You dont have javascript enabled! Please enable it!

বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমিকা  রাজনৈতিক দল

আমি নতুন পতাকা ওড়াবাে …

 

হত্যা, চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কালােমেঘ ছিন্ন করে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনল স্বাধীনতা। পাকিস্তান কারাগার থেকে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারি, ১৯৭২। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন।

১.১  ২১শে জানুয়ারি স্বদেশ ফিরতি পথে আসামের ফকিরগঞ্জে মওলানা ভাসানী এক জনসভায় বললেন : মিসেস গান্ধীর মতাে দয়ালু মহিলা হয় না। ভারতের জনগণের সহানুভূতির কথা ভুলব না। বললেন : স্বাধীন বাংলাদেশ ধর্ম-নিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

১.২  ২২শে জানুয়ারি, ১৯৭২। মওলানা ভাসানী ভারত থেকে ফিরে এলেন স্বদেশের বুকে। শুরু হয়ে গেল নবতর খেলা! ১৯৭১ সনের ২১শে এপিল মওলানা ভাসানী বহু কাকুতি মিনতি করে চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইয়ের নিকট মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য পত্র লেখেন। কিন্তু ইতিহাস বলে চীন নেতৃবৃন্দ সে পত্রের গুরুত্ব প্রদান করেননি। ১.৩ অথচ কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখা গেল মওলানা ভাসানী বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদলে বিভক্ত চৈনিক পন্থীদের মহান নেতা’ বনে গেলেন। যদিও এই সব নেতাগণ মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরােধিতা করেছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে পরাজিত চৈনিক প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই সখেদে বললেনঃ ঢাকার পতন ভারতের বিজয়ের পথে অগ্রগতির স্বাক্ষর নয় বরং এশীয় উপমহাদেশে এক অন্তহীন যুদ্ধের সূচনামাত্র। ১৯৭১ সনের ১৭ই ডিসেম্বর পিকিং-এ তিনি বললেন : ভারতীয়রাই পাকিস্তানের ঘাড়ে  তথাকথিত বাংলাদেশের ক্রীড়নক সরকারকে চাপিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি ১৯শে ডিসেম্বর পাকিস্তান থেকে ভুট্টো বললেন যে, এই অবস্থা চিরস্থায়ী নয়—পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিচ্ছেদ্য ও অবিভাজ্য অঙ্গ।

২.  এই ঘােষণার সাথেই সিরাজ শিকদারের পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টি ‘স্বাধীনতার নামে বাংলাদেশ ভারতের পদানত হয়েছে বলে উল্লেখ করে। এবং স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বান জানায়। মওলানা ভাসানী ফিরে আসার পর বিরােধী রাজনীতিতে নেমে পড়েন। হক-কথা নামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনা শুরু করেন, যার সম্পাদক কলাবরেটর।

২.১  ‘হক তােহা মতিন, আলাউদ্দিন, দেবেন শিকদার, শান্তি সেন, অমল সেন প্রমুখের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলের নেতাগণ চীন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী রাজনীতির পথ বেছে নেয়। মওলানা ভাসানী এদের নেতা সেজে ‘স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা কায়েমের সুরে সুর মিলিয়ে ঘােষণা করলেন, “আমি নতুন পতাকা। ওড়াবাে।

২.২ ” এই নতুন পতাকা ওড়ানাে’র নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল স্বাধীনতা বিরােধীদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক তৎপরতা। পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো মওলানা ভাসানীকে আরাে উসকে দেবার জন্য ১৯৭২ সনের ৮ই জুলাই মওলানা ভাসানীকে পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানান। শুধু তাই নয়, লন্ডন হয়ে বিশেষ দূত মারফত ভুট্টো মওলানা ভাসানীর নিকট পত্র প্রেরণ করেন- যেখানে ভুট্টো ‘মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানার সাহায্য কামনা করেন।৩

