You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.26 | জয় বাংলা ২৬ মে ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

1971.05.26 | জয় বাংলা ২৬ মে ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
মুজিবনগরঃ ১ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যাঃ বুধবার ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮, ২৬শে মে ১৯৭১
জঙ্গী চক্রে প্রতি আমাদের চ্যালেঞ্জ
মিথ্যা প্রচারণার জন্য গোয়েবলস ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। তার এ প্রচারণার মূল প্রতিপাদ্য ছিল একই মিথ্যা বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলতে হবে, এবং বিশ্বাসযোগ্য করে বলতে হবে। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য করে বলার বিষয়টা পাকিস্তানের গোয়েবলসরা যেন ভুলে গেছেন বা জানেন না। তাই তারা কখন কি বলছেন তারা নিজেরাই বোঝেন না।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করতে গিয়ে পিন্ডির জঙ্গিশাহী মহা বেকায়দায় পড়েছে। তারা যে সমস্যার সৃষ্টি করেছে তা আজ তাদেরই গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে। একেবারে যেন ব্যাঙের হাতি গেলা অবস্থা। সেজন্য তারা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য। বাংলাদেশে পরিচালিত গণহত্যার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য অপচেষ্টা মত্ত। ২৫শে মার্চ রাতের অন্ধকারে সারা বাংলাদেশব্যাপী তারা নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমন্ত মানুষের উপর লেলিয়ে দেয় সামরিক বাহিনী। অভিনীত হয় বিশ্বের ইতিহাসের জঘন্যতম মর্মান্তিক নাটক। তারা ভেবেছিল কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তাই ২৬শে মার্চ পাকিস্তান বেতার থেকে বোঝানো হচ্ছিল যে বাংলাদেশের সব কিছুই তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং অফিস-আদালত কাজকারবার যোগাযোগ ব্যবস্থা সবকিছু স্বাভাবিক চলছে। কিন্তু অচিরেই বিশ্ববাসী জানতে পারল যে বাংলাদেশে কোন কিছুই স্বাভাবিক ভাবে চলছে না; বরং পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী সেখানে কয়েক লাখ মানুষকে খুন করেছে। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা বাঙালি।
তাই তারা বলতে চাইলো যে, সামরিক বাহিনী “কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতিকারী”কে শায়েস্তা করছে। ইত্যবসরে জানাজানি হয়ে গেল, মুক্তিবাহিনীর হাতে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, বগুড়া, যশোরের পতনের কথা। এছাড়াও প্রকাশ হয়ে পড়ল বাংলাদেশের অপরাপর স্থানে মুক্তিবাহিনীর হাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বেদম মার খাওয়ার কথা। সুতরাং পাকিস্তানি গোয়েবলসরা কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারীর সাথে যোগ করল ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের কাহিনী। কিন্তু কোথাও হালে পানি পেল না তাদের আজগুবি যুক্তি। দুনিয়ার মানুষ দেখল এবং বুঝল নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত বাঙালিরাই চালাচ্ছে প্রতিরোধ সংগ্রাম। এটা তাদের জাতি হিসেবে বেঁচে থাকা জীবন-সংগ্রাম।
গণহত্যার দায়ে ইয়াহিয়ার জঙ্গী চক্র আজ বিশ্ব বিবেকের কাছে ধিকৃত। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো যুক্তি খুঁজে না পেয়ে দিশেহারা পশ্চিম পাকিস্তানী গোয়েবলসরা উত্থাপন করেছে নয়া অজুহাত। তারা বেছে নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার জঘন্য পথ। তারা বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চাচ্ছে যে লাখো লাখো বাঙালিকে কতল হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ইয়াহিয়া খান তার সেনাবাহিনীর লেলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। তারা বলতে চাচ্ছে যে শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাঙালিরা নির্বিচারে তথায় বসবাসকারী অবাঙালিদের হত্যা করেছে। এই যুক্তি তুলতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ গোষ্ঠী কি সর্বনাশা পথ বেছে নিয়েছে তা বোঝার মত মগজ তাদের নেই।
তাদের এ অজুহাতে কত মিথ্যা, কত অসার একটু চিন্তা করলে যেকোনো মানুষের পক্ষে তা বোঝার কোনো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশের ইয়াহিয়া টিক্কা চক্রের গণহত্যা অভিযান শুরু হয়। ২৫শে মার্চ রাতে ছাব্বিশে মার্চ রাত আটটায় এ অভিযানের যৌক্তিকতা। ব্যাখ্যা করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক দীর্ঘ ভাষণ দেন। তাতে তিনি আওয়ামী লীগ ও তার নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কত কাল্পনিক -কত আজগুবি অভিযোগ করেছিলেন, কিন্তু বাঙ্গালীদের হত্যার কোনো কথাই বলেননি। আওয়ামী লীগ কর্মীরা যদি সত্য সত্যই লাখো লাখো বাঙালিকে হত্যা করে থাকে তবে তা গোপন করে রাখার কি কারন ইয়াহিয়া সাহেবের ছিল। বাঙালিরা ইয়াহিয়া সাহেবের চেয়ে কম মানবপ্রেমিক নয়। ইয়াহিয়া সাহেব যদি সেদিন এ অভিযোগ তুলেছেন এবং তা সত্য বলে প্রমাণিত হত তাহলে বাঙালিরা রুখে দাঁড়াত কথিত খুনিদের বিরুদ্ধে। ইয়াহিয়া সাহেব যে তা জানেন না এমন নয়।
দ্বিতীয়তঃ নিজের নরমেধ যজ্ঞ অভিযানের যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য আধুনিক যুগের সীমার টিক্কা খান বেতার ও টেলিভিশন ভাষণ দিয়েছেন। কিন্তু কই তিনিও তো এ সম্পর্কে একটি কথা বললেন না।
সর্বোপরি ২৫শে মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় অর্ধশত বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামীলীগ তাদের কারো মাথা কিনেন নি বা সে ক্ষমতা কারো নেই। আওয়ামী লীগের অসহযোগের সময় সংবাদপত্রের উপর কোন বিধি-নিষেধ ছিল না, বিদেশে সংবাদপত্রের উপর ছিল না কোন সেনসর্শিপ। তবু, কোন বিদেশী সাংবাদিকের প্রেরিত সংবাদে লাখো লাখো অবাঙ্গালী’ হত্যার কাহিনীতো দূরের কথা অনুরূপ কোনো ঘটনার আভাস ও তো তারা দেননি? সামরিক চক্রের কাল্পনিক দৃষ্টিতে বাংলাদেশের ঘটনাবলী অবলোকন করতে পারেনি বলেই কি তাদের আনা হয়নি?
