মুজিব হত্যার হাতিয়ার খাদ্য সংকট : চক্রান্ত-২
১. পর পর দুই বছর প্রচণ্ড বন্যা, অনাবৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদির ফলে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশে খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। বিশ্বে তেলের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে ১৯৭৪-এর পূর্বেই মুদ্রাস্ফীতি চরম আকার ধারণ করেছিল। বিশ্ব মুদ্রাস্ফীতির ধাক্কায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা নিঃশেষিত। এমনি অবস্থা দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শােনা গেল। বঙ্গবন্ধু বিশ্বের দরবারে খাদ্য ক্রয়ের জন্য প্রাণাত্মক প্রচেষ্টা চালালেন। অবস্থার দ্রুত অবনতি দেখে সােভিয়েত ইউনিয়ন ত্বরিত গতিতে খাদ্য সাহায্য করে, কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় তা ছিল নগণ্য। বঙ্গবন্ধু হাজারাে প্রয়াস নিয়েও খাদ্য সংকট ঠেকাতে ব্যর্থ হলেন। দেশের উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেল। ২৭ হাজার লােক অনাহারে মৃত্যু বরণ করলেন।
১.১ ১৯৭৪ সনের ঘটনা। অক্টোবর। তখন অনাহারে মৃত্যুর খবর আসছে। বঙ্গবন্ধু প্রাণাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সে দিন বিকেল ঘনিয়ে এসেছিল …। গণভবনে গেলাম। দেখলাম উত্তরাঞ্চলীয় সংসদ সদস্যদের কয়েকজন উপস্থিত। তার মধ্যে জনাব লুৎফর রহমান সাহেব রংপুর এলাকার দুর্দশার কথা বলেছিলেন। অনাহারী মানুষের কথা, মৃত্যুর কথা, বেদনার কথা। বঙ্গবন্ধুর চোখে পানি। দুই হাতে মুখ ঢাকলেন। তার বিষন্ন মুখের দুই পাশ ঘিরে অবিন্যস্ত কাঁচাপাকা চুলরাশি। অসহায়। বিপর্যস্ত। বেদনার্ত বিশাল একটি মানুষ। রক্তাক্ত হৃদয়।
১.২ কেন এই দুর্ভিক্ষ? অনেক গবেষকই অভিযােগ করেছেন দেশে যে খাদ্য ছিল তা সুষ্ঠু বিলিবণ্টন হলে বহু লােকের প্রাণ বাঁচানাে যেতাে। অভিযােগটির সত্যতা বিশ্লেষণ সাপেক্ষ-বিতর্কিত। তবু একটি কথা এখানে বিরাট প্রশ্নের আকারে আজো আমাকে আলােড়িত করে, আর তা হলাে খাদ্য বিভাগ সেদিন সময়মতাে ও দ্রুত খাদ্য সরবরাহে ব্যর্থ হয়েছিল কেন? কেন এই দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পূর্বাহ্নেই জানানাে ও প্রতিরােধের ব্যবস্থা করা হয়নি? সে সময় খাদ্য সচিব ছিলেন আবদুল মােমেন খান। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর যিনি জিয়াউর রহমানের মন্ত্রী সভায় খাদ্য মন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন। যে ব্যক্তি খাদ্য সচিব হিসেবে ১৯৭৪ সনে ব্যর্থ হলেন, তিনিই ১৯৭৫ সনের বঙ্গবন্ধু হত্যার পর কেন ব্যর্থতার পুরস্কার লাভে ধন্য হলেন? কেন? এখানে কোনাে জাতীয় ষড়যন্ত্র ছিল কি?