২.৩  স্বাধীনতা যুদ্ধের পরাজিত দেশদ্রোহী জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও পিডিপির নেপথ্য শক্তিকে আড়ালে রেখে মওলানা এই সব অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির স্বপক্ষে কাজ করার জন্য গঠন করলেনঃ হুকমতে রব্বানী—এর লক্ষ্য চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি ও ভারত বিরােধিতা। মৌলনা ভাসানী বিভিন্ন সভা সমিতিতে প্রকাশ্যে হাত তুলে এদের সমর্থন জানিয়ে দোয়া করলেন। বললেন, “মুসলিম বাংলার জন্য যারা কাজ করছে তাদের আমি দোয়া করছি। আল্লাহর রহমতে তারা জয়যুক্ত হবে।” বলাবাহুল্য মুসলিম বাংলার শ্লোগানটি ভুট্টো প্রদত্ত, যা ঐ সময়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচারিত হতাে। মওলানা ভাসানী দীর্ঘদিন ধরে প্রগতিশীল রাজনীতির কথা বলেছেন, নির্যাতন ভােগ করেছেন তিনি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে অতি উগ্র বাম ও ডানপন্থীদের হাতে এবং জাতীয়  আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে গেলেন। রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গৃহীত মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমুন্নত বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র বাতিল করার দাবী জানিয়ে মওলানা ভাসানী বললেন ঃ বাংলাদেশের সংবিধান অবশ্যই কোরআন ও হাদিসের ভিত্তিতে প্রণীত হবে।

২.৪  শুধু তাই নয়, তিনি পল্টনের জনসভায় হুংকার দিয়ে বললেনঃ বাংলাদেশকে আমি ভিয়েতনামে পরিণত করে ছাড়বে। স্বাধীনতা যুদ্ধে বর্ণনাতীত ক্ষতিগ্রস্ত বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে যেখানে প্রয়ােজন ছিল সহযােগিতা, সেখানে প্রকাশ্য জনসভায় মওলানা ভাসানী হুংকার দিতে থাকলেন ঃ আমি এ দেশে প্রতিবিপ্লব ঘটাবাে।

৩.  এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভিন্নতর, সর্বনাশা এক সংকট। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগের মধ্যে মতপার্থক্য প্রবল হয়ে উঠল, তরুণ মুক্তিযােদ্ধারা বিভক্ত হয়ে পড়েন। তদানীন্তন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট নূরে আলম সিদ্দিকীর সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র উত্তরণের হুংকার, অন্যদিকে আ, স, ম, রবের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লম্পঝম্পে ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৭২ সনের ২১শে জুলাই একই দিনে বঙ্গবন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকী আহুত ছাত্রলীগের সম্মেলনে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে উপস্থিত হন। অন্যদিকে পল্টন ময়দানে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সশস্ত্র সংগ্রামের দ্ব্যর্থহীন ঘােষণা দেয়া হলাে।

৩.১  আওয়ামী লীগের ছাত্রফ্রন্টে-ছাত্রলীগের এরূপ ভাঙন অচিরেই শ্রমিক, কৃষক, মুক্তিযােদ্ধা ফ্রন্টগুলােতেও ব্যাপক ভাঙনের সৃষ্টি করে। পরিণতিতে ১৯৭২ সনের ৩১শে অক্টোবর বিপ্লবে পরিপূর্ণতা প্রদান ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শ্লোগানে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের আহবায়ক কমিটি গঠিত হয়।

৩.২ বলাবাহুল্য জাসদ গঠিত হবার পর স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে জাসদকে ব্যবহার করে। স্বাধীনতা বৈরী পুঁজিপতি, শশাষক শ্রেণী এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিসমূহ স্ব-স্বার্থে জাসদকে অর্থ, সম্পদ, সাহায্য ও সহযােগিতা দিতে থাকে। মুজিব বাহিনী, মুক্তিযােদ্ধা ও তরুণ সমাজের একটি বিরাট অংশ জাসদের কাতারে এসে সামিল হয়। ঐ সময়ে দেশের অভ্যন্তরে বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে এবং আসন্ন খাদ্য সংকটের মুখে ১৯৭৪ সনের জুলাই মাসে জাসদ কর্ণেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করে। তাহেরের সঙ্গে  যথা থ সংযােগ রক্ষা করে চলতেন সর্বহারা পার্টির মেজর জিয়া ও সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।৬

