নতুন গাড়ি ও অস্ত্র দ্বারা সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। প্রকৃত প্রস্তাবে জনশৃংখলার স্বার্থে প্যারামিলিটারি বাহিনী হিসেবে রক্ষীবাহিনী গঠন করা হয়েছিল। তাদের কোনাে আর্মড কোর ও আর্টিলারি ছিল না। বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে সেনাবাহিনীকেও গড়ে তােলার প্রয়াস নিয়েছিলেন। তিনটি ট্যাংকের জায়গায় মিশর থেকে আরাে ৩০টি ট্যাংক নিয়ে এলেন। সােভিয়েত থেকে এল এক স্কোয়াড্রন মিগ-২১। বিভিন্ন দেশ থেকে সামরিক সরঞ্জাম আসতে শুরু করে। বিগ্রেডগুলােকে ডিভিশনে উন্নীত করার অনুমােদন তিনি প্রদান করেছিলেন। এতদসত্ত্বেও ব্যাপক মিথ্যা প্রচারে সেনাবাহিনীতে বঙ্গবন্ধু বিরােধী মনােভাবের প্রসার ঘটতে থাকে। এ মনােভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে সেদিনের চতুরতা ও খলতা সম্পর্কে সামরিক বাহিনীর পদস্থ এক অফিসার লিখেছেন“অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামে একটি নতুন আধাসামরিক বাহিনী গঠন করা হলাে। রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে বিভিন্ন কথা আছে—পক্ষে ও বিপক্ষে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে যেয়ে এ বাহিনী যে কার্যপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল, তা বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। তাছাড়া রক্ষী বাহিনী ভারত সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত বলে অনেকে মিথ্যা প্রচার করতাে। রক্ষীবাহিনীর জলপাই সবুজ রংয়ের পােশাক এ অপপ্রচারে সাহায্য করতাে। আর সেনাবাহিনীতে রক্ষীবাহিনী সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল অতন্ত বিরূপ। সেনাবাহিনীতে প্রচার হতে লাগলাে যে, রক্ষীবাহিনীকে আধুনিক অস্ত্র দেয়া হচ্ছে, যা সেনাবাহিনীকে দেয়া হচ্ছে না, রক্ষীবাহিনীকে নতুন গাড়ি দেয়া হচ্ছে, তাদের রেশন ও বেতন সেনাবাহিনীর চাইতে বেশি। এ রকম প্রচারণাও ছিল যে বঙ্গবন্ধু সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে রক্ষী বাহিনীকেই দায়িত্ব দেবেন। প্রকৃতপক্ষে এ সব প্রচারণার কোনােটাই সত্য ছিল না। অনেকটা ছিল উদ্দেশ্যমূলক, আর কিছুটা ভুল বুঝাবুঝির ফল। আর সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চপদস্থ অফিসার এ প্রচারণার নেতৃত্বে ছিল। পয়লা নম্বরে ছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান জিয়াউর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর হত্যার পরপর যখন রক্ষীবাহিনী বিলুপ্ত হয়ে সেনাবাহিনীর সাথে একীভূত হয় তখন সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত রক্ষীবাহিনীর একীভবন সম্পর্কিত একটি সভায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। জিয়াউর রহমান তখন সেনাবাহিনীর প্রধান বা চীফ অব আর্মি স্টাফ। জিয়াউর রহমান উক্ত সভায় এক পর্যায়ে বলেছিল, “রক্ষীবাহিনী সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই ভ্রান্ত ছিল। এখন দেখছি তাদের কিছুই নেই। তাদের অস্ত্র সেনাবাহিনীর চাইতে অনেক নিম্নমানের। গাড়ি এবং অন্যন্য প্রয়ােজনীয় সরঞ্জামও তাদের প্রয়ােজনের তুলনায় অনেক কম ছিল।” অনিচ্ছাসত্ত্বেও জিয়াউর রহমান উক্ত স্বীকারােক্তি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রক্ষীবাহিনী ছিল একটি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বাহিনী বা আধা-সামরিক বাহিনী। সেনাবাহিনীর মতাে ট্যাংক, কামান, বিমান-বিধ্বংসী কামান, ট্যাংক-বিধ্বংসী কামান, মাইন ইত্যাদি তাদের থাকার কথা নয়, ছিলও । নতুন বাহিনী হিসেবে কিছু নতুন গাড়ি তাদের দেয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় তা ছিল অপ্রতুল। সে তুলনায় সেনাবাহিনীকে অনেক অনেক বেশি নতুন গাড়ি দেয়া হয়েছিল, যদিও সেনাবাহিনীর জন্যও তা যথেষ্ট ছিল না। রেশন ও বেতনের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী ও রক্ষী বাহিনীর মধ্যে কোনাে তারতম্য ছিল না। স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীর প্রথম চিফ অব স্টাফ নিয়ােগ নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। যুদ্ধকালীন সময়ে জিয়াউর রহমানের কথাবার্তা ও কার্যকলাপে তার রাজনীতি বিরােধী মনােভাব ধরা পড়েছিল। তাছাড়া ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নেতিবাচক। তাই জিয়াউর রহমান সিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও তাকে ডিঙিয়ে কে, এম শফিউল্লাহকে সেনাবাহিনীর প্রধান বা চিফ অব স্টাফ নিয়ােগ করা হয়। সরকার সশস্ত্র বাহিনীত্রয়ের প্রধান সেনাপতি নিয়ােগে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এটা চিরাচরিত নিয়ম।