আমাদের এইসব অকাট্য যুক্তি এর পরও যদি সামরিক চক্রের অভিযোগ সম্পর্কে কারো মনে কোন সন্দেহ থাকে তাহলে এর জন্য আমরা ব্যাপারটা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক তদন্তের প্রস্তাব দিচ্ছি এবং তা গ্রহণের জন্য সামরিক সরকারকে চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি।
পরিশেষে বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালিদের প্রতি আমাদের দুটো কথা। বিদ্রোহী মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে তাদের শাসন করার ( divide and rule) নীতি উপনিবেশিক শাসকরা সব দেশেই অনুসরণ করে থাকে। পিণ্ডির উপনিবেশিক শাসক গোষ্ঠী আজ নেই নীতিরই আশ্রয় নিয়েছে। তারা বাঙালি অবাঙালির মধ্যে ভাষাগত সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করে বাংলাদেশের উপর তাদের শাসনের যাতাকল বহাল রাখতে চাচ্ছে। যাদের জন্য আজ তারা মায়াকান্না কাঁদছে এই ঘৃণা, মিথ্যা প্রচারণা যে দুদিন পরে তাদের সর্বনাশের কারণ হতে পারে, তা তারা আজ ভেবে দেখছে না। অবশ্য তা ভেবে দেখার প্রয়োজনও তাদের নেই।
পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদীদের লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনীকে বাঙালি আজ যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তাতে বাংলাদেশ থেকে দুদিন আগেই হোক আর পরেই হোক তাদেরকে তল্পিতল্পা গোটাতেই হবে। কিন্তু যাবার সময় তারা বাংলাদেশে বসবাসকারী অবাঙালিদের প্রতি তাকাবেও না। যেমনটি ঘটেছিল পাকিস্তান অর্জনের পর। ভারতের দশ কোটি মুসলমান অধিবাসীর আবাসস্থল হিসেবে পাকিস্তান অর্জন করে নেতারা যখন পাকিস্তানের পাড়ি জমালেন তখনও ভারতে পড়ে রইলো সাড়ে তিন কোটি মুসলমান। তাদের জন্য এতটুকু দরদও পাকিস্তানের স্রষ্টাদের অন্তরে জাগেনি।
সুতরাং বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকেই বাংলাদেশে থাকতে হবে। বাংলাদেশের সুখ-দুঃখের সমান ভাগি হতে হবে। এ প্রশ্নে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যই আমাদের শেষ কথা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষ বাঙালি -সে যে ভাষায় কথা বলুক, তার আদি বাসস্থান বা ধর্ম যাই হোক না কেন সে বাঙালি। আমরাও বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে আজ বঙ্গবন্ধুর উদ্বুদ্ধ হওয়ার এবং তদনুযায়ী নিজেদেরকে বাঙালি স্বার্থের সাথে একাত্ম করার আহ্বান জানাচ্ছি। কোনো কারণে যদি কেউ আমাদের পক্ষে সক্রিয় সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে না পারেন অন্ততঃ আমাদের বিরুদ্ধে কাজ না করার জন্য তাদেরকে আমরা অনুরোধ করবো।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালি হানাদারের বিতাড়িত করবেই – মাওলানা ভাসানী
পিকিংপন্থী বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা, অশীতিপর বৃদ্ধ জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী দৃড়তার সাথে ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মরণপণ সংগ্রামে নিয়োজিত হয়েছেন তাতে তাদের জয়লাভ সুনিশ্চিত। জয় তাদের হবেই।
মাওলানা সাহেব ঘোষণা করেন যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষ হানাদার বাহিনীকে পরাস্ত করে বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেই।
গত ২১শে মে বাংলাদেশের কোন এক জায়গায় অবস্থানরত বিশ্বের প্রবীণতম রাজনীতিকদের অন্যতম মাওলানা ভাসানী সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলার’ আত্মপ্রকাশকে অভিনন্দিত করে প্রদত্ত এক বাণীতে উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
উক্ত বাণীতে বয়োবৃদ্ধি জননেতা মাওলানা ভাসানী বলেন,’বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আছে দেশমাতৃকার স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখার জন্য এক অসম অথচ মরণপণ সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছেন। ইতিহাসের এই মহা লগ্নে মরণ বিজয়ী নিরস্ত্র জনসাধারণকে পথনির্দেশের জন্য আজ বলিষ্ঠ একটা সংবাদপত্রের প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। এই প্রয়োজন মেটাবার জন্যে জয় বাংলা সাপ্তাহিকটির প্রকাশ একটা সঠিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। আমি এই সাপ্তাহিকের সার্বিক সমৃদ্ধি কামনা করি। এবং কর্মীদের মোবারকবাদ জানাই।
আমার স্থির বিশ্বাস আছে যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ হানাদার বাহিনীকে পরাভূত করে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হবেই ইনশাল্লাহ জয় আমাদের সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।”
শুভেচ্ছাবাণী
সাপ্তাহিক জয়বাংলা প্রকাশিত হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। সুন্দরভাবে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অসমসাহসী কৃতিত্বের বার্তা, স্বাধীনতা সংগ্রামের বিবরণ ও আমাদের মনের কথা এভাবে পত্রিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে আমি সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। মুক্তি ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জয় বাংলা-জয় মাল্য নিয়ে বেঁচে থাক আর এর মধ্যে ফুটে উঠুক বাংলাদেশের মনের কথা।- পথ চলার নির্দেশ। স্বাধীনতা আমাদের এসেছে এবং পরম করুনাময় আল্লাহর কৃপায় তা আমরা রক্ষা করবো
এম, হোসেন আলী
প্রধান
বাংলাদেশ মিশন
সংগ্রামী বাঙালির প্রতি সম্মান
বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা জনাব আব্দুস সামাদ আজাদ গত ১৫ ই মে বুদাপেস্ট অনুষ্ঠিত বিশ্ব শান্তি পরিষদের “ঔপনিবেশিক ও বর্ণ বৈষম্য ভিত্তিক নিপীড়ন” সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ইয়াহিয়ার বর্বর সেনা বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি সম্মান ও সমর্থন জ্ঞাপন এর উদ্দেশ্যে বিশ্ব শান্তি পরিষদ জনাব আজাদের প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন করেছেন। জনাব সামাদ তার ভাষায় বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে মনে না করার জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্র বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্র গুলোর প্রতি আকুল আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আপামর মানুষ আজ ইয়াহিয়ার সেনা বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ মোকাবিলা করছেন এমন একটি সুদক্ষ সেনাদলের যারা গণচীন ও মার্কিন অস্ত্রে সুসজ্জিত। তিনি বাঙালির এই সংগ্রামকে মানবতার সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন, এবং বিপন্ন মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান।
বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলীর রাজনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করে জনাব সামাদ বলেন, পাক সেনাবাহিনী বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি বলেন আমাদের সংগ্রামের প্রতীক ভারত যেভাবে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছেন সেজন্যে ভারতবাসীদের জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। এছাড়া পাকিস্তানের দখলকারী সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন এর জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
হবু রাজার শাসনে ! –
হবু রাজার দেশে গবু মুখ্যমন্ত্রী হবে তাতে বিচিত্র কি? বাংলাদেশের অর্থে পোষা সেনাবাহিনীতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া জানা স্কুল পালানো টিক্কা খান জেনারেল হয়েছেন তাতেও হয়তো অনেকে আশ্চর্য হননি। কিন্তু হাল আমলের হবু রাজা টিক্কা খান বাংলাদেশের আজ যা করছে তাতে বোধ হয় আশ্চর্য না হয়ে পারবেন না।