৩.৩  গণতান্ত্রিক অধিকারসমূহের সুযােগ নিয়ে জাসদ প্রকাশ্যত অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালাতে থাকে। ১৯৭৪ সনের ২০শে জানুয়ারি এবং ৮ই ফেব্রুয়ারি জাদি সাধারণ ধর্মঘট আহবান করে এবং বােমা ও গুলি চালায়। ১৯৭১ সনের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও করতে অগ্রসর হয় ও পুলিশের প্রতি গুলি বর্ষণ করে। ফলে পুলিশের পাল্টা গুলিতে তিন জন নিহত হয়, ১৮ জন আহত হয়। জনতা জাসদ অফিস পুড়িয়ে দেয়। জাসদ হাইকমান্ড এমনি অবস্থায় সর্বত্র নির্দেশ পাঠায় সশস্ত্র প্রতিরােধের। সমগ্র দেশে শুরু হয়ে যায় খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, হাইজাকিং। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি

ঘটে।

৩.৪ ১৯৭৪ সনের স্মরণাতীত কালের প্রচণ্ড বন্যায় দেশে ব্যাপক ফসল হানি ঘটে। দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শােনা যায়। এই সুযােগে সকল আন্ডার গ্রাউন্ড সশস্ত্র দলগুলাে তাদের কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটায়। ১৯৭৪ সনের ১৬ই ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতিকর পরিস্থিতির উল্লেখ করে এক বেতার ভাষণে বলেন, “তিন হাজার আওয়ামী লীগ নেতা কর্মীদের হত্যা করা হয়েছেহত্যা করা হয়েছে চার জন জাতীয় সংসদ সদস্যকে।” ২৮শে ডিসেম্বর সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা জারী করা হয়।

৩.৫  এই সময়ে জাসদ সশস্ত্র গ্রুপ-সমূহের সমন্বয় সাধনের উদ্যোগ গ্রহণ। করে।

৩.৬  জরুরি অবস্থা ঘােষণার পর দেশে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে থাকে চাল ডাল নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দাম হ্রাস পেতে থাকে। সন্ত্রাসবাদী উগ্রপন্থী সশস্ত্র-গ্রুপ ও দল আত্মরক্ষার জন্য ডিপ আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যায়। সে জন্য পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৪ সনের ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ সনের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত গুপ্ত ঘাতকের হাতে প্রাণহানির সংখ্যা একশ’র বেশি নয়। অথচ জরুরি অবস্থা জারীর পূর্বের অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। বাকশাল গঠিত হওয়ার পর জাসদ জনগণের প্রতি সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির আহ্বান জানায়। তাদের প্রচারপত্রে বলা হয়, গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে এই সরকারকে অপসারণের আর কোনাে পথ খােলা না থাকায় সশস্ত্র বিপ্লবের পথেই শাসন ক্ষমতা দখল করতে হবে। জাসদ বিপ্লবী গণবাহিনীতে যােগদানের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানায়।

৩.৭ পরবর্তীকালে দেশবাসীর প্রতি মেজর জলিল ও আ, স, ম, রবের এক যৌথ বিবৃতিতে স্বীকার করা হয় যে, শেখ মুজিবের ফ্যাসীবাদী। কার্যকলাপ প্রতিরােধের জন্য খুবই গােপনে অথচ তৎপরতার সাথে গড়ে তােলা হয় সারা দেশব্যাপী মুক্তিযােদ্ধা, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক প্রাক্তন সৈনিকের সমন্বয়ে বিপ্লবী গণবাহিনী। অতি গােপনে সংগঠিত করা হয় বাংলাদেশে প্রতিটি সেনানিবাসের সৈনিক ভাইদেরকে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার মাধ্যমে।

৩.৮  শুধু তাই নয় সশস্ত্র লড়াই সংগঠিত করতে জাসদ নেতৃত্বে সি.আই. এর লােক বলে কথিত জনৈক পিটার কাস্টারের নিকট হতে ৪০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করে।

