জয় বাংলা ২ জুন ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপাত্র
মুজিবনগরঃ প্রথম বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যাঃ বুধবার ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮, ২রা জুন ১৯৭১
শান্তি, মানবতা ও স্বাধীনতার দাবি
পশ্চিম পাকিস্তানে জঙ্গি গোষ্ঠী আজ এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তির শ্বাশত অধিকার স্তব্ধ করতে গিয়ে আজ তারা চোখে সর্ষেফুল দেখতে শুরু করেছে। ঘরে ভাত নাই, তুনে হাতিয়ার নেই আর থলেতে নেই পয়সা। বাস্তুঘুঘুরা এভাবে যে ফাঁদে পড়বে তা তারা আগে ভাবতেই পারেনি। বারবার এসব গুগোল ডাল বাংলাদেশের ফসল খেয়ে গেছে। কিন্তু ফাঁদ কখনো দেখেনি। শুধুমাত্র প্রতিবাদ ও প্রস্তাবের মধ্যেই হয়েছিল বাঙ্গালির প্রতিক্রিয়া সীমাবদ্ধ। কিন্তু বাঙালি আজ জেগেছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আজ বাস্তুঘুঘুদের সবংশে নির্ধারণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কোন অত্যাচার-নির্যাতন রাইফেল, মেশিনগান ও কামানের গুলিগোলা আজ তাদের স্তব্ধ করতে পারছেনা। যুদ্ধ শুরুর পর দু মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেল কিন্তু বাস্তু ঘুঘুরা বাঙ্গালীদের বশে আনতে পারেনি। বরং মরণজয়ী বাঙালি দিন দিন যুদ্ধকে তীব্রতর করে তুলছে।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিরোধ সংগ্রামে নাস্তানাবুদ হয়ে গণহত্যার নায়ক জল্লাদ ইয়াহিয়া দেশে দেশে দুধ পাঠিয়েছে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে। অর্থ দাও, অস্ত্র দাও, খাদ্য দাও আর বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার শুরু করে দিয়েছে। খুনি জল্লাদ গোষ্ঠীর এই মরণ কান্নায় কারো মন ভিজেছে আবার কারো ভেজেনি। কেউ কেউ আবার বাংলাদেশে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের (Political Statement) নামে জল্লাদগোষ্ঠীকে সাহায্যদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বলতে এরা কি বোঝাতে চাচ্ছেন বা কি বুঝিয়েছেন তা আমাদের জানা নেই। রাজনৈতিক সমাধান বলতে তারা যদি বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা বুঝে থাকেন তাহলে তাতে আমাদের আপত্তির কিছু নেই। কেননা সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আজ একমাত্র স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ ছাড়া আর কিছু বোঝেনা এবং বুঝবেও না। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের প্রবক্তারা এ ছাড়া যদি অন্য কিছু বুঝে থাকেন বা বুঝাতে চান তাহলে তারা এক মারাত্মক ভুল করবেন। বুঝতে হবে তার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মন ও মানসের সত্যিকার খবর রাখেন না। এ প্রসঙ্গে তাদের অবগতির জন্য আমরা বাংলাদেশ সরকারের জনৈক মুখপাত্রের মন্তব্যের উল্লেখ করছি। স্ত্রী এ ধরনের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন যে একমাত্র পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি আজ আর অন্য কিছু শুনতে বা বুঝতে প্রস্তুত নয়। জয় বাংলার প্রথম সংখ্যায় আমরা লিখেছিলামঃ ইয়াহিয়াও পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও সেনাবাহিনীর নরঘাতী আক্রমণ বাঙালিকে বাধ্য করছে অস্ত্র ধারণ করতে ।স্বাধীন সরকার গঠন করতে। বাঙালি আর কোনো ও চক্রান্তের শিকারে পরিণত হতে চায়না। খুনের উত্তর খুন……। রক্তদিয়ে আমরা রক্তের বদলা নেব। বাংলাদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে এক নতুন পতাকা। বাংলাদেশের সবুজ প্রান্তরে পড়ছে লাল রক্তের দাগ। এ রক্তের কথা আমরা ভুলবোনা। বাঙালির রক্ত বৃথা যেতে দেব না। আর জয় বাংলার দ্বিতীয় সংখ্যা আমরা লিখেছিলামঃ লাখো শহীদের লাশের তলায় লাখো মায়ের পদতলে কবর হয়ে গেছে পাকিস্তানের। আমরা ঘোষণা করেছি স্বাধীনতা। আমাদের সন্তানরা ধরেছে অস্ত্র। বহাচ্ছে খুনের বন্যা। আমরা লিপ্ত হয়েছি এক মরণপণ সংগ্রামে -হয় স্বাধীন জাতি হিসেবে বাঁচবো না হয় মরবো।
অতএব আমাদের বক্তব্য অতি স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন। বিশ্বের রাষ্ট্রপতির প্রতি আমাদের আবেদন একটি জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের নিশ্চিহ্ন করতে আপনারা ইয়াহিয়া চক্রকে কোন সাহায্য দেবেন না। দেবেন না, পাকিস্তানের নামে কোন সামরিক বা আর্থিক সাহায্য। কেননা পাকিস্তান আজ আর বেঁচে নেই। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। এটা শুধু আমাদের আহ্বান নয়, এটা শান্তি, প্রগতি ও বিশ্ব মানবতারও দাবি। বিশ্বের কোন মানবপ্রেমিক ও স্বাধীনতাকামী ব্যক্তি এ দাবি অগ্রাহ্য করতে পারেন না।
শান্তি, প্রগতি, মানবতা ও মানব স্বাধীনতার দাবি অগ্রাহ্য করে কোন রাষ্ট্র যদি পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গি চক্রকে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসে তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে আমাদের জীবন মরণের এই সংগ্রামে আমাদের দুশমনদের যারা সাহায্য করবেন তারা চিরকালের জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রীতি, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব হারাবেন।
প্রসঙ্গতঃ আমরা বাংলাদেশের সর্বস্ব হারা মানুষের ত্রাণকার্যের বিষয়টাও পরিষ্কার করে দিতে চাই। আমরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ত্রাণকার্যের বিরোধী নই। বরং যত বেশি সাহায্য আমাদের মানুষ পেতে পারে তার পক্ষপাতী। নরখাদক ইয়াহিয়া মাত্র সেদিনও বাংলাদেশে কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই বলে দাবি করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক রেডক্রসের ত্রাণ ও সাহায্য সামগ্রী পৌঁছে একখানা বিমানকে করাচি থেকে জেনেভায় ফেরত পাঠাতেও জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিবেকে বাধেনি। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের দুর্গত মানুষের নামে সাহায্য লাভের জন্য তারা পাগল হয়ে উঠেছে। অতীত অভিজ্ঞতার প্রেক্ষিতে তাদের এই প্রচেষ্টাকে আমরা সন্দেহের চোখে না দেখে পারছি না। কেননা, ইতিপূর্বে বরিশাল, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর যে ত্রাণ সামগ্রী, নৌযান ও হেলিকপ্টার বিদেশ থেকে এসেছিল ইয়াহিয়া খানরা ওগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করেছে। ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য প্রেরিত নৌযান গুলোকে রুপান্তরিত করা হয়েছে গানবোটে আর হেলিকপ্টারগুলো কে ব্যবহার করা হয়েছে মুক্তিকামী বাঙালির উপর বোমা বর্ষণের কাজে। ত্রাণকার্যের জন্য যে কোটি কোটি টাকা বিদেশ থেকে এসেছিল তার একটা ফুটো পয়সাও বাংলাদেশে আসেনি। সবই রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাংকে এম এস আহমেদের হেফাজতে।