১.৩ খাদ্য বিভাগের এই জাতীয় ব্যর্থতা ও ষড়যন্ত্রের পাশাপাশি বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট মানুষদের নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি জঘন্য ষড়যন্ত্রে মেতেছিল তার প্রমাণ এখন উদ্ঘাটিত। কাউন্সিল অফ ফরেন রিলেসন্স (নিউইয়র্ক)- এর জর্নাল ফরেন এফেয়ার্সের ১৯৭৬ সনের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের প্রকৃত কারণ প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখানাে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার শেখ মুজিব ও তার সরকারকে দুর্বল করার জন্য কিভাবে তার খাদ্য রপ্তানি নীতিকে ব্যবহার করেছে। ‘ফুড পলিটিক্স’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে এমারথ চাইল্ড লিখেছেন- সি, আই, এ খাদ্যই শক্তি’ এই নব্য মতবাদকে সামনে রেখে খাদ্য রাজনীতি দ্বারা ক্ষমতা ও প্রভাব খাটানাের কৌশল উদ্ভাবন করছে। ১৯৭৪ সনে বাংলাদেশ সি. আই. এর সেই খাদ্য রাজনীতির শিকার হয়েছে মৃত্যু হয়েছে হাজার হাজার মানুষের। উক্ত গবেষণা নিবন্ধের কালের দুর্ভিক্ষের উৎস সম্পর্কে বলা হয়েছে ? বাংলাদেশ ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সনে বাণিজ্যিক বাজার থেকে আমেরিকান খাদ্য কেনে। ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বাংলাদেশ সরকার খাদ্য ঘাটতি পূরণের জন্য কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য ক্রয়ের চুক্তি সম্পাদন করে। চলতি বাজার দরেই এ সব খাদ্য ক্রয়ের কথা ছিল। অর্থ যােগানাে হতাে সুদ হারের ঋণ থেকে। ১৯৭৪ সালে গ্রীষ্মে বাংলাদেশ সরকার বৈদেশিক মুদ্রার তীব্র ঘাটতির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্থায় ঋণ সংগ্রহ অসম্ভব হয়ে পড়ে। মার্কিন খাদ্যশস্য সরবরাহকারী কোম্পানিগুলাে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাংলাদেশে পৌছানাের জন্য স্থিরীকৃত দুটি বড় চালানের বিক্রয় বাতিল করে। বাংলাদেশ ঐ সময় বহু চেষ্টা করেও মার্কিন সরকারের ঋণ লাভে ব্যর্থ হয়।
ঐ একই সাথে পি, এল-৪৮০ কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশকে। প্রদত্ত খাদ্যশস্য পাঠানাে বিলম্বিত করা হয়। কারণ দেখানাে হয়। বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাট বিক্রয় করার ফলে বাংলাদেশ সাহায্য পাবার যােগ্য কিনা তা নির্ধারণ করা প্রয়ােজন। যদিও ঐ একই সময় মিশর কিউবায় তুলা রপ্তানি করেছিল এবং মিশরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য করতে কুণ্ঠিত হয়নি। ১৯৭৪ সনের ৭ই জুন পি, এল-৪৮০-এর অধীনে ১ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল মিশরকে। ২.. সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলাে এই যে, কিউবার সঙ্গে গােপনীয় ৪০ লক্ষ পাটের থলে রপ্তানির চুক্তি সম্পর্কিত একটি খবর বিশেষ সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়। ঐ সংবাদের কাটিং নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনের সঙ্গে দুই দুইবার সাক্ষাৎ করেন এবং যথা সময়ে বাংলাদেশে খাদ্য প্রেরণের ক্ষেত্রে অজুহাত ও অন্তরায় সৃষ্টি করা হয়। খাদ্য সংকট সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সরকারের প্রচেষ্টার অন্ত ছিল না। যেমন ১৯৭৩ সালের ১লা আগস্ট ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব উইলিয়ম রজার্সের সাথে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বৈঠক করেন। উক্ত বছরের ৩০শে আগস্ট বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম ও মার্কিন সাহায্য সংস্থার সহকারী প্রশাসক মরিস উইলিয়ামসের মধ্যে এক বৈঠক হয় এবং ১৯৭৪ সনের ৯ই জানুয়ারি ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্র সচিবের সাথে দেখা করেন। এ সব সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য ছিল খাদ্য সাহায্য প্রার্থনা।