৪. ১৯৭৪ সনের খাদ্য সংকটকে সামনে রেখে ১৪ই এপ্রিল ন্যাপ ভাসানী, জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ, বাংলাদেশ গণমুক্তি ইউনিয়ন, বাংলাদেশ কমুনিস্ট পার্টি (লেলিনবাদী) শ্রমিক-কৃষক সাম্যবাদী দল। সম্মিলিতভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। তারা ৩০শে জুন জনসভা আহবান করে। ২৯শে জুন রাতে মওলানা ভাসানীকে টাঙ্গাইলে তার স্বগৃহে তার ইচ্ছে অনুসারে আটক রাখা হয়, জনসমর্থন না পেয়ে যুক্তফ্রন্ট অকেজো হয়ে পড়ে। মওলানা ভাসানী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযােগ উত্থাপনে সে অবস্থাতেও ক্ষান্ত হয়নি।

৫. অন্যদিকে পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি পূর্ববাংলার সাম্যবাদী দল (এম, এল) পূর্ববাংলার কমুনিস্ট পার্টি (এম, এল), পূর্ব পাকিস্তান কমুনিস্ট পার্টি প্রকাশ্য ও গােপন তৎপরতা চালায়। তারা আন্ডারগ্রাউন্ড নেটওয়ার্ক গড়ে তােলে, ক্যাডারদের সশস্ত্র করে, গেরিলা কায়দায় যােগাযােগ ব্যবস্থার উপর আঘাত হানে, বিপ্লবের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে স্বাধীনতার স্বপক্ষের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীকে খুন করে, শস্য লুট করে, ব্যাংক ডাকাতি করে এবং থানা লুটের মতাে কার্যক্রমে অংশ গ্রহণ করে আইন-শৃঙ্খলা ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তােলে। হাটবাজার, রেলওয়ে, গ্রামে সর্বত্র ডাকাতি শুরু করে। তারা-রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে। এই সব অতি উগ্রপন্থী দল ১৯৭৪ সনের জুননভেম্বর মাসে কমপক্ষে ১০০ বার পুলিশ ও রক্ষীবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।”৯

৫.১ স্বাধীনতার পরপরই এই অতি উগ্র চীনপন্থী দলগুলাে কখনাে স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ’ কখনাে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ কখনাে মুসলিম বাংলার শ্লোগান দিয়ে চীন-পাকিস্তান প্রদত্ত অস্ত্র নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের জন্য মরীয়া হয়ে ওঠে। তােয়াহা ও তার সহযােগী আবদুল হক চীনা নীতির সমর্থক হিসেবে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখা তাদের পবিত্র কর্তব্য  বলে ঘােষণা করে।১০

৫.২ নাশকতামূলক কার্যক্রম জনমনে আতংক সৃষ্টি করে। প্রতিদিনই গােপন হত্যা, কিডন্যাপিং, হাইজ্যাক, ডাকাতি খবরের কাগজে ফলাও করে প্রচারিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সরকার গঠনের পর হতে; অর্থাৎ ১৯৭২। সনের জানুয়ারি হতে ১৯৭৩ সনের জুন পর্যন্ত এক সরকারি হিসাবে দেখা গেছে ঐ সময়কালে ২০৩৫টি গােপন খুন, ৩৩৭টি কিডন্যাপিং, ১৯০টি ধর্ষণ, ৪৯০৭ ডাকাতি এবং ৪০২৫ ব্যক্তি ঐ সমস্ত উগ্রপন্থী দুষ্কৃতিকারীদের হাতে প্রাণ হারায়।

৫.৩ ১৯৭৪ সনে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পরিসংখ্যানে জানা যায়, জাসদের গণবাহিনী, চৈনিকপন্থী সশস্ত্র দল ও গ্রুপ এবং স্বাধীনতা বিরােধী উগ্রপন্থী চক্র মিলে ১৫০টি ছােট বড় হাট-বাজার, অর্ধশতাধিক ব্যাংক, প্রায় দুই ডজন থানা ও ফাড়ি লুট করে। গ্রামেগঞ্জে হাজার হাজার ডাকাতি ঐ সময়ে সংঘটিত হয়।১২