তাই আমাদের দাবি কোন ত্রাণ সামগ্রীই ইয়াহিয়া সরকারের হাতে দেয়া যাবেনা। অথবা এ কাজের জন্য প্রেরিত কোন নৌযান বা হেলিকপ্টার জঙ্গী শাহীচক্রের কর্তৃত্বে ন্যাস্ত করা চলবে না। বাংলাদেশ সরকারের কর্তৃত্বাধীনে আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও অনুরূপ অন্যান্য সংস্থার মাধ্যমেই পরিচালনা করতে হবে এ ত্রাণকার্য।
পাকিস্তানের কাঠামোতে কোন আপোষের প্রশ্নই উঠতে পারে না -তাজউদ্দীন
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোতে কোনরকম আপস-মীমাংসার প্রশ্নই উঠতে পারে না।
গত রোববার মুজিবনগরের জয়বাংলা প্রতিনিধির সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দীন এ ঘোষণা করেন। বহির্বিশ্বে বিভিন্ন মহলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে যেসব কথাবার্তা উঠেছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে জনাব তাজউদ্দীন উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
জনাব তাজউদ্দীন আরো বলেন যেকোনো মূল্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের জনগণ তাদের পৃথক সত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষা করবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হওয়ার আগেই যদি তথাকথিত পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাদের খুনি সৈন্যবাহিনীকে বাংলাদেশের মাটি থেকে সরিয়ে নেন তবে সেটাই হবে তাদের পক্ষে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।
নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি দল
তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল গত ২৫শে মে নয়া দিল্লির উদ্দেশ্যে মুজিবনগর ত্যাগ করেছেন। নয়াদিল্লিতেতারা ভারতীয় পার্লামেন্টের বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সাথে দেশের সাধারণ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করবেন।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য অনুষ্ঠান মিঃ ফনিভূষণ মজুমদার এর নেতৃত্বে গঠিত উক্ত প্রতিনিধি দলের অপর সদস্যরা হচ্ছেন আওয়ামী লীগের মহিলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় পরিষদ সদস্যা বেগম সারওয়ার মোর্শেদ এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ মোয়াজ্জেন হোসেন।
প্রতিনিধিদলটি ভারতের অঙ্গরাজ্যের রাজধানী শহর করবেন এবং সেসব স্থানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠকে মিলিত হবেন।
সপ্তাহব্যাপী সফর শেষে তারা মুজিবনগর প্রত্যাবর্তন করবেন এবং বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাছে সফর সম্পর্কে এক রিপোর্ট পেশ করবেন।
নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান…..
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের পরিবারবর্গের সমগ্র দায়িত্ব নিজ হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। তাছাড়া যারা মুক্তিযুদ্ধে আহত পঙ্গু হয়েছেন তাদের ভরণপোষণের দায়িত্ব ও সরকার নিজ হাতে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন।
এ সম্পর্কে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাহায্য ও পুনর্বাসন দপ্তরের এক সার্কুলারে বলা হয় যে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শৌর্য ও ত্যাগ চিরকাল জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন অথবা আহত ও পঙ্গু হয়েছেন তাদের সম্পর্কে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সরকারকে প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধীনতা
ভারত বিভক্ত হল। গঠিত হল পাকিস্তান ও ভারত। পূর্ববঙ্গ ছাড়া পাকিস্তানের বাকি চারটি প্রদেশেই দেশের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত ভৌগোলিক সীমারেখা দিক থেকে একক। কিন্তু পূর্ববঙ্গ পশ্চিম অঞ্চল থেকে বারো শত মাইল দূরত্বে শুধু অবস্থিত নয় মাঝখানে ভারত রাষ্ট্র। তদুপরি দুই অঞ্চলের মধ্যে সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক ব্যবধান ও বিদ্যমান। এক রাষ্ট্র ও এক পতাকার প্রতি সার্বভৌমত্বের আনুগত্য প্রকাশের পূর্ববঙ্গ প্রথম দিন থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করল।
পূর্ববঙ্গ জনসংখ্যার দিক থেকে পশ্চিমাঞ্চলের চেয়ে বেশি। পাকিস্তানের বাজেটের চাহিদার এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৭৫ ভাগের যোগানদার।
অতএব পাকিস্তানের বাংলাদেশের প্রভূত প্রতিষ্ঠাই ছিল স্বাভাবিক। তদুপরি সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশের শাসন পেষন বন্ধ হওয়ার ফলে জনগণের আর্থিক অবস্থা বলিষ্ঠতর হবে এ আশা করাই স্বাভাবিক ছিল। জনগণ তাই স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু বাস্তবে ঘটলো তার উল্টো। যে পশ্চিমাংশ ছিল মরুভূমি অর্থনৈতিক সামাজিক ও শিল্প ক্ষেত্রে ছিল পশ্চাৎপদ সেই পশ্চিম পাকিস্তান ক্রমাগত ফুলে-ফেঁপে ঐশ্বর্য আর বৈভবে ভরে উঠতে লাগলো এবং তার পাশাপাশি অগ্রসর পূর্ববঙ্গ হতে লাগল ক্রমাগতই অর্থনৈতিক দিক থেকে পঙ্গু এবং অবহেলিত বঞ্চিত -সহজ অর্থে শোষিত। এই অর্থনৈতিক শীর্ণতা বঞ্চনার বিরূপ প্রতিক্রিয়া জনমনে অসন্তোষ এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে লাগল। তাতে সহায়ক হল পশ্চিমা প্রভুত্বে পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছাকৃত এবং ষড়যন্ত্রমূলক কতগুলো রাজনৈতিক কার্যক্রম। যথা উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র, বাংলার সংস্কৃতিকে গলা টিপে মারার দুরভিসন্ধি, শিল্পোন্নয়নে পূর্ববঙ্গের প্রতি বিমাতা সুলভ মনোভাব, এবং কেন্দ্রীয় চাকুরী ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের প্রতি ক্ষমাহীন উপেক্ষা। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এই স্বার্থবাদী প্রবণতা পূর্ণ পূর্ববঙ্গের জনগণের চোখ খুলে দেয়, তারা বুঝতে পারে পশ্চিমাদের সংহতি ও ধর্মীয় বন্ধনের গালভরা বুলির স্বরূপ। বিরূপ হয়ে ওঠে বাংলার মানুষের মন শক্ত কেন্দ্রের বিরুদ্ধে।
এই থেকেই বাংলাদেশে স্বায়ত্তশাসনের দাবি। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় চরিত্র ফেডারেল ধরনের। অতএব ফেডারেশনের অঙ্গরাজ্যগুলো দেশের সামগ্রিক অখন্ডতা রক্ষা করে নিজে নিজে অঞ্চলে নিজেদের প্রয়োজন মোতাবেক বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকারী হবে -এটাই স্বাভাবিক। কেননা আঞ্চলিক সমস্যার মোকাবিলায় সেখানকার জনগণ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সরকারেই যোগ্যতম। এই সুবিধা বা ক্ষমতাই Autonomy বা স্বায়ত্তশাসন। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের মূল কথাও ছিল তাই। যে লাহোর প্রস্তাব ছিল পাকিস্তানের বুনিয়াদ স্বাধীনতার পর যারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলেন তারা সেই লাহোর প্রস্তাবের প্রতি প্রদর্শন করলেন উপেক্ষা। শুধু তাই নয়, স্বায়ত্তশাসনের দাবীদার তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং পাকিস্তানের দুশমন বলে অভিহিত করতেও দ্বিধা করলেন না। দেশ স্বাধীন হবার পরপরই শাসকচক্রের মুখে এই ধরনের কথা উচ্চারিত হতে পারল কি করে এ-প্রশ্ন আবার মনে জাগা স্বাভাবিক। জবাব সহজ। বাংলাদেশ সম্পদ আর ঐশ্বর্য দিক থেকে ছিল বিশ্বের রানী। অতএব এদেশের প্রতি সবারই লোলুপ দৃষ্টি। এ সম্পদই বাংলার এবং বাঙ্গালির ভাগ্য আজকের দুর্ভোগ টেনে এনেছে। এ বিষয়ে কোনো বিতরকের অবকাশ নেই ।