বাংলাদেশের লাখো লাখো বাঙালিকে মেরে জল্লাদ টিক্কা খান বর্তমানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার (অবশ্য বাংলাদেশের কোন পর্যায়ে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার কথা ঠিক কাদের মুখপাত্র মুখপাত্ররা কোন সময় স্বীকার করেনি) জন্য টিক্কা খান পাগল হয়ে গেছে। ফলে অনেকের কপাল খুলে গেছে। কেননা, হাতের কাছে বিশ্বস্ত লোক যাকে পাচ্ছে তাকেই নিয়ে জোর করে বাবিনাজ ওরে বসিয়ে দিয়েছে প্রশাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন পদে। এর ফলে অনেক গৃহভৃত্য হয়েছে থানার দারোগা, পানওয়ালা হয়েছে ওসি, কেরানি হয়েছে এস,ডি,ও, দারোগা হয়েছে এসপি, এবং কনভেনশন লীগের দাগী চোর ডাকাত হয়েছে ডি,সি।
আমাদের কথা বিশ্বাস না হয় টিক্কা রুপী হবু রাজার দেশ থেকে একবার ঘুরে আসুন। দেখবেন চট্টগ্রামের এসপি পদে লোক বসে আছে সে ছিল ঢাকার দারোগা। পাবনা ও রাজশাহীর ডিসির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছে তারা মাত্র দেড় মাস আগেও বাংলাদেশের দাগি আসামি রূপে সুপরিচিত ছিল।
আর রাজশাহী জেলার চারঘাট থানার ওসি হিসেবে যে লোকেশনে আছে মাত্র দেড় মাস আগেও সে ছিল গৃহভৃত্য।
প্রকাশ, থানার দায়িত্ব পেয়েই ওসি সাহেব পুলিশ দল নিয়ে গিয়েছেন তার থানার এলাকায় একটি গ্রামে গ্রামে লুটতরাজ করতে। কিন্তু ঘটনাস্থলে যে অপ্রত্যাশিত নাটকের অবতারণা হয়েছে তাতে ওসি সাহেব লজ্জা পেয়েছেন কিনা তা আমাদের জানা নেই; তবে যার বাড়ি লুট করতে গিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোক যে লজ্জা পেয়েছেন এবং মনের দুঃখে বনে গিয়েছেন সে বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। প্রকাশ, এই ওসি সাহেব ২৫শে মার্চের আগে পর্যন্ত জেলা শহরে ওই ভদ্রলোকের বাসায় চাকর ছিলেন তাই মনের দুঃখে ভদ্রলোক সপরিবারে অনিশ্চিত পথে পাড়ি জমিয়েছেন।
পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে কান্নার রোল
বাংলাদেশের আসল ঘটনাবলীর কিছুই এতদিন পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে জানতে দেওয়া হয়নি। গোয়েবলসীয় প্রচারণার দ্বারা তাদের বোঝানো হয়েছিল, কিছু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশের সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সামরিক বাহিনী কেবল তাদেরই শায়েস্তা করছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ ততই বুঝতে পারছে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা কেবল দুষ্কৃতিকারীদের কাজ বলে ব্যাখ্যা করা যায় না। এ হচ্ছে বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঞ্চিত বাংলাদেশের সমস্ত মানুষেই রয়েছে এ সংগ্রামের পশ্চাতে। সমস্ত বাংলাদেশকে ঐক্যবদ্ধ করে তুলেছে এই সংগ্রাম। এই যুদ্ধ তার লক্ষ্যে না পৌঁছে থামবে না। সামরিক বাহিনী বিরাট ভুল করেছে, আপোষ রফা আলোচনার পথ বন্ধ করে দিয়ে নির্বিচার গণহত্যা চালিয়ে।
বাংলাদেশের ঘটনায় পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা দিচ্ছে মারাত্মক সংকট। পশ্চিম পাকিস্তানের কলকারখানায় উৎপাদিত পণ্যের তিনভাগের দুইভাগ বিক্রি হতো বাংলাদেশে। এই মাল এখন বাংলাদেশে রপ্তানি হতে পারছে না। মাল জমে যাচ্ছে গুদামে। ফলে অনেক কারখানায় উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে বেকার সমস্যা ও শ্রমিক অসন্তোষ। অন্যদিকে তাদের কল কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে হত বিদেশ থেকে। এই সব জিনিসপত্র আমদানি করার জন্য প্রয়োজন প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার। কিন্তু পাকিস্তানের সঞ্চিত বিদেশি মুদ্রার পরিমাণ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। যা আছে তাও লাগবে গোলাবারুদ কিনতে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করার আগে, পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা প্রধানত উপার্জিত বাংলাদেশের বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্যের মাধ্যমে। বাংলাদেশ প্রতিদিন উপার্জন করত প্রায় ৫০ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে এখন পণ্য রপ্তানি বন্ধ। তাই পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা ঘাটতি রোধের কোন সম্ভাবনা নেই।
বিশ্বের বাজারে পাকিস্তানি টাকা কেউ আর নিতেই চাচ্ছে না। যুদ্ধের আগে পাকিস্তানে সাড়ে চার টাকায় এক মার্কিন ডলার পাওয়া যেত। এটা ছিল বিনিময়ের সরকারি হার। কিন্তু গত দেড়মাসে পাকিস্তানের মুদ্রার মূল্য এতো হ্রাস পেয়েছে যে বর্তমানে ১০ টাকার বিনিময়েও কেউ এক ডলার দিতে চাচ্ছে না। কোন কোন ক্ষেত্রে এক ডলার পেতে হলে ১৫/১৬ টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। বর্তমান যুদ্ধ আর বেশিদিন চলবে বিশ্বের বাজারে ইয়াহিয়া সরকারের টাকার কানাকড়ি মূল্যও থাকবে না। প্রকাশ, ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম এম আহমদ বিভিন্ন দেশের কাছে ঋণ চাইতে গেলে তারা জিজ্ঞাসা করেছিলেন এ ঋণের জন্য দায়ী থাকবে কে? পূর্ববাংলা স্বাধীন হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে একা সমস্ত ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে কিনা? তিনি এসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
পশ্চিম পাকিস্তানের এসব দুরারোগ্য ব্যাধির পাশাপাশি দেখা দিয়েছে আর একটি উপসর্গ। ২৬শে মার্চ থেকে ইয়াহিয়ার টিক্কা তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বুঝাতে চেয়েছে যে “বাংলাদেশের সব ঠিক হ্যায়”।
তারা এখন জানতে পেরেছে বাংলাদেশের মুক্তি ফৌজের হাতে কমসে কম দশ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে এবং আরো বিশ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে। গত দেড়মাসে অনেক মা সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত তাদের সন্তানদের কাছ থেকে চিঠি পাননি, টাকা পাননি, অনেক স্ত্রী স্বামীর পত্র পাননি, অনেক ভাই ভাইয়ের খোঁজ পাননি। এসব কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের বিশেষ করে পাঞ্জাবের ঘরে ঘরে শুরু হয়ে গেছে কান্নার রোল। তাদের বোঝা হয়ে গেছে আসল ব্যাপার। জঙ্গী চক্র শত চেষ্টা করেও আজ তা চাপা দিতে পারছেনা। কেননা সত্য আপন গুলো প্রকাশ হয়ে পড়বেই।
এ প্রসঙ্গে তাদের মনে পড়ছে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের কথা। সেসময় আইয়ুব সরকারের গোয়েবলস করিৎকর্মা আলতাফ সাহেব বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শুধু এগিয়ে চলেছে, অনেক ক্ষেত্রে তারা ভারতের ভেতরে ঢুকে গিয়েছে। সারা কাশ্মীর পাকিস্তানের দখলে এসে গেছে। কিন্তু হায়! ১৯৬৬ সালের চৌঠা জানুয়ারি আইয়ুব খান যখন নাকে খত দিয়ে তাসখন্দ চুক্তি সই করলেন তখন দেখা গেল কাশ্মীর পূর্বে যেখানে ছিল সেখানেই আছে। বরং ভারতীয় সেনাবাহিনীর দখল করে আছে খোদ পাঞ্জাবেরই কয়েক শত বর্গমাইল এলাকা। মাঝখানে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আট সহস্রাধিক সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে ভারতীয় বাহিনীর কাছে। তাছাড়া যুদ্ধে নিহত হয়েছে আরো প্রায় ১০ হাজার বীর পাকিস্তানি সৈন্য। শুরু হয়ে গেল পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরে কান্নার রোল। পত্র-পত্রিকা ও জন নেতারা প্রশ্ন তুললেনঃ আইয়ুব খান যদি এই অসম্মানজনক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবেন, কাশ্মীর যদি ভারতেই থেকে যাবে তবে কি প্রয়োজন ছিল এত লোকক্ষয়ের? ভুট্টো সাহেব কয়েকদিন লাফালাফি করলেও ভুলে গেলেন তার হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করার কথা।
তাই তারা আজ ভাবছে বাঙালিরা যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তাতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সেখান থেকে হাত গুটাতেই হবে। তবে কেন এত লোকক্ষয়?
ওদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক গগনে দেখা দিয়েছে নানা রূপ অশুভ লক্ষণ। অতি চালাক ভুট্টো ভেবেছিলেন আওয়ামীলীগকে নির্মূল করার পর তাকে বসানো হবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীত্বের গদিতে। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার মুক্তি ঘটতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের রক্তগঙ্গা প্রবাহের তথা পাকিস্তানের অপমৃত্যুর জন্য কেউ কেউ যত দোষ নন্দ ঘোষ অর্থাৎ সমস্ত দায়িত্ব একতরফাভাবে ইয়াহিয়া খানের ঘাড়ে চাপিয়ে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করছে। যে আব্দুল হামিদ খান এ নর হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছিলেন তিনিও নাকি আজ ইয়াহিয়ার উপরে টেক্কা মারার চেষ্টা করছেন। তার বক্তব্য আইয়ুব এরপর ইয়াহিয়া যদি প্রেসিডেন্ট হতে পারেন তবে ইয়াহিয়ার পর তিনি সেই গলিতে বসতে পারেন না কেন? ওদিকে আবার কিছুসংখ্যক জেনারেল (পাকিস্তানের মোট জেনারেলের সংখ্যা ৬২) সাবেক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্টের গদিতে বসানোর চেষ্টা করছেন। প্রকাশ, ভূট্টোকে চিরতরে খতম করাই নাকি এদের উদ্দেশ্য। আইয়ুব খানকে পুনরায় গতিশীল করার চক্রান্ত ওয়াশিংটনের কিনা তা জানা যায়নি তবে তিনি এখন মার্কিন রাজধানীতে আছেন।
অন্যদিকে বর্তমান সঙ্কট মুহূর্তে পাকিস্তানকে সাহায্যকারী একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ সাহায্যের শর্ত হিসেবে তাদের পছন্দসই কোন জেনারেল এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করছে। পরস্পর বিরোধী দুটি রাষ্ট্রের স্বার্থের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কোন লংকা কান্ড ঘটে যায় কিনা তা দেখার জন্য অপেক্ষা করছেন। ভুট্টো সাহেব এ দু’দলের ফ্রি-স্টাইলে কোন পক্ষ নেবেন তাও দেখবার বিষয়। তবে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যে তার দলে মারামারি শুরু হয়ে গেছে। পাঞ্জাবি চক্রের সমর্থক মাহমুদ আলী কাসুরীসহ বেশ কিছু সংখ্যক পিপিপি নেতা ভূট্টোর রাজনৈতিক বেঈমানীর প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই দল ত্যাগ করেছেন।
এসব কারণে সিন্ধু সীমান্ত প্রদেশের এমনকি প্রতিক্রিয়াও চক্রান্তের দুর্গ পাঞ্জাবেও সৃষ্টি হয়েছে তীব্র গণঅসন্তোষ। আর তা দমন করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে এগিয়ে আসতে হয়েছে সামরিক আইনের অস্ত্র নিয়ে। ইতিমধ্যেই সিন্ধুর বিখ্যাত নেতা জনাব জিএম সৈয়দ এবং পাঞ্জাবের মালিক গোলাম জিলানী সহ কয়েক শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। চারটি দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক ও মুদ্রাকরকে সম্মুখীন করা হয়েছে সামরিক আইনের বিচারে।
ভ্রম সংশোধন
জয় বাংলার প্রথম সংখ্যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র শীর্ষক সংবাদের মুদ্রণ প্রমাদ শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ২৩ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বলে ছাপা হয়েছে। আসলে তিনি ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। অতএব আলোচ্য স্থানে ২৩ শে মার্চ এর বদলে ছাব্বিশে মার্চ পড়তে হবে।
রণাঙ্গনেঃ খোদ ঢাকায় মুক্তি বাহিনীর হামলাঃ এক সপ্তাহে আরও ছয় শত শত্রুসৈন্য খতম
গত এক সপ্তাহের সংগ্রামের মুক্তিবাহিনীর হাতে আরও ছয় শতাধিক শত্রুসৈন্য প্রাণ হারায়।
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় গভর্নর হাউস, দৈনিক পাকিস্তান সেক্রেটারিয়েট ভবন ও নিউমার্কেটের মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংকে হাতবোমা দিয়ে আক্রমণ চালায়।
কুমিল্লা চট্টগ্রামের সংযোগকারী শুভাপুর সেতু দখলের জন্য মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে গত ১৪ই ও ১৫ই মে-র লড়াইয়ে প্রায় দু’শো খানসেনা খতম হয়েছে।
রাজশাহী শহরের কালীহাটায় পুলিশ লাইনে গেরিলারা দখলকার সৈন্যদের উপর হামলা চালায়।
১৬ই মে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বাংলাদেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে বিভিন্ন সৈন্য ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ৬টি স্থল ও জলযান দখল করে নিয়েছে। এছাড়া একটা ট্রাক ধ্বংস করে প্রায় ৮০ জন খান সেনাকে খতম করা হয়।
কুমিল্লা জেলার কসবা মুক্তিফৌজ তিনটি পাকিস্তানী সামরিক ট্রাক দখল করে নেয়। এই হামলায় একজন ক্যাপ্টেনসহ ২৮ জন সৈন্যকে খতম করা হয়।
উত্তর-পশ্চিমে রংপুর অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী রামনগর এলাকায় একটি পাকবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে একজন মেজর সহ কয়েকজন পাকফৌজ হতাহত করে।
মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম ও ঢাকার মধ্যে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তাছাড়া সড়কের সেতুগুলোর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে।
গত ১৭ই মে দিনাজপুর জেলার হাতিডাঙায় মুক্তিবাহিনীর চোরাগোপ্তা আক্রমণে ক্যাপ্টেনের পদতুল্য একজন অফিসারসহ ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।
মুক্তিবাহিনী পূর্বাঞ্চল সেক্টরের আখাউড়ায় এক আকস্মিক হামলা চালিয়ে গত ১৯শে মে ও ২০ শে মে ৪০জন শত্রুসেনা কে খতম করেছে।