৫.৪ শুধু তাই নয়, তারা দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করার জন্য ব্যাপক নাশকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। দেশের জাতীয় সম্পদ পাটের গুদামে আগুন লাগিয়ে দেয়। ১৯৭৪ সনের ১১ই সেপ্টে ‘র সােভিয়েত রাশিয়া কর্তৃক নির্মিত ঘােড়াশাল সার কারখানার কন্ট্রোল রুমটি এ সব উগ্রপন্থীরা বড় রকমের বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেয়। তদন্ত কমিটির হিসেবে জানা যায়, সার কারখানার এই নাশকতামূলক কার্যক্রম অত্যন্ত দক্ষ ও অভিজ্ঞ হাতের কাজ। এই বিস্ফোরণে ক্ষতি হয় বৈদেশিক মুদ্রায় ১৫০ মিলিয়ন টাকা। দশ মাস পর্যন্ত এই কারখানা উৎপাদন অক্ষম হয়ে পড়ে। সারের বন্টন হ্রাস পেয়ে গেল বছরে ৩ লক্ষ ৮০ হাজার টন থেকে ১৯৭৪/৭৫ সনে মাত্র ২ লক্ষ ৮০ হাজার টন; এক লক্ষ টন কম। ফলে খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়।

৫.৫  বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সনের ৩০শে নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করলে ৩৬৪০০ পাকিস্তানী দালাল মুক্তি লাভ করে।১৪ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ১লা ডিসেম্বর এ তথ্য প্রকাশ করেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি লাহাের ইসলামী সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যােগদান করেন। প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী দালাল নেতাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মনােভাব কোনাে সময়ই কঠোর ছিল না। একটি উদাহরণ দিলেই দালালদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মানসিকতা কি ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে ওকালতি করার জন্য  শাহ আজিজুর রহমান পাক-প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘে গিয়েছিলেন। শাহ আজিজুর রহমানের পত্নী বঙ্গবন্ধুর সংগে দেখা করলে বঙ্গবন্ধু শাহ। আজিজের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত মাসিক ৫০০ টাকা করে বরাদ্দ করেন।১৫ অনুরূপভাবে খাজা খায়েরউদ্দিনকে বঙ্গবন্ধু জেল হতে বের করে নিজের কাছে নিয়ে এসে, তাকে খাওয়ায়ে টিকেট কিনে, পাকিস্তানে প্রেরণ করেন। অথচ এই খাজা খায়ের উদ্দিন ছিল শান্তি কমিটির প্রধান। সবুর খান সম্পর্কে এরূপ সদয় ব্যবহারের কথা বাজারে চালু আছে। অর্থাৎ পাকিস্তানী দালাল নেতাদের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কোমল মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন।

৫.৬  কিন্তু পাকিস্তানী দালালগণ বঙ্গবন্ধুর এ মহানুভবতাকে দুর্বলতা ভেবেছে। ফলে স্বভাবতই সাম্প্রদায়িক শক্তি এ দুর্বলতার আড়ালে নিজেদের সংগঠিত করেছে। সে জন্য লক্ষণীয় মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলামী প্রভৃতি বেআইনী ঘােষিত দলগুলাের এক শ্রেণীর নেতা ও কর্মী চাদ তারা মার্কা পতাকা নিয়ে জাতীয় গণতন্ত্রী দল গঠন করে। এদের এক সভায় ভারতের রাহুগ্রাস হতে বেরিয়ে এসে ইসলামী সম্মেলনে যােগদানের জন্য বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানানাে হয়। সারা দেশে মসজিদে মসজিদে ও ধর্মীয় সভা সমাবেশে তারা প্রচণ্ডভাবে ভারত বিরােধিতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালায়। এমনকি তাদের অবস্থান সম্পর্কে তারা আস্থাশীল হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত আলবদর ও দালালদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবী করে। কবি দাউদ হায়দারের একটি কবিতায় হযরত মােহাম্মদ (সঃ) সম্পর্কে অশালীন উক্তির অজুহাতে সারাদেশে এটিকে উপলক্ষ্য করে স্বাধীনতা বিরােধী চক্র চরম সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করে এবং নিজেদের অবস্থানকে পাকাপােক্ত ও শক্তিশালী করে নেয়।