বাংলার পাটে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলে গড়ে ওঠে প্রাসাদোপম অট্টালিকা। অপরপক্ষে বাংলার জনগণের থাকেনা মাথা গোঁজার ঠাঁই। বাংলার জনগণের রক্ত পরিশুদ্ধ বৈদেশিক ঋণের পশ্চিমাঞ্চলের লবণাক্ততা দূর হয়, মঙ্গলা তারবেলা এবং গোলাম মোহাম্মদ বাঁধ তৈরি করা হয়। কিন্তু বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলার জনগণ যখন এই দাবি তোলে তখন কেন্দ্রীয় সরকারের কোষাগারে অর্থের টান পড়ে। বাংলার কৃষক ও জনগণের নিকট থেকে আদায়কৃত অর্থে প্রতিপালিত হয় বিরাট সেনাবাহিনী। দেশরক্ষা বাহিনীর সদর দপ্তরেই পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত-যদিও পাকিস্তানের মানুষের শতকরা ৫৬ জনের বাস পূর্ববাংলায় তবু সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয় না দেশ রক্ষা বাহিনীর কোনো একটির সদর দপ্তর। শিক্ষা ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি এবং দ্রব্যমূল্যের তারতম্যে কল্পনাতীত ভাবে বৈষম্য বিরাজ করে দুই অংশের মধ্যে। উল্লেখিত বৈষম্য এবং রাজনৈতিক কারণে যখন বাংলার আকাশ-বাতাস তপ্ত সেই সময় ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ বেধে গেল। আর এই যুদ্ধে পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বিপদকালে কি অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে তার নগ্ন রূপে তুলে ধরল বাঙ্গালীদের সামনে। দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে দেখলে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গ কে কোথায় নিয়ে ফেলেছে। কি করুন এবং বিভীষিকাময় সেইরূপ -তা কল্পনা করা যায় কিন্তু তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু এই অবস্থার বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না-কারণ মাথার উপর ঝুলানো রয়েছে দেশ রক্ষা আইনের খড়গ। কোন কথা বললেই বিনা বিচারে আটক এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য কারাবাসের ব্যবস্থা। সমস্ত দেশকে নির্যাতনমূলক আইন স্তব্ধ করে দিতে পারলেও একটি কণ্ঠ স্তব্ধ করতে পারলো না -সেকন্ড হল কেশরী, জনগণ নন্দিত মহানায়ক বাংলার নব অগ্নিযুগের শ্রেষ্ঠ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। স্বাধীনতা-উত্তরকালে অঞ্চলের মানুষের মানুষের সৃষ্ট বৈষম্যের পাহাড় ভেঙ্গে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি কে মজবুত বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠাকল্পে স্বায়ত্তশাসনের বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যাখ্যাসহ তিনি পেশ করলেন ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি। জনগণ একবাক্যে ছয় দফাকে
বাংলার শোষণমুক্তির এবং মানুষের মানুষের ভেদাভেদ দূর করার মহাসনদ বলে গ্রহণ করলেও শাসকচক্র তা মেনে নিতে রাজী হলই না বরং আয়ুব অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ এবং গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে ছয় দফা মোকাবেলার হুংকার ছাড়লেন। চালালেন নির্বিচারে অত্যাচারের স্টিমরোলার। মুজিব তাজউদ্দীনসহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। দেশ রক্ষা আইন প্রয়োগ করে বন্ধ করে দেওয়া হলো আওয়ামী লীগ ও সরকারের সমর্থক দৈনিক ইত্তেফাক। বাজেয়াপ্ত করা হলো ইত্তেফাকের সমস্ত সম্পত্তি।
সে এক অবিশ্বাস্য এবং নাটকীয় অবস্থা। কিন্তু এত করেও ছয় দফার সঞ্জীবনী আবেদন ম্লান করা সম্ভব হলো না। অতএব আইয়ুব তৈরি করল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বঙ্গবন্ধু হলেন এক নম্বর আসামি। পশ্চিমারা ভাবল বাংলার বুকে আর কেউ শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে স্বায়ত্তশাসনের দাবি তোলা রইলো না। কিন্তু পদ্মা-মেঘনা-যমুনার স্রোতের দুর্বার গতি নিয়ে গর্জে উঠল বাংলার অধিকার সচেতন জাগ্রত ছাত্র শ্রমিক কৃষক জনতা। থর থর করে কেপে উঠল আইয়ুবের তখতে তাউস। আইয়ুব চমকে ওঠে নিমজ্জমান তরী রক্ষায় ব্যাপৃত হল। বঙ্গবন্ধু কুর্মিটোলার সামরিক ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসে ঘোষণা করলেন শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না। আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলবে।
আইয়ুব বিদায় নিল ইয়াহিয়ার আগমন ঘটল। আসলে এটা ছিল নতুন বোতলে পুরাতন মদ রাখার প্রয়াস। উদ্দেশ্য ছিল ইহাকে দিয়ে কোনরকমে বাংলাদেশের ওপর শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা যায় কিনা তা যাচাই করে দেখা। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্ক ভোটের নির্বাচন জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিলেন ইয়াহিয়া। কিন্তু প্রতিশ্রুতি দিলেন যে সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে এমন কথা তো পশ্চিমাদের অভিধানে নেই।
নির্বাচনের দিন ঘোষিত হল ৭০’এর ৫ই অক্টোবর। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে তা পিছিয়ে ৭ই ডিসেম্বর ধার্য করা হলো। বঙ্গবন্ধু ও তার দল আওয়ামীলীগ ছয় দফা কর্মসূচিকে নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে জনগণের নিকট তুলে ধরে বলেন যদি আপনারা বাংলার শোষণ মুক্তি চান, যদি পাকিস্তানের নাগরিকত্বের সম্মান মর্যাদা চান- চান ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন তবে আমার দলের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দিন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ বিশ্বের নির্বাচনে সকল রেকর্ড করে দিয়ে এক বাক্যে বঙ্গবন্ধু কে বাংলার মুকুটহীন সম্রাট’ মনোনীত করে দিল। ইসলামাবাদের এবং লারকানা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল কক্ষে বসে সম-রসে আমোদিত ইয়াহিয়া ভুট্টো আঁতকে উঠলেন -নেশা বুদবুদের মত মিলিয়ে গেল।
তারপর চলল ষড়যন্ত্রের খেলা। ঠিক করা হল আওয়ামি লীগকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হবে না। আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা যাওয়া মানেই বাঙ্গালীদের প্রভুত্ব স্বীকার করে নেওয়া। যার ফলে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীরে আর শোষণ করা যাবে না। এই ষড়যন্ত্রের পরিণতি হিসেবে ২৫ শে মার্চ রাতের অন্ধকারে যা শুরু করা হয়েছে তার ব্যাপকতা, নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা সমস্ত বিশ্ববাসীর আজ জানা। তাই সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীরে জাতীয় অস্তিত্ব বজায় রাখার তাগিদেই করতে হল স্বাধীনতা ঘোষণা, ধরতে হলো অস্ত্র।
রণাঙ্গনেঃ মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে বেইমানদের ত্রাহি ত্রাহি রব !
বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে বেইমান খানসেনাদের বেদম মার খাওয়ার খবর আসছে, অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমা দস্যুসৈন্যরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে চোরের মত পালিয়ে গেছে।
বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে বিগত সপ্তাহে আরো সাত শতাধিক শত্রুসৈন্য এর মৃত্যুর খবর এসেছে।
গত ২৩ শে মে রাতে নোয়াখালীর ফেনী মহাকুমার আমতলী, দত্তশা, টিলাবারি, ও বদেরা এলাকায় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে ৫০ জন সেনা কে খতম করে। মহেশপুর থানার কাবিলপুর স্বাধীনতাকামীরা বেইমান বিশ জন পাকসেনাকে খতম করেছে।
উক্তিটির বিপুল সংখ্যায় পাকসেনারা একটি ট্রেনে করে ভৈরব বাজার থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা একটি ঝোপের আড়াল থেকে বোমা আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন খানসেনা হতাহত হয়।
ভৈরব বাজারের পশ্চিম দিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের উপরকার সেতুটি মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছে। গত ২৭শে মে থেকে ঢাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্রেন চলাচল বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
কুমিল্লা থেকে এক ট্রাক বোঝাই খানসেনা অগ্রসর হতে চেষ্টা করলে স্বাধীনতাকামী গেরিলারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তা উড়িয়ে দেয়। কসবার পশ্চিম পাকবাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র রেশন একটি ট্রলিতে করে সরবরাহের চেষ্টা করা হলে আমাদের মুক্তিবাহিনীরা তা পুড়িয়ে দেয়।
যশোহর মহেশপুর থানার কাবিলপুর সেক্টরে মুক্তি সেনা ও দখলকার বাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে ২০ জন সৈন্য নিহত হয় এবং বাকিরা দুইটি জীপ ফেলে পালিয়ে যায়।
গত ২৬শে মুক্তিসেনা খুলনা-রংপুর ময়মনসিংহ সিলেটের বিভিন্ন সেক্টরে তীব্র হামলা চালিয়ে খানসেনাদের নাস্তানাবুদ করে ফেলে।
কুষ্টিয়ার মেহেরপুরের প্রায় তিন মাইল দূরে কামদেবপুর এর হানাদার দখলকৃত এলাকায় মুক্তিসেনা মর্টার ও হালকা অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে পাকসেনার উপর আক্রমণ চালায়। হামলা একজন অফিসার সহ দশ জন খানসেনা নিহত হয়।
খুলনার পারুলিয়াতে মুক্তি বাহিনি একটি জিপের উপর হামলা করলে চারজন হানাদার সৈন্য খতম হয়।
রংপুরের ফুলবাড়ীতে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দলের আক্রমণে দুইজন পাকসেনা নিহত হয়। মুক্তিসেনা একজন হানাদার সৈন্যকে বন্দী করতে সমর্থ হয়। মুক্তিসেনা চিলমারীতে পাকসেনাদের ঘাঁটির ওপর গুলিবর্ষণ করলে বহু পাকসেনা হতাহত হয়।
ময়মনসিংহে পাকফৌজ দখলকৃত সীমান্ত ঘাঁটি তোয়াকাঁচা মুক্তিসেনারা ধ্বংস করে নিয়েছে।
কুমিল্লা সেক্টরের মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার দুবার হামলা করে শত্রুপক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে। অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে ২৫ জন শত্রুসেনা খতম হয় আমাদের পক্ষে নয় জন স্বাধীনতাকামী তরুণ বীরের মতো যুদ্ধ করে অবশেষে শহীদ হন। গত ২৫শে মে রাতে মুক্তি সেনা সৈদামাজিতে পাক ফৌজের উপর আক্রমণ চালিয়ে ২৫ জন সেনাকে খতম করে। তাছাড়া আক্রমণে ১৪ জন সেনা আহত হয় এবং একটি ট্রাক ও জীপ বিধ্বস্ত হয়।
রংপুরের আর এক খবরে প্রকাশ, পাক সেনাবাহিনীর একখানি ট্রেনকে মুক্তিসেনা আক্রমণ চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে এই হামলার ফলে কমপক্ষে দশ জন বেইমান সৈন্য খতম হয়। মুক্তিসেনারা লালমনিরহাট ও বোরাবাড়ির মধ্যে একদল পাকসেনার উপর হামলা চালিয়ে ১৬জন শত্রুসৈন্য কে খতম করে।
গত ২৬শে ও ২৯শে মে স্বাধীনতাকামী বাংলা বাহিনী খান সেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে সিলেটের এক বিস্তীর্ণ এলাকা পুনর্দখল করে নিয়েছে। এই সংঘর্ষে ৪০ জন পাক ফৌজ খতম হয়, তিনটি মোটরযান বিধ্বস্ত এবং প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিসেনার হস্তগত হয়।
এছাড়া রাজশাহী-খুলনা ঢাকা ও ফরিদপুরে কয়েকজন দালাল কে মুক্তিসেনারা হত্যা করেছে।
গত ২৯শে মুক্তিবাহিনীর সিলেটের উত্তরাঞ্চলের একটা বিরাট এলাকা থেকে হানাদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়। হানাদার সৈন্য সারিনদীর সেতু বরাবর অবরোধ করে রাখলে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায় এবং পাক ফৌজের সৈন্যদের হরিপুর পেট্রোলিয়াম প্রকল্প পর্যন্ত তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই আক্রমণে দুই শতাধিক খান সেনা নিহত হয়।
লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কারা -আমরা না তোমরা? – তাজউদ্দীন
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত এর প্রতিক্রিয়া যা হবে হবে বলে আশা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেরালা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্ট ভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এক পাকিস্তানের কাঠামোতে বাংলাদেশের ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোন সম্ভব নয়। নিজেরিয়া ভান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। কায়দার এক বাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের উপর চাপ দিতে থাকেন।
শেখ মুজিব এতদসত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩রা মার্চ অসহযোগ কর্মসূচি আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলার জন্য শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনো তিনি আশা করেছিলেন যে সামরিক চক্র তাদের জ্ঞান বুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২রা ও ৩রা মার্চ ঠান্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশের পহেলা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে সাফল্যের সাথে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরীভাবে অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি, পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেলোনা হাই কোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস প্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। আমাকে সামরিক দপ্তর এর বেসামরিক কর্মচারীগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকেই তার ক্ষান্ত হলেন না। বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরা সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করলেন যে আওয়ামী লীগ প্রধানের নির্দেশ ছাড়া তারা কারো নির্দেশ মেনে চলবে না।