জিয়াউর রহমানকে ডিঙিয়ে কে, এম শফিউল্লাকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিয়ােগ করা সঠিক হয়েছিল কিনা জানি। তবে যা সঠিক হয়নি বলে মনে করি, তা হচ্ছে অতঃপর জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে রাখা। জিয়াউর রহমানকে যদি দীর্ঘদিন ধরে সেনাবাহিনীর দুই নম্বর; অর্থাৎ উপ-প্রধান পদে রেখে কে, এম শফিউল্লাহ- এর সাথে একটার পর একটা পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল বানানাে যায়, তাহলে তাকে এক নম্বর; অর্থাৎ সেনাবাহিনী প্রধান না করার যুক্তি অনেকটা দুর্বল হয়ে যায় বৈকি! জিয়াউর রহমান স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ ছিল। যে কেউ তার জায়গায় হলে অনুরূপভাবে ক্ষুব্ধ হতাে, কিন্তু সে খুব একটা ধরা দিতাে না। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে তােফায়েল আহমদ পর্যন্ত সকলের সাথে সে নিয়মিত সাক্ষাৎ করতাে। সকল উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক নেতার বাড়ি মাঝে মাঝে সে যেতাে তার আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য। এটা ছিল তার বাইরের রূপ। ভেতরে ভেতরে সে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার এবং অপপ্রচার চালানাের জন্য সে বিভিন্ন স্তরে কাজ শুরু করে। অফিসারদের মধ্যে কাজ করার জন্য ব্যক্তিগতভাবে তার প্রতি অনুগত, এমন কিছু অফিসারকে সে নিয়ােগ করে। অনুরূপভাবে জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকদের মধ্যে কাজ করার জন্য কয়েকজন জেসিওকে নিয়ােগ করে। সেনাবাহিনীতে অশুভ কিছু ঘটলে তার দায়িত্ব পড়তে কে, এম শফিউল্লাহর কাধে। আর শুভ কিছু ঘটলে সাথে সাথে সেনাবাহিনীতে প্রচার হয়ে যেতাে যে, তা জিয়াউর রহমানের কারণেই ঘটেছে। সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে মীর শওকত আলী, এম, এ, মঞ্জুর এবং নূরুল ইসলাম শিশু জিয়াউর রহমানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। ভারত বিরােধী প্রচারণায়ও এরা সক্রিয় ছিল। ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের নায়কদের সাথেও এদের যােগাযােগ হয় এবং ষড়যন্ত্রকারীরা অভিন্ন লক্ষ্যে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে।