৬. এমনি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগও উপদলীয় কোন্দলের এক সর্বনাশা খেলায় তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৭৩ সনের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে পর পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল চমরভাবে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, যা প্রকারান্তরে বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে বহুলাংশে ক্ষুন্ন করে।

৬.১  এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জেলায় জেলায় ক্ষমতাসীন চিহ্নিত আওয়ামী লীগ নেতাদের বিশেষ বিশেষ বাহিনী, লাল বাহিনী জনগণের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। তদের সন্ত্রাসে জনগণ প্রতিবাদহীন আক্রোশে হয়েছে নির্বাক নিপ।১৬ 

শুধু তাই নয়, কেন্দ্রে মনি-তােফায়েল উপদলীয় কোন্দলের বহিঃপ্রকাশ। ঘটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিভিন্নভাবে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ছিল ১৯৭৪ সনের এপ্রিলে সূর্যসেন হলের ৭ জন ছাত্রের নৃশংস হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু তখন অসুস্থ। মস্কোয় চিকিৎসাধীন। ১৯শে মার্চ থেকে ১১ই এপ্রিল। মাঝখানে তিন সপ্তাহ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মনসুর আলী বলতেন, এই পরিকল্পিত ছাত্র হত্যা ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ। যার লক্ষ্য বঙ্গবন্ধুর সরকারের উৎখাত।

৬.২  ক্ষমতার কোন্দল সবাইকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। গমিরুদ্দিন প্রধান পাকিস্তান পন্থী ও আইয়ুব-ইয়াহিয়ার বিশ্বস্ত এবং কলাবরেটর- তার পুত্র সফিউল আলম প্রধান ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট হল, দুনীতি উচ্ছেদের নামে মনি ও তােফায়েল গ্রুপের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। সূর্যসেন হলে ৭ জন ছাত্র হত্যাকাণ্ডের পেছনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথিত কোনাে ধরনের ষড়যন্ত্র ছিলএকদিন তা উদ্ঘাটিত হবে। এই হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমদের নির্দেশে সংঘটিত হয়েছিল বলে যুবলীগ প্রধান ফজলুল হক মনি বারবার অভিযােগ করেছেন। এ ভাবে এ সব দলীয় হত্যাকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে বহুলাংশে হ্রাস করেছিল সন্দেহ নেই। শুধু তাই নয়, কফিডেনসিয়াল ডায়রিতে বলা হয়েছে, ‘মনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাে। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলাে, আচ্ছা বলুনতাে বাংলাদেশে স্পাই-এর কাজ কে করে? আমি জানিনে। স্পাই-এর খোঁজ খবর রাখা আমার কাজ নয়। আমি বেশ। ছােট, কিন্তু স্পষ্ট জবাব দিলুম। কিছুদিন যাবত শুনছি কতকগুলাে বিদেশী দূতাবাসে সাংবাদিকরা খুব যাতায়াত করছে। এম্বাসী থেকে এদের জন্য বিলেতী মদ আসে, আরাে কত কী? এবার শুনুন আমি কাকে সন্দেহ করি। প্রথমত আপনার ঐ বন্ধু এনায়েতুল্লাহ, তােফায়েল আহমদ, তাহেরুদ্দিন ঠাকুর এরাই সবাই বিদেশী গুপ্তচর।”১৭ | বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে দুর্বল করার অর্থই হলাে শক্রদের হাতকে শক্তিশালী করা। তােফায়েলের প্রােটেশনে সফিউল আলম প্রধান কি সেই পথ বেছে নিয়েছিল। পরবর্তী রাজনীতিতে শফিউল আলম প্রধানের অবস্থান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুনসুর আলীর ধারণাকেই কি সমর্থন করে না? 

 

সূত্র : ফ্যাক্টস্- এন্ড ডকুমেন্টস্–বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!