এ অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হল। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণের নয় বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধান কে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থার ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ সমস্যা কিন্তু এসব সমস্যার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশে কোন আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্বেও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক দল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার আদর্শ স্থাপন করেছিলেন তা স্বাভাবিক সময়ে ও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ই মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশন এর জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলে মনে হল। কেননা তাঁর ঐদিনের প্রচারণামূলক বেতার বক্তৃতায় সংকটের সম্পূর্ণ দায় চাপালেন আওয়ামী লীগের উপর। অথচ তিনি ছিলেন সংকটের স্থাপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকায় সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লেফটেনেন্ট জেনারেল ইয়াকুব খান এর স্থলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানে করে ঢাকায় পাঠানো হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতিমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ সত্বেও শেখ সাহেব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদের যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে চার দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেয়া হয়েছে তার শেষ সুযোগ।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিলনা। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের সামরিক শক্তি জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সংকট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেওয়া হয়েছিল।
পয়লা মার্চ এর ঘটনা সামান্য কিছু আগের রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাঙ্কগুলো ঢাকায় ফেরত আনা হয়। পয়লা মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানী কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লোকদের পরিবার-পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে।
পয়লা মার্চ এর পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে সিআইএ-র কমার্শিয়াল সাদা পোশাকে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশে আনা হয়। সি-১৩০ পরিবহন বিমান গুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশের স্তূপীকৃত করা হয়।
সাবধান! সাধু সাবধান!
বাংলাদেশের অভূতপূর্ব স্বাধীনতার লড়াই চমকে দিয়েছে সারা পৃথিবীকে। সাধারণ মানুষের দৃঢ় মনোবল সর্বস্ব ত্যাগের মানসিকতা এই মহান মুক্তিযুদ্ধকে বলবান করেছে পৈশাচিক শক্তির বিরুদ্ধে। তাই এই যুদ্ধ জয়ের সংকল্প কঠিন, একে অস্ত্রের শক্তিকে পরাভূত করা যাবে না।
তাই কিপটে বিশ্বাসের মনে হয় পশুশক্তির ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের অগণিত নারী-পুরুষ-শিশু আর বৃদ্ধের উপর। নারকীয় হত্যাযজ্ঞের হার্মাদ’দের হাতে লাখো লাখো মানুষ জীবন দিয়েছেন। কিন্তু ওরা জানেনা তপ্ত লহর এই ক্ষুরধার স্রোত সারা বাংলার বুকে যে রক্তবীজ ছড়িয়ে যাচ্ছে তা থেকে জন্ম নেবে লাখো-কোটি শহীদের ভাই। ওরা বাংলার ঘরে ঘরে শত্রু হত্যার উৎসব বসাবে।
রক্তচোষা হায়নার বাচ্চারা ২৩টি বছর শাসন করেছে সরলপ্রান বঙ্গবাসী কে। যেকোনো শাসকচক্রই পাঞ্জাবি স্বার্থান্বেষী শকুনিদের অঙ্গুলিহেলনে উঠেছে বসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের লুটেরারা সবসময় ওদের পাঞ্জাবি প্রভুদের রেখেছে সোনার বাংলার সম্পদ হরন করে। কারণ ছিল স্পষ্টঃ এদের শয়তান বৃদ্ধিকে নিবৃত্ত করতে না পারলে আসন টলে উঠবে। কিন্তু মুষ্টিমেয় শয়তানি শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের ঐক্য সংঘ শক্তি আরো নির্মম, তা কিন্তু অত্যাচারী লোভাতুরেরা এটা ভাবতেই পারেনি। এবারের এই নিদারুণ মার খাওয়া, তাই ওদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে ফেলেছে।
হানাদার বাহিনী তাই অকথ্য অত্যাচার করে মানুষের মনোবল ভেঙে দেয়ার অপচেষ্টায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে। মানুষের ধন সম্পদ লুট করছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে, মা বোনের ইজ্জত লুটছে। কিন্তু এতেও পিশাচ শক্তির লোলুপ আকাঙ্ক্ষা মেটেনি। করে খুঁজে বের করছে মীরজাফরদের -বাংলার মাটির সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে অতীতে, এখনো করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। এইসব গণবিরোধী স্বার্থান্বেষীদের চক্রান্ত কখনো এদেশের মানুষের জীবন প্রয়াসকে এগুতে দেয়নি। আর তাকে রুখবার অপপ্রয়াসে মেতে উঠেছে নানান ফন্দিতে। এখনো ওদের চক্রান্তের জাল বিস্তৃত বাংলাদেশের বুকে। দখলদার পাক ফৌজের নির্মমতার রজ্জুকে ওরা নিজ দেশবাসীর গলায় পরিয়ে দিতে ততটুকু দ্বিধা করে না। নিজের মা বোনের ইজ্জত পরদেশি হায়নার কাছে বিকিয়ে দিতে ইতস্তত করে না।
মুক্তাঞ্চলে খবর আসছে ওদের অপকীর্তির। ওরা হানাদার ফৌজের ছত্রছায়ায় দখল করে নিচ্ছে বাংলাদেশের নিরীহ নাগরিকদের ঘরবাড়ি, অপহরণ করছে ধন-সম্পদ। খবর এসেছে: সংগ্রাম বিরোধী হানাদার দস্যুদের পদলেহী কুকুরের দল আজ বাংলাদেশের নিরীহ নিরপরাধ মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিদিন নিলামে ডেকে নিচ্ছে। হানাদারেরা নিলামে উঠেছে আর এই নরক কীটেরা তা ডেকে নিচ্ছে প্রায় মুফতে। কিংবা তার নাম মাত্র মূল্যে। কারো ফেলে যাওয়া ব ব্যবসায় পুঁজি হয়তো বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকার কিন্তু তোষণকারী অমানুষগুলো ওগুলো নিলামের ডাকে নিয়ে নিচ্ছে হয়তো কয়েক শ’ টাকায় অথবা স্রেফ দালালীর বিনিময়ে।
কিন্তু এইসব মীরজাফরের বিচার একদিন হবেই। এবং জনগণের হাতে ওরা পাবে সমুচিত শাস্তি। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকারীদের বরদাস্ত করবে না। ওরা দেশদ্রোহী, ওরা জাতিদ্রোহীতার আসামী। জনতার বিচারের কাঠগড়ায় ওদেরকে দাঁড়াতে হবে ওদের প্রভুদের সাথে। একসাথে শুনতে হবে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত মীরজাফরদের শাস্তির রায়। জনতার রায়ে আবার এইসব অপহৃত লুণ্ঠিত সম্পদ ফিরে যাবে পূর্ব মালিকের হাতে। মানুষ পাবে হৃত মর্যাদা আর বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর পাবে সমুচিত শাস্তি।
সংকট মানব সৈয়দ নজরুল
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাঙালিদের কাছে একজন সংকট মানব হিসেবে পরিচিত। বস্তুতঃ আওয়ামী লীগ ও বাঙালি যখনই কোনো সংকটে পতিত হয়েছে তখনই তার উপর অর্পিত হয়েছে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব। সহজ সরল নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কথার চেয়ে কাজ করেন বেশি -চিন্তা করেন আরও বেশি।