এছাড়াও ইরিন কুষ্টিয়া মেহেরপুর মহকুমার ব্রাহ্মণপাড়া ও জীবননগরে মুক্তিবাহিনী ও পাক সেনার মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনী দুটি সড়কের কালভার্ট উড়িয়ে দেয়। গত ১৯শে মে কুষ্টিয়া জেলার কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত ফাড়িটি দখল করে।
গত ১৮ই মে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোর চুয়াডাঙ্গার দক্ষিণের রেলপথ উড়িয়ে দেয়। গেরিলারা যশোরের একটি রেল সেতু এবং খুলনা রেলস্টেশন এর ক্ষতি সাধন করেছে।
ময়মনসিংহ সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর ট তিলা খালিতে এক প্লাটুন সৈন্যের উপর হামলা চালায় এবং উক্ত এলাকার একটি সেতু ধ্বংস করে।
সিলেট জেলার শমশেরনগরে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালিয়ে পাক ফৌজের কাজ থেকে বহু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছে।
সাতক্ষীরা মহাকুমার ভোমরায় মুক্তি বাহিনীর হামলায় পাকফৌজ দিশেহারা ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ওইখানে বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য নিহত হয়েছে।
গত ১৯শে মেয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাক সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের সংঘর্ষে কমপক্ষে ৬১ জন শত্রুসেনা নিহত হয়।
এছাড়া মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা আকস্মিক হামলা চালিয়ে রংপুর, সৈয়দপুর এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সেতু উড়িয়ে দেয়। বগুড়া জেলার জয়পুরহাটের কাছে মুক্তিবাহিনী ৩৪ জন পাকসেনা কে খতম করে। এছাড়া তারা অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই তিনটি ট্রাক দখল করে।
গেরিলারা ময়মনসিংহ জেলার কলা শক্তি ও রহমতপুরে এবং রংপুর জেলার সাতগোলাঘাট ও কুড়িগ্রামে পাকফৌজের উপর অব্যাহতভাবে আক্রমণ চালায়।

বিশ্ব জনমতঃ নিজেদের সৃষ্ট সমস্যা এখন নিজেদের গলার ফাঁস হয়ে দাঁড়িয়েছে
আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির ভাই সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের পাক সামরিক বর্বরতার বিশদ বিবরণ মার্কিন সিনেটের এশীয় কমিটিতে পেশ করেছেন। তিনি তাতে বলেছেনঃ ছাড়া বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের দিকে। আগামী এক মাসের মধ্যেই এই ভূখণ্ডে দেখা দেবে ভয়াবহ খাদ্যাভাব। যদি এখনই বিদেশ থেকে এসে দেশে খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ না করা যায়, তবে সে অঞ্চলের ঘটবে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু।
তিনি বলেন নিরপেক্ষতার নামে আমেরিকার শাসকরা বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে চাচ্ছেন না। আমাদের সরকার বলছেন পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে জড়ানো তাদের লক্ষ্য নয়। কিন্তু জড়িয়ে তো আমরা পড়েছিই। কেননা, পাকিস্তানকে আমরা যেসব অস্ত্র শস্ত্র সাহায্য করেছি তাই আজ পাকিস্তানের সামরিক সরকার ব্যবহার করছে নিরস্ত্র বাঙালির নর-নারীকে হত্যা করার জন্য।
কেনেডি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা একটা বিরাট অংশ আজ ইসলামাবাদ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করেছে। এই আনুগত্য বোধহয় তারা আর কোনদিনও ফেরত পাবে না।
কেনেরে আরও বলেছেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী কেবলমাত্র শহর অঞ্চল গুলো জোর করে দখল করে আছে। কিন্তু গ্রাম অঞ্চলে বর্তমানে তাদের কোন প্রশাসন ব্যবস্থাই নেই।
কেনেডির একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মী জানিয়েছেন যে পাক দূতাবাসের রাজনৈতিক কাউন্সিলর প্রস্তারিত সিনেট বক্তৃতা থেকে কেনেডিকে বিরত থাকার অনুরোধ করার জন্য তার সাথে দেখা করতে যান। কেনেডি তাকে ৪০ মিনিট বাইরে বসিয়ে রাখেন এবং তারপর বের হয়ে যেতে নির্দেশ দেন।
বাঙালির প্রতিরোধ দৃঢ় হচ্ছে
আমেরিকা নামকরা সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজ উইকের এক সংবাদদাতা জে, কিউবিক বাংলাদেশ ঘুরে তার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কথা লিখেছেন নিউজ উইক পত্রিকায়। কিউবিক এর মধ্যে যুদ্ধের প্রথম পর্ব মোটামুটি শেষ হয়েছে। এখন আরম্ভ হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব।এই পর্ব হলো গেরিলা যুদ্ধের পর্ব। তিনি গাইবান্ধার একটি গ্রামে যান সেখানে একটি হাই স্কুলের ছাত্রের সাথে তার কথা হয়। ছাত্রটি তাকে বলে আমি আমার দেশ ছেড়ে যেতে চাই না। আমি রিফিউজি হতে চাই না। আমি চাই সৈনিক হতে। আমি চাই লড়াই করতে। মাঠিল বলে একটি গ্রামে একটি বয়স্ক লোকের সাথে কথা হয় লোকটির একটি ছেলের বয়স ২৩ বছর। অন্যটির বয়স ১৭ বছর। দুই ছেলেকেই তিনি যোগ দিতে দিয়েছেন মুক্তিফৌজে। তিনি বলেন আমি আমার পুত্রদের জন্য গর্বিত। খালি হাতে খান সেনাদের হাতে মরবার চাইতে লড়াই করে মরা অনেক গৌরবের। নিউজ উইকের সাংবাদিকের মতে, বাঙালির দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ ক্রমশ প্রবল আকার ধারণ করছে।
চট্টগ্রাম নিষ্ক্রিয় বন্দরঃ
পাকিস্তানের বেআইনি জঙ্গিশাহীর চোখে ধুলা দেওয়ার জন্য ছয় জন বিদেশি সাংবাদিক কে নিয়ে যান যে কয়টি শহর এখন তাদের হাতে আছে সেগুলো দেখাবার জন্য। আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদদাতা ছিলেন এই ছয় জন সাংবাদিকের অন্যতম। তিনি তার কাগজে লিখেছেনঃ চট্টগ্রাম বন্দর পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়েছে। কোন শ্রমিক বন্দরে কাজ করতে আসেনা। পাকবাহিনীর ভয় দেখান স্বত্তেও কুড়ি পঁচিশ জন লোকের বেশী কাজ করতে আসেনি। চাটগাঁ থেকে ঢাকায় কোন ট্রেন যাচ্ছে না।