অন্যদিকে লেঃ কর্নেল আবু তাহের ও কর্ণেল জিয়াউদ্দিন (জাসদের মেজর জিয়াউদ্দিন নয়) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আদর্শে তাড়িত হয়ে সেনাবাহিনীতে কিছু কিছু শৃঙ্খলা বিরােধী কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। উভয়েই এম, এ, মঞ্জুরের সাথে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিয়েছিল। উভয়েই বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আবু তাহের মারাত্মকভাবে আহত হয়ে একটি পা হারায়। দক্ষ তরুণ অফিসার হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে জিয়াউদ্দিনের যথেষ্ট সুনাম ছিল। সে ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে, আর আবু তাহের ছিল বেলুচ রেজিমেন্টে। স্বাধীনতার পর জিয়াউদ্দিন ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগ্রেডের কমান্ডার থাকাকালীন সময় তার একটি বিতর্কিত নিবন্ধ প্রয়ােজনীয় অনুমােদন ব্যতিরেকে ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’তে ছাপা হয়। নিবন্ধে তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে জিয়াউদ্দিন বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের সমালােচনা করে। এ নিয়ে বিভিন্ন মহলে হৈ চৈ হয়। বঙ্গবন্ধু তখন বিদেশে। দেশে ফিরে এসে তিনি জিয়াউদ্দিনকে ডেকে বুঝাতে চেষ্টা করেন যে তার এ কাজটি সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলাভঙ্গের আওতায় পড়ে এবং সে লিখিতভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেই বিষয়টি শেষ হয়ে যাবে। যাহােক, শেষ পর্যন্ত জিয়াউদ্দিন দুঃখ প্রকাশ করেননি এবং সে চাকুরিচ্যুত হয়। পরবর্তীকালে জিয়াউদ্দিন প্রয়াত কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বাধীন গুপ্ত সংগঠন পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টিতে যােগ দেয় এবং সম্ভবত এখন সেই গুপ্ত সংগঠনের একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছে। আবু তাহেরও সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত হয়ে বেসামরিক সরকারি চাকুরিতে যােগ দেয়। সেনাবাহিনীতে থাকতেই সে জাসদের সাথে সম্পৃক্ত হয়। সেনাবাহিনীতে জাসদের সংগঠন সৈনিক সংস্থা তারই সৃষ্টি, যার সাহায্যে যে ১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বরের তথাকথিত সিপাই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়ে জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতায় আনেন। পরবর্তীকালে জিয়াউর রহমান তাকে ফাঁসি দেয়। বলাবাহুল্য আবু তাহেরের মাধ্যমে জাসদের সাথেও জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল। এদিকে মুক্তিযােদ্ধারা সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে দুইবছরের জ্যেষ্ঠত্ব নিয়ে নেয়। এর ফলে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগমনকারীগণ বিক্ষুব্ধ হয়। অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধারা সাময়িকভাবে সন্তুষ্ট হলেও অন্যান্য কারণে তাদের অসন্তোষ বাড়তে থাকে; কারণ তাদের আরাে অনেক বেশি প্রাপ্য ছিল বলে অনেক মুক্তিযােদ্ধা মনে করতাে। ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিক এটাই চেয়েছিল।