ইংরেজি ১৯২৫ সালে ময়মনসিংহের কিশোরগঞ্জ থানার যশোদল গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৪৫ সালে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাস করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রীও লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই হয়েছিল তার রাজনীতির হাতেখড়ি এবং তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে ১৯৪৫ সালে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন প্রভাবশালী নেতা। এ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জিন্নাহর কাছে যে প্রতিনিধিদলটি গিয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাতেও অন্যতম সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সক্রিয় ভূমিকা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
একজন সরকারি চাকুরের পুত্র উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরে হবেন এটাই ছিল তার আত্মীয়-স্বজনের অনেকের বাসনা। কিন্তু বিধাতা যার জন্য একটা বিরাট দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে রেখেছেন – সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি শাসিত বঞ্চিত জাতিকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নির্দিষ্ট করেছেন, তিনি কি করে সরকারি চাকরি করবেন। তাই পাকিস্তানের সর্বাধিক লোভনীয় সেন্ট্রাল কুরিয়ার সার্ভিসে প্রতিযোগিতা করে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ট্যাক্সেশন সার্ভিসের যোগদান করে এক বছর চাকুরীও করলেন কিন্তু বিবেকের দংশন ও মনের পীড়নে এই স্বাধীনচেতা মানুষটি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে অধ্যাপনায় যোগ দিলেন। পেশা মানে সভা চাকরিতে থাকাকালে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদ কিভাবে শোষণ করে বাংলাদেশকে। তাই পরবর্তীকালে তাকে পশ্চিমা-শোষণ বিরোধী সংগ্রামে অটল থাকতে দেখা গেছে।
১৯৫১ সাদাস্রাব নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ বারে যোগদান করেন এবং সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। তার সৎ চিন্তা সততা ও নির্ভীকতা অল্পদিনের মধ্যেই তাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কর্মী মহলে প্রিয় করে তোলে। ১৯৫৭ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ঐ বছরেই দলের প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশে আইয়ুবী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন শুরু হয় তিনি ছিলেন তার অন্যতম পুরোধা।
১৯৬৬ সাল। এ বছরটা ছিল আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের জন্য একটা সংকটকাল। শেখ মুজিবরের ছয় দফা বাঙালি জাতির মনে একটা আশার আলো তুলে ধরল। আইয়ুব খান ও তার দালাল মোনায়েম খান ছয় দফার জনপ্রিয়তায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। আইয়ুব প্রকাশ্যে ঘোষণা করলেন আওয়ামী লীগ ও ছয় দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের কথা। শুরু হয়ে গেল ধরপাকড় নির্যাতন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মোস্তাক হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারে। শুরু হয়ে গেল কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রস্তুতি। প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন বাইরে। তিনি দৃঢ় হাতে তুলে দিলেন দলের নেতার দায়িত্ব। প্রমাণ করে দিলেন নেতাদের গ্রেফতার করে বাঙালিকে স্তদ্ধ করা যাবে না। ৭ই জুন ঢাকা নারায়ণগঞ্জের রাজপথে খোড়া হল আইয়ুব-মোনায়েম শাহীর কবর। এর সবই হয়েছিল অকুতোভয় স্থিরচিত্ত সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে।
১৯৬৯ সালের আলামিন দিতে যে গোলটেবিল বৈঠক হয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। গত ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে তিনি জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সহকারি নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন, যার নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।
পাঞ্জাবি পুঁজিপতি ও সেনাবাহিনীর স্বার্থেই চালানো হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যা -সীমান্ত গান্ধী
খুদাই-খিদমতগার নেতা ও সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গফফর খান গত ২২ মে এক বিবৃতিতে অবিলম্বে বাংলাদেশ পাঞ্জাবি সেনাবাহিনীর গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
জনাব গফফার খান বলেন বাংলাদেশে বর্তমানে যে যুদ্ধ চলছে তা আসলে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য নয়, বরং পাঞ্জাবি স্বার্থ রক্ষার জন্য চালানো হচ্ছে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, পাঞ্জাবের জনাকয়েক সমর নায়ক ও পুঁজিপতির স্বার্থে এ যুদ্ধ চালানো হচ্ছে।
খান আবদুল গফফর খান বলেন, বাংলাদেশের একমাত্র অপরাধ তারা বিগত নির্বাচনে জয়লাভ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার দাবী করছে। তিনি বলেন বাঙালিরা পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য দায়ী নয়। এজন্য যদি কেউ দেখে থাকেন তারা হলেন ভুট্টো, কাইউম ও পাঞ্জাবি চক্র।
পাকিস্তান সৃষ্টির ইতিহাস বর্ণনা করে খান সাহেব বলেন ভারতের অন্য কোন প্রদেশের যখন মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠিত হতে পারেনি তখন বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মুসলিম লীগ সরকার। বাংলাদেশের মুসলমানরা সেদিন পাকিস্তানের দাবি সমর্থন না করলে, পাকিস্তানের জন্মই হতো না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আজ সেই বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে পাকিস্তান ভঙ্গের অভিযোগ। তিনি আরো বলেন যে বাঙালি মুসলমানরা মনেপ্রাণে মুসলমান আজ তাদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে ইসলাম ধ্বংসের অভিযোগ।
আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচি পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী বলে স্বার্থবাদী মহল যে বাজে অজুহাত খাড়া করেছে তার জবাবে বাদশাহ খান সাহেব বলেন, ছয় দফা দাবি পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী হয়ে থাকে তাহলে পূর্বাহ্নে তা নিষিদ্ধ করা হলো না কেন? অথবা আওয়ামী লীগকে ছয় দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অবতীর্ণ হতে দেয়া হলো না কেন? তিনি আরও জিজ্ঞাসা করেন ছয় দফা যদি পাকিস্তানের সংহতির পরিপন্থী হয়ে থাকে তাহলে ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ সাহেব কে পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করেছিলেন কেন? অথবা ছয় দফা যদি পাকিস্তানের স্বার্থের পরিপন্থী শেখ মুজিব যদি দেশদ্রোহী হয়ে থাকেন তাহলে ইয়াহিয়া খান সাহেব নির্বাচনে জয়লাভের পর শেখ মুজিব ও তার দলকে অভিনন্দনেই বা জানিয়েছিলেন কেন?