পাকিস্তানের ভিত্তি বরাবরই ছিল নড়বড়ে –
পাকিস্তান সম্পর্কে বলতে গিয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক মিরডাল তার বিখ্যাত গ্রন্থ “এশিয়ান ড্রামা”- তে বলেছেনঃ পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে কোন ঐক্য নেই। সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে আলাদা। এদেশের অনৈক্যের আরো বড় কথা হলো দুই অঞ্চলের মধ্যে ভৌগোলিক ব্যবধান। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে ঐক্যের প্রধান ভিত্তি হলো দুটি ধর্ম ও ভারত বিদ্বেষ। কিন্তু ধর্ম ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষ একটি রাষ্ট্রের জন্য খুবই দুর্বল ভিত্তি, কেবল ধর্ম ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি বিদ্বেষ কে কেন্দ্র করে একটি আধুনিক রাষ্ট্র বাঁচতে পারেনা।
পাকিস্তানের আজ যা ঘটছে, তা মোটামুটি আশ্চর্যজনক কিছু নয়। পাকিস্তানের ভিত্তি ছিল খুবই দুর্বল। এই রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রয়োজন ছিল এই রাষ্ট্রের অন্তর্গত এসব অঞ্চলের মানুষের ন্যায্য দাবির প্রতি সম্মান প্রদর্শন। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আজকের সংকট। মৃত্যু হয়েছে পাকিস্তানের।
শুধু ধর্মকে ভিত্তি করে যদি রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারত তবে সব মুসলমান হতে পারতো একটি রাষ্ট্রের নাগরিক। সব খ্রিস্টান, সব বৌদ্ধ মিলে গড়তে পারত একটি করে রাষ্ট্র কিন্তু তা হয়নি। মানুষ যারা আলাদা ভাষায় কথা বলে যাদের উদ্ভব হয়েছে আলাদাভাবে তারা চায় আলাদা রাষ্ট্র। ইউরোপ তাই আজ অনেক রাষ্ট্রে বিভক্ত। অন্যদিকে ভূগোলের ব্যবধান বিরাট ব্যবধান। বিলাত আর আমেরিকার মধ্যে যদি আটলান্টিক মহাসাগরের ব্যবধান না থাকত তবে আমেরিকাতে যেসব ইংরেজ বসতি স্থাপন করেছিল তারা বিলাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়ে যেত না। আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভব হতো না। ভাষা ও রক্তের দিক থেকে এক হওয়া সত্বেও তারা বিলাত থেকে আলাদা হয়ে যাবার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিল। আমেরিকায় বসবাসকারী ইংরেজদের অভিযোগ ছিল বিলাতের লোক তাদের উপর অর্থনৈতিক শোষণ চালাচ্ছে। অনেক দূরে অবস্থিত বিলাতের ফার্মা পার্লামেন্টের যেসব আইন পাস হতো তাতে তাদের স্বার্থের কথা ভাবা হতো না। তাই তাদের জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় স্বাধীনতার। আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা হয় সব মানুষ সমান আর স্বাধীনতার উপর আছে মানুষের জন্মগত অধিকার।
বাঙালিরা ও আজ লড়াই করছে তাদের স্বাধীনতার জন্য। তাদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের পার্থক্য কেবল ভৌগলিক নয়। দোহাজারী কেবল ভৌগলিক দূরত্বের হতো তাহলে আজকেও স্বাধীনতা যুদ্ধ হত। কিন্তু বাঙ্গালীদের সাথে পাকিস্তানের অন্যদের পার্থক্য হলো আর বিরাট ও ব্যাপক। বাঙ্গালীদের জীবন ভাত মাছের জীবন। বাঙালীদের ইতিহাস ভাষা, মানসিকতা, জীবনযাত্রা, প্রণালী ও অর্থনৈতিক কাঠামো সবই ছিল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা। বাংলাদেশের মাটি নদীবাহিত পলি মাটি দিয়ে গড়া। এ মাটির সাথে মেলেনা পশ্চিম পাকিস্তানের রুক্ষ, মরুময়, নিরস মাটি। এত পার্থক্য যেখানে, সেখানে এক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকে দেওয়া উচিত ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। মেনে নিতে হতো তার সব দাবি-দাওয়া। আওয়ামীলীগ তাই চাচ্ছিল। কিন্তু ইয়াহিয়া, তা দেয়নি।
ভুট্টোর মুখেই শুনুন…!
‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। পাকিস্তানের সাবেক ডিরেক্টর ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খানের পক্ষপুটে লালিত-পালিত ছোকরা রাজনীতিক জুলফিকার আলী ভুট্টো নিজেকে অতি চালাক বলে মনে করতেন। পাকিস্তানের বিগত সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা দৃষ্টে তিনি বেঁচায়েন হয়ে পড়েছিলেন। তিনি দেখতে পেয়েছিলেন উজিরে আজম এর গদী তো দূরের কথা ফরিং মিনিস্টার বনারও তার কোন সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি চীনা বাসনের দোকান এর মত ব্যবহার করতে শুরু করলেন। জমহুরিয়াত ও ইসলামী মুসাওয়াতের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের দুটি প্রদেশের নির্বাচনে জয়লাভ করা সত্ত্বেও তিনি যোগ দিলেন চোর-ডাকাত, কায়েমী স্বার্থবাদী, কুচক্রী ও একনায়কত্বের ফর্মাবর্দার ইয়াহিয়া হামিদ টীক্কার জোটে, লন্ডভন্ড করে দিলেন বহু লোকের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পাকিস্তান। তার উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করতে পারলে ভেড়ার দলের পরামানিক সেজে যাবেন অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে দুই চারটি কুইসলিং সংগ্রহ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তিনি হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। যদি আর পাকিস্তানের পঞ্চত্ত ঘটে, তাতে ব্রিটিশের পদলেহন করে ন্যায্য উপাধি অর্জনকারী সিন্ধুর প্রজাপীড়ক, অত্যাচারী ভূস্বামী শাহনেওয়াজের পুত্র জনাব জুলফিকার আলীর কিই বা আসে যায়!