অসন্তোষ, ক্ষোভ, বিক্ষোভ, ভুল বুঝাবুঝি, গ্রুপিং বা দলাদলি সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এ রকম পরিস্থিতিতে তাদের সরকার বিরােধী প্রচারণা চালাতে সুবিধে হয়েছিল। পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের প্রত্যাগমনের পর সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধা আর প্রত্যাগতদের মধ্যে দ্রুতগতিতে বিভেদ ও ভুল বুঝাবুঝি শুরু হয়। এ ব্যাপারে জিয়াউর রহমানের অবদান সবচেয়ে বেশি, কিন্তু সে তার। কার্যব্যবস্থা পরিচালনা করতে অত্যন্ত সুচতুরভাবে। সে প্রত্যাগতদের। সাথে সুসম্পর্ক রেখে চলতাে, কিন্তু গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের উস্কিয়ে দিতাে। প্রত্যাগতদের বিরুদ্ধে। প্রত্যাগতদের মধ্যে কিছু অফিসারের আস্থা অর্জন করে অনুরূপভাবে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলতে মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে। এখানে একটি ছােট ঘটনা প্রাসঙ্গিক হবে। চুয়াত্তরের প্রথম দিকের কথা। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত পুরাতন বন্ধুদের সাথে আমার সদ্ভাব অক্ষুন্ন ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিল আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাদের সাথে আমার মেলামেশার বিষয়টি জিয়াউর রহমানের চোখ এড়ায়নি। একদিন তার অফিসে আলাপ প্রসঙ্গে একজন বন্ধুর নাম উল্লেখ করে সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলাে, তার সাথে তােমার সম্পর্ক এত ঘনিষ্ঠ কেন?” আমি উত্তরে বললাম যে, “আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু।” এরপর জিয়াউর রহমান আমাকে জিজ্ঞাসা করলাে “তার বাড়ি কি ফরিদপুর জেলায়?” বুঝতে পারলাম জিয়াউর রহমান আমাদের বন্ধুত্ব জেলাভিত্তিক সম্পর্ক কিনা জানতে চাইছে। আমি উত্তরে বললাম, “তার বাড়ি ফরিদপুর জেলায় নয় এবং আমি জেলাভিত্তিক চিন্তা-ভাবনার উর্ধ্বে। সে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু এটাই যথেষ্ট।” জিয়াউর রহমান একটু মুচকি হাসলাে এবং সাথে সাথে একবার তার নিজের চোখে টিপ মারলাে। কথা বলার সময় বিশেষ মুহূর্তে নিজের চোখে টিপ মারা জিয়াউর রহমানের একটা দুষ্ট মুদ্রাদোষ বলে আগেই আমার কাছে ধরা পড়েছিল। তারপর একটু গম্ভীর হয়ে সে বললাে, “শওকত, কোন প্রত্যাগত অফিসার তােমার বন্ধু হতে পারে।