এ প্রসঙ্গে খান আবদুল গফফর খান বলেন জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু হয়েও বাংলাদেশের যদি আজ এ অবস্থা হয়ে থাকে তাহলে হিন্দু সীমান্তের মত সংখ্যালঘুদের ভাগ্যে যে কি ঘটতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। সীমান্ত গান্ধী জানান যে বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে সে ব্যাপারে মধ্যস্থতা করতে তিনি রাজি আছেন বলে ইয়াহিয়াকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান সে প্রস্তাবে সাড়া দেননি। সেজন্যই বাংলাদেশের সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে নিজস্ব বক্তব্য প্রকাশে বিলম্ব ঘটেছে বলে তিনি জানান। তিনি জানান যে এখনও তিনি তার প্রস্তাবে অটল রয়েছেন এবং পাকিস্তান সরকার সম্মত থাকলে তিনি পাঞ্জাব সিন্ধু ও বেলুচিস্তান থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি নিয়ে বাংলাদেশের যেতে রাজি আছেন। বাংলাদেশের মানুষ এ ব্যাপারে তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাবে বলে তার বিশ্বাস।
উপসংহারে সীমান্ত গান্ধী বলেন আজ বাংলাদেশের যা কিছু ঘটছে তা পাঞ্জাবের সেনাবাহিনীও পুঁজিপতিদের সার্থে ও নির্দেশেই ঘটছে।
আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক-
ইসলামঃ
জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রিয় ধর্ম হল ইসলাম। আওয়ামী লীগের মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্ট গ্যারান্টি থাকবে যে পবিত্র কুরআন ও সুন্নায় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলীর পরিপন্থী কোন আইনে পাকিস্তানের প্রণয়ন বা বলবৎ করা চলবে না। শাসনতন্ত্রের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি সন্নিবেশিত হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সংখ্যালঘুঃ
সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং আইনের কাছে সমান আশ্রয় পাবে। তারা পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন এবং প্রচারে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও পরিচালনায় এবং স্ব স্ব ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষা দানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিক ভাবে রক্ষা করা হবে। স্বীয় ধর্ম ব্যতীত অন্য কোন ধর্ম প্রচারের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো ব্যক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা চলবে না। ভিডিও ধর্মের শহীদ সংশ্লিষ্ট না হলে কোন ব্যক্তিকে ধর্ম সম্পর্কীয় কোনো নির্দেশ গ্রহণ অথবা কোন ধর্মীয় উপাসনালয় অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে বাধ্য করা চলবে না।
জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তাঃ
অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিক এ কর্মসংস্থানের সুযোগ সহ প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা পূরণের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের-একথার স্বীকৃতি শাসনতন্ত্র থাকবে।
আওয়ামী লীগ প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সাম্যের নীতির প্রতি বিশ্বাস পুনরায় ঘোষণা করছে এবং সকল নাগরিককে গণতান্ত্রিক সমাজের সর্বক্ষেত্রে পূর্ণ নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।
মৌলিক অধিকারঃ
বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, জনসভা আহ্বানের স্বাধীনতা, সমিতি গঠনের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিগত কাল থেকে শান্তি কার্যকর করা ও সর্বোপরি বেআইনি গ্রেপ্তার এবং বিনা বিচারে আটক থেকে রক্ষার ব্যবস্থা সহ সকল মৌলিক অধিকার শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হবে। অস্পৃশ্যতা, দাসত্ব এবং বলপূর্বক শ্রম আদায় নিষিদ্ধ করা হবে।
প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অন্তর্গত অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা হবে।
এতদ্ব্যতীত শ্বাসনতন্ত্রের বিধান থাকবে যুদ্ধকালীন প্রকৃত আক্রমণের সময় ছাড়া মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। জাতীয় জরুরি অবস্থার অজুহাতেও এই অধিকার খর্ব করতে দেওয়া হবে না।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ঃ
শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শাসনতন্ত্রের প্রশাসন বিচার বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের নিশ্চয়তা থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখার মতো চরিত্রবান জ্ঞান এবং ব্যক্তিদের বিচার বিভাগের সদস্য হতে পারেন শাসনতন্ত্রের বিধান রাখা হবে।
অর্থনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিঃ
শোষণমুক্ত একটানা ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করায় এই অর্থনৈতিক কর্মসূচির মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প-জাতীয় অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধির ফল যথাযথ বণ্টনের বিধান থাকবে। যে সমাজে অধিকাংশ মানুষেরই দারিদ্র্যের অতল জলে নিমজ্জিত এবং জীবনের মৌলিক প্রয়োজন গুলো থেকে বঞ্চিত সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি প্রয়োজন অপরিহার্য। আমাদের সমাজের নবজাতকের সংখ্যার ঊর্ধ্বগতি ও মৌলিক সম্পদের স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনে বিরামহীন সংগ্রাম ও বিপুল ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। আমাদের কাজ হল গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে একটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন।সংগ্রাম ও ত্যাগ ব্যতীত দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন অন্যায় করেন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মিথ্যা অঙ্গীকারের সামিল।
এটাই কি ইয়াহিয়া খানদের ইসলাম?