স্বার্থান্ধদের নাকি দৃষ্টিশক্তি একেবারে লোক পেয়ে যায়। তাই বোধহয় জনাব ভুট্টো সারা পাকিস্তানের না হলেও অন্তত পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনভার তার হাতে তুলে দেয়ার দাবি জানিয়েছেন। জনাব ভুট্টো হয়তো জানতেন না যে, যাদের হাতে তিনি আজ খেলছেন এর আগে তারা ভূট্টোর মত আরো বহু লোককে খেলিয়েছেন। নিজেদের প্রয়োজন ফুরালেই খেলার সাথীকে তারা ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছেন। জনাব ভুট্টো স্বচক্ষে এইসব দেখলেও আজ হয়তো এই সব মনে নেই। যে ইস্কান্দার মির্জা কোন এক অখ্যাত আদালতের বার থেকে ব্রিটিশ আইনজীবী ভুট্টোকে তুলে এনে করাচির রাজসভায় স্থান দিয়েছিলেন ইস্কান্দার মির্জার ঘাড়ে বন্দুক রেখে আইয়ুব খান পাকিস্তানের সিংহাসন কিভাবে দখল করেছেন, আবার কিভাবেই বা লাথি মেরে দেশত্যাগী করেছিলেন তা সবই ভুট্টো সাহেবের জানা, তবে বাঙালি বিদেশে বা মন্ত্রীত্বের গদীর মোহে এর সবই তার স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়ে গেছে।
জনাব ভুট্টো জানা উচিত ছিল যে কায়েমী স্বার্থের যে ভূতেরা তার ঘাড়ে চেপেছে আর যাই করুক তারা ভূট্টোর হাতে ক্ষমতা দিতে পারেনা। কেননা পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদীরা একইসাথে বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান দুটোই হারাতে পারে না।
লুণ্ঠিত দ্রব্যের ভাগ বন্টন নিয়ে গোলমাল দেখা দিলে ডাকাতদের মধ্যে মারামারি লেগে যায় এবং পরবর্তী কালে কোন কোন ক্ষেত্রে ডাকাতদের কেউ রাজসাক্ষী সেজে যায়। জনাব ভুট্টোর ক্ষেত্রে আজ তাই ঘটতে চলেছে। ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নাগালের বাইরে ভেবেই হয়তো তিনি আজ সঙ্গী ডাকাতের গোমর ফাক করতে মনস্থ করেছেন।
প্রকাশ গত ২১ শে মে করাচিতে এক বিবৃতিতে জনাব ভুট্টো যে সমস্ত বাঙালি বাংলাদেশের বর্তমান সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেননি তাদের প্রতি সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের প্রস্তাব করেছেন। জনাব ভুট্টোর এ কথা থেকে একটা জিনিস একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশে কাকেও ক্ষমা করছে না। যারা সংগ্রামে অংশ নিয়েছে তাদের কেউ মারছে, যারা অংশ নেয়নি তাদের কেউ মারছে। অর্থাৎ সাধারণভাবে প্রতিটি মানুষ আজ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের চোখে দুশমন। আর পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে একমাত্র বাঙালি হওয়ার অপরাধেই পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা নির্বিচারে হত্যা করছে তাদেরকে।
আর কতদিন ?
ইসলামাবাদ যুদ্ধের জন্য প্রতিদিন দুই কোটি টাকা ব্যয় করছে। হিসাবটি করেছেন বিলাতের বিখ্যাত ইনস্টিটিউট অফ স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ। দৈনিক প্রত্যেক সৈনিকের মাথাপিছু ব্যয় হচ্ছে ৭৫ টাকা। বাংলাদেশে ৮০০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য আছে। এই হিসাবে খরচ হচ্ছে প্রতিদিন ১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে বিমানে করে সৈন্য আন্তর্জাতিক সৈন্য পিছনে খরচা হচ্ছে ৯০০ টাকা। ব্যাংকক দিয়ে যেসব বিমান এসেছে তাতে যে সব সময় এসেছে তাতে সৈন্য পিছু খরচা পরেছে ১২০০ টাকা। এমনই বিভিন্ন ব্যাপারের খরচার উপর নির্ভর করে এই হিসাবটি করা হয়েছে। এই হিসেবে বাংলাদেশে ব্যবসা করে পশ্চিম পাকিস্তান প্রতিদিন যে লাভ করত তার হিসাব ধরা হয়নি। এইসবের বাংলাদেশ থেকে বিদেশে কাঁচামাল রপ্তানির জন্য যে আয় হতো তার হিসাবও ধরা হয়নি। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানির ফলে, পাকিস্তান সরকারের বছরে আয় হতো ২০০ কোটি টাকা। প্রতিদিন প্রায় ৫৫ লাখ টাকা।
যুদ্ধের ইতিমধ্যে প্রায় ১৫ হাজার খান সেনা নিহত হয়েছে। প্রত্যেকটি সৈন্যকে শিক্ষা দিতে ও মৃত সৈনিকদের পরিবারকে ভাতা দিতে কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা।
পাকিস্তানের সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কমে ১৫ কোটি টাকার এসে পৌঁছেছে।
এই অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব থেকে বলা যায় সুদীর্ঘ দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া খানসেনাদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
তাছাড়া আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে পাকিস্তানি মুদ্রা মূল্য অর্ধেক হ্রাসের প্রস্তাব থেকে ইয়াহিয়া খান সরকারের কাহিল অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় ইতিমধ্যেই ফুটে উঠেছে।
পুলিশের কর্তব্য সম্পর্কে আইজিপি
বাংলাদেশ পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেল এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলার বর্তমান মুক্তিযুদ্ধে সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য পুলিশের লোকদের প্রতি এক আবেদন জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে পুলিশপ্রধান রাজারবাগ, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, কুমিল্লা অন্যান্য জেলায় ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনী যেভাবে মেশিনগান চালিয়ে বর্বরের নেয় পুলিশের লোকদের হত্যা করেছে তার উল্লেখ করেন,
তিনি বলেন হালকা অস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী মেশিনগান, পুলিশ ও বোমার মুখে যে বীরত্ব দেখিয়েছেন তার কোন তুলনা হয় না। তাদের এ ত্যাগ ও অবদান বাংলার স্বাধীনতার ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
বর্বর পাক ফৌজের অমানুষিক অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য যেসব পুলিশ কর্মচারী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়েছে তাদেরকে অবিলম্বে মুক্তি ফৌজ যোগদানের জন্য অনুরোধ জানান। আর যে সমস্ত পুলিশ কর্মচারী সীমান্তের ওপারে চলে গেছেন ৯নং সার্কাস এভিনিউ, কলকাতা, (বাংলাদেশ মিশন)- এর যোগাযোগ স্থাপনের পরামর্শ দিয়েছেন।
মীরজাফরদের খতম কর
এক শ্রেণীর মীরজাফর বাংলাদেশ ও বাঙালির স্বার্থের বিরোধিতা করছে। তারা ইয়াহিয়া খানের লেলিয়ে দেওয়া পাঞ্জাবি কুকুরগুলোকে মুক্তিফৌজের অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম ঠিকানা বলে দিচ্ছি অথবা ক্ষেত্রবিশেষে পশ্চিমাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করছে। তারা নানা রকম মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে শত্র কবলিত এলাকার মানুষের মনোবল ভেঙে দেয়ার চেষ্টা করছে। গুন্ডা, দুষ্কৃতিকারী, লেলিয়ে দিয়ে লুটতরাজ করাচ্ছে অথবা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির প্রয়াস পাচ্ছে। এদের কোনো কোনো নেতা বেতার বক্তৃতা, সংবাদপত্র, বিবৃতি ও তথাকথিত জনসভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধাচরণ করছে।
এরা যদি এই মুহূর্ত থেকে নিজেদের অপকর্ম বন্ধ না করে তাহলে মুক্তিফৌজ তাদেরকে কুকুরের মত হত্যা করবে। বাংলাদেশ মুক্তিফৌজ কর্মীদের প্রতি আমাদের নির্দেশ এদের খতম করো।
শরণার্থীদের উদ্দেশে –
বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত কিশোর যুবক এবং মধ্যবয়সী লোক সপরিবারে বা একাকী সীমান্তের ওপারে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের প্রতি আমাদের অনুরোধ, আপনারা অবিলম্বে বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে গঠিত বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাথে যোগাযোগ করুন এবং সামরিক ট্রেনিংয়ের জন্য নাম তালিকাভুক্ত করুন।
বাংলাদেশ থেকে যারা সীমান্তের ওপারে আশ্রয় শিবিরে আছেন তাদের সবসময় স্মরণ রাখতে হবে যে এটা অস্থায়ী ব্যবস্থা মাত্র। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য তারা ভারতে যাননি। তাদের চেষ্টা হবে সামরিক ট্রেনিং গ্রহণ করে মুক্তিফৌজের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া, এবং নিজেদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়া। ভারতে যারা শরণার্থীদের সাহায্য করছেন তাদের উপর বোঝা হবে বসবার চেষ্টা করলে তা নানা কারনে আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে।
লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কারা- আমরা না তোমরা? – তাজউদ্দীন
এমতাবস্থায় পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এই জন্যই সবাইকে আরো বেশি বিস্মিত করেছে যে শেখ মুজিবের ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতোই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন।
পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতিপ্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত করা। এই কাজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকে। জনাব ভুট্টো লেফটেন্যান্ট জেনারেল ওমরের প্রবল চাপ সত্ত্বেও পিপিপি ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই তিন মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিমানে পূর্ব-পাকিস্তানে গমনের টিকেট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অনেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে পিপিপির বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে যখন কোন কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না তখন গত পয়লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য শুধু তাই না জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। এ লোকটা ইয়াহিয়া প্রশাসনের মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙ্গালীদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি যান্তার হাতে তুলে দেওয়া হল।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোনক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণরায় বানচাল করা ছাড়া আর কিছুই ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদে ছিল একমাত্র সংস্থা যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারতো এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বানচাল করার জন্যই চেষ্টা চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকারের ক্ষমতার উৎস না করে একটা ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত করার।
একটা যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
রাস্তায় কোনো বাতি নেই। চারিদিকে অন্ধকার। কামরার ভেতরেও আমরা বাতি নিভিয়ে চুপচাপ বসে আছি। বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটাচ্ছে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া নেই। খিদের জ্বালায় মাথা ঘুরছে। রাস্তা দিয়ে অনবরত চলাচল করছে মিলিটারি ট্রাক। শুয়ে শুয়ে ভালো লাগছিল না। ঘুম আসার কোন লক্ষনই নেই। একদিকে খিদের জালায় পেট চোঁ চোঁ করছে অন্যদিকে মেশিনগান, মর্টার, রাইফেল আর বিস্ফোরণের আওয়াজে তখন আমাদের স্নায়ু শিথিল হয়ে এসেছে।
রাত দুটোর দিকে কেউ একজন এসে বলল বাবুপুরা বস্তিতে আগুন দিয়েছে মিলিটারিরা। ছাদের উপরে গিয়ে দেখলাম আগুনের লেলিহান শিখা দিগন্ত আলোকিত করে তুলেছে। কানে ভেসে আসলো অসহায় নর নারী ও শিশুর আর্তনাদ। আর তার সাথে কানে আসলো গোলাগুলির আওয়াজ। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে তখনও যুদ্ধ চলছে প্রবলভাবে, বাঙালি পুলিশ অল্প সংখ্যক রাইফেল দিয়ে বীরত্বের সাথে লড়ছে আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত বর্বর সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
আগুন দেয়া হয়েছে শহরের আরো বিভিন্ন জায়গায়। দিগন্তের পানে তাকালে মনে হয় শহরে সব জায়গায় আগুন জ্বলছে। এইভাবে চললে সারারাত মনে হচ্ছিল এই রাতের বুঝি শেষ হবেনা কোনদিন। সবকিছুরই শেষ আছে তাই এ দুঃস্বপ্নের রাত হল অবসান ঘটল অবশেষে।
শুক্রবার। এ দিনটি আমার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পেছনদিকে একটা কামরায় গিয়ে আস্তে আস্তে পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। আমাদের ঠিক পশ্চিম দিকে রাস্তার বিপরীত দিকে মর্নিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান অফিস। অফিসের কার্নিশে কোথা থেকে এসে বসলো দুটো কাক। কাক দুটোর চেহারাও কেমন যেন ম্লান। সারারাত মর্টার আর মেশিনগানের আওয়াজে নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি তাদের। অন্যদিকে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম তিনটি মিলিটারি ট্রাক অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বীভৎস চেহারার কয়েকজন পাঞ্জাবি সৈন্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে টহল দিচ্ছে রাস্তায়।
এরকম বিকট চেহারার যে মানুষের হতে পারে তা আগে কখনো দেখিনি। বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনা বাহিনীর নির্মম আক্রমণের পরিণতি হিসেবে কি ঘটেছে তা জানার তখনো কোন উপায় ছিলনা। কোন সংবাদপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি, ঢাকা বেতার চলছেনা। টেলিফোন অচল। সুতরাং শহরে কোন অঞ্চলে কি ঘটেছে পরিচিত কেউ মারা গেছে কিনা তা জানার কোন উপায় রইল না।
রাস্তা একেবার জনমানব শূন্য, রোদ উঠেছে বেশ কড়া ভাবে বেলা আটটার দিকে মিলিটারি ট্রাকগুলো চলে গেল। জানালার কাছ থেকে সরে আসলাম। হঠাৎ একটা বালকের কন্ঠস্বর ভেসে আসলো আবার জানালার কাছে গিয়ে দেখি, ব্যারিকেডের পাশে ছেলে দুটো সামনের রাস্তার উপরে এসে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমরা ওদের সাহসের তারিফ করছিলাম।
মনে পড়লে বস্তির ছেলেদের সম্পর্কে ঢাকার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার মন্তব্য। পত্রিকাটিতে একটি ছবি ছাপানো হয়েছিল। ছবিতে ছিল একটা অর্ধ-উলঙ্গ বছর আটেকের ছেলে শ্লোগান দিচ্ছে। ছবি নিচে লেখা ছিল, “ওরা বকাটে , ওরা আর্চিন, সূর্য কর্নিকা ওরা।” সত্যিই তো সূর্য কর্নিকা ওরা। কতক্ষণ পর দেখলাম সেখানে বেশ কয়েকজন জুটে গেছে। ওদের সাথে বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোক ও দেখলাম রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ দেখলাম সবাই দৌড়াচ্ছে। বুঝলাম মিলিটারির গাড়ি আসছে নিশ্চয়ই। একটু পরেই কয়েকটি ট্রাক এসে দাঁড়াল। কিছুক্ষন দাঊড়িয়ে থেকে চলে গেল ওরা। সকাল এগারোটা বাজে তখন, মেশিনগান আর রাইফেল এর আওয়াজ তখনো থামেনি। আগুনের ধোঁয়া উঠছে জায়গা থেকে। বসে বসে অনেক ভাবলাম বঙ্গবন্ধুর সাথে বৈঠকে এমন কি মারাত্মক ফাটল ধরলো পৃথিবীর এমন এক নজিরবিহীন ধ্বংসলীলা ঘটে গেল।