তােমার মতাে একজন মুক্তিযােদ্ধার পাকিস্তানীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। রাখা উচিত নয়। হঠাৎ করে আমি যেন দিব্যদৃষ্টি পেলাম। সেনাবাহিনীতে তখন যে সকল ঘটনা ঘটেছিল আমার কাছে তার অনেক কারণ পরিষ্কার হয়ে উঠলাে। অবশ্য আগেও কিছু কিছু জানতাম, কিন্তু এভাবে জিয়াউর রহমান আমার কাছে ধরা দেবে তা আশা করিনি। আমি কিছুটা উত্তেজিত হয়ে তাকে বললাম, “স্যার আমি দুঃখিত। আপনার সঙ্গে আমি একমত হতে পারছি না। যারা পাকিস্তানে আটক ছিল তারা এ মাটিরই সন্তান, তারাও বাঙালি তাদের মধ্যে অনেক দেশপ্রেমিক বাঙালি আছে। আপনি যার কথা বলেছেন, সে একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। পাকিস্তানে যারা আটক ছিল আপনিও তাদের একজন হতে পারতেন। যারা পাকিস্তানে আটক ছিল তারা এখানে থাকলে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতাে, এ সম্বন্ধে আমার কোনাে সন্দেহ নেই। আর বন্ধুত্বের কথা বলছেন? পাকিস্তানে আটক থাকার কারণে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব এতটুকু খাদ ধরেনি। আমাদের বন্ধুত্ব অটুট আছে এবং থাকবে। স্যার, অনুগ্রহ করে আপনি খেলা বন্ধ করুন। জাতীয় স্বার্থের কথা চিন্তা করে সেনাবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করা থেকে বিরত থাকুন। আপনি সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান। আপনি যদি এ ধরনের ষড়যন্ত্রমূলক কাজে লিপ্ত হন, তাহলে আমাদের জুনিয়ারগণ কি করবে?” কথাগুলাে বলে আমি চলে আসি। কড়া কথা ইচ্ছে করেই বলেছিলাম। এ জন্য অবশ্য আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে। খন্দকার মােশতাকের আমলে সেনাবাহিনীর প্রধান হয়ে জিয়াউর রহমান প্রথমেই আমাকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেয়। পরবর্তীকালে ক্ষমতার শীর্ষে বসে জিয়াউর রহমান আমার বিরুদ্ধে যে সব হয়রানিমূলক পদক্ষেপ নেয়, তার জের এখনাে চলছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন মনে করি যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আমিও বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিলাম না। বঙ্গবন্ধুর সাথে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন আসামী থাকাকালীন সময় থেকে তার সাথে যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে ওঠে; তা স্বাধীনতার পরও ছিল। এ কারণে কারাে আক্রোশ, কারাে বিদ্বেষ আবার কারাে ঈর্ষার লক্ষ্যবস্তু ছিলাম। তাছাড়া সেনাবাহিনীতে বিভেদের কারণে অনেক প্রত্যাগত বন্ধু আমাকেও তাদের বিরােধী দলভুক্ত বলে মনে করতাে। আবার প্রত্যাগতদের প্রতি পূর্বোল্লিখিত দৃষ্টিভঙ্গির কারণে অনেক মুক্তিযােদ্ধা আমাকে ভুল বুঝেছে। আমি এ সম্বন্ধে সচেতন থাকলেও কিছু করার ছিল না। গায়ে পড়ে কারাে কাছে কোনাে কৈফিয়ত দেয়াও প্রয়ােজন মনে করিনি। ফলে অনেক খেসারত দিয়েছি। জিয়াউর রহমানের আরেক দিনের ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি জিয়াউর রহমানের ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপের অনেক খবরই বঙ্গবন্ধু রাখতেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু মােটেই বিচলিত হতেন না। একবার তাকে হাসতে হাসতে বলতে শুনেছি, “জিয়া একজন মুক্তিযােদ্ধা। এখনাে ছেলেমানুষ। দেশের অবস্থা ভালাে না। তাই মাঝে মাঝে আমার উপর অভিমান করে একটু আধটু ষড়যন্ত্র করে। যাহােক যে ঘটনার কথা বলছিলাম। একদিন সন্ধ্যার পর বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডিস্থ ৩ নং রােডের বাড়ির তিন তালার একটি কামরায় কে, এম, শফিউল্লাহ, জিয়াউর রহমান, শাফাত জামিলের সাথে আমি ছিলাম। আমরা বঙ্গবন্ধুর সাথে একটি জরুরি বিষয় আলােচনা করতে গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমানই আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। আলােচনা শেষে হঠাৎ জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে বললাে, “স্যার আমার বুক বিদ্ধ না করে বুলেট আপনার গায়ে লাগতে পারবে না।” জিয়াউর রহমানের বঙ্গবন্ধু বিরােধী। ষড়যন্ত্রমূলক কার্যকলাপ সম্বন্ধে অবহিত ছিলাম, বলে বঙ্গবন্ধু ও আমরা। বাকী তিন জন জিয়াউর রহমানের কথাগুলাে উপভােগ করেছিলাম। এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ নেই যে, জিয়াউর রহমানের সক্রিয় সমর্থন ও সহযােগিতা ছাড়া ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের তথাকথিত অভ্যুত্থান ঘটাতে কেউ সাহস পেতাে না এবং জিয়াউর রহমানের উপরােক্ত কথাগুলাে ছিল নিছক ভাওতা।