২.১ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা থেকে সােভিয়েত ইউনিয়নের নগদ দামে কেনা ২ লক্ষ টন খাদ্য জাহাজ যােগে সে দেশের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল। বাংলাদেশ সরকার অনুরােধ জানালে সে খাদ্যশস্য সােভিয়েত বাংলাদেশকে প্রদান করে। যার ফলে সংকটপূর্ণ রেশন ব্যবস্থা সে সময় চালু সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় তা ছিল নগণ্য।
২.২ যাহােক, বারবার আবেদন-নিবেদন করার পরেও যুক্তরাষ্ট্র কাঙ্খিত সময়ে খাদ্যশস্য পাঠায়নি। অজুহাত কিউবাতে পাটের থলে রপ্তানি। এ সম্পর্কে অধ্যাপক রেহমান সােবহান লিখেছেন, “কেন যে পাটের থলে কাঁচা তুলার চেয়ে অধিকতর বিপজ্জনক ‘অস্ত্র’ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল অথবা কেন মিশরের ক্ষেত্রে যে বিশেষ অনুমতির ব্যবস্থা হয়েছিল তা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও হলাে না—এই সব প্রশ্নের কোনাে উত্তর নেই। প্রকৃত ব্যাখ্যা সম্ভবত এটাই যে, মিশরের আনােয়ার সাদত সেই সময় কিসিঞ্জারের কুটনীতিকে পশ্চিম এশিয়ায় প্রয়ােগ করেছিলেন বা প্রয়ােগে সহায়তা করেছিলেন।
৩. অন্য যে কোনাে সময়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু মুজিব আমেরিকার এই ধরনের আচরণের মােকাবিলা করার দিকেই ঝুঁকতেন এবং বাংলা-মার্কিন সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতেন। এমনটি তার জন্য নতুনও নয়।
৩.১ ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে পাকিস্তানের বৈদেশিক ঋণের উত্তরাধিকার অস্বীকার করার মাধ্যমে তিনি এ ধরনের একটি অবস্থা অতীতেই সৃষ্টি করেছিলেন। তবে ঐ মুহূর্তে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনে রাজনৈতিক বীরত্ব প্রদর্শনের কোনাে অভিলাষ ছিল না। চালের দাম মণ প্রতি ১৪০ টাকা রেখে দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে শক্তি সংগ্রহের সম্ভাবনা তদানীন্তন অর্থনৈতিক কাঠামােয় খুবই সীমিত ছিল। সে জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার দুর্ভিক্ষ ঠেকানাে ও মানুষকে বাঁচানাের স্বার্থে নতি স্বীকার করে এবং ফলশ্রুতিতে ১৯৭৪ সনের ১০ই জুলাই ব্যক্তিগত খাত ও বিদেশী। বিনিয়ােগকারীদের অনুকূলে বঙ্গবন্ধুকে নীতি পরিবর্তনের বিষয় বিবেচনা করতে হয়।
৩.২ এত সব প্রতিশ্রুতি ছাড়া, কনশেসান দেয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খাদ্যশস্য পাঠাতে অহেতুক বিলম্ব করল। অজুহাত হিসেবে বলল, কিউবায় পাঠানাে পাটের থলির সরবরাহের বিষয়-পর্ব পুরােপুরি শেষ না হওয়ায় খাদ্যশস্য পাঠানাে হবে না। সুতরাং ১৯৭৪ সনের অক্টোবর পর্যন্ত। কোন খাদ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেয় না। ১৯৭৪ সনের ৪ঠা। অক্টোবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে খাদ্য পাঠানোের সবুজ সংকেত দেয়, কিন্তু দুইমাস পর যখন এ খাদ্য এল তখন দুর্ভিক্ষ শেষ। আর মৃত মানুষের লাশে তখন বাতাস ভারী হয়ে আছে।
সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