অতি লোভে তাঁতি নষ্ট বলে একটা কথা আছে। পশ্চিম পাকিস্তানের একটা বিশেষ এলাকার পুঁজিপতি ও সমর নায়কদের অতিলোভী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের অপমৃত্যুর কারণ হলো। কারণে উক্ত অঞ্চলের পুঁজিপতি ও সমর নায়করা পাকিস্তানের জন্মাবধি দেশের সমস্ত ধন-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য চাকরি-বাকরি সবকিছু কুক্ষিগত করার প্রয়াস চালিয়ে যেতে লাগল। পাকিস্তানের বেশিরভাগ জনসংখ্যা পূর্বপাকিস্তানে হওয়া সত্ত্বেও রাজধানী করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। দেশের তিন তিনটি সামরিক দপ্তর স্থাপন করা হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশের স্বার্থ ও অর্থের বিনিময় গড়ে তোলা হলে সেনাবাহিনী। সারা পাকিস্তানের নামে বিদেশ থেকে অর্থ নেতা ঢালা হল পশ্চিম পাকিস্তানের -এ যেন পরের ধনে পোদ্দারি।
রপ্তানি বাণিজ্যঃ কোটি টাকার হিসাবে
সাল বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান মোট
১৯৪৮-৪৯ ৪২.৯০ ৫১.৯৯ ৯৫.৮০
১৯৪৯-৫০ ৬২.৯০ ৫৬.৫০ ১১৯.৪০
১৯৫০-৫১ ১২১.১০ ১৩৪.৩০ ২৫৫.৪০
১৯৫১-৫২ ১০৮.৭০ ৯২.২০ ২০০.৯০
১৯৫২-৫৩ ৬৪.২০ ৮৬.৮০ ১৫১.০০
১৯৫৩-৫৪ ৬৪.৫০ ৬৪.১০ ১২৮.৬০
১৯৫৪-৫৫ ৭৩.২০ ৪৯.১০ ১২২.৩০
১৯৫৫-৫৬ ১০৪.১০ ৭৪.৩০ ১৭৮.৪০
১৯৫৬-৫৭ ৯০.৯০ ৬৯.৯০ ১৬০.৮০
১৯৫৭-৫৮ ৯৮.৮০ ৪৩.৪০ ১৪২.২০
১৯৫৮-৫৯ ৮৮.১০ ৪৪.৪০ ১৩২.৫০
১৯৫৯-৬০ ১০৮.০০ ৭৬.৩০ ১৮৪.৩০
১৯৬০-৬১ ১২৫.৯০ ৫৪.৩০ ১৭৯.৯০
১৯৬১-৬২ ১৩০.১০ ৫৪.০০ ১৮৪.৩০
১৯৬২-৬৩ ১২৪.৯০ ৯৯.৮০ ২২৪.৭০
১৯৬৩-৬৪ ১২৪.০০ ১১৪.০০ ২২৯.৯০
১৯৬৪-৬৫ ১২৬.৮০ ১১৪.০০ ২৪০.৮০
১৯৬৫/৬৬-
১৯৬৯/৭০ ৭৭৮.৬০ ৭৮৩.৫০ ১৫৬২.১০
২৪৩৭.৭০ ২০৫৫.৬০ ৪৪৯৩.৩০
আর সারা দেশের ধন-সম্পদের উপর নিজেদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব কায়েম রাখার জন্য ষড়যন্ত্র করে পশ্চিম পাকিস্তানে কায়েম হতে দিল না গণতন্ত্র ও ইনসাফ। যখনই বাঙ্গালীদের ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ এসেছে তখনই তা তারা অস্ত্রের জোরে তা বানচাল করে দিয়েছে।
তাদের এই অপকর্ম ঢাকা দেবার উদ্দেশ্যে তারা সবসময় ব্যবহার করেছে পবিত্র ইসলামের নাম। অথচ ইসলামের মূল কথাই হল ইনসাফ। দুনিয়ার সমস্ত বিবেকবান মানুষেরা বুঝতে পেরেছেন পাঞ্জাবি পুঁজিপতি ও সামরিক বাহিনীর সার্থেই বিগত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল বানচাল করা হয়েছে। বাঙ্গালীদের উপর চালানো হয়েছে গণহত্যা। অথচ এই জল্লাদেরই মুখে শুনতে পাচ্ছি ইসলামের কথা। কিন্তু আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে চাই অপরকে বঞ্ছনা করা, অপরের মুখের গ্রাস কেরে খাওয়াই কি ইসলামে নীতি?
শুধুমাত্র বৈদেশিক আমদানি-রপ্তানি হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ইসলামের নামে পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমি স্বার্থবাদীরা কিভাবে বাংলাদেশকে শোষণ ও বঞ্চনা করেছে। ১৯৪৮-৪৯ সাল থেকে ১৯৬৯-৭০ সাল পর্যন্ত রপ্তানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ আয় করেছে ২৪শ’ ৩৮ কোটি টাকা; অথচ আলোচ্য সময়ে বাংলাদেশে আমদানি করেছে মাত্র ২হাজার ১৭ কোটি টাকার পণ্য অর্থাৎ বহির্বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত রয়েছে ৫’শ কোটি টাকা।
পক্ষান্তরে আলোচ্য সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান আয় করেছে ২হাজার ৫৫ কোটি টাকা। অথচ সে ব্যয় করেছে ৪ হাজার ৩শ ৭৭ কোটি টাকা বৈদেশিক বাণিজ্য পশ্চিম পাকিস্তানের ২ হাজার ৩শ ৬০ কোটি টাকার ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে বাংলাদেশের উদ্বৃত্ত থেকে। তারপরও যে ঘাঁটতি বাকি রয়েছে তা পূরণ করার ব্যবস্থা রয়েছে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পাট বেচা টাকা দিয়ে।
পাঞ্জাবি পুঁজিপতি ও সমর নায়করা জানে বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে গেলে পরের ধনে পোদ্দারি করা এক দিনও চলবে। না দুই হাজার কোটি টাকা আয় করে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা চলবে না। তাই নিজেদের কায়েমি স্বার্থ বজায় রাখার জন্য তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষের উপর। হত্যা করছে তাদেরকে নির্বিচারে।
আর এসব অপকর্ম ঢাকার জন্য তারা ব্যবহার করছে পবিত্র ইসলামের নাম।
আমদানি বাণিজ্যঃ কোটি টাকার হিসেবে
সাল বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান মোট
১৯৪৮-৪৯ ২৮.২০ ১১৭.৭০ ১৪৫.৯০
১৯৪৯-৫০ ১৩৮.৫০ ৯১.২০ ১২৯.৭০
১৯৫০-৫১ ৪৫.৩০ ১২৬.৭০ ১৬২.০০
১৯৫১-৫২ ৭৬.৩০ ১৪৭.৪০ ২২৩.৭০
১৯৫২-৫৩ ৩৬.৬০ ১০১.৮০ ১৩৮.৪০
১৯৫৩-৫৪ ২৯.৪০ ৮২.৪০ ১১১.৮০
১৯৫৪-৫৫ ৩২.০০ ৭৮.৩০ ১১০.৩০
১৯৫৫-৫৬ ৩৬.১০ ৯৬.৪০ ১৩২.৫০
১৯৫৬-৫৭ ৮১.৯০ ১৫১.৬০ ২৩৩.৫০
১৯৫৭-৫৮ ৭৩.৬০ ১৩১.৪০ ২০৫.০০
১৯৫৮-৫৯ ৫৫.৪০ ১০২.৪০ ১৫৭.৮০
১৯৫৯-৬০ ৬৫.৫০ ১৮০.৬০ ২৪৬.১০
১৯৬০-৬১
১৯৬১-৬২ ৮৭.৩০ ২২৩.৬০ ৩১০.৯০
১৯৬২-৬৩ ১০১.৪০ ২১৭.৪০ ৩১৮.৮০
১৯৬৩-৬৪ ১০১.৯০ ২১৭.৪০ ৩১৮.৮০
১৯৬৪-৬৫ ১৪৮.৯০ ২৯৪.১০ ৪৪৩.০০
১৯৬৫-৬৬ ১৭০.০০ ৩৬৭.০০ ৫৩৭.৪০
১৯৬৬-
১৯৬৯/৭০ ৭৮৮.৫০ ১৬১৬.৫০ ২৪০৫.০০
২০১৭.০০ ৪৩৭৬.৭০ ৬৩৯৩.৭০