ফুসে থাকা শিল্পপতি

১. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের অন্যতম মৌল লক্ষ্য ছিল শােষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। পাকিস্তানের কথিত বাইশ পরিবারের শােষণের যাতাকলে নিষ্পেষিত বাঙালি জাতি শােষণমুক্তির লক্ষ্যে সগ্রাম করেছে এবং স্বাধীনতা এনেছে। লরেন্স জে, হােয়াইট দেখিয়েছেন বাইশ পরিবার নয় ৪৩ পরিবার সমগ্র পাকিস্তানের স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত কার্যসমূহের ৭২.৮ ভাগ, ম্যানুফাকচারিং প্রতিষ্ঠানসমূহের ৭৭.৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করত। এরা পূর্ব পাকিস্তানের প্রাইভেট ফার্মের ৪৫.১ ভাগ। নিয়ন্ত্রণ করত। ১.২ এই ৪৩ পরিবারের মধ্যে একটি মাত্র বাঙালি পরিবার অন্তর্ভুক্ত ছিল। ৪৩ পরিবারের মধ্যে তার স্থান ছিল ২৯ তম। পরিবারের ১৪টি কোম্পানি বীমা পরিসম্পদের ৭৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করত। এ, কে খান এই ১৪টি বড় ধরনের কোম্পানির মধ্যে শতকরা ২ ভাগের মালিক ছিলেন, অর্থাৎ বাঙালি শিল্পপতিদের মধ্যে এ, কে, খান ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ছাড়াও এ, কে, খানের রাজনৈতিক পরিচয় ছিল। তিনি জেনারেল। আইয়ুব খানের আমলে পাকিস্তানের মন্ত্রী হয়েছিলেন।

১.৩ স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু এ, কে, খানসহ বাঙালি শিল্পপতিদের শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ বিশেষকরে পাট, বস্ত্র, চিনি ও ভারী শিল্প জাতীয়করণ করেন।

১.৪  ফলে বাঙালি শিল্পপতিগণ বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারের ঘােরতর শত্রু হয়ে দাঁড়ায়।

২. এই শিল্পপতিদের উন্নতি ও বিকাশ ঘটেছিল মুসলিম লীগ সরকার ও নেতাদের বদৌলতে। শুধু তাই নয়, বাঙালি বুর্জোয়া শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে এ সব শিল্পপতির সব সময়ই ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিল পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে। পাকিস্তানী শাসকদের জীবনাচরণ এরা রপ্ত করেছিল।

২.১ পাকিস্তানী অভিজাত শ্রেণীর সাথে পাক সামরিক অফিসারবৃন্দের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ ও পারস্পরিক পরিপূরকমূলক।

২.২ সে জন্য দেখা যায়, স্বাধীনতা যুদ্ধে এ সকল শিল্পপতিদের অধিকাংশই নিরাপদে জীবন যাপন করেছে। পাক সামরিক বাহিনীকে সহযােগিতা করেছে।

৩. এ, কে, খানের কন্যার পাণি গ্রহণ করেছেন আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রী এম, আর সিদ্দিকী। বাণিজ্য মন্ত্রী থেকে এম, আর সিদ্দিকীকে সরিয়ে বঙ্গবন্ধু তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পদে নিয়ােগ করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর এম, আর সিদ্দিকী রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে কুখ্যাত শান্তি বাহিনী চুক্তি করলে তাকে পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

৪.  এ, কে, খানের এক ভাই, এম, এস, খান। এই ভাইয়ের দুই মেয়ের দুই স্বামী কর্নেল রশিদ ও কর্নেল ফারুক।

৫.  এই সকল পাকিস্তানী ও দেশী শােষক দালালদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বললেন যে, আমি ব্যাংক, বীমা, পাট, বস্ত্র, চিনি, রসায়ন শিল্পকারখানাসহ সকল মৌল ও ভারী শিল্পকে জাতীয়করণ করে শােষণের চাবিকাঠি ভেঙ্গে দিয়েছি। বড় বড় শােষক গােষ্ঠীর কালাে হাতকে বঙ্গবন্ধু বেঁধে ফেললেও আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় কালােবাজারী, মজুতদার, মুনাফাখাের, চোরাচালানী চলতে থাকে। দেশে গড়ে উঠে নব্য এক অসাধু বণিক গ্রুপ। এ সব বিজনেসম্যান বা ব্রিফকেস ব্যবসায়ী শ্রেণী অবাধে দেশের অর্থনীতিকে অবনতির পথে নিয়ে যায়। মুনাফা অর্জনের জন্য হেন পন্থা নেই যা তারা গ্রহণ করত না। এদের অধিকাংশই ছিল “সিক্সটিন ডিভিশনের লােক।

৫.১  এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দুর্নীতি চলত সরকারি অফিসসমূহে। টিসিবি প্রায় তিন শত পণ্য আমদানি ও সারা দেশে বাজারজাত করার দায়িত্ব লাভ

করে। দেখা গেল টিসিবি হয়ে দাঁড়াল দুর্নীতির বিরাট আখড়া।

৫.২ বঙ্গবন্ধুর সরকার রাজনৈতিক কর্মীদের জন্য প্রতি থানায় দশটি করে স্বল্প। অংকের আমদানি লাইসেন্স প্রদান করেন। এর বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে অপপ্রচার চলতে থাকে। এরা ব্যবসা না করে প্রকাশ্যেই লাইসেন্স বিক্রি করতে থাকে। লাইসেন্স আমদানিকৃত মালামাল নির্ধারিত এলাকায় গেল

। পথেই বিক্রি হয়ে যেতে থাকে। বলাবাহুল্য, এই স্কিমের অধীনে ইস্যুকৃত পাঁচ হাজার লাইসেন্সে আমদানির পরিমাণ ছিল মােট আমদানির মাত্র ২৩ ভাগ। বাকী ৭ ভাগের সিংহ ভাগ পাকিস্তানী আমলে আমদানিকারকদের হাতেই ছিল। সে জন্য ভােগ্য পণ্যের কৃত্রিম সংকট যদি কেউ তৈরি করে থাকে তাহলে পুরাতন আমদানিকারকেরাই করেছে। যার অধিকাংশই ছিল মুসলিম লীগ সমর্থক এবং স্বাধীনতা বিরােধী শক্তি। নব্য উটকো ব্যবসায়ী এদের সাথে যুক্ত হয়েছে মাত্র।

৫.৩  পরবর্তীকালে বাণিজ্যমন্ত্রী এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান অভিযােগ করেছেন যে ২৫ হাজার লাইসেন্সের মধ্যে ১৫ হাজার ভূয়া। অসৎ নব্য রাজনৈতিক কর্মীদের লাইসেন্সের সংখ্য ৫ হাজার হলে বাকী ১০ হাজার ভূয়া লাইসেন্সের অধিকারী কারা ছিলেন? নিশ্চয়ই পুরাতন লাইসেন্সধারীগণ। কিন্তু যত দোষ নন্দ ঘােষ, এর পুরাে সমালােচনার বলি হল আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু।

৫.৪  জনগণ আমদানিকৃত কৃত্রিম পণ্যের সংকটে দুর্ভোগে পড়েছে। শিশুর জন্য দুধ পায়নি, খাবার তেল পায়নি, লবণের সংকট, তার পুরাে দায় দায়িত্ব সরকার ও বঙ্গবন্ধুর ঘাড়ে পড়েছে।

৫.৫ রাজনীতির নামে দেশ জুড়ে মুনাফাখখার চোরাকারবারীদের অবাধ লাইসেন্স চলতে থাকে। ম্যান ছেরু মিয়া ধরা পড়লেও এ রকম হাজারাে বড় বড় ছেরু মিয়ারা চোরাচালানী ও কারবারি, মুনাফাখখারী চালাতে থাকে। এদের জন্য, অবৈধ অস্ত্রধারীদের জন্য ফায়ারিং স্কোয়াড’ আইন সংসদে পাস করা হলেও একজনও এ আইনে শাস্তি পেল না।

৬.বঙ্গবন্ধু এ সকল দিক বিবেচনা করে ১৯৭৪ সনের ডিসেম্বরে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করলে এ সব নব্য অসৎ ব্যবসায়ী, কলকারখানা বে-হাত হয়ে যাওয়া শিল্পপতিগণ বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে উৎখাতের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। এরা বঙ্গবন্ধু বিরােধী শিবিরে মােটা রকমের চাদা ও অন্যান্য সহযােগিতা দিতে থাকে। শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী শ্রেণী পুরােটাই বঙ্গবন্ধুর উপর ছিল ক্ষিপ্ত। একজন শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীও তাঁর স্বপক্ষে ছিল কিনা তা গবেষণার বিষয়।

 

 

